বিএনপির ডিফিকাল্ট থেকে ক্রিটিকাল রাজনীতি



মো. জাকির হোসেন
মো. জাকির হোসেন, ছবি: বার্তা২৪

মো. জাকির হোসেন, ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

বিএনপির পাঁচ সংসদ সদস্যের (এমপি) শপথ গ্রহণকে কেন্দ্র করে দেশ-বিদেশে তোলপাড় করা আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। কেউ কেউ তো রীতিমতো টাসকি খেয়েছেন। এটা কী হলো? গত বছরের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের পর চার মাস ধরে সংসদে না যাওয়ার ব্যাপারে দলটির কট্টর অবস্থান ছিল। সংসদে না যাওয়ার শক্ত অবস্থান ধরে রাখতে এমনকি উপজেলা নির্বাচনও বর্জন করল। ঠাকুরগাঁও থেকে নির্বাচিত বিএনপির সংসদ সদস্য জাহিদুর রহমান শপথ নেওয়ায় তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলো। কী এমন ঘটলো যে চার সংসদ সদস্যের শপথ নিতে তড়িঘড়ি করে বিএনপি তার অবস্থান অনেকটা ডিগবাজির মতো পাল্টাতে বাধ্য হলো?

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘আমরা অতীতে বলেছিলাম যে, আমরা সংসদে যাব না, ওই মুহূর্তে আমাদের সেই সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল না। এটা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই।’ সংসদে যাওয়ার পক্ষে রাতারাতি নতুন যুক্তির আড়ালে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে বিএনপি। কিন্তু কেন? উত্তরটা মোটেও কঠিন নয়।

শপথের পক্ষে সিদ্ধান্ত নেওয়া না হলে দলে সংকট আরও ভয়াবহ হতো। বিএনপির ভাঙন না ধরলেও বিভেদ ঠেকানো দুরূহ হতো। বর্তমান নেতৃত্বের প্রতি দলটির নেতাদের একাংশের আস্থাহীনতার প্রকাশ দৃশ্যমান হতো। সম্প্রতি বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ এক সাক্ষাৎকারে বিষয়টি রাখঢাক না করেই বলেছেন, ‘বিএনপি ভেঙে যাচ্ছিল। ভেঙে যাওয়াটা ঠেকানো হয়েছে। যতদূর জানি, তারেক রহমান দলের ভাঙন রোধ করতে পেরেছেন। দল ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা হয়তো থাকে, আছে। এই মুহূর্তে তা তিনি বন্ধ করতে পেরেছেন।’ শপথের আগে কয়েকদিন ধরে বিএনপি থেকে নির্বাচিতদের কথা-বার্তায় এটা স্পষ্টই প্রকাশ পাচ্ছিল যে, মির্জা ফখরুল বাদে বিএনপির অন্য সংসদ সদস্যরা সংসদে যেতে এক পায়ে খাড়া ছিল। দল শপথের পক্ষে সিদ্ধান্ত না নিলেও চারজন শপথ নিতেনই। এটা প্রকাশ্যেই চলে এসেছিল।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর থেকে নির্বাচিত এমপি এবং বিএনপির অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব হারুন অর রশীদ বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, ব্যক্তিগতভাবে তিনি মনে করেছেন তার সংসদে যাওয়া উচিত। জাহিদুর রহমান ২৫ এপ্রিল শপথ নেওয়ার পর তাঁর বিরুদ্ধে স্থানীয় পর্যায়ে বড় কোনো প্রতিরোধ দেখা না যাওয়ায় ও কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় কর্মীদের ক্ষোভ সেভাবে দৃশ্যমান না হওয়ায় অন্য চার সংসদ সদস্যও শপথ নিতে সাহসী হয়ে ওঠেন। তাদের বিশ্বাস ছিল- শপথ নিলে বিএনপির মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা যাবে না। বিএনপি থেকে বলা হচ্ছে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশেই বিএনপির সংসদ সদস্যরা শপথ নিয়েছেন। আর দলীয় সিদ্ধান্তেই মহাসচিব শপথ নেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। এটা বিএনপির রাজনৈতিক কৌশলেরই অংশ বলে প্রচার করা হচ্ছে। এটি কৌশল না অপকৌশল তা সময়ই বলে দিবে। তবে ‘ডাল ম্যা কুছ কালা হ্যায়’ এটি ঠাহর করতে খুব বেগ পেতে হয় না। বিএনপির আকস্মিক সংসদে যোগ দেওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক মহলে সরকারের সঙ্গে বিএনপির সমঝোতা হিসেবে কেউ কেউ বিবেচনা করছেন। যারা এটিকে সমঝোতা হিসেবে বিচেনা করছেন তাদের যুক্তি হলো, ক্ষমতাসীনরা হয়তো চাচ্ছে নির্বিঘ্নে সরকার পরিচালনা করতে, আর বিএনপি চাচ্ছে বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি এবং মামলা-হুলিয়া-জেল-জুলুম থেকে নিষ্কৃতি পেয়ে সীমিত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে।

আমার ব্যক্তিগত ধারণা এ ধরনের ফর্মুলা হয়তো একেবারেই কল্পনাপ্রসূত। এই তো সেদিনও চক্ষু অপারেশনের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লন্ডনে গেলে সেখানে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা তাঁর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে। সমঝোতার অংশ হিসেবে হোক, আর দলের ভাঙনরোধ করার জন্যই হোক, বিএনপির এমপিদের একাংশের আকস্মিক সংসদে যোগদান দল ও বিএনপির রাজনীতিতে টালমাটাল অবস্থার ইঙ্গিত দেয়। বিএনপি গঠিত হওয়ার পর চার দশক অতিবাহিত হয়েছে। এ চার দশকে ৪৭ বছর বয়সী বাংলাদেশে তিন দফায় ১৬ বছর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি। কিন্তু এ দীর্ঘ সময়েও বিএনপি রাজনৈতিক সাবালকত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়নি। কেন সক্ষম হয়নি এর কারণ খুঁজতে আমাদের পেছন ফিরে দেখতে হবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতার মসনদে আরোহন করেই জিয়াউর রহমান অনুভব করলেন নিজের রাজনৈতিক একটি দল না থাকলে ক্ষমতা স্থায়ীও হবে না, নিজের মতো করে চালানোও যাবে না। তাই বিলম্ব নয়, রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে। সামরিক জান্তা ক্ষমতা দখল করে যেভাবে দল গঠন করে, বিএনপির জন্ম কাহিনীও তা থেকে ভিন্ন নয়। ১৯৭৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ‘জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দল’ বা ‘জাগদল’ নামে একটি রাজনৈতিক দল তৈরি করা হয়। জাগদল রাজনীতিতে তেমন ঢেউ তুলতে পারেনি। এরপর আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করার লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের ১ মে জিয়াকে চেয়ারম্যান করে 'জাতীয়তাবাদী ফ্রন্ট' ঘোষণা করা হয়। এটি ছিল বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গ্রুপের একটা প্লাটফর্ম।

তাদের একতার একটাই ভিত্তি ছিল, তারা সবাই ছিলেন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে এককাট্টা। নানা মত ও পথের এ ফ্রন্ট নিয়ে জিয়াউর রহমান স্বস্তিতে ছিলেন না। তিনি ‘একমনা’ লোকদের নিয়ে আলাদা দল তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। তানভীর আহমেদ সিদ্দিকী দলের নাম ‘জাস্টিস পার্টি’ রাখার প্রস্তাব করেন। কিন্তু এটি গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় ও দলের নামের সাথে জাতীয়তাবাদী থাকাটা আবশ্যিক হওয়ায় শেষমেশ দলের নামকরণ করা হয় ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল’। ১৯৭৮ সালের ২৮ আগষ্ট ‘জাগদল’ বিলুপ্তির ঘোষণা করা হয় ও ১ সেপ্টেম্বর ঢাকার রমনা রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে জিয়াউর রহমান বিএনপির প্রধান হিসেবে দলের নাম, গঠনতন্ত্র ও কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। রাজনীতিতে এসেই জিয়া ঘোষণা দিলেন, ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর পলিটিশিয়িানস’। যেই কথা, সেই কাজ। বিভিন্ন দলের লোভী দলছুট নেতাদের নানা সুযোগ-সুবিধা ও পদ-পদবির লোভ দেখিয়ে ভাগিয়ে এনে নতুন দলে স্থান করে দিলেন। চূড়ান্ত ডানের পাশাপাশি চূড়ান্ত বামদের মিলন হলো। ফলে নানা মতাদর্শের মানুষ মিলে এক হরিচ্ছত্রের মেলা হয়ে উঠল বিএনপি। আর রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে ওঠা হলো সুদূরপরাহত।

