ঘানি



রেহানা বীথি
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

মসজিদের মিনার ডিঙিয়ে তেরছাভাবে রোদটা এসে পড়েছে একেবারে নুরু মোড়লের খড়ের চাল পেরিয়ে উঠোনটায়। কিছুক্ষণ আগেও ওখানে ছিলো জমজমাট কুয়াশা। ফজরের নামাজ পড়ে বিছানাতেই শুয়ে থাকে নুরু মোড়ল। বেটার বউরা কড়া করে নিষেধ করে দিয়েছে, এই শীতে অতো ভোরে বাইরে না বেরোতে। কিন্তু মনটা তাও আঁকুপাঁকু করে। কত আর শুয়ে থাকা যায়! চুপিচুপি বেরিয়ে গেছিলো দিন দশেক আগে। লাঠিতে ভর দিয়ে পায়ে পায়ে ঘর পেরিয়ে উঠোন, উঠোন পেরিয়ে বাঁশের ঝাঁপ টা সরিয়ে একেবারে রাস্তায়। কুয়াশায় সাদা চারপাশ। তারওপর ছানিপড়া চোখ। কিছুই দেখতে পেলো না ঠিকমতো। কিন্তু যা হওয়ার তাই হলো। বিকেল হতে না হতেই নাক, গলা সব বুঁজে এলো সর্দিতে, সাথে ধুম জ্বর। বুড়ো হাড়ে পৌষের হিম সইবে কেন? সেই থেকে বৌমারা চোখে চোখে রাখে। হেঁসেল থেকে গলা বাড়িয়ে দেখে নেয়, শ্বশুর ঘরে আছে তো? তারপর থেকে ভোরবেলাটা ঘরেই থাকে নুরু মোড়ল। পেচ্ছাব টেচ্ছাবের বেগ সে ফজরের নামাজের আগেই সেরে নিয়ে, বিছানায় বসে বসে নামাজ পড়ে শুয়ে যায় লেপ গায়ে দিয়ে। সারারাতে গরম হওয়া লেপটার ওমে তখন আরাম লাগে বেশ। আবারও জড়িয়ে আসে চোখ। যেন আধো ঘুম আধো জাগরণ। মৃদু ঝাঁঝালো কিন্তু খুব মিষ্টি একটা সুবাস নাকে ধাক্কা দেয় তার। চোখে ভাসে দিগন্তজোড়া হলুদ। পৌষের হিম হাওয়ায় দুলছে সেই হলুদ..... সেই সর্ষে ক্ষেত।

জেগে ওঠে নাতি নাতনিরা। বেটার বউরা হাঁস-মুরগিগুলো ছেড়ে দেয়। ছড়িয়ে দেয়া দানা খুটে খেয়ে বেরিয়ে যায় ওরা। পৌষেও জেগে ওঠে পাড়া। নুরু মোড়লও জেগে ওঠে পুরোপুরি। বিছানা থেকেই বার বার উঁকি দিয়ে দেখে কুয়াশার হালকা হওয়া। রোদটা যখনই মসজিদের মিনার ডিঙায়, টুক টুক করে এসে বসে সে উঠোনে। সূর্যের ওমে পিঠ পেতে দিয়ে দেখতে থাকে পথচারী চলাচল। টুংটাং সাইকেল রিকশা, দুই একটা অটোও যাওয়া আসা করে হেলেদুলে। মন্থরগতি গরুর গাড়িও দেখা যায়। তবে এখন খুব কমে গেছে সে গাড়ি। তার জায়গা দখল করে নিয়েছে ট্রলি নামক বিকট শব্দওয়ালা এক বাহন। সামনে বসানো শ্যালো মেশিনই যার ইঞ্জিনের কাজ করে। নুরু মোড়লের খুব রাগ হয় ওগুলো দেখে। কোথায় গরুর গাড়ি আর কোথায় এই ট্রলি! একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক থেকে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে নিজের শূন্য ঘানির ঘরটার দিকে চেয়েও। তিনদিকে মাটির শক্ত দেয়াল, ওপরে খড়ের চাল। অব্যবহৃত ঘানিটাও যেন তাকিয়ে আছে নুরু মোড়লের দিকে। বুকের ভেতরটা কেমন এক অজানা কষ্টে ভরে যায়। মনে পড়ে সেই ভোরবেলার ঘুমঘোর... সেই নাকে ধাক্কা দেয়া সর্ষেফুলের সুবাস!

নুরুল ইসলাম নাম তার। কোনোকালে বংশে হয়তো কেউ মোড়ল ছিলো, সঠিক জানা নেই। তারই রেশ ধরে গাঁয়ের লোকজন মোড়ল ডাকে। পেশা ছিলো যার ঘানি ঘুরিয়ে তেল বানানো। বংশীয় পেশা। এ রূপমতী গাঁয়ে তো বটেই, আশেপাশের দু'তিন গাঁয়েও নুরু মোড়লদের ঘানিই ছিলো একমাত্র ভরসা। সেই ঘানিই কিনা অকেজো এখন। কী যুগ এলো! কারেন্টের আলোতে রাতগুলো দিনের মতো।চারিদিকে শুধু মেশিনের ছড়াছড়ি। জমিতে হাল দেয়া, ধান মাড়ানো, ধান ভাঙানো, আটা ভাঙানো, এমনকি সর্ষেও! সব মেশিন, সবই মেশিন। বড়ছেলেকে বলেছিলো, বংশের ধারাটা বজায় রাখতে। কে শোনে কার কথা? ঘানির বলদদুটোকে বেঁচে দিয়ে মুদিখানার দোকান দিলো । বাড়ির উঠোনটা ঘিরে রেখেছে যে চাটাইয়ের বেড়া,তারসাথে লাগানো সেই দোকান। বেচাবিক্রি ভালোই হয়। তা হোক,তবুও বংশের পেশা ছেড়ে দেয়ায় নুরু মোড়লের রাগ রাগ ভাবটা থেকেই গেছে ছেলের ওপর। ছোট দুই ছেলে যেটুকু জমিজিরাত আছে তাতেই করে কর্মে খায়। দুই মেয়ে বিয়ে হয়ে পরের ঘরে। বচ্ছরে দুই তিনবার ছেলেপুলে নিয়ে আসে বাপের বাড়িতে। 

থেকে যায় ক'দিন করে। বাড়িটা তখন নাতি নাতনিতে ভরপুর। বড় ভালো লাগে নুরু মোড়লের। ভালোলাগায় চোখ ভিজে যায়। বুড়ির কথাও মনে পড়ে তখন। কেন যে এ ভরা সংসার রেখে ওপারে চলে গেলো বুড়িটা তাকে ফেলে! রোদে পিঠ পেতে বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন ঝিমুনি চলে আসে। সাদা হয়ে যাওয়া পাঁপড়িওলা চোখের পাতা বুঁজে আসতে চায়। দড়ির চৌপায়ায় বসা নুরু মোড়লের বৃদ্ধ শরীরটা গুটিয়ে এতটুকু। ঠিক যেন কাপড়চোপড়ের একটা পুঁটলি।

দাদা, চলো, মা ডাকে। খাবা না?

ধীরে ধীরে মুখ তুলে চায় নুরু মোড়ল। আবছা দৃষ্টিতেও নাতনির মুখটা বড় সুন্দর লাগে তার। যেন দাদির মুখটা কেটে বসানো ওই মুখে। তেমনই সোনার মতো গায়ের রঙ, পিঠে ছড়ানো ঘন কালো চুল। ঝকঝকে মুক্তোদানার মতো দাঁতগুলো মেলে যখন হাসে নাতনি, অবিকল যেন ওর দাদি, সেই যৌবনের জহুরা খাতুন!

-- আব্বারে একটু বুজাইলেও তো পারো। তোমারে খুব মায়া করে।

--  আমি পারুম না। ওই ঘর আব্বার জানের চাইতেই বেশি। শ্বাশুড়ি বুক দিয়া আগলাইয়া রাখছিলেন ওইডা। দুইজনে মিইলা ঘানি ঘুরাইয়াই তো তোমাগো মানুষ করছে।

--  মানুষ করছে না ছাই! লেহাপড়া শেখাই নাই। লেহাপড়া শিখাইলে আইজ....

--  কী কও? চুপ করো। তোমাগো দৌড় জানা আছে। শ্বাশুড়ির মুখে শুনছি, চেষ্টা কিছু কম করে নাই। তোমরা ভাইগুলানই বলদ । ঘানির বলদগুলারও কিছু বুদ্দি থাকে, তোমাগো তাও নাই। থাকলে ঠিকই লেহাপড়া শিখবার পারতা।

বউয়ের ধমক খেয়ে কিছুটা চুপসে যায় মাসুদ আলী। ঠিকই তো। মা মেলা চেষ্টা করছিলো বটে। তয় তাগো মাথায় আসলেই গোবর। নাইলে অন্ততঃ ম্যাট্রিকটা তো পাশ করবার পারতো! যাক, না পারলে কী আছে, দোকান আর জমি দিয়া তো তাগো ভালোই চইলা যায়। তয় এখন খরচ বাড়তাছে। পোলা মাইয়াগুলা লেহাপড়া করে। তাগো বই খাতা পেরাইভেটের খরচ। মাইয়াডা আইএ ক্লাসে পড়ে। দূরে কলেজ, হাঁইটা যাইতে কষ্ট খুব। অটোতে যায়, ভাড়া লাগে। পোলাডা বি এ পাশ কইরা এম এ ভর্তি হইলো। তারও মেলা খরচ। সে অবশ্য সাইকেলেই চলাফেরা করে। দুই ভাইয়ের বাচ্চারাও বড় হইতেছে। খরচও বাইড়া গেছে। জমির ধান খাইয়া আর বেচতে পারে কই? তারওপর ধানের দামও কম। বেইচাও খুব একটা লাভ হয় না।

গাঁয়ের মানুষ এখন খুব সৌখিন হইছে। আগের মতোন দুইখান কাপড়েই বচ্ছর চালায় না। যাগো ট্যাকা আছে তারা সারাবচ্ছরই কিনতে থাকে। ঈদ পরব তো আছেই।

তাই মাসুদ আলীর শখ জেগেছে মনে মনে, একখান গার্মেন্টস এর দোকান দেয়। রেডিমেড জামাকাপড় শহর থেকে এনে বেচে সেই দোকানে। শহরেও ভাড়া নিয়ে দোকান দেয়া যায়, কিন্তু ভাড়া যে মেলা! তারচাইতে নিজের বাড়িতেই যদি ওই অকেজো ঘানির ঘরটা পাওয়া যায়, ঠিকঠাক করে ওখানেই দোকান দেবে বড় করে। গাঁয়ের লোকজনকে আর কষ্ট করে শহরে যেতে হবে না কাপড় কিনতে।বউটাকে মনের সে কথা জানায় সে। বউটাও নিমরাজি, কিন্তু শ্বশুরকে ওই ঘরের কথা বলতে পারবে না কিছুতেই।

চুপসে গেলেও বউকে শুনিয়ে শুনিয়ে গজ গজ করতে থাকে মাসুদ, কি হইবো ওই ঘর রাইখা। ঘানি তো আর ঘুরবো না কুনুদিন। কে ঘুরাইবো ঘানি?

--  না ঘুরলে কী? শ্বশুর কয়, শ্বাশুড়ির আত্মা ঘোরে ঘরখানায়। দেখো না, লাঠি ঠকঠকাইয়া মাজে মদ্যেই কি যেন খুইজ্যা বেড়ায় ওইখানে। দূর থাইকাও কেমুন উদাস চাইয়া থাকে। বড় মায়া লাগে গো! বুড়া মানুষটার জইন্যে খুব মায়া লাগে। কত বছর হইলো বউ মরছে, তবুও দেহো, কেমুন ভালোবাসে এহনও বউরে!

বলে একটু আদুরে অভিমানী গলায় বলে স্বামীকে, আমারে তো তুমি একটুও ভালোবাসো না। বাসলে বুঝতা বাপের মনডা।

তাছাড়া দোকানের মাল কিনতেও তো ট্যাকা লাগবো, পাইবা কই?

চোখের দৃষ্টিতে কি যেন খেলে গেলো মাসুদের। বউয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো, আব্বারে কইয়া দশ কাঠা জমি বেইচা দিমু!

অবাক হয়ে স্বামীর দিকে তাকায় শেফালি। এইডা কী কইতাছো, আব্বা রাজি হইবো না। যেটুক জমি আছে, পাঁচ ভাই বইনের। তুমি বেচবার চাও কোন সাহসে? তুমার কি মাথা খারাপ হইয়া গেলো?

--  মাথা খারাপ হইবো ক্যান? দোকানের ইনকাম কি অরা খাইবো না? আর ওই ঘরখান, বুকের মইদ্যে ঘানি লইয়া খাড়ায় আছে, কি দাম আছে তার? খামাখা ফালায়া রাইখা হইবোডা কী? যত্তসব ফালতু!

বিছানা থেকে নেমে মাটি কাঁপিয়ে হেঁটে বাতিটা নিভিয়ে দিলো মাসুদ আলী। বিছানায় এসে জোরের সাথে লেপটা টেনে গায়ে জড়িয়ে শুয়ে পড়লো বউয়ের দিকে উল্টো হয়ে।

এশার নামাজ পড়ে বিছানাতেই গুটিসুটি শুয়েছিলো নুরু মোড়ল। তসবি গুনতে গুনতে কানে এলো আবছা, ছাড়া ছাড়া কিছু কথা। খুবই আবছা, তবুও বুকের ভেতরটা কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো কথাগুলো শুনে। এ কী বলছে ছেলে! নাকি ভুল শুনছে সে? ভুলও হতে পারে। ছেলে তার এমন কথা ভাবতেই পারে না। ঘানি চালাতে রাজি হয়নি বটে, তবে ঘরটা তো এতদিন যেমন ছিলো তেমনই রয়েছে। একদিনও তো ছেলেরা ভেঙে ফেলতে চায়নি তা! একদিনও তো বলেনি কেউ, ওটার কোনো দরকার নেই, মুছে ফেলি ওই স্মৃতি! তাহলে আজ কেন পাশের ঘরের আওয়াজ ভেসে এলো মাটির দেয়াল ভেদ করে? ভুল ভুল, নিশ্চয়ই ভুল! 

কোনটা ভুল, ছেলের কথাগুলো নাকি নুরু মোড়লের ভাবনা? হতেও পারে। পুরোনো স্মৃতিকে এভাবে আঁকড়ে থাকাটা ভুল হতেও পারে। সত্যিই তো! সংসার বেড়েছে, বেড়েছে খরচও। ওই ঘরটা যদি কাজে লাগায় ছেলে নিজের মতো করে, ক্ষতি কী? গাঁয়ের অনেক মাটির বাড়ি এখন পাকা। তার ছেলেরাও তো চাইতে পারে উন্নতি হোক। মাটির দেয়াল ভেঙে ইট সিমেন্টের ভিত উঠুক ভিটেতে তাদের। খারাপ তো কিছু চাইছে না ছেলে। না না, ভুল তারই। ওই ঘর, ওই ঘানি তার বংশের ইতিহাস। সে ইতিহাস পাল্টাতেও তো পারে। শুরু হতে পারে নতুন গল্প, নতুন ইতিহাস। জহুরার বাস তো তার অন্তরে। অন্তরেই থাকবে। ছেলেরাও তো তাকে কখনও অযত্ন করেনি। ছেলের বউরাও যেন নিজের সন্তানের মতো আগলে রেখেছে তাকে। মৃত শ্বাশুড়ির কথাও তো তারা স্মরণ করে সম্মানের সাথে। ওদের মনে কষ্ট লাগে এমন কিছু হোক চায় না তা নুরু মোড়ল। ওরা ভালো থাক, নাতি নাতনিরা মানুষ হোক, এর বাইরে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে তার? সকালে উঠেই ছেলেকে বলতে হবে, আপত্তি নেই, সাজিয়ে তুলুক দোকান সে নিজের মতো করে। ভবিষ্যত গড়ে তুলুক তাদের সন্তানদের।

রাত বাড়ে, পৌষের হিমে ঘন হয়ে আসে আঁধার। শান্ত হয়ে আসে নুরু মোড়লের বুকের উথাল পাথাল। মনটা তার হালকা লাগছে অনেক। যেন অনেকটাই নিশ্চিন্ত লাগে নিজেকে। ছেলেরা তাদের নিজেদের জীবন বুঝে নিতে শিখেছে, এর চেয়ে বড় সুখের আর কী হতে পারে? এবার সে নিশ্চিন্তে চলে যেতে পারে ওপারে। ওখানে যে জহুরা তার অপেক্ষায় আছে! ওই তো ডাকছে তাকে জহুরা। ডেকে ডেকে মিলিয়ে গেলো যেন কোথায়! কোথায় যেন মিলিয়ে গেলো ঘানির জোয়ালের ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ। মিলিয়ে গেলো যেন ফোটায় ফোটায় তেল পড়ার শব্দ । সর্ষের তেলের ঝাঁঝও যেন মিলিয়ে গেলো বাতাসে, নতুন কোনো গল্প হয়ে।

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;