বিষধর



রেহানা বীথি
রেহানা বীথি/ছবি: বার্তা২৪

রেহানা বীথি/ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

সেদিন ছিলো মধ্য বৈশাখের ঝাঁ ঝাঁ এক দুপুর। সবুর মিয়া খালি গায়ে ঘাড়ে গামছাটা ফেলে উঠোন পেরিয়ে চলে গেলো বাড়ির পেছনে। ইচ্ছে তার, গায়ে যদি পুকুরপাড়ের নিম, বরুণ আর ওই ঘন পাতায় ছাওয়া কাঁঠালগাছের ঝিরিঝিরি হাওয়া লাগে একটু। যা গরম পড়েছে! বিশাল ভুঁড়িসমেত এই পাহাড়ের মতো দেহখানা ঘামে চুপচুপে সারাক্ষণ। যদি পুকুরপাড়ের ঠাণ্ডা হাওয়ায় শুকায় সেই ঘাম। কিন্তু তা আর হলো না। সবুর মিয়ার চুপচুপে ঘামে ভেজা শরীর নতুনভাবে ঘামতে লাগলো কুলকুল করে। সেই ঘামে পরনের লুঙ্গিখানাও যেন ভিজে গেলো। মনে হলো, লুঙ্গি বেয়ে ঘাম ঝরঝর করে পড়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে তার পায়ের তলার মাটি। কিন্তু তা কি করে হয়? শুধু ঘামেই পায়ের তলার মাটি ভিজে কাদা হয়ে গেলো? এ প্রশ্ন মনে জাগতেই যেন হুশ হলো তার। ভালো করে খেয়াল করে বুঝতে পারলো, ঘাম নয়... কখন যেন পেচ্ছাবই করে ফেলেছে সে। হ্যাঁ, হ্যাঁ... লোকমুখে শুনেছিলো বটে সবুর মিয়া, ভয়ে, আতঙ্কে মানুষের পেচ্ছাব পায়খানাও হয়ে যায়। তাহলে কিনা তারও!

এখন কথা হলো, এত ভয়, এত আতঙ্ক তার হলো কেন? প্রচণ্ড গরমে গা ঘামছিলো বটে, তবে মনটা তো তার বেশ ফুরফুরাই ছিলো। নাহ্, কোনো বিষয়ে একবারও তো আনচান করেনি তার মন! কিংবা কোনো দুশ্চিন্তার রেখা ভাঁজ ফেলেনি কপালে। তাহলে? হঠাৎ কী এমন হলো, যার কারণে ঘাম তো ঘাম, সে একেবারে পেচ্ছাবই করে ফেললো? আর তারপর এই যে দিন দশেক পার হয়ে গেলো, এতটুকুও তো কমলো না সেই সেদিনের আতঙ্ক! বরং বেড়েই চলেছে দিন দিন। প্রতিদিন একটু একটু করে বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে সেই আতঙ্ক, যে মনে হচ্ছে ওই আতঙ্কই একধরনের নেশায় পরিণত হয়েছে তার। তাই যদি না হবে, তাহলে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার পরেও কেন বার বার সবার অগোচরে উঁকি দিচ্ছে বাড়ির কান্টার ওই মজা পুকুরপাড়ে? তাজ্জব ব্যাপার বটে! নানা কিসিমের নেশা থাকে মানুষের, কিন্তু আতঙ্কের নেশা? জেনে বুঝে আতঙ্কিত হতে চাওয়ার নেশা? সে বোধহয় একমাত্র সবুর মিয়ারই আছে। আর এই নেশার কারণে কেমন যেন ঝিম মেরে গেছে সে। থেকে থেকে চমকেও উঠছে, দীর্ঘ দীর্ঘ শ্বাসও ফেলছে। আট ছেলেমেয়ের মা করিমন নেসা, যে কিনা তার বউ। যতন করে সে যখন পানের খিলি সাজিয়ে ধরছে মুখের সামনে, মুখটা কেমন যেন তিতা তিতা আর বিস্বাদ লাগে তখনও। বউটার পান খাওয়া রঙিলা ঠোঁট দু'টো যে এই বুড়া বয়সেও কত সুন্দর লাগে, সেটা আর চোখেই পড়ে না তার। যৌবন বয়সের মতো বউয়ের লজ্জা লজ্জা হাসিমুখটা দেখে হঠাৎই তার মনে উদয় হয় সেই দুপুরের আরেকটা হাসিমুখ। সে মুখ কোনো মানুষের নয়, মুখটা একটা সাপের। কালো কুঁচকুঁচে, কিলবিল করে ছুটে চলা একটা সাপ। ফনা তোলে না তাকে দেখে, শুধু হাসে।

