নিজ বলয়ে প্রদক্ষিণরত নক্ষত্র



রোজেন হাসান
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভালো কবিতা অনেকেই লেখেন, যে কবিতাগুলো পড়ে পাঠকেরা আপ্লুত হন। এই কবিতাগুলো অনেকটাই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতার সাথে মিলে যায়। পাঠকেরাও পূর্বকবিদের কবিতা পড়ার কারণে এই ভালো কবিতাগুলোর ভাষা-ভঙ্গিমাকে চিনতে পারেন। তাই যখনই ওইসব গুরুত্বপূর্ণ কবিদের কবিতার মতো কবিতা কোনো কবি লেখেন, সেগুলো পাঠকদের পূর্বঅভিজ্ঞতার সাথে মিলে যায় এবং তারা বাহ্ বাহ্ বলে ওঠেন এবং সেগুলো ভালো কবিতা হিসেবে চিহ্নিত হয়। কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় যখন কোনো কবি কথিত ভালো কবিতা লেখেন না, এর বিপরীতে নিজস্ব কাব্যভাষায় নিজের কবিতা লেখেন। এই কবির নিজস্ব কাব্যভাষা আসে তার নিজস্ব কাব্যজগত থেকে। যে জগত তিনি পৃথিবীর চির ইতিহাসের মাঝে বিরাজমান চিন্তা, প্রাণ এবং বস্তুর সাথে নিজের অভিজ্ঞতাকে মিলিয়ে তৈরি করেন। ফলে তার কবিতা নতুন হয়ে ওঠে। আর তার কবিতার এই নতুনত্বের কারণেই অতীতের কবিতায় অভ্যস্ত এবং সাম্প্রতিক কালের ভালো কবিতার দৌরাত্ম্যের কবলে পড়ে পাঠকেরা এই কবিতাগুলোকে ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেন না।

পাঠকদের মতো সমালোচকেরাও সমস্যায় পড়ে যান কেননা তারা এইরকম কবিতা আগে পড়েননি। আর যা আগে পড়েননি সেরকম কবিতার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা তাদের পক্ষে দুরূহ হয়ে পড়ে। কিন্তু আশার কথা হলো একসময় এইরকম কবিরা গৃহীত হন পাঠক এবং সমালোচক মহলে। সময়ের সাথে সাথে এই কবিদের—যারা সংখ্যায় খুব নগন্য—কাব্যজগতটি ধীরে ধীরে ভাস্বর হয়ে ওঠাই এর মূল কারণ। যখনই তাদের জগতটি উন্মেচিত হতে শুরু করে, তাদের আসে গৃহীত হবার পালা, তখন পাঠক এবং সমালোচকরা উন্মাদপ্রায় হয়ে যান। এই কবির অনুসারীতে কবিতা লেখকদের ছোট পরিধিটি দ্রুত ভরে যেতে থাকে। এই কবি নতুন কবিদের আদর্শ হিসেবে বিবেচিত হন। অবশ্য তার অনুসারীরাও ভালো ভালো কবিতা লিখতে শুরু করেন। এই ধারা চলতে পারে এমনকি যুগ থেকে যুগ পর্যন্ত। বিনয় মজুমদারও সেই নতুন কবিতা সৃষ্টিকারী কবি, যাঁর রয়েছে একটি স্বতন্ত্র কবিতাবিশ্ব, রয়েছে একটি নিজস্ব কাব্যভাষা। ভালো কবিতালেখকদের ভিড়ে তিনি তাই এক নিজ বলয়ে প্রদক্ষিণরত নক্ষত্র। যার আলো বহু আলোকবর্ষ দূর থেকে আসে। তাই তাঁকে বুঝতে পাঠকদের এবং সমালোচকদের একটু সময় লেগেছে, সময়টা একটু বেশিই।

কী রয়েছে তাঁর কবিতাবিশ্বে? তাঁর কবিতা বিশ্বের স্তম্ভগুলো হলো গণিত, বিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান এবং দর্শন। এই সবকিছুকেই তিনি মিলিয়েছেন নিজের অভিজ্ঞতার সাথে, আর অভিজ্ঞতার হীরক স্পর্শে এইসব উপাদান বিনয় মজুমদারের নিজস্বতায় চিহ্নিত হয়ে ওঠার সাথে সাথে বাংলা কবিতাতেও খুলে দিয়েছে নতুন নতুন সব জানালা। তার কাব্যভাষাটিও তাই নতুন। তিনি কবিতায় আবেগকে পরিমিতভাবে ব্যবহার করেন। কবিতাসহ শিল্পের যে কোনো শাখায় অতি আবেগ এবং আবেগহীনতা এই দুটি জিনিসই ক্ষতিকর, বিনয় মজুমদারের কবিতায় আবেগ সবসময় এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থান করে; তিনি তাঁর কবিতার জন্য এমন একটি ভাষা নির্মাণ করেছিলেন যেটিতে অনায়াসে গভীর চিন্তাকে উপমা, চিত্রকল্পে ব্যক্ত করা যায়। তাঁর কবিতার ভাষায় গণিতের বস্তুনিষ্ঠতা, নিরপেক্ষতা এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে, পর্যবেক্ষণ এবং যুক্তিরও একইরকম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সেখানে। তবে একসময় তিনি ক্রমশই সহজ-সরলতার দিকে ঝুঁকে পড়েছিলেন। এই কবিতাগুলোতে চারপাশের মানুষ, উদ্ভিদ এবং বস্তু পারস্পরিক পারম্পর্য তৈরি করে ভিন্ন অর্থবোধকতা তৈরি করে। বিনয় মজুমদারের কবিতা থেকে কিছু পঙ্ক্তি পড়া যাক—

আমার আশ্চর্য ফুল, যেন চকোলেট, নিমিষেই
গলাধঃকরণ তাকে না-ক’রে ক্রমশ রস নিয়ে
তৃপ্ত হই, দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।
অনেক ভেবেছি আমি, অনেক ছোবল নিয়ে প্রাণে
জেনেছি বিদীর্ণ হওয়া কাকে বলে, কাকে বলে নীল—
আকাশের হৃদয়ের; কাকে বলে নির্বিকার পাখি।
[ফিরে এসো, চাকা]

পৃথিবীর আকর্ষণে ফুলগুলি নুয়ে পড়ে, ঝ’রে পড়ে যায়।
কিন্তু দ্যাখো, পাখিগুলি স্বেচ্ছাধীন নেমে পুনরায় উড়ে যেতে পারে।
চেষ্টাকৃত পদ্ধতিতে অসময়ে জন্ম দিতে গেলে
শিশু মরে যেতে পারে, এ সত্যটি চিকিৎসক জানে।
[গায়ত্রীকে]

অমিল পয়ার ছন্দে রচিত বসন্তকাল শেষ হয়ে এলো।
পথের উপরে আজ দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ দেখলাম চারিপাশে মাঠ
কালো কালো ধানগাছ ঢাকা আছে, এই সুমুদ্রিত ধানগাছগুলি
আমার এ জীবনের বসন্তের অভিজ্ঞতা।
[বসন্তকাল]

তিনি অনেকটা সুফি কবি মনসুর আল-হাল্লাজ এবং মাহমুদ শাবিস্তারির মতো মেকি আবরণ ছেড়ে কবিতার অন্তঃসারটিকেই মুখ্য ভূমিকা দিতে চান। মিউজগণ এবং দুয়েন্দের বিপরীতে তাঁর ছিল গণিত, বিজ্ঞান ও দর্শন। বাস্তবেও তিনি গণিতচর্চায় মুখর থাকতেন। গণিতে তাঁর কিছু আবিষ্কারও আছে।

দুই.

বিনয় মজুমদার তাঁর কবিতায় উৎসর্গকৃত জীবন, গায়ত্রী চক্রবর্তীর প্রতি প্রেম এবং তাঁর বারবার পাগল হয়ে যাওয়া নিয়ে মিথে পরিণত হয়েছেন আজ। তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় এক সুন্দরী নারীর প্রেমে পড়েন, সেই নারীটি হলেন গায়ত্রী চক্রবর্তী। ইংরেজি সাহিত্যের এই ছাত্রীর সাথে তাঁর কথা হয়েছিল মাত্র তিন-চারবার। পরে বিনয় মজুমদার ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে অন্যত্র চলে যান। কিন্তু গায়ত্রীর প্রতি প্রেম এবং সেই প্রেমের অভিঘাত স্থায়ী হয়েছিল তাঁর সমগ্র জীবনব্যাপী। কৃতিত্বের সাথে তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছিলেন এবং সেইকালের মোটা অংকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধুমাত্র কবিতায় আরো গভীরভাবে মনোনিবেশ করার জন্য। তাঁর ‘ফিরে এসো, চাকা’র সেই ৭৮টি শিল্পের উত্তুঙ্গ শিখরস্পর্শী কবিতা লেখা সম্ভব হয়েছিল মনে হয় কবিতায় এই বিশুদ্ধ আত্মনিবেদনের ফলেই। এই বইটির নাম গায়ত্রী চক্রবর্তীর নাম থেকেই নেওয়া, তিনি পরে বলেছিলেন গায়ত্রী চক্রবর্তীকে তিনি রূপান্তরিত করেছিলেন ‘গায়ত্রী চাকা’তে। বইটি উৎসর্গও করেছিলেন তাঁকেই।

