রিয়ালের দুঃস্বপ্ন



সাদ রহমান
অলঙ্করণ কাব্য কারিম

অলঙ্করণ কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

একটানে কোকের বোতলটার প্রায় পুরাটাই শেষ করতে গিয়া—না জানি কোন এক গভীর পিপাসায়—কিন্তু শেষমেষ কুলাইতে না পাইরা নাকেমুখে উঠবার জোগাড় হইল, রিয়ালের। সেইসঙ্গে তার শ্বাসপ্রশ্বাসও ক্রমে বন্ধ হইতে লাগল। এই চাপে ঘুমটাই ভাইঙ্গা গেল তার।

ফিজিকালি, রিয়াল উপুড় হইয়া বালিশের ভিতরে নাক ডুবাইয়া ঘুমাইতেছিল। ফলে তার নাশারন্ধ্রটি আটকায়া যাওয়া স্বাভাবিক ছিল। ঘুম ভাঙতেই রিয়াল দেখল, বাস্তবিক দুনিয়াতে তেমন কোনো আলোর প্রসার নাই। সদ্য যে স্বপ্ন সে দেইখা উঠছিল, যেন পৃথিবীও সেটারই মতন প্রতিবেশ নিয়া, তদ্রূপ এক আলো-আঁধারির সঞ্চয়ন হইয়া আছে। জানালার পর্দাতে যেইরকমের সন্ধ্যাটারে সে দেখতেছিল, যেন, এইরকমের একটা সন্ধ্যাই মাত্র সে স্বপ্নের মধ্যেও দেইখা আসছে।

এই আলো-অন্ধকার, আর পর্দার ব্যাপার মাথায় আসতে রিয়ালের মনে পড়ল, সে আসলে কিছুক্ষণ আগেই ঘুমাইছিল। অন্যান্য দিনের মতো আজকে, ঘুমানোর আগে সে ঢাকাতে ছিল না, ছিল নেত্রকোনায়। সেহেতু ঘুম থেকে ওঠার পরে—এখন সে জানালার উপরে এইরকমের একটা ভাবকবলিত পর্দা, ঝুলতে থাকতে দেখল।

রিয়াল আজকে স্বপ্নের মধ্যে অনেকগুলো অপরিচিত দৃশ্যের মুখোমুখি হইছে। এইজন্যই তার একটু অস্থির লাগতেছিল। কোকের যেই বোতলটিকে সে খাইতে খাইতে প্রায় মরতে নিছিল, আদতে বোতলটি যে কোথা হইতে আসছিল, সেই কথা ভাবতে গিয়া রিয়াল দেখল, বোতলের উৎপত্তির ব্যাপার সে অলরেডি ভুইলা গেছে। আর তার কণ্ঠেও বিশেষ কোনো পানির পিপাসা লাগে নাই। তাহলে, স্বপ্নের ভিতরে এমন কী কারণ থাকতে পারে, যার দরুন রিয়াল একটা বোতলের পুরাটা কোক এক ঢোকে খাইতে গিয়া—মরতে নিছে?

রিয়ালের মনে পড়ল, এমনকি কোক খাইবার আগেও স্বপ্নের মধ্যেই সে আরেকবার পানিও খাইছিল। সে আসলে নিজের সঙ্গে এইসব বোঝাপোড়াগুলো কইরা যাইতেছিল। কেন, কিসের পিপাসা ছিল তার, পানির কি? অথবা অল্প কইরা হইলেও, পিপাসা তাহার লাগছে কি? কিন্তু সে বুঝল, পিপাসা তাহার লাগে নাই।

স্বপ্নে রিয়াল তার এক বন্ধু, নাম কুরাইশ, আর অন্য আরেক বন্ধু, নাম জোসেফের সঙ্গে একটা প্রায়-অন্ধকার সন্ধ্যার আলোর মধ্যে বইসা ছিল। আর সেই নিভু আলোর অবস্থান ছিল একটা অচেনা ঘর। যার জানালা দিয়া সন্ধ্যার ওইটুকু আলোই শুধু প্রবেশ করতেছিল। তারা তিনজন আলাপ করতেছিল মদ খাওয়া বিষয়ে। তাদের কারো কাছে কোনো টাকা ছিল না, যেহেতু, রিয়ালের হঠাৎ মনে পড়ল—ওই অচেনা ঘরটিও ঢাকার থেকে অনেক দূরে একটা কোথাও ছিল। তারা স্বপ্নের মধ্যে ঢাকায় ফিরতে পারতেছিল না, টিকেটের চিন্তায়, নাকি বাসস্টপেজের চিন্তায়, নাকি সড়ক দুর্ঘটনায়, নাকি কী—ইত্যাদি অনেকরকম চিন্তার টানাটানিতে, তারা হয়তো বেখেয়ালেই এই মদের আলোচনাতে ঢুইকা পড়ছিল। আগামাথাহীন, স্বপ্নে যেইরকম হয়।

রিয়ালের অবশ্য তাৎক্ষণিক আরো কিছু বিষয় স্মরণে আসলো। অভিজ্ঞতাপ্রসূত সে জানে, স্বপ্ন উদ্ধারের ক্ষেত্রে কখনোই অতীব ব্রতী হওয়া চলে না। তাতে ওইখানেই স্বপ্ন উদ্ধারের বিষয়টির মৃত্যু ঘটে। স্বপ্ন উদ্ধারে স্বাভাবিক থাকতে হয়। স্বাভাবিকভাবে মস্তিষ্কের অন্যান্য সিন ও প্রতিসিনগুলোকে মোকাবিলা করতে হয়। তাই রিয়াল তার চোখটা বন্ধ করে, আস্তে আস্তে, স্বপ্নটার আশপাশ দিয়াই বরং ঘুরতে-টুরতে থাকল।

সবার প্রথমে তার স্মরণ হইল, তারা আসলে আলাপ করতেছিল কিভাবে মদের টাকা জোগাড় করা যায়, সেই বিষয়ে। এরকম আলাপটি তারা বাস্তব জীবনেও প্রায়শ কইরা থাকে। স্বপ্নের ভিতরে রিয়ালের বিকাশ একাউন্টে মাত্র তিনশো টাকা ছিল। কিন্তু রিয়াল মনে করতে পারল না, সেই মাত্র তিনশোটি টাকাও সে কোথায় কিম্বা কোন বিধায় খরচ কইরা ফেলছিল[স্বপ্নে]। তাই স্বপ্ন যখন চলতেছিল, তাদের তিনজনের অনুভূতিটা এমন ছিল যে, হায় আফসোস, যদি ওই তিনশোটা টাকা আমাদের থাকত, তাহলে হয়তো আমরা মরতাম না!

এমন সময়ে, স্বপ্নের মধ্যেই কে যেন রিয়ালরে জানাইল যে, মাসকান্দায় মাত্র আট টাকায় এক পেগ মদ পাওয়া যায়। এই খবরে তারা তিনজন অন্তত তিন পেগ মদ খাইতে চায়, এমন চিন্তায় চব্বিশ টাকা জোগারের ব্যাপারে অস্থির হইয়া পড়ল।

রিয়াল তার স্বপ্ন-উদ্ধার প্রক্রিয়াটিকে আরো ধীর কইরা আনলো। ভাবতে চেষ্টা করল—কিন্তু কে? কে তাদেরকে ঢাকার বাইরের ওই দূরের, ওই প্রায়-অন্ধকার এক ঘরে, আট টাকা পেগ মদের সন্ধান দিতে পারে? নিতান্ত অস্পষ্টতা অথবা ভাবালুতাভাবে হইলেও রিয়ালের চোখের সামনে এবার ভাইসা উঠল তার বাল্যবেলার বন্ধু, ফজিলতের মুখ। ফজিলতের মুখ তার চোখের সামনে ভাসতেই সে কন্ট্রোল হারাইল, এবং তার স্বপ্ন-উদ্ধার প্রকল্প ওইখানেই শেষ হইল।

রিয়ালও এইসব স্বপ্ন-টপ্ন আর ভাবতে চেষ্টা করল না। বরং ফজিলতের মুখচ্ছবিটাই আরেকটু ম্পষ্ট করতে করতে, সে শোয়া থেকে উইঠা বসল।

২.
ভয়ানক হইলেও সত্য যে, রিয়ালের এই বাল্যবেলার বন্ধু ফজিলত গতবছর রোড একসিডেন্টে প্রয়াত হইছে। এই খবর রিয়াল জানতে পারছে ছয় সাত মাস আগে।

একদিন দুপুরবেলায় রিয়ালের প্রচণ্ড গাঁজা খাওয়ার ইচ্ছা হইছিল। অগত্যা সে সইতে না পাইরা দুপুরবেলাতেই বাইর হইছিল গাঁজা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। খিলগাঁও রেললাইন ধইরা সে মালিবাগের দিকে আগাইতেছিল, আগাইতে আগাইতে, আশ্চর্জনকভাবে, হঠাৎ রেললাইনেই তার রিজভির সঙ্গে দেখা হইয়া গেল। রিজভিও রিয়ালের আরেকজন বাল্যবেলার বন্ধু। বাল্যবেলা কাটবার পরে, যেহেতু আরো কয়েকবার এই দুইজনের দেখাসাক্ষাৎ হইছিল—তাই তারা এমন হঠাৎ-সাক্ষাতেও নিজেদের মধ্যে বিশেষ কোনো আশ্চর্যের ভঙ্গি ধরল না। একটু পরে জানা গেলো, রিজভিও নাকি গাঁজাই খুঁজতেছিল।

তাদের দেখা হইছিল পরে—প্রথমে দুইজনই এমনভাবে আলাপ করতেছিল যেন তারা হুদাই আর কি হাঁটতে বাইর হইছে, রেললাইনে। রিজভি বলতেছিল, তার ভালো লাগতেছিল না। রিয়ালও বলতেছিল, তার ভালো লাগতেছিল না। কিন্তু এইসব তো কোনো অর্থ উৎপাদন করতেছিল না, কাজেই একটা পর্যায়ে তারা নিজ নিজ স্বার্থেই একে অপরের চোখগুলা নীরবে পইড়া নিছিল। মানে স্বীকার কইরা নিছিল, একে অপরে, গাঁজার উদ্দেশ্যের কথা। তখন তারা দুইজন মিলা গাঁজা সংগ্রহ কইরা রিয়ালের মেসে গিয়া সেটা স্মোক করছিল।

সেইদিন আরো হাজারটা তথ্য-ইনফরমেশনের পাশাপাশি রিজভিই রিয়ালকে এই হার্টব্রেকিং ইনফরমেশনটা দিছিল। বলছিল, কিভাবে ফজিলত বাইক এক্সডিডেন্টে মারা গেছে। এই ইনফরমেশন শুইনা রিয়ালের চোখমুখ আন্ধার হইয়া গেছিল। হা কইরা সে রিজভির দিকে এমন শূন্য দৃষ্টিতে তাকাইতেছিল, যে বোকা রিজভি তাতে ভাবছিল রিয়ালের হয়তো এই বিষয়ে অসীম আগ্রহ। তেমন ভাবনায় সে প্রয়াত ফজিলতের মৃত্যুর খবর তো রিয়ালকে বলছিলই, তার পাশাপাশি, ফজিলতের জীবন যে আরো কত জটিল আর দুর্দশাময় হইয়া উঠছিল, সেইগুলাও শুনাইতেছিল।

রিয়ালের একটা নিজস্ব ধারণা হইল, সে মনে করে, গাঁজাখোররা ইয়াবাখোরদের ব্যাপারে অমূলক এক ঘৃণা পোষণ করে। সেই কারণে একটি গাঁজাখোর একটি ইয়াবাখোরের ব্যাপারে অসংখ্য অলিক গল্প ফাঁদে। মানে ফাঁদাই স্বাভাবিক। যেমনটাই হয়তো রিজভি এখন ফাঁদতেছিল।

ইয়াবা খাইতে খাইতে শেষে ফজিলতের এমনই অবস্থা হইছিল যে, ফজিলতের বাপ-মা তারে আর ঘরেও থাকতে দিতে পারল না। বাইর কইরা দিল। রিজভির বক্তব্য অনুযায়ী, পিতামাতা যখন বাধ্য হইলেন তখনই আর কি এমনটা করলেন। এমনিতে ফজিলতের বাবা যে একজন মহৎপ্রাণ মানুষ ছিলেন, সেই বিষয়ে রিজভির নজরানা হাজির করবার কোনো শেষ ছিল না। অথচ অন্যদিকে, ফজিলতের বাপের চেহারাটাই মনে করতে পারতেছিল না রিয়াল।

রিজভি বলল, ফজিলতের বাপ ফজিলতকে দুই-দুইবার রিহাবে দিছিল, কিন্তু কোনো কাজ হয় নাই। ফাইনালি যা হবার তাই হইছে। কেন কাজ হয় নাই, আর কেনই বা ফাইনালে যা হবার তাই হইছে, এমন প্রশ্নে আইসা সম্ভবত রিজভি নিজেও খানিকটা কুচকাইয়া গেছিল।

ফজিলতের ব্যাপারে রিজভি সবচাইতে বাজে আর ভয়ংকর যেই তথ্যটা দিছিল, সেটা শুইনা রিয়াল আসলেই বিরূপ হইয়া উঠছিল, রিজভির ওপর। সে আসলে তার বাল্যবেলার একজন ঘনিষ্ঠ মৃতবন্ধুর ব্যাপারে এইসব কিছুই শুনতে চাইতেছিল না। আর রিজভিরেও সে থামতে বলতে পারতেছিল না। হয়তো বা, চিকনভাবে হইলেও, তার মনেও একটি নৈতিক ভাবাবেগ তৈরি হইছিল। যে, শুনতে কষ্ট হইলেও ফজিলতের গল্পগুলা তার শোনাই উচিত।

ফজিলতরে যখন ফজিলতের বাপ ঘর থেকে বাইর কইরা দিছিল, তখন ফজিলত আর কোথায় বা যাবে, কোথায় বা খাবে, কোথায় বা ঘুমাবে, আর ইয়াবা খাবার পয়সাই বা সে কোথায় পাবে, সেইরকমের এক নিদারুণ অবস্থায় সে কিভাবে কিভাবে যেন একটা ডাকাতিটাইপ আয়ের উৎস বাইর কইরা নিছিল। সেটা হইল, বিকাশ একাউন্ট প্রতারণা।

রিয়াল খুব ভালো কইরা জানত, একচুয়ালি কারা এই বিকাশ একাউন্ট প্রতারণার শিকার হয়। সাধারণত খুব গরিব মানুষেরা, গ্রামের মানুষেরা। কাজেই ফজিলতের এই কাহিনী তাকে খুবই মর্মাহত করল। তখন সে রিজভিকে অনুরোধ করল, এইসব কিছু আর না বলতে। রিজভি থামল বটে, কিন্তু বোঝা গেল, অনেক কথাই তার বলার বাকি। সেইদিনের পর থেকে রিয়াল রিজভির সঙ্গে আর যে কোনো প্রকার দেখাসাক্ষাৎ এড়াইয়া গেছিল। রিজভি যদিও সেদিনের পরের দিন, পরের দিনের পরের দিন, বেশ কয়েকবার তাকে ফোন করছিল, রিয়াল সেগুলো রিসিভ করে নাই।

ফজিলতের ব্যাপারে রিয়ালের এই গভীরটাইপ অনুভূতির একটা প্রধান কারণ হইল, রিয়ালের বাল্যবেলার যৌনতার সঙ্গে ফজিলতের যোগ আছিল। ক্লাস ফোরে বা ফাইভে পড়বার সময়ে, ময়মনসিংহ কে.বি. হাইস্কুলে, একদিন তাদের কোন একটা ক্লাস মনে হয় হইল না। কিম্বা কী জানি, খেলাধুলা বা অন্য কিছু ছিল মাঠে—তাই ক্লাসরুমে কেউ ছিল না। অন্ধকারের মধ্যে রিয়াল একটা বেঞ্চিতে চিৎ হইয়া শুইয়া মনে হয় ঘুমাইতেছিল। হঠাৎ কইরা প্রবল এক যৌন-উত্তেজনায় তার ঘুম অথবা তন্দ্রাটা ভাইঙ্গা গেল। সে দেখল, তার যৌনাঙ্গটা তখন টনটনে হইয়া আছে। আর ঘাড় ঘুরাইল পরে দেখল—পাশের বেঞ্চিতেই ফজিলত শুইয়া তার দিকেই তাকায় আছে। ফজিলত তারে বলল, ‘কেউ নাই।’ তারপরে একটু অপেক্ষা করল, তারপরে ফজিলত পুনরায় টেবিলের তলা দিয়া হাত বাড়াইল, আর রিয়ালের হাতটাও টাইনা নিয়া বলল, ‘আমারটাও ধর্!’

যাইহোক, কোকের বোতল খাইতে খাইতে আজকেও যখন ঘুম ভাঙছিল, তখনও রিয়ালের যৌনাঙ্গটি স্বাভাবিক ছিল না। অথবা যেহেতু সে উপুড় হইয়া ছিল, সেই কারণেও এমনটা হয়ে গিয়া থাকতে পারে। অন্য কত কারণেও তো হইতে পারে।