জলজ্যান্ত দু'টো মানুষকে একেবারে হাওয়ায় মিলিয়ে দেয়া চাট্টিখানি কথা নয়। কিন্তু সবুর মিয়া কেমন করে যেন করে ফেলেছিলো সে কাজটা। যদিও কাজটা করতে তাকে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা ভাবনা করে অনেক বুদ্ধি খরচ করতে হয়েছিলো। জীবনে ওই একবারই সে চরম বুদ্ধির পরিচয় দিয়েছিলো। যার কারণে বাকি জীবনটা তার এমনভাবে বদলে গেলো, যে বদলের কথা সে কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবেনি। যার ঠিকমতো পেটের ভাত জুটতো না, ছিলো না সমাজে মান সম্মানের ছিটেফোঁটা, চুরি চামারি করার কারণে দেখতে পারতো না মা বাপও। সেই সবুর কিনা দেখতে দেখতে হয়ে গেলো সবুর মিয়া! গাঁয়ের দশজন মান্যি করে, উঠতে বসতে সালাম দেয় এখন তাকে, সে তো তার সেদিনের সেই বুদ্ধির জোরেই! সেই বছর চল্লিশ আগে যদি সে অমন বুদ্ধির পরিচয় না দিতো, হয়তো অভাবে জর্জরিত হয়ে এতদিনে সে এই সাধের দুনিয়া ছেড়ে চলেই যেতো ওপারে। কিন্তু তা হয়নি। সবুর সেদিন জীবনের মোক্ষম সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছে সবুর মিয়া..... গাঁয়ের মোড়ল। সুখে সম্পদে উপচে পড়ছে তার সংসার। কিন্তু হঠাৎ ওই সাপ? কিলবিল করে চলতে চলতে মাথাটা সবুর মিয়ার দিকে ঘুরিয়ে অমন করে হাসছে কেন সে? যে পুকুরপাড়ে এত বছর ধরে পুঁতে রাখা আছে তার সুখ সম্পদের রহস্য, ঠিক সেই পুকুরপাড়ে, ঠিক ওই জায়গাটাতেই রোজ ওই সাপ আসে কোত্থেকে? আসে তো আসে, তাকে দেখে হাসে কেন? সাপ কি হাসে কখনও? দেখে তো মনে হয়, এতবছর ধরে পুঁতে রাখা গোপনীয়তার সব রহস্য সাপটার জানা। সত্যিই কি তাই? একথা মনে হতেই আবারও ঘেমে ওঠে সবুর মিয়া। টপ টপ করে পড়ে তার ঘাম পাকা দাড়ি বেয়ে।

চল্লিশ বছর আগের সেই মাটিচাপা দেয়া ঘটনার পর কোনোদিন পুকুরপাড়ের জঙ্গল পরিষ্কার করেনি সবুর মিয়া। পাঁচ কাঠা ভিটের ওপর ছনের চাল দেয়া মাটির কুঁড়ে, আর কুঁড়ের পেছনে ছোট্ট পুকুর, কিছু গাছপালা, এই ছিলো তার সম্পদ। ধীরে ধীরে ভিটেতে ওঠে দালান, চকচকে হয় তার জীবন। কিন্তু পুকুরের পাড় আগাছায় ঢাকা। ভিটেয় যখন দালান ওঠে, তখন রাজমিস্ত্রিরা চেয়েছিলো বটে, ঘাটটা ইট সিমেন্টে বাঁধিয়ে দিতে। কেন যেন হায় হায় করে উঠেছিলো সবুর। রাজমিস্ত্রিদের কাছে সে ছিলো এক আচানক ব্যাপার। কেন লোকটা অমন হায় হায় করে উঠলো? পুকুরঘাট বাঁধানো এমন কি খারাপ কাজ! যাই হোক, সবুরের তখন টাকার দেমাগ। গাঁয়ের যেসব লোকজন তাকে কোনোদিন গ্রাহ্যই করেনি, তারা এগিয়ে আসে তাকে দেখে দু'টো কথা বলার জন্য। মুখে কিছু না বললেও, হাবেভাবে বলতে চায় তারা, তোমার উন্নতির রহস্য কি সবুর মিয়া? গঞ্জে বড় দোকান, ভিটেতে ঘরের পর ঘর, ক্যামনে কী? এসব প্রশ্ন তাদের মনে খেলা করে সবসময়, কিন্তু বলে না তারা কিছু। জানে তারা, সবুর এখন বড়লোক, তার টাকার জোর বেজায় এখন। ওসব বলে তাকে খামোখা বিরক্ত করা কেন? তারচেয়ে তারা মনোযোগী হয় সবুরের বিয়ে দিতে। মাথার উপর কোনো বটবৃক্ষের ছায়া নেই যে সবুরের, গাঁয়ের লোকের একটা দায়িত্ব আছে না? দেখে শুনে বিয়ে ঠিকও করে ফেলে তারা। সবুরও রাজি। হবে না? করিমন নেসার রাঙা বেদানার মতো চেহারা চোখে যে নেশা ধরায়। বিয়ে হলো সবুরের। একে একে ছেলেপুলেতে ভরে যেতে লাগলো ঘর। পুকুরপাড়ে পুঁতে রাখা রহস্য দিন দিন ঢেকে গেলো ঘন জঙ্গলে। অব্যবহারে টলটলে পুকুর হয়ে গেলো মজা পুকুর। কেউ যায় না ওই জঙ্গলের মধ্যে তেমন। শুধু সবুর মিয়াই মাঝে মধ্যে যায় কাঠের একটা টুল হাতে করে। গিয়ে বসে থাকে কিছুক্ষণ। ওই সেদিন.... সেই ঝাঁ ঝাঁ দুপুরে যেমন গিয়েছিলো!

সেই দুপুরের পর হঠাৎ করেই যেন সত্যি সত্যি একটা বৃদ্ধ মানুষে পরিণত হলো সবুর মিয়া। তার একদিন আগেও নিজেকে কখনও বুড়ো ভাবেনি সে। বুকের ভেতর যে দপদপা তেজ ছিলো, হঠাৎ করেই কেমন যেন মিইয়ে গেলো তা। দিনরাত সবসময় চোখে ভাসে ওই সাপ, আর তার ঘাড় ঘুরানো হাসিটা। করিমন নেসা সুধায় তাকে,
-- আপনের কী হইলো? পাহাড়ের মতো ওই দেহে বয়স তো ছাপ বসাইবার পারে নাই এতদিন। হঠাৎ এমুন ঝিমাইয়া পড়লেন ক্যান?
একটা দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে জবাব দেয় সবুর মিয়া,
-- কিছু না গো বউ! কিচ্ছু হয় নাই আমার! খালি কইজাডায় কেমুন জানি অস্থির অস্থির লাগে। আইচ্ছা বউ, তুমি কি কুনুদিন কুনু সাপরে হাসবার দেখছো?
-- হায় আল্লাহ্, কী কন আপনে! মাথাডা কি খারাপ হইলো আপনের? সাপে হাসবো কেমুন কইরা? অবলা জীব, না পারে হাসতে, না পারে কথা কইতে। খোদা তালা তো কেবল মানুষরেই দিছে সেই ক্ষমতা। কথা কওনের, হাসোনের, বুদ্দি কইরা কাম করনের। এই জন্যেই তো মানুষ আল্লাহ্ তায়ালার সেরা জীব।
-- হ বউ, ঠিকই কইছো তুমি। মানুষ হইলো সেরা জীব। আমরা হইলাম আল্লাহ্ তায়ালার এক নম্বর বান্দা। আমাগোরে কেউ হারাইতে পারবো না। সাপ তো দূরের কথা!

করিমন নেসা ভাবনায় পড়ে, তার স্বামীর হইলোডা কী? সাপ সাপ করে ক্যান?
বিছানায় গা এলিয়ে চোখ বুঁজে আছে দেখে আর কিছু বললো না করিমন নেসা। না জানি কি দুশ্চিন্তার মধ্যে আছে লোকটা, ঘুমাক একটু। এই বয়সেও ধকল তো কম যায় না। গঞ্জের এতবড় দোকান, এত জমিজিরাত, সবকিছুর হিসাব তো তাকেই রাখতে হয়। পোলারা তো বউ বাচ্চা নিয়া ঘুরণ ফিরোনেই ব্যস্ত। বাপের টাকার মর্ম বোঝে না তারা। খালি উড়ানোর ধান্দা। সিনেমা দেখা, আইজ এই মেলা তো কাইল সেই মেলা। নিত্যনতুন জামাকাপড়। আর খাওনের কী ঠাঁট! গাঁ কি আর গাঁ আছে এখন? টিভির চ্যানেল ঘুরাইয়া বিদেশি সব রান্না-বান্না দেইখা মুখস্ত কইরা রাখে পোলার বউরা। কিসব টক-মিষ্টি মিশাইয়া মুরগি রান্ধে, ভাজেও মচমচা কইরা। মাছের কাঁটা বাইছা হাত দিয়া চটকাইয়া মশলা মুশলি দিয়া আঙুলের মতন লম্বা বানায়। সেইগুলারে আবার বিস্কুটের গুঁড়ায় গড়াইয়া ভাইজ্জা ভাইজ্জা খায়। ক্যান, মাছ এমনি রাইন্ধা খাওন যায় না? যত্তসব! এত কষ্টে তৈরি বাপের সায় সম্পত্তি ওরা যেন ঘুরে ফিরে খেয়েই শেষ করে দেবে। ভয় হয় করিমন নেসার, বাপটা চোখ বুঁজলে সব উইড়া যাইবো না তো! সম্পত্তি ধইরা রাখোনের যোগ্যতা তো চাইর পোলার এক পোলারও হইলো না এতদিনেও! মাইয়ারা তো পরের ঘরে। অরা আর কী করবো! বাপের সম্পত্তি তো পোলারাই বাড়ায়। তার স্বামী সবুর মিয়ার কিছুই তো ছিলো না। নিজের বুদ্ধি দিয়ে, খাটনি দিয়ে তিল তিল করে গড়ে তুলেছে সব। শুনেছে সব করিমন নেসা স্বামীর কাছে। সেই মানুষটাই আজ অস্থির? হবে না কেন? নিশ্চয়ই ছেলেদের উড়নচণ্ডি ভাব দেখে মনে মনে সে খুব কষ্ট পায়। হয়তো মুখ ফুটে কিছু বলতে পারে না। তাই হয়তো কয়েকদিন ধরে তার এমন অস্থিরতা আজ প্রকাশ পেলো এমন উল্টোপাল্টা কথায়! কে জানে!

আহারে, একটু চোখ বুঁজছে লোকটা, বুজুক!বোধহয় ঘুমাইয়াই পড়ছে, ঘুমাক... একটু ঘুমাক!
বাড়ির পেছন দরজাটা একহাতে ঠেলে খুলে ফেললো সবুর মিয়া। আরেক হাতে তার ছোট্ট কাঠের টুল। একটু বসবে সে পুকুরপাড়ে। না, আজ গরম নেই। আকাশের পূব থেকে দক্ষিণ, পুরোটা জুড়ে ঘনকালো মেঘ। ঝড় আসবে বোধহয়। বসে বসে মেঘ দেখবে সে। দেখবে কেমন করে সেই মেঘ পাক খেয়ে খেয়ে ঝড়ে রূপ নেয়। তার বুকের ভেতর যে ঝড় বইছে ক'দিন ধরে, তেমনটাই কী? দেখবে সে।

বসে আছে সবুর মিয়া। মাথার ওপর মেঘেঢাকা আকাশ। কালো। সেই কালো মিশে গেছে মজা পুকুরটার পানিতে। পুকুরের পানি এখন আরও মিশমিশে, অন্ধকার। হঠাৎ কটমট করে শব্দ হলো নিম গাছটার ডালে ডালে। কচি কচি পাতাগুলো কেন যেন অযথাই ঝরে ঝরে পড়তে লাগলো গাছতলায়। বাঁকানো বরুণ গাছের সাদা সাদা ফুলগুলো থেকে মাতাল মাতাল গন্ধ ভেসে আসছে। সেই গন্ধ শুঁকছে একটা সাপ। কালো, চকচকে তার গা। কিলবিলে লেজটা নড়ছে এমনভাবে যেন সাপটা গাছ থেকে নামবে এখনই। সবুর মিয়া স্থির, ঠিক যেন পাথর। সাপটা মুখ তুললো ফুল থেকে। ঘাড় ঘুরিয়ে এমন করে হাসলো সবুর মিয়ার দিকে তাকিয়ে, যেন ফুলের গন্ধে মোহিত সে। সড়সড় করে নেমে আসতে লাগলো বাঁকানো বরুণ গাছ বেয়ে। তারপর হঠাৎ যেন মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়।
কোথায় গেলো...... কোথায় গেলো?

