জবাফুলের দুনিয়া



দেবদুলাল মুন্না
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

এরকম হয়। খুব কম সময়। তবে হয়। সে তো জানা ছিল রফিকুলের। কিন্তু এবার যেরকম হলো সেটা অতীতের চেয়ে ব্যতিক্রম। সে যাচ্ছিল  নীলক্ষেত টু মিরপুর রোডের শুক্রাবাদের সিনজিয়ান রেস্তেরাঁর সামনে দিয়ে। সন্ধ্যা ৭টার একটু বেশি হবে। রাত বেশি নয়। কিন্তু শবে বরাতের রাত বলেই হয়তোবা ঠিক সেসময় মানুষজন রাস্তায় কম ছিল। যদি বেশি থাকত তবে হয়তো রফিকুল অতীতে এমন ঘটনার সময় যেরকম মানুষের হেল্প নিয়েছিল সেরকম নিত। কিন্তু  সেদিন সে নিরুপায়। সিনজিয়ান রেস্তেরাঁ বা’পাশে ফেলে দু’কদম এগুতেই সে পড়ে গেল।

এরপর ধানমন্ডি ইবনে সিনা ক্লিনিকে ১৪ ঘণ্টা পর যখন তার জ্ঞান ফিরল তখন দেখল তার বাবা, মা ও ছোট ভাই আরিফ তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। চিকিৎসক জানালেন, রফিকুলের যে রোগটি হয়েছে এটিকে চিকিৎসা শাস্ত্রের ভাষায় বলে, ডিমেনশিয়া। এ রোগ সাধারণত বৃদ্ধকালে হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যারা এলকোহলিক তারা এই রোগের ঝুঁকিতে থাকে।

কিন্তু রফিকুলের বয়স মাত্র আটাশ বছর কয়েক মাস। এবং সে নন-এলকোহলিক।

রফিকুল ক্লিনিক থেকে সুস্থভাবে বাসায় ফেরে ঠিকই কিন্তু বাইরে বেরুনোর ব্যাপারে ভয় গেড়ে বসে তার মনে। যদি সে আর তার বাসা না চিনতে পারে। আবার যদি এমন হয়!

কিন্তু তাকে ক্লাস নাইনে পড়ুয়া যে মেয়েটি ভালোবাসে, মানে মিল্কি, তার তো আর এসব বোঝার কথা নয়। সে মোবাইলে ফোন দিতেই থাকে প্রতিদিন। বলে, ‘স্যার আমাকে বাসায় এসে পড়ানো ছেড়ে দিলেন, ঠিকাছে। কিন্তু আসবেন না বেড়াতে?’ কোনোদিন বা বলে, ‘স্যার খুব মিস করছি। জবাফুলের গল্প না একদিন বলেছিলেন শোনাবেন, শোনালেন না তো!’ কখনো বলে, ‘স্যার পোস্টমাস্টারের রতনের কথা মনে পড়লে এখনো আমার চোখ ভিজে যায়। বলেছিলেন না, মফস্বলে এখনো অনেক রতন থাকে। তাদের কথা বলবেন। কই এলেন না তো! কবে আসবেন।’

রফিকুলের এসব কথা শুনতে আর ভালো লাগে না। আবার সারাদিন-রাত বাসায় কাটায় বলেই হয়তোবা রতনের ফোনকলের অপেক্ষাও করে। কিন্তু তাকে সারাক্ষণ তো তটস্থ রাখে সেই ভয়—যদি কোনোদিন সে তার বাবা, মা আর ছোটভাই আরিফকেও না চিনতে পারে। বাসার এ ঘর থেকে ওঘরে যাওয়া ভুলে যায়।

জীবন কিভাবে যে ধীরে ধীরে গুটিয়ে আসছে সে টের পায়।

একদিন দুপুরবেলা তার মাথায় প্রথম চিন্তা আসে যে, আত্মহত্যা করলে তো সে এই ক্রমাগত যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে পারে। কিন্ত সমস্যা হলো আরিফ। আরিফের মুখ ভাসে। যেন সেই শৈশবে জামালপুরের রেললাইন ধরে রফিকুল ঘুড়ি নিয়ে দৌড়াচ্ছে। পেছনে আরিফ। আহা, এমন মায়াময় দৃশ্যের বাইরে চলে গেল রফিকুল। রাতে ঘুম হয় না বললেই চলে। তার পাশে ঘুমায় আরিফ। মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। সেও জেগে থাকতে চেষ্টা করে। রফিকুল যখন আরিফ ঘুমিয়েছে ভেবে একটু উঠে বসে থাকতে চায়, অন্ধকার ঘরে দেখা গেল ঠিক তখনই আরিফ লাফিয়ে উঠে রফিকুলকে জড়িয়ে ধরে বলবে, ‘ভাইজান খারাপ লাগছে?’

রফিকুলের তখন ভীষণ কান্না পায় ছোট ভাইয়ের তার প্রতি মায়া দেখে। কিন্তু বুঝতে দেয় না। সচরাচর এমনই বলে, ‘তুই ঘুমাস না কেন? আমি ঠিক আছি।’

রফিকুল যদিও বলে ভালো আছে কিন্তু আজকাল তার মাঝেমাঝেই আত্মহত্যার ইচ্ছা জাগে। সে আত্মহত্যা বিষয়ে বিভিন্ন পরিকল্পনা করে। বেশ রোমান্টিকতাও আছে এসব পরিকল্পনায়।

উদাহরণ দেওয়া যাক

এক. ছোট্ট তিনটা নীল ক্যাপসুল রফিকুলের হাতে। লাউয়াছড়ার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যে নিঃসঙ্গতম রেলপথটি চলে গেছে সে পথে আশ্বিনের জোছনা, রেললাইনের পাশ দিয়েই নেমে গেছে ঢালুপথ। ওই পথ দিয়ে নেমে যাচ্ছে রফিকুল। জিহ্বার নিচে রাখে  তিনটা নীল ক্যাপসুল। এই-ই শেষ। যে শেষটার জন্য সবাই অপেক্ষা করে। কেউ পায় দেরিতে, কেউ পেতে চায় না। কিন্তু রফিকুলের জীবনে আচমকা এসেছে, বুঝে ওঠার আগেই সে ছিনিয়ে নিয়ে যায় বোধ। হ্যাপিলি এভার আফটার। কেমিক্যাল নাম পটাশিয়াম সায়নাইড।

দুই. একটা বাথটাব, কানায় কানায় পরিপূর্ণ উষ্ণ পানি। গোসল করবা মিল্কি? তুমি আর আমি নেকেড হই চলো আপাতত। শরীর, শরীরই তো। নতুন কিছু নয়। চলে এসো। ঘ্রাণ নাও। নেবু নেবু গন্ধ পাইতেছো না? ওই যে দুইটা গেলাস। আগে আমি খাইনি। কসম আল্লার। আজই একদিন দুইজনে মিল্যা খেলতে খেলতে খাইতে খাইতে তোমারে রতনের গল্প করুম। জবাফুলের। ওই গেলাসে গোপীবাগ থিকা আনা স্পিরিট মিশানো বাংলা মদ।
না রফিকুল বলে না, একটা মদের গ্লাসে দুশোটা ঘুমের বড়ি মেশানো আছে।
মিল্কি পানির ভিত্রে আধডোবা হৈয়্যা আছি ফেস টু ফেস দু’জনে। নাও গেলাস। একশোবার গেলাস বদল করব। আর এক, দুই, তিন করে একশো গুনব। ঠিকাছে? রফিকুল বলে, মিল্কি রতনের মতন কাউরে ভালোবাসবা না। কানবা না। বুঝলা, জবাফুল আমি খুব ভালোবাসতাম। লাল দেইখ্যা। কিন্তু গন্ধ নাই বুঝলা। এরপর এতটুকু বলে রফিকুল গেলাসের হাত বদল করতে করতে গোপন সংকেত দেওয়া গেলাসটা নিজ হাতে নেয়। একশো গোনা শেষ। সে গেলাসের সবটুকু খায়। মিল্কি হয়তো কিছু বুঝে ওঠার আগেই তার ওপরে শুয়ে পড়ে রফিকুল, অস্ফুস্ট স্বরে কী বলেছিল, তুমি জবাফুল হলা না আমার!
বাথটাব পানির নিচে এলোমেলো দুটি নগ্ন তরণ-তরুণীর শরীর জড়ানো। অয়েল পেইন্টিং।

তিন. কোনো পাহাড়ী হিমশহর। রফিকুল হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে অনেক কষ্টে এমন একটা জায়গায় উঠে সেখানে দেখে যীশুখ্রিস্টের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার মতো লোহার ফ্রেমের একটা ক্রুশ। সেই ক্রুশে একটা সাপ ঝুলে আছে। রফিকুল তার মোবাইল থেকে সিম খোলে। তারপর সিমটিকে মুখে মুড়ে চিবিয়ে যতটা সম্ভব গুঁড়ো করে গেলে। মোবাইল ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে। এরপর এগিয়ে যায় ক্রুশে ঝুলে থাকা সাপের দিকে। তখন শীতের বিষণ্ণ বিকাল। সে জিহ্বা এগিয়ে দেয়, ব্যাস সাপটি সাহায্য করে। তার জিহ্বায় একটা সত্যি একটা মাত্র ছোবল দেয়। The road less travelled। রফিকুলকে দেখা যায় গড়িয়ে গড়িয়ে অনেক নিচে খাদ থেকে থাদে ঝরে পড়তে।

কিন্তু মুশকিল হলো রফিকুল এসব ভাবলে ভয় পায়। সে জানে আত্মহত্যা করবে না। সে ভীরু প্রকৃতির। তার সামনে জাকিরের মুখ ভাসে। ভাইজান ভাইজান ডাক শোনে। তার বাবার মুখ অতোটা ভাসে না। তবে মায়ের মুখ ভাসে। মাঝে মাঝে। ভাসবে আর কতদিন? সে তো স্মৃতিভ্রষ্টই হতে যাচ্ছে। অতএব বেঁচে থাকলেই বা কী মরে গেলেই বা কী? এমন চিন্তা রফিকুলকে তাজা করে।

একদিন দুপুরে ঘুম থেকে উঠে গোসল, নাস্তা সেরে তার কেন জানি বহুদিন পর খুব ফ্রেশ লাগে নিজেকে। আব্বা অফিসে। আম্মা রান্না নিয়ে ব্যস্ত। জাকির স্কুলে। সে গ্যাবার্ডিনের একটা প্যান্ট আর এ্যাশ কালারের টিশার্ট পরতে পরতে ফোনকল দেয় মিল্কিকে, ‘মিল্কি কোথায় তুমি?’
মিল্কি কল রিসিভ করে। কিন্তু এত কোলাহলপূর্ণ তার চারপাশ যে কথা স্পষ্ট শোনা যায় না। শুধু শোনা যায়, ‘স্কুলের গেইটে।’ আরো কীসব বলে শোনা যায় না।
রফিকুল বলে, ‘থাকো। আমি আসছি।’

বাসা থেকে বেরুনোর আগে রফিকুলের একটু ভয় জাগে, যদি না বাসা চিনে ফিরতে পারে, যদি চারপাশ অন্ধকার দেখে! তবু সে বেরিয়ে পড়ে। শ্যামলী সিনেমা হলের উল্টোপাড়ে গিয়ে একটু দাঁড়ানোর পরই বাস পায়। ঘিঞ্জি। উঠতে গিয়ে তাড়াহুড়ো করায় পায়ের একজোড়া স্যান্ডেলের একটা খসে পড়ে।

রফিকুল ততোক্ষণে উঠে গেছে। বাসও ছেড়েছে। রফিকুলের একটা হাত উপরের হাতল ধরা অন্যটি একটি সিটের পেছনে ভর দেওয়া। সে ধীরে ধীরে বাম পায়ে থাকা অন্য স্যান্ডেল পা থেকে খুলে অগোচরে যেনবা, কেউ যেন না দেখে এমনভাবে ধাক্কা দিতে দিতে অনেকটা দূরে সরিয়ে দেয়। যেন ওই একখানা স্যান্ডেল তার না।

জ্যাম।  বাস ধীরে ধীরে এগুচ্ছে। আসাদগেটের স্টপেজ পেরিয়ে ফের জ্যাম। রফিকুল মিল্কির বাসার কথা মনে পড়ে। আজিমপুর সরকারি কোয়ার্টারে। তার স্কুলও পাশেই। 

মিল্কিদের বাসার গেটভর্তি মাধবীলতা। উলোঝুলো হয়ে ঝুপ্পুস করে জড়িয়ে আছে গেটটা। সেই গেট ঠেলে এগুলে একটা উঠোনমতো। তারপর একটা টানা বারান্দা। প্রথম দরজাটা খুললে উপরে ওঠার সিঁড়ি। ওই উপরে থাকে বাকি বাড়িটা। আর দ্বিতীয় দরজা ঠেললে? হ্যাঁ, ওইটা মিল্কির ঘর। অনেকগুলো জানলা। সেই জানালা দিয়ে তাকালে জবাফুলের দুটো গাছ। মিল্কিকে যেদিন প্রথম টিউশনি পড়াতে যায় রফিকুল সেদিনের কথা মনে পড়ে। মিল্কিদের বাসার কাজের বুয়া প্রথমে এসে চা বিসকিট দেন। এর কিছুক্ষণ পর আসেন মিল্কির আম্মা। বোরকা পরিহিতা। বাসায়ও কি বোরকা পরেন? রফিকুল ভাবে। কে জানে? রফিকুলের পেছনে পেছনে ঢোকে মিল্কি। পরিচয়পর্ব শেষে রফিকুল মিল্কিকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই চলে যায় জবাফুলের দুটো গাছের দিকে। সে ওদিকে তাকিয়েই বলে, ‘বাহ, জবাফুল দেখতে দেখতে পড়ানো।’
মিল্কিও তাকায় জানালা গলিয়ে জবাফুলের দিকে।
রফিকুল আপনমনে বিড়বিড় করে বলে, ‘ফুলটা লাল। সুন্দর। কিন্তু কোনো স্মেল নাইকা। এই যে গন্ধ—এই ফুলটা পেল না এই নিয়া মজার গল্প আছে।’
মিল্কি মিশুক মেয়ে বোঝা গেল তার প্রশ্নে, ‘কী গল্প স্যার বলেন না?’
রফিকুল বলে, ‘ওইটা আরেকদিন বলুম। নাও ম্যাথ বইটা নাও।’

জ্যাম ছেড়েছে। প্রায় একঘণ্টা লেগে যায় মিল্কির স্কুলের গেটের কাছে পৌঁছাতে পৌঁছাতে। রফিকুল মোবাইলে কল করে, ‘মিল্কি আছো?’
কল রিসিভ করে মিল্কি বলে, ‘জ্বী। এই যে পাশেই আমিন কনফেকশনারির ভেতর।  জবাফুলের, রতনের গল্প শুনব বলে সেই থেকে বসে আছি। আপনি কই?’

দেখা হয় তাদের। একটা কমদামী হোটেলে ঢোকে। চা সিঙাড়া খায়। মুখোমুখি বসা। রফিকুলের মনে হয় সে তো আর কিছুদিন পরই মিল্কিকে চিনবে না। সে কিছু বলে না।   তার মুখ দেখে। ভাগ করে করে। ভ্রু। কপাল। চিবুক। ওষ্ঠ। কান। মিল্কি জানতে চায়, ‘কথা বলছেন না যে। কী দেখছেন?’
মানুষের এমন হয়। দেখছে এক জিনিস। ভাবছে অন্য জিনিস। আর ওই অন্য জিনিস নিয়ে ভাবনাই সে অসতর্কভাবে প্রকাশ করে ফেলে হঠাৎ। মন। তোর এত অলিগলি।   রফিকুল দৌড়াচ্ছে। এ গলি থেকে ও গলিতে। আর সামনে বসা মিল্কিকে বলে, ‘কী দেখছি? দেখছি জবাফুল।’

রফিকুলের মিল্কির হাত স্পর্শ করতে ইচ্ছা করে। বলতে ইচ্ছা করে সে আর বেশিদিন বাঁচবে না হয়তো। কিছুদিন পরই হয়তো আর কাউকে চিনতে পারবে না। স্মৃতিভ্রষ্ট হবে। বলতে ইচ্ছা, এই অল্প জীবনে সে কেন পড়াতে গিয়েছিল মিল্কিকে। মিল্কিকে কেন মনে পড়বে তার?

কিছুই বলে না।

বাসায় ফেরার পথে রফিকুল আটকা পড়ে নীলক্ষেত মোড়ে জ্যামে। একটা বাম ছাত্র সংগঠনের ছেলে মেয়েরা মিছিল বের করেছে। শ্লোগান দিচ্ছে ‘প্রহসনের নির্বাচন  চাই না। লুটপাটের ক্ষমতা চাই না। মুক্তি মুক্তি মুক্তি, মানুষের মুক্তি চাই।’

রফিকুলের শিরদাঁড়া বেয়ে ঘামের বিন্দু নামতে থাকে একের পর এক। তার মনে হলো ফের ঘটতে যাচ্ছে বিপর্যয়। একটা নেপথ্য। ব্যাকগ্রাউন্ড। আলো নেই। পিচ ডার্ক। শুধু সাউন্ড আসছে। কথা। আর অসংখ্য জবাফুল। ঝরে পড়ছে তার ওপর।

আপনারা কী ভাবছেন? চারপাশে যাদের দাঁত হাসছে তারা সেভেন্থ হেভেনে আছে আর রফিকুল দোজখের  টিকেট কেটেছে? জ্বী না... এটা দোজখই, টিকিট দরকারই নেই। এই যারা চাদ্দিকে রংচং মেখে দাঁড়িয়ে আছে, চোখ টিপছে, মুচকি হাসছে, বলছে, ‘দেখো, সব ঠিক হয়ে যাবে...’ তারাও, ওই... দোজখেই। কিন্তু কাউকে সেটা বলছে না। অথবা, কেউ কেউ আবার জানেও না এখনো। কেউ কাউকে বলে না তো... তাই সবাই জানে যে তারা জানে না তারা দোজখে আছে, অথবা তারা সত্যিই জানে না অথবা ওই বামের মিছিলের মুখগুলোও জানে না বিশ্ব পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। নো মোর বিপ্লব।

ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়া দুপুর যাচ্ছে বিকেলের কাছে। রফিকুলকে আমরা পড়ে থাকতে দেখি। দেখি অনেক লালজবা ঝরে পড়ছে তার ওপর। সত্যি কথা কী, এসব গপসপ তো আর রফিকুলকে বানিয়ে লাভ নেই। ইলিউশ্যুন। সব। সব।

সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষই বা কেমন দায়িত্বজ্ঞানহীন। ম্যানহোলের ঢাকনা খোলা। সেদিকে নজর নেই।

থাক ওসব কথা। আমরা এরপর দেখি রফিকুল একটু পাশ ফেরে। এরপর জবাফুলের ভিড় থেকে ম্যানহোলে পড়ে যায়। তেমন কিছু না, ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশন। এন্ড অব দ্যা হিস্ট্রি।

এগিয়ে আসুন, প্লিজ, না রফিকুলদের জন্য নয়। একটু ভাবতে থাকেন, রফিকুল গন্ধহীন জবাফুল কেন ভালোবাসত? আর তার পরিণতি কেনইবা হলো দুর্গন্ধযুক্ত ম্যানহোলে। সে ভেসে ভেসে এই রাজধানী ঢাকার নিচ দিয়ে বুড়িগঙ্গায় গিয়ে মিশবে। বাদ দেন। আমরা বরং উপরিকাঠামোতেই ব্যস্ত থাকি। লগ আউট।

   

দুই দেশের রং মিলেছে এক দেয়ালে



মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, ব্যাংকক, থাইল্যান্ড
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

রঙের শহর, হাসির শহর ব্যাংকক। দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভ্রমণ করা শহর ব্যাংকক। ব্যাংককের প্রাণকেন্দ্র সিয়ামেই রয়েছে ব্যাংকক র্আট এন্ড কালচারাল সেন্টার (বিএসিসি)। বাংলাদেশ থেকে যারা ব্যাংককে বেড়াতে যান, তারা যদি এমবিকে মলের পাশ দিয়ে স্কাই ওয়াক হয়ে তৃতীয় তলায় প্রবেশ করেন তাহলে হাতের ডানে চোখ ফেললেই দেখতে পাবেন বাংলাদেশের রঙের খেলা আর জীবনযাত্রার চিত্র।

স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষ্যে গত ২৬ র্মাচ থেকে ব্যাংককের র্আট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে শুরু হয়েছে বাংলাদেশ ও থাই চিত্রশিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘ড্রীম অব কালারস’ বা ‘রঙের স্বপ্ন’ র্শীষক চিত্র প্রর্দশনী। ‘কানেক্টিং টু ল্যান্ডস এন্ড টুপিপলস’ স্লোগানকে সামনে রেখে বাংলাদেশ ও থাইল্যান্ডের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তেই এই আয়োজন।


তৃতীয় তলার করিডোর ধরে হাঁটতেই চোখে পড়বে শিল্পী মুস্তাফিজুল হকের নিহঙ্গ। ওয়াসি পেপারের ওপর জাপানি ধরনের চিত্রকর্মের জন্য প্রসিদ্ধ তিনি। ক্যানভাসের ওপর আর্কিলিকের চিত্রকর্ম ‘হর্স’ মনযোগ আকর্ষন করছিল দর্শনার্থীদের। তার চিত্রকর্মের বড় বৈশিষ্ট্য নাটকীয়তা এবং বিষয়ের গভীর উপস্থিতি।

নগরের জীবনযাত্রার প্রতিচ্ছবি ফুটিয়ে তুলতে শিল্পী কামাল উদ্দিনের জুড়ি নেই। তবে এখানে ব্যক্তির পোর্ট্রেট নয় বরং পেস্টেলে তবলার রং ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী।

আবার থামাসাত বিশ্ববিদ্যালয়ের চিত্রকলার শিক্ষক খাজোনসাক মাহাকুন্নাওয়ানের তুলিতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের নগরের জীবন। রিকশার সঙ্গে যাত্রীদের ছুটে চলা। সময়কে যেন পাশ কাটিয়ে ছুটে চলছে তার চিত্রকর্ম।


