রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও প্রাসঙ্গিক কথা



আবদুল মোনেম
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের মূল আইনে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের কোনো বিধান না থাকলেও রাজনীতির প্রতি বিতশ্রদ্ধ ১/১১ সরকার ১৯৭২ সালের Representation of People Order (RPO) পরিবর্তন করে সংশোধন আকারে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের Representation of People (Amendment) Ordinance, 2008 নামক একটি আইন করে। এই আইনে ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের একটি অতিরিক্ত অধ্যায় সংযোজন করা হয় । উক্ত অধ্যায়ে ৯টি ধারা (৯০এ থেকে ৯০আই) রয়েছে । ৯০এ অনুসারে নির্বাচনে অংশগ্রণেচ্ছু দলসমূহকে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত হতে হবে ।  উপরোক্ত আদেশের ৯০বি(১)এ ধারার বিধি অনুসারে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিবন্ধন পেতে হলে:

(i) বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দরখাস্ত দাখিলের তারিখ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের যে কোনো একটিতে দলীয় নির্বাচনী প্রতীক নিয়ে কমপক্ষে একটি আসন লাভ করে থাকতে হবে অথবা

(ii)উক্তরূপ নির্বাচনের যেকোন একটিতে দরখাস্তকারী দল কর্তৃক নির্বাচনে অংশগ্রহণকৃত আসনসমূহে প্রদত্ত মোট ভোট সংখ্যার ৫% ভোট লাভ করে থাকতে হবে অথবা 

(iii) কেন্দ্রীয় কমিটি ও অফিস, অফিসসহ কমপক্ষে ১০টি জেলা কমিটি এবং অফিসসহ কমপক্ষে ৫০টি উপজেলা/থানা কমিটি থাকতে হবে ।

৯০বি(১)বি(ii) অনুসারে ২০২০ সাল নাগাদ সর্বস্তরের কমিটিতে কমপক্ষে ৩৩% নারী সদস্য অন্তর্ভূক্তির শর্ত পূরণের প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে ।

এছাড়া ৯০এইচ(১)ই অনুসারে পর পর দুইটি জাতীয় নির্বাচনে কোনো নিবন্ধিত দল অংশগ্রহণ না করলে দলটির নিবন্ধন বাতিল বলে গণ্য হবে ।

উক্তরূপ আইন অনুসারেই ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগসহ চল্লিশটি দল নিবন্ধন লাভ করে এবং গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়ে আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালের শুরুতে সরকার গঠন করে । এ সরকার ৯০বি(১)এ (iii) নং উপ ধারায় ১০টি জেলা কমিটি ও অফিসের স্থলে ২২টি জেলা কমিট; ৫০টি উপজেলা/ থানা কমিটির স্থলে ১০০টি উপজেলা/ থানা কমিটি; প্রতিটি কমিটিভূক্ত উপজেলা/ থানায় কমপক্ষে ২০০ জন নিবন্ধিত ভোটার সদস্য এবং এসবের প্রামাণ্য দলিল-পত্রাদির বাধ্যবাধকতা যুক্ত করে Representation of People Order (Amendment) Act, 2009 (Act No. XIII of 2009) নামে ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯ সালে আইনটিকে সংসদের প্রথম অধিবেশনেই পাস করিয়ে নেয় ।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য বিশ্বব্যাপী পরিচিত এবং আমাদের দেশের রাজনীতিক এবং বুদ্ধিজীবী মহল কর্তৃক সর্বাধিক আলোচিত দেশসমূহে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে কীরূপ আইন প্রচলিত আছে সে বিষয়ে একটু আলোকপাত করা যাক।

দেশের খ্যাতিমান রাজনীতিক ও বুদ্ধিজীবি মহলের কাছে গণতন্ত্রের সূতিকাগার হিসাবে পরিচিত যুক্তরাজ্যের Registration of Political Party Act-1998 অনুসারে কেন্দ্রীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় অফিস ও দলীয় গঠণতন্ত্র থাকলে যে কোনো রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের যোগ্য হয় । বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতাত্রিক দেশ ভারতে Representation of People Act-1951 অনুসারে কেন্দ্রীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় অফিস এবং গঠণতন্ত্র থাকলেই যেকোন রাজনৈতিক দল নিবন্ধন পেতে পারে । রাজনীতিক মহলে সর্বাধিক পরিচিত ও বিশ্বব্যাপী সর্বাধিক আলোচিত গণতান্ত্রিক দেশ যুক্তরাষ্ট্রের The Political Parties (Registration And Regulation) Act অনুসারে কেন্দ্রীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় অফিস, দলীয় গঠণতন্ত্র এবং ১০০ জন নিবন্ধিত ভোটার সদস্য থাকলে যেকোন  রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের যোগ্যতা লাভ করে । গণতন্ত্রপন্থী অন্য সকল রাষ্ট্রসমূহেও রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে একই রূপ আইন চালু রয়েছে ।

এবার আমাদের দেশে রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বিদ্যমান আইনটি নিয়ে একটু পর্যালোচনা করা দরকার । আইনটির ৯০বি(১)এ(i) নং উপধারা অনুসারে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ২০০৮ সাল পর্যন্ত যে ৮টি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এর যে কোনো একটিতে দলীয় প্রতীকে অংশ নিয়ে একটি আসন লাভ করলেই যেকোন একটি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের যোগ্যতা লাভ করবে। অথচ ৮টি নির্বাচনের মধ্যে অধিকাংশ নির্বাচনই সুষ্ঠু-অবাধ-নিরপেক্ষতার মাপকাঠিতে কিংবা গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে পারেনি। এ আইনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, বিনা ভোটে কিংবা বিশেষ কিছু নেতা-নেত্রীর অনুকম্পায় নির্বাচিত হিসাবে ঘোষিত ব্যক্তিদের দলকে নিবন্ধনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে । অর্থাৎ যেসব দলের পূর্বসূরীগণ রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ও অনুকম্পায় পূর্ব থেকেই অধিকতর সুবিধা ভোগ করে এসেছেন এই আইনে তাঁদের উত্তরসূরীদের জন্যও সুযোগ সুবিধাসমূহের স্থায়ী বরাদ্ধ দেওয়া হয়েছে ।

৯০বি (১)এ(ii) নং উপধারা অনুসারে কোনো একটি দল ৮টি নির্বাচনের যে কোনো একটিতে অন্তত একটি আসনে নির্বাচন করেও যদি ৫% ভোট লাভে সমর্থ হয়ে থাকে তাহলে এটি নিবন্ধন লাভের যোগ্য বলে বিবেচিত হবে এবং তাতে মাত্র ১/২ হাজার ভোট প্রাপ্তিও নিবন্ধনের যোগ্যতা লাভের জন্য যথেষ্ট হতে পারে । উল্লেখ থাকে যে, নতুন গড়ে উঠা দলগুলোর ক্ষেত্রে ৯০বি(১)এ(i) ও (ii) নং উপধারার সুবিধা প্রাপ্তির কোনো সুযোগ নেই।