নড়ে উঠলো পুকুরপাড়ের ঝোপঝাড়গুলো। সবুর মিয়া নেশাগ্রস্তের মতো তাকিয়ে আছে ওদিকে। ওই তো.... ওই তো সাপটা! কিন্তু ওর পাশে ওটা কে দাঁড়িয়ে? ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ, পরনে ধূতি পাঞ্জাবি!
-- কে... কে ওটা? কে তুমি?
-- আমারে চিনবার পারো নাই সবুর? ভালো কইরা দেখো তো!
-- চিনি না, চিনি না তোমারে! কে তুমি?
-- আশ্চর্য, আমারে ভুইলা গ্যালা! কেমুন কইরা ভুললা তুমি আমারে, আমার বিশ্বস্ত সহচর! ভুইলা গ্যালা, পুকুরপাড়ে পুঁইতা রাখছো তুমি আমার ভালোবাসা, আমার বিধবা বউরে? আমার পোলারে?
-- কই? আমি কিচ্ছু পুঁতি নাই! ক্যান পুতুম। কী পুতুম!
-- আমি সব জানি সবুর। এই অনিল কর্মকাররে তুমি মিছা কথা কইয়া পার পাইবা না। তুমার বাপে মরার আগে হাতে পায়ে ধইরা আমার দুকানে তুমারে কামে রাখবার কইছিলো। তার কথা ফেলবার পারি নাই। আজীবন কাম করছে তুমার বাপ আমাগো দুকানে। মরণের সময় তার কথা ফেলি ক্যামনে? তাই তো তুমার মতো বজ্জাত পোলারে কামে রাখছিলাম। চুরি চামারি করবার ধরছিলা তুমি। ধরা পইড়া মাইর খাইতা মাইনষের কাছে। তুমার বাপ মনে করছিলো আমার দুকানে থাকলে ভালা হইয়া যাইবা তুমি। তুমার মা'টাও তুমার কুকর্মের ব্যথা সইয্য করবার না পাইরা ধুইকা ধুইকা মইরা গেলো। একটাই পোলা ছিলা কিনা মা বাপের। কিছুদিন তো মনে হইতো ভালা হইয়া গেছো তুমি। বিশ্বাস করতে শুরু করছিলাম তুমারে। সেজন্যেই তো সোনাদানা রাখছিলাম বিশ্বাস কইরা। কিন্তু কই? ভিতরে ভিতরে তুমি সেই বজ্জাতই রইয়া গেছিলা। বুঝবার পারি নাই আমি, হায় রে!
-- কে কইছে তুমারে, ভালা হই নাই আমি! জানো, এখন গাঁয়ে আমার কত সম্মান? সবাই আমারে সবুর মিয়া কইয়া ডাকে। মোড়ল আমি গাঁয়ের। আমার কত সম্পত্তি জানো তুমি?
-- জানুম না ক্যান? আমি আমার দুকানের সমস্ত সোনা, রূপার গয়না আর টাকা পয়সা তুমার কাছে জমা রাইখা ভারত পালাইলাম। আমার বাবা কাকারা আগেই গেছিলো সেই দ্যাশে। মুক্তিযুদ্ধ যখন খুব জোরদার তখনও আমি দ্যাশ ছাইড়া যাইবার চাই নাই। কিন্তু আমার পোলা মাইয়া আর বউয়ের মুখের দিকে চাইয়া যাইতে রাজি হই। না গেলে তো পাকিস্তানীরা পাখির মতো গুলি কইরা মারতো।
অবশ্য যাইয়াও কী লাভ হইলো? পথেই গুলি খাইলাম আমি। বউরে কইলাম, তুমার কাছে সব আছে। টাকা পয়সা, গয়নাগাটি সব। যদি কুনুদিন দ্যাশ স্বাধীন হয়, আইসা সবুরের কাছে সব পাইবা।
-- আসে নাই তো তুমার বউ! আসলে তো দিয়াই দিতাম সব।
-- আসে নাই? এক থাপ্পড়ে তুমার বাকি দাঁতগুলা ফালাই দিবো আমি। দ্যাশ স্বাধীনের সাত বছর পর পোলারে নিয়া আসে নাই সে? আইসা কত তুমার হাতে পায়ে ধরলো, তুমি দিলা না কিছুই। অস্বীকার করলা সবকিছু। পরের দ্যাশে টাকার অভাবে খুব কষ্টে পড়ছিলো বইলাই পোলার হাত ধইরা আসছিলো তুমার কাছে। দুকানের সোনাদানা কম তো ছিলো না! সেগুলা পাইলে কষ্ট লাঘব হইতো তাগো। তা না দিয়া তাগোরেই তুমি সরায়া দিলা দুনিয়া থাইকা। মাইয়াডারে মা ভাই হারা করলা? কইরা আবার মিয়া সাইজ্জা বইছো? গাঁয়ের মোড়ল! পরের ধনে মোড়ল? আমার বউ আর পোলারে খুন কইরা, কুচি কুচি কইরা কাইটা, পুকুরপাড়ে পুঁইতা রাইখা তুমি সবুর মিয়া সাজছো?

অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো অনিল কর্মকার। গায়ের লোমগুলো এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে গেলো সবুর মিয়ার। সাপটা ততক্ষণে একেবারে তার পায়ের কাছে। ঘুরছে কিলবিল করে তার পায়ের চারিদিকে। কালো মেঘগুলো যেন আকাশ ছেড়ে নেমে এসেছে সবুর মিয়ার মাথার ওপর। প্রচণ্ড কড়কড় শব্দে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঠিক তার মাথার ওপরেই! বাজ পড়ে ঝলসে যাবে বুঝি তার পাহাড়ের মতো দেহখানা। ওই তো অনিল কর্মকার! বিদ্রুপের হাসি হাসছে তাকে দেখে, আর বলছে.... তুমি মরবা... এইবার তুমি মরবা সবুর! কেউ পারবো না তুমারে বাঁচাইতে! যে পাপ তুমি করছো, সেই পাপ-ই তুমারে দংশন করবো সাপ হইয়া। দেখো নাই, ক্যামন কইরা হাসে সে তুমারে দেইখা? ওইডাই তুমার মরণ সবুর... ওইডাই তুমার মরণ!

আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায় সবুর মিয়ার । পা দু'টো ছুঁড়তে থাকে এদিক ওদিক। কিছুই দেখা যায় না ক্যান? এত আন্ধার ক্যান? সে কি দোযখে? মরণের পর দোযখে জায়গা হইছে তার? এখন তারে আগুনে পুড়ানো হইবো? ভাবতেই যেন সারাশরীরে আগুনের ভয়াবহ তাপ অনুভব করলো সে। ছুটে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে সিথানে রাখা চর্চ হাতে নিয়ে। সোজা চলে গেলো বাড়ির কান্টায়। পুকুরের পানিতে ডুব দিতে হইবো এক্ষণি, দেরি করা যাইবো না! দেরি করলে তো পুইড়া অঙ্গার হইয়া যাইবো তার দেহ!

তখন ছিলো গভীর রাত। বৈশাখের শেষ দিনের কালবৈশাখীতে লণ্ডভণ্ড পুকুরপাড়ের ঝোপঝাড়। ধীরে ধীরে রাত এগোয় ভোরের দিকে। ফজরের আজান হয়। করিমন নেসা বিছানা হাতড়ে স্বামীকে পায় না। ঘর ছেড়ে উঠোনে নামে সে। দেখে পেছনের দরজা হাট করে খোলা। কোনো এক ছেলের নাম ধরে জোরে চিৎকার করে সে। জেগে ওঠে সবাই। পায়ে পায়ে সবাই এগিয়ে যায় কান্টায়। আলো আঁধারিতে সবাই দেখে পুকুরপাড়। দেখে আর আতঙ্কিত হয়। একটা কালো কুঁচকুঁচে সাপ পেঁচিয়ে রয়েছে সবুর মিয়ার কণ্ঠনালী, কিলবিল করছে। মুখটা অল্প হাঁ হয়ে আছে সবুর মিয়ার। কাঠ হয়ে পড়ে আছে তার বিশাল দেহখানা। বোঝা যায়, প্রাণ নেই ও দেহে।

   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;