মধুপ-কাহিনী



রহিমা আখতার কল্পনা
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

বিষয়টা হঠাৎ করেই, বহু বছরের ব্যবধানে আমাকে চমকে দেয়। কিংবা তার চেয়েও বেশি। বলা যায়, আমাকে আমূল নড়িয়ে দেয়। আমার বন্ধু শামীম, শামীম খন্দকার—মাঝখানে ন’বছরের অদর্শন সত্ত্বেও, তার চেহারা সুরতে নয়টি বছরের পরিষ্কার পরিবর্তনের ছাপ বহন করা সত্ত্বেও, কথাটি এমন সহজে বলে, যেন এটি গতকাল বা পরশুর ঘটনা। যেন রোজ আমাদের দেখা হয়। যেন ঘটনাটি ঘটবার পর পুরো ঊনিশটি বছর কেটে যায়নি। প্রসঙ্গটা কিভাবে যেন উঠেছিল মনে নেই। এক পর্যায়ে শামীম বলে
- দোস্ত, সেদিন তোমার পরনের শাড়িটা ছিল সবুজ, খুব তাজা সবুজ।
আমি চমকে যাই—শাড়ির রঙটাও তোমার মনে আছে?
- হ্যাঁ। সবুজ। পাড়টা লাল। এ দু’টো রঙের মিশেল কি ভুলে যাওয়া সম্ভব! বিশেষ করে একজন বাঙালির পক্ষে?

সামান্য ক’টি বাক্য, কয়েকটি মাত্র শব্দ, অথচ কী যে হয়ে যায় আমার ভেতরে। আশ্চর্য, এতগুলো বছরের এত হাজার হাজার দিনের লক্ষ লক্ষ ঘণ্টার দীর্ঘ সময়ে কথাটা একবারও আমি ভাবিনি। কেন ভাবিনি?

আমাদের জাতীয় পতাকার, আমার মাতৃভূমির, আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক লাল-সবুজ কম্বিনেশনের শাড়ি আমার খুব কম বয়স থেকেই পছন্দের। প্রায়ই পরি। এখনো। লাল শাড়ি সবুজ পাড়। সবুজ শাড়ি লাল পাড়। পাড়হীন সবুজ থান অথবা পাড়হীন গাঢ় লালও, সময়ে সময়ে। কিন্তু বহুদিন আগেকার সেই ঘটনাটির সঙ্গে কাকতালীয়ভাবে মিলে যাওয়া এই প্রতীকী বর্ণ-সমন্বয়টি আমার মনে কখনো উদিত হলো না কেন, সেটাই বিস্ময়ের। শামীম আজ এতদিন পরে কী কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে! আমি কি বাংলাদেশ!

হ্যাঁ, আমি একটা দেশ। বাংলাদেশ। আজ থেকে ঊনিশ বছর আগে, যখন আমার বয়স ছিল চব্বিশ, আর আমি শেষ জুলাইয়ের এক মধ্যদুপুরে স্বাধীন বাংলাদেশেই প্রথমবারের মতো ধর্ষিত হই—তখন আমার পরণে ছিল লাল পাড়ের তাজা কিন্তু গাঢ় সবুজ রঙের শাড়ি। টাঙ্গাইলের তাঁত। আহা, ঐতিহ্য। সেদিনের কোনো কিছুই ভুলে যাবার কথা নয়। আমি ভুলিওনি। কিন্তু শাড়ির রঙ টঙের ব্যাপারটা কেমন যেন আবছা হয়ে এসেছিল স্মৃতিতে। অথবা তেমনভাবে স্মৃতিতে আঁচড়ই কাটেনি বিষয়টা।
- তুই আমার বাড়ি থেকেই গিয়েছিলি।
শামীমের কথায় আমি নিজের মধ্যে ফিরে আসি—হ্যাঁ। তুমি তখন নীলক্ষেত কোয়ার্টারে সাবলেট থেকে ল্যাব এইডে কাজ করো।
- হুঁ। অফিস সেক্রেটারি ছিলাম। কোম্পানি সেক্রেটারিও, সাকুল্যে ওই একটা অফিসই তখন ওদের কোম্পানি ছিল তো।

আমি একবার শামীমের দিকে তাকাই। সেদিনের স্বল্পায়তন প্রতিষ্ঠানটির অফিস সেক্রেটারি শামীম খন্দকারকে আজকের শামীমের ভেতরে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। অবশ্য বদলে গেছে প্রতিষ্ঠানটিও, অনেক বড় হয়েছে। তবু সেখানকার ‘চাকুরে’ হিসেবে আজ শামীমের অবস্থান অকল্পনীয়। আজ সে ওরকম ব্যবসার কমপক্ষে বিরাট শেয়ারের মালিক হতে পারে। আমি তার কথার জের ধরি—
- আমি তোমার বাসায় তৈরি হয়ে কোথাও যাব বলে তুমি আধাবেলা ছুটি নিয়েছিলে।
- কারণ আমি জানতাম দিনটা তোর জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

ল্যাব এইড তখন সদ্য প্রতিষ্ঠিত ছোট একটা ডায়াগনোস্টিক সেন্টার। আজকের বিশাল হাসপাতাল-ভবন তখন কল্পনারও বাইরে। তিনতলা ভবনের ওই পরীক্ষাগারে কাজের ব্যস্ততা বলতে গেলে ছিলই না। আমার সব মনে পড়ে। বলি—ওই টেবিলে বসে থেকে তুমি খুব বোর হতে তখন।
- হ্যাঁ। ওটার মালিকের নামও শামীম। ডা. শামীম। নামের সূত্রে খানিকটা সৌহার্দ্য থাকায় শামীম ভাইয়ের অনুমতি পেয়েছিলাম সহজে। কোম্পানি-সচিবের মাছিমারা দায়িত্বের টেবিল ছেড়ে উঠে এসেছিলাম দুপুর বারোটার পরপরই।
- হুঁ।
- হুঁ মানে কী। তোর জন্যই করেছিলাম সব। অকৃতজ্ঞ।

ওর উষ্মার মুখে আমি আর কোনো শব্দই করি না। আমাদের আড্ডার তৃতীয় সদস্য, শামীমের বান্ধবী নাজনীন আমাদের আলাপচারিতা সবিস্ময়ে শুনছিল, নীরবে। খানিক পরে শামীম আবার সক্ষোভে বলে—আমি জানতাম দিনটা তোর বিশেষ দিন।
- হুঁ।
- আবার হুঁ। আমি কিন্তু জানতাম দোস্ত, সেদিন ঘটবে।

এবার শামীমের উচ্চারণে ক্ষোভ নেই, বরং নির্বিকার সে। কিছুটা কি কৌতুকপ্রবণও? কেন যেন আমার সুক্ষ্ম একটা অপমানবোধ হয়—কী অশ্লীল ইঙ্গিত দিয়ে কথা বলো শামীম। ‘ঘটবে’। কী ঘটবে ?
- এটা অশ্লীল ইঙ্গিত? যাহ্ শালা। যার জন্য করি চুরি...। কামখান বানাইতে পারলা তোমরা, আমি আন্দাজ করতে পারলে দোষ।
- আবার বাজে কথা?
- কথা যেরকমই হোক, আমি একশো ভাগ সিওর ছিলাম, জানতাম যে ওই দিন অঘটনটা ঘটবেই।
- মাই গড, তুমি এতো নিশ্চিত জানতে ? আমি তো কিছুই জানতাম না। তুমি কী করে...
- ওসব বুঝা যায়, কাঞ্চনমালা।

শামীমের মুখে আমাকে ‘কাঞ্চনমালা’ ডাকতে শুনে আমার কোনো স্মৃতিমেদুরতা তৈরি হয় না, কারো প্রতি ক্ষোভ কিংবা ঘৃণাও না। হাসি পায়। একদা এক যুবক আমার ‘মালা’ নামটিকে অলংকৃত করিয়া কাঞ্চনমালা বলিয়া আহ্বান করিত বটে। সুমিত। সুমিত ফায়জুল্লাহ। কী ছিল তার ঢলোঢলো আবেগ! বাথটাব ভর্তি সুগন্ধি সাবান-ফেনার মতো। কিন্তু শামীম তো মনে হচ্ছে আজ এই বিদঘুটে প্রসঙ্গ—কচলানো থেকে রেহাই দেবে না আমাকে। দেড় হাত দূরত্বে মুখোমুখি বসে সে যেন কোন এক দূরাগত গলায় স্বগতোক্তি করে—
- রওনা দেবার আগে আমার রুমে এসে তুই যত্ন করে গাঢ় লাল টিপটা কপালে দিলি। সঙ্গে ম্যাচ করে লিপস্টিক... টিপটপ ড্রেসআপ...
- তুমি শামীম, মুখস্ত করে রেখেছো ওই সব!
- কেন, অস্বাভাবিক? বলতে চাস তোরও মুখস্ত নেই! মনে পড়ে না এখনো?

আমি জবাব দেই না। চুপ থাকি। একসময় চোখ বুজে মুখটা আকাশমুখো তুলে ধরি। যেন এক্ষুণি আকাশ থেকে বৃষ্টি নামবে, মুখটা ধুইয়ে দেবে। বৃষ্টি নামে না। নাজনীন অধৈর্য হয়ে এসময় বলে—অনেক হয়েছে ভাই। তোমরা এবার দু’জনেই ঊনিশ বছর পেছন থেকে আজকের দিনটাতে ফিরে আসো তো।

হঠাৎ শামীম হাসতে থাকে। আমিও। নাজনীনও। যে যার নিজস্বতায়, আনন্দে, স্বস্তি বা অস্বস্তিতে, অর্থহীনতায় কিছুক্ষণ হাস্য-আক্রান্ত থাকি। এরপর একসময় থিতিয়ে আসে যার যার নিজস্ব অনুভূতি। খানিক আগের ঝলমলে বিকেলটা কেমন যেন বিমর্ষতায় মরে আসতে থাকে। জাতীয় জাদুঘরের ভেতরের পুকুরটা কমলারঙের মিহি সরভাসা পানি বুকে নিয়ে স্থির হয়ে আছে। পশ্চিমে হেলে পড়া সূর্যরশ্মি তির্যকরেখায় পুকুরের পানিতে পড়ে কেমন একটা সব্জে-কমলা রঙ ধরেছে। আমরা তিনজন পুকুরপাড়ের সবুজ মাঠে বসে থেকে নিজেদেরকে চিনতে পারি না। অথচ বহুদিনকার যোগাযোগহীনতাকে দূর করে দেবার জন্যই আমরা খুব উদার প্রকৃতির স্পষ্টতায় খোলা আকাশের নিচে বসেছিলাম; শামীম বারবারই কাছের কোনো চাইনিজ রেস্টুরেন্টে বসবার জন্য পীড়াপীড়ি করা সত্ত্বেও। শুধু তারুণ্যের স্মৃতিমেদুরতার কারণেই এই প্রান্তরবিহার। না হলে বয়স এবং তথাকথিত পদমর্যাদার দৌরাত্ম্যে আমাদের জীবন থেকে সাধারণ দিনযাপনের আনন্দ অন্তর্হিত হয়েছে বহু আগে। আমি চারপাশে চোখ ফেলি। দূরে দূরে ছড়ানো নানান গাছপালা। এ মুহূর্তে এই বৃক্ষমালাদের মতো আমরাও আমাদেরকে অনড় বলে বোধ করি। তিনজনই চুপ করে যাই। যেন আমরা সত্যিই গাছ হয়ে গেছি। ভাষাহীন। গাছগুলো মাটির গভীরে চলে যাওয়া শেকড়ের বন্ধনে আঁটো, তবে এই গাছ তিনটির কাণ্ডগুলো হাঁটু ভেঙে জুবুথুবু হয়ে জমে পড়েছে বুঝি। আমরা মাঠের দুর্বাঘাসের ওপর বসেছিলাম।

একটু দূরে, মাঠের অন্যপাশে কয়েকটি শিশু-কিশোর কল্পিত পীচের দু’প্রান্তে পরপর চার পাঁচটা করে ইট বসিয়ে স্ট্যাম্প বানিয়ে ক্রিকেট খেলছিল। বিপদজনক স্ট্যাম্প, কিন্তু বাচ্চাদের মুখে ভীতি বা দুশ্চিন্তার চিহ্ন নেই। এসময় আমাদের নীরবতার অখণ্ডতায় একটা ঢিল পড়ে। আচমকাই। ওদের একটি বল ব্যাটের আঘাতে উড়ে এসে আমার ঠিক ডান হাঁটুতে লেগেছে। ক্ষুদে খেলোয়ারদের হল্লা উঠলে আমরা আবার ধুলোওড়া বিকেলটাতে ফিরে আসি। আমি বলটা হাতে নিয়ে ওদেরকে হাত ইশারায় ডাকি। খুব দ্বিধার সঙ্গে একজন এগুচ্ছে। হাতে ব্যাট। স্ট্যাম্পের কাছে ব্যাট হাতে আরেকটি ছেলে। তার পাশে বড় জোর ন’দশ বছরের একটি মেয়ে। কী মায়াবী মুখটা তার! খুশির হাসিতে চোখ দুটো বুজে আসার যোগাড়। হাসতে হাসতে ঝুঁকে পড়েছে সামনের দিকে। তার কথা শুনতে পাচ্ছি—আমাকে তো খেলতে নাও না। এই জন্য। এইজন্য বিচার হইছে।

আগুয়ান ছেলেটি সম্ভবত ‘বিচার’- এর ভয়েই মুখ শুকনো করে একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়াল। শামীম গম্ভীর গলায় বলে—কী ঘটনা? ছেলেটি উসখুশ করছে। শামীম আবার বলে—ঘটনাটা কী, বল নিতে এসেছো?
নাজনীন হেসে ফেলে—বেচারা ভয় পেয়েছে। শামীম আবার রহস্য করে আমাকে দেখিয়ে বলে—ভয়ের দেখেছো কী, শোনো ছেলে, এই ম্যাডাম যে খুব রাগী, তা জানো?
ছেলেটি না বোধক মাথা নাড়ে।
- এই রাগী ম্যাডাম যদি সত্যিকার রেগে যায়, তাহলে তোমাদের খেলাটা একদম খেয়ে হজম করে ফেলবে, বুঝলা?
- কী খেয়ে ফেলবে? এতক্ষণে বিস্মিত মুখে কথা ফুটল ছেলেটির।
- তোমাদের খেলাটা।
- খেলা-টা? খেয়ে হজম?
- হ্যাঁ ব্যাট-বল-স্ট্যাম্প সব। বেশি রাগ করলে উনি হাতের কাছে যা-ই পান, তাই খেয়ে ফেলেন।
তারপর আমার দিকে চেয়ে উদাস গলায় বলে—নিজের রাগটা খেতে পারেন না তো! এজন্য।
এবার সম্ভবত কৌতুকটা ধরতে পারল ক্রিকেটার। সে মুচকি হেসে আমার দিকে হাত বাড়াল বলটার জন্য। বলল—আমরা সরি আন্টি। আপনি কিন্তু খুব বেশি রাগ করেন না।

আমরা এবার নিজেরাই হাসতে লাগলাম। ছেলেটা বল হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে গেল। অনেকক্ষণ ধরে খেলা বন্ধ রেখে ওদের হাসাহাসিই চলছে, দেখলাম। বিকেলটা ফের তার নিজস্বতা নিয়ে ফিরে এসেছে শাহবাগ অঞ্চলে। আমাদের মধ্যেও কি ফিরে আসে প্রত্যেকের নিজ নিজ দিনরাত, ভিন্ন ভিন্ন জীবনযাপনের অশ্রুত পাঁচালী! কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা, সম্পূর্ণ ভিন্ন তিনটি বাস্তবতার প্রতিনিধি, কিছু কমন বিষয় নিয়ে মামুলি আলোপচারিতায় অংশী হয়ে উঠি। একটু পরেই জাদুঘরের ডেপুটি কিপার ড. নীরু শামসুন্নাহারকে আসতে দেখা যায়। মুখে উজ্জ্বল আভা। তার সম্প্রতি পাওয়া দু’বছর মেয়াদী জাপানের স্কলারশিপসহ ভিসা প্রাপ্তির খবর এবং আগে থেকে জানা তার সদ্যসূচিত সপ্রেম দ্বৈত-জীবনের তথ্য আমাদের দারুণ আনন্দিত করে অথবা নিজেদের কিছু কিছু না-পাওয়ার ক্লেশকে অধিকতর গভীর করে। আমরা তাকে উইশ করি, সঙ্গে থাকা মিষ্টি সকলে মিলে খাই। নিমকিভাজা খাই, বোতলের পানিতে তৃষ্ণা দূর করি। নানান বিষয়ে কথা চলতে থাকে। মিনিট চল্লিশেক পরে নীরু আপা ‘মোশারফ ভাই আমার জন্য অপেক্ষা করতেছে, না হইলে আরো অনেকক্ষণ থাকতাম’ বলে উঠে গেলে আবার তিনজন একা হয়ে পড়ি।

শামীমের বহুদেশ ঘোরার অভিজ্ঞতা আছে। আজ সে নিউইয়র্ক তো পরশু ব্রাসেলস। এক সপ্তাহ পরেই  হয়তো সে ফ্রান্সে, পরের মাসেই থাকতে পারে হংকং। কয়েক মাস ধরে সে বাংলাদেশে আছে। সম্প্রতি সে বিরিশিরিতে বিঘা দশেক জমি কিনেছে। আরো দশ পনের বিঘা কেনার ধান্দায় আছে। আপাতত কিনে ফেলা জমিতে একটা ট্যুরিস্ট-রিসোর্ট আর বৃদ্ধাবাস করার জন্য প্রয়োজনীয় প্রাথমিক কাজকর্ম সেরে ফেলেছে। মহাব্যস্ত লোক।

নাজনীনের ব্যাপারটাও জানা গেল। সম্প্রতি নিঃসঙ্গ হয়েছে সে। বিয়ে হয়েছিল পারিবারিকভাবে। ছেলে রূপে গুণে বিদ্যায় ছিল অতুলনীয়। মনকাড়া সুন্দরী নাজনীনও মেধায় নান্দনিকতায় চূড়াস্পর্শী। সোনায় সোহাগা। কিন্তু স্বামীধনের গুণপনার অলিগলিতে বিচরণ করতে নিয়ে সে যখন আবিষ্কার করে যে, প্রতিরাতে স্বামী তাকে কিশোরীসুলভ কিছু ব্রীড়াভাঙার ক্রীড়াশৈলীতে আবিষ্ট রাখবার চেষ্টা করে ঘুম পাড়াতে চায়, অভিযাত্রার প্রান্তদেশে পৌঁছাতে উদ্যোগী হয় না, তখন সে সংশয়ে পড়ে। লোকটি কি শারীরিকভাবে অক্ষম! মগজে কেউটের মতো ফণা তোলা এ প্রশ্নের জবাব কিন্তু সে অচিরেই পেয়ে যায়। দেহ আর মনের বিবাদভঞ্জন হয়—নাহ, অমূলক সন্দেহ। বরং পারঙ্গম স্বামী নিজের দাদীর কাছে শোনা স্বামী-স্ত্রীর মিলন বিষয়ক অব্যর্থ প্রবাদটি তাকে শোনায়—‘মাসে এক, বছরে বারো, এর থাইককা যে যতো কমাইতে পারো।’ নাজনীন বিশ্বাস করেছিল। তীব্র আকাঙ্ক্ষায় জর্জরিত বহু রাতেই সে স্বামীর ঔদাসীন্যে তেমন দোষ দেখেনি। আর দীর্ঘ বিরতিতে যেদিন প্রত্যাশিত সন্তরণ ঘটেছে, সেদিন তার মতো সুখী আর কেউ নয়। ভালোই কাটছিল। মন্দের ভালো। দু’বছর আগে স্বামী যখন উচ্চতর বিদ্যালাভের জন্য ইংল্যান্ড পাড়ি দেয়, তখনই সে প্রথম জানতে পারে যে লোকটি সম্পর্কে তার জানাশোনায় ফাঁক থেকে গেছে। ইংল্যান্ডে সে একা যায়নি। সঙ্গে স্বামীর কৈশোরোত্তীর্ণকাল থেকে সখ্যের সম্পর্কধারিনী একজন দু’সন্তান-শোভিত বিধবা যুবতী মাতাও গিয়েছেন। সন্তানসহ তার ভিসা অবশ্য আলাদাভাবে হয়েছে। তার বাচ্চারা ওখানে পড়াশোনা করতেই যাচ্ছে।

নাজনীনের সঙ্গে তার স্বামীর বিয়েটা ছিল পরিবারের চাপে। এ বিয়ের ফলে তাদের পূর্বসম্পর্কের কোনো বিরতি ঘটেনি। সবকিছু জানাজানি হলে ঘুমন্ত স্বামীর পাশে জেগে কাটানো উপোসী রাতগুলো তার চোখে টেঁটাবিদ্ধ করে বুঝিয়ে দেয় সত্য কী। তারপরও সে চেষ্টা করেছিল। বৃথা। দু’বছর প্রকৃত প্রোষিতভর্তৃকার জীবন কাটানোর পর সম্প্রতি তালাকের নোটিশ এসেছে। যে ফ্ল্যাটটিতে সে এখন বসবাসরত, সেটি দেনমোহরের হিসাবে ফেলে নাজনীনের নামে লিখে দিয়ে স্বেচ্ছায় মুক্তি নিচ্ছে তার প্রবাসী স্বামী। দেনমোহর এবং তিনমাস দশদিনের ইদ্দতকালের খোরপোশের খরচের অন্তত আট ন’ গুণ বেশি হবে ফ্ল্যাটটির দাম। কিন্তু নাজনীন এই প্রাপ্তির হিসাব বুঝিয়ে অনির্বাণ জ্বলতে থাকা মনকে শান্ত করতে পারে না। অপমান। তীব্র অপমান অবিরত দংশনে তাঁকে মৃত্যুমুখী করে ফেলছিল।

এ অবস্থায় শামীম তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। অথবা শামীমকে সে। বন্ধু হিসেবে পরস্পর পরস্পরের নির্ভরতা হয়ে উঠছে। ফেরার পথে কলাবাগানে আমার বাড়িতে আমাকে নামিয়ে দিয়ে যায় ওরা। আমার বাচ্চাদের জন্য অনেক খাবার আর গিফট কিনে দিয়েছে শামীম। কিন্তু সময়ের তাড়া বলে ওরা আমার বাড়িতে নামে না, রওনা দেয় উত্তরার দিকে, নাজনীনের বাড়ির উদ্দেশ্যে। শামীম কিছুদিন ধরে নাজনীনের ফ্ল্যাটে থাকছে। আমি দেখি, আমার বন্ধু শামীম তার বন্ধু নাজনীনকে নিয়ে ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে জনাকীর্ণ রাজপথে। কিন্তু শামীম কি জানে, কী মারাত্মক একটি জখমের চাপাথাকা মুখ সে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খুলে দিয়ে গেছে আজ!

সে দিনটা অন্য দিনগুলো থেকে ভিন্ন ছিল।
গরম কালটা আমার অপছন্দের। কিন্তু শেষ জুলাইয়ের সেই অসহ্য গরমেও নিজেকে আমার ফুরফুরে লাগছিল। আমার বন্ধু... দীর্ঘদিনের বন্ধু, যাকে আমি খুব মামুলি মেয়েদের মতো লুকিয়ে লুকিয়ে ভালোবাসি—আজ আমাকে নিভৃতে ডেকেছে। আমরা বহুবছর বন্ধুত্ব রক্ষার দূরত্বে থেকেছি, তার বিভিন্ন নারী বা তরুণী বিষয়ক গল্প, তা প্রেম বা নিছক কামের তাড়নাতেই হোক—আমি শুনেছি। জানি। আমার রক্ষণশীল প্রেমপ্রবণতাও জানে সে। আমাদের সম্পর্কটা নিয়ে একটা ধুম্রজাল রয়েছে বন্ধুদের মধ্যে। কেউ বলে, আমি সুমিতের পেছনে অর্থহীন মোহে সময় নষ্ট করছি। কেউ বলে সুমিত আমাকে খেলাচ্ছে, লক্ষ্যে পৌঁছামাত্র কেটে পড়বে। বন্ধুরা, বিশেষত মেয়ে বন্ধুরা আমার ব্যাপারে খুবই শংকিত। তারা মনে করে, আমি সুমিত ফায়জুল্লাহর মতো একটা চিহ্নিত প্লেবয়ের পাল্লায় পড়ে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলটা করতে যাচ্ছি। আমি জানি প্রকৃত সত্য। ভুল শুদ্ধ যা-ই হোক কাজটা আমি করেই বসেছি। সুমিতকে ভালোবেসেছি। বাইরে অবশ্য আমি এর তীব্র বিরোধিতা করি। সুমিতও। সে কী বুঝে আমাদের প্রেমসম্পর্ক হওয়ার সম্ভাবনাকে স্রেফ অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয় জানি না। তবে আমিও ঠিক তারই মতো করে সবকিছু অস্বীকার করি। কারণ সকলের মনোযোগ সরিয়ে দিয়ে আমি ওকে সত্যিকারেরই পেতে চাই। এরপর জানতে পেরে চমকে উঠুক সবাই। তবে মেলামেশার ব্যাপারে আমি খুবই সাবধানী। আগামী মাসে আমার চব্বিশ পূর্ণ হবে। এখনো আমি কোনো পুরুষের শারীরিক সাহচর্যে যাইনি। দীর্ঘ ছ’বছরের বন্ধুত্বে সুমিত পর্যন্ত কাছ ঘেঁষতে পারেনি। কত গান, কত সাংগঠনিক কাজ, ডাকসু সাংস্কৃতিক দলের অনুষ্ঠান আমরা একসঙ্গে অনেকের সাথে করেছি। আবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়েছি শুধু দু’জনে, আমি যে চাচাজির বাড়িতে থাকি, সেখানে। কোনো নির্জনতার প্ররোচনাতেই সে বন্য হয়ে ওঠেনি। অথচ কত কথাই ওর লাম্পট্য সম্পর্কে আমি শুনেছি।

সুমিতের আমার সাথে একান্তে দেখা করে আমাদের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনার প্রস্তাবে আমি সানন্দে রাজি হয়েছিলাম। তবে কথাটা যাতে কোনোভাবেই প্রচার না হয় সেদিকে আমরা দু’জনেই সর্তক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সুমিত অন্য সাবজেক্টের ছাত্র আমাদের ইয়ারেই। তার একাডেমিক রেজাল্ট খুব সাধারণ হলেও সে কোনো বিচারেই সামান্য নয়। সুমিতের বাবা দেশের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী শিক্ষাবিদ। সে নিজে সঙ্গীত-শিল্পী। সম্প্রতি সিনেমার প্লে ব্যাকও শুরু করেছে। আমার অনার্সের রেজাল্ট আশানুরূপ, একই পর্যায়ের রেজাল্ট এমএতেও হবে আশা রাখি। এরপর তো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় যোগ দেবার সিদ্ধান্ত পাকা হয়েই আছে। স্বপ্নের জীবন পেয়ে যাব বাস্তবে। কঠিন সংগ্রামের দীর্ঘ জীবন থেকে বিদায়। আমি এখন নিজের উপার্জনে পড়ি। পার্টটাইম কাজ করি দু’টো জাতীয় দৈনিকে। অনেকে ছাত্র পড়াতে বলে। আমার পোষায় না। শিক্ষকতা একেবারে বিশ্ববিদ্যালয়েই শুরু করব। সুমিত আমার এই ডিটারমিনেশনটা খুব সম্মান করে। সীমাহীন প্রতিকূলতায়ও হাল ছেড়ে না দেবার দৃঢ়তাকে সম্মান করে। আরেকটা ব্যাপারে আমার আশ্চর্য লাগে—ও তার সমস্ত গোপন কথা, লোভ, ঈর্ষা, ভবিষ্যত-ভাবনা এমনকি অপরাধবোধের কথাও আমাকে জানায়। আমি মাঝে মাঝে সংশয়ে পড়ে যাই। ও কি আমাকে সত্যিই ভালোবাসে ? নাকি এ কেবল কথামালা ? আবার বিভ্রান্ত লাগে—ভালো না বাসলে কেউ কাউকে এত চায়? এত কিছুতে জড়িয়ে নেয়! মাঝে মাঝে আমার সম্পর্কে সুমিত বন্ধুদের কাছে উচ্চকণ্ঠে প্রশংসা করে, যার মর্মার্থ হচ্ছে—আমি একটা খুব অন্যরকম চরিত্র। মামুলি মেয়েদের মাপকাঠিতে আমাকে বিচার করা যাবে না। এগুলো কি স্তুতি? সে চিঠিতেও আমাকে লেখে—কাঞ্চনমালা, আমার প্রতি আপনার কোনো তুচ্ছ অধিকারবোধ নেই বলেই আপনার অধিকার আমার ওপর সবচাইতে বেশি। সম্পর্কের ভেতরকার দাবি মানুষের সম্পর্ককে জীর্ণ করে। আপনাকে এত বেশি ভালো লাগার এটা অনেক বড় কারণ যে আপনি অনাবশ্যক দাবির কথা তুলে আমাদের অসাধারণ সম্পকটা, জীর্ণ করেন না।

হ্যাঁ—আমি হয়তো সুমিতের কথাগুলোর মতোই একটা চরিত্র। আমি এখন পর্যন্ত কিছু চাই না ওর কাছে। সে-ও না। কিন্তু চাওয়া কি নেই, এমনকি দাবি? আমি আপনমনেই হেসে ফেলি। সে-ও তো মুখে কিছু উচ্চারণ করে না। কিন্তু গত মাসখানেক আগে এই প্রথমবারের মতো, ফাঁকা বাড়িতে বড় চাচাজির বেডরুমে আমরা যখন আচার খুঁজছি, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে আচমকা একটা চুমু খেয়ে ফেলেছিল সুমিত। দীর্ঘ সময়ের চুমু। আমি আচারের বয়াম রাখবার সেল্ফটাতে খুঁজে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছি মাত্র, কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে একহাতে কোমর জড়িয়ে ধরে মুখটা অন্যহাতে ঘুরিয়ে গ্রাস করতে শুরু করেছে ঠোঁট দুটো। দম আটকে ছটফট  করতে শুরু করার আগে পর্যন্ত ছাড়েনি। আমি ক্ষুণ্ণ হয়েছিলাম। প্রতিক্রিয়ায় এক সপ্তাহ আর দেখা করিনি। সেও সাহস করে আমার বাসস্থানে আসেনি। একটা চিঠি পেয়েছিলাম সে সময় তার। অনেক কথার সঙ্গে লিখেছিল যে, আমরা দু’জন পরস্পরকে ভালোবাসি আর বিষয়টাও উপভোগ না করার মতো কিছু ছিল না, তবে ক্ষুব্ধ হওয়ার কারণ কী। এ-ও লিখেছিল—এরকম একটা ঘটনার জন্য কান্নাকাটি করাটা কোনো সোলেমানীয় ব্যাপার না। ‘সোলেমানীয়’ কী? কথাটা আমি বুঝতে পারিনি। এবার জিজ্ঞাসা করতে হবে। আরেকটা ভয় হচ্ছে—এবারও কি একবার সেদিনের মতো দুঃসাহস করে ফেলতে পারে সে? ভাবতেই আমার গায়ে শিহরণ বোধ করি। বজ্জাত। এবার ওকে কাছে আসার সুযোগই দেওয়া যাবে না। অবশ্য সে নির্জনতাও আজ পাবে না। আমরা যে বাসায় দেখা করব, সেটা আবৃত্তিকার দম্পতি ফরহাদ-নাবিলার। ফরহাদ ভাই আর নাবিলা আপা দু’জনেই চাকরিজীবী। তাদের বাসায় আমি আসবো জানালে নাবিলা আপু বলেন—
- সুমিতও আসবে শুনলাম?
- হ্যাঁ। কিন্তু আমি তো এখনো তোমাকে সেটা বলিনি। জানলে কিভাবে।
- ফরহাদ বলেছে। আসো দু’জনেই। কিন্তু মালা, যত দ্রুত সম্ভব সম্পর্কটার পরিণতি ঠিক করে ফেলো। সুমিত খুব অস্থির ধরনের ছেলে।
- কী করব?
- কী করব মানে? আমরা কি করেছি, আমি আর ফরহাদ? জগতের আর সব জুটিরা কী করে? বিয়ে করবে। সরাসরি বিয়ের সিদ্ধান্ত নিতে বলবে এবার।