এই বইয়ের কবিতাগুলোতে আমরা যে বিনয় মজুমদারকে পাই তিনি একাধারে দার্শনিক, বিরহী প্রেমিক, জীবনের গহীন অতল সমস্যাগুলোর পর্যবেক্ষক, বৈশ্বিক বোধের অধিকারী, বিজ্ঞানে নিবেদিত এবং এমন এক কবিসত্তায় উত্তীর্ণ কবি যিনি বিশ্বের মাঝে মানবাত্মার দুরূহ জীবনের বহুবিস্তারী সুন্দরের অনেকগুলো জানালা খুলে দেন। বইটি থেকে কিছু কবিতার পঙ্ক্তি পড়া যাক—

১.
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেল—এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হ’লো ফল।

২.
ভালোবাসা দিতে পারি, তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?
লীলাময়ী করপুটে তোমাদের সবই ঝ’রে যায়—
হাসি, জ্যোৎস্না, ব্যথা, স্মৃতি, অবশিষ্ট কিছুই থাকে না।

৩.
স্রোতপৃষ্ঠে চূর্ণ-চূর্ণ লোহিত সূর্যাস্ত ভেসে আছে;
নিশ্চল, যদিও নিম্নে সংলগ্ন অস্থির স্রোত বয়।
এখন আহত মাছ কোথায় যে চ’লে গেছে দূরে,
তুমিও হতাশ হ’য়ে রয়েছো পিছন ফিরে, পাখি।
এখনো রয়েছে ওই বর্ণময়, সুস্থ পুষ্পোদ্যান;
তবুও বিশিষ্ট শোকে পার্শ্ববর্তী উদাত্ত সেগুন
নিহত, অপসারিত, আর নেই শ্যামল নিস্বন।
কেন ব্যথা পাও পৃথিবীর বিয়োগেবিয়োগে?

৪.
শুনেছি সবার মাঝে একটি কুসুম ঘ্রাণময়ী;
ব্যথিত আগ্রহে দেখি; এত ফুল, কোনটি বুঝি না।
যে-কোনো অপাপবিদ্ধ তারকারো জ্যোৎস্না আছে ভেবে
কারো কাছে যেতে চাও, হে চকোর, স্বপ্নচারী, বৃথা।

৫.
অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমে আকাশের বর্ণহীনতার
সংবাদের মতো আমি জেনেছি তোমাকে; বাতাসের
নীলাভতাহেতু দিনে আকাশকে নীল মনে হয়।

৬.
আমিই তো চিকিৎসক, ভ্রন্তিপূর্ণ চিকিৎসায় তার
মৃত্যু হ’লে কী প্রকার ব্যাহত আড়ষ্ট হ’য়ে আছি।
আবর্তনকালে সেই শবের সহিত দেখা হয়;
তখন হৃদয়ে এক চিরন্তন রৌদ্র জ্ব’লে ওঠে।

৭.
শ্বাশ্বত মাছের মতো বিস্মরণশীলা যেন তুমি।

এই কবিতাগুলো শিল্পের সেই উর্ধ্বমেঘে ডানা মেলেছে, যেখানে একজন কবির যাবার প্রত্যাশা থাকে। পাঠকদের জন্যেও এ এক নতুন অভিজ্ঞতা। এ-বইয়ে শিল্প সক্ষমতার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছেন বিনয় মজুমদার।

‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রকাশিত হবার পর থেকে অনেকদিন পর্যন্ত এর কবিতাগুলো জীবনানন্দ দ্বারা প্রভাবিত হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। অবশ্য বিনয় মজুমদারও একবার বলেছিলেন তিনি সারাজীবন জীবনানন্দ দাশের মতো কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সময় প্রবাহিত হওয়ার সাথে সাথে আজ এটি প্রতিষ্ঠিত যে ‘ফিরে এসো, চাকা’ তাঁর মৌলিক সৃষ্টি। এটি অনন্য, যদি প্রভাবিত হওয়ার বিষয় থাকেও, সেটি তিনি করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ থেকে সরে যাওয়ার জন্য, মানে জীবনানন্দকে তিনি একটি উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছিলেন এখানে। জীবনানন্দ দাশের কাব্যজগত এবং বিনয় মজুমদারের কাব্যজগত সম্পূর্ণ পৃথক।

‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রকাশিত হবার দীর্ঘকাল পর তিনি একটি আশ্চর্য কবিতার বিষয়বস্তু খুঁজে পান। সেই বিষয়বস্তু খুঁজে পেয়ে তিনি ১৯৭৪ সালে একমাসে ছয়টি দীর্ঘ কবিতা লিখলেন। তিনি নিজে বলেছিলেন, “১৯৭৪ এক মাসের মধ্যে এ যেন একটা বিশাল যুগ পার হয়ে যাওয়া।” এই কবিতাগুলোই লিপিবদ্ধ হলো ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ নামক কবিতার বইয়ে। বাংলা সাহিত্যে স্বার্থক দীর্ঘকবিতা হিসেবে এই কবিতাগুলো এক অনন্য উদাহরণ। কবিতাগুলোতে তিনি একজন দ্রষ্টার মতো বস্তুর, দৃশ্যের, সময়ের, অন্তর্নিহিত সত্তাকে উন্মোচিত করেছেন। এখানে দেখা যায় তিনি একটি বিষয় নির্বাচন করেছেন, এবং এরপর সেই বিষয়টিকে ভিন্ন ভিন্ন কোণ থেকে বিশ্লেষণ করেছেন, সিদ্ধান্ত টেনেছেন, এরপর এরকমভাবে আরেকটি বিষয়ে গেছেন। এগুলো স্বার্থক দীর্ঘকবিতা কারণ কবিতাগুলোকে দশ-বারো লাইনের লিরিক কবিতার মতো টেনে-টেনে বড় করেননি তিনি। এখানে কবিতায় উপস্থাপিত বিষয়বস্তুই প্রধান, একজন কথক তো আছেনই কিন্তু লিরিক কবিতার কবির মতো তিনিই মুখ্য নন, কবির নিজস্ব আবেগই মুখ্য নয় এখানে। কবিতায় আসা প্রতিটি বিষয় এবং ঘটনাই মূল ভূমিকা নিয়ে চিত্রকল্পে, উপমায়, বর্ণনায় হাজির হয়েছে। তাই পাঠকদের ক্লান্তিবোধ জাগে না, বারবার পড়ার পরেও। কবিতাগুলো মহাপয়ারে লেখা। তিনি অবশ্য তাঁর প্রায় সব কবিতাই পয়ার এবং মহাপয়ারে লিখেছেন। বইটি থেকে কয়েকটি পঙ্ক্তি পড়া যাক—

১.
যদি কাছাকাছি থাকি তবে আর অকারণে উদয়ের ভাবনায় কখনো পড়ি না।
থাকে না এমন ভিড়ে খুঁজে-খুঁজে সপ্তর্ষিকে বার ক’রে আনবার বিরাট ঝামেলা।
নিজেই উদিত হলে এ রকম অসুবিধা—অপরের উদয়ের ভরসা লাগে না।
সপ্তর্ষিকে পেতে হলে এইভাবে তার কাছে নিজেই উদিত হতে চিরকাল হয়।

২.
অনেক গভীর রাতে আমি রোজ বাজপাখি হয়ে যাই—বাজপাখি হই,
পাহাড়ের বাজপাখি... এবং আকাশে উঠে এসকল... উড়ে দেখি।

এর বিপরীতভাবে, পাখি যদি মরে যায় তবু সেই মৃতদেহ পাখি,
গাছ যদি মরে যায় তবে যা থাকে তা—তাও গাছ, মৃত বলে অন্য কিছু নয়।
সেইভাবে আমাদের মন ম’রে গেলে যা থাকে তা—তাও মন
মৃত্যুর নিয়মে।
[বিশাল দুপুরবেলা]

কবিতাগুলো মহাজাগতিকতাকে স্পর্শ করে বৈশ্বিকতার দিকে যাত্রা করেছে। এই কবিতাগুলোয় জীবনের বহুমাত্রিক বিস্তারকেও যেন স্পর্শযোগ্য করে তুলেছেন বিনয় মজুমদার।

