রোহিঙ্গা ও লোতশাম্পা শরণার্থীদের মিল-অমিল ও ভবিষ্যৎ করণীয়



মো. জাকির হোসেন

  • Font increase
  • Font Decrease

দীর্ঘস্থায়ী শরণার্থী সৃষ্টি ও প্রত্যাবাসনে গড়িমসিসহ বেশ কিছু বিষয়ে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাথে ভুটান থেকে তাড়িয়ে দেয়া নেপালে আশ্রয় নেয়া লোতশাম্পা শরণার্থীদের মিল রয়েছে। জিডিপি নয়, জিএনপি-তে(গ্রোস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস) বিশ্বাসী সাংগ্রি-লা অর্থাৎ মোট জাতীয় সুখের দেশ ভুটান নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে তার মোট জনসংখ্যার এক-ষষ্ঠমাংশ লোককে দেশ ছাড়তে বাধ্য করে।

মিয়ানমারের নাগরিকত্ব শুদ্ধি অভিযান স্টাইলে ভুটানও জতিগত শুদ্ধি অভিযান ‘এক জাতি, এক জনগণ’(ওয়ান নেশন, ওয়ান পিপল) নীতি হাতে নেয়। এর ফলে দেশটিতে কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাসরত নেপালি ভাষাভাষী মানুষ যারা লোতশাম্পা নামে পরিচিত তারা ভয়ংকর পরিচয় সংকটের মুখে পড়ে, যেমনটি পরিচয় সংকটের মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে। মিয়ানমারে বসতিস্থাপনকারী রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষদের মতো লোতশাম্পাদের পূর্বপুরুষরাও কয়েক শতাব্দী আগে ভুটানের দক্ষিণাংশের নিম্নভূমিতে এসে বসতি স্থাপন করেছিলো। মিয়ানমারের জান্তা যেমন নাগরিক আইন সংশোধন করে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়, তেমনি  ভুটানেও নাগরিকত্ব আইনের সংস্কার দ্বারা লোতশাম্পাদের নাগরিক হওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়। নাগরিক নয় বলে রোহিঙ্গাদের মতো লোতশাম্পাদেরও রাষ্ট্রের সুযোগ-সুবিধাগুলোতে কোনো অধিকার নেই।

জাতিগত শুদ্ধিতার নামে নিপিড়নমূলক অভিযান শুরুর পরই লোতশাম্পারা সীমান্ত অতিক্রম করে চলে এসেছিল ভারতে। সেখানেও তাদের ঠাঁই মিলেনি। ভারতের সীমান্তরক্ষীরা তাদের ঠেলে দিয়েছিল নেপালে। ২৪ বছর ধরে লোতশাম্পারা শরণার্থী হয়ে নেপালের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করেছে। এ ২৪ বছরে ভুটান সরকারের নানা পর্যায়ের প্রতিনিধিরা নেপাল সফর করে লোতশাম্পাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য বার বার আশ্বাস দিলেও একজন শরণার্থীকেও ভুটান ফেরত নেয় নি। ২৪ বছর ধরে নানা টালবাহানার পর ভুটান সরকার শরণার্থী সমস্যা আরও দীর্ঘায়িত করার কৌশল হিসাবে যখন নেপালকে জানায় যে, জনগণের প্রতিনিধিরা প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে তখন এটি স্পষ্ট হয়ে যায় যে শরণার্থীদের ফেরার আশা তলানীতে ঠেকেছে। অবশেষে জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আন্তরিক প্রচেষ্টা শুরু করেন লোতশাম্পা শরণার্থীদের তৃতীয় কোন দেশে পুনর্বাসনের জন্য।

পরিসংখ্যান অনুযায়ি বিশ্বব্যাপী, শরণার্থীদের শতকরা এক ভাগেরও কম তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন হয়। এইদিক থেকে নেপালের লোতশাম্পা উদ্বাস্তুদের জন্য তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন কর্মসূচী খুবই ব্যতিক্রম। জাতিসংঘ কার্যালয়ের হিসাব মতে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রায় এক লক্ষ ১১ হাজার লোতশাম্পা শরণার্থী যুক্তরাষ্ট্র,  অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্ক, নরওয়ে, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পেয়েছে। তৃতীয় কোন দেশে পুনর্বাসনের পরও নেপালে ৮,৫০০ লোতশাম্পা শরণার্থী রয়েছে। ঝাপা জেলার ক্যাম্পে বসবাসরত এ আট হাজার ৫০০ শরণার্থীর জন্য কোন বিকল্প খুঁজে বের করতে পারেনি নেপাল সরকার ও ইউএনএইচসিআর। নেপালে থেকে যাওয়া শরণার্থীদের অনেকেই ভুটানে ফিরে যেতে চায়। যুক্তরাষ্ট্র কেন, ভুটান বাদে পৃথিবীর কোথাও যেতে রাজি নন তারা। তাদের স্বপ্ন একটাই, মাতৃভূমিতে ফেরা। তারা বিশ্বাস করে তাদের জীবদ্দশাতেই এ সমস্যার সমাধান হবে এবং তাদেরকে ফেরানোর জন্য ভুটান তার সীমান্ত খুলে দেবে। ওখানকার সাথে তাদের নাড়ির সম্পর্ক। মনে করে, ওটিই তাদের দেশ; কায়মনে প্রার্থনা করে, মৃত্যুটা যেনো ভুটানে গিয়েই হয়। আবার অনেকে নেপালেই থেকে যেতে আগ্রহী। নেপালের সাথে ভুটানি শরণার্থীদের সাংস্কৃতিক, ভাষাগত ও ধর্মীয় বেশ মিল আছে।

ঝাপা ক্যাম্পের লোতশাম্পা শরণার্থীদের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেপালি নাগরিকদের বিয়ে করেছে।  ইউএনএইচসিআর কর্মকর্তাদের মতে ভুটানেই উদ্বাস্তুদের প্রত্যাবাসনের চেষ্টা চললেও এটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। তাই জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থা অবশিষ্টদের নেপালি সমাজে আত্নীকরণের কথা বলছে আকারে-ইঙ্গিতে। ইউএনএইচসিআর বলছে, তারা (ভুটানি শরণার্থীরা) সুশিক্ষিত, কঠোর পরিশ্রমী এবং নেপালি সমাজে পুরোপুরি অবদান রাখাতে প্রস্তুত।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ৯১-৯২ সালে যেসব রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে তারা লোতশাম্পাদের চেয়েও দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করছে।

রোহিঙ্গা ও লোতশাম্পা শরণার্থীদের মাঝে অনেক মিল থাকলেও লোতশাম্পা সমস্যা যেভাবে সমাধান হয়েছে রোহিঙ্গাদের সমস্যা সেভাবে সমাধানের সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। লোতশাম্পা শরণার্থীদের সিংহভাগকে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসিত করা হলেও রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ। একমাত্র কানাডা ছাড়া আর কোন রাষ্ট্রই রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে আগ্রহ প্রকাশ করেনি।

রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের প্রধান অন্তরায় হলো তারা মুসলমান। আমেরিকার নেতৃত্বে মধ্যপ্রাচ্য তছনছ হওয়ার আগে যে মানুষগুলোর অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসার ন্যূনতম নিশ্চয়তা ছিলো, সে মানুষগুলো সব হারিয়ে বাস্তুচ্যুত হয়ে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের অজানা আশংকায় মধ্যপ্রাচ্য ছেড়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌকায় সমুদ্র পেরিয়ে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোতে শরণার্থীর মর্যাদা চেয়ে এক সীমান্ত থেকে আরেক সীমান্তে ভিক্ষুকের মতো যে হাত পাতলো তাদের প্রতি কেমন আচরণ করা হয়েছে সে কথা তো আমাদের অজানা নয়।

তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সম্ভাবনা যদি খুঁজতেই হয় তাহলে ইসলামী সম্মেলন সংস্থা (ওআইসি)-র সহযোগিতায় মুসলিম রাষ্ট্রসমূহে প্রচেষ্টা চালানো যেতে পারে। তবে সে সম্ভাবনাও খুব ক্ষীণ। ভূমির দুষ্প্রাপ্যতা, মাত্রাতিরিক্ত  জনঘনত্ব, সম্পদের স্বল্পতা, কর্মসংস্থানের সংকট ছাড়াও রাজনৈতিক, সামাজিক, পরিবেশগত ও নিরাপত্তাজনিত কারণে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বাংলাদেশে আত্নীকরণের সম্ভাবনা প্রায় অসম্ভব।

নিরাপদ ও টেকসই স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনই এ সমস্যার একমাত্র সমাধান। মিয়ানমারে স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে ও টেকসই সমাধান খুঁজে পেতে হলে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, নিরাপত্তা, বাসস্থান ও জীবিকার ব্যবস্থা এবং জবরদস্তিমূলক কেড়ে নেওয়া সম্পদ-ভূমি ফেরতদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। তবে সে সম্ভাবনার সামান্যতমও এখনও দৃশ্যমান নয়।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে গত ২৩ নভেম্বর একটি অ্যারেঞ্জমেন্ট সম্পাদিত হয়েছে। ১৯ ডিসেম্বর যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন ও এর কার্যপ্রণালী ঠিক করা হয় এবং সর্বশেষ ১৬ জানুয়ারি মাঠপর্যায়ের চুক্তি ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্ট স্বাক্ষরিত হয়। এর অর্থ হলো, প্রত্যাবাসনসংক্রান্ত সব ধরনের আইনগত প্রক্রিয়া শেষ। প্রায় সাত মাস আগে প্রত্যাবসনের সর্বশেষ আইনগত ধাপ মাঠপর্যায়ের চুক্তি সই হলেও এর পর আর কোন অগ্রগতি নেই। চুক্তি অনুযায়ি বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ৮ হাজার শরণার্থীর তালিকা দেওয়া হয়েছিল গত ফেব্রুয়ারিতে। তার মধ্যে মাত্র ৫০০ জনের পরিচয় যাচাই করে নিশ্চিত হওয়ার কথা জানিয়েছে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।

প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পাদনের পর সাত মাস পেরিয়ে গেলেও অদ্যাবধি একজন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমার ফেরত নেয়নি। তদুপরি, প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পাদনের পরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করেছে মিয়ানমার।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ২০০৫ সালের পর থেকে মিয়ানমার একজন রোহিঙ্গাকেও ফেরত নেয় নি। এমন কি ২০১৪ সালে মিয়ানমার সরকার ২,৪১৫ জনকে রাখাইনের বাসিন্দা বলে ফিরতে ‘অনাপত্তি সনদ’ দিলেও আজ অবধি তাদেরও ফেরত নেয় নি।

জাতিসংঘ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা মিয়ানমার সফর করে বার বার এ বার্তাই দিচ্ছেন যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রত্যাবাসনের কোন পরিবেশ মিয়ানমারে এখনও তৈরি হয়নি। কেউ কেউ এও বলেছেন যে, শরণার্থীদের রাখাইনে নিজ বাড়িতে ফেরানোর কোনো ধরনের প্রস্তুতি তারা সেখানে দেখেননি বা শুনেননি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক উপ মহাসচিব উরসুলা মুলার স্পষ্ট করেই বলেছেন, “সেখানকার পরিস্থিতি কোনোভাবেই ফেরার উপযোগী নয়।” মিয়ানমারের বাস্তব অবস্থার উধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, “আমি পরিস্থিতি নিয়ে সত্যিই উদ্বিগ্ন।”

এদিকে খবরে প্রকাশ রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা আবাদি জমি ইজারা দিচ্ছে মিয়ানমার সরকার। মিয়ানমারের ইরাবতী পত্রিকা এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেলে আসা ৭০ হাজার একর জমির মধ্যে ১০ হাজার একর জমি ইতোমধ্যেই একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে লিজ দিয়েছে মিয়ানমার সরকার। তারা জানাচ্ছে বাকিগুলোও লিজ দেয়া হবে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টার ন্যাশনাল রোহিঙ্গাদের ফেলে যাওয়া গ্রামের উপগ্রহ চিত্র তুলে ধরে এ তথ্য দিয়েছে যে, সাত লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে দেশ থেকে তাড়িয়ে এখন তাদেরই ফেলে যাওয়া গ্রামে নানা স্থাপনা করছে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে মিয়ানমার প্রতারণার পাশাপাশি ‘চোর-পুলিশ’ খেলায় মেতেছে। রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে হলে মিয়ানমারকে তোয়াজ-তোষামোদ করার পরিবর্তে একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার লজ্জা মিয়ানমারকে বাধ্য করতে হবে।

ইতহাস সাক্ষ্য দেয়, অতীতে আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার লংঘনকারী রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কঠোর অবরোধ আরোপের পাশাপাশি জাতিসংঘ কাঠামোর মধ্যে সামরিক শক্তি প্রয়োগ করেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও এ্যাডহক ট্রাইব্যুনালে অপরাধীদের বিচার করে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রকে শায়েস্তা করেছে। আন্তর্জাতিক আইন ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্ত মানতে বাধ্য করেছে। এমনকি কখনও কখনও আঞ্চলিক সামরিক জোটকে ব্যবহার করে শান্তিচুক্তি গ্রহণ করতে দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রকে বাধ্য করার উদাহরণও রয়েছে।

সার্বদের বাধ্য করতে ১৯৯৫ সালে স্রেবরেনিৎসায় বসনীয় সার্বদের ওপর ও কসোভোয় জাতিগত শুদ্ধি অভিযান চালানোর কারণে ১৯৯৯ সালে সার্বিয়ায় ন্যাটো বিমান হামলা চালিয়েছিলো।

মিলিয়ন ডলার প্রশ্ন হলো মিয়ানমারকে কে বাধ্য করবে এবং কীভাবে বাধ্য করা যাবে?

জাতিসংঘের বিবেচনায় এ গ্রহের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠি হলো রোহিঙ্গারা। যে জাতিসংঘ বলছে রোহিঙ্গারা এ পৃথিবীর সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠি, সে জাতিসংঘের মহাসচিবসহ বিভিন্ন পর্ষদের উর্ধতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সফর করেছেন, রোহিঙ্গাদের ওপর মগের বংশধরদের হত্যা, ধর্ষণসহ নানা বর্বরতার গল্প শুনেছেন, পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের শরীরে নৃশংসতার চিহ্ন থেকে ব্যথিত হয়েছেন, ক্রন্দন করেছেন, নিরাপত্তা পরিষদে প্রকাশ্য ও রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেছেন। এমনকি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশের পাশাপশি জাতিসংঘ-মিয়ানমারের সমঝোতা চুক্তিও সম্পন্ন হয়েছে। পরিতাপের বিষয় হলো, মিয়ানমার সরকার ও জাতিসংঘের মধ্যে সই হওয়া গোপন চুক্তিতে দেশটিতে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব কিংবা স্বাধীনভাবে চলাচলের কোনো নিশ্চয়তা নেই।

মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গবেষক লরা হাই বলেন, মিয়ানমার সরকার ও জাতিসংঘের চুক্তি অনুযায়ি রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরার অর্থ হচ্ছে, তারা এমন একটি বর্ণবিদ্বেষমূলক রাজ্যে ফিরবেন, যেখানে তারা মুক্তভাবে চলাফেরা করতে পারবেন না। এমনকি তাদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও কর্মস্থলে যাতায়াতের সুযোগও থাকবে না।

রয়টার্সের এক খবরে বলা হয়েছে, মিয়ানমার সরকারের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা পশ্চিমা কূটনীতিকদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, নাগরিকত্বের যে আইনে রোহিঙ্গাদের কার্যত রাষ্ট্রহীন করে রাখা হয়েছে, তা পর্যালোচনার কোন প্রস্তাব আমলে নেয়া হবে না। তার মানে হলো,  নাগরিকত্বহীন রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের বন্দীজীবনে ফেরার প্রত্যাবাসন চুক্তি এটি।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের প্রধান মোহিবুল্লাহ এ চুক্তির প্রতিক্রিয়ায় জানিয়েছেন, এই চুক্তিটি নিয়ে আমরা বেজায় ক্ষুব্ধ। এতে রোহিঙ্গা পরিভাষাটি উল্লেখ নেই। তিনি জানান, আমরা এ সমঝোতা মানবো না। এর মানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এ যাবতকালের সব দৌঁড়ঝাপের ফলাফল হলো বড়মাপের একটি শূন্য। বাংলাদেশকে প্রশংসা বন্যায় ভাসানো আর মিয়ানমারকে নখ-দন্তহীন হুংকার দেয়া ছাড়া জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এখন পর্যন্ত মিয়ানমারকে কোনো একটি সিদ্ধান্তও মানাতে বাধ্য করাতে পারেনি।

লোতশাম্পা শরণার্থীদের মতোই রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও বাংলাদেশে অবস্থান দীর্ঘতর হতে যাচ্ছে এটা বুঝতে রকেট বিদ্যার প্রয়োজন পড়ে না। বাংলাদেশকে এ বাস্তবতা মেনে শরণার্থীদের দীর্ঘ অবস্থানের সাথে সম্পৃক্ত সকল সমস্যা বিশেষ করে নিরাপত্তা ও জঙ্গীবাদের হুমকিকে মাথায় রেখে পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

নিরাপত্তা ও জঙ্গীবাদের প্রশ্নে রোহিঙ্গারা টাইমবোমার মতো। হিসাবে ভুল হলেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ হতে বাধ্য। ভ্রান্ত মতাদর্শে বিশ্বাসী এক শ্রেণীর মুসলিম রোহিঙ্গাদের জঙ্গীবাদে প্রলুব্ধ করতে, রোহিঙ্গাদের আত্ননিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠায় মিয়ানমারের বিরুদ্ধে উস্কে দিতে ও আওয়ামীবিরোধী দেশি-বিদেশি একটি গোষ্ঠী রাষ্ট্রে অস্থিতিশীলতা করতে রোহিঙ্গাদের ব্যবহারে সদা তৎপর রয়েছে।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, উদ্বাস্তু জীবনের অসন্তুষ্টিসহ নানা কারণে  খুন, ধর্ষণের মতো ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িযে পড়ছে রোহিঙ্গারা। গত আট মাসে ১৫ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তারা। এ ছাড়া ধর্ষণ, অপহরণ, চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, ডাকাতির মতো দেড় শতাধিক অপরাধে নাম এসেছে রোহিঙ্গাদের। এসব ঘটনায় এ যাবত ১৬৩ টি মামলা দায়ের হয়েছে। এ ছাড়াও ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৪ মাসে ৬০৭ জন রোহিঙ্গাকে সাজা দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলামের ভাষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দুই থেকে আড়াই লাখ বাংলাদেশি পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে চলে গেছে। ফলে স্থানীয় ও প্রবাসী বাংলাদেশিদের মধ্যে রোহিঙ্গাবিরোধী মনোভাব ক্রমেই দৃঢ় হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সবাইকে মনে রাখতে হবে আন্তর্জাতিক সমালোচনার মুখে সাময়িকভাবে রাজী হলেও রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার মোটেও আন্তরিক নয়। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের শত্রুতামূলক রাষ্ট্রীয় নীতির কোন পরিবর্তন না করে, রোহিঙ্গাদের নাগরিক হিসেবে স্বীকৃতি না দিয়ে স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসন প্রায় অসম্ভব। বাস্তবতা হলো, মিয়ানমার জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আদালতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কোন পদক্ষেপকেই মোটেও পাত্তা দিচ্ছে না।

একথা সর্বজনবিদিত যে, অপরাধী মিয়ানমারের শক্তির উৎস চীন ও রাশিয়া। নিরাপত্তা পরিষদে ভোটো ক্ষমতার অধিকারী এ রাষ্ট্রদ্বয়ের সম্মতি ছাড়া জাতিসংঘের কাঠামোর মধ্যে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ প্রায় অসম্ভব। এমতাবস্থায় রোহিঙ্গাদের দীর্ঘ অবস্থানের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ, মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চতুর্মূখী চাপ সৃষ্টিতে তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া ও চীন-রাশিয়ার মানবতাবোধ জাগ্রত করতে বিরামহীন দেন-দরবার করা ছাড়া বাংলাদেশের সামনে আর কোন পথ খোলা আছে বলে প্রতীয়মান হয় না।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

   

বর্জনে অসারের তর্জন গর্জন সার



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটা প্রচারণা শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন এটা ছিল কেবল সামাজিক মাধ্যমে। এখন এটা রাজনৈতিক ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আগে যদিও ছিল, তবে সেটার প্রভাব এতখানি বিস্তৃত ছিল না।

রুহুল কবির রিজভীর পরনের চাদর ছুড়ে ফেলা এবং এরপর পুড়ানোর ঘটনার পর এখন এটা নিয়ে সরকারের একাধিক মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীও কথা বলেছেন। ঘটনা যখন এত দূর গড়িয়েছে, তখন ধারণা করা যায়, খুব সহসা এটা থামছে না। যদিও শেষ পর্যন্ত এটা চূড়ান্ত বর্জন পর্যন্ত না পৌঁছে বাগযুদ্ধ পর্যন্তই সীমিত থাকবে।

বিএনপি মুখে ভারত-বিরোধিতার রাজনীতি করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে তাদের এই ভারত-বিরোধিতা চালিয়ে যেতে হয়েছে। দলটির ধারণা এবং প্রচারণা বলছে, আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় রেখেছে ভারত বা ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থনে আওয়ামী লীগ 'যেনতেন উপায়ে' নির্বাচন করে ক্ষমতায় টিকে আছে। তাদের ধারণা, আমেরিকা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ টিকে আছে মূলত ভারতের সমর্থন ও সহায়তার কারণে। সবশেষ নির্বাচনে পশ্চিমা দেশগুলোর তৎপরতাকে যেভাবে উড়িয়ে দিয়ে ক্ষমতায় রয়েছে আওয়ামী লীগ তাতে বিএনপির এই ধারণা আরও শক্ত হয়েছে। নিষেধাজ্ঞার ইঙ্গিত দিয়েও আমেরিকা ও ইইউভুক্ত দেশগুলো যে শেষ পর্যন্ত কঠোর হয়নি, এখানেও রয়েছে ভারতের প্রভাব। বিএনপির এই ধারণাকে আরও দৃঢ় করেছে একাধিক মন্ত্রীর বক্তব্য, যেখানে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'গত নির্বাচনে ভারত বাংলাদেশের পাশে ছিল বলে বড় বড় দেশগুলো অশুভ হস্তক্ষেপ করতে পারেনি।’ হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'নির্বাচন নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছিল, ওই সময় ভারত আমাদের পাশে ছিল। ২০১৮ সালে নির্বাচনে ভারত আমাদের সঙ্গে ছিল। এবারও ভারত আমাদের পাশে ছিল ও আছে।’

বিএনপির বিশ্বাস আর মন্ত্রীদের বক্তব্য যখন কাছাকাছি, তখন দলটি এবার কামান দাগাচ্ছে ভারতের দিকেই। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে এখন সামনে এনেছে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা। প্রচারণায় সর্বশক্তি দেওয়ার এ প্রবণতায় মাঝে মাঝে ভ্রম হয়—ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বুঝি বাংলাদেশের ওপরই নির্ভরশীল! অথচ বাস্তবতা ঠিক উল্টো। ভারত থেকে আমদানি বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের নিয়ন্ত্রণহীন বাজার ব্যবস্থা আরও ভেঙে পড়ে।

বাজার ব্যবস্থার দিকে ইঙ্গিত করে বক্তব্য দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে নিজের পরনের ভারতীয় পণ্য (চাদর) ছুড়ে ফেলে দিয়ে এরপর নেতাকর্মীদের মাধ্যমে আগুনে পুড়ানোর দুইদিন পর ২২ মার্চ ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, 'ভারতীয় পণ্য বয়কটের নামে বিএনপি বাজার ব্যবস্থা অস্থিতিশীল করার গভীর ষড়যন্ত্র করছে।' তিনি বলেন, 'বিএনপি নেতার (রিজভী) শাল ফেলে দিয়ে ভারতীয় পণ্য বয়কটের প্রদর্শন করা পাগলামি। আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটি বড় অংশ আসে ভারত থেকে। বিএনপির এক নেতা (আব্দুল মঈন খান) গণতন্ত্র উদ্ধারে ভারতের সহযোগিতা চায়, আবার আরেক নেতা ভারতের পণ্য বয়কটের ডাক দেয়। আসলে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে নিজেরা দিশেহারা হয়ে গেছে।'

ভারত বর্জনের প্রচারণায় যখন সংহতি জানালেন রুহুল কবির রিজভী, এর দিন তিনেক পর কিন্তু বিএনপির ইফতার মাহফিলে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের কূটনীতিকরা। গত ২৪ মার্চ রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে কূটনীতিকদের সম্মানে বিএনপি যে ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে তাতে অংশ নেন ভারতের ডেপুটি হাইকমিশনার ড. বিনয় জর্জসহ দেশটির দূতাবাসের আরও কয়েকজন। ওই অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। রিজভী ইফতার মাহফিলে না থাকলেও দল কিন্তু এখানে ভারতকে বর্জন করতে পারেনি।

দলের নীতিনির্ধারণীতে রুহুল কবির রিজভী যে অবস্থানেই থাকুন না কেন, তিনি দলটির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব; এবং নিত্যকার সংবাদ সম্মেলনের বেশিরভাগ তিনিই করে থাকেন। তার হঠাৎ ভারত-বিদ্বেষ প্রকাশ্য হলেও এটা নিয়ে দলের মধ্যে যে আলোচনা হয়নি তা এর মধ্যেই প্রকাশিত। যদিও বিএনপির যাবতীয় সিদ্ধান্ত দেশে হয় না, লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশনা আসে, এবং সে অনুযায়ী সেটা প্রকাশিত হয়। রিজভীর এই ভারতীয় পণ্য বর্জনে সংহতি প্রকাশ লন্ডন থেকে আসা সিদ্ধান্ত, নাকি রিজভীর একার তা এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তার চাদর-নাটক যে ব্যাপক প্রভাব রেখেছে দেশের রাজনীতিতে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

ভারত-বিরোধিতা এবং ভারতীয় পণ্য বর্জনের বিষয়টি কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ১১ মার্চ বিষয়টি তুলেছেন মুশফিকুল ফজল আনসারী। ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহকারী প্রেস সেক্রেটারির দায়িত্বে থাকা মুশফিকুল ফজল আনসারী মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ম্যাথিউ মিলারের কাছে জানতে চান, ''মিডিয়ার রিপোর্ট অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারণা ছড়িয়ে পড়ছে। একতরফা নির্বাচনের পর প্রতিবেশী ভারতে তৈরি পণ্য বর্জনকে উৎসাহিত করছে জনগণ। তাদের সন্দেহ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখছে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?" জবাবে ম্যাথিউ মিলার বলেন, 'এই প্রচারণা সম্পর্কেও আমরা অবহিত। আমি অবশ্যই ভোক্তাদের নিজেদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না—সেটা বাংলাদেশ হোক বা বিশ্বের অন্য কোথাও। কিন্তু বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের সঙ্গেই আমাদের সম্পর্ককে মূল্যায়ন করি। অবাধ, মুক্ত, নিরাপদ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করাসহ অভিন্ন স্বার্থে দুই দেশের সরকারের সঙ্গেই আমরা অব্যাহতভাবে কাজ করব।' এরপরই রুহুল কবির রিজভীর এই চাদর ছুড়ে ফেলা আর আগুন দেওয়ার ঘটনা। অর্থাৎ নির্বাচনকেন্দ্রিক এই ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা, যেখানে আমাদের অতিপরিচিত 'দেশি পণ্য, কিনে হও ধন্য' স্লোগানের কোনো সম্পর্ক নেই; সব সম্পর্ক, সব বিরোধিতা মূলত রাজনৈতিক। রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়ালের চেষ্টা।