৯০বি(১)এ(iii) নং উপধারার শর্ত পূরণ করতে হলে অফিস সহ ২২টি জেলা কমিটি এবং ১০০টি থানা কমিটি পরিচালনা করতে যে পরিমাণ ( মাসে কমপক্ষে ১৫/২০ লক্ষ টাকা )অর্থের প্রয়োজন হয় নতুন দলগুলো তা মেটাতে গেলে দল পরিচালনাকারী নেতৃবৃন্দকে অঢেল ধন সম্পদের মালিক হতে হবে যা বৈধ উপায়ে অর্জিত না হওয়াটাই স্বাভাবিক । অতীতে কোনো এক নির্বাচনে কোনো এক দলকে ১/২ হাজার মানুষ ব্যালটের মাধ্যমে (অপ্রকাশ্যে) সমর্থন দিয়েছিল, বর্তমানে দলটির সারাদেশে দু’চারশ সদস্য/সমর্থক (প্রকাশ্য/অপ্রকাশ্য) থাকুক বা না থাকুক, সারাদেশে অফিস দু’চারটা থাকুক বা না থাকুক দলটি নিবন্ধন লাভের যোগ্য হয়ে গেল । অথচ নতুন করে দল নিবন্ধন পেতে গেলে অফিস ও কমিটি চালাতে হবে কমপক্ষে ১২৩টি এবং লিখিত/ প্রকাশ্য সম্মতিসহ নিবন্ধিত ভোটার সদস্য লাগবে কমপক্ষে ২০,০০০ (১০০ থানা/উপজেলা X২০০ সদস্য) জন ।

রাজনৈতিক দলের সকল স্তরের কমিটিতে ৩৩% নারী সদস্য অন্তর্ভূক্তির বাধ্যবাধকতা প্রয়োগের দুঃসাহস যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারতসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বের কোনো রাষ্ট্র কিংবা উন্নত বিশ্বের কোনো রাষ্ট্রও আজ পর্যন্ত দেখাতে পেরেছে বলে আমাদের জানা নেই । এমনকি এই শর্ত পূরণের মুচলেকা দিয়ে নিবন্ধন পাওয়া আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ কোনো দলই আজ অবধি (প্রায় ১০ বছরে) টার্গেট পূরণের ধারে কাছে পৌঁছূতে পারেনি । কাজেই এ আইন ধরে রাখা কার স্বার্থে ?

প্রিয় পাঠক, আপনারা সবাই অবগত আছেন যে, কোনো নিবন্ধন ছাড়াই আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে, একাধিকবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, বিএনপিও একাধিকবার ক্ষমতায় এসেছে, জাতীয় পার্টিও দেশ চালিয়েছে।  সরকার কর্তৃক এ আইনটিকে বাতিল করে দেবে এটাই ছিল রাজনীতি সচেতন দেশপ্রেমিক জনগণের প্রত্যাশা ।

এ আইনের শর্ত মেনে ও পূরণ করে যেসব দল ডিসেম্বর, ২০১৭ সালে নিবন্ধন লাভের প্রচেষ্টা চালিয়েছিল এদের অনেকের মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ । নির্বাচন কমিশনের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এমনভাবেই তদন্ত কাজ চালাচ্ছে যাতে করে সংশ্লিষ্ট দলের কর্মীরা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে নিজের অবস্থান অস্বীকার করতে বাধ্য হয়।অতএব, দারিদ্রপীড়িত, শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত, নিষ্পেষিত গণমানুষের কোনো সংগঠন গড়ে উঠতে পারবে না ।

এবার রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু তা নিয়েও একটু আলোচনা করা দরকার বলে মনে করি । দেশের মালিক হিসাবে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ ও সংগঠনের স্বাধীনতা নাগরিকদের সাংবিধানিক অধিকার। কাজেই কোনো রাজনৈতিক দল  গঠন ও পরিচালনা করতে নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা থাকতে পারে না । কিন্তু রাষ্ট্র শাসনে সরাসরি ভূমিকা রাখতে চাইলে অর্থাৎ নির্বাচন প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণ করতে চাইলে দলের জন্য সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী প্রতীক সংরক্ষণ করা, একই নামে একাধিক রাজনৈতিক দল যাতে গড়ে উঠতে না পারে তা নিশ্চিত করা এবং কোনো দল যাতে কোনোরূপ বেআইনী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে না পারে তা নিশ্চিত করা  প্রভৃতি লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে আমরা মনে করি । আবার যেহেতু ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকারের সকল পর্যায় পর্যন্ত দল বা দলীয় প্রতীক ভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে এবং সারা বছর ব্যাপী বিভিন্ন নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হতে থাকে সেহেতু ৫ বছর পর পর কিংবা শুধুমাত্র নির্বাচনের প্রাক্কালে দল নিবন্ধনের ব্যবস্থা থাকার কোন যুক্তি নেই ।

কাজেই সংসদের চলতি অধিবেশনেই ১৯৭২ সালের গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের কিছু ধারাসমূহ বাতিল করে আন্তর্জাতিক মানের নিবন্ধন আইনের অনুরূপ অর্থাৎ কেন্দ্রীয় কমিটি, কেন্দ্রীয় অফিস এবং দলীয় গঠণতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে দলসমূহের নিবন্ধনের বিধান চালু করা হোক এবং নিবন্ধন ব্যবস্থা শুধুমাত্র জাতীয় নির্বাচনের প্রাক্কালে নয় বরং সারা বছর চালু রাখা হোক ।

আবদুল মোনেম: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ গণমুক্তি পার্টি।

 

   

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে কী করা হচ্ছে



ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন (অবঃ)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ সাতবছর ধরে মিয়ানমার সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকটের বোঝা বহন করে চলছে। বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (এ এ) এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যেকার সংঘর্ষে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং এর পাশাপাশি এ এ’র তীব্র আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী (বিজিপি) এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর এদেশে পালিয়ে আসা একটা নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে এবং এর ধারাবাহিকতায় তাদেরকে ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম ও অন্যান্য প্রাশাসনিক কাজ বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ২৮৫ জন সদস্যকে মিয়ানমারের জাহাজে নৌপথে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রায় সাড়ে বার লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বহনের পাশাপাশি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কে এন এফ) সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষের ফলে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। নিরাপত্তার দৃষ্টিকোন থেকে এই ধরনের ঘটনা আদৌ কাম্য নয়। বাংলাদেশের এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, পার্বত্য চত্তগ্রামে কয়েক দশক ধরে চলমান সংঘাত পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে নিরসন করায় বেশ কয়েক দশক ধরে সেখানে শান্তি বিরাজ করছিল এর ফলে এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন বেগবান হয়েছিল।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুনরায় এই এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলো এবং কক্সবাজার জেলার সাথে আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্ত রয়েছে। কক্সবাজার ও এই অঞ্চল পর্যটনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে এই অঞ্চলের বিশেষ ভুমিকা আছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ পূর্বক শান্তি ফিরিয়ে আনা জরুরি।