সময়ের বিবর্তনে বিএনপির ডিফিকাল্ট (কঠিন) রাজনীতি আজ বিএনপির নিজের জন্যই ক্রিটিকাল (সংকটপূর্ণ) রূপধারণ করেছে। শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে পারস্পারিক আস্থাহীনতা ও অবিশ্বাস প্রবল হয়েছে। ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনকে ‘রাতের ভোট’ বলে গলা ফাটালেও নির্বাচন প্রতিরোধ করতে কিংবা নির্বাচন পরবর্তী কোনো আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তুলতে বিএনপির ভিতর কোনো তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়নি। বরং নির্বাচনকে ঘিরে মনোনয়ণ বণিজ্যসহ নানা অভ্যন্তরীণ কোন্দল বাইরে এসেছে। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কিংবা সরকারের ব্যর্থতা কোনো ক্ষেত্রেই ন্যূনতম আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারা, আন্দোলনের ডাক দিয়েও নেতাদের মাঠে না নামা, সকাল-বিকাল বিদেশি কূটনীতিকদের দ্বারস্থ হয়েও আশানুরূপ সাড়া না পাওয়া, বিএনপির রাজনীতির ক্রিটিকাল অবস্থারই জানান দেয়।

বিএনপির রাজনৈতিক এ দেউলিয়াত্ব একদিনে সৃষ্টি হয়নি। অনেকগুলো ভুলের সমষ্টি দল ও রাজনীতিতে বিএনপির জন্য এমন ক্রিটিকাল অবস্থা সৃষ্টি করেছে। অতি পাকিস্তান প্রীতি, কট্ট্রর ভারতবিরোধীতা, স্বাধীনতাবিরোধীদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধা, বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার-অপমান করা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে সহিংসতার পথ বেছে নেয়া, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া, জঙ্গিবাদকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে আড়াল করতে বিকৃত ইতিহাস রচনা করা, নির্বাচনে অংশ না নিয়ে অরাজকতার মাধ্যমে সরকার হঠানোর পরিকল্পনা, দল ও সরকার পরিচালনার মধ্যে ক্ষমতার একাধিক কেন্দ্র তৈরি করা ইত্যাদি বড় ‍ভুলগুলোর মধ্যে অন্যতম। কিছু ভুল তো একেবারে নিজের গলায় ছুরি চালানোর মতো।

উদাহরণস্বরুপ, বিএনপি মুজিবনগর সরকারকে স্বীকার করে না। জিয়া মুজিবনগর সরকারের অধীন একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। মুজিবনগর সরকারকে অস্বীকার করলে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়া মুক্তিযোদ্ধা থাকেন কীভাবে? অন্যদিকে, মুজিবনগর সরকারকে স্বীকার করলে জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করা অবৈধ, অসাংবিধানিক। কেননা ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল প্রণীত মুজিবনগর সরকারের অন্তবর্তীকালীন সংবিধান স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অইনানুগ ও সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে, অন্য কারও ঘোষণা বা ঘোষণাপাঠ অনুমোদিত হয়নি। ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা বিষয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে বর্ণিত আছে- ‘যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনাকালে ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন; এবং যেহেতু উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানান;’।

উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণাকে অন্তবর্তীকালীন সংবিধান নিম্নরুপে অনুমোদন করেছে - ‘সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়েছেন সে ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা, নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র ঘোষণা করছি;এবং এর দ্বারা পূর্বাহ্ণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করছি;’।

ছোট ভুলের ছোট মাশুল, বড় ভুলের বড়। শুধু আওয়ামী বিরোধীতা একটি রাজনৈতিক দলের ভিশন ও মিশন হলে রাজনীতি পথচ্যুত হতে বাধ্য। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে মানুষকে বোকা বানানোর দিন শেষ। বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে হলে মুক্তিযুদ্ধের সত্যিটা ধারণ করতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে অস্বীকার করার অর্থ মুক্তিযুদ্ধ তথা বাংলাদেশকে অস্বীকার করা।

সংবিধান-ইতিহাসকে অস্বীকার করে জিয়াকে কৃত্রিমভাবে স্বাধীনতার ঘোষক বানিয়ে বঙ্গবন্ধুর কাতারে দাঁড় করানোর চেষ্টা বিএনপির রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ও অপরিপক্কতারই প্রমাণ। বিএনপির বর্তমান ক্রিটিকাল অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়াতে হলে খালেদা জিয়া-কে হাল ধরতে হবে। তার জন্য দরকার খালেদা জিয়ার মুক্তি। আইনি যুদ্ধ করে মামলা থেকে মুক্তি দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ। এ অবস্থায় খালেদা জিয়ার মুক্তির দু’টি পথ খোলা আছে – এক. অপরাধ স্বীকার করে রাষ্ট্রপতি বরাবরে ক্ষমা প্রার্থনা করা এবং খালেদা জিয়ার আবেদনে সাড়া দিয়ে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক ক্ষমা ঘোষণা করা। এটি খালেদা জিয়া করবেন না বলেই প্রতীয়মান হয়। দুই. খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তিলাভ। খালেদা জিয়ার জামিনে মুক্তিলাভের বিষয়ে সরকারের অবস্থান অনমনীয় বলেই মনে হচ্ছে। জামিনের বিরোধীতা থেকে সরকার আপাতত সরে আসবেন বলে মনে হয় না। আমার বিশ্বাস মুক্তিযুদ্ধের সত্যিটাকে মেনে নিয়ে বিএনপি বঙ্গবন্ধুকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিলে, জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করা থেকে সরে আসলে ও ১৫ আগস্টকে শোক দিবস হিসেবে গ্রহন করলেই খালেদা জিয়ার জামিনলাভের ক্ষেত্রে নাটকীয় অগ্রগতি হবে। সরকার জামিনের বিরোধীতায় কট্টর অবস্থান থেকে নমনীয় হবেন বলে আশা করা যায়। বিএনপিকে ভুলগুলো চিহ্নিত করে দ্রুত সংশোধনের দিকে নজর দিতে হবে। নইলে লঞ্চ ও পঞ্চ দু’টোই হারাতে হতে পারে।

মো. জাকির হোসেন: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

   

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়



তোফায়েল আহমেদ
মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতি বছর জাতীয় জীবনে ‘মুজিবনগর দিবস’ ফিরে আসে এবং এবছর ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের ৫৩তম বার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ১৭৫৭-এর ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের আম্রকাননে স্বাধীনতার সেই সূর্য উদিত হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের স্মৃতিকথা লিখতে বসে কতো কথা আমার মানসপটে ভাসছে। পঁচিশে মার্চ  দিনটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। এদিন মণি ভাই এবং আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে বিদায় নেই। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘ভালো থেকো। আমার দেশ স্বাধীন হবেই। তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন করো।’

পঁচিশে মার্চ রাতে আমরা ছিলাম মতিঝিলের আরামবাগে মণি ভাইয়ের বাসভবনে। রাত বারোটায় অর্থাৎ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি নিধনে গণহত্যা শুরু করে। চারদিকে প্রচ- গোলাগুলি। এক রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী লক্ষাধিক লোককে হত্যা করে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ছাব্বিশে মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনি। ভাষণে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আরো আগেই গ্রেফতার করা উচিত ছিল, আমি ভুল করেছি।’ ‘দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিস্ড।’ তারপর কারফিউ জারি হয় এবং ছাব্বিশে মার্চেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’র কথা বারবার প্রচার করে বলছেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করে বলেছেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে’।”

এরপর দুই ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আমরা কেরানিগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেব; মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি সহ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী সাহেব এবং কামারুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে ভারতের দিকে যাবো। আমাদের এই যাত্রাপথ আগেই ঠিক করা ছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থেকে নির্বাচিত এমসিএ (গবসনবৎ ড়ভ ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু) ডাক্তার আবু হেনাকে বঙ্গবন্ধু যে পথে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন, সেই পথেই আবু হেনা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য আগেই বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে ভুট্টো যখন টাল-বাহানা শুরু করে তখন ’৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাসভবনে জাতির জনক জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের এই ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এখানে  তোমরা থাকবে। তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।’ ২৯ মার্চ কেরানিগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে এপ্রিলের ৪ এপ্রিল আমরা ভারতের মাটি স্পর্শ করি এবং সানি ভিলায় আশ্রয় নেই। এখানে আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন-পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী-জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।

১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ তথা ‘চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরো যা ঘোষিত হয় তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।’ রাষ্ট্রপতি শাসিত এই ব্যবস্থায় ‘ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা’, ‘একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজন মনে করিলে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের’ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হস্তে ন্যস্ত করার বিধান রাখা হয়। এছাড়াও যেহেতু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, সেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই মর্মে বিধান রাখা হয় যে, ‘কোন কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করিতে না পারেন অথবা তাহার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।’ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক জাতীয় নেতা উপ-রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী. জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ সদস্যগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম, ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ছাব্বিশে মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন সেই দিন থেকে কার্যকর হবে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ১০ এপ্রিল ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে।

সে-সময় তাজউদ্দীন ভাইয়ের সাথে সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। একটি বিশেষ প্লেনে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মণি ভাই এবং আমি যখন শিলিগুঁড়ি পৌঁছাই, তখন সেখানে পূর্বাহ্নে ধারণকৃত তাজউদ্দীন ভাইয়ের বেতার ভাষণ শুনলাম। বাংলার মানুষ তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপোষহীন, এককাতারে দ-ায়মান। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল যেদিন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়, তার আগে ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে-মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি-আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, একটা গাড়িতে করে রাত তিনটায় নবগঠিত সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে কলকাতা থেকে রওয়ানা করি সীমান্ত সন্নিহিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরের উদ্দেশে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রবেশ করি প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের আ¤্রকাননে। আমাদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিক ছিলেন। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে বোমা হামলা চালাতে পারে। মেহেরপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস তখন মুখরিত। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিস্ময়ের সাথে প্রত্যক্ষ করছিল নবীন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব। দিনটি ছিল শনিবার। সকাল ১১টা ১০ মিনিটে পশ্চিম দিক থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলেন। দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা আমাদের সাথে সমস্বরে গগনবিদারী কণ্ঠে মুহুর্মুহু ‘জয়বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুললো। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠান স্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহন করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রীপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকগণ পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেতৃবৃন্দকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকম-লীর সভাপতি আবদুল মান্নান, এমসিএ’র উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে মুক্তির বাণীসমূহ পাঠ করা হয়।

আকাশে তখন থোকা থোকা মেঘ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে বাংলা মায়ের চারজন বীরসন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। উপস্থিত সকলেই তাদের সাথে কণ্ঠ মিলালাম। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজিতে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তাঁর পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’ এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ সদস্যবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতার শেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড়ো জাতির বন্ধুত্ব।’ ‘বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশী দাবীদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর সংগ্রাম করেনি। জয়বাংলা।’ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল তা-ই তাঁরা বলেছেন। আমাদের শীর্ষ দুই নেতার এই দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য। জাতীয় নেতৃবৃন্দ, নির্বাচিত এমসিএ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকগণ, পাবনার জেলা প্রশাসক জনাব নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক জনাব তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীসহ আরো অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রেখে, সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়েছিল। আর এসব কিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ’৭১-এর এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় সাংবিধানিক বৈধতা নিশ্চিত করে সমগ্র বিশ্বের সমর্থন নিয়ে জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে শপথের সময় আমরা সমস্বরে বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ আমরা জানি না। কিন্তু যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি এবং তোমাকে মুক্ত করতে না পারবো, ততদিন আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে বাঙালির চেতনায় বন্দী মুজিব মুক্ত মুজিবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিলেন। যারা ষড়যন্ত্রকারী তাদের হোতা খুনি মুশতাক তখনই আমাদের কাছে প্রশ্ন তুলেছিল, ‘জীবিত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও।’ আমরা বলতাম, ‘আমরা দু’টোই চাই। স্বাধীনতাও চাই, বঙ্গবন্ধুকেও চাই।’ ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর দু’ লক্ষ মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম।

প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের এই মহান দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের অমর স্মৃতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। জাতীয় চার নেতা জীবনে-মরণে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থেকেছেন, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, কিন্তু বেঈমানী করেননি। ইতিহাসের পাতায় তাঁদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তাঁরা যে আত্মদান করেছেন সেই আত্মদানের ফসল আজকের এই স্বাধীন ওসার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে জাতীয় নেতৃবৃন্দের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা সর্বত্র স্মরণ করা উচিত। জাতীয় ইতিহাসের গৌরবময় দিনগুলো যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধিই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।

;

মুক্তিপণের প্রতিষ্ঠা বনাম দায়িত্বশীলতা



কবির য়াহমদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটর, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

১৪৩১ বঙ্গাব্দ শুরু হয়েছে সুখবর দিয়ে। বাংলা বর্ষের প্রথম সকালে দেশবাসী জেনেছে সাগরে জিম্মি ২৩ বাংলাদেশি নাবিক মুক্ত হয়েছেন। তাদেরকে রেখে সরে যেতে হয়েছে সোমালিয়ান জলদস্যুদের। বাংলাদেশিরা এখন সাগরপথে আরব আমিরাত অভিমুখে এবং সেখান থেকে উড়োজাহাজে করে ফিরবেন দেশে।

এই ২৩ বাংলাদেশি নাগরিকের মুক্তিতে একটা বড় ফাঁড়া কাটল। বাঁচল মানুষের প্রাণ, বাঁচল দেশের ইজ্জত। কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, দূরদর্শিতার সব জয় হয়েছে। তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে বাংলাদেশ শক্তি প্রয়োগের পথে না গিয়ে মানুষের জীবনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে নিরাপদে ফিরিয়ে আনার পথ বেছে নিয়েছে। এখানে শুরু থেকেই আলোচনায় ছিল মুক্তিপণের। এই ঘটনার সুন্দর সমাধানের পর আদৌ কি মুক্তিপণের কিছু ঘটেছে, ঘটলে টাকার অঙ্কে সেটা কত এ নিয়ে আলোচনা চলছে, যদিও এই আলোচনাকে অবান্তর বলে মনে করছি। কারণ এখানে জাতীয় স্বার্থের প্রশ্ন নেই, নেই ইজ্জত বাড়ার মতো কিছু। আছে কেবল বিশাল এক শ্রেণির শ্রোতা-দর্শক-পাঠকের তুমুল আগ্রহ; তবে এই আগ্রহ জাতীয় স্বার্থ কিংবা অপরাপর ক্ষেত্রে অগুরুত্বপূর্ণই।

বাংলাদেশিদের মুক্তি প্রক্রিয়ায় যদি আক্রান্ত নাবিকদের পরিবার যদি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতো, তবে এটা নিয়ে আলোচনা হতো যৌক্তিক। এখানে যদি পাবলিক ফান্ডিংয়ের বিষয় জড়িত থাকত তবে সেটা নিয়েও আলোচনা জরুরি ছিল, কিন্তু এর কিছুই নেই এই প্রক্রিয়ায়। তাহলে কী কারণে এই আলোচনা, এত আলোচনা?