তাঁর কাব্যকৃতির সর্বোচ্চ নিদর্শন ‘ফিরে এসো, চাকা’ এবং ‘অঘ্রানের অনুভূতিমালা’ নামক কবিতার বই দুটি। অবশ্য তাঁর ‘বাল্মীকির কবিতা’ নামক কবিতার বইটি প্রকাশিত হবার পর থেকেই বিতর্কিত হয়ে আসছে। এতে তিনি মানব-মানবীর যৌনতার যে আড়ালবিহীন প্রকাশ ঘটিয়েছেন, সেটিই এর বিতর্কিত হবার কারণ। কবিতা হিসেবেও সেগুলি বিশেষ উৎরে যায়নি। তাঁর ঠাকুরনগর বাসপর্বে লিখিত কবিতাগুলি ক্রমেই জটিলতামুক্ত হয়ে এসেছে, যেন এক অন্য সহজতার দিকে যাত্রা করেছিলেন তিনি।

বারবার পাগল হয়ে যাওয়া বিনয় মজুমদারের জীবনে নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে উঠেছিল। ২০০২ সালে আবার সেই রোগ ফিরে এলে তিনি বাঙ্গুর সাইকিয়াস্ট্রি ইনস্টিটিউটে দুইমাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। কবিতা লেখার তিন বছরের বিরতির পর কিছুটা সুস্থ হলে সেই হাসপাতালেই নতুন করে লিখতে শুরু করেন কবিতা। কবিতাগুলো অনবদ্য। এর সাথে লেখেন একটি ছোটগল্পও। এ বিষয়ে মনে পড়ে ভিনসেন্ট ভ্যান গখের কথা, তিনিও মানসিক হাসপাতালে থাকার সময় বিস্ময়কর সব ছবি এঁকেছিলেন। ২০০৩ সালে বিনয় মজুমদারের এই পর্বে লেখা কবিতা নিয়ে বের হয় ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ শিরোনামে বই। এই বই পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পায় ২০০৫ সালে। বইয়ের ‘আমরা দুজনে মিলে’ কবিতাটা পুরোটাই পড়া যাক, কবিতাটিতে তিনি গায়ত্রী চক্রবর্তীকে উদ্দেশ্য করে বলছেন—

আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো।
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খ্রিস্টান হয়েছো।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি
আমার মাথার চুল যেরকম ছোট করে ছেঁটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোট করে ছাঁটা,
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।

অভিমান এবং অভিজ্ঞতার মিশেলে কবিতাটি অনন্য হয়ে উঠেছে। গায়ত্রী চক্রবর্তীর নামের সাথে তখন স্পিভাক যুক্ত হয়েছে এবং তিনি বিশ্ববিখ্যাত একজন তাত্ত্বিক ও যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।

কবিতার পাশাপাশি বিনয় মজুমদার কিছু গল্প, ছড়া, গান এবং প্রবন্ধ লিখেছিলেন। ডায়রিও লিখতেন তিনি। যৌবনে তিনি রুশ ভাষা শিখেছিলেন, অনেক রুশ কবির কবিতা অনুবাদের সাথে সাথে আলেক্সান্দ্র পুশকিনের কবিতাও অনুবাদ করেছিলেন তিনি। সেগুলিও অনন্য। তাঁর মৌলিক গল্পগুলি আকারে খুবই ছোট, অনেকগুলিই এক থেকে দেড় পৃষ্ঠার মধ্যে শেষ হয়েছে। এর মাঝে একটি গল্পের শিরোনাম ‘বিশ্ববীক্ষা’, কল্পিত এক আমি’র সাথে কল্পমামার কথোপকথন দিয়ে এর শুরু এবং শেষ। এর একটি অংশ পড়া যেতে পারে—

আমি: ঐ যে চা বানাচ্ছে সুবোধ। সুবোধ পৃথিবীর অংশ মানে বিশ্বের অংশ।
কল্পমামা: তা ঠিক। সুবোধ পৃথিবীর অংশ বিশ্বের অংশ।
আমি: তা হলে কল্পমামা, আপনিও পৃথিবীর অংশ মানে বিশ্বের অংশ।
কল্পমামা: তা ঠিক। আমি পৃথিবীর অংশ মানে বিশ্বের অংশ।

গল্পগুলোতে সাধারণ কথোপকথনের মাঝে চমকপ্রদ সব সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তিনি। চারপাশের সব চেনা-জানা মানুষেরাই তাঁর গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র।

বিনয় মজুমদারের কবিতার আবেদন ফুরোবার নয়। তিনি কালে-কালে নতুন-নতুনভাবে মূল্যয়িত হতে থাকবেন। পাঠকেরা প্রতিবারই নতুন সৌন্দর্যের মুখোমুখি হবেন তাঁর কবিতায়, গানে, গল্পে, অনুবাদে।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;