বিবর্ণ সায়র



ফাহ্‌মিদা বারী
অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

অলঙ্করণ শতাব্দী জাহিদ

  • Font increase
  • Font Decrease

এক

দিলারা হাসান পাতলা টাওয়েল দিয়ে শিশুটিকে প্যাঁচিয়ে বের হয়ে এলেন লেবার রুম থেকে। একটুও সময় নষ্ট করলেন না তিনি। ডাক্তার, দুজন জুনিয়র সহকারি ডাক্তার, নার্স...সবাই বিস্মিত হয়ে তাকে দেখছে। বাধা দেওয়ার ক্ষমতাটুকুও যেন হারিয়ে ফেলেছে সবাই। দিলারা হাসান নির্বিকার। এত কিছু লক্ষ্য করার সময় নেই এখন। ডাক্তারের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়েই লেবার রুমে ঢুকেছিলেন তিনি। প্রথমে রাজি হচ্ছিলেন না ডাক্তার রওশন জাহান। বেশ কড়া ভাবেই বলেছিলেন, ‘আরে, কী বলছেন এসব আপনি? আপনি কেন থাকবেন লেবার রুমে? আমাদের হসপিটালের একটা নিজস্ব নিয়ম আছে। আমরা ডাক্তার কিংবা নার্স ছাড়া অন্য কাউকে লেবার রুমে এলাউ করি না।’
দিলারা হাসান কাতর মুখে বলেছিলেন, ‘দেখুন, দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন। আমার মেয়েটি সাঙ্ঘাতিক ভীতু প্রকৃতির। ভয়ে শেষমেশ ওর একটা ভীষণ কিছু হয়ে যাবে। আমি থাকলে মেয়েটা একটু সাহস পেত।’
‘দেখুন, আপনিও দয়া করে বোঝার চেষ্টা করুন। সব মেয়েদেরই এইরকম সময় পার করতে হয়। ডেলিভারি পেইন সহ্য করে মা হতে হয়। পৃথিবীর সব মেয়েই কি সাহসী হয়ে জন্মায়? মা হওয়ার এই প্রক্রিয়াও তাদের সাহসী হতে সাহায্য করে। তাছাড়া আপনার মেয়ের বয়স অল্প। ডেলিভারিতে কোনোরকম কমপ্লিকেসি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমি কেন আপনার এই অন্যায় আবদার মেনে নেব?’

দিলারা হাসান তবুও গোঁ ধরে বসে থাকেন। কিছুতেই নিজের আবদার থেকে তাকে সরানো যায় না। শেষ পর্যন্ত নিতান্ত ইচ্ছের বিরুদ্ধে রাজি হতে বাধ্য হলেন ডাক্তার রওশন জাহান। দিলারা হাসান ডেলিভারির সময় লেবার রুমে থাকার অনুমতি পেলেন। কিন্তু ডেলিভারির পরপরই তিনি কেমন যেন অস্থিরতা শুরু করে দিলেন। তাড়াতাড়ি বাচ্চাকে কোলে নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলেন।

উপস্থিত ডাক্তার, নার্স প্রত্যেকে খুব বিরক্ত হয়ে উঠল এই আচরণে। ডেলিভারির পরে বাচ্চাকে তার মায়ের বুকে দেওয়ার কথা...কিন্তু দিলারা হাসান কেমন একরকম ছোঁ মেরেই বাচ্চাকে তুলে নিলেন। তারপরে হঠাৎ করে কাউকে কিছু বোঝার অবকাশ না দিয়েই বাচ্চাকে একটা টাওয়েল দিয়ে পেঁচিয়ে সেখান থেকে বের হয়ে এলেন। যে মেয়ের জন্য তিনি লেবার রুমে ঢোকার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠেছিলেন, সেই মেয়ের দিকে একবার ফিরেও দেখলেন না।

লেবার রুমে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে এ ওর মুখের দিকে তাকাতে লাগল। কী ঘটে গেল তারা যেন কিছুই বুঝতে পারছে না। এভাবে বাচ্চাকে নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার কী মানে হয়? আর তাছাড়া ডেলিভারির পরে বাচ্চাটাকে কিছুক্ষণ অবজারভেশনেও রাখার কথা। অথচ এই ভদ্রমহিলা কাউকে কোনো সময়ই দিলেন না!

বাইরে বেরিয়ে দিলারা হাসান নির্দিষ্ট জায়গায় অপেক্ষা করতে লাগলেন। বাচ্চাটা কাঁদছিল। তিনি মুখে একটা দুধের ফিডার ধরে দিলেন। কিছুক্ষণ টেনে তার কান্না বন্ধ হয়েছে। ড্রাইভার আর কাজের মেয়ে কমলাকে আগে থেকেই সবকিছু বলা ছিল।

নরমাল ডেলিভারি হয়েছে। অল্প সময়েই রোগীকে ওয়ার্ডে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকেই একটা হুইল চেয়ারে বসিয়ে তাকে ওঠানো হয়েছে গাড়িতে। ওয়ার্ডের এসিস্টেন্ট নার্স অনেক বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সুবিধা করতে পারেনি। নার্স কিছু একটা সন্দেহ করে ডাক্তারকে ডেকে আনার জন্য পাও বাড়িয়েছিল। তখনই তার হাতে বেশ কিছু নোট গুঁজে দেয় ড্রাইভার লিয়াকত।

রোগীকে গাড়িতে উঠিয়ে তারা দুজন দিলারা হাসানকে চোখের ইশারা করে। সেটা দেখেই আর দেরি করেন না দিলারা হাসান। তাড়াতাড়ি চলে আসেন রিসেপশনে।

ক্লিনিকটা তেমন পুরনো নয়। মোটামুটি নতুনই বলা চলে। স্টাফ সংখ্যাও খুব একটা বেশি নয়। ওয়ার্ডগুলো বেশ ফাঁকা ফাঁকা। চিকন করিডোরটা পার হতে হতে এদিক সেদিক দেখছিলেন দিলারা হাসান। নাঃ! তেমন কেউ নেই আশেপাশে।

রিসেপশনে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন তিনি। রিসেপশনিস্ট মেয়েটি চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। দিলারা হাসান কিছুক্ষণের জন্য থতমত খেয়ে গেলেন। কিন্তু খুব তাড়াতাড়িই সুনিপুণ দক্ষতায় নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। করুণ মুখে বললেন, ‘আমার মেয়ের বাচ্চাটা মনে হয় বদল হয়েছে। আমি কাউকে পেলাম না কথাটা বলার জন্য। আপনি...তুমি কি একটু দেখবে দয়া করে মা?’ মেয়েটা ফোন করার জন্য রিসিভার কানে তুলতে যাচ্ছিল দেখেই তিনি তাড়াতাড়ি আবার বলে ওঠেন, ‘না না...তুমি একটু বাচ্চাটাকে সাথে করে নিয়ে যাও। আমি এখানেই আছি। একটু কিছুক্ষণের জন্য...নিজে গিয়ে একটু দেখো না মা!’

রিসেপশনিস্ট মেয়েটি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকল দিলারা হাসানের দিকে। তার রিসেপশন থেকে উঠে যাওয়ার অনুমতি নেই। আবার ভদ্রমহিলার কথাগুলোও সে ঠেলতে পারছে না। বয়স্ক একজন মানুষ মা মা বলে তাকে অনুরোধ করছে। এটা ঠেলে ফেলার মতো মনের জোর এখনো হয়ে ওঠেনি মেয়েটার। সে কোলে তুলে নিলো বাচ্চাটিকে। বাচ্চাটি ঠিক সেই মুহূর্তেই কেমন যেন একটা শব্দ করে উঠল। দিলারা হাসান আবার তাড়া দিলেন তাকে। মেয়েটি কিছুটা অনিচ্ছা সহকারেই এগিয়ে গেল সামনের দিকে।

আর দাঁড়ালেন না দিলারা হাসান। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠে সশব্দে বন্ধ করে দিলেন দরজা। মেয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন নিশ্চল চোখে। ব্যথায় কুঁকড়ে যাওয়া মুখে স্বগতোক্তি করে চলেছে তার মেয়ে ঈষিতা, ‘একটিবার দেখতেও দিলে না আমাকে? একটিবারের জন্য ওকে কোলে নিতে দিলে না! মাত্র একবার....’
দিলারা জামান ঠান্ডা গলায় ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন, ‘লিয়াকত, গাড়ি চালাও।’