এটা সাধারণ বোধজ্ঞানের বিষয় যে, এইধরনের পরিবহন কিংবা যাত্রায় বীমা কোম্পানির বিবিধ অংশগ্রহণ থাকে। এখানেও এর ব্যতিক্রম থাকার কথা নয়। মুক্তিতে যদি বীমা কোম্পানির অংশগ্রহণ থাকে, তবে সেটার ব্যবসায়িক দিক তাদের। এই ব্যবসায়িক দিক নিয়ে মুখরোচক গল্প ফাঁদার প্রয়োজনীয়তা দেখি না।

২৩ বাংলাদেশি মুক্তিতে ৫০ লাখ ডলার ব্যয় করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। দুই জলদস্যুর বরাত দিয়ে রয়টার্সের সূত্রে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশের একাধিক গণমাধ্যম। রয়টার্সের প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, এক জলদস্যু তাদের জানিয়েছে, দু’দিন আগেই হাতে পৌঁছে মুক্তিপণের অর্থ। তারপর তারা সেগুলো নকল কিনা যাচাই করে দেখেছে। আসল মুদ্রা নিশ্চিত হওয়ার পর নিজেদের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছে। কিছু গণমাধ্যম জানিয়েছে, হেলিকপ্টার করে তিন বস্তা টাকা পানিতে ফেলা হয়। বিষয়টি অনেকটাই সিনেম্যাটিক। প্রতিবেদনে ভ্রম হয় সিনেমার দৃশ্যের বর্ণনা কিনা! অবশ্য সোমালিয়ান জলদস্যুদের নিয়ে একাধিক সিনেমা এরইমধ্যে তৈরি হয়েছে। হতে পারে সে সব সিনেমার কোন একটা দৃশ্যের সঙ্গে মিল রেখে এমনভাবে বলছেন কেউ কেউ। কারণ জাহাজের মালিকপক্ষ কেএসআরএম নিজ থেকে বলেনি তারা মুক্তিপণ পরিশোধ করেছে।

বাংলাদেশের নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী মুক্তিপণ পরিশোধের বিষয় অস্বীকার করেছেন। প্রতিমন্ত্রীর অবস্থান যৌক্তিক। তার অবস্থানে থেকে মুক্তিপণের বিষয় নিয়ে স্বীকার-অস্বীকার করা যায় না। তিনি বলেছেন, ‘জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে মুক্তিপণ দেয়ার বিষয়ে সরকারের কাছে কোনো তথ্য নেই।’

নাবিকদের মুক্তির পর রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুল করিম বলেছেন, ‘নাবিকদের মুক্ত করতে সোমালিয়া, কেনিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র- এই চার দেশের নিয়মকানুন মেনেই সমঝোতা হয়েছে। সবকিছুই বৈধভাবেই শেষ হয়েছে। তবে সমঝোতার শর্ত অনুযায়ী অনেক কিছু আমরা প্রকাশ করতে পারছি না।’ সমঝোতার সব শর্ত প্রকাশের কিছু নেই। এখানে এমন কিছু থাকতে পারে যা ভবিষ্যৎ বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলতে পারে। এটা নিয়ে টানাটানিও তাই অযৌক্তিক।

প্রতিমন্ত্রী বলেননি, কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ বলেনি তারা ৫০ লাখ ডলার মুক্তিপণ দিয়েছে। সুতরাং কথিত মুক্তিপণের এই অঙ্ক প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা থেকে সরে যাওয়া উচিত আমাদের। কারণ মুক্তিপণের বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত করা হলে সাগরপথে এইধরনের একটা অঙ্কের খরচ প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। গভীর সাগরে জলদস্যুদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়া এবং টাকা দিয়ে উদ্ধার পাওয়ার বিষয়টি নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়ে যাবে। ভবিষ্যতে এখানে কেউ নতুনভাবে সুযোগ নিতে চাইবে। এখান থেকে বেরুনো যাবে না।

উদাহরণ দিতে গেলে এখানে আসতে পারে, কয়েক বছর আগে একই কোম্পানির আরেকটি জাহাজ সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হয়েছিল। একশ দিন পর উদ্ধার হয়েছিল সে জাহাজ ও নাবিকেরা। তখনো নাকি এমন মুক্তিপণের বিষয় ছিল। এবারের জিম্মির ঘটনার পর আগের সেই ঘটনার অতি-আলোচনা হয়েছে, এবং সেই অতি-আলোচনা এখানে প্রভাবক হয়ে পড়েছিল কিনা সন্দেহ।

একজন প্রতিমন্ত্রী, একটা প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলরা বলতে পারেন না মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করে এনেছি জিম্মি বাংলাদেশিদের। যে অবস্থানে তারা সেটা দায়িত্বশীল অবস্থান, যে বক্তব্য তাদের সেটা প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বশীল বক্তব্য; সেটা যদি আমরা বুঝে থাকি, তারা মুক্তিপণের বিষয় যদি স্বীকার করতেন কী প্রভাব পড়তে পারে, সেটা যদি আমরা বুঝে থাকি তবে এও বুঝা উচিত মুক্তিপণকে প্রতিষ্ঠা করা অনুচিত। এর চেষ্টা করা অনাকাঙ্ক্ষিত। বিষয়টি নিয়ে অযথা টানাটানি না করে অন্যের কাছ থেকে আমরা যেমন দায়িত্বশীলতা প্রত্যাশা করি তেমনি নিজেই যেন সেটা অনুশীলনের চেষ্টা করি।

জিম্মি বাংলাদেশিদের ছেড়ে যাওয়ার পর আট জলদস্যু গ্রেফতার হয়েছে- ঠিক এই সংবাদে বুঝার চেষ্টা করুন ছেড়ে কথা বলেনি বাংলাদেশ। নিজেদের নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছিল। এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টার ফল জলদস্যুদের গ্রেপ্তার। জিম্মি বাংলাদেশিদের জীবন আর অন্যায়কে অন্যায় বলতে পারার বাংলাদেশের এই সফল প্রচেষ্টা অভিনন্দনযোগ্য।

জাহানমণি উদ্ধারে লেগেছিল ১০০ দিন; এমভি আব্দুল্লাহকে মুক্ত করতে লেগেছে মাত্র ৩২ দিন। মুক্ত বাংলাদেশিদের অভিনন্দন, ধন্যবাদ সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে।



;

জীবনে সুখী হওয়া



ড. হাসিন মাহবুব চেরী, সিনিয়র স্পেশালিস্ট সায়েন্টিস্ট, ইউকে
জীবনে সুখী হওয়া

জীবনে সুখী হওয়া

  • Font increase
  • Font Decrease

মানুষের বয়স বৃদ্ধির কোনো এক পর্যায়ে জীবনবোধের বিষয়গুলো তীক্ষ্ণ হয়। সে সময় সবার মনে একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসে: কীভাবে জীবনটাকে আরও সুন্দর আর উপভোগ্য করা যায়? কীভাবে দীর্ঘদিন জীবনে আনন্দ নিয়ে বেঁচে থাকা যায়?