কক্সবাজারে গত সাত বছর ধরে আশ্রয় নেয়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাবার কার্যক্রম ও উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে হলে ও সেখানে রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর সাথে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের জন্য একটা সহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি। বহু বছর ধরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে সেই পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্মম সেনাঅভিযানের আগে তাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকের মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল এবং এর পেছনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাত ছিল বলে জাতিসংঘের তদন্তে উৎঘাটিত হয়েছে। ফেসবুক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ২০২১ সালে রোহিঙ্গারা ফেসবুকের বিরুদ্ধে ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মামলা করে। এখন জাতিসংঘের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মিয়ানমারের (আইআইএমএম) তথ্য থেকে প্রমানিত হয়েছে যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গোপনে ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচারণা চালিয়েছিল।

তদন্তকারীদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, সেনাবাহিনী 'নিয়মতান্ত্রিক ও সমন্বিতভাবে' সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় ও ঘৃণা ছড়ানোর জন্য পরিকল্পিত উপাদান ছড়িয়েছিল। এসব বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিষয়বস্তু প্রায়ই রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে প্রচলিত বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে চালানো হয়। রোহিঙ্গারা সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ বা 'ইসলামীকরণের' মাধ্যমে মিয়ানমারের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সেখানে জানানো হয় এবং তারা বার্মিজ জাতিগত বিশুদ্ধতার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল। এসব প্রচারণার কারণে রাখাইনের সাধারণ জনগণও রোহিঙ্গা নিধনে অংশ নিয়েছিল। সেনাবাহিনীর বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারণার কারণে সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুকে মারধর, যৌন নিপীড়ন এবং হত্যা করা হয় ও তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এখনও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি এই মনোভাব দূর করতে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বা হয়েছে বলে জানা যায় নাই।

রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের আচরণ এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রাখাইনে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক ব্যবহার করে বুথিডং শহর জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্টদরা জানায় যে, রাখাইন রাজ্যে জাতিগত বিভাজনের বীজ বপন করতে জান্তা রোহিঙ্গা রিক্রুটদেরকে রাখাইনদের বাড়িঘর ও গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে বাধ্য করে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদানের বাধ্যবাধকতার আইন ঘোষণার পর রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের আটক করে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা হচ্ছে ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে রোহিঙ্গাদের ফ্রন্টলাইনে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী। রাখাইন রাজ্যে গত বছরের নভেম্বরে এ এ’র অভিযান শুরুর পর থেকে বেশ কিছু শহর এবং অনেক সেনা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী মার্চ মাসে বুথিডং, মংডু ও সিতওয়েতে এ এ’র বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা বিক্ষোভের আয়োজন করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভোলকার টার্ক সতর্ক করে জানিয়েছেন যে, রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে লড়াই ও উত্তেজনা বেসামরিক জনগণের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর ফলে অতীতের নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

গ্রুপ অব সেভেন (জি-সেভেন) দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ১৯ এপ্রিল ইতালির ক্যাপ্রিতে অনুষ্ঠিত জি-সেভেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির প্রয়োজনীয়তা এবং রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতিগত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছে। তারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে সহিংসতা বন্ধ, নির্বিচারে আটক সব বন্দির মুক্তি এবং একটি অর্থবহ ও টেকসই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে সব অংশীজনের সঙ্গে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপের আহ্বান জানায়। এটা একটা গঠনমূলক উদ্যোগ কিন্তু এর বাস্তবায়ন কবে হবে এবং রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে এর ভুমিকা তেমন স্পষ্ট নয়। আসিয়ান নেতৃবৃন্দ থাই সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র মায়াওয়াদ্দি অঞ্চলে তীব্র সংঘর্ষের পর সাম্প্রতিক সংঘাত বৃদ্ধিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং সংঘাতময় মিয়ানমারে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আসিয়ান মিয়ানমারের চলমান সঙ্কট নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত সাড়ে বার লাখ রোহিঙ্গা গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশে আশ্রিত এবং তাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া থমকে আছে। মিয়ানমারে চলমান সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করায় আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চায় এবং তারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হয়েছে। সীমান্ত এলাকা ঘেঁষে আরাকান আর্মির তৎপরতার পাশাপাশি নতুন করে কেএনএফ বেপরোয়া হয়ে ওঠায় সীমান্ত এলাকা অস্থির হয়ে উঠতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমার সীমান্তের অস্থিরতার সুযোগে কেএনএফ বেপরোয়া আচরণ করছে ও হামলা চালানোর সাহস পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার পার্বত্যাঞ্চলের আশপাশের সীমান্ত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলার কাজ করছে। অনেকের মতে এ এ’র সাথে কেএনএফের ভালো যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ভারতের মণিপুরের কুকিদের সঙ্গেও কেএনএফের যোগাযোগ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেএনএফসহ তিন দেশীয় সন্ত্রাসীদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে ওঠার বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সীমান্তে অস্থিরতার সুযোগ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও নিতে পারে। এর ফলে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এবং কক্সবাজার এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটতে পারে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অস্ত্রের লেনদেন এবং পরস্পরকে সহায়তা করার বিষয়টিও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। কেএনএফ পার্বত্য তিন জেলার প্রায় অর্ধেক এলাকায় তৎপর, তারা ‘কুকিল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কুকি সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতের মণিপুর ও মিজোরাম এবং মিয়ানমারে রয়েছে। ওই দুই দেশেও তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা আছে। কেএনএফ ভারতের মণিপুর, মিজোরাম এবং মিয়ানমারে সক্রিয়। ওই সব এলাকায় চলমান অস্থিরতার প্রভাবে কেএনএফ ফের তৎপর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলমান প্রেক্ষাপটে সীমান্ত এলাকায় আমাদের নজরদারি বাড়াতে হবে।

রাখাইনে জাতিগত বিদ্বেষ সহনীয় অবস্থায় আনার জন্য পদক্ষেপ নেয়া জরুরি এবং গত সাত বছরে ও রোহিঙ্গাদের প্রতি সামরিক জান্তার মনভাব পরিবর্তন না হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। রাখাইনের পরিস্থিতি যে রকমই হোক না কেন স্থানীয় জনগণের সাথে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সহবস্থান নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং প্রত্যাবাসনের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য সকল পক্ষকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। রাখাইনের উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু ও তা অব্যাহত রাখতে হবে যাতে দারিদ্র পীড়িত জনগণের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয় । অর্থনৈতিক মুক্তি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার তিক্ত সম্পর্কের সুন্দর সমাধান হতে পারে। মিয়ানমার ও রাখাইনের রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সবাইকে পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন একটা সহনশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের এই সীমান্ত অঞ্চলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে শক্তহাতে এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। স্থায়ীভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে হলে সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে তাই এ বিষয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অবঃ)
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

;

আকাশ পথে স্বপ্নযাত্রার সঙ্গী ইউএস বাংলা



মো. কামরুল ইসলাম
আকাশ পথে স্বপ্নযাত্রার সঙ্গী ইউএস বাংলা

আকাশ পথে স্বপ্নযাত্রার সঙ্গী ইউএস বাংলা

  • Font increase
  • Font Decrease

ইউএস- বাংলা। এটা শুধু একটা নাম নয়। এটা একটা স্বপ্নের নাম। বাংলাদেশের একটি অন্যতম বেসরকারী এয়ারলাইন্স এটি। ইউএস-বাংলা আকাশে ডানা মেলে স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে। একের পর এক সাফল্য যেন এই স্বপ্নের পরিধি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে সেরাদের সেরা হয়ে উঠছে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স। আকাশপথে ভ্রমণকারীদের চাহিদার শীর্ষে অবস্থান করছে ইউএস- বাংলা এয়ারলাইন্স। সাধারণ যাত্রীরা ভ্রমণ পরিকল্পনায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকেই বেছে নিচ্ছেন। বিমান যাত্রীরা যেন শুধু ইউএস-বাংলাকেই বেছে নিচ্ছেন না, তারা বেছে নিচ্ছেন ইউএস- বাংলার স্বপ্নকেও। যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মানুন।

বাংলাদেশের বেসরকারী বিমানসংস্থা হিসেবে প্রথমবারের মতো ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবীতে ফ্লাইট শুরু করে ইতিহাস স্থাপন করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। গত শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) বাংলাদেশ এভিয়েশন তথা বেসরকারী এয়ারলাইন্সের ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে বেসরকারী এই বিমান সংস্থা। বর্তমানে দুবাই, শারজাহ এর পর মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের তৃতীয় গন্তব্য আবুধাবীতে ফ্লাইট শুরু করেছে ইউএস-বাংলা। দুবাই, শারজাহ ছাড়া বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গন্তব্য মাস্কাট, দোহা, প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, মালে, পর্যটক বান্ধব অন্যতম গন্তব্য ব্যাংকক ও চীনের অন্যতম বাণিজ্যিক শহর গুয়াংজু, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা ও চেন্নাইতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। আন্তর্জাতিক রুট ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে বিশেষ করে ঢাকা থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর, যশোর ও রাজশাহী ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।

এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মান বাংলাদেশের এভিয়েশনকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উন্নিত করার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের পরিধি বিস্তার করে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে বিমান অবতরণের সুযোগ করে দিচ্ছে। যশোর, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের টার্মিনালকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ও রানওয়ের সম্প্রসারণ দেশের এভিয়েশনের অগ্রযাত্রাই নির্দেশ করছে। এরমধ্য দিয়ে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে দেশের অন্যতম বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সাথে কক্সবাজার ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নিত করার চেষ্টায় লিপ্ত বাংলাদেশ সরকার। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নিত করলে ভারতের সাতকন্যা খ্যাত রাজ্যগুলো, নেপাল ও ভুটানের সাথে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো বেশী জোরদার হবে।

বর্তমানে আটটি বিমানবন্দর দেশের অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের আকাশ পথকে ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছে। যা মানচিত্রের অর্ধেক জনগোষ্টিকে সেবা দিয়ে থাকে। বর্তমানে চালু বিমানবন্দরগুলো হচ্ছে- ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর. চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিলেটের এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যশোর বিমানবন্দর, রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দর, সৈয়দপুর বিমানবন্দর ও বরিশাল বিমানবন্দর।

যাত্রা শুরুর পর দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থেকে একটি এয়ারলাইন্স যাত্রীদের চলার পথে যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠে। যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠতে অন-টাইম পারফর্মেন্স, নিরাপত্তা, ইন-ফ্লাইট সার্ভিস জরুরী হয়ে উঠে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই যাত্রা শুরুর পর থেকে ৯০ শতাংশের উপর ফ্লাইট অন-টাইম বজায় রেখে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে। এয়ারক্রাফটের পর্যাপ্ততা একটি এয়ারলাইন্স এর এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় ভূমিকা রাখে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স দু’টি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট দিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন বহরে যুক্ত করেছে ২৪টি এয়ারক্রাফট। যার মধ্যে ২টি এয়ারবাস ৩৩০-৩০০, ৯টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ১০টি এটিআর ৭২-৬০০ ও ৩টি ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট রয়েছে। খুব শীঘ্রই অভ্যন্তরীণ রুটকে শক্তিশালী করার জন্য আরো একটি এটিআর ৭২-৬০০ এয়ারক্রাফট যুক্ত করতে যাচ্ছে। অন-টাইম পারফর্মেন্স বজায় রেখে অভ্যন্তরীণ সকল রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পর আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রীদের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। ২০১৬ সালের ১৫ মে ঢাকা থেকে কাঠমুন্ডু রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যাত্রা শুরু করে। একের পর এক নতুন নতুন আন্তর্জাতিক গন্তব্য শুরু করতে থাকে ইউএস-বাংলা। যাত্রীদের চাহিদাকে পরিপূর্ণতা দিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ফ্লাইট সিডিউল ঘোষণা করছে। নূন্যতম ভাড়ায় ভ্রমণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। পর্যটকদের ভ্রমণকে আরো বেশী আকর্ষণীয় করতে নানা ধরনের ভ্রমণ প্যাকেজ ঘোষণা করছে। ইএমআই সুবিধা দিয়ে প্যাকেজ ঘোষণা পর্যটকদের ভ্রমণ পরিকল্পনাকে সহজতর করে দিচ্ছে। কলকাতা কিংবা চেন্নাইয়ে চিকিৎসার জন্য ভ্রমণ করলে এ্যাপোলো হাসপাতালে ডিসকাউন্ট অফার দিচ্ছে ইউএস-বাংলা। ইউএস-বাংলায় ভ্রমণকে উৎসাহিত করার জন্য ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লাইয়ার প্রোগ্রাম “স্কাইস্টার” চালু রয়েছে শুরু থেকেই। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গন্তব্য মালদ্বীপের রাজধানী মালের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে। যার ফলে ভারত মহাসাগরের নীলাভ সৌন্দর্য দর্শনে পর্যটকরা ঢাকা থেকে মালে ভ্রমণ করছে। বিভিন্ন ধরণের প্যাকেজ সুবিধা নিয়ে মালদ্বীপের আকর্ষণীয় দ্বীপগুলোতে ভ্রমণ করছে। মধ্যপ্রাচ্যে পর্যটকদের আকর্ষণীয় গন্তব্য দুবাই, শারজাহ ভ্রমণে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিদিন ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত মাস্কাট ও দোহাতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা। সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক কিংবা গুয়াংজু রুটে বাংলাদেশি যাত্রীদের পছন্দক্রমে ইউএস-বাংলা অগ্রগণ্য। যাত্রী বিবেচনায় প্রবাসী শ্রমিক ও পর্যটকরা আরামদায়ক আসন ব্যবস্থা, ইনফ্লাইট সার্ভিস, সর্বোপরি অন-টাইম পারফর্মেন্স ইউএস-বাংলাকে পছন্দক্রমে এগিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সসমূহের এর দশ বছর অতিক্রমকাল অত্যন্ত জটিল ও ক্যালকুলেটিভ। বিগত দিনে বন্ধ হওয়া বিমানসংস্থা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ কিংবা জিএমজি এয়ারলাইন্স দশ বছর অতিক্রমকালীন সময়ে চরম বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে বন্ধ হওয়ার মিছিলে যোগ দিয়েছে। ঠিক সেই সময়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স তার বিমান বহরে যোগ করে চলেছে আধুনিক ওয়াইড বডি এয়ারবাস ৩৩০ এয়ারক্রাফট। সাথে গন্তব্যের পরিধিও বৃদ্ধি করে চলেছে। প্রতিনিয়ত যাত্রীদের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠছে ইউএস-বাংলা। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জগৎখ্যাত এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে সেবা দিয়ে প্রতিযোগিতা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানচিত্রকে সমুন্নত রেখে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সেবাকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবসার পরিধির বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। পছন্দক্রমে যাত্রীরা ইউএস-বাংলাকে অগ্রগণ্য করেছে। স্বাধীনতা লাভের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বল্পতম জীবদ্দশায় বেশ কতগুলি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। তার মধ্যে জাতীয় বিমান সংস্থা গঠন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় লাভের পর মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারী জাতীয় বিমান সংস্থা গঠন করে এবং ঠিক এক মাস পর ৪ ফেব্রুয়ারী প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা করে। সর্বাধিক অগ্রাধিকারের মধ্যে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন গঠন করেন ১৯৭৩ সালে। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের জীবদ্দশায় দেয়া দিক নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলছে উন্নয়নের সোপানে।

