“মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছেন”



অনুবাদ ও গ্রন্থনা : আন্দালিব রাশদী
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

হেনরি কিসিঞ্জারকে জোসেফ জে সিসকোর চিঠি ও অন্যান্য

[জোসেফ জে সিসকো (জন্ম ৩১ অক্টোবর ১৯১৯-মৃত্যু ২৩ ডিসেম্বর ২০০৪), ইতালিয়ান-আমেরিকান, ১৯৭১-এ আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট; চেয়ারম্যান, ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল রিভিউ গ্রুপ। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে হেনরি কিসিঞ্জারের শাটল ডিপ্লোম্যাসি চলাকালে তিনিই প্রধান দাপ্তরিক দায়িত্ব পালন করেন। সিসকো ১৯৫১ সালে কূটনৈতিক চাকরিতে যোগদানের আগে কিছুসময় সিআইএ-ও কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। হেনরি কিসিঞ্জার তখন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট রিচার্ড এম নিক্সনের সহকারী।]

১৫ মার্চ ১৯৭১ : আজ ঢাকায় দিনের প্রথম ভাগে শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছেন, তার দল আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে (৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টি অধিকার করে) পূর্ব পাকিস্তানের শাসনভার নিয়ে নিয়েছে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইন প্রশাসন, যা এখনো পাকিস্তান সরকার, তার তোয়াক্কা না করেই মুজিব এককভাবে এ কাজটি করেছেন। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, মুজিবের ঘোষণার ৩৫টি নির্দেশনা প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নেওয়ার ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত পদক্ষেপ।

এই পদক্ষেপ নিয়ে মুজিব সরাসরি ইয়াহিয়া সরকারের মুখোমুখি দাঁড়ালেন, তবে তিনি সচেতনভাবে পূর্ব পাকিস্তানের নিঃশর্ত স্বাধীনতা ঘোষণা এড়িয়ে গেছেন এবং তার এ কাজের ভিত্তি যে গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণের গণতান্ত্রিক রায় তা উল্লেখ করেছেন।

ইয়াহিয়া প্রশাসন এই সংকটাকীর্ণ পদক্ষেপের কারণে অবশ্যই দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাবে। মুজিবের সঙ্গে কথা বলার জন্য ইয়াহিয়া ঢাকায় ছুটে এসেছেন।

ইয়াহিয়ার সামনে দুটি পথ—এর যে কোনোটি ইতিমধ্যেই ভঙ্গুর হয়ে পড়া পাকিস্তানের ঐক্য আরো বিপদাপন্ন করে তুলবে। ইয়াহিয়া যদি মুজিবের এ পদক্ষেপ মেনে নেন, তাহলে ধরে নিতে হবে তার সামরিক আইনের ক্ষমতা অন্তত পূর্ব পাকিস্তানে প্রত্যাহৃত হয়েছে, পশ্চিম পাকিস্তানে তা বহাল রাখা দুরূহ হয়ে পড়বে (ভুট্টোর রোববারের ভাষণ তা আরো স্পষ্ট করে তুলেছে)।

যদি ইয়াহিয়া কিংবা সামরিক বাহিনীর অন্যরা বলপ্রয়োগ করে মুজিবকে প্রতিহত করেন, পূর্ব পাকিস্তান হয়ে উঠবে সামরিক বাহিনী ও বাঙালি জাতীয়তাবাদীদের লড়াইয়ের রণক্ষেত্র। যার ফলে শেষ পর্যন্ত স্বাধীন বাংলার আত্মপ্রকাশ ঘটবে।

পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন হবে—যদি-না দীর্ঘমেয়াদে সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমন করতে পুরোপরি সক্ষম হয়। ‘সম্ভাব্য সব পন্থায়’ তাদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত সব শক্তিকে প্রতিহত করতে মুজিব এক বিবৃতিতে বাঙালিদের আহ্বান জানান।

সোমবার করাচিতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি জানিয়েছেন ক্ষমতা দুই অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে হস্তান্তর করা হোক—ভুট্টোর দলকে পশ্চিমাংশের, মুজিবকে পূর্বাংশের।

