কায়সারবাগের কাকা-হুজুর



মঈনুস সুলতান
রেঙুনের সুলে প্যাগোডা। ছবি. লেখক

রেঙুনের সুলে প্যাগোডা। ছবি. লেখক

  • Font increase
  • Font Decrease

সারা দুপুর সেন্ট্রাল রেঙুনের হাটবাজার ঘেঁটে ঘামে গরমে লবেজান হয়ে আমি ও হলেণ আমাদের ঘুমন্ত কন্যা কাজরিকে কাঁধে নিয়ে সুলে প্যাগোডার সামনে দাঁড়িয়ে ভাবি—এবার যাওয়া যায় কোথায়? আমাদের সামনে সুলে প্যাগোডার সুনশান সোনালি স্থাপত্য। তার চারপাশের চুনকাম করা শপিং কমপ্লেক্সে ক্রেতা বিক্রেতার কোনো পাত্তা নেই। দিন কয়েক হলো আমরা রেঙুনের হাটবাজারে বিস্তর ঘুরছি। খুঁজে খুঁজে খরিদ করছি বর্মার তাঁতে বোনা বস্ত্র, সোনালি ল্যাকারে রঞ্জিত লক্ষীপ্যাঁচা, টিক কাঠের ট্রে ও জেড পাথরের হাতি। কাজরি সব সময় স্থির থাকতে চায় না, সুতরাং তাকে নিয়ে বেশিক্ষণ বাজার-সওদা করা মুশকিল। তাই আমরা তাকে বিরতি দিতে প্রায়ই চলে আসি সুলে প্যাগোডার ভেতরের আঙিনায়। মন্দিরের হিমেল বাতাবরণে সে ওখানে ছোটাছুটি করতে ভালোবাসে। জনা কয়েক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীনীদের সাথে তার ভাবও হয়েছে। মাঝেমাঝে সে তাদের সাথে পালকের ঝাড়ু হাতে মন্দিরের বিগ্রহ ছড়ানো পরিসরে ঝাট দিতেও হাত লাগায়। এ মুহূর্তে সে ঘুমিয়ে পড়েছে, এবং আমাদের খুব পিপাসা পেয়েছে বলে আমরা কায়সারবাগ রেস্তোরাঁর দিকে হাঁটি।

সুলে প্যাগোডার পেছনভাগে ওয়ারলেস টাওয়ারের ছায়া ধরে হেঁটে আমরা কায়সারবাগ রেস্তোরাঁয় ঢুকি। খুব সস্তা কাঠ ও টিন দিয়ে সম্প্রতি তৈরি রেস্তোরাঁর ঘরটি আশপাশের অন্যান্য দোকানপাটের ডিজাইন থেকে ভিন্ন, এবং মানের দিক থেকে এক নজরে তার গরিবি হালতও খুব স্পষ্ট। এ রেস্তোরাঁয় আমরা আরো বার কয়েক এসেছি। সেন্ট্রাল রেঙুনে আসলে এখানে বসে এক পেয়ালা দুধপাত্তি চায়ের সাথে চালের রুটি দিয়ে সুজির হালুয়া—আমাদের পারিবারিক প্রিয় খাবারের তালিকায় পড়ে। এখানকার খদ্দেরদের বেশিরভাই বর্মার মুসলিম অভিবাসি সম্প্রদায়ের বেকার তরুণ। কায়সারবাগের বর্তমান স্বত্বাধিকারীর পরদাদা অনেক বছর আগে লখনৌ থেকে বর্মাটিক কাঠের ব্যবসা করতে রেঙুন এসেছিলেন। লখনৌ শহরে কায়সারবাগ নামে নবাবী আমলের মশহুর একটি প্রাসাদ আছে। রেস্তোরাঁর বর্তমান মালিক তার পুত্র সে স্মৃতিতে আদনা এ চা-খানার নামকরণ করেছেন। বয়সের দিক থেকে মুরব্বি হওয়ার কারণে সকলের কাছে তিনি কাকা-হুজুর বলে পরিচিত। তাঁর আসল নাম এ অব্দি আমাদের জানার সুযোগ হয়নি।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/10/1536567592493.jpg
সেন্ট্রাল রেঙুনের দৃশ্যপট

কাকা-হুজুরের বয়স হলেও তাকদ এবং তনদুরুস্তির দিক থেকে তিনি এখনো দড়ো আছেন। তাঁর দীর্ঘ কোঁকড়ানো দাড়ি মেহদি রঞ্জিত। উপর ও নিচের পাটি মিলিয়ে তাঁর মোট চারটি দাঁত খোয়া গেছে। তাই হাসলে তাঁর মুখমণ্ডলকে শিক-ভাঙ্গা জানালার মতো দেখায়। কারণে অকারণে তিনি লখনৌয়ের কবি তকী মীরের কবিতা থেকে উদ্ধৃতি দিতে পছন্দ করেন। তাঁর কাউন্টারে ক্যাশবাক্সের পাশে ১৮৮৯ সালে লখনৌ থেকে ছাপা মীরের কবিতার একখান দিওয়ান হামেশা মজুদ থাকে। দিওয়ানের পাতাগুলো জিল ছিঁড়ে ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। তাই তিনি শের-শায়েরীর কেতাবখানা তাঁতের কাপড়ে তৈরি বস্তনীতে সিজিলমিছিল করে রাখেন।

বেশ কিছুক্ষণ হলো আমরা কায়সারবাগে এসে বসেছি। কাকা-হুজুর আমাদের কোনো খোঁজখবর নিচ্ছেন না দেখে একটু অবাক লাগে। তাঁর খালি কাউন্টারে একটি আগরবাতি অযথা পুড়ে পুড়ে খুশবু ছড়াচ্ছে। আমরা পিপাসার্ত, তাই তাঁর খোঁজে কিচেন থেকে যে ফোঁকর দিয়ে চা-নাশতা সাপ্লাই দেওয়া হয়, তার সামনে এসে দাঁড়াই। রান্নাঘরে জ্বলন্ত চুলার উপর মস্ত এক হান্ডিতে কাকা-হুজুর হাতা দিয়ে কিছু নাড়ছেন। আমার সাথে চোখাচোখি হতেই তিনি কপালের ঘাম মুছে বলেন, ‘জেরা ইন্তেজার করো বেটা, আখনি পাকা রাহা হ্যায়।’ সাথে সাথে আমার নাকে এসে লাগে মশলাদার খুশবু। আমাদের কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না, গামছায় হাত মুছতে মুছতে দু’পেয়ালা লাচ্ছি হাতে কাকা-হুজুর আমাদের সামনে এসে দাঁড়ান। তারপর খুব স্নেহের স্বরে হলেণের কাঁধে হাত রেখে বলেন, ‘বহুত পেরেশান লাগতা হ্যায়.. বাচ্চেলোক, শরবত লাচ্ছি পিয়া করো, আল্লাকা নাম লিয়া করো।’

আমরা হাতপাখা দিয়ে মাছি তাড়িয়ে ধীরেসুস্থে লাচ্ছি পান করতে থাকি। কাকা-হুজুর এখন কাউন্টারে বসে চশমা চোখে বস্তনী খুলে ঘাঁটছেন তকী মীরের শের-শায়েরী। আজ থেকে হপ্তা দুয়েক আগে পয়লা যেদিন তাঁর চা-খানায় আমরা এসে হাজির হই, তিনি আমাদের দিকে খুব তাজ্জব হয়ে তাকিয়ে ছিলেন। শ্বেতাঙ্গীনী হলেণের গাত্র বর্ণই বুঝি তাঁর অবাক হওয়ার কারণ। কপালে ভাঁজ ফেলে তিনি আমার নাম জানতে চেয়েছিলেন। আমি জবাবে ‘মঈনুস সুলতান’ বললে তিনি আমাকে শুধরে দিয়ে বলেন, ‘মোহাম্মদ মঈনুস সুলতান বলো বেটা।’ নামে মোহাম্মদ সংযোজনের তাঁর প্রস্তাব আমি বিনা বাক্যব্যয়ে কবুল করে নিলে—তিনি ভুরু কুঁচকে হলেণকে দেখিয়ে জানতে চান, ‘কৌণ হ্যায় উ হাসিন আওরত?’ জবাবে আমি কনফিডেন্টলি তাকে শাদি করা বেগম জানালে, তিনি শিক-ভাঙ্গা জানালা খোলার অভিব্যক্তিতে হো হো করে হেসে বলেন,  ‘তুমকো জরুর মীর ছাহেব ক্যা শ্যার শুনানো হোগা।’ তারপর তিনি বস্তনী বিছরিয়ে তকী মীরের দিওয়ান খোলেন। কিতাবখানার বয়স দেখে হলেণ রীতিমতো অবাক হয়। একটি হলুদ হয়ে আসা পৃষ্ঠা দেখিয়ে কাকা-হুজুর পড়েন, “মুহব্বৎসে হ্যায় ইন্তেজাম-এ জহাঁ/ মুহব্বৎসে গর্দিসমেঁ হ্যায় আসমাঁ।” অর্থাৎ “ভালোবাসার জন্যই তো সবকিছু/ আশমান ও তো চরকির মতো ঘুরছে তার টানে।” আচমকা শায়েরবাজিতে খানিক বিব্রত হলে কাকা-হুজুর কিতাব বন্ধ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে বলেন, “ভুখা হ্যায় তুম দুনো, ঠিক হ্যায়, পয়লা আল্লাকা নাম লাও, ইসকা বাদ হালওয়া রুটি খিলাও। ইয়ে খানে কা লিয়ে কই পয়সা উইসা দেনে কা জরুরত নেহি।”

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Sep/10/1536567706425.jpg
কায়সারবাগে আদি কাঠের বাড়ি

ব্যাস্, মুফতে পয়লা দিন হালওয়া রুটি খিলানোর পর থেকে তাঁর সাথে আমাদের চাচা-ভাতিজার জানপহচান সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে যায়। সেন্ট্রাল রেঙুনে আসলেই আমরা একবার করে কায়সারবাগে হাজিরা দিই। কিন্তু আজ কেন জানি কাকা-হুজুর নীরব হয়ে আছেন। হলেণ কায়সারবাগের দেয়ালে লটকানো একটি বড়সড় পিকচার ফ্রেমের দিকে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এ ফটোগ্রাফ আগে আমরা খেয়াল করে দেখিনি। ছবিতে বর্মী কেতায় চমৎকার একটি কাঠের বাড়ির নিচে বড়বড় হরফে ইংরেজিতে হাতে লেখা ‘কায়সারবাগ’। আমি কৌতূহলী হয়ে ছবিটি কিসের তা জানতে চাইলে তিনি দ্বীর্ঘশ্বাস ফেলে যা বলেন, তার সারমর্ম হচ্ছে—মন্দিরের মতো চূড়োওলা টালির ছাদের প্রান্তে কাঠের ঝালর লাগানো সুদর্শন এ বাড়িটি তাঁর পরদাদা তৈরি করিয়েছিলেন পারিবারিক বাসস্থান হিসাবে। ওখানে একান্নবর্তী পরিবারের তিন প্রজন্ম একসাথে বাস করত। বাড়িটির নিচ তলার হলঘরে তেতাল্লিশ বছর আগে কাকা-হুজুর চালু করেছিলেন টি-স্টল কাম রেস্তোরাঁ। বর্মায় গোপনভাবে পরিচালিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে যুক্ত কিছু মুসলমান ছেলেপিলে এ চা-খানায় এসে বসত। পুলিশ তাড়া করলে তিনি তাদের কায়সারবাগের ছাদের কুঠুরিতে লুকিয়ে রাখতেন। বিষয়টি জানাজানি হলে পুলিশ তাঁর পিতামহের হাতে তৈরি কাঠের সুন্দর বাড়িটি বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দেয়। আজকাল সে ধরনের বাড়ি আবার তৈরি করা খুবই মুশকিল। বর্মাটিক কাঠ বাজারে পাওয়া যায় না, অলঙ্কৃত ছাদ তৈরি করার হাতযশওলা করিগররাও বিগত হয়েছেন। এ রকমের একটি ঘর তৈরির রসদপত্রও দারুণভাবে এক্সপেনসিভ। কাকা-হুজুরের সে কিমত নেই। তাই তিনি সাদামাটা কাঠ ও টিন দিয়ে নতুন ঘর বানিয়ে আবার কায়সারবাগ রেস্তোরাঁটি চালু করেছেন। ঘটনা শুনে আমি ও হলেণ তাকে হামদর্দির সাথে সহানুভূতি জানাই। তিনি ম্লান হেসে—সব আল্লাতালার ইচ্ছা বলে তকী মীরের আরেকটি শের আবৃত্তি করে শোনান, “জফায়েঁ দেখ লিয়ে, বেবফাইয়া দেখি/ ভলা হুয়া কেহ্ তেরি সব বুরাইয়াঁ দেখি।” অর্থাৎ “প্রভু তোমার অসীম দয়ার সাথে আশা দিয়ে আশহত করার নির্মমতাও দেখলাম/ তোমার খারাপ দিকটা দেখতে পেয়ে কিন্তু ভালোই হলো।”

এ শের শুনে অবশেষে বিষণ্ণ মনে কাকা-হুজুরের কাছ থেকে বিদায় নিতে যাই। তিনি হাত নেড়ে বলেন, “বয়ঠো বাচ্চালোক, জেরা বয়ঠো, আভি আরেক দফা পরওয়াদেগার কি নাম লাও, ইস কা বাদ থোড়া আখনি খিলাও।

   

জাফরানি



শরীফুল আলম । নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

ভাবছি এই বৈশাখের প্রথম পলাশটা আমি তোমাকেই দেবো
প্রথম চুম্বনটাও তোমাকে।
একটা দীর্ঘ শীত পাড়ি দিয়ে এসেছি,
তোমার খোঁপায় লাল গোলাপ দেবো বলে
চোখে কাজল, কপালে কাল টিপ
এই সব দেয়ার আগে কিছুটা খুনসুঁটি তো হতেই পারে ,
তুমি অনন্যা বলে কথা
তোমাকে উৎকণ্ঠা ও বলা যায়
কিম্বা সুনীলের কবিতা, অসমাপ্ত শ্রাবণ
তুমি আমার ওয়াল্ড ভিউ
তুমি আস্ত একটা গোটা আকাশ
চুরমার করা তুমি এক পৃথিবী ,
কখনো তুমি মুক্ত বিহঙ্গ, সুদূরের মেঘ
তুমি কখনো শান্ত মোহনা, কখনো মাতাল স্রোত
ভরা শ্রাবণ, শরতের স্তব্ধতা তুমি ,
তুমি কখনো আমার সুখের আর্তনাদ ।

আমি সমুদ্র, আমি ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠি
দিগন্ত রেখায় আমি তোমার অপেক্ষায় থাকি
আমি অপেক্ষায় থাকি তোমার ফোনের গ্যালারিতে
ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে ,
আমি প্রলেপ বানাতে জানিনা
তাই ফাগুণের রঙকে আমি টকটকে লাল বলি
সিজোফ্রেনিক কে পুরোনো রেকাবি বলি
মূলত তুমি এক হরিয়াল ছানা
আড়ালে চিঁ চিঁ ডাক, উঁকি মার জাফরানি ।

আমার ভাললাগার টুনটুনি
এই শ্রাবণ ধারায় স্নান শেষে
চল ঝিলিমিলি আমরা আলোয় ঢেউ খেলি
ভালোবাসলে কেউ ডাকাত হয় কেউবা আবার ভিখারি ।

;

আকিব শিকদারের দু’টি কবিতা



আকিব শিকদার
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যোগ্য উত্তর

‘তোমার চোখ এতো ডাগর কেন?’
‘স্বর্ণ দিনের স্বপ্নঠাসা দুচোখ জুড়ে।’

‘তোমার বুকের পাঁজর বিশাল কেন?’
‘সঞ্চয়েছি স্বদেশ প্রীতি থরেথরে।’

‘তোমার আঙুল এমন রুক্ষ কেন?’
‘ছদ্ধবেশীর মুখোশ ছেঁড়ার আক্রোশে।’

‘তোমার পায়ের গতি তীব্র কেন?’
‘অত্যাচারীর পতন দেখে থামবে সে।’

অনন্তকাল দহন

ঝিঝির মতো ফিসফিসিয়ে বলছি কথা আমরা দুজন
নিজেকে এই গোপন রাখা আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

বাঁশের শুকনো পাতার মতো ঘুরছি কেবল চরকী ভীষণ
আমাদের এই ঘুরে ঘুরে উড়ে বেড়ানো আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তপ্ত-খরায় নামবে কবে প্রথম বাদল, ভিজবে কানন
তোমার জন্য প্রতিক্ষীত থাকবো আমি আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

তোমার হাসির বিজলীরেখা ঝলসে দিলো আমার ভুবন
এই যে আগুন দহন দেবে আর কতোকাল?
: অনন্তকাল।

;

তোমার বীণায় সুর ছিল



প্রদীপ্তকুমার স্যানাল
দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

দৈনিক বসুমতীতে প্রকাশিত প্রদীপ্তকুমার স্যানালের সেই নিবন্ধ। ছবি: আশরাফুল ইসলাম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘দিল্লী চলো, চলো দিল্লী’ সুভাষকণ্ঠে আটত্রিশ কোটি আশি লক্ষ হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলিত কণ্ঠস্বর যেন এই মুহূর্তে পাচ্ছি আবার শুনতে। দিল্লীর মাটিতে স্বাধীন বাংলার প্রথম রাষ্ট্রপতি পা দিলেন-অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তে শুনি বিস্ময়কর অভিভাষণ, ভারতের আকাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত সাড়ে সাত কোটির কণ্ঠস্বর একটি কণ্ঠে। মুজিবর রহমান ..সেই নাম। আমি জানি, নামমাত্র নয় সেই নাম; সমস্ত বাঙালীর সংগ্রামের নামান্তর সে নাম আমাদের আগামীকালের ইতিহাস গড়বে।

লন্ডনের হোটেলে ছিন্নবেশে পা দিয়েছিলেন তিনি যাঁর নির্দেশে বীণা তুলে নিয়েছে ছিন্নকণ্ঠ, মানুষ শুনেছে মৃত্যুর গর্জন সঙ্গীতের মতো। সেই নেতার গলায় স্বাধীন বাংলার প্রথম বরমাল্য তুলে দেওয়ার মহত্তম সৌভাগ্যের অধিকারী আমরা। ভারতবর্ষ তাঁর ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করেছে কণায় কণায়। এই মুহূর্তে সমস্ত কিছুর রং বদলে গেছে। এপারের মানুষও উন্মাদ হয়েছে ওপারের মানুষের উদ্বেল হওয়ার মুহূর্তে।

স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি থেকে-যে বিপ্লবী বীর এবং স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে অগ্রসর প্রথম পদাতিক মুজিব (?) তুমি আমাদের ..চিত্তের প্রণতি গ্রহণ করো। তোমার মুখে ‘আমার সোনার বাংলা তোমায় ভালোবাসি’ বাংলার জাতীয় সঙ্গীত হল..। কত আন্দোলনে যে বাংলা ভাষা প্রাণ ফিরে পেয়েছিল তা প্রাণবন্ত হল দিল্লীর জনসভায় তোমার অভিভাষণের জোযারে। দেশবন্ধুর মৃত্যুহীন প্রাণ নেতাজী, আর সেই প্রাণের নিঃসীম স্পন্দন তোমার নেতৃত্বের অঙ্গে অঙ্গে।

শেখ মুজিব তাঁর বক্তৃতায় বলেছেনঃ আমি মানুষ, আমি বাঙালী, আমি মুসলমান। বাঙালীর হৃদয় থেকে উৎসারিত যত কথা যত ভাব সব নেতার একটি ঘোষণায় সুস্পষ্ট চেহারা নিয়েছে। এর চেয়ে সত্য ভাষণ আর কি হতে পারে! সবার উপরে মানুষ সত্য-মনুষ্যত্বের দাবী সবার আগে। মানুষের বাঁচার অধিকার প্রতিষ্ঠায় পৌঁছবার লক্ষ্যে যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, তার প্রথম পর্যায় সমাপ্তির মুখে। এর চেয়ে সত্যোন্মুক্ত বাণী নেতৃত্বের জবানীতে আর কি হতে পারে? সর্ব প্রথম মানবমুক্তি তার পর অন্য প্রয়োজন। ভাই শেখ সাহেব তাঁর ভাষণের প্রথমেই বলেছেন, প্রতিহিংসার নয় ক্ষমার ক্ষমা সুন্দর মুখকে বাঙালী নিভৃতেও ফুটিয়ে তোলার কথা। এই অন্যায় অবিচারের তুলনা বিরল, দুর্ঘটনায় পরিসমাপ্তির সন্ধিক্ষণে শত্রুকে ক্ষমা করার ঔদার্যে মহিমান্বিত প্রসন্নোক্তি আর কবে কোথায় শোনা গেছে? দেশের মানুষকে কবে কোথায় কোন নেতৃত্বের অভয়বাণী যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই শোনাতে পেরেছে শান্তির ললিতবাণী। তাই মনুষ্যত্বের কথা, মানুষের কথা ওঁর মুখে মানায়। অসহযোগ আন্দোলন পূর্ণতম সাফল্যকে সর্বাত্মক মুক্তির আগমন মুহূর্তে সশস্ত্র সংগ্রামে রূপ দেওয়া যাঁর নেতৃত্বে সম্ভব সেই নেতার মুখেই মানায় শান্তির বাণী। দুর্বলের মুখে শান্তির প্রয়াস হাস্যকর নয় শুধু অট্টহাসিকরও বটে।

বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রাম শুরু হওয়ার পরেই-বিভিন্ন মুখে শুনেছি এর নানা বিশ্লেষণ, বৃহত্তর হিসেব নিকেশ। তবু যা একবারও শুনিনি, একটি মানুষের মুখেও যে সত্য উক্তি একবারের জন্যও শোনা যায়নি, তা হল, এ সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সংগ্রাম, এ সংগ্রাম বাঙালীর জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম। সেই দুর্ণিবার জাতীয়তাবোধকে ইজমের ধোঁয়ায় অন্ধকারে যদি বিপথে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হত তবে ইয়াহিয়া চক্রের পক্ষেও সম্ভব ছিল এ যুদ্ধ জয় করা। বাঙালীয়ানাই বাঙালীর সবচেয়ে উজ্জ্বল সত্য চরিত্রচিত্র। তাই দিল্লীর জনসভায় মুজিবের কম্বুকণ্ঠে যখন শুনিঃ

‘‘আমি জানতাম না আবার আপনাদের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। আমি ওদের বলেছিলাম তোমরা আমাকে মারতে চাও, মেরে ফেল। শুধু আমার লাশটা বাংলাদেশে আমার বাঙালীদের কাছে ফিরিয়ে দিও।’’

তখন তাঁকে শুধু বাংলা বলব, না, সমস্ত মানুষের দুঃখে তার নেতার কণ্ঠে একে বেদনার করুণ বিপ্রলম্ভ বলব। তবু এত ভালবাসা, এত ¯েœহসিক্ত আনন্দের নির্ভরতা বাঙালীর জাতীয়তাবোধ ছাড়া আর কোন পথে আসা সম্ভব। ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ জাতীয় সঙ্গীতের এই প্রথম লাইনেই বঙ্গহৃদয় সোনা হয়ে গেছে। এই গান মুখে নিয়ে বাঙালী প্রাণ দিয়েছে। তবু এই সংগ্রামকে যদি বাঙালী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম না বলি, তবে মিথ্যা ভাষণের ফল আমাদের পেতেই হবে। বাঙালীর বাঁচারও বটে মরারও বটে একমাত্র প্রশ্ন তার ভাষা। এ সংগ্রাম শুরু হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের মুহূর্তে। বাঙালীর সবচেয়ে কোমল সবচেয়ে নিভৃত মর্মকোষ তার ভাষা। সেই কোমল স্থানেই আঘাত করে শাসনচক্র চেয়েছিল বাঙালীকে নিশ্চিহ্ন করতে। বেদনায় বিক্ষত বাঙালী হৃদয় কঠিনতম প্রতিজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিল। সে প্রতিজ্ঞা সফল হয়েছে। সেই সফলতার উৎসে বাঙালীর সবচেয়ে প্রাণের কবি রবীন্দ্রনাথ। বাঙালী কবি। তাই কবিতাই তাকে রক্তাক্ত করেছে, করেছে সুজলা সুফলা।

এমন কঠোরে, কোমলে, আনন্দ বেদনায়, হাসিকান্নার হীরাপান্নায় আর কোন দেশের ইতিহাস হয়ে আছে গাঁথা। ধর্ম নিয়ে অধর্মের রাজনীতি করার পুরণো পথ পরিত্যাগ করেছে বাংলাদেশ। দুর্দিনে অশ্রুজলধারায় বাঙালীর চেতনা থেকে ধর্মান্ধতার ক্লেদ ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গেছে। বাঙালী মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ অথবা খৃষ্টান এসব কিছুই নয়। বাঙালীর একমাত্র পরিচয় যে বাঙালী। এই সত্যটুকু বাঙালীকে বুঝে নিতে রক্তের মূল্য দিতে হয়েছে বারংবার। যতদিন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান অথবা বৌদ্ধ, খৃষ্টান ছিল, ততদিন জঙ্গীশাহীর শোষণের থাবাও ছিল অপ্রতিহত শক্তিতে উদ্যত। যে মুহুর্তে বাঙালীর মুখ থেকে খসে পড়েছে ধর্মীয় বাধানিষেধের মিথ্যে মুখোশ সেই ক্ষণ থেকেই শোষণে কায়েমী সিংহাসন বাংলার মাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে গেল। কারণ এই ধর্মীয় বাধানিষেধকে সম্বল করেই দীর্ঘদিনের শোষণে পাক জঙ্গীচক্র বাংলার মানুষকে নিঃস্ব করেছে, সব কিছু লুঠে নিয়েছে বাংলার বুক থেকে। রক্তস্নাত বাংলা আজ শোষণহীন, বাঙালীর আজ একটি মাত্র পরিচয় সে-বাঙালী।

বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক এবং সবার বড় কথা সে আজ ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। মুসলিম ইতিহাসে এ এক বিরাট নজির। ধর্ম আজ বাংলাদেশে ব্যক্তিগত বিষয় ছাড়া কিছুই নয়। তার নেতার কণ্ঠেও আজ এরই প্রতিধ্বনি। বাংলাদেশের সাথে ভারতবর্ষের পরবর্তীকালে কি সম্পর্ক দাঁড়াবে তা এই প্রথম দিনেও সুস্পষ্ট। বাংলা এবং ভারতের নীতি এক এবং সে নীতি দুর্ণীতির মুলোচ্ছেদ। বাংলাদেশের পাশে বন্ধুত্বের দাবী নিয়ে এগুতে পেরে, পৃথিবীর পৃথিবীর মহত্তম স্বাধীনতা সংগ্রামের পাশে একমাত্র সাহায্যদাতা হিসেবে থাকতে পেরে ভারতবর্ষ বিশ্বের শক্তির ভারসাম্য সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। অন্যের কৃপাকণায় বেঁচে থাকার দুর্দিন আজ ভারতবর্ষের সৌভাগ্যের ঊষা লগ্নে অপসৃত। মুজিবের কণ্ঠে কৃতজ্ঞতার সহৃদয় সম্ভাষণ ভারতবর্ষের মানুষকে ঘিরে, ইন্দিরাকে ঘিরে। বাংলাদেশ তার চরম দুর্ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্ষকে যে বন্ধুত্বের মর্যাদায় বসিয়েছে তা ক্ষুন্ন হওয়া কোন চক্রান্তেই সম্ভব নয় আর।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সাফল্যের দ্বারে উপনীত করার প্রতিটি পদক্ষেপে নেতা মুজিব পেয়েছেন নেতাজীর ভাব নির্দেশ। আমরা আজ গর্বিত। বাংলার মানুষের দুঃখের বটে সুখেরও বটে সমান অংশীদার ভারতবর্ষ। মুজিবের নেতৃত্বে নেতাজীর পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে আসমুদ্র হিমাচল। (নিবন্ধে প্রদীপ্তকুমার স্যানাল ব্যবহৃত বানানরীতি অবিকৃত রাখা হয়েছে)।

প্রথম প্রকাশ: রবিবারের বসুমতী সাময়িকী, ১৬ই জানুয়ারি ১৯৭২; দৈনিক বসুমতী

সংগ্রহ ও সম্পাদনা: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা



ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা

  • Font increase
  • Font Decrease

মানবিকভাবে বিপর্যস্ত গাজ়ার ঘটনাবলি ইসরায়েল সম্পর্কে কয়েকটি মারাত্মক বিষয় উন্মোচিত করেছে। কয়েকটি জরুরি প্রশ্ন সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে বিশ্ববাসীকে। যেমন: ১. গণহত্যা কাকে বলে, ২. নব্য-বর্ণবাদের স্বরূপ কেমন, ৩. জাতিগত হিংসার নৃশংস চেহারা কত ভয়াবহ।

এইসব প্রশ্নের উত্তরের জন্য তাকাতে হবে, বাস্তব গবেষণাগার ফিলিস্তিনের ক্ষুদ্র জনপদ গাজায়, যেখানে প্রশ্নগুলোর ‘প্র্যাকটিক্যাল ক্লাস‘ বা ‘মডেল টেস্ট‘ করছে, ইসরায়েল। রক্ত, মৃত্যু, ধ্বংসের ইসরায়েলি পাইলট প্রজেক্ট তথাকথিক মুক্ত-গণতান্ত্রিক বিশ্ব বিকারহীনভাবে দেখছে। আরব তথা মুসলিম বিশ্বও এত বড় একটি গণহত্যার বিষয়ে নির্বিকার। 

২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘ফিলিস্তিন: যুদ্ধ, গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ, জাতিগত হিংসা‘ (প্রকাশক: শিশুকানন/রকমারি) শিরোনামে আমার প্রকাশিত বইটিতে গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের পটভূমিতে ফিলিস্তিন পরিস্থিতি ও জায়নবাদী নীতির ঐতিহাসিক ধারাক্রমের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। কোনো ঐতিহাসিক বিপর্যয়ের সময়ে গণ-নিষ্ক্রমণের ছবিটা বাস্তবে আসলে কেমন হয় আর প্রতিশোধজনিত হিংসার কারণে জাতি, বা রাষ্ট্র, বা তার ধ্বজাধারীরা কতটা হিংস্র হয়ে উঠতে পারে, এসব কথাও আলোচিত হয়েছে।

বাস্তবে ইসরায়েলের হিংস্রতা কল্পনার দানবকেও হার মানিয়ে গেছে। ‘গাজায় গণহত্যা বন্ধ হবে‘, মানবিক বিশ্বের এমন শুভ-আশাকে দুরাশায় পর্যবসিত করেছে, ইসরায়েল। গত অক্টোবর থেকে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সেখানে নিহত হয়েছেন মোট ৩২ হাজার ৭০ জন ফিলিস্তিনি। সেই সঙ্গে আহত হয়েছেন আরও ৭৪ হাজার ২শ ৯৮ জন। প্রতি ২৪ ঘণ্টায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমায় গড়ে নিহত হচ্ছেন ১০০ জন এবং আহত হচ্ছেন ১৫০ ফিলিস্তিনি, যাদের অধিকাংশই নারী, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ রোগী। ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলায় বাড়িঘর হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন গাজার ২২ লাখ বাসিন্দার ৮৫ শতাংশ।

গাজায় ‘ইসরাইল-ফিলিস্তিন’ সংঘাতকে 'যুদ্ধ' বলা হচ্ছে। আসলে তা মোটেও ‘যুদ্ধ’ নয়, স্রেফ ‘গণহত্যা’। যুদ্ধে সৈন্য মারা যায়। সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়। গাজায় মরছে সাধারণ মানুষ, জনতা। জনতাকে বেপরোয়া হত্যা করা যুদ্ধ নয়, নগ্ন গণহত্যা। যুদ্ধের ছদ্মাবরণে গণহত্যায় মেতে গত ৭৫ বছর ইসরাইল নব্য-বর্ণবাদী আগ্রাসন, জাতিগত নিধন চালাচ্ছে ফিলিস্তিনে, যার সর্বসাম্প্রতিক হিংস্রতম পর্যায় চলছে গাজায়। সেখানে অসুস্থ রোগী, ডাক্তার, শিশু, বৃদ্ধ, নারী, কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। খ্রিস্টানদের বড়দিনে এবং মুসলমানদের  রমজান মাসের পবিত্রতাকেও পরোয়া করা হচ্ছে না। রমজানে গাজায় মানবিক সাহায্য প্রবেশেও বাধা দিচ্ছে, জায়নবাদী ইসরায়েলি বাহিনী। বুলেটের আঘাতে আর খাদ্য, পথ্য ও ঔষধের অভাবে মরছে মানুষ গাজা উপত্যকায়।

বিশ্বের ইতিহাসে, সভ্যতার পথ-পরিক্রমায়, এমনকী, যুদ্ধের রক্তাক্ত প্রান্তরেও যা ঘটেনি কোনোদিনও, তেমন অকল্পনীয়, অভাবনীয় ও অদৃশ্যপূর্ব বর্বরতা-নারকীয়তা প্রদর্শন করছে ইসরায়েল। জীবিত মানুষদের হত্যার উদ্দেশ্যে আক্রমণের পর লাশের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়েছে। এতদিন ইসরাইলি নৃশংসতা ছিল জীবিত গাজাবাসীর ওপর। এবার তা-ও অতিক্রম করেছে। কমপক্ষে চারটি মৃতদেহ ও অ্যাম্বুলেন্সের ওপর দিয়ে বুলডোজার উঠিয়ে দিয়ে তা থেঁতলে দিয়েছে।

বীভৎস, ন্যক্কারজনক এই ঘটনা ঘটছে মুসলিমদের ঘরের ভিতরে, চোখের সামনে। চারপাশে মুসলিম দেশ- সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, মিশর, ইরান, ইরাক, কাতার, তুরস্কসহ আরও কত দেশ। তারা কীভাবে এই নৃশংসতাকে সহ্য করছে!