প্রশ্নটা খুব সহজ হলেও এর উত্তর পাওয়া কিন্তু এতোটা সহজ নয়। এমনকি, সারাটা জীবন সুখ নামের মরীচিকার খোঁজে পাগলের মতো ঘুরেও বেশিরভাগ মানুষই তার দেখা পায় না! আশায় আশায় জীবন কেটে যায়। সুখী হওয়ার আশা পূরণ হয় না।

আসল সমস্যা হলো, জীবনে সুখী হওয়ার জন্যে ছোটোবেলা থেকে আমাদের মস্তিষ্কে চাপ তৈরি করে দেওয়া হয়। মাথার মধ্যে সুখী হওয়ার যে ফরমুলা ঢুকিয়ে দেয়া হয়, তা হলো নিজেকে সমাজে অনেক সাকসেসফুল করতে হবে। রাত দিন কাজে ডুবে গিয়ে প্রচুর টাকার মালিক হতে হবে, ডাক্তার/ইঞ্জিনিয়ার হতে হবে, অথবা অনেক ফেমাস কোনো ব্যক্তি হতে হবে। যাতে করে সবাই আপনাকে চেনে, জানে এবং এভাবেই আপনার খ্যাতি অথবা পয়সা আপনাকে সুখ এনে দেবে অটোমেটিক।

কিন্তু বাস্তবে ব্যাপারটা একেবারেই ভিন্ন! চলুন দেখি এ ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা কি বলছেন। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের বিজ্ঞানীরা গত ৭৫ বছর যাবৎ এক গবেষণা চালিয়ে খুঁজে বের করেছেন মানুষের জীবনে সুখী হওয়ার রহস্য। গবেষণাটি শুরু হয় ১৯৩৮ সাল থেকে। গবেষণাটিতে বিজ্ঞানীরা ৭২৪ জন মানুষের জীবনকে গত ৭৫ বছর যাবৎ ফলো করে এসেছেন। এই গবেষণায় তারা ৭৫ বছর ধরে এই প্রত্যেকটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা থেকে শুরু করে তাদের শারীরিক ও মানসিক সব রকম পরীক্ষা, ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা সব কিছুই অন্তর্ভুক্ত করেন।

গবেষণাকালীন দীর্ঘ ৭৫ বছরে এই মানুষদের অনেকেই মারা যায়, কেউবা মদ্যপ হয়, আবার অনেকে নানা রকম মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে মানসিক রোগী হয়। অনেকেই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হন, আবার একজন আমেরিকার প্রেসিডেন্টও নির্বাচিত হন! অর্থাৎ, বিচিত্র তাদের জীবনের ফলাফল পরিণতি।

শেষ পর্যন্ত এদের সবার জীবন থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা দেখতে পান যে, একমাত্র জীবনে ভালো রিলেশনশিপের উপস্থিতি মানুষকে সুখী এবং দীর্ঘজীবী করে! আর কিছু পাসিং স্যাডো: ভাসমান মেঘের মতো ক্ষণস্থায়ী, হালকা ও অস্থায়ী।

এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা প্রথমেই জোর দিয়েছেন খুব কাছের সম্পর্কের মানুষের সাথে সম্পর্কের কোয়ালিটি নিয়ে। তারা দেখেছেন যেসব মানুষের জীবনে খুব ভালোবাসার এবং নির্ভর করার মতো একজন মানুষও থাকে তারা অনেক সুখী এবং দীর্ঘজীবী হয়।

এই গবেষণায় আরো দেখা যায়, যেসব ব্যক্তি অন্যের সাথে নিজের কোনো কিছু শেয়ার করতে পারে না, খুব ক্লোজ রিলেশনশিপ মেনটেন করতে চায় না বা পারে না, তারা অতি দ্রুত শারীরিক এবং মানসিক অবক্ষয়ের দিকে চলে যায়। এক্ষেত্রে বিজ্ঞানীরা বারবার জোর দিয়েছেন এমন কাছের মানুষের সাথে সম্পর্ক মেনটেন করতে, যার ওপর আস্থা, বিশ্বাস ও নির্ভরতা রাখা যায়।

গুরুত্বপূর্ণ এই গবেষণায় আরও দেখা গেছে, সারাজীবন বিবাহিত থেকে অশান্তিকর ভালোবাসাহীন জীবন-যাপন করা মানুষের চেয়ে যারা সেই অশান্তি থেকে বের হয়ে এসেছে ডিভোর্সের মাধ্যমে, তারা পরবর্তীতে সুখী এবং দীর্ঘজীবনের অধিকারী হয়েছে। এই গবেষণায় দেখা যায় যে, ৫০ বছরের পর যেই কাপলদের মধ্যে গভীর ভালোবাসা বজায় ছিল তারা ৯০ বছরের অধিক সময় ধরে বেঁচে আছে।

ভালোবাসার সম্পর্ক বলতে বিজ্ঞানীরা এমনটা বোঝেননি যে ঝগড়া বা ইমোশনাল ups এন্ড downs থাকবে না, বরং বুঝিয়েছেন সব কিছুর পরেও যদি দিনশেষে একে অপরের উপর এই বিশ্বাসটা রাখার মতো সম্পর্কটা হয় যে, আমার এমন একজন আছে, যে আমার বিপদে আমার পাশে আছে, সেটাই পরবর্তীতে সুখী এবং দীর্ঘজীবন যাপনে মূল ভূমিকা পালন করে।

এই গবেষণায় আরেকটি চমকপ্রদ পয়েন্ট উঠে আসে আর সেটি হলো: যাদের জীবনে আস্থা এবং গভীর ভালোবাসার মানুষের উপস্থিতি থাকে, তারা তুলনামূলকভাবে যেকোনো তীব্র ব্যথা অনেক কম অনুভব করেন। যখন ব্যথার তীব্রতা তুলনা করা হয় সেসব মানুষের সাথে, যাদের জীবনে ভালোবাসার সম্পর্ক অনুপস্থিত!

বিজ্ঞানীরা দ্বিতীয় যে বিষয়টার ওপর জোর দিয়েছেন সেটি হলো, ভালো সামাজিক সম্পর্ক তৈরির ওপর। কারণ, দেখা গেছে যেসব মানুষ ভালো সামাজিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে বন্ধু বান্ধবের সাথে, তারা অনেক বেশি সুখী ও স্বাস্থ্যবান জীবন-যাপন করে, যখন তুলনা করা হয় সেসব মানুষের সাথে, যারা অপেক্ষাকৃত একাকী জীবন যাপন করে।

বাস্তবেও একাকিত্ব মানুষকে শারীরিক এবং মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলে, তাদের ব্রেইনের কার্যক্ষমতা কমে যায় এবং তারা অপেক্ষাকৃতভাবে কম দিন বাঁচে। নিঃসঙ্গ ও একাকী মানুষের তীব্র যন্ত্রণার বিষয়গুলোও গবেষণায় উত্থাপিত হয়েছে।

এই গবেষণার ফলাফল থেকে দেখা যায় যে, মানুষের কতগুলো বন্ধু আছে অথবা সে বিবাহিত কিনা সেটার চেয়ে বড়ো ব্যাপার হলো তার কয়জন বিশ্বস্ত বন্ধু আছে অথবা তার স্বামী স্ত্রী অথবা প্রেমিক-প্রেমিকার সাথে তার সম্পর্কের কোয়ালিটিটা কেমন। ৫০ বছর বয়সে যেসব মানুষ তাদের সম্পর্ক নিয়ে satisfied ছিল তারা high cholesterol থাকার পরেও কোলেস্টেরল না থাকা মানুষদের চেয়ে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনযাপন করে।

আরেকটি বিষয় যা গবেষণাকালে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেন তা হলো, যদি কোনো মানুষ একটি securely attached caring রিলেশনশিপে থাকে এবং বিশ্বাস করে যে, সে তার সবচেয়ে কাছের একজনের ওপর নির্ভর করতে পারে, তাহলে এটি তাদের ব্রেইনকে রক্ষা করে এবং তাদের মেমোরি শার্প থাকে ৮০ বছরের পরেও! এই মানুষগুলোর সম্পর্ক যে খুব স্মুথ ছিল তা কিন্তু নয়। বরং প্রতিদিন ঝগড়া করেও যদি দিনশেষে তারা একে অপরের ওপর নির্ভর করতে পারে তাহলে তাদের মেমোরি ও স্বাস্থ্য দীর্ঘদিন ভালো থাকে।

মোট কথা, গভীর ভালোবাসায় থাকা সম্পর্কের মানুষের জীবন অনেক সুখের এবং তাদের মন, মেজাজ, ব্রেন ও স্বাস্থ্য অনেক ভালো থাকে বলে তারা দীর্ঘজীবী হয়। কেননা গভীর ভালোবাসা, আস্থা, বিশ্বাস, নির্ভরযোগ্যতা মানুষকে sense অফ protectovity দেয় এবং সুখী রাখে।