এই যে ভারতীয় পণ্য বর্জনের প্রচারণা, এটা যদি দেশি পণ্যের প্রসারের উদ্দেশ্যে হতো, তাহলে সমস্যা ছিল না। সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আওয়াজ তোলা হয়েছে, এবং সে অনুযায়ী প্রচার-প্রচারণা চলছে। এই প্রচার-প্রচারণা আবার লুফে নিয়েছে সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগ। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কথা বলছেন, কথা বলছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, কথা বলছেন অন্য মন্ত্রী, এমনকি প্রধানমন্ত্রীও। গতকাল বুধবার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের আলোচনা সভায় সভাপতির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, 'বিএনপির এক নেতা (রুহুল কবির রিজভী) চাদর খুলে বলে দিয়েছেন, ভারতের পণ্য ব্যবহার করবেন না। যে নেতারা বলছেন ভারতীয় পণ্য বর্জন করেন, তাদের বউদের কয়খানা ভারতীয় শাড়ি আছে? তারা বউদের কাছ থেকে শাড়িগুলো এনে পুড়িয়ে দিচ্ছেন না কেন? আমি বিএনপি নেতাদের বলব, তাদের বউরা যেন ভারতীয় শাড়ি না পরেন। যেদিন ওগুলো এনে অফিসের সামনে পোড়াবেন, সেদিন বিশ্বাস করব, আপনারা ভারতীয় পণ্য বর্জন করলেন।' আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরেক বক্তব্যে বলেছেন, 'চিরাচরিত পাকিস্তানি কায়দায় ভারতের বিরোধিতা শুরু করেছে বিএনপি। তারা যখন কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না পায়, তখনই এই একটা ইস্যু সামনে নিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধুর আমলেও করেছে, এখন শেখ হাসিনার আমলেও তাই করছে।' বলা যায়, রুহুল কবির রিজভীর একটা চাদর কেবল চাদরই থাকল না, এটা রাজনৈতিক অঙ্গনে বাগযুদ্ধের এক প্রপঞ্চ হয়ে গেছে।

মুক্তবাজার অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় এভাবে কোনো দেশের পণ্য কি বর্জন করা সম্ভব? আমাদের দেশে কি সম্ভব ভারতের সব পণ্য বর্জনের? যে বিএনপি নেতারা বর্জনের পক্ষে তর্জন গর্জন করছেন তারা কি বাস্তবতা টের পান না? গায়ে থাকা ভারতীয় চাদর যেদিন খুলেছেন সেদিনই কি প্রমাণ হয়নি রুহুল কবির রিজভী ভারতের পণ্যের অন্যতম ভোক্তা? অন্য অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়, সামান্য এক উদাহরণ দিলেও বলা যায়—যে সিএনজিচালিত অটোরিকশার দখলে রাজধানীসহ সারাদেশ, সে অটোরিকশাগুলোও আসে ভারত থেকে। ২০০২ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে এই সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়, এবং এর শুরুটা করে বিএনপি সরকারই। মোটরসাইকেলসহ অন্য অনেক যানবাহন, নিত্য ভোগ্যপণ্য, ব্যবহার্য পণ্যের অনেক কিছুতেই আমরা ভারতের ওপর নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতাকে অস্বীকার করার উপায় নাই।

আমরা জানি, বিএনপিও জানে এসব; কিন্তু স্বীকার করছে না। নিজেদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা আড়াল করতে তারা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে চায় ভারত-বিরোধী প্রচারণাকে। এটাকে কি বলা যায় 'অসারের তর্জন গর্জন সার'? কারণ রাজপথ আর রাজনৈতিক অঙ্গনে ক্ষমতাহীনের গর্জনই বেশি শোনা যায়। বিএনপি এক্ষেত্রে একটা উদাহরণ হয়ে আছে এই ভারতের পণ্য বর্জনের প্রচার-প্রচারণা বা তর্জন গর্জন দিয়ে।

তবু বলি, এই বাকযুদ্ধে সরকার ও সরকার দল আওয়ামী লীগের বিপুল অংশগ্রহণ জরুরি নয়। জরুরি নয় মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রীর ধারাবাহিক বাক্য খরচের। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত অন্তঃসারশূন্য যে প্রচার-প্রচারণা, সেখানে অংশ না নেওয়াটাই হতে পারে যথার্থ সিদ্ধান্ত।

;

সফুরের পুড়ে অঙ্গার হওয়া ও রাষ্ট্রের গভীর ‘ঘুম’



আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দেশে অপঘাতে মৃত্যুর সংখ্যা যেভাবে প্রতিনিয়তই বেড়ে চলছে, তাতে ‘স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি’ চাওয়া প্রবাদপ্রতিম সাংবাদিক নির্মল সেনের সেই আকাঙ্ক্ষা আজ যেন বিদ্রুপ করছে! আমরা কে যে কখন অপঘাতের এই মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চলেছি তা বলা কঠিন!

রাষ্ট্রের অঙ্গসমূহের দীর্ঘ ঔদাসীন্যে যখনই একেকটি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর মিছিল ছুটতে শুরু করে, তখনই তাদের কিঞ্চিৎ নিদ্রাভঙ্গ ঘটে। মিডিয়ার তৎপরতায় তাদের দৌঁড়ঝাঁপ কিছু সময় সমান্তরালে চলতে থাকে। ফের গভীর ঘুমে চলে যান তারা!

হতাশাজনক এই অবস্থায় উপনীত হয়ে প্রতিদিনই আমাদের অপেক্ষা করতে হয়, কোথায় কী ঘটতে চলেছে! সংবাদপত্রের অফিসগুলোতে অপঘাতের মৃত্যুর এই হরহামেশা ব্যাপারটি এমন দাঁড়িয়েছে যে, কেবল সংখ্যা দিয়ে বিচার করা হয় ঘটনার ভয়াবহতা।

শুনতে খারাপ লাগলেও মানুষের প্রাণের মূল্য আজ এমনি মূল্যহীন হয়ে পড়েছে যে, নিত্যনতুন ঘটনার ডামাডোলে, আজকের ‘ক্রন্দনরোল’ দু’দিন বাদে কোথায় যে অপসৃত হয়ে যাচ্ছে, আমরা কেউ তার খোঁজ রাখি না। বাস্তবতা আমাদের এমন জায়গায় উপনীত করেছে যে, বর্তমানের এই সমাজকে ‘প্রাণহীন’, ‘মূল্যবোধহীন’ বললেও বোধহয় কম বলা হবে।

গেল সোমবার (২৫ মার্চ, ২০২৪) বিকেলে চট্টগ্রামের চন্দনাইশের গাছবাড়িয়া কালঘর এলাকায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগুনে পুড়ে ছফুর নামের সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকের মৃত্যু পাষাণ হৃদয়কেও টলিয়ে দিয়েছে! এ দু’দিন ফেসবুকের পাতায় সফুরের পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া ছবিটি ঘুরে ফিরে আমাদের দংশন করেছে।

ফায়ার সার্ভিসের বরাতে ঘটনার বিবরণে যা জানা যাচ্ছে, হাইওয়ের গাছবাড়িয়া এলাকায় পুলিশ বালুবাহী একটি ডাম্প ট্রাককে থামার নির্দেশ দিলেও চালক নির্দেশ অমান্য করে দ্রুতগতিতে গাড়ি চালাতে থাকেন। বেপরোয়া গতির ট্রাকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে ধাক্কা দিলে অটোরিকশার সিলিন্ডার বিস্ফোরণে হতভাগ্য চালক নিজের সিটে বসেই নির্মম মৃত্যুকে বরণ করেন।

সফুরের মৃত্যুর শোক কেটে উঠতে না উঠতেই গতকাল (২৬ মার্চ, ২০২৪) একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যুর খবর পেলাম আমরা। খবরে প্রকাশ, মৌলভীবাজারের জুড়ী উপজেলায় মঙ্গলবার ভোরে জুড়ীর পূর্ব গোয়ালবাড়ি গ্রামের মখলিছ মিয়ার বাড়িতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ওই পরিবারের ৫ জনের অপমৃত্যু ঘটে।

দুর্ঘটনা ঘটবে, এতে হতাহতও হবেন কেউ না কেউ; কিন্তু চারপাশে অপঘাতে এমন মৃত্যুর মিছিল যে রাষ্ট্রের বিভাগগুলোর ভঙ্গুর ব্যবস্থাপনার কারণেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘায়িত হচ্ছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা যদি পথ দুর্ঘটনার কথাই বলি, তবে বলতে হবে দেশের সড়কগুলো যেন মৃত্যুর ফাঁদ রচনা করে বসে আছে।

সড়কে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে কিন্তু তারও একটা মাত্রা আছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার, সংশ্লিষ্ট সবার আইন মানার প্রবণতা আর কর্তৃপক্ষের কঠোর তদারকির মাধ্যমে এই মাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা সম্ভব। আমাদের সরকারের বিপুলসংখ্যক কর্মচারী জনগণের করের অর্থে নানা ‘প্রকল্প’ সংক্রান্তে (অভিজ্ঞতা লাভ, কেনাকাটা ইত্যাদি) বিদেশ ভ্রমণ করেন।

সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করে বিশ্বে যেসব দেশ রোলমডেল হয়েছে, সেসব দেশের অভিজ্ঞতা লাভে আমাদের ‘রাজ কর্মচারীরা’ বিদেশ সফর করেছেন কি না আমাদের জানা নেই, তবে নিশ্চয়ই করবার কথা। যদি এ ধরনের সফরে গিয়েই থাকেন তবে লব্ধ অভিজ্ঞতার কী কাজে লাগানো হয়েছে, তা আমরা জানতে চাই! সড়কে মৃত্যুর এই মিছিল বন্ধে আইনের প্রয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের মনোবৃত্তির যে বিরাট পরিবর্তন করা জরুরি আর বাংলাদেশের যে বাস্তবতা তাতে সম্পূর্ণরূপে খোলনলচে বদলে ফেলার বিকল্প কী হতে পারে, তা আমাদের জানা নেই।

তবে যুৎসই একটি শব্দ প্রয়োগ করা যেতেই পারে। তা হচ্ছে, ‘আমূল পরিবর্তন’। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট নেতারা কিংবা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ‘রাজ কর্মচারীরা’ এই রকম পরিবর্তনের প্রয়াস আদৌ কি হতে দেবেন বা ইতোপূর্বে দিয়েছেন! এর সোজাসাপটা উত্তর- ‘না’।

সোশ্যাল মিডিয়ায় গেল দু’দিনের বিস্তর মুক্ত আলোচনায় কেবলমাত্র পরিবহন ও যোগাযোগ খাত নিয়ে নাগরিকেরা যত অভিমত তুলে ধরেছেন, তা বিস্তৃত আলোচনার দাবি রাখে। তবে যানবাহনের জ্বালানি হিসেবে সিলিন্ডার গ্যাসের ব্যবহার ও বর্তমান বাস্তবতা আমাদের কী পরিমাণ ঝুঁকিতে রাখে, তা নিয়ে কিছু মন্তব্য নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। অনেকের অভিমত, গাড়িতে ব্যবহৃত গ্যাসভর্তি সিলিন্ডারগুলো একেকটি চলন্ত বোমা।

দেশের এই চলন্ত বোমা (মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা ব্যবহার অনুপযোগী) নিয়ে কতসংখ্যক যানবাহন নিত্যদিন চলছে তার হিসাব আমাদের জানা নেই। সড়কে গাড়ির কাগজপত্রের বৈধতা দেখতে যেভাবে হঠাৎ দাঁড় করিয়ে অনুসন্ধান চালানো হয়, ঠিক তেমনি করে সিলিন্ডারের উপযোগিতা দেখার জন্য কোনো কর্তৃপক্ষের এমন তদারকি চোখে পড়ে না।

কিন্তু বিষয়টি কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলবেন। তবে আমরা স্বল্পজ্ঞানে এইটুকু বুঝতে পারি, এই জায়গাটিতে যথেষ্ট উদাসীনতা বিরাজমান এবং আমরা এও শুনি, তদারকি কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করে ছাড়পত্র নিতে অসুবিধা হয় না। তার মানে সুশাসনের অভাব দুর্ঘটনা রোধের প্রতিটি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের বিরুদ্ধেই করা যাবে।

আমরা জানি না, সড়কে নাগরিকদের মৃত্যুর এই মিছিল থামাতে রাষ্ট্র আদৌ কঠোর কোনো পদক্ষেপ নেবে কি না কিংবা ‘কঠোরতর’ পদক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কার্যকারিতার মুখ দেখবে কি না! তবে আপাতদৃষ্টিতে তার কোনো সুলক্ষণ চোখে পড়ছে না বিধায় আমাদের দীর্ঘশ্বাস হয়ত আরও দীর্ঘায়িতই হবে।

একইভাবে বলা যায়, অগ্নি দুর্ঘটনায় মৃত্যুর যে পরিসংখ্যান গেল এক দশকেই আমরা জানতে পারছি, তাতে শিউরে না ওঠার কোনো উপায় নেই। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের তোড়জোড়ে অগণন মানুষের প্রাণহানি ইতিহাসে লেখা হবে না।

সংশ্লিষ্টদের হেলায় বহু প্রাণ ঝরে যাওয়ায় দায়ীদের দায়মুক্তি দিয়ে রাষ্ট্র হয়ত ক্ষমতাবানদেরই পাশে থাকবে। আর ‘জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস’ টাইপের কিছু বচন আওড়ে রাজনীতির সরেস মানুষেরা ক্ষমতার মসনদে পালাবদল করবেন!

;

‘মুক্তিযুদ্ধ’র সমাপ্তি টানতে যে কাজ আজও বাকী



অঞ্জনা দত্ত
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

এই বছরের মার্চের ২৫ তারিখে কাকতালীয় ভাবে মিলে গেল দোল পূর্ণিমা। সনাতন ধর্মাবলম্বীরা সাধারণত দোলের দিনে রঙের খেলায় মেতে উঠেন । বোলপুরের শান্তিনিকেতন এই দিনে রঙে রঙে রঙিন হয়ে উঠে। তবে এখন দোল পূর্ণিমার কথা হবে না। শুধু মনে করিয়ে দিতে এসেছি ১৯৭১ সালের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাত দশটা থেকে ঢাকার রাস্তায় ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নেমেছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে৷ সেই রাতে বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলেছিল বাংলাদেশের যেসব বড়ো বড়ো শহরে ক্যান্টনমেন্ট ছিল, সেইসব শহরে ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তানি রক্তপিপাসু সৈন্যরা। সেই বড়ো দুঃখের দিনের কিছু কথা বলতে এসেছি।

যতদিন বাঙালি জাতি স্মৃতিশক্তি হারাবে না, বিশেষ করে যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, যেসব পরিবার স্বজন হারিয়েছেন, যেসব পরিবার থেকে তাঁদের মা-বোনদের এই হায়েনারা ধরে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতন করেছিল... হত্যা করেছিল সেইসব পরিবার কোনোদিন ২৫ মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত একটা দিনকেও ভুলতে পারবেন না। এইসব পরিবারের সদস্যরা ধুঁকে ধুঁকে বেঁচেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। এঁদের সাথে যুক্ত করুন এক কোটি শরণার্থীদের যাঁরা বাধ্য হয়েছিল দেশ ত্যাগ করতে এবং দেশের ভিতরেও কোটি কোটি মানুষ নিজ বাড়িতে থাকতে না পেরে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁরা যতদিন বেঁচে থাকবেন ততদিন এই মানসিক যন্ত্রণা থেকে বের হতে পারবেন।

পাকিস্তানিরা এই দেশের মুসলমানদের সাচ্চা মুসলমান ভাবত না। তারা এঁদের ভারতের দালাল ভাবত। ওরা আমাদের দেশের মুসলমানদের নিকৃষ্ট ভাবত, আরও একটি কারণে যে তাদের দৃষ্টিতে বাঙালি মুসলিমরা হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হয়েছে। তাই তাদের এতটুকু কষ্ট হয়নি, খারাপ লাগেনি, পরকালের ভয় হয়নি পাখির মতো গুলি করে মারতে আমাদের ভাইদের, বাবাদের, আমাদের সন্তানদের। এক চুকনগরে কয়েকঘন্টায় দশ সহস্রাধিক বাঙালিকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করেছে এই জালিমরা।

তখন বিশ্বজুড়ে চলছিল সমাজতান্ত্রিক এবং ধনতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মধ্যে ঠান্ডা লড়াই। তাই তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের পাশে দাঁড়ালো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন না থাকলে ভারত এতবড়ো ঝুঁকি নিত কি না সন্দেহ আছে। কেননা ঠিক ঐ সময়ে আমেরিকা এবং চীনের মধ্যে সম্পর্ক পাতানোর কাজে দূতিয়ালি করছিল পাকিস্তান। চীন ছিল পাকিস্তানের মিত্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্কও ভালো ছিল। যদিও সাধারণ মার্কিন জনগণ এই জেনোসাইডের বিরুদ্ধাচরণ করেছিলেন। তাঁদের ছিল ভিয়েতনামের যুদ্ধের নির্মম অভিজ্ঞতা।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখন ভিয়েতনাম থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছিল। মার্কিন প্রশাসনের কাজ ছিল তখন কোনো দেশের জনগণ শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তি আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লে তাঁদের টুঁটি চেপে ধরত। না জানি এখানে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে যায়! বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও মার্কিন সরকারের এই ভয় ছিল। পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বাঙালি মুসলমানদের স্বপ্ন ভঙ্গ হতে শুরু করেছিল। ১৯৪৭ সালের অল্প কিছু সময়ের পর থেকেই বাঙালিরা নানারকম অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল। তার প্রথম রক্তঝরা আন্দোলন শুরু হয় ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠা করার মধ্যে দিয়ে। '৫২ এর হাত ধরেই আসে একাত্তর।

গভীর শ্রদ্ধা জানাই ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে যেসব নীরিহ বাঙালি প্রাণ দিয়েছিলেন। সংসদ নির্বাচনে বাঙালিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করার পরেও পাকিস্তানি জেনারেলরা বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে তার বাহিনীকে লেলিয়ে দিয়েছিল বাঙালির রক্ত নিয়ে হোলি খেলতে। স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরেও আমরা জাতিসংঘ থেকে জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায় করতে পারিনি। আরও ৫৩ বৎসর অপেক্ষা করতে হবে? অনেকেই আর্মেনিয়ার উদাহরণ দেখায় ওদের ওপর করা অটোমান সাম্রাজ্যের জেনোসাইডের স্বীকৃতি পেতে, তাও আংশিক, ১০০ বছর লেগেছিল। তাহলে কি আমাদের সেদিকে ঠেলে দিচ্ছে?

আপনারা সোচ্চার হন জাতিসংঘ কর্তৃক আমাদের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ে। আমাদের মা-বোনদের ওপর যে নির্মম অত্যাচার করেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, আমাদের ত্রিশ লক্ষ শহিদের হত্যা করেছিল, তাঁদের কাছে আমরা দায়বদ্ধ। ওঁরা আমাদের একটা স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন। আর আমাদের কর্তব্য হলো যারা একাজ করেছিল তাদের বিচার করা। আর সেটি সম্ভব হবে যখন আমরা জেনোসাইডের স্বীকৃতি পাবো। তাই আসুন আজ থেকে গণহত্যা না বলে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে যা কিছু সংঘটিত করেছে পাকিস্তানি হানাদার সেনাবাহিনী, একে আমরা বলব জেনোসাইড। আর একটি কথা আপনাদের সন্তানদের, আপনাদের বংশধরদের বলে যান-কী ঘটেছিল ১৯৭১ সালে এই দেশে। কেননা জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের যুদ্ধে ওদের অংশগ্রহণের প্রয়োজন হবে। সেদিন হবে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সমাপ্তি। জয় বাংলা। জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক

;