ঘুমানোর আগে তো রিয়াল এই বিছানাতেই বৃষ্টি ভাবির সঙ্গে আনন্দ করছিল, তারপরে ঘুমাইছিল। এটাও একটা কারণ। রিয়াল তাই খুব মজবুতভাবেই ধারণা কইরা নিল, আজকের কারণটা কোনোভাবেই ফজিলতের কারণ না। শুধু একমাত্র—যদি সে স্বপ্নে ফজিলতের ওই বাল্যবেলার ক্লাস ফাইভের চেহারাটা দেইখা থাকে, কিন্তু রিয়ালের তেমনটাও মনে হইল না। মনে হইল, না, বরং অন্য কোনো চেহারাই সে দেখছে। কোন চেহারা, সেইটা মনে না আসাই স্বাভাবিক।

ফজিলতের সঙ্গে রিয়ালের সর্বশেষ দেখা হইছিল ক্লাস এইটে পড়ার সময়। কিন্তু ফজিলতের ক্লাস এইটের চেহারাটা কেমন ছিল, সেইটা এখন তার কাছে একটা আবছা আবছা ধারণা, তার বেশি কিছু না। এছাড়া, ক্লাস এইট পর্যন্ত যাইতে যাইতে রিয়াল আর ফজিলতের সম্পর্কটাও আরেকরকমের গিয়া ঠেকছিল। সেইখানে সমকামিতামূলকতা কিছুই আর ছিল না।

রিয়ালের বাপের যেদিন কেওয়াটখালি থানা থেকে অন্য একটা কোথাও পোস্টিং হইয়া গেল, সেই হবার কিছুদিন আগে, একবার সে আর ফজিলত গাঙ্গিনার পারে রাতের শো দেখতে গেছিল। সেই শোয়ের একটা পর্যায়ে হলের লোকেরা বিরাট স্ক্রিনে [সফট]পর্ন ক্লিপ ছাইড়া দিছিল। রিয়ালের খেয়াল আছে, সেদিন তারা নিজেরা কিছুই করতে গেল না ওই হলের ভিতরে, ধরাধরি বা এই জাতীয়। তারা বরং ওইখান থেকে বাইর হইয়া মেয়েদের খুঁজতে লাগল। তারা জানত, সিনেমা হলে রাতের শোতে তেমন মেয়েদের পাওয়া যায়। যদিও তারা হাজার খুঁইজাও তেমন মেয়েকে পাইল না।

এতসব ভাবতে ভাবতে, যদিও ভাবতে কিন্তু বেশি সময় লাগে না, কিন্তু ততক্ষণে সন্ধ্যাটা বলা যায় পুরাই সমাপ্ত হইয়া গেল। যেই অল্প আলোটুকু বাকি ছিল, ছায়ার মতো, সেই আলোতেই রিয়াল দেখল বিছানায় বৃষ্টি ভাবির রক্ত লাইগা আছে। যেন খুব ছোট একটা দেশের মানচিত্রের মতো, বিরাট গোলাপি এক বিছানায়। যেহেতু বৃষ্টি ভাবির মাসিক চলতেছিল, তাই এই রক্ত। তৎমুহূর্তে, রিয়ালের একটু গাঁজা খাইতে ইচ্ছা করল।

বাসস্ট্যান্ডের দিকে গেলে গাঁজা কিনতে পাওয়া যায়। প্রতিবারই নেত্রোকোনায় আইসা সে বাসস্ট্যান্ডের গাঁজা না খাইয়া ফেরে না। সেরকম আকাঙ্ক্ষাতে সে উপরতলায় বৃষ্টি ভাবিরে ফোন করল, বলল, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে একটু বাসস্ট্যান্ড থেকে ঘুইরা আসতেছে। বৃষ্টি ভাবি বলল বেশি দেরি না করতে, কেননা সে আটটার দিকে রওনা হইতে চায়।

৩.
বৃষ্টি ভাবির জামাই, তথা রিয়ালের বড়ভাই—বিদেশ থাকে। ফাঁকে, এই জামাই আর বড়ভাইয়ের অনুপস্থিতিটুকু তারা দুইজন মিলে উপভোগ করে।

এই উপভোগের বরাতে তারা কোনোপ্রকার রাগ, বিরাগ, অথবা অনুরাগ বা অধিকারের জন্ম হইতে দেয় না। দুইজন দুইজনের অসুবিধাগুলারে খেয়াল করে, আর সেই মোতাবেক কাজ করে। যখনই তারা সুযোগ পায়, যে কোনো সুযোগই তারা মিস করে না। আর সুযোগের কোনো অভাবকেও তারা সুযোগ বানাইতে গিয়া বিপদে পড়ে না।

রিয়ালদের বাড়ি গৌরীপুরে, অর্থাৎ বৃষ্টি ভাবির যেটা শ্বশুরবাড়ি। সেখানে তারা এইরকম কিছু করার সুযোগ পায় না। এছাড়াও বৃষ্টি ভাবি শ্বশুরবাড়ি অপেক্ষা বাপের বাড়িতেই বছরের বেশিরভাগ সময় কাটায়। যেহেতু তার স্বামী দেশে থাকে না। রিয়াল ঢাকা থেকে গৌরীপুরে ফিরবার কালে ভাবিকে দেখবার নাম করে, অথবা ঢাকা থেকে আনা একটা-দুইটা কসমেটিক পণ্য ভাবিকে পৌঁছে দিবার ছলে, অথবা বাপের বাড়ির ভাবিকে শ্বশুরবাড়িতে নিয়া যাইবার অথবা ফেরত রেখে যাইবার এইসব কিছু পলে ও বিপলে, সে ভাবির সঙ্গে এইসব আনন্দকাণ্ডগুলা ঘটায়।

বৃষ্টি ভাবির বাপের পেনশনের টাকা দিয়া গড়া এই দুইতলা বাসার নিচতলাতে বৃষ্টি ভাবি আর তার বাচ্চা ছেলেটা—মাসুদ রানা, থাকে। বৃষ্টি ভাবির জামাইয়ের নাম আনোয়ারুল ইসলাম। আর উপরতলায় থাকে তার বাবা-মা, অর্থাৎ মাসুদ রানার নানা ও নানি।

রিয়াল এইখানে আসলে, তাকে নিচের তলা ছাইড়া দিয়া বৃষ্টি ভাবি আর মাসুদ রানা উপরতলায় চইলা যায়। তারপরে কোনো এক নিশ্চিত সুযোগে, হয়তো বা দুপুরবেলায়, অথবা দেবরকে ভাত খাওয়াইতে হবে তাই, বৃষ্টি ভাবি নিচতলায় আইসা হাজির হয়। তাছাড়া মাসুদ রানা কেমন একটু অসুস্থই থাকে সবসময়। ঘুমাইতেই বেশি ভালোবাসে। তখন, মাসুদ রানার ঘুমের মতোই তাদেরও ঘুম-ঘুম অথবা স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগে।

যাই হোক, নিচতলাটা থেকে বাইর হইয়া বাসস্ট্যান্ডের দিকে যাইতে যাইতে রিয়ালের মনে হইল, গৌরীপুরে রওনা দেওয়ার আগে আরো একবার সে ভাবিকে পাইতে চায়। সেরকম চিন্তা থেকে, বাজারের ভিতর দিয়া আগাইতে আগাইতে সে ভাবিকে একটা মেসেজ পাঠাইল। ‘vabi, bair hoar agey, arekbar deikhen…’

সবসময়ের মতো এইবারও রিয়ালের গাঁজা খুঁইজা পাইতে বিশেষ কোনো অসুবিধা হইল না। বাসস্ট্যান্ডের পিছনের দিকের টয়লেটগুলোর ওইখানটাতে, ওই পুরান দলটার থেকেই। গাঁজাটা নিয়া সে একটা বাসের আড়ালে আইসা দাঁড়াইল। তারপরে দুইটা সিগারেটের মধ্যে জিনিসটা ভইরা, এবার সে আস্তে আস্তে মেইনরোড ধইরা বিজিবি ক্যাম্পের দিকে হাঁটতে আরম্ভ করল।

রিয়ালের নেত্রোকোনায় গাঁজা খাওয়ার অভিজ্ঞতাগুলো একইরকম। প্রতিবারই যা প্রায় একই মতন কইরা তার জীবনে ঘটতে থাকে। একটা পর্যায়ে যখন পিছনের বাসস্ট্যান্ডের হইহল্লা ক্রমে বিলীন হইতে থাকে, তখনই রিয়াল প্রথমটায় আগুন ধরায়। এবারও তাই ধরাইল। পিছনের হইহল্লাগুলো ক্রমে বিলীন হইয়া হাইওয়ের হম-হম শব্দটা তারে ধইরা বসল। আরো সম্ভবত, তখনও তার মাথার মধ্যে ফজিলতের কথাগুলোই ঘুরতেছিল। তার যেই বন্ধুটা কিনা, রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছিল। তাছাড়া গাঁজারও তো একটা তাৎক্ষণিক প্রভা অথবা প্রভাব থাকে, সেটাই রিয়ালকে পুনরায় ওই স্বপ্ন, ওই ফজিলত, আর ফজিলতের ওই মৃত্যুতে নিয়া আছাড় মাইরা ফালাইল। তখন বৃষ্টি ভাবির ফিরতি মেসেজটাও তার ফোনে ঢুকল, যে, ‘ajke ar hoitona’।