সহ্য করছে, রাজনৈতিক স্বার্থগত কারণে। অধিকাংশ আরব দেশই স্বৈরশাসকের কব্জায় রয়েছে, যারা টিকে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দুনিয়ার ইচ্ছায়। মার্কিন-ইসরায়েল অক্ষশক্তির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ও শক্তি আরব দেশগুলোর নেই। অনুগত দাসের মতো তারা মার্কিন মদদপুষ্ট ইসরায়েল কর্তৃক ফিলিস্তিনের গণহত্যার দর্শক হয়ে আছে। আরব দেশগুলোর এই হলো বাস্তবচিত্র।

তুরস্ককে বেশ সাহসী ও উদ্যোগী মনে করা হলেও বাস্তবে তুরস্ক কৌশলজনক অবস্থানে থেকে ‘না ধরি মাছ, না ছুঁই পানি‘ নীতিতে নিজেকে নিরাপদ রাখছে। নতুন কোনো ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে চায় না তুরস্ক। 

বাদ থাকে ইরান। ইরান ও তার সহযোগী সিরিয়া, লেবানন ও ইয়ামেনের কিছু গ্রুপ মাঝে মাঝে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইরান নিজে মাঠে নামছে না। নানা গ্রুপকে কাজে লাগাচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ-ইসরায়েল সমর্থনের বিপরীতে রাশিয়া ও চীন সুস্পষ্ট কোনো ভূমিকা নিয়ে সংঘাতের অবসানে কাজ করছে না। তারা নিজ নিজ স্বার্থ ও কৌশলের আলোকে কার্যক্রম চালাচ্ছে। বড় ও শক্তিশালী দেশ দুটি ফিলিস্তিনে গণহত্যার ঘটনায় মোটেও কাতর হচ্ছে না এবং বাস্তবক্ষেত্রে ইসরায়েলকে বিন্দুমাত্রও অসন্তুষ্ট করছে না।

বস্তুতপক্ষে বৃহত্তর মুসলিম উম্মাহর অংশ হলেও মধ্যপ্রাচ্যে তিনটি জাতি (আরব, তুর্কি, ইরানি) আঞ্চলিক ক্ষমতা কাঠামোর নেতৃত্বে আসীন হওয়ার জন্য  পারস্পরিক লড়াইয়ে লিপ্ত। এই ত্রিমুখী দ্বন্দ্ব মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম ঐক্য ও সংহতিতে ক্ষয় ধরিয়ে দিয়েছে, যার ফায়দা লুটছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা শক্তি অস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে এবং পশ্চিমাদের দোসর ইসরায়েল একতরফাভাবে ফিলিস্তিনে নিধনযজ্ঞ পরিচালনার মাধ্যমে। আর  অধিকাংশ আরব দেশই অবৈধ শাসকের অধীনে থাকায় বৈধতার অভাবের জন্য কোনো পদক্ষেপ তো দূরের বিষয়, ইসরায়েলের বিরুদ্ধে জোর গলায় কথা পর্যন্ত বলতে পারছে না। 

রাষ্ট্র ও সরকারসমূহের সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যেও রয়েছে দুর্বলতা। ফিলিস্তিন নিয়ে বিশ্বের সকল মুসলমানের মধ্যেই তীব্র ‘আবেগ‘ আছে, কিন্তু ‘অনুধ্যান‘ নেই। 'অনুধ্যান' শব্দটি আমি এখানে খুব সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছি, যার অর্থ: সর্বদা চিন্তা বা স্মরণ, শুভচিন্তা, নিরন্তর চিন্তা, অনুচিন্তন, সর্বদা স্মরণ, সর্বদা ধ্যান করা। অনুধ্যান শব্দে অর্থ ও প্রতিশব্দগুলো ফিলিস্তিনের ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হচ্ছে না। চিন্তা ও গবেষণায় ফিলিস্তিনের ঘটনাবলি এবং সেখানকার গণহত্যা, নব্য-বর্ণবাদ ও জাতিগত হিংসার জায়নবাদী চক্রান্তের বিষয়গুলো উন্মোচিত করা হচ্ছে বলেও মনে হয় না। ফিলিস্তিন সম্পর্কে মানুষের জ্ঞানের পরিধি ও অনুধ্যান বাড়ছে না।

বরং আমজনতা ও নেতৃবৃন্দ ফিলিস্তিন প্রশ্নে কাজে লাগিয়েছে আবেগকে। প্রচণ্ড আবেগে মিছিল, সমাবেশ, দোয়া করার পর অনেক দিন ফিলিস্তিন ইস্যুতে চুপ মেরে থাকাই হলো নির্মম বাস্তবতা। এমনটি কতটুকু সঠিক, তা চিন্তার বিষয়। ৭৫ বছর ধরে ফিলিস্তিনে সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুচিন্তিত কার্যক্রমের দ্বারা ইসরায়েল যা করে চলেছে, তা ধারাবাহিক গবেষণা-অধ্যয়নের পথে গভীরভাবে অনুধ্যান ও আত্মস্থ করাই ছিল জরুরি। তাহলেই আবেগ আর যুক্তির সমন্বয়ে বিপন্ন-নির্যাতিত ফিলিস্তিনের পক্ষে দাঁড়ানো এবং জায়নবাদী, বর্ণবাদী ইসরায়েলের জাতিগত হিংসা ও গণহত্যার অর্থবহ প্রতিবাদ ও বিরোধিতা করা সম্ভব হবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওন্যাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;