কিন্তু প্রশ্ন হলো- এতো কিছুর পরেও কেন আমরা আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলোকে অবহেলা করি? এর উত্তর হলো, মানুষ সহজে যা পেয়ে যায় তার মূল্য দেয় না, আর ভালো রিলেশনশিপ বজায় রাখতে হলে যে মূল্য দিতে হয়, সেটাও মানুষ সহজে দিতে চায় না। ভালো রিলেশনশিপ মেনটেন করা সহজ কাজ নয় এবং এজন্যে প্রচুর ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, যা মানুষ সচরাচর করতে চায় না। কারণ তারা সব কিছু রেডিমেড উপভোগ করতে চায়। কিন্তু আমরা ভুলে যাই যে: ‘When we love, we always strive to become better than we are. When we strive to become better than we are, everything around us becomes better too.’ — Paulo Coehlo

তাই আসুন ভালোবাসার সম্পর্কগুলোকে যত্ন করি এবং একটি আনন্দময় সুখী সার্থক দীর্ঘজীবনের অধিকারী হই।

;

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার দুবাই বৈঠক: বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে তাৎপর্য ও করণীয়



ড. মোস্তাফিজুর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

একটি উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সদ্য সম্প্রতি সময়ে সংযুক্ত আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ত্রয়োদশ মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন (২৬ ফেব্রুয়ারি-১ মার্চ ২০২৪) ছিল আলাদাভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। সুবিদিত যে, বাংলাদেশ নভেম্বর ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে স্বল্পোন্নত-বহির্ভূত উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। ত্রয়োদশ বৈঠকে (এম. সি. ১৩) বাংলাদেশের অংশগ্রহণ ছিল ত্রিমাত্রিক পরিচয়কে ধারণ করে: স্বল্পোন্নত দেশ, উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে।

বাংলাদেশকে একদিকে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের সাথে সংহতি রাখতে হয়েছে; একই সাথে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ হিসাবে নিজস্ব স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হয়েছে, আবার অন্যদিকে নিকট ভবিষ্যতের একটি উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে তার স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় ও ইস্যু সমূহকেও বিবেচনায় রাখতে হয়েছে। সম্মেলনে নাগরিক সমাজের একজন প্রতিনিধি হিসেবে অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায় যে, এবারের এম.সি. ১৩ তে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধি দলের প্রস্তুতি ছিল বেশ ভাল। এ ধরণের সম্মেলনের ক্ষেত্রে প্রস্তুতিমূলক আলোচনা সবসময়ই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাথে পরামর্শক্রমে বাংলাদেশের জেনেভাস্থ মিশন জেনেভাতে এম.সি ১২ ও এম. সি. ১৩ এর মধ্যবর্তী সময়ে অনুষ্ঠিত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন আলোচনায় সক্রিয় ভূমিকা রেখেছে এবং তার সুফল আবুধাবিতে দেখা গেছে। এম. সি. ১৩-তে মাননীয় বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী জনাব আহসানুল ইসলাম এম. পি.’র নেতৃত্বে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ও জেনেভাস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান ও অন্যান্য সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত সরকারি ডেলিগেশন আবুধাবিতে গ্রিনরুম (বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাভূক্ত সীমিত সংখ্যক দেশের অংশগ্রহণমূলক আলোচনা) ও সাধারণ আলোচনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন এবং দ্বিপাক্ষিক মতবিনিময়ের বিভিন্ন সুযোগকেও কাজে লাগিয়েছেন। ফলশ্রুতিতে, সর্বক্ষেত্রে সম্ভব না হলেও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্তসমূহ বাংলাদেশের অনুকূলে এসেছে, যা সম্মেলন শেষে এম. সি. ১৩ এর মন্ত্রীপর্যায়ের ঘোষণায় প্রতিফলিত হয়েছে।

এবারের মন্ত্রীপর্যায়ের বৈঠকে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয় ছিল বেশ কয়েকটি: ক) শুল্কমুক্ত, কোটামুক্ত বাজার সুবিধার প্রসারণ; খ) স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে প্রদেয় অন্যান্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কার্যক্রমের সময়-নির্দিষ্ট প্রসারণ, গ) মৎস্যখাতের ভর্তুকির আলোচনায় উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য সময়-নির্দিষ্ট বিশেষ সুবিধা; ঘ) বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সংস্কার বিষয়ক আলোচনায় বহুপাক্ষিক বাণিজ্য ব্যবস্থায় স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের স্বার্থের নিশ্চয়তা বিধান। এর বাইরে সরকারি খাদ্য সংগ্রহে প্রদত্ত কৃষি ভর্তুকিকে কৃষিখাতে প্রদত্ত ভর্তুকির সর্বোচ্চ হিসাবের (যা কৃষি জিডিপির ১০% এর সমপরিমাণ) বাইরে রাখা, ই-কমার্সের ওপর ১৯৯৮ সাল থেকে প্রচলিত শুল্ক নিষেধাজ্ঞার সমাপ্তি, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রাতিষ্ঠনিক প্ল্যাটফর্মের বাইরে অনুষ্ঠিত বহুপাক্ষিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করার বিষয়ে অবস্থান নির্ধারণ ইত্যাদি।

উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত বাজার সুবিধার প্রসারণ। এ বিষয়ে অবশ্য ইতিপূর্বে, ২৩ অক্টোবর ২০২৩-এ বিশ^ বাণিজ্য সংস্থার সাধারণ অধিবেশনে একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল, যা এম. সি. ১৩-তে অনুমোদিত হয়। এ ক্ষেত্রে তিনটি বিষয় প্রণিধানযোগ্যঃ প্রথমত, সিদ্ধান্তটি ‘বেস্ট এনডিয়েভার’ (সেরা প্রচেষ্টা) আকারে গৃহীত হয়েছে, অর্থাৎ এটা মেন্ডেটরি বা বাধ্যতামূলক নয়, বরং সদস্যদের সদিচ্ছার ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এক্ষেত্রে কোন সুনির্দিষ্ট সময়ের কথা বলা হয়নি, যদিও স্বল্পোন্নত দেশসমূহের এ সংক্রান্ত প্রথম প্রস্তাবে ১২ বছরের কথা বলা হয়েছিল, যা পরবর্তীতে ৬-৯ বছরে নামিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল। তৃতীয়ত প্রস্তাবটি কেবলমাত্র সেসব দেশের জন্য প্রযোজ্য যাদের স্বল্পোন্নত দেশ-নির্দিষ্ট বাজার সুবিধা স্কিম আছে। উদাহরণস্বরূপ, যেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এধরণের কোন স্কিম নেই, সিদ্ধান্তটি সে দেশের জন্য প্রযোজ্য হবে না।

এতদসত্ত্বেও এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, এম. সি. ১৩-এর সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশ ও অন্যান্য উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশের জন্য দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে বাজার সুবিধা সম্প্রসারণের একটি সুযোগ সৃষ্টি করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে, ইউরোপিয় ইউনিয়ন (এভরিথিং বাট আর্মস বা ই. বি. এ.) ও যুক্তরাজ্য (ডেভেলপিং কান্ট্রিজ ট্রেডিং স্কিম বা ডি. সি. টি. এস) তাদের স্ব-স্ব এলডিসি স্কিম এর মেয়াদকাল উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহের জন্য উত্তরণ-পরবর্তী আরো তিন বছর বৃদ্ধির ঘোষণা দিয়েছে। অন্য দেশসমূহের সাথে বাজার সুবিধা সম্পর্কিত আলোচনায় এটা একটা মানবিন্দু (রেফারেন্স পয়েন্ট) হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। বাংলাদেশকে এখন দ্বিপাক্ষিকভাবে কানাডা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারতসহ অন্যান্য দেশসমূহের সাথে এম. সি. ১৩ এর সিদ্ধান্তের আলোকে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। এম. সি. ১৩-তে এ সিদ্ধান্তও হয়েছে যে, উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে কারিগরি সহায়তা ও সক্ষমতাবৃদ্ধিমূলক সাহায্য উত্তরণ পরবর্তীতে আরো তিন বছরের জন্য প্রদান করা হবে।

গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি সিদ্ধান্ত হল-উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহ স্বল্পোন্নত দেশসমূহের অনুরূপ ডিউ রেসট্রেইন্ট (যথাযথ সংযম) সুবিধা উত্তরণ-পরবর্তী আরও তিন বছরের জন্য ভোগ করতে পারবে। এর অর্থ হল-স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর তিন বছর পর্যন্ত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্যভূক্ত কোন দেশ এসব দেশের বিরুদ্ধে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিরোধ নিষ্পত্তি বডি (ডিসপিউট সেটেলম্যান্ট বডি)-তে নালিশ করতে পারবে না।

স্বল্পোন্নত দেশগুলি এর বাইরে যেসব সুবিধা ভোগ করে সেসবগুলিও যাতে উত্তরণ-পরবর্তীতে তারা বাড়তি সময়ের জন্য ভোগ করতে পারে এমন একটি প্রস্তাবও রাখা হয়েছিল উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশের স্বার্থসমূহ বিচেনায় রেখে। তবে এ সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট কোন সিদ্ধান্ত এম. সি. ১৩-এ গৃহীত হয়নি। মেধাসত্ব অধিকার, ওষুধ ও মেধাসত্ব অধিকার, রপ্তানিতে ভর্তুকি প্রদান ইত্যাদি ইস্যুতে বাড়তি সময় সুবিধা ভোগ করতে সমর্থ হলে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহ, বিশেষ করে বাংলাদেশ, উপকৃত হত। এম. সি. ১৩ এর সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, এ সম্বন্ধীয় আলাপ-আলাচেনা জেনেভাতে অব্যাহত থাকবে এবং এম. সি. ১৪-তে এ বিষয়ে আলোচনার ফলাফল উপস্থাপন করা হবে। জেনেভাস্থ বাংলাদেশ মিশন নিশ্চয়ই এম. সি. ১৩ পরবর্তী আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব (তথাকথিত এনেক্স ২ প্রস্তাব) এর প্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্তে উপনীত হবার জন্য সক্রিয় ভূমিকা রাখবে। বিশেষত বাংলাদেশের ওষুধশিল্পের বিকাশে মেধাসত্ব অধিকার বিষয়ক নমনীয়তার যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে তা সুবিদিত।

মৎস্য খাতে ভর্তুকি বিষয়ক আলোচনায় কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা যায়নি, যদিও নিয়মবহির্ভূত, অনথিভূক্ত, অপ্রতিবেদিত মৎস্য শিকারের ক্ষেত্রে প্রদেয় ভর্তুকির প্রেক্ষিতে একটি সিদ্ধান্ত এম. সি. ১২-তে গৃহীত হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপের আলোচনায় ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে প্রদেয় ভর্তুকি হ্রাস ছিল মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশসমূহকে যাতে মৎস্য খাতে ভর্তুকী প্রদানের ক্ষেত্রে স্বল্পোন্নত দেশসমূহের অনুরূপ সুবিধা দেয়া হয়; বাংলাদেশ সে বিষয়ে সচেষ্ট ছিল, জেনেভাতে এ বিষয়ে যে টেক্সট নিয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়েছিল তাতে মতৈক্যে পৌছান সম্ভব হয়নি (এ সংক্রান্ত টেক্সট-এ অনেক ব্র্যাকেট থেকে গিয়েছিল)। আবুধাবিতে বিশেষতঃ ভারতের সাথে উন্নত ও ধনী দেশসমূহের ভর্তুকি বিষয়ে বিরাজমান বড় পার্থক্যের নিরসন করা সম্ভব হয়নি। ভারতের যুক্তি ছিল ছোট ও আর্টিসানাল মৎস্য শিকারের ক্ষেত্রে প্রদেয় ভর্তুকির ক্ষেত্রে কোন ধরণের সীমা আরোপ করা যাবে না (অন্ততঃ ২৫ বছরের জন্য)। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বার্থ ছিল ভারতের অনুরূপ, বিশেষতঃ আগামীর উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে।

সামুদ্রিক মৎস্য শিকারে ভর্তুকির ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রাপ্তির জন্য বিশ^ সামুদ্রিক মৎস্য শিকারের ০.৮% এর একটি সীমারেখা আলোচ্য টেক্সটে ছিল, যে সীমারেখাটি বৃদ্ধি করতে বাংলাদেশ সচেষ্ট ছিল (যেহেতু ইলিশকে সামুদ্রিক মাছ হিসেবে গণ্য করলে বাংলাদেশের সামুদ্রিক মৎস্য শিকার ০.৮% এর সীমারেখা অতিক্রম করে)। আলোচ্য টেক্সটে বৃহৎ মৎস্যশিকারী দেশসমূহের বড় বড় সামুদ্রিক মৎস্যশিকারী কোম্পানিসমূহের জন্য প্রদত্ত ভর্তুকির বিষয়ে যেসব ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে, সে বিষয়েও অনেক উন্নয়নশীল দেশের জোরাল আপত্তি ছিল। অবশ্য এ বিষয়ে কোন সিদ্ধান্ত না হওয়া ও স্থিতাবস্থা বিরাজমান থাকায় বাংলাদেশের সংক্ষুব্ধ হবার তেমন কোন কারণ নেই। তবে এম. সি. ১৩ ও এম. সি. ১৪ এর অন্তবর্তীকালীন আলোচনায় বাংলাদেশকে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশ-এ দ্বিবিধ স্বার্থ বিবেচনায় রেখে অংশগ্রহণ করতে হবে।

কৃষিখাত সংক্রান্ত ‘পিস ক্লজ’ এর আলোচনায় বেশ বড় ধরণের মতপার্থক্য থেকে যায় যার কারণে কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রদেয় কৃষি খাতের ভর্তুকি ১০% সীমা অতিক্রম করে যদি সরকারি খাদ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রদত্ত ভর্তুকি এ হিসাবের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত হয়; ভারতের যুক্তি ছিল এ ভর্তুকি ‘গ্রিন সাবসিডি’র অনুরূপ যেহেতু এর লক্ষ্য হল প্রান্তিক মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা। বেশ কিছু দেশ এর বিরোধিতা করে এই যুক্তি দিয়ে যে, এই খাদ্যের একটি অংশ ভারত আবার রপ্তানিও করে। ভারতের দাবি ছিল ‘পিস ক্লজ’-কে চিরস্থায়ী করা। অন্য বেশ কয়েকটি দেশের অবস্থান ছিল, এ সংক্রান্ত আলোচনা কৃষি খাত বিষয়ক বৃহত্তর পরিসরের আলোচনার অংশ হতে হবে। শেষ অবধি দুই পক্ষের অনড় অবস্থানের কারণে এ বিষয়ে কোন ঐক্যমতে পৌছান সম্ভব হয়নি।

ই-কমার্সের ওপর শুল্ক আরোপে যে নিষেধাজ্ঞা ১৯৯৮ সাল থেকে বর্তমান, সে বিষয়ে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্দোনেশিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশের অবস্থান ছিল, এতে ই-পণ্য ও সেবা রপ্তানিকারক উন্নত দেশগুলিই লাভবান হচ্ছে; আর আমদানিকারক উন্নয়নশীল দেশসমূহ শুল্ক আহোরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এক অর্থে এই যুক্তি প্রযোজ্য। সিপিডি-র গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিবছর বাংলাদেশ সরকার এ নিষেধাজ্ঞার কারণে প্রায় ৪০ মিলিয়ন ডলার শুল্ক থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ই-কমার্সের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য কিছুটা মিশ্র। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রক্ষণাত্মক স্বার্থ (ডিফেন্সিভ ইন্টারেস্ট) যেমন আছে, তেমনি আছে আক্রমণাত্মক স্বার্থ (অফেন্সিভ ইন্টারেস্ট)। তার কারণ বাংলাদেশ সেবাখাতে রপ্তানিও করে থাকে এবং নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে গন্তব্য দেশসমূহে রপ্তানির ওপর শুল্ক আরোপিত হবে যা এসব রপ্তানির প্রতিযোগিতা সক্ষমতার ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। আবুধাবিতে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যদি পরবর্তী আলোচনায় অগ্রগতি না হয় তাহলে ৩১ মার্চ ২০২৬ বা এম. সি. ১৪ এ দুটোর মধ্যে যেটিই আগে আসবে সে তারিখ থেকে নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে। উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশের ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ রপ্তানির ওপর কোনো শুল্ক বসবে না (নির্দিষ্ট সময়ের জন্য), এমন একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে বাংলাদেশের জন্য তা ইতিবাচক হবে।

বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সংস্কার বিষয়ক আলোচনা জেনেভা ও পরবর্তীতে আবুধাবি এম. সি. ১৩-তে বিশেষ গুরুত্ব পায়। স্মর্তব্য যে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ডি. এস. বি. বর্তমানে অনেকাংশে অকেজো হয়ে আছে কারণ সংস্কার আলোচনার পরিসমাপ্তি ব্যতিরেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ডি. এস. বি.’র আপিল বডিতে কোন নিয়োগ প্রদান করতে বাধা দিচ্ছে। অথচ ডি. এস. বি.’-কে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ‘জুয়েল ইন দি ক্রাউন’ বলা হয় যা এ সংস্থাকে ব্যতিক্রমী বিশিষ্টতা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বেশকিছু উন্নত রাষ্ট্রের যুক্তি হচ্ছে ব্যাপক সংস্কারের অনুপস্থিতিতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। তারা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিদ্যমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও চলমান সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া দুটোরই বিরোধিতা করে আসছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ঐকমতভিত্তিক সিদ্ধান্ত ‘সব কিছুতে সহমত না হলে কোন কিছুতেই সিদ্ধান্ত নয়’ (নাথিং ইজ এগ্রিড আনলেস এভরিথিং ইজ এগ্রিড) এবং ‘একক অঙ্গীকার’ (সিঙ্গল আন্ডারটেকিং) -এসব পদ্ধতিগত বিষয়েও প্রশ্ন তোলা হচ্ছে বেশ কিছু উন্নত দেশের পক্ষ থেকে। বিশেষত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এসব ক্ষেত্রে অনেকটাই অনড়। এসব বিষয়ে আবুধাবিতে বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। উন্নয়নশীল দেশসমূহের অবস্থান হল সংস্কারের নামে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাতে যেন শক্তিশালী ও উন্নত দেশসমূহের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা না করা হয় এবং যে কোন সংস্কার কর্মসূচির নামে এ সংস্থার ‘উন্নয়ন মাত্রা’ (ডেভেলপমেন্ট ডাইমেনশন) যেন দুর্বল না হয়।

আবুধাবিতে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে যে, ভারত, বাংলাদেশের মত দেশসমূহ অংশগ্রহণ না করলেও ‘বহুপাক্ষিক আলোচনা’ (প্লুরিলেটারেল ডিসকাশন) ক্রমান্নয়ে অধিকতর গুরুত্ব পাচ্ছে। বিনিয়োগ (ইনভেস্টমেন্ট ফেসিলেটেশন ফর ডেভেলপমেন্ট), পরিবেশ (ট্রেড অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট সাসটেইনেবিলিটি, স্ট্রাকচারড ডিসকাশন), ই-কমার্স (জয়েন্ট ইনিশেয়েটিভ অন ই-কমার্স) ও অন্যান্য ইস্যুর ওপর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্ম সমূহের বাইরে অনেক সদস্য দেশ শুল্ক হার, রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন সংক্রান্ত আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে।

উদ্দেশ্য হল, ঐক্যমত্য প্রতিষ্ঠিত হলে এসব আলোচনাকে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার মূলধারাতে নিয়ে আসা। আবুধাবিতে এভাবেই সেবা সংক্রান্ত অভ্যন্তরীন রেগুলেশন্সকে প্লুরিলেটারেল থেকে বহুপাক্ষিক রূপ দেওয়া হয়েছে, যা পরবর্তীতে সবার জন্য ‘মোস্ট ফেবারড নেশানন্স বা এম. এফ. এন.’ ভিত্তিতে প্রয়োগ হবে। পূর্বেই বলা হয়েছে, বাংলাদেশ এখনো কোন প্লুরিলেটারেল আলোচনায় অংশগ্রহণ করেনি যদিও বেশ কিছু সংখ্যক স্বল্পোন্নত দেশ বেশ ক’টিতে সক্রিয় আছেঃ যেমন-বিনিয়োগ সংক্রান্ত আলোচনায় ২৫টি স্বল্পোন্নত দেশ অংশগ্রহণ করছে। এসব আলোচনায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ করা সমীচীন হবে। তাহলে রুলস নির্ধারণে ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাংলাদেশ প্রভাব রাখতে পারবে এবং উন্নয়নশীল দেশ সমূহের স্বার্থরক্ষায় অবদান রাখতে পারবে।

স্বল্পোন্নত দেশসমূহের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী অর্থনীতি হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিভিন্ন আলোচনায় ধারাবাহিতভাবে উদ্যোগী ও অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। আগামীতে এ ভূমিকা অব্যাহত রাখতে হবে, একই সাথে উত্তরণকালীন স্বল্পোন্নত দেশ ও উন্নয়নশীল দেশসমূহের স্বার্থও বিবেচনায় রাখতে হবে। বাংলাদেশ সরকার টেকসই উত্তরণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতায় উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করেছে, যার অধীনে সাতটি উপ-কমিটি কাজ করে যাচ্ছে। ‘স্মুথ গ্রেজুয়েশন’ এর লক্ষ্যে এসব সাব-কমিটি অনেকগুলি সুনির্দিষ্ট পরামর্শও প্রণয়ন করেছে। লক্ষ্য ও সময় নির্দিষ্টভাবে এগুলি বাস্তবায়ন করতে হবে। একই সাথে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অধীনে উন্নয়নশীল সদস্য দেশসমূহকে যেসব বিশেষ ও বিভাজিত (স্পেশাল অ্যান্ড ডিফারেনসিয়াল) সুবিধা দেওয়া হয়েছে এবং উত্তরণশীল স্বল্পোন্নত দেশসমূহের ক্ষেত্রে যেসব বিদ্যমান সুবিধা আছে (যেমন টেকনোলজি ব্যাংক এবং বাণিজ্যের জন্য সহায়তা ফান্ড থেকে উত্তরণ-পরবর্তী আরো পাঁচ বছরের জন্য সহায়তা প্রাপ্তি, এল. ডি. সি. ক্লাইমেট ফান্ড, লিগ্যাল সাপোর্ট) সেগুলিরও সুযোগ নিতে হবে।

বাংলাদেশের জন্যও টেকসই এল. ডি. সি. উত্তরণ-কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি মূল করণীয় হতে হবে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার এম. সি. ১৩ পরবর্তী আলোচনার প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন ইস্যুতে নিজস্ব অবস্থান নির্ধারণ, এসব আলোচনার অভিঘাত বিচার-বিশ্লেষণ ও তার প্রেক্ষিতে কৌশল নির্ধারণ। স্বল্পোন্নত দেশের গ্রুপ থেকে উত্তরণের পূর্বে কেমেরুনে ২০২৬ সালে অনুষ্ঠিতব্য এম. সি. ১৪-ই হবে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশের শেষ মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক। এসবের প্রেক্ষিতে এম. সি. ১৩ এর পরবর্তীতে জেনেভায় পরিচালিত বিভিন্ন আলোচনায় বাংলাদেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে।

লেখক: সম্মানীয় ফেলো, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

;