১৭ কোটির অধিক জনসংখ্যার দেশে প্রায় ১৩/১৪ মিলিয়ন নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের সূত্রে কিংবা শিক্ষার বা চিকিৎসার কারনে, ভ্রমণের সূত্রে আকাশপথ ব্যবহার করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারের প্রায় ৭৫ ভাগ বিদেশি এয়ারলাইন্স এর দখলে সেখানে দেশীয় এয়ারলাইন্স এর কাছে মাত্র ত্রিশভাগ যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারেনা। আরো বেশ কিছু বিদেশী এয়ারলাইন্স এর আগমনে অপেক্ষায় বাংলাদেশের এভিয়েশন।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এর প্রসার বাংলাদেশ এভিয়েশন যেন কিছুটা পজিটিভ মেরুকরনের গতিপথ পাওয়ার আশা করছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ার বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকছে বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সের। দেশীয় এয়ারলাইন্সের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পসহ হোটেল ইন্ডাস্ট্রিও ঘুরে দাড়ানোর সুযোগ পাবে।

বাংলাদেশের যাত্রীদের উপর ভিত্তি করে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সাজায় অথচ বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সগুলো সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না, তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। বাংলাদেশিরা পৃথিবীর অনেক জাতি থেকেই অনেক বেশী দেশপ্রেমিক। কিন্তু সেই দেশাত্ববোধকে সম্মানের জায়গায় রেখে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোকে সেবা প্রদান করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশি যাত্রীরা বিদেশী এয়ারলাইন্সের তুলনায় দেশীয় এয়ারলাইন্সে ভ্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিবে। ফলে শুধু এয়ারলাইন্সের আয় বাড়বে না, দেশীয় জিডিপিতে অধিক অংশগ্রহণ দেখা যাবে। বেকারত্ব দূরীকরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশি প্রবাসীরা পৃথিবীর যেসকল দেশে বসবাস করছে সবখানেই বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইট পরিচালনা করবে, একজন এভিয়েশন কর্মী হিসেবে সব সময়ের প্রত্যাশা। জাতীয় বিমান সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারী বিমান সংস্থা বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে এই স্বপ্ন প্রতিনিয়ত দেখি একজন বেসরকারী এয়ারলাইন্সের কর্মী হিসেবে। নীতি নির্ধারকগণ সবক্ষেত্রে জাতীয় বিমান সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারী এয়ারলাইন্স এর গুরুত্ব অনুধাবন করে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী করে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ করে দিলে বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলোর এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হবে। পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে এয়ারলাইন্সগুলোর স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করলে বাংলাদেশ এভিয়েশন এগিয়ে যাবে। বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে সহায়তা করবে। সুবর্ণ সময়ের প্রত্যাশায় স্বপ্ন দেখি আর স্বপ্ন উড়াই বাংলাদেশ এভিয়েশনে।

লেখক: মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

;

হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ের ক্ষতিতে বিপদের ‘রেডএলার্ট‘



মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ের ক্ষতিতে বিপদের ‘রেডএলার্ট‘

হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ের ক্ষতিতে বিপদের ‘রেডএলার্ট‘

  • Font increase
  • Font Decrease

 

কেন বাংলাদেশের মতো একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ দেশ আবহাওয়ার চরম আচরণের মুখোমুখি হচ্ছে? এই প্রশ্ন এখন সবাইকে ভাবচ্ছে এবং এই মারাত্মক সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা করছে সবাই।

এজন্য ভাবাচ্ছে যে, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি অন্যায় আচরণের প্রতিফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশও। চরম উষ্ণতার দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশের আবহাওয়া। বৈশাখের শুরুতেই যে তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে, সামনের মাসগুলোতে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে চরমতম হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। বন-জঙ্গল-বৃক্ষ কেটে সাফ করা, নদী ভরাট করে দখল করা, পাহাড় কর্তন করা, এমনকি, প্রাকৃতিক জলাধার, মাছ ও জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য হাওরের পরিবেশ-প্রকৃতিতে বিকৃতি সাধন করার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের কুফল ক্রমেই ঘিরে ধরেছে সবাইকে। আর এসব কারণে বাড়ছে বিপদ আর ভবিষ্যতের দিনগুলোতে অপেক্ষা করছে আরও বড় আকারের বিপর্যয়।

বিগত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির চরম আঘাত বাংলাদেশেও সরাসরি টের পাওয়া যাচ্ছে নানাভাবে ও নানা দিক থেকে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা বিপদের যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা আস্তে আস্তে বাস্তব আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশও এই বিপদের মুখোমুখি হয়েছে স্থানীয় ক্ষেত্রে অসতর্কতার কারণে। যেমন:

এক) একদা নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশে চলছে প্রচণ্ড দাবদাহ। তাপে পুড়ছে দেশের কয়েকটি অঞ্চল। গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত মানুষের। বিরূপ পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সাত দিনের জন্য। কোথাও কোথাও হিটস্টোকে আক্রান্ত হওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

দুই) ঢাকার বায়ু লাগাতার ভাবে অস্বাস্থ্যকর থাকার রেকর্ড করছে। বিশ্বের শীর্ষ দুষিত বায়ুর শহরের তালিকায় নিজের স্থান করে নিয়েছে ঢাকা, যেখানে বসবাস দিনে দিনে বিপদজনক হচ্ছে আর বাড়ছে নানা রোগের প্রকোপ।

তিন) চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার জন্য ভূমিধস হচ্ছে বৃষ্টির দিনগুলোতে। যেজন্য ঘটছে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি।

চার) পাহাড়ের প্রাকৃতিক বিন্যাস নষ্ট হচ্ছে। রিসোর্ট, সুইমিং পুল ও অন্যান্য বিতর্কিত উন্নয়নের কারণে সেখানে ক্ষতি হচ্ছে মানুষ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের।

পাঁচ) মধুপুর, ভাওয়ালসহ দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে থাকা বণাঞ্চলগুলো দখলের জন্য গাছ কাটা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে অবাধে, যা প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট করছে।

ছয়) দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নদ-নদী দখল ও দুষণের শিকার। নদী ক্ষীণ হতে হতে খালে পরিণত হয়েছে বা লুপ্তই হয়ে গেছে। শিল্পায়নের বর্জ্য অনেক নদীকে এবং নদীর জীব ও উদ্ভিদ গোষ্ঠীকে মেরে ফেলছে। জল নিষ্কাষণ ব্যাহত হয়ে বাড়িয়েছে জলাবদ্ধতা।

সাত) পূর্ব-মধ্যাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে যে বিশাল হাওরাঞ্চল, সেখানেও চলছে বিপর্যয়। প্রাকৃতিক এই জলাধারের কিশোরগঞ্জ অংশে রাস্তা, রিসোর্ট ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের ফলের উজানের বৃহত্তর সিলেটে নজিরবিহীন বন্যা হয়েছে। হাওরের মিঠা পানির মাছের বংশ বিস্তার ও আবাদ হ্রাস পেয়েছে। নানা রকমের জ্বালানি, পলিথিন, ব্যবহার্য বস্তু ও কেমিক্যালের ব্যবহারে পানির মান দুষিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক অঞ্চলটিও নদী, পাহাড় ও বনের মতো দখলের কারণে রয়েছে অবলুপ্ত হওয়ার আতঙ্কে।

কিশোরগঞ্জের হাওরে ঘটেছে আরেকটি মারাত্মক পরিবেশ হানিকর ঘটনা। বার্তা২৪.কম-এর স্থানীয় প্রতিনিধি সরেজমিন তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছেন, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সেলিব্রিটিরাও ধুমধাম করে হাওরে উদ্বোধন করেছেন সড়ক-আলপনা। কিন্তু এই সাময়িক সৌন্দর্য একসময় প্রকৃতির হুমকি হবে এটি চিন্তার মধ্যে আনেননি কেউ। কদিন পরেই হাওরে আসবে নতুন পানি। আর এই রঙের প্রভাব কতটুকু ক্ষতির কারণ হবে তাই নিয়ে এখন চলছে তুমুল আলোচনা।

খবরে প্রকাশ, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সম্প্রতি হাওরের অল-ওয়েদার সড়কের মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার জুড়ে দৃষ্টিনন্দন আলপনা আঁকা হয়েছে। আলপনার এসব রং বৃষ্টিতে ধুয়ে হাওরের পানিতে মিশলে তা হাওরে মাছের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো রঙে স্বাভাবিকভাবে নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে। হাওরের সড়কে আঁকা আলপনায় যে পরিমাণ রঙ ব্যবহার হয়েছে, তাতে থাকা রাসায়নিকের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেখানকার জলজ উদ্ভিদ, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণি।

সাধারণত, প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে জীববৈচিত্র্যময় স্পটগুলোকে রাসায়নিক ও কেমিক্যাল পদার্থ থেকে দূরে রাখতে হয়। সেখানে পলিথিন চলে না। বায়ুদূষণ রোধে যান্ত্রিক যান চলে না। শব্দ দুষণ বন্ধ রাখা হয়। সব ধরনের দুষণ বন্ধ রাখা হয়। হিমালয়ে, কাশ্মীরে, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের শৈলশহরগুলোতে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

পক্ষান্তরে, কিশোরগঞ্জের হাওরে চলছে ফ্রি-স্টাইল অবস্থা। নদী আটকে হয়েছে রাস্তা। সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো হয়েছে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, বাণিজ্যিক স্থাপনা। শত শত ইঞ্জিন চালিত নৌকা থেকে পোড়া তেল-মবিল ভাসছে পানিতে। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন হাওরের মিঠামইন, অষ্টগ্রাম অংশে ঘুরতে গিয়ে নদীতে ফেলে আসছে অদ্রবীভূত প্যাকেট, বর্জ্য ও আবর্জনা। চরম নৈরাজ্যের কারণে প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হাওর এখন চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি।

ব্যক্তিগতভাবে কারো কারো ব্যবসা বা লাভ হলেও হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ের ক্ষতিতে সমগ্র জাতি বিপদের ‘রেডএলার্ট‘-এর সম্মুখীন। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপদ, আবহাওয়ার বৈরী আচরণ, চরম ভাবাপন্ন পরিস্থিতিকে ‘আসমানি গজব‘ বলে নিজেকে সাধু বানানোর সুযোগ নেই। কতিপয় মানুষ ও গোষ্ঠী কর্তৃক হাওর, নদী, বন, পাহাড় তথা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের চরম ক্ষতি সাধনের প্রতিফল হলো এইসব বিপদ। যাদের কারণে পুরো দেশের আবহাওয়া, পানি, বায়ু, পরিবেশ হচ্ছে বিপর্যস্ত। সমগ্র জাতি বিপদাপন্ন।

বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্টভাবে পবিবেশ রক্ষায় অঙ্গীকারবাদ্ধ। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে সরকার আগ্রহী ও সচেতন। তারপরেও হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ে সীমাহীন ক্ষতির ঘটনা ঘটছে। এসব অপকর্ম কেউ লুকিয়ে করছে না। সরকার ও প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়েই হচ্ছে। এতে দেশ ও জাতি প্রাকৃতিক বিপর্যয় কবলিত হচ্ছে। দেশে সামগ্রিক জলবায়ু ও আবহাওয়া ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