ঢাকার গ্যালারি চিত্রকের ১৮ জন শিল্পী এবং থামাসাত ইউনিভার্সিটির ফাইন অ্যান্ড এপ্লাইড আর্টস বিভাগের ৪ জন শিল্পীর যৌথ অংশগ্রহণে চলছে এই আয়োজন। চলবে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত। গত ২৬ মার্চ চিত্র প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন থাইল্যান্ডে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহা. আব্দুল হাই।

চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন নিয়ে তিনি বলেন, দুটি দেশের ভূমি আর মানুষকে কাছাকাছি নিয়ে এনেছে এই আয়োজন। চিত্রকর্মের মাধ্যমে যে যোগাযোগ সেটা শুধু বাহ্যিক নয়, বরং আত্মার যোগাযোগ। শুধু দেশকে চেনায় না, বরং সেখানকার জীবনযাত্রার ধারণা দেয়, মানুষকে কাছে নিয়ে আসে।


ব্যাংককের বাংলাদেশ দূতাবাসের এই চিত্রপ্রদর্শনীতে রফিকুন্নবী, আব্দুস সাকুর শাহ, সৈয়দ আবুল বার্ক আলভি, শেখ আফজাল, মাহফুজুর রহমান, সুমনা হক, মুনিরুজ্জামান, জহির উদ্দিন, কনক চাপা চাকমা, বিপাশা হায়াত, মোহাম্মদ ইউনুস, সুলেখা চৌধুরী, রেজাউন নবী, কামাল উদ্দিন, পারভীন জামান, সুমন ওয়াহিদ, মোস্তাফিজুল হক, আহমেদ সামসুদ্দোহার চিত্রকর্ম স্থান পেয়েছে।

এছাড়াও থাইল্যান্ডের চিত্রশিল্পী খাওজনসাক মাহাকুন্নাওয়ান, ওয়ারাপান সামপাও, জিরাতচায়া ওয়ানচান, প্রারুনরপ প্রিউসোপির চিত্রকর্মও স্থান পেয়েছে প্রদর্শনীতে।

ব্যাংকক আর্ট অ্যান্ড কালচারাল সেন্টারে সকাল থেকেই বিভিন্ন বয়সী শিল্প প্রিয় মানুষের আনাগোনা থাকে। সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত এই প্রদর্শনী উপভোগ করতে পারছেন দর্শনার্থীরা।

;

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান

  • Font increase
  • Font Decrease

ইতিহাসবিদ-দার্শনিক মুঈন উদ-দীন আহমদ খান জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চায় নিমগ্ন এক মনীষীর নাম। বাংলাদেশের বিদ্যাবৃত্তে ক্লাসিক্যাল চরিত্রের শেষ দৃষ্টান্ত ছিলেন তিনি। ২৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) ৩য় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা। 

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান (১৮ এপ্রিল, ১৯২৫-২৮ মার্চ, ২০২১) নির্জলা তথ্যভিত্তিক ইতিহাসের খোঁজে সুদীর্ঘ জীবনব্যাপী জ্ঞানচর্চার কষ্টসাধ্য দিনগুলো অতিবাহিত করেন নি। তিনি মনে করতেন, ইতিহাসের সত্য সন্ধান শুধু তথ্য আর যুক্তি ভিত্তিক নয়। প্রকৃত ইতিহাস মূলত ইতিহাসের দর্শন, ইতিহাসের পুনর্গঠন, কল্পনা, সমকালীন পর্যালোচনা ও ইনটুইশনের উপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর সান্নিধ্যে এলে সবাই এই সত্য টের পেতেন যে, ইতিহাস প্রধানত দর্শন ও সাহিত্যের সমধর্মীতায় বর্তমানের জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বাস্তবতা ভিত্তিক সমস্যাগুলোকে বিশ্লেষণের এবং দিকনির্দেশনা দেওয়ার অপরিহার্য মাধ্যম। তাঁর স্বকীয় চিন্তার দ্যুতিতে তিনি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা চর্চা ও গবেষণায় একটি বিশিষ্ট ধারার প্রতিভূ রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এবং একটি পুরো জীবন সম্পূর্ণভাবে বিদ্যাচর্চার ধ্যানজ্ঞানে যাপন করেছেন। আর চট্টগ্রামের নিরিখে তিনি ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাচর্চা কাঠামোর আদি নির্মাতাদের অন্যতম। যেমনভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র ড. আবদুল করিম ছিলেন ইতিহাসচর্চার প্রতিষ্ঠাতা, প্রফেসর মোহাম্মদ আলী ইংরেজির, ড. আর. আই চৌধুরী রাজনীতি বিজ্ঞানের, তেমনিভাবে তিনি ছিলেন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোবদ্ধ বিদ্যাচর্চা ধারার সূচনাকারী। চট্টগ্রামের আধুনিক উচ্চশিক্ষা বিস্তারের আদি মুঘলদের একজন ছিলেন তিনি।  

তিনি ছিলেন আড়ম্বরহীন জ্ঞানসাধক। নিজস্ব বিদ্যাবলয়ের বাইরে তাঁর কোনও আত্মপ্রচার বা আত্মগরিমা ছিল না। যদিও তাঁর জ্ঞানের পরিধি ও গভীরতা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়ার মতো যোগ্য লোকের সংখ্যা তাঁর আশেপাশে খুব বেশি ছিল না, তথাটি যারা তাঁর রচনা খেয়াল করে পড়েছেন এবং তাঁর সঙ্গে শ্রেণিকক্ষে কিংবা অনানুষ্ঠানিক পরিসরে আলাপ, আলোচনা, সংলাপ ও বিতর্কের সুযোগ পেয়েছেন, তাঁরা বিলক্ষণ জানতেন, কত ভাষা, কত বিষয়, কত তত্ত্ব ও তথ্যাদি সম্পর্কে অনায়াস দক্ষতা ও পা-িত্য ছিল প্রাচ্যদেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের এই জ্ঞানতাপসের। দক্ষিণ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী চুনতী গ্রামের আদিবাস আর পুরনো চট্টগ্রাম শহরের রুমঘাটা থেকে এই মান্যবর জ্ঞানবৃদ্ধের কাছ থেকে বিচ্যুরিত দীপ্তি কিছু কিছু অনুভব স্পর্শ করেছে দেশে-বিদেশে তাঁর কর্ম ও গবেষণা ক্ষেত্র এবং বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

তাঁর জ্ঞান, গবেষণা, মনীষা, বুদ্ধির দীপ্তি, বহু ভাষায় পারঙ্গমতা তাঁর সমকালে অন্য কারও মধ্যে বিশেষ পরিলক্ষিত হয় নি। বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চায় প্রবাদপ্রতীম ড. আহমদ হাসান দানি যে তিনজন ছাত্রকে গবেষণায় প্রণোদিত ও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিলেন, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান তাঁদের একজন। অন্য দুইজন হলেন আবদুল করিম ও মোহর আলী। এই তিনজনই বাংলাদেশের ইতিহাসচর্চায় সত্যিকারের মৌলিক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে, মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষাজীবনে প্রথম বিভাগ, স্বর্ণপদক, ফেলোশিপ ও বৃত্তি লাভ করেন একজন মেধাবী ছাত্র রূপে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ও মাস্টার্স করার পর তিনি মোটেই থেমে থাকেন নি। ফুলব্রাইট স্কলারশিপ নিয়ে কানাডার বিখ্যাত ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় মাস্টার্স ডিগ্রি নেন। ফিরে এসে খ্যাতনামা ইতিহাসবিদ ড. আহমদ হাসান দানির তত্ত্বাবধানে ‘ফরায়েজি আন্দোলন’ বিষয়ে পথপ্রদর্শনকারী পিএইচডি গবেষণা সম্পন্ন করেন। তারপর পোস্ট গ্রাজুয়েট ফেলোশিপ লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় বার্কলের ‘ইন্সটিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ’-এ রাজনীতি বিজ্ঞানের ‘সেমিনার ইন ফিল্ড ওয়ার্ক কোর্স’ অধ্যয়ন করেন। তিনি কানাডার ম্যাকগিল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বের প্রখ্যাত প-িত, ইসলামিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা উইলফ্রেড ক্যান্টওয়েল স্মিথের সান্নিধ্যে এসে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হন। যে কারণে, পরবর্তী জীবনে তিনি ইসলামিক স্টাডিজ ও ইসলামের ইতিহাসকে কেন্দ্রবিন্দুতে রেখে ধর্মতত্ত্ব, দর্শন, বিজ্ঞান, বিশেষত এক্সপেরিমেন্টাল সায়েন্সের ক্ষেত্রেও নিজের অবদান রাখেন এবং তাঁর গুণমুগ্ধ শিক্ষার্থীদের ছাড়াও তাঁর মূল-বিষয়ের বাইরের লোকজনকেও প্রবলভাবে আকর্ষণ করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুইজন নেতৃস্থানীয় শিক্ষক যথাক্রমে মর্শন বিভাগের প্রফেসর ও বিভাগীয় প্রধান বদিউর রহমান এবং কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ডিন শব্বির আহমদ তাঁর অধীনে পিএউচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।

গবেষণা তত্ত্বাবধানে তিনি ছিলেন প্রচ- রকমের শুদ্ধতাবাদী। একটি প্রকৃষ্ট গবেষণার জন্য ¯œাতকোত্তর ও এমফিল পর্যায়ের গবেষকদেরও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নিয়োজিত করতেন, যাতে তারা ভবিষ্যতে গবেষক হিসাবে স্বাধীনভাবে কাজ করার দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। তাঁর সাথে গবেষণার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে ড. আফম খালিদ হোসেন জানিয়েছেন, “তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের উদ্দেশ্যে তাঁর অনুমোদন নিয়ে কলকাতা, লক্ষেœৗ, দিল্লি, তুঘলকাবাদ, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদ, মক্কা ও মদিনা সফর করি।” কোনও মতে একটি ডিগ্রি দিয়ে দেওয়ার অসৎ পন্থার বিপরীতে গবেষণাকে বস্তুনিষ্ঠ ও তথ্যনির্ভর করতে তিনি ছিলেন একজন দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী শুদ্ধতম তত্ত্বাবধায়ক। শেষজীবনে তাঁর সঙ্গে বা পরামর্শে যারা গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন, তাদের মানস গঠনে ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা নির্মাণে তিনি শ্রমবিমুখ ছিলেন না। ঘন্টার পর ঘণ্টা তিনি তাঁদের সঙ্গে আলোচনা কিংবা বই-পুস্তক পর্যালোচনায় লিপ্ত হতেন। এমন চিত্র আমি নিজে তাঁর বাসভবনে উপস্থিত কালে লক্ষ্য করেছি। কখনও নবাগত গবেষকদের তিনি অন্যান্য শিক্ষক ও গবেষকদের কাছে পাঠাতেন। তাঁর রেফারেন্সে একাধিক তরুণ গবেষক আমার কাছে এসে নানা বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং তাঁর রেফারেন্সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের বিভাগের সেমিনার লাইব্রেরিতে কাজ করেছেন। একটি বস্তুনিষ্ঠ ও স্বয়ংসম্পূর্ণ গবেষণা সম্পন্ন করতে তিনি তত্ত্বাবধায়ত ও প্রণোদনাদাতা রূপে ছিলেন নিরলস।   

কঠোর তথ্যনিষ্ঠা ও শুদ্ধতার প্রতিফলন ঘটেছে মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের প্রতিটি রচনায়। বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ও প্রবন্ধগুলো যে কারণে একই সাথে পাঠকপ্রিয় এবং অ্যাকাডেমিক জ্ঞান ভা-ারে মণি-মুক্তা তুল্য। তাঁর সবচেয়ে আলোচিত গ্রন্থ ‘হিস্ট্রি অব ফরায়েজি মুভমেন্ট ইন বেঙ্গল’ একটি পথিকৃৎ গবেষণা, যা ‘বাংলায় ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস’ নামে ইংরেজি থেকে অনূদিত হয়েছে। যে ফরায়েজি আন্দোলনকে ওয়াহাবি আন্দোলন বা তরিকা-ই-মুহাম্মদীয়া নামেই সবাই জানতো, তিনি তাঁর বহুমাত্রিক চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব গবেষণার মাধ্যমে উন্মোচিত করেন।  ফারায়েজি আন্দোলন যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছিল বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক সচেতনতা, সামাজিক গতিশীলতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম ও আদি প্রচেষ্টা, তিনিই সর্বপ্রথম তা প্রমাণ করেন। বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে উত্থিত এই আন্দোলনের গণমুখী চরিত্র, ঔপনিবেশিকবাদ বিরোধী বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ও ধর্মীয় কুসংস্কার বিরোধী মনোভাব এবং সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াকু মানসিকতার বিষয়াবলী তিনি ঐতিহাসিক তথ্য ও ধর্মতাত্ত্বিক মাত্রায় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক পটভূমিতে উপস্থাপন করেন। বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও বৃহৎ ক্যানভাসে গবেষণার কৃতিত্বে তিনি এই বিষয়ে এবং ঔপনিবেশিক বাংলার সামাজিক-রাজনৈতিক ইতিহাস বিনির্মাণের পথিকৃৎ প্রাণিত স্বরূপে সর্বমহলে সম্মানীত হয়েছেন। 

পরবর্তীতে প্রকাশিত মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের গ্রন্থ ও প্রবন্ধে তিনি তাঁর মৌলিকত্বের ছাপ রেখেছেন। প্রতিটি লেখাতেই তিনি নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্লেষণের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তাঁর লেখায় দর্শন, বিজ্ঞান, ধর্মতত্ত্ব, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস ইত্যাদি বহুবিদ্যার প্রকাশ ঘটেছে। শ্রেণিকক্ষের পাঠদান ও গবেষণার বাইরে তাঁর সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হলো জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাধারাকে পরবর্তী প্রজন্মে প্রবাহিত করার প্রয়াস। তিনি ছিলেন ধ্রুপদী দার্শনিকদের মতো সংলাপ-প্রবণ ব্যক্তিত্ব। কেউ আগ্রহী হলে কিংবা কারো প্রতি তিনি আগ্রহী হলে তাঁকে বা তাঁদেরকে সাদরে আমন্ত্রণ জানিয়ে আলোচনায় লিপ্ত হতেন। তিনি তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানদের মতো বইয়ের পাতার শুকনো অক্ষরে বন্দি ছিলেন না, জ্ঞানবৃত্তের মানুষের সঙ্গে প্রাণবন্ত সংলাপ ও সংশ্লেষের মাধ্যমে সদা জীবন্ত ছিলেন। চট্টগ্রামে তো বটেই, বৃহৎ বঙ্গদেশে খুব কম সংখ্যক প-িতই এমন ছিলেন, যারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় অন্যকে প্রণোদিত করার ক্ষমতা ধারণ করতেন। ঢাকায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক এবং চট্টগ্রামে ড. আবদুল করিম, ড. আর. আই. চৌধুরী ছাড়া কম প-িতই ছিলেন, যারা শিক্ষার্থীদের প্রাণিত করার ক্ষেত্রে মনীষী মুঈন উদ-দীন খানের সঙ্গে তুলনাযোগ্য।

জ্ঞানের সঞ্চার ও বিস্তারে তাঁর অসীম কষ্ট সহিষ্ণুতা, আগ্রহ ও বিনয় তাঁকে ক্লাসিক্যাল যুগের প্রাচীন জ্ঞানতাপসের আধুনিক প্রতিচ্ছবিতে পরিণত করেছিল। ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সান্নিধ্যে এসে আমি তা স্পষ্টভাবে অনুভব করি। আমি তাঁর সরাসরি ছাত্র ছিলাম না। এবং বয়সের দিক থেকে তিনি ছিলেন আমার চেয়ে কয়েক প্রজন্ম অগ্রগামী। তথাপি অশীতিপর বয়সে এসেও তিনি আমার কোনও লেখার প্রতি আগ্রহী হলে নিজে ফোন করে জানিয়েছেন। ডেকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং বিষয়টিকে তত্ত্ব ও তথ্যগতভাবে আরও সমৃদ্ধ করার ইঙ্গিত দিয়েছেন। সেসব আলোচনায় জ্ঞানতত্ত্ব ও তুলনামূলক দর্শন সম্পর্কে তাঁর অতলস্পর্শী পা-িতের দীপ্তিমান প্রভার আঁচ পাওয়ার বিরল সুযোগ আমার হয়েছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছিল, বহু তরুণকে তিনি গবেষণার দিক-নির্দেশনা ও বিষয়বস্তু সম্পর্কে মৌলিক ধারণা দিতে আগ্রহী ছিলেন। তাঁর মধ্যে পথ প্রদর্শনের একটি বিরল গুণ ছিল। আর ছিল জ্ঞানকে অকাতরে ছড়িয়ে দেওয়ার উদার মানসিকতা, যা আজকের অ্যাকাডেমিক প্রতিযোগিতার পঙ্কিল ও সঙ্কীর্ণমনা ধারার প্রেক্ষিতে অকল্পনীয় বিষয়। বড় মন ও মুক্ত মানসিকতার কারণে তিনি ‘বাংলাদেশের লিলিপুট প-িতদের সমাবেশে’ মহীরূহ-সম ব্যক্তিত্বে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন।   

মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খানের মতো বিটপী ব্যক্তিত্বকে দৃশ্যপটে রেখে আজকের ক্ষুদ্রতর পরিসরে আলোচনা করা মোটেও সম্ভব নয়। কারণ, বর্তমানের ঊন-মানুষ ও ঊন-মানসিকতার পরিম-লে তাঁর মতো বড় মানুষের দেখা পাওয়াও দুষ্কর। তিনি এবং তাঁর সমগোত্রীয়রা শেষ মুঘলের মতো দৃশ্যপট থেকে চলে গিয়েছেন। কিন্তু রেখে গিয়েছেন ধ্রুপদী ঐতিহ্য, ব্যক্তিত্বের দীপ্তি ও বিভা। তিনি ছিলেন প্রথম প্রজন্মের আধুনিক বাঙালির হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে সকল অগ্রণী প-িত, গবেষক ও শিক্ষাব্রতীগণের শ্রেষ্ঠতম ও উজ্জ্বল প্রতিনিধি, যারা  জাগতিক প্রাপ্তির আশায় জ্ঞানের সাধনা করেন নি। জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যাচর্চার নিতান্ত আবশ্যক পরিসীমার বাইরেও তাঁরা সচরাচর যান নি। তাঁদের নিতান্ত আবশ্যক বস্তুর তালিকায় সর্বাগ্রে ছিল জ্ঞানচর্চা, বিদ্যার্জন ও গ্রন্থপাঠ। বিষয় ভিত্তিক প্রয়োজনীয় বইয়ের বাইরেও অন্য বিষয় সংক্রান্ত রচনা তাঁরা পড়তেন আনন্দ ও কৌতূহল নিবৃত্তির সুতীব্র আকর্ষণে। কারও কারও পুস্তক সংগ্রহ আর রোজগারের মধ্যে কোনও ভারসাম্য থাকতো না। জাগতিক উন্নতির বিষয়গুলোকে তাঁরা তুচ্ছ বিবেচনা করে অবজ্ঞা করেছেন। ইতিহাসবিদ তপন রায়চৌধুরীর মতে, “যে জীবনে বৈষয়িক উন্নতির সম্ভাবনা বিরল, তার পরিপ্রেক্ষিতে বেশ কিছু বিখ্যাত মানুষ সত্যিই সারস্বত-কর্মে জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। বর্তমানের বিশ্লেষণপ্রবণ গবেষণার ধারা তখনও প্রবল হয় নি। কিন্তু অনেক গবেষণাই গভীর পা-িত্যের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হতো।” মনীষী মুঈন উদ-দীন আহমদ খান সম্পর্কে এই বক্তব্য বিশেষভাবে প্রযোজ্য। আত্মমগ্ন ধ্যানীর মতো সারা জীবন তিনি জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত থেকে গভীর পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন। শুধু নিজেই নন, প্রণোদিত করেছেন পরবর্তী বেশ কিছু প্রজন্মের উৎসাহী তরুণদের, যাদের অনেকেই বিদ্যাচর্চায় লিপ্ত রয়েছেন।

তাঁর সঙ্গে ইতিহাসের আরেক মহান সাধক যদুনাথ সরকারের কিছু কিছু বিষয় তুলনীয়, যার মধ্যে রয়েছে প্রবল পরিশ্রম, জ্ঞান তৃষ্ণা এবং অনুসন্ধান। যদুনাথের বিশ্লেষণের নিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বিতর্ক থাকার পরেও ইতিহাসচর্চায় তিনি সর্বজনমান্য আচার্য। তিনি নিজের কর্ম ও জীবন আলোচনা করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি করতেন: “পথের প্রান্তরে করি নাই খেলা/শুধু বাজায়েছি বসি সারাবেলা/ছিন্নতন্ত্রী বীণা।” মনীষী প্রফেসর ড. মুইন উদ-দীন আহমদ খানও সারাজীবন জ্ঞানচর্চার বাঁশরী বাজিয়েছেন। একটি আস্ত জীবনকে উৎসর্গ করেছেন জ্ঞানের সাগরে অবগাহনের মাধ্যমে। বিদ্যার্চচাকে পেশাগত পরিম-লে জিম্মি না করে জীবন ও যাপনের মূলমন্ত্রে পরিণত করেছিলেন তিনি। আর সব কিছুই তিনি করেছেন নিজের সুমৃত্তিকা ও মানুষকে কেন্দ্র করেই। জীবনের পর্বে পর্বে নানা দেশে, নানা প্রতিষ্ঠানে কাজ করেও তিনি অবশেষে ফিরে এসে আলোকিত করেছেন প্রিয় মাটির প্রিয় মানুষদের, প্রিয় জনপদকে। জীবনের দিনগুলোর মতোই মৃত্যুর পরেও তিনি আলোর দিশারী হয়ে দেদীপ্যমান রয়েছেন জ্ঞানচর্চা ও বিদ্যামুখী অভিযাত্রীদের চৈতন্যের মর্মমূলে।  

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম  সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;