রিয়ালের কোনোভাবেই বোধগম্য হইতেছিল না, ঠিক কী কারণে সে ফজিলতরে স্বপ্নে পাইতে পারে। এমনকি সেটা কোনো বাল্যবন্ধুর সঙ্গেও নয়, বাল্যবেলার কোনো স্মৃতিতেও নয়। বয়সকালের দুই বন্ধু কুরাইশ আর জোসেফের সঙ্গে। মদের ব্যাপারে-স্যাপারে কুরাইশ আর জোসেফরে স্বপ্নে পাওয়া স্বাভাবিক। রিয়ালের ইদানীং যা মদ খাওয়া এবং মদের যা জোগাড়যন্ত্র, তার সবটাই—এই দুইজনকে কেন্দ্র কইরা ঘইটা থাকে। তবে ফজিলত এইখানে কে? কিভাবে? বিধায়ক রূপে কি? মদের বিধানকর্তা কি? যার কাছে থাকে, আট টাকা পেগ মদের সন্ধান!

তারপরে, রিয়ালের মনে হইল, স্বপ্নে সে যেই অচেনা ঘরটারে দেখছিল, সেইটাও হয়তো বা কুরাইশের বাসাটাই হবে। তাছাড়া, আজকে দুপুরবেলাতেই যেহেতু সে ময়মনসিংহের মাসকান্দা অতিক্রম কইরা আসছিল, তাই স্বপ্নের মধ্যে মাসকান্দাতে ওই অচেনা ঘর আর আট টাকা পেগ মদের দোকান তৈরি হয়ে পড়া—অসম্ভব কিছু নয়। শুধু অসম্ভব যে, যদি আট টাকা পেগ মদের সন্ধান দিতে আসলো ফজিলত। রিয়াল ভাবতে চেষ্টা করল, ছোটবেলায় সে আর ফজিলত আট টাকা দামের কোনো কিছু খাইত বা কিনত কিনা। তেমন কিছু তার মনে পড়ল না। উল্টা পরপর দুই-দুইটা গাঁজা খাইয়া সে ভাবনার এমন এক জটিল অন্তঃপুরে গিয়া পড়ল, সম্ভবত এমনসব অন্তঃপুরে পইড়া গিয়াই মানুষ [মজা কইরা] আত্মহত্যার কথা ভাবতে আরম্ভ করে।

রিয়ালের পাশ দিয়া ছোট ছোট সিএনজি আর বড় বড় বাস ফরফর কইরা ছুটতে ছুটতে যাইতেছিল। এইসব যানবাহনেরা মাত্রই বাসস্ট্যান্ড থেকে ছাইড়া-ছাইড়া আসতেছিল। বাসগুলার বেশিরভাগের গন্তব্য ছিল ঢাকা, কোনোটা কোনোটা ময়মনসিংহ পর্যন্ত গিয়া আবার ফেরত আসবে। সিএনজিগুলা যাবে গৌরীপুর, মাসকান্দা, ব্রিজের পাড়, ইত্যাদি নানান জায়গায়। হয়তোবা গাঁজা খাবার কারণেই, রিয়ালের কাছে এইসব সিএনজিগুলাকে নিতান্ত ঠোঙ্গার মতন লাগল। তার মনে হইল, কোনো একটা বাসের সঙ্গে যদি কোনো একটা সিএনজির একটা কোনাও বাড়ি খায়, তাতে সিএনজিটা উইড়া গিয়া কতদূরে যে পড়বে, তার ইয়ত্তা নাই। অথচ তা সত্ত্বেও, এইসব সিএনজিরা ও বাসেরা, কিভাবে এত স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতেছিল, সেটা ভাইবা রিয়ালের অবাকই লাগল। কিছুক্ষণ পরেই যে তাকে বৃষ্টি ভাবি সহযোগে এই রাস্তা দিয়া গৌরীপুরে যাইতে হবে, সেইকারণেও ভয় হইল।

সে বিজিবি ক্যাম্পের কাছাকাছি পৌঁছাইলে পরে রাস্তার কিনারে একটা গাছের গুঁড়ির উপরে বসল। তখন তার মনে হইল রিজভিরে একটা ফোন করা যাইতে পারে। কেন সে জানে না, তবে তার বিশ্বাস জন্মাইল, এইসময়ে ফজিলতকে নিয়া দুইটা-একটা কথা বললে সে একটু হয়তো প্রশান্তি পাবে।

কয়েকবার ফোন করার পরে রিজভি ফোন ধরল। রিজভি একটু ব্যস্ত ছিল বটে, তবে তার ব্যস্ততার গল্পটাও বয়ানযোগ্য। ঈদের ছুটিতে রিজভির বাপ-মা-ভাই-বোন সবাই গ্রামের বাড়িতে গেছে, কিন্তু রিজভি যায় নাই। এই মুহূর্তে, রিজভির প্রেমিকা হোস্টেল থেকে বাড়িতে যাবার আগের রাতে—একটা রাত রিজভির সঙ্গে খালি বাসায় কাটাইয়া যাইতেছে। হাহা, যদিও রিয়াল এই ব্যস্ততারে বিশেষ পাত্তা দিল না। নানান-নানান কথায়-মথায় ফজিলতের আলাপটা সে তুললই।

এইসব বিষয়ে রিজভির হয়তো আগ্রহ তৈরিই থাকে। বা গার্লফ্রেন্ডের সামনে বইসা থাকার কারণে তার আগ্রহ তৈরিও হইতে পারে। অথবা একজন ইয়াবাখোরের প্রতি তার ঘৃণাপূর্ণ অবস্থান, বা ইয়াবার পরিণতি বিষয়ে তার বক্তব্যপ্রদান, যেন এইসব ব্যাপারগুলাও তার দায়িত্বেরই অন্তর্গত বিষয়। তাই সে ফজিলতের বিষয়ে, অল্পক্ষণের মধ্যেই নতুন নতুন আরো অনেক খবর রিয়ালকে জানাইল। সেগুলোর মধ্যে ছিল একটা বিশেষ খবর, মৃত্যুর বিবরণী হিসাবে রিজভি সেটা বলছিল। আর এই খবরটাই রিয়ালের স্বপ্ন নিয়া করা ফ্যান্টাসি-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, উদ্ধার-কল্পনা, সবকিছুরেই এক লহমায় উপড়াইয়া ফেলল। যেন রিয়ালকে জীবন-মরণের এক সন্ধিক্ষণে আইনা খাড় করাইয়া দিল।

রিজভি যেই ঘটনা বলল, তার সারমর্মটা ছিল এমন—ফজিলত বিদ্যাময়ী কলেজে পড়তে সময়ে যেই মেয়েটার সঙ্গে প্রেম করছিল, আর কয়দিনের মধ্যেই যেই প্রেম সে খোয়াইছিল, অনেকবছর পরে ফেসবুকের সূত্রে ফজিলত ওই মেয়েটাকেই আবার পেয়ে ফেলছিল। রিজভির ধারণা, সেইটাই ফজিলতের জন্য কাল হইছিল। ওই মেয়ের বিয়া হইছিল যার সঙ্গে, সেই লোকটা ছিল খারাপ। ফলেই সে ফজিলতরে পুনরায় পাইছিল মাত্রই তার সঙ্গে আবারও জড়াইতে চেষ্টা করছিল। আর জড়াইতে জড়াইতে, মানে জড়াইতে জড়াইতে, যেইদিন ফজিলত বাইকে কইরা আইসা ওই মেয়েকে নিয়া ঢাকার উদ্দেশ্যে পলাইতেছিল, যাওয়ার বেলায়—সেইদিনটিতেই মাসকান্দায়—তাদের বাইক একটা বাসের তলায় পিষ্ট হইল। মেয়েটা বাঁচল যদিও, ফজিলত মরল।

এই কাহিনী শুইনা, রিয়ালের কাছে—আজকের সন্ধ্যার স্বপ্নটা মৃত্যুর এক গভীর সংকেত ছাড়া আর কী-ই বা মনে হইতে পারে? ভয়ে তার ভিতরের সবটুকু গোপন সত্যই তখন বাহিরে চইলা আসলো। ভাবির সঙ্গে তার যেই পলায়নের প্রকল্প, এইসব কিছু থেকেই সে তৎক্ষণাৎ পরিত্রাণ লইয়া ফেলল। ভাবল, দুই মাস পরে বড়ভাই চইলা আসবে? আসুক। তার দুই মাস পরেই সে নিজে বিদেশে চইলা যাবে। একমাত্র বিদেশে গেলেই সে বৃষ্টি ভাবিকে ভুইলা থাকতে পারবে।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;