দুই

আঠারো বছর পরের কথা...
লতিফা বেগম আঁচারের বয়াম রোদে শুকাতে দিয়ে মোড়ায় বসে উলকাঁটা বুনছেন। শীতের সকালের মিঠেকড়া রোদ। এমন আরামদায়ক রোদে পিঠে রোদের হাল্কা আঁচ এসে লাগলে শরীরটা চনমনে হয়ে ওঠে। বাতের ব্যথারও বড় উপশম হয়। তিনি শীতের সকালের এই রোদটা উপভোগ করার জন্য সব কাজকর্ম ফেলে রাখতে রাজি আছেন।

ছোট বউমা আঁচার বানিয়েছে। লতিফা বেগম বসে বসে সেই আঁচার পাহারা দিচ্ছেন। এই অজুহাতেই তিনি দীর্ঘসময় রোদে বসে থাকেন। কারণ বেশিক্ষণ আরাম করে রোদ পোহানোর জো নেই। বড় বৌ সোহানা তার এই বেশিক্ষণ রোদ পোহানোর ওপরেও কড়াকড়ি জারি করে দিয়েছে। শক্ত নির্দেশ দিয়ে বলেছে, ‘মা, আপনি কিন্তু অনেক বেশি সময় রোদে বসে থাকেন। বেলা বারোটার পরে সূর্যের আলো সরাসরি গায়ে না লাগানোই ভালো। সকাল আটটা থেকে নয়টা...বড়জোর দশটা, ব্যাস! তারবেশি দরকার নেই। এক ঝামেলা মেটাতে গিয়ে আরেক ঝামেলা বাঁধিয়ে বসবেন দেখছি!’

সোহানা ডাক্তার। কাজেই তার কথা না শুনে উপায় নেই। তবু রোদ থেকে উঠে আসতে মন চায় না লতিফা বেগমের। বসে বসে কত কী ভাবনায় জড়িয়ে যান তিনি! রোদের ওম গায়ে লাগিয়ে ব্যথা বেদনাকে সাময়িক ছুটি দিয়ে সংসারের হাজার বেদনায় ইচ্ছেমতন ডুব মারা যায়।  মনোকষ্টের কি আর শেষ আছে? আপাতত ছোট ছেলের বৌকে নিয়েই যত চিন্তা তার। বিয়ের প্রায় পনেরো বছর হতে চলল। এখন অব্দি মা হওয়ার নাম নেই! সারাদিন রান্নাবান্না, সেলাই ফোঁড়াই নিয়ে তুমুল ব্যস্ত সময় কাটায়। কী ই বা করবে বেচারী! একটা কিছু না করলে তার সময়টাই বা কিভাবে কাটবে?

লক্ষীগোছের চুপচাপ মেয়ে দেখে ঘরে এনেছিলেন। দেখতে শুনতে একেবারে এক নাম্বার। মাস্টার্স করছিল। বড় বৌ ডাক্তার। কাজেই ছোটজন লেখাপড়াতে বেশি পিছিয়ে থাকলে বিয়ের পরে দুই বৌয়ের মধ্যে ঝামেলা বাঁধতে পারে। ব্যক্তিত্বের ঝামেলা। সেজন্যই মাস্টার্স পাশ মেয়ে দেখে খুঁজে এনেছিলেন। কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে সেটাই কাল হয়েছে। আরেকটু কম বয়সী মেয়ে নিয়ে এলে হয়তো বাচ্চা হতে এই সমস্যাটা পোহাতে হতো না। আজকাল মেয়েদের একটু বাড়তির দিকে বয়স চলে গেলেই বিপদ। বাচ্চা হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।

ছোটছেলের যদি কোনো উত্তরাধিকার না থাকে, তাহলে কিভাবে সয়সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারা করবেন সেই চিন্তাতেই রাতে ঘুম আসে না তার। স্বামী তো তার ঘাড়ে সব দায় চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে ওপারে বসে আছে। বড় জনের দুই ছেলে। বিপুল অধিকার তার। অথচ আদরের ছোট ছেলের ঘর শূন্য। মা হয়ে এই ব্যবধান তিনি সহ্য করতে পারছেন না। সোহানার বাছাই করে দেওয়া গাইনোকলজিস্টকেই দেখিয়ে আসছে ছোট বৌমা। কিন্তু সুফল তো আজও এলো না! তিনি চোখ বুজলেই যদি সম্পত্তি নিয়ে ভাইয়ে ভাইয়ে ঝগড়া বাঁধে!

ঈশিতা ছাদে উঠে এসে দেখে, গালে হাত দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে তার শাশুড়ি। হাতের উলকাঁটা মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আঁচারের বোতলের কাছে দু’তিনটি কাক ঘুরঘুর করছে। একজন একটু বেশি সাহসী হয়ে মুখ প্রায় লাগিয়েই ফেলেছে আর কি! ঈশিতা দৌঁড়ে গিয়ে সেটাকে তাড়িয়ে দিয়ে শাশুড়ির দিকে মুখ ফিরিয়ে বলে, ‘মা, কী করছেন? নিচে চলেন। ভাবী একবার ফোন করে খবর নিয়েছে আপনি ছাদ থেকে ফিরেছেন কি না!’
লতিফা বেগম ঈশিতার আওয়াজ পেয়ে নড়েচড়ে বসেন। ওঠার আয়োজন করতে করতে বলেন, ‘বড় বৌমার জ্বালায় একটু আরাম করে রোদ পোহাতে পারি না!’
ঈশিতা মুখ টিপে হাসে। আঁচারের বয়ামগুলোর মুখ আটকাতে আটকাতে ক্ষীণসুরে বলে, ‘মা, আজ বিকেলে একটু মোহাম্মদপুরে যাব।’

মোহাম্মদপুর ঈশিতার বাবার বাড়ি। সে মাসে বড়জোর এক দু’বার বাবার বাড়িতে যায়। ইচ্ছে করলে প্রতি সপ্তাহেই যেতে পারে। কারো কোনো আপত্তি নেই তাতে। কিন্তু ঈশিতা নিজে থেকেই তেমন একটা উৎসাহ দেখায় না। লতিফা বেগম জোরাজুরি করেন না। মেয়ে যদি নিজে থেকে বাবার বাড়িতে যেতে আগ্রহ না দেখায়, তাহলে তার কী করার আছে? অবশ্য ঈশিতার মাকে তিনি মনে মনে একটু ভয় পান। এমন কাঠখোট্টা স্বভাবের মহিলা! কেমন যেন চাঁছাছোলা ভাবভঙ্গি! মাধুর্য শব্দটা তার ভেতরে খুঁজেই পাওয়া যায় না। অথচ ঈশিতার আঁচার আচরণ ভারী নম্র। এমন মায়ের এরকম মেয়ে কিভাবে হয়, তা এক বিস্ময়েরই ব্যাপার বটে! বয়ামগুলোর মুখ আটকে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে ঈশিতা। শাশুড়ি নিচে নেমে গেছেন ইতিমধ্যে।

বিয়ের পরে এই বাড়িটাতেই শিকড় বিছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছে ঈশিতা। খুব ডাকাডাকি না করলে মায়ের কাছে যেতেও ইচ্ছে করে না ওর। কেন যেন মনে হয়, আঠারো বছর আগের সেই ঘটনাটি না ঘটলে ওর জীবনটা অন্যরকম হতে পারত।

যদিও মাকেও দোষ দেওয়া যায় না কিছুতেই। মেয়ের ভবিষ্যত সাচ্ছন্দ্যের দিকটা তো বাবা-মাকেই দেখতে হয়! অবশ্য ওর জীবনে বাবার ভূমিকা প্রায় নেই বললেই চলে। ছোটবেলা থেকেই ওদের পরিবারে মা’র কথাই শেষ কথা। বাবাকে নীরব দর্শকের ভূমিকায় দেখতে দেখতে সেই বাড়ির প্রতি কেমন যেন অভক্তি জন্মে গিয়েছিল ঈশিতার। তাইতো মোমেনের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিল একদিন। পালিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল।

মোমেনকে বিয়ে করে সন্তানের মাও হতে পেরেছিল সে। কিন্তু ওর নিজের মা ই তাকে সেই সংসার করতে দেয়নি। ছিনিয়ে নিয়েছে সবকিছু। মা’র পছন্দেই আবার নতুন সংসার পাততে হয়েছে তাকে। সব অতীতকে নিপুণ দক্ষতায় ধামাচাপা দিয়ে ঈশিতার মা তাকে আবার বিয়ে দিয়েছে। আজ্ঞাকারী ভক্তের মতো চুপচাপ সবকিছু মেনে নিয়েছিল ঈশিতা। এই নতুন সংসারেই সে ডালপালা ছড়িয়ে বাঁচতে চেয়েছিল আবার। কিন্তু ভাগ্যের ফের কার জানা আছে? সে তো শিকড় ছড়িয়েছে ঠিকই...কিন্তু ডালপালা আর ছাড়তে পারল কই?

তিন

ঈশিতা আগে একবার মা হয়েছিল। তার কেসটা প্রাইমারি ইনফার্টিলিটির নয়।
গাইনোকলোজিস্ট রেহানা খানম সোহানার টিচার ছিলেন। ঈশিতার ইনফার্টিলির বিষয়টা দেখার জন্য তার চেয়ে বেশি কাউকে পারদর্শী মনে করেনি সোহানা। সেই রেহানা খানমই একদিন ফোনে জানিয়েছিলেন বিষয়টা। সোহানা একেবারে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল শুনে। সহজ সরল বোকা ধরনের একটা মেয়ে ঈশিতা। কে জানত, ওর জীবনে এমন বিষয় লুকিয়ে আছে! অবশ্য সে জানে, আলাভোলা মেয়েরাই জীবনে বিপদে পড়ে বেশি। ঈশিতাও নিশ্চয়ই কোনো বোকামির খেসারত দিতে গিয়েই মা হয়ে গিয়েছিল। আর সেই মাতৃত্বকে লুকিয়ে ছাপিয়েই তাকে বিয়ে দেওয়া হয়েছে।

কথাটা ঈশিতাকে জিজ্ঞেস করবে কি করবে না অনেকদিন ভেবেছে সোহানা। করলে যদি কোনো সমস্যা হয়? ঈশিতা যদি আর কখনোই ওর সাথে সহজ হতে না পারে! সাত পাঁচ বহু কিছু ভেবে একদিন জিজ্ঞেস করেই ফেলেছিল কথাটা। ঈশিতার দু’চোখ ভরে উঠেছিল টলটলে অশ্রুতে। কাতর কণ্ঠে বলেছিল, ‘আমার সংসারটা ভেঙে দিও না ভাবী!’
সোহানা ব্যাকুল হয়ে বলেছিল, ‘না না এমন কথা বল না ঈশিতা। আমি তোমাকে আমার ছোটবোনের মতোই দেখি। এসব কথা কাউকে কি বলা যায়?’

সেদিন কাঁদতে কাঁদতে অনেক কথাই বলেছিল ঈশিতা। বাবার অফিসের ছোটখাট এক কর্মচারী প্রায়ই আসত ওদের বাসায়... এটা সেটা অফিসের কাজে। মা’র কড়া শাসনে বন্দি জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছিল সে। অল্প বয়সী ভদ্র গোছের সেই কর্মচারীকে কেন যেন খুব আপন লাগত ঈশিতার। অল্প বয়সের ভুলে পালিয়ে গিয়েছিল তার সাথে। বিয়েও করেছিল ওরা। তারপরে লুকিয়ে সংসার...বাচ্চা। আর তখনই মায়ের হস্তক্ষেপ। বাচ্চাটাকে চোখের দেখাও দেখতে পারেনি সে। আর সেই কর্মচারীকে কোথায় যে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাও জানা হয়নি ঈশিতার।

সোহানা অবাক হয়েছিল এমন গল্প শুনে। নিখাঁদ বিস্ময়েই বলেছিল, ‘আবির জানে এসব কথা?’
‘নাহ ভাবী। ও কিছু জানে না!’
সোহানা হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিল সেই কথায়। মনে মনে ভেবেছিল, ‘ভাগ্যিস, আবিরটা চিরদিনের বোকা!’

ঈশিতার মা হতে চাওয়ার এই দুরন্ত সংগ্রামে তার মাকে সে কিছুতেই সামিল করতে চায়নি। নিজের মা একদিন ওর মাতৃত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল। তাকে সে কিছুতেই নিজের কষ্টের কথা বলবে না।

কিন্তু না বললেই বা কী আসে যায়! মায়ের দায় কি এত সহজে মেটে? আঠারো বছর আগে যা করেছিলেন, তার জন্য এখনো অনুতপ্ত হতে পারেননি দিলারা হাসান। একমাত্র মেয়েকে সারাজীবনের জন্য সামান্য এক অফিস কর্মচারীর কাছে সঁপে দিতে পারেননি তিনি। বাচ্চাটাকে যদি রেখে দিতেন, তাহলে ঈশিতা কোনোদিনই তার নতুন জীবনে মানিয়ে নিতে পারত না। আর তাছাড়া বিয়েই বা দিতেন কিভাবে?

মোমেন ছেলেটা অবশ্য খুব ঝামেলা করেছিল। যতটা না ঈশিতার জন্য, তারচেয়ে বেশি বাচ্চাটার জন্য। মৃত বাচ্চা প্রসবের গল্প শুনিয়ে আর মোটা অঙ্কের খেসারত চুকিয়ে তাকে অন্য জায়গায় বদলির ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছেন। তার স্বামী তো বিপদ দেখলেই গর্তে গিয়ে লুকায়। তাকেই এসব অপ্রিয় কাজগুলো করতে হয় সবসময়। আর তার ফল হিসেবে সকলের কাছে তিনিই খারাপ হিসেবে চিহ্নিত হন। আর কেউ না জানুক, তিনি নিজে তো জানেন...যা কিছু করেছেন মেয়ের সুখের কথা ভেবেই করেছেন।

কিন্তু তার মেয়েটা নতুন যে কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, সেটা থেকেও মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারছেন না তিনি। কারণ তিনি তো মা! আর মা হওয়াই যে সবচেয়ে বড় বিপদ! গতকাল রাত থেকেই মেয়েকে ক্রমাগত ফোন দিয়ে চলেছেন দিলারা হাসান।

একটা ভালো সন্ধান পেয়েছেন। নবজাতক শিশুকে দত্তক হিসেবে নেওয়ার এক দারুণ সুযোগ। ড্রাইভার লিয়াকতই খবরই এনে দিয়েছে। লিয়াকত তার পুরনো বিশ্বস্ত লোক। এই পরিবারের সবকিছুই আগাগোড়া জানে সে। সরকারি হাসপাতালের এই বাচ্চা কেনা বেচার খবরটা সে কোথা থেকে যেন সংগ্রহ করেছে। দরিদ্র অনেক পিতামাতাই অর্থের অভাবে বাচ্চাকে বিক্রি করে দেয়। ঈশিতাকে এমন একটা বাচ্চা কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা গেলেই সব দুঃখ দূর হয়ে যাবে। একটা বাচ্চা সবকিছু বদলে দিতে পারে।

ঈশিতাকে রাতে অনেক অনুনয় বিনয় করে আসতে বলেছেন দিলারা হাসান। মেয়েটা কেন যেন তাকে আর দেখতেই পারে না। মাকে শত্রু মনে করে সে। অনেক অনুরোধের কারণে শেষমেশ আসতে রাজি হয়েছে বটে,  কিন্তু বাসায় পা দিয়েই বলেছে, ‘মা, আমার বাচ্চার ব্যাপারে তুমি দয়া করে আর কিছু করতে যেও না। বাচ্চা যদি আমার ভাগ্যে না থাকে আমি সেটা মেনে নিতে রাজি আছি।’ দিলারা হাসান জানেন, এসব মেয়ের ক্ষোভের কথা। একটা বাচ্চাকে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারলেই এসব ক্ষোভ কই হাওয়া হয়ে যাবে! তিনি ধৈর্য হারান না। আস্তে ধীরে মেয়েকে বোঝান। ‘মারে, তুই না হয় মেনে নিবি। তোর শ্বশুরবাড়িও কি মেনে নিবে? তাদের বাচ্চা চাওয়ার আবদার মেটাবি কিভাবে?’
‘সেই আবদার মেটানোর জন্য আরেকজনের বাচ্চাকে কিনে আনতে বলছো! সেটা আমার শ্বশুরবাড়ি মেনে নিবে তাই বা কিভাবে ভাবছো মা?’
‘মেনে না নাওয়ার কিছু নেই। এমন হরহামেশাই হচ্ছে। তুই দয়া করে আর ঝামেলা করিস না। আবিরকে বোঝানোর ভার আমার।’

ঈশিতা বুঝতে পারে, তার মা আঁটঘাট বেঁধেই নেমেছে। এবারও নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নাই তার।

চার

আবির আর ঈশিতাকে নিয়ে হাসপাতালে পৌঁছে যান দিলারা হাসান। লিয়াকত তাদেরকে একটা ওয়ার্ডের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে কাকে যেন ডেকে আনতে যায়। কিছুক্ষণ বাদেই মোটাসোটা গড়নের এক আয়াকে নিয়ে হাজির হয় সে। মহিলার নাম নুরজাহান। বয়স পঞ্চাশ আর পঞ্চান্নের আশেপাশে। প্রথম থেকেই বিভিন্ন ক্লিনিক আর হাসপাতালে আয়ার কাজ করে আসছে সে।

বিশাল শরীরে থপথপ করে হেঁটে এসে হাঁপাতে থাকে সেই নুরজাহান আয়া। নির্বিকার মুখে দেওয়ালের গায়ে পানের পিক ফেলে খসখসে গলায় বলে, ‘বাচ্চা কেডা নিব?’ দিলারা হাসান মেয়ে আর জামাইকে দেখিয়ে দিয়ে বলে, ‘এরা নিবে বাচ্চা।’
‘বিয়া কদ্দিনের? বাচ্চা হয়নি?’ লিয়াকত অধৈর্য গলায় বলে, ‘সেই খবরে তুমার কী খালা? বাচ্চা কনে পাইবো? ক্যামনে পাইবো...খোঁজ দাও। নিয়া বিদায় হই। তুমিও কামে যাও।’

লিয়াকতের মুখের দিকে গনগনে চোখে তাকিয়ে আরেকবার পিচ করে পানের পিক ফেলে দশাসই নুরজাহান খালা। তারপরে টেনে টেনে বলে, ‘গরীব মাইনষের বাচ্চারে নিয়ে যাইবো বইলা ডিটেল হুনুম না কী কও মিয়া? গরীব বইলা কি হ্যারা বানের পানিত ভাইসা আইছে নাকি? হ্যারাও আল্লাহর বান্দা! বৈধ বাচ্চা। আল্লাহ্‌র ফেরেশতা। এমনি এমনি যার তার হাতে তুইলা দিমু?’ লিয়াকত শান্ত হয়। সে জানে, এই খালাকে চেতিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না। ইনি অনেকটা মিডিয়ার কাজ করে থাকে। দরিদ্র পিতামাতা যারা সন্তান লালনপালনে অক্ষম, তারা এই খালার সাথে যোগাযোগ করে। আর খালা যোগাযোগ করে কোনো নিঃসন্তান দম্পত্তি এমন বাচ্চা কিনে নেবে কিনা। টাকা পয়সা যা পায়, সেই দরিদ্র পিতামাতাকেই দিয়ে দেয় সে। এই লেনদেনে সে নিজে তেমন একটা লাভবান হয় না।

অথবা অন্য কথায় বলা যায়, লাভবান হতে চায় না। এই কাজ পরস্পরের সম্মতির ভিত্তিতেই করে থাকে সে। তবু নিজের বাচ্চাকে যখন অসহায় দুটি মানুষ অন্য একজনের হাতে নিতান্ত বাধ্য হয়ে তুলে দেয়, তখন সেই দরিদ্র পিতামাতার চোখের পানিতে সে এখনো কাতর হয়ে ওঠে। সেই শিশুটিকে বুকে নিয়ে নিঃসন্তান দুজন মানুষ যখন আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে, সেই দৃশ্যও চোখের সামনে থেকে সরে না। এ যেন দুঃখ আর সুখের মিলিত ধারা!
লিয়াকত আবার জিজ্ঞেস করে। তবে এবার বেশ শান্ত গলায়, ‘তাইলে কই যামু খালা?’
‘৩ নাম্বার ওয়ার্ডের পাশে একডা ছোট ঘর আছে। হেইখানে আমার মাইয়া সুফিয়া আছে। হ্যায় বাচ্চা দেখাইবো। আইজ আমার ডিউটি নাই। বাড়িত যামু। হেইখানে গিয়া আমার নাম কইলেই হইবো। সুফিয়ারে কওন আছে!’

এতক্ষণ পাথরের মুখে দাঁড়িয়ে এই কথোপকথন শুনছিল আবির আর ঈশিতা। ঈশিতার দু’চোখের কোল বেয়ে অশ্রু ঝরে পড়ছে। আবিরও চুপচাপ শান্ত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ঈশিতার বুকের ভেতরটা অজানা যন্ত্রণায় জ্বলেপুড়ে খাক হচ্ছে। আঠারো বছরের আগুন এত সহজে তো শান্ত হবার নয়! এই বুক যে শিশুকে স্তন্যপান করাতে পারেনি, তা আজও যেন দুধের ভারে টনটন করে ওঠে। তবু সেই বুকে আর কোনো শিশুকে সে ঠাঁই দিতে পারল না! আর কেউ এই দুধের ভার থেকে তাকে মুক্তি দিলো না!

খালার কথামত ৩ নাম্বার ওয়ার্ডের পাশের ছোটঘরটিতে হাজির হয়ে যায় তারা। ঘরটিতে ছোটছোট কয়েকটা বেড সাজিয়ে রাখা। দুইটি বেডে দুজন শিশুকে রাখা আছে। মলিন শাড়ি কাপড়ের দুটি নারী আকুল চোখে সেই শিশুদুটির দিকে ঝুঁকে বসে আছে। সালোয়ার কামিজ পরা একটি সুশ্রী মেয়ে তাদের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে।

ওদের ঢুকতে দেখেই নারী দুজনের চোখে মুখে কিসের যেন এক ছায়া সরে গেল। ঈশিতার চোখ এড়ালো না সেই অব্যক্ত ছায়ার আড়ালের কথা। চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সবকিছু মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগল সে। সুফিয়া মেয়েটিকে দেখে তার বুকের মধ্যে কেমন এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। মেয়েটার বয়স সতেরো আঠারোর বেশি হবে না। আয়াটি বলছিল, সুফিয়া তার মেয়ে। অথচ এই মেয়ের সমগ্র অবয়বের কোথাও সেই আয়াটির সাথে বিন্দুমাত্র মিল নেই। এ যেন অনেকটা...অনেকটা...তার মতোই দেখতে!

নিজেকে শাসন করল ঈশিতা। জীবন জীবনের মতোই। এই জীবনে কাকতালীয় কোনোকিছু এত সহজে ঘটে না। হয়তো এই মেয়েটি সত্যি সত্যিই সেই আয়াটিরই মেয়ে। অথবা এমনও হতে পারে, একেও সে কোথাও থেকে কিনেই নিয়েছে। যদিও সে নিজেও দরিদ্র...কিন্তু তারও তো অপূর্ণ মাতৃত্বের কষ্ট থাকতে পারে! অথবা এটাও সম্ভব... কারো ফেলে যাওয়া সন্তানকেই সে নিজের করে নিয়েছে!

বুকটা কেঁপে ওঠে ঈশিতার। তার অনেক চাপাচাপিতে কাজের মেয়ে কমলা বলেছিল, তার সন্তানকে সেই ক্লিনিকেই ফেলে এসেছিল তার মা। সেখানে তার ভাগ্যে কী ঘটেছিল সেই খবর কেউ জানে না। কাজেই... এমন কি হতে পারে না?

অবরুদ্ধ অশ্রুকে বহুকষ্টে সংবরণ করে বাইরে বেরিয়ে আসে ঈশিতা। এক মুহূর্তের জন্য ওর মনে হয়, দরিদ্র নারী দুটির চোখেমুখে কিসের এক চাপা আনন্দ যেন ছিটকে পড়ছে। ঈশিতা তাদের শিশুদের কাউকে নেবে না, আরো কিছুদিন তারা তাদের শিশুদের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখতে পারবে... এই আনন্দ পৌঁছে গেছে তাদের কানে।

এদিকে ঘরে ফিরতে ফিরতে নুরজাহান আয়া তখন ভাবছিল, ঐ বয়স্কা মহিলাটিকে কোথায় যেন দেখেছে সে। অনেকদিন আগে ডাক্তার রওশন জাহানের ক্লিনিকে সে আয়ার কাজ করত। সুফিয়াকে সে যেখানে পেয়েছিল। সেখানেই কি দেখেছে এই মহিলাটিকে?

ভাবনাটা বেশিদূর এগোয় না নুরজাহানের। বয়স হয়ে গেছে। এখন কেন যেন কোনো কিছুই খুব বেশিক্ষণ ভাবতে ভালো লাগে না তার। জীবন সায়রে অনেক তো অবগাহন করা হলো! বিবর্ণ আঁচড়ে মলিন হয়ে গিয়েছে সেই সায়রের জল।
আর কী হবে ওতশত ভেবে?

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;