নাবিলা আপার কথার যুক্তি আমাকে প্রভাবিত করে। সুমিতের সঙ্গে সম্পর্কটা নিয়ে একমুখী সিদ্ধান্তে স্থির হয়ে আমি তার মুখোমুখি হবার অপেক্ষায় থাকি।

বাজে ধরনের গরম পড়েছিল সেদিন। বকশিবাজার এলাকায় নাবিলা আপার শ্বশুরবাড়ি। বাড়িটায় তিনতলার ছাদে আরেকটা ফ্লোর করে গোটা অর্ধেক অংশ জুড়ে একটা এ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি অর্ধেকটা ছাদ যেন স্নিগ্ধ উঠান। চারপাশে টবের বাগান। ফুলের, ফলেরও। কিন্তু এ মুহূর্তে চারতলার কংক্রিটের উঠান রোদে জ্বলছে। দু’জোড়া ক্লান্ত পা দু’টি পরিশ্রান্ত মানুষকে সেই আঙিনাতে এনে পৌঁছায়। সুমিত আর আমি অথবা আমি আর সুমিত। তবু রক্ষা, চলে তো এলাম। স্বস্তি। স্বস্তির কথা ভাবতে না ভাবতেই আমার মাথায় একটা চক্কর দিয়ে উঠল। অ্যাপার্টমেন্টের দরজায় বিশাল এক তালা।

আমার মনে হলো ক্লান্তি যেন শতগুণ বেড়ে গেছে। ইচ্ছে করছে কয়েক পা পিছিয়ে ছায়াচ্ছন্ন সিঁড়িঘরেই বসে পড়ি। হঠাৎ চোখে পড়ে, তালার আঙ্টায় একটা কাগজ গুঁজে রাখা। দ্রুত ভাঁজ খুলি। নাবিলা আপার লেখা—মালা, দুঃখিত। ভোরবেলা খুব জরুরি খবর পেয়ে নরসিংদী যেতে হচ্ছে। মা অসুস্থ। রাতের আগে ফিরতে পারব না, ওখানে আজ থেকে যেতেও হতে পারে। তোদের বোঝাপড়াটা আরেকদিন হোক। অবশ্যই, আমার বাড়িতেই হোক। দুঃখিত সোনা।

আমি হতাশ হয়ে সুমিতের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হই। তার মুখে চিন্তার ছায়া নেই। এবং অচিরেই পকেট থেকে চাবি বের করে সে গেট খোলে। আমি প্রায় চিৎকার করে উঠতে গিয়ে সতর্ক হই। গলা খাটো করে বলি
- অ্যাই, কিভাবে?
- ফরহাদ ভাই। চিরকুটে লেখা খবরটা সকালে আমাকে জানালে আমি রিকোয়েস্ট করেছিলাম...।
- কী রিকোয়েস্ট?
- বলেছিলাম, আমাদের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আজকেই কথা বলা খুব জরুরি।
- নাবিলা আপা?
- জেনে থাকতে পারে, না-ও জানতে পারে। এটা তাদের ব্যাপার। আমরা তো আর লুকিয়ে চুরি করতে আসিনি।
- তবু
- তবু কী। খোদ গৃহকর্তাই তো চাবিসহ প্রবেশাধিকার দিয়েছে। নাকি?
- ধূর। কেমন যেন হয়ে গেল না?
- হ্যাঁ। খুবই ‘কেমন’ হয়ে গেল। এসো ভেতরে।

জ্বলতে থাকা দুপুরের ঝাঁজ থেকে স্নিগ্ধ পরিচ্ছন্ন আরামদায়ক ফ্ল্যাটটিতে ঢুকে আমি মুগ্ধ হই। সুমিতও। ঘুরে ঘুরে দ্যাখে ঘরগুলো। বেডরুমটায় ঢুকতে গিয়ে সুমিত একবার পেছনফিরে তাকায়—‘এসো।’ ও সব সময় আমাকে ‘আপনি’ বলে। আমিও। আজকে সেই প্রথম থেকেই ‘তুমি’ বলছে। বিনা কারণেই কেমন একটা ভয় হয় আমার। দ্বিধার সঙ্গে বলি,
- একজনের অনুপস্থিতিতে তার বেডরুমে ঢুকে পড়া উচিত হয়?
- আরে কী মুশকিল। এ বাড়িটা পুরোটাই আজ আমাদের জন্য বরাদ্দ আছে তো।
- তবু
- আবার তবু। বিছানার পাশে ড্রেসিং টেবিলের সেটিংটা দারুণ না?

সত্যিই দারুণ। এ সংসারে অনেক কিছুই দারুণ। কিন্তু আমরা এসব ‘দারুণ গৃহসজ্জা’ কতক্ষণ দেখব? কথা বলা জরুরি। নিজেদের ভবিষ্যত-পরিকল্পনার কথা। হঠাৎ করেই সুমিত আমার কাঁধে হাত রাখে। আমি চমকে উঠি। সে আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করে না। একজন সম্পূর্ণ আলাদা সুমিত আমাকে সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ধরে তীব্র চুমু খেতে থাকে। আমার সাধের পাটভাঙ্গা টাঙ্গাইলের শাড়ি, সাথে রঙমেলানো যাবতীয় আবরণ তার কাছে বাহুল্য বলে সে সব সে অপসারণে ব্যস্ত হয়। আমি একটি মরিয়া প্রাণীর মতোই প্রতিরোধ করতে থাকি। আজন্ম যত্ন-লালিত সংস্কার আমাকে আমার সবচাইতে আকাঙ্ক্ষিত মানুষের বিরুদ্ধে প্রায় যুদ্ধে অবতীর্ণ করে। এক সময় সমস্ত শরীরে অনিচ্ছার মুদ্রা নিয়ে বিছানায় আমাকে কুঁকড়ে থাকতে দেখে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে সুমিত—এ সবের কী মানে মালা, এটা কী রকম আচরণ?
- এই কথা তো আমি জিজ্ঞেস করব আপনাকে।
-  না, করবে না। এটাই স্বাভাবিক।
- না।
- তাহলে চলো, ফিরি।

সুমিতের ফিরে যাবার প্রস্তাব শুনে আমার অন্তর আর্তনাদ করে ওঠে—ফিরি মানে? আমরা কি এসবের জন্য এসেছিলাম? আমরা কথা বলব না?
- অবশ্যই বলব। অনেক কথা বলার আছে আজ। একটু সহজ হও।

আমি সহজ হবার চেষ্টা করি। সুমিতও অনেকটা শান্ত, আমার অন্তত তাই মনে হয়। অভয় দেবার ভঙ্গিতে সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকে। বেশ কিছুক্ষণ। এবং আর কিছুক্ষণ পরেই সে সমস্ত নিয়ন্ত্রণের বাইরে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। তার প্রাণের ‘কাঞ্চনমালা’ এবার তার আগ্রাসী পৌরুষের কাছে সম্পূর্ণ পরাস্ত হয়। এরপর অনেকক্ষণ স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে সুমিত। কোনো কথা বলে না। আমার ভেতরে অকারণে একটা ভয়-শিরশিরে অনুভূতি হয়। আর এত অসহায় লাগে ! নিজেই বুঝতে পারি না কখন নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করেছি।
- এতে কান্নাকাটির কী হলো...।
আমি আহত বোধ করছি, তবুও বলি—‘সরি।’
- সেদিন একটা চুমু খাওয়ার পরও তুমি কেঁদেছিলে। এসব কী ন্যাকামো। নাকি বুঝাতে চাও এর আগে কেউ তোমাকে চুমুও খায়নি!

সুমিত ব্যঙ্গ করে বললেও কথাটা সত্যি। কিন্তু এ মুহূর্তে তথ্যটা অর্থহীন লাগে, ওকে তা জানিয়ে কী হবে। বরং তার চোখমুখে নির্মমতার অভিব্যক্তি দেখে আমি বিস্মিত হয়ে পড়ি। সুমিতকে আমি চিনতে পারি না। ওর কণ্ঠস্বর, আমার এত প্রিয় কণ্ঠশিল্পীর নিয়মিত রেওয়াজের স্বর এত কর্কশ! আমার কান্নার বেগ দ্বিগুণ হয়ে উঠছে। কিন্তু আমি নিজেকে সামলে নিই। মনে হয় যেন অন্য কেউ আমার গলায় মরিয়া হয়ে বলছে—এসব কী বলেন আপনি।
- হ্যাঁ, ঠিকই তো বলছি। তুমি এত খুকী নাকি। সামান্য একটা চুমুতেও তুমি ক্ষয়ে গিয়েছিলে?

আকাশপাতাল খুঁজেও এ প্রশ্নের জবাব আমি পাই না। কিন্তু ঠেলে ওঠা কান্নার দমকটা এবার আর সামলাতে পারি না আমি। উপুড় হয়ে দু’হাতের ওপর মুখটা রেখে কাঁদতে থাকি। শুধু বেডকভারটাই আমার শরীর ঢেকে রেখেছে। খানিকটা সময় ভীষণ অস্বস্তির মধ্যে কাটে। আবার সুমিতের গলা শোনা যায়, এবারে অনেকটাই কোমল—‘শোনো।’
আমার অভিমান হয়। হায় আল্লাহ, এরপরও আমার অভিমান হয়! কিন্তু সত্যিই হয়েছে তো। আমি সাড়া দিই না। আমার তলপেটে খুব ব্যথা, দুই উরুর মাঝখানের গহীনে তীব্র জ্বালা। বরফঠান্ডা পানিতে যদি এক্ষুণি গোসল করা যেত! কিন্তু আমি উঠব না। ও বেরিয়ে যাক এ বাড়ি থেকে। তারপর উঠে, অনেকক্ষণ ধরে গোসল করে ধুয়ে ফেলে দেব সমস্ত ক্লেদ। সুমিত অপরাধী। সুমিত অপরাধী। আমাকে ফাঁদে ফেলে কলঙ্কিত করেছে সে।
- শোনো, মালা। জরুরি কথা আছে।
আমি মুখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি সে বেশ শান্ত। আমার মনে হয় যেন কিছুটা আপোষের বা অনুতাপের ভাব ফিরে এসেছে তার মধ্যে। আমি চোখভরা পানি নিয়ে ওর দিকে তাকাই। এখন যেভাবেই হোক, আমি তাকে মনস্থির করাব। আমি তাকে সরাসরি জানাব যে আমার পক্ষে আর ফিরে যাওয়া সম্ভব না। আমরা আজ হোক কাল হোক দ্রুত বিয়ে করব। এরকম একটি ঘটনার পর আমার শরীর-মন আর কারো হতে পারে না। ভিতরে ভিতরে ক্ষীণ একটা আশা দৃঢ় হতে থাকে। সুমিত নিজের ভুল বুঝতে পারছে। এমন রক্ষণশীল একটা সমাজে আমার মতো একটা অসহায় নিরুপায় অভিভাবকহীন মেয়েকে পরিকল্পনা করে ঠকাবার মতো হীন সুমিত নিশ্চয় না। আমার স্ট্রাগলকে, আমার মেধাকে সে তো খুবই সম্মান করে। সে তো জানে, একটি সৎ জীবনের আশায় আমি এই প্রতিকূল সমাজের সমস্ত অশুভ নেতিবাচক শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করছি। ঘটনার আকস্মিকতায় সে হয়তো খানিকটা এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল। সামলে নিচ্ছে এখন। কত দীর্ঘদিন আমরা এক অপরকে জানি।  