ভুট্টোর ভাষণ মুজিবের পদক্ষেপকে উজ্জীবিত করে থাকতে পারে। বিগত কিছুদিন ধরে যা সন্দেহ করা হচ্ছিল—ভুট্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সম্পূর্ণ বা আংশিক খণ্ডিত দেশে পশ্চিমাংশের ক্ষমতা গ্রহণই তার জন্য উত্তম, তবে মুজিবের মতো পদক্ষেপ গ্রহণ ভুট্টোর বেলায় সহজ হবে না কারণ সেনাবাহিনী পশ্চিমাংশে এত শক্তিশালী যে বিদ্রোহীদের দমন করা কঠিন হবে না। এ সময় ইয়াহিয়া কী সাড়া দেন তা-ই হয়ে উঠবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্ণায়ক।

বিবিসি লন্ডন

২৭ মার্চ ১৯৭১ (দ্বিতীয় সংবাদ)
তিন দিন আগে সেনা মোতায়েনের একজন চাক্ষুষ সাক্ষী বিবিসি প্রতিনিধি নিজেই : তাকে ঢাকা থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়েছিল। তিনি বলেছেন, ঢাকা শহরের লোকদের সন্ত্রস্ত করার জন্য সেনাবাহিনী পূর্ব-পরিকল্পিত নিষ্ঠুর একটি অপারেশন চালিয়েছে।

আমাদের সংবাদদাতা আরো বলেছেন, ট্যাংক ও আর্মার্ড ট্রাকভর্তি সৈন্য খুব কমই প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে, যদিও ছাত্রদের হাতে কিছু অস্ত্র ছিল। চারদিকে গুলির শব্দ এবং ভবনগুলোতে লেলিহান অগ্নিশিখা।

আমাদের প্রতিনিধি ও তার সঙ্গী ফিল্ম ক্রুকে তিনবার ব্যাপকভাবে তল্লাশি করা হয়েছে। দেশের বাইরে প্রেরণের আগেই তাদের সংবাদ ও কাগজপত্র জব্দ করে রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, সামরিক সরকার মরিয়া হয়ে উঠেছে যাতে সেন্সরবিহীন সংবাদ দেশের বাইরে যেতে না পারে।

প্রতিনিধি আরো জানিয়েছেন, সামরিক বাহিনীর বিবৃতিতে নিষিদ্ধ ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার হওয়ার সংবাদটি সম্ভবত সত্য।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শেষ হয়ে আসছে। রেডিও পাকিস্তান জানিয়েছে, যুদ্ধবিরতি কার্যকর করা হয়েছে। ভারতীয় বাহিনী ঢাকায় প্রবেশ করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী সংসদে বলেছেন, দু পক্ষের প্রতিনিধি ঢাকায় আত্মসমর্পণ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছেন। পাকিস্তানের পক্ষে এই চুক্তি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের।

তিনি বলেন, ভারত আশা করে যে পাকিস্তানে আটক পূর্ব পাকিস্তানীদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান নিজ দেশের মানুষের মধ্যে তাঁর আসন গ্রহণ করবেন এবং বাংলাদেশকে শান্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাবেন।

তিনি বলেন, ভারতীয় বাহিনী প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় অবস্থান করবে না। তিনি আরো বলেন, লাখ লাখ শরণার্থী এর মধ্যেই দেশের পথে পা বাড়িয়েছে।
(বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিস থেকে প্রচারিত ইংরেজি সংবাদের অনুবাদ)

একটি অসাধারণ সাক্ষাৎকার

[তেহরানের দৈনিক কিয়ান আওয়ামী লীগ প্রধানের যে সাক্ষৎকার গ্রহণ করে তার ওপর ভিত্তি করে ডন ২০ ফেব্রুয়ারি ১৯৭১-এ যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তা অনূদিত হলো]

মুজিব প্রদেশসমূহের অধিকার নিশ্চিত করতে চান
তেহরান, ১৯ ফেব্রুয়ারি : আওয়ামী লীগপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, কেবল পূর্ব পাকিস্তানের নয়, ফেডারেল কাঠামোর আওতায় পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশের অধিকার তিনি নিশ্চিত করতে চান। তেহরানের দৈনিক কিয়ানের প্রতিনিধিকে ঢাকায় দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে বলেন, আমরা চাই সুবিচার ও ঐক্যের ভিত্তিতে সমগ্র জাতি উন্নতি লাভ করুক। তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক পাকিস্তানই হবে শক্তিশালী পাকিস্তান। তার পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে শেখ মুজিব বলেন, পররাষ্ট্রনীতি হবে জোট নিরপেক্ষ কিন্তু পৃথিবীর সকল দেশের সাথে সক্রিয় বন্ধুত্ব থাকবে।

শেখ মুজিবুর রহমান জোর দিয়ে বলেন, যারা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে, তারা কুৎসা রটনাকারী। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে যেসব ভুল করা হয়েছিল তা সংশোধন করতে পারলে পাকিস্তান শক্তিশালী হয়ে উঠবে, অন্যদিকে বর্তমান প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে পাকিস্তান এত দুর্বল হয়ে পড়বে যে, তা থেকে আর উত্তরণ সম্ভব হবে না।

শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে ইসলামাবাদ আর পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যতের নির্দেশনা দিতে পারবে না। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত্বশাসন প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আমাদের কর্মসূচি কেবল পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নয়। ফেডারেল কাঠামোর আওতায় আমরা চাই পাঞ্জাব, সিন্ধু, বালুচিস্তান এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অধিকারও সুরক্ষিত হোক।

বাংলাদেশকে দারিদ্র্যের মধ্যে ফেলে রাখা পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইদেরও প্রকৃত স্বার্থের পরিপন্থী। এখন যা স্থানীয় দারিদ্র্য, দীর্ঘমেয়াদে তা-ই সমগ্র দেশে ছড়িয়ে পড়বে। আমরা চাই ধনবাদী পদ্ধতির যে একচেটিয়াবাদ ও ট্রাস্ট লাখো মানুষের দারিদ্র্যের বিনিময়ে কিছু মানুষকে মোটাসোটা করছে, তার অবসান ঘটুক।

ভারত কি বাংলাদেশকে খেয়ে ফেলবে?
যখন জিজ্ঞেস করা হলো, ফেডারেল পাকিস্তান হবার কারণে ভারত না আবার বাংলাদেশকে ‘খেয়ে ফেলে’, মুজিব হেসে উঠেন। তিনি আমাদের আশ্বস্ত করলেন, ‘আজকাল কেউ কাউকে খেয়ে ফেলতে পারে না। ভারত তো তাদের বাংলাকে নিয়ন্ত্রণ করতেই হিমশিম খেয়ে যায়, আমাদের দরিদ্র লোকেরা ভেঙে পড়ার পর্যায়ে এলেও তাদের স্বাধীনতা রক্ষা কতে পারবে।’

তিনি বলতে থাকলেন ‘ভিয়েতনামের দিকে তাকান, আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশ তার ইচ্ছে চাপাতে গিয়ে গরিব কৃষকের মাতৃভূমিতে কত অসহায় হয়ে পড়ছে। আমেরিকা যদি ভিয়েতনামকে খেয়ে ফেলতে না পারে, ভারত কেমন করে বাংলাদেশকে খাবে?’

অর্থনৈতিক নীতিমালা
সাক্ষাৎকারের ওপর ভিত্তি করে রচিত প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক নীতিমালায় প্রধান সেক্টরসমূহ ব্যাংক, ইন্স্যুরেন্স, ভারি শিল্প, বিদেশ বাণিজ্য, পাট, তুলা, যানবাহন বিশেষ করে জাহাজ পরিবহন পুরোপুরি জাতীয়করণের কথা বলা হয়েছে। তিনি বিশ্বাস করেন, এতে ‘কোটারি শক্তি ভেঙে যাবে এবং দেশের ফেডারেল ইউনিটগুলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে যার যার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে পারবে এবং জনগণ রাষ্ট্রের কর্মকাণ্ড নিয়ে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পাবে।

বিদেশী ঋণ
তার অর্থনৈতিক নীতিমালার আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, উদারীকরণ, ‘বৈদেশিক ঋণের অভিশপ্ত বোঝা’ থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করা—‘আমরা অতীতে উন্মত্তের মতো বৈদেশিক ঋণ গ্রহন করেছি, আমাদের গ্রহণ করা ঋণে কিছু সংখ্যক পুঁজিবাদী এবং প্রশাসনে তাদের এজেন্টগণ পুষ্ট হয়েছে আর ঋণের বোঝা ও ঋণের সুদের বোঝা বহন করতে হয়েছে সাধারণ মানুষকে।’

তিনি চান ফেডারেল সরকার পূর্ণ কর্মসংস্থান, খাদ্যসহ মৌলিক চাহিদা পূরণ এবং ইরানের ‘লিটারেসি কোর’-এর মতো সংগঠনের মাধমে দারিদ্র্য বিমোচনের গ্যারান্টি দিক। তার পররাষ্ট্রনীতি জোটনিরপেক্ষ থাকার এবং পৃথিবীর সব জাতির সঙ্গে বন্ধুত্ব রক্ষার এবং আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমস্যা নিষ্পতি করার।

তিনি চান পাকিস্তান ‘সেন্টা’ এবং ‘সিয়োটো’ থেকে বেরিয়ে আসুক, তবে তিনি চান পাকিস্তান, ইরান ও তুরস্কের একত্রে থাকার আরসিডি গ্রুপ থাকুক এবং বিশেষ করে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর অংশগ্রহণে তা আরো বড় হোক।

কাশ্মীর বিরোধ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, একনায়কত্বের দোহাই দিতে এবং সমরাস্ত্রের জন্য বিপুল ব্যয় করতে সামরিক বাহিনী ও পুঁজিবাদীরা কাশ্মীরকে ব্যবহার করছে। ‘তবুও জম্বু ও কাশ্মীরের জনগণের জন্য আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করিনি।’

মুজিব ভারতের সঙ্গে সর্বোত্তম সম্পর্ক রক্ষা করতে চান। তিনি বলেন, ‘আমরা একই উপমহাদেশের ভাগীদার। পছন্দ হোক বা না হোক আমাদের একসঙ্গে থাকতে হবে, একসঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে হবে।

চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব
চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব মুজিবের পররাষ্ট্রনীতির অংশ। ভৌগোলিক অবস্থান এবং নীতিই বন্ধু নির্ধারণ করে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘কিন্তু তার মানে এই নয় আমাদের পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। আমরা মুসলমান এবং আমরা কখনো কমিউনিজম গ্রহণ করব না।’ ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মুজিব বলেন, ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক এবং আবেগময় বন্ধনে দু দেশ এমন দৃঢ়ভাবে আবদ্ধ যে এ নিয়ে বেশি কথা বলার প্রয়োজন নেই এবং এই দুই ভ্রাতৃপ্রতীম দেশকে কেউই বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না।

জাতিসংঘ মহাসচিব বললেন

জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট পূর্ব পাকিস্তানের নিরঙ্কুশ সমর্থিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার গোপন বিচার নিয়ে পাকিস্তান সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, নভেম্বরে পূর্ব বাংলায় হারিকেনের ধ্বংসযজ্ঞ এবং পরবর্তী কলেরা মহামারির চেয়ে ভয়াবহ হবে এই বিচারের পরিণতি।

আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকরা উ থান্টের সঙ্গে একমত পোষণ করেন। আওয়ামী লীগের জন্য ৯৮ ভাগ জনসমর্থনের ওপর ভিত্তি করে তারা এই মন্তব্য করেন।... ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন কোথায় মুজিবুর রহমানের বিচার হচ্ছে তা প্রকাশ করতেও অস্বীকার করছে। তাদের সরবরাহকৃত তথ্যে বলা হয়েছে ‘পাকিস্তানের কোথাও’ তার বিচার হচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে বাঙালিরা কোনো রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেবে তা যেখানে উদ্বেগের বিষয়, যেখানে তারা পশ্চিমাপন্থী, কিন্তু তারা রেড চীনের প্রতিবেশী, মুজিবুর রহমান যেখানে মধ্যস্থতার চেয়ে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে বেশি ঝুঁকে আছেন—তিনি ভোটারের মতামত ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর চাওয়ার তফাতটা ভালো করে জানেন তার গোপন বিচারের পরিণতি ভালো হওয়ার নয়।
(১৩ আগস্ট, ১৯৭১)

মুজিবকে অবশ্যই মুক্তি দিতে হবে - ইন্দিরা গান্ধী

[ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দুটি অফিসের একটি দিল্লির প্রশাসনিক ভবন, যেটি সাউথ ব্লক নামে পরিচিত। সানডে টাইমস-এর নিকোলাস ক্যারোল এখানে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ ইন্দিরা গান্ধীর সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয় ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে।]

গান্ধী বললেন, তাঁর কোনো সন্দেহ নেই যে ভারত ও পাকিস্তানের জন্য বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠবে, যদি বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ না থাকে তাহলে উপমহাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে।

ক্যারল : বাংলাদেশ প্রশ্নে আপনার ঘোষিত লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। আপনি স্পষ্টভাবেই বলেছেন, ভারতের রাষ্ট্রসীমা বৃদ্ধির কোনো অভিলাষ নেই। তাহলে কবে নাগাদ শেষ ভারতীয় সেনা প্রত্যাহারের কাজটি সম্পন্ন হবে?
মিসেস গান্ধী : এ পর্যায়ে বলা কষ্টকর। বিষয়টি প্রধানত বাংলাদেশ সরকারের ওপর নির্ভর করে। আমরা আশা করি তা শিগগিরই ঘটবে।
ক্যারল : কত সপ্তাহ বা মাস এমন কিছু কি ভাবছেন?
মিসেস গান্ধী : এখনো বিষয়গুলো এলোমেলো অবস্থায় রয়েছে বলে আমি এ অবস্থায় কিছু বলতে পারছি না। সেখানকার জনগণের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হবে। অবাঙালিদের প্রতি এবং অন্যান্য বিষয়েও আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। আমি মনে করি ভারতীয় সেনাবাহিনী এক্ষেত্রে সাহায্য করতে পারবে।
ক্যারল : আপনি কি আবারও সুনির্দিষ্টভাবে বলবেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো এলাকা ভারতের অধিকারে রাখার ইচ্ছে আপনার নেই?
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি আমি সুনির্দিষ্টভাবেই জনসভায় এবং সংসদে বলেছি যে আমাদের সীমানা সম্প্রসারণের কোনো আকাঙ্ক্ষা নেই।
ক্যারল : পাকিস্তানের অধিকারে যে এলাকা রয়েছে যা আপনার মতে ন্যায্যত ভারতের—সেক্ষেত্রেও কি এমনই কথা প্রযোজ্য?
মিসেস গান্ধী : আমি বলেছি যে আমরা বল প্রযোগ করে তা উদ্ধার করব না। কিন্তু আপনি জানেন, আমরা কেবল বিশ্বাসই করি না, এটা প্রমাণিতও হয়েছে যে যুদ্ধরহিতকরণ রেখা বরং খামখেয়ালির মাধ্যমে নির্ধারিত এবং তা শান্তি নিশ্চিত করতে সাহায্য করে না। তবে এটা নিয়ে সরকার নতুন করে বা নতুন কিছু ভাবছে না।
ক্যারল : বাংলাদেশের জন্য তার নেতা শেখ মুজিবুরের বিশেষ প্রয়োজন। তার মুক্তি নিশ্চিত করতে ভারত কী করছে? আপনি কোন ধরনের চাপ দিচ্ছেন?
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি না আমরা অনেকটা চাপ দিতে পারব। আমাদের দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে আমরা বিশ্ব সরকারগুলোর কাছে আপিল করেছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে সবার কাছে চিঠি লিখেছি। আমরা একান্তভাবে প্রত্যাশা করি, তারা কিছুটা চাপ দেবে। আজ সকালেই দেখলাম আমেরিকান সরকার (পাকিস্তানের সাথে ভারতের) যুদ্ধবিরতির কিছুটা কৃতিত্ব দাবি করে বসেছে: আশা করি তারা তাহলে এ ব্যাপারটাও দেখবে।
ক্যারল : কিন্তু আপনি তো তার জন্য জিম্মি হিসেবে পূর্বাঞ্চলে পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দীদের আটকে রেখেছেন। এটা কি সমঝোতার দরকষাকষিতে একটা ভূমিকা রাখতে পারে?
মিসেস গান্ধী : এ নিয়ে আমি তেমন কিছু বলতে পারব না, কারণ আমি জানি না কিভাবে সে আলোচনা হবে বা কী ঘটবে।
ক্যারল : ভারত শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক স্থাপন করতে পারবে বলে মনে করেন?
মিসেস গান্ধী : পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের অত্যন্ত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপিত হবে এ নিয়ে আমার কখনোই কোনো সন্দেহ ছিল না। আমি মনে করি দুর্ভাগ্যজনক দিকটি হচ্ছে মাঝেমধ্যে এমন সরকার ক্ষমতাসীন হয়েছে যারা এই সম্পর্ক স্থাপনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমার কোনো সন্দেহ নেই যে পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে আমাদের প্রতি একটি সৌহার্দ্যপূর্ণ অনুভূতি রয়েছে। যখনই আমাদের কেউ যে কোনো উদ্দেশে সেখানে গিয়েছে যেমন শিখদের, অতীতে আমাদের ক্রীড়াদলকে তারা উষ্ণ স্বাগতম জানিয়েছে।
ভারতেও দেখবেন পাকিস্তানের ব্যাপারে কোনো কথা নেই; এটা ঠিক তাদের খবরের কাগজে ঘৃণা প্রচারণা অব্যাহত আছে। এমনকি শিক্ষা কর্মসূচিতে।...ভারতে কী ঘটছে, উন্নয়ন কিভাবে হচ্ছে সে দৃষ্টিতে যদি তারা তাকায়, আমরা যদি সহযোগিতা করি তাহলে দুই দেশই আরো শক্তিশালী ও সামর্থ্যবান হয়ে আমাদের কঠিন সমস্যার মোকাবিলা করতে পারব।
ক্যারল : আপনাকে যুক্তিসংগত আশাবাদী শোনাচ্ছে।
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি আমি একজন আশাবাদী মানুষ।
ক্যারল : বাংলাদেশ ও শরণার্থী প্রশ্নে ভারতের অবস্থান বুঝতে না পারায় আপনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে তিরষ্কার করেছেন, ফলে আপনার সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তিক্ত হয়ে উঠেছে। যদি ধরে নিই আপনার প্রত্যাশা অনুযায়ী যত দ্রুত সম্ভব এ সম্পর্কের উন্নয়ন হয়, আপনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পদক্ষেপ গ্রহণ দেখতে চান?
মিসেস গান্ধী : হ্যাঁ, এটি আপনিই উল্লেখ করেছেন। শেখ মুজিবের মুক্তির বিষয় তাদের বাংলাদেশ পরিস্থিতির বাস্তবতায় স্বীকার করতে হবে। তাদের পাকিস্তান পরিস্থিতির বাস্তবতাও মানতে হবে। একটা দূরের দেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে উৎসাহ জোগাতে পারে না, হস্তক্ষেপও করতে পারে না। আপনার পছন্দের বিশেষ সরকারকে আপনি সমর্থন করতে পারেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেই সরকার সে দেশের জনগণের জন্য সঠিক কিনা? যদি তা না হয়, তাহলে এটি কখনো শক্তিশালী সরকার হতে পারে না—এর পেছনে যত সেনাবাহিনীই থাকুক না কেন, তাতে কিছু এসে যায় না। এটা আমাদের বিষয় নয়, তাদের। এটা পাকিস্তানের ব্যাপার।
ক্যারল : বর্তমানে ভারতের সঙ্গে ব্রিটেনের চমৎকার সম্পর্ক। এশিয়ায় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা রক্ষায়, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ বা কমনওয়েলথ বিষয়ক ব্রিটেন কী করতে পারে বলে আপনার ধারণা?
মিসেস গান্ধী : আমি আগেই বলেছি বাইরের শক্তি যদি হস্তক্ষেপ না করে তাহলে স্থিতিশীলতা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ব্রিটেন সম্প্রতি কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। কিন্তু আপনারা আগে করেছেন। বর্তমান পরিস্থিতি অংশত সে কারণেই সৃষ্টি হয়েছে—কেবল আপনাদের নয়, অন্যদের হস্তক্ষেপেও।
ক্যারল : আপনি কি মনে করেন আপনার এই উদ্বেগের বিষয়টি আমরা সবাই অবহিত?
মিসেস গান্ধী : হ্যাঁ, আমি মনে করি আপনারা জানেন।
ক্যারল : আমরা যদি বাংলাদেশকে আগে স্বীকৃতি দিই, আপনি তা স্বাগত জানাতেন?
মিসেস গান্ধী : বাংলাদেশের জনগণ স্বাগত জানাবে।
ক্যারল : আপনি কি মনে করেন আমাদের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিকভাবে সংকট সমাধানে সহায়ক হবে?
মিসেস গান্ধী : আমি মনে করি তা হবে। এটা বাংলাদেশের জন্য ভালো, কারণ তারা বুঝবে তাদের বন্ধু আছে।
ক্যারল : গত সপ্তাহে মি. কুজনেতজভ যখন দিল্লিতে আসেন, তখন কি বাংলাদেশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের স্বীকৃতি দান নিয়ে আলোচনা করেছেন?
মিসেস গান্ধী : না, আমরা এ ধরনের বিষয় নিয়ে আলাপ করিনি। তবে আমরা নিশ্চয়ই আশা করব, আরো বহুসংখ্যক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে।
ক্যারল : অন্য সব দেশ পেছনে ফেলে কেবল সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ছুটে আসবে—এটাকে আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত মনে করেন না?
মিসেস গান্ধী : এটাকে বরং আমি এভাবে দেখতে চাই, যত বেশিসংখ্যক দেশ স্বীকৃতি দেবে, বাংলাদেশ তত আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠবে, এখন বাংলাদেশকে যেসব সমস্যার মোকাবিলা করতে হচ্ছে তখন তার সমাধান সহজ হয়ে যাবে। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, স্বাধীনতা দরজাটা খুলে দেয়; কিন্তু আসল কাজ আসে তারপর।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;