স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা বাঙালি জাতির ইতিহাসে এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রামের এক অম্লান মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত। এটি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের অত্যাচারী শাসনের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কয়েক দশকের নিপীড়ন, প্রান্তিকতা এবং শোষণের চূড়ান্ত পরিণতি।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাকে বুঝতে হলে প্রথমেই এর জটিল ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বোঝা আবশ্যক। প্রায় দুইশত বছরের ব্রিটিশ শাসনের পর ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র গঠিত হয় এবং পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। একমাত্র ধর্মীয় পরিচয় ছাড়া পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে আর কোনো বিষয়ে মিল ছিলনা। যাই হোক, পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি এর দুই অংশের মধ্যে ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে ব্যর্থ হয়, যার ফলে বাঙালি জনগণের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ জন্ম নেয় ও অসন্তোষ দেখা দেয়।

শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে প্রান্তিকতার দিকে ঠেলে দেয় ও শোষণ ব্যবস্থা কায়েম করে। তাদের সঙ্গে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে আচরণ করে এবং তাদের সম্পদ ও প্রতিনিধিত্বের ন্যায্য অংশ অস্বীকার করে। একমাত্র সরকারি ভাষা হিসেবে উর্দুকে আরোপ করা বাংলাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে আরও বিচ্ছিন্ন করে এবং ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক অধিকারের দাবিতে ক্ষোভ ও বিক্ষোভের জন্ম দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও মোহভঙ্গের মধ্যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জনগণের অবিসংবাদিত নেতা ও কণ্ঠস্বর হিসেবে আবির্ভূত হন। গণতন্ত্র, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং ভাষাগত অধিকারের নীতির প্রতি তার অটল অঙ্গীকার বাঙালি জনগণের আকাঙ্ক্ষার সাথে গভীরভাবে অনুরণিত হয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তাঁকে "বঙ্গবন্ধু" উপাধিতে ভূষিত করেছিল।

১৯৬০ এর দশক জুড়ে, বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের অধিকার ও মর্যাদার জন্য নিরলস সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, একটি ফেডারেল ব্যবস্থার কাঠামোর মধ্যে বৃহত্তর স্বায়ত্তশাসন এবং প্রতিনিধিত্বের পক্ষে ছিলেন। যাই হোক, সামরিক ও স্বার্থান্বেষী পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারগুলো বাঙালি জনগণের ন্যায্য দাবির প্রতি উপেক্ষা দেখায় যা তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা ও ক্ষোভের অনুভূতি তীব্রতর করে।

পশ্চিম পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে রাজনৈতিক আলোচনা ও সংলাপে জড়িত থাকার জন্য বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকরা বাঙালি জনগণের দাবি মেনে নিতে অনড় এবং অনিচ্ছুক ছিলেন। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি, সম্পদের বৈষম্যমূলক বণ্টন এবং সামরিক শক্তির মাধ্যমে ভিন্নমতকে দমন করা বাঙালি জনগোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা বাড়াতে এবং অন্যায়ের বোধকে গভীরতর করে।

১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে টার্নিং পয়েন্ট আসে যখন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিপুল বিজয় লাভ করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ আওয়ামী লীগকে যে অপ্রতিরোধ্য ম্যান্ডেট দিয়েছিল তা ছিল স্বায়ত্তশাসন ও স্বশাসনের জন্য একটি সুস্পষ্ট ম্যান্ডেট, যেখানে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন।

পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী, বাঙালি নেতৃত্বের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে নারাজ ছিলেন এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করার জন্য বিলম্বিত কৌশল ও অপকৌশল অবলম্বন করে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এবং ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকৃতি জানানোর ফলে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক অসন্তোষ ও বিক্ষোভ দেখা দেয়।

পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক ক্রমবর্ধমান দমন-পীড়ন ও সহিংসতার মুখে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বাঙালি জনগণের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষার জন্য সিদ্ধান্তমূলক অবস্থান নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণ দিয়ে জনগণকে ঐক্য, প্রতিরোধ ও স্বাধীনতার সংগ্রামের আহ্বান জানান।

১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালো রাতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দমন করতে এবং ভিন্নমতের যে কোনো চিহ্নকে চূর্ণ করার জন্য অপারেশন সার্চলাইট নামে একটি নৃশংস গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক সংঘটিত নির্বিচার হত্যা, ধর্ষণ এবং নৃশংসতা পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ ও আতঙ্কের পথ রেখে যায়, যা বঙ্গবন্ধুকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দেয়।

১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন। তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণা, প্রতিরোধ ও প্রতিবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং মুক্তির শিখা জ্বালিয়েছিল যা শেষ পর্যন্ত একটি নতুন জাতির জন্মের দিকে পরিচালিত করে।

বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা নিছক প্রতীকী বিষয় ছিল না। এটি ছিল অত্যাচার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের একটি সাহসী সিদ্ধান্ত। এটি নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করেছিল, যে সময়ে বাংলাদেশের জনগণ, মুক্তিবাহিনীর (মুক্তিযোদ্ধা) নেতৃত্বে, ভারতীয় যৌথ বাহিনীর সহায়তায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম পরিচালনা করে বিজয় ছিনিয়ে আনে এবং ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উত্তরাধিকার এবং তার স্বাধীনতার ঘোষণা স্বাধীনতা, গণতন্ত্র এবং জাতীয় ঐক্যের মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে বাংলাদেশীদের ধারাবাহিকভাবে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন আজও ততটাই প্রাসঙ্গিক রয়ে গেছে যেমনটা ১৯৭১ সালের উত্তাল দিনগুলোতে ছিল।

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ছিল বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি অমর ঘটনা। এই ঘোষণা ছিল বাঙালিদের অধিকার, মর্যাদা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষার এক সাহসী প্রকাশ। এই ঘোষণার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শুধুমাত্র একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্মই দেননি, বরং একটি নতুন জাতির ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।

এই ঘোষণা বাঙালিদেরকে একত্রিত করেছিল এবং তাদেরকে তাদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে নিতে অনুপ্রাণিত করেছিল। এই ঘোষণা ছিল একটি নতুন সূচনার প্রতীক, একটি নতুন যুগের সূচনা, যেখানে বাঙালিরা তাদের পূর্ণ সম্ভাবনায় পৌঁছাতে পারবে।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে, আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয় যে আমরা কী অর্জন করেছি এবং আমাদের কী অর্জন করতে হবে। এই ঘোষণা আমাদেরকে ঐক্যবদ্ধ থাকার এবং আমাদের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা সকলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার আহ্বান জানায়।

২৬ শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী মুহূর্ত। এটি একটি স্মরণীয় দিন যা আমরা চিরকাল গর্বের সাথে উদযাপন করব। কয়েক দশকের নিপীড়ন ও শোষণের অন্ধকারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার অটল সংকল্প, নিরলস নেতৃত্ব, অসীম ত্যাগ ও দীর্ঘ সংগ্রাম মুক্তির সূচনা করে জন্ম দিয়েছিল এক নতুন জাতির।

ন্যায়বিচার, সাম্য ও গণতন্ত্রের মূলনীতিতে বিশ্বাসী বঙ্গবন্ধু স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তার আদর্শের আলোয় আজও বাংলাদেশ তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে।

লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

;