ওকে চিনতে এমন ভুল কিছুতেই হতে পারে না। আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাই,
- কী জরুরী কথা?
- মানে... বলছিলাম, তোমার কি শরীর খারাপ?
আমার গলা বুজে আসে। ওর গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ লুকিয়ে বলতে ইচ্ছে করে—হ্যাঁ গো সোনা, আমার শরীর খারাপ, খুব খারাপ। মনও খারাপ। তুমি আমাকে আগের মতো আদর করে কথা বলো, আমি ঠিক হয়ে যাব।
বলা হয় না। আমি রুদ্ধস্বর চুপ করে থাকি।
- কিছু বলছো না কেন। তোমার পিরিয়ড চলছে এখন?
এবার আমি প্রশ্নটার প্রকৃত অর্থ বুঝতে পারি। আমার ক্ষোভ হয়—‘পিরিয়ড? না, আমার এখন পিরিয়ড চলছে না।’
- তুমি সিওর?
- হ্যাঁ, সিওর। কেন?  
- এদিকে তাকাও। এটা কী!

আমার সবুজ শাড়ির অর্ধেকটা বিছানায়, অর্ধেকটা বিছানার পাশে রাখা ড্রেসিং টেবিলের সীটার-এ। বিছানায় থাকা অংশটুকুতে বেশ অনেকটা রক্ত। তাজা লাল রক্ত সবুজ কাপড়ে পড়ে সামান্য কালচে দেখাচ্ছে। আমার ভেতরে শিরশির করে ওঠে। অস্বাভাবিক লজ্জায় আমার সর্বাঙ্গ ঝিমঝিম করছে। কুমারীর প্রথম সঙ্গম সম্পর্কে আমার পড়াশোনা ছিল। আমার নিজের জীবনে সেই অপূর্ব ঘটনাটি ঘটেছে। শাড়িটা বিছানায় থাকায় তাতে লেগেছে রক্তের ছোপ।
- বলো, কী এটা।
- আপনি বুঝতে পারছেন না?
কথাটা বলতে গিয়ে আবেগে আমার গলা কেঁপে ওঠে।
- নতুন করে বুঝবার আর কী আছে। বলো তো শেষবার তোমার পিরিয়ড হয়েছে কবে?
আমি একটু হিসাব করে জবাব দেই—প্রায় সতের আঠারো দিন আগে।
- মিথ্যা বলো না মালা। আমার কাছে সতী সাজবার কোনো দরকার নেই। এসব কৌশল বিয়ের রাতে স্বামীর সঙ্গে কোরো।
- কীহ্?

আমার এই আহত জিজ্ঞাসা যেন সুমিতকে আরো হিংস্র করে তোলে। হিসহিসিয়ে বলে,
- আজকে তোমার পিরিয়ডের কত দিন? আর এ অবস্থায় আমার সঙ্গে দেখা করতে এলে কেন?

আমি হতভম্ব হয়ে সুমিতের দিকে তাকিয়ে থাকি। তার চোখে তীব্র ঘৃণা। আমার সমস্ত স্বপ্নপ্রাসাদ ভেঙে খান খান হয়ে যায়। সুমিতের প্রতিটা কথা ধারাল চাবুক হয়ে আমার সর্বাঙ্গে আঘাত করতে থাকে। আমার মনকে ক্ষত বিক্ষত করতে থাকে। আমি সহ্য করতে পারি না। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে—তুমি এখান থেকে যাও সুমিত। তুমি আমার জীবন থেকে একেবারে দূর হয়ে যাও। তুমি একটা মেরুদণ্ডহীন কীট। দায়িত্ব নেবার ভয়ে তুমি আমাকে এমন নোংরাভাবে আক্রমণ করছো।

বলতে চাই, কিন্তু আমার জিভ সরে না। আমার কণ্ঠ স্বরহীন। আমি অকল্পনীয় বিস্ময়ে হতবাক। সুমিত বাথরুমে গেলে আমি উঠে দ্রুত আমার বাসি, ক্লেদাক্ত বেশবাস আবার শরীরে উঠাই। অরণ্যে পশুদের আক্রমণে বিধ্বস্ত বনমানুষের মতো বাকল জড়াই গায়ে। সবুজ বাকল। শাড়ির প্যাঁচটা এমনভাবে জড়াই যেন রক্তের দাগগুলো সহজে দেখা না যায়। হায়, আরব সভ্যতার ইতিহাসে প্রসিদ্ধ কুমারী নারীর পবিত্র রক্ত। পাপস্পর্শহীনতার প্রতীক। কান পাতি, বাথরুমে কলকল করে পানি পড়ার শব্দ। আমার জীবনের প্রথম পুরুষ আমাকে বলাৎকার শেষে গোসল করছে। আমি তার জীবনের কততম নারী? এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসার আর কোনো প্রয়োজন নেই। আমি বাড়ির চাবিটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে অভুক্ত স্নানহীন ধর্ষিতা এক স্বপ্নভুক নারী বেরিয়ে এসেছিলাম সেদিনের পড়ন্ত দুপুরে। পুড়ন্ত দুপুরে। সেই দুপুরের আগুন সমগ্র জীবন ধরে অপমান সাথী করে জ্বলছেই। সেদিনের পর সুমিত নিজেকে পুরোপুরি গুটিয়ে নিয়েছিল। আমিও।

আমার জন্মভূমিতে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। আমি তখন শিশু। কিন্তু সেদিনের লক্ষ নারীর সম্ভ্রম হারানোর ইতিহাসে পরবর্তীকালে যোগ দেওয়া আমিও যে একজন সৈনিক, আমার গোপন রক্তও যে বাংলাদেশের সবুজ জমিনে মিশে লাল সূর্যটা তৈরি করেছে, কথাটা আমি আজকের আগে একবারও ভাবিনি। আমার বন্ধু শামীম, আমার গভীর গোপন গ্লানির সাক্ষী শামীম আজ কথাটা আমাকে মনে পড়িয়ে দিয়েছে।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;