সামনের দিনগুলোতে বিপদ যখন আরও ভয়াবহ আকার নেবে, তখন পরিস্থিতি হবে আরও মারাত্মক। বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিপদ রোধে চুপ থাকার অর্থ হলো জেনেশুনে ক্ষতির পথকে প্রসারিত করা। সরকার, সুশীল সমাজ, পরিবেশবাদীগণ এবং আমজনতার তরফে হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ে চলমান ক্ষতিকর কাজের বিরুদ্ধে আর চুপ করে থাকার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এখনই ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে না দাঁড়ালে ‘বিপদের ‘রেডএলার্ট‘ অচীরেই সবাইকে গ্রাস করবে।

 

;

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়



তোফায়েল আহমেদ
মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

মুজিবনগরে স্বাধীনতার সূর্যোদয়

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রতি বছর জাতীয় জীবনে ‘মুজিবনগর দিবস’ ফিরে আসে এবং এবছর ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবসের ৫৩তম বার্ষিকী যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হচ্ছে। ১৭৫৭-এর ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে স্বাধীনতার যে সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১-এর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের মুজিবনগরের আম্রকাননে স্বাধীনতার সেই সূর্য উদিত হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের স্মৃতিকথা লিখতে বসে কতো কথা আমার মানসপটে ভাসছে। পঁচিশে মার্চ  দিনটির কথা বিশেষভাবে মনে পড়ছে। এদিন মণি ভাই এবং আমি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে বিদায় নেই। বিদায়ের প্রাক্কালে তিনি বুকে টেনে আদর করে বলেছিলেন, ‘ভালো থেকো। আমার দেশ স্বাধীন হবেই। তোমাদের যে নির্দেশ দিয়েছি তা যথাযথভাবে পালন করো।’

পঁচিশে মার্চ রাতে আমরা ছিলাম মতিঝিলের আরামবাগে মণি ভাইয়ের বাসভবনে। রাত বারোটায় অর্থাৎ জিরো আওয়ারে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পূর্বপরিকল্পিত ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নীলনকশা অনুযায়ী বাঙালি নিধনে গণহত্যা শুরু করে। চারদিকে প্রচ- গোলাগুলি। এক রাতেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী লক্ষাধিক লোককে হত্যা করে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। ছাব্বিশে মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনি। ভাষণে তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করা হয়েছে। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের আরো আগেই গ্রেফতার করা উচিত ছিল, আমি ভুল করেছি।’ ‘দিস টাইম হি উইল নট গো আনপানিস্ড।’ তারপর কারফিউ জারি হয় এবং ছাব্বিশে মার্চেই চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’র কথা বারবার প্রচার করে বলছেন, “বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ প্রদান করে বলেছেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারীর মোকাবিলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে’।”

এরপর দুই ঘন্টার জন্য কারফিউ শিথিল হলে আমরা কেরানিগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামান সাহেব; মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি সহ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী সাহেব এবং কামারুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে ভারতের দিকে যাবো। আমাদের এই যাত্রাপথ আগেই ঠিক করা ছিল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে সিরাজগঞ্জের কাজিপুর থেকে নির্বাচিত এমসিএ (গবসনবৎ ড়ভ ঈড়হংঃরঃঁবহঃ অংংবসনষু) ডাক্তার আবু হেনাকে বঙ্গবন্ধু যে পথে কলকাতা পাঠিয়েছিলেন, সেই পথেই আবু হেনা আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের জন্য আগেই বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছেন। ক্ষমতা হস্তান্তর প্রশ্নে ভুট্টো যখন টাল-বাহানা শুরু করে তখন ’৭১-এর ১৮ ফেব্রুয়ারি ধানম-ির ৩২ নম্বরের বাসভবনে জাতির জনক জাতীয় চার নেতার সামনে আমাদের এই ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন, ‘সানি ভিলা, ২১ নম্বর রাজেন্দ্র রোড, নর্দার্ন পার্ক, ভবানীপুর, কলকাতা।’ বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘এখানে  তোমরা থাকবে। তোমাদের জন্য সব ব্যবস্থা আমি করে রেখেছি।’ ২৯ মার্চ কেরানিগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া হয়ে এপ্রিলের ৪ এপ্রিল আমরা ভারতের মাটি স্পর্শ করি এবং সানি ভিলায় আশ্রয় নেই। এখানে আমাদের সাথে দেখা করতে আসেন-পরে বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী-জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম।

১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নবনির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ গঠন করে, মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলাকে ‘মুজিবনগর’ নামকরণ করে রাজধানী ঘোষণা করা হয় এবং জারি করা হয় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ তথা ‘চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব’। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাকে অনুমোদন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে আরো যা ঘোষিত হয় তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘সংবিধান প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন এবং রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।’ রাষ্ট্রপতি শাসিত এই ব্যবস্থায় ‘ক্ষমা প্রদর্শনের ক্ষমতাসহ সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতা’, ‘একজন প্রধানমন্ত্রী এবং প্রয়োজন মনে করিলে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের’ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হস্তে ন্যস্ত করার বিধান রাখা হয়। এছাড়াও যেহেতু বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, সেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই মর্মে বিধান রাখা হয় যে, ‘কোন কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করিতে না পারেন অথবা তাহার দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অক্ষম হন, তবে রাষ্ট্রপ্রধান প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।’ ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক জাতীয় নেতা উপ-রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন এবং জাতীয় নেতা তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী. জাতীয় নেতা এএইচএম কামারুজ্জামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দান করেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিপরিষদের সভায় কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়। ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’-এই সাংবিধানিক দলিলটির মহত্তর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে আমরা ‘বাংলাদেশ গণপরিষদ’ সদস্যগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলাম, ‘আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ছাব্বিশে মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে।’ অর্থাৎ যেদিন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেছিলেন সেই দিন থেকে কার্যকর হবে। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অনুসারে প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ মোতাবেক স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ১০ এপ্রিল ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক মুজিবনগরে।

সে-সময় তাজউদ্দীন ভাইয়ের সাথে সীমান্ত অঞ্চল পরিদর্শন করেছি। একটি বিশেষ প্লেনে তাজউদ্দীন ভাই, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মণি ভাই এবং আমি যখন শিলিগুঁড়ি পৌঁছাই, তখন সেখানে পূর্বাহ্নে ধারণকৃত তাজউদ্দীন ভাইয়ের বেতার ভাষণ শুনলাম। বাংলার মানুষ তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে আপোষহীন, এককাতারে দ-ায়মান। পরবর্তীতে ১৭ এপ্রিল যেদিন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের তারিখ নির্ধারিত হয়, তার আগে ১৬ এপ্রিল গভীর রাতে-মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমি-আমরা মুজিব বাহিনীর চার প্রধান, একটা গাড়িতে করে রাত তিনটায় নবগঠিত সরকারের সফরসঙ্গী হিসেবে কলকাতা থেকে রওয়ানা করি সীমান্ত সন্নিহিত মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলা তথা স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরের উদ্দেশে। সূর্যোদয়ের সাথে সাথে প্রবেশ করি প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তাঞ্চল মেহেরপুরের আ¤্রকাননে। আমাদের সঙ্গে দেশি-বিদেশি অনেক সাংবাদিক ছিলেন। কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল। আশঙ্কা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী সেখানে বোমা হামলা চালাতে পারে। মেহেরপুরসহ আশপাশের এলাকা থেকে প্রচুর লোকসমাগম হয়েছিল। মুহুর্মুহু ‘জয় বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস তখন মুখরিত। আন্তর্জাতিক বিশ্ব বিস্ময়ের সাথে প্রত্যক্ষ করছিল নবীন এক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের উদ্ভব। দিনটি ছিল শনিবার। সকাল ১১টা ১০ মিনিটে পশ্চিম দিক থেকে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ দৃপ্ত পদক্ষেপে মঞ্চের দিকে এলেন। দেশ স্বাধীন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সমবেত সংগ্রামী জনতা আমাদের সাথে সমস্বরে গগনবিদারী কণ্ঠে মুহুর্মুহু ‘জয়বাংলা’ রণধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে তুললো। মুজিবনগরে শপথ অনুষ্ঠান স্থলে একটি ছোট্ট মঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রথমে মঞ্চে আরোহন করেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুবউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সশস্ত্র দল রাষ্ট্রপ্রধানকে ‘গার্ড অব অনার’ প্রদান করেন। এরপর মঞ্চে আসেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রীপরিষদ সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। উপস্থিত স্বেচ্ছাসেবকগণ পুষ্পবৃষ্টি নিক্ষেপ করে নেতৃবৃন্দকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। সরকারের মুখপত্র ‘জয়বাংলা’ পত্রিকার সম্পাদকম-লীর সভাপতি আবদুল মান্নান, এমসিএ’র উপস্থাপনায় শপথ অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়। প্রথমেই নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক দলিল ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ পাঠ করেন চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। পবিত্র ধর্মগ্রন্থ থেকে মুক্তির বাণীসমূহ পাঠ করা হয়।

আকাশে তখন থোকা থোকা মেঘ। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে বাংলা মায়ের চারজন বীরসন্তান প্রাণ ঢেলে গাইলেন জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। উপস্থিত সকলেই তাদের সাথে কণ্ঠ মিলালাম। অপূর্ব এক ভাবগম্ভীর পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছিল তখন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ইংরেজিতে প্রদত্ত ভাষণের শুরুতে বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে আমি তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ করেছি এবং তাঁর পরামর্শক্রমে আরও তিনজনকে মন্ত্রীরূপে নিয়োগ করেছি।’ এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদ সদস্যবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। তারপর ঘোষণা করেন প্রধান সেনাপতি পদে কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ পদে কর্নেল আবদুর রবের নাম। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর আবেগময় ভাষণের শেষে দৃপ্তকণ্ঠে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণনন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের পর তাজউদ্দীন আহমদ অভূতপূর্ব ও অবিস্মরণীয় বক্তৃতায় বলেন, ‘পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন।’ মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে বক্তৃতার শেষে তিনি বলেন, ‘আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড়ো জাতির বন্ধুত্ব।’ ‘বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশী দাবীদার হতে পারে না। কেননা, আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর সংগ্রাম করেনি। জয়বাংলা।’ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই তৎকালীন বাস্তবতায় যা বলার প্রয়োজন ছিল তা-ই তাঁরা বলেছেন। আমাদের শীর্ষ দুই নেতার এই দিকনির্দেশনামূলক ভাষণ ছিল ঐতিহাসিক এবং অনন্য। জাতীয় নেতৃবৃন্দ, নির্বাচিত এমসিএ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, আন্তর্জাতিক ও জাতীয় খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিকগণ, পাবনার জেলা প্রশাসক জনাব নুরুল কাদের খান, মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক জনাব তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীসহ আরো অনেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে প্রতিনিধিদের ইচ্ছার শতভাগ প্রতিফলন ঘটিয়ে রাজনৈতিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণœ রেখে, সাংবিধানিক বৈধতা অর্জন করে সেদিন রাষ্ট্র ও সরকার গঠিত হয়েছিল। আর এসব কিছুর বৈধ ভিত্তি ছিল বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে তথা ’৭১-এর এপ্রিলের ১০ ও ১৭ তারিখে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র ও সরকারের শপথ অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রধানতম লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় সাংবিধানিক বৈধতা নিশ্চিত করে সমগ্র বিশ্বের সমর্থন নিয়ে জনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সুমহান বিজয় ছিনিয়ে আনা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেরাদুনে মুজিব বাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে শপথের সময় আমরা সমস্বরে বলতাম, ‘বঙ্গবন্ধু মুজিব, তুমি কোথায় আছ, কেমন আছ আমরা জানি না। কিন্তু যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি এবং তোমাকে মুক্ত করতে না পারবো, ততদিন আমরা মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী দিনগুলোতে বাঙালির চেতনায় বন্দী মুজিব মুক্ত মুজিবের চেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিলেন। যারা ষড়যন্ত্রকারী তাদের হোতা খুনি মুশতাক তখনই আমাদের কাছে প্রশ্ন তুলেছিল, ‘জীবিত মুজিবকে চাও, না স্বাধীনতা চাও।’ আমরা বলতাম, ‘আমরা দু’টোই চাই। স্বাধীনতাও চাই, বঙ্গবন্ধুকেও চাই।’ ত্রিশ লক্ষ প্রাণ আর দু’ লক্ষ মা-বোনের সুমহান আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বঙ্গবন্ধু মুজিবকে মুক্ত করতে পেরেছিলাম।

প্রথম সরকারের শপথ অনুষ্ঠানের এই মহান দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতা সর্বজনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানের অমর স্মৃতি গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। জাতীয় চার নেতা জীবনে-মরণে বঙ্গবন্ধুর পাশে থেকেছেন। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে থেকেছেন, মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন, কিন্তু বেঈমানী করেননি। ইতিহাসের পাতায় তাঁদের অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। প্রিয় মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তাঁরা যে আত্মদান করেছেন সেই আত্মদানের ফসল আজকের এই স্বাধীন ওসার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসে জাতীয় নেতৃবৃন্দের বীরত্বপূর্ণ অবদানের কথা সর্বত্র স্মরণ করা উচিত। জাতীয় ইতিহাসের গৌরবময় দিনগুলো যথাযথ মর্যাদায় স্মরণ করে জাতীয় মর্যাদা ও গৌরব বৃদ্ধিই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

লেখক: উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; সদস্য, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।

;