কলকাতার সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর নবাব
নবাব যখন কলকাতায় এলেন, তার কিছুদিন পরেই ঘটতে থাকে নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে ভারত শাসনের দায়িত্ব রানির হাতে যাওয়া দিয়ে শুরু; শেষ পর্বে ১৮৮৫-তে তৈরি হয়েছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। মাঝে একের পর এক ধর্ম ও সমাজ সংস্কার আন্দোলনে কলকাতা উত্তাল। কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলায় তখন নবজাগরণের ঢেউ।
সে সময় কলকাতায় জাগছে বাঙালি জাতি, তৈরি হচ্ছে ভারতীয় জাতীয়তাবাদ, পুনরুত্থান হচ্ছে হিন্দু ধর্মের। নেতৃত্ব দিচ্ছেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭-১৯০৫), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১), যারা নবাব ওয়াজিদ আলীরই সমসাময়িক। নবাব কিন্তু এ সবের বাইরে ছিলেন না। তবে তিনি ছিলেন কাছে থেকেও দূরে। কারণ পশ্চিমি কেতার প্রতি তাঁর দুর্বলতা ছিল না। তাঁর ছিল ঐতিহ্য ও নিজস্বতার প্রতি অনুরাগ। তাঁর আমলে লক্ষ্ণৌতে সাংস্কৃতিক জীবনে হিন্দু-মুসলমানের পুরাণ, উপকথা, লোকগাথার বিশেষ প্রভাব। মেটিয়াবুরুজেও তা বদলায়নি। তিনি উপমহাদেশের সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে লালন করেছেন। নিজস্বতার মধ্যে রেনেসাঁ খুঁজেছেন। বাইরের ধার করা কিছু দিয়ে নবজাগরণ করতে চান নি।
নবাব ওয়াজিদ আলির বিরুদ্ধে কোম্পানির শাসনকর্তাদের অভিযোগগুলি খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, ইংরেজের কাছে যে যে কারণে তিনি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেননি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে সেই কারণগুলির জন্যই তিনি পথিকৃতের মর্যাদা পেতে পারেন। রমণীবিলাস (সারা জীবনে তাঁর স্ত্রীর সংখ্যা প্রায় ৩৭৫ জন) ছাড়া তাঁর নাচ-গানে অতিরিক্ত আসক্তিই ব্রিটিশের আপত্তির প্রধান কারণ ছিল। অথচ কেউ কেউ তাঁকে হিন্দুস্তানি থিয়েটারের প্রথম নাট্যকার বলে বর্ণনা করেছেন। তখনও তিনি নবাব হননি, ১৮৪৩ সালে ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসার আয়োজন করেন ওয়াজিদ আলি। সেখানে নিজের লেখা নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেন। এই কিস্সাকেই বলা যায় প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। কৃষ্ণ ছিলেন তাঁর রোল মডেল। যমুনাতীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা নবাবের চিরকালীন অনুপ্রেরণা ছিল। কৃষ্ণের রাসলীলা থেকেই লখনউয়ে ‘রহস’-এর সৃষ্টি। ওয়াজিদ আলির রহস বস্তুত অপেরা, যেখানে তিনি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নৃত্যের সঙ্গে নিজস্ব কত্থকের কম্পোজিশন মিলিয়েছিলেন। রহস নাটক হল নৃত্যনাট্য, যেখানে নির্দিষ্ট গল্প থাকত। লখনউয়ে নবাবির সময় ওয়াজিদ আলি মোট চারটি জলসার আয়োজন করেন, আর মেটিয়াবুরুজে ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৫-এর মধ্যে অন্তত ২৩টি। ১৮৬১ থেকে মেটিয়াবুরুজে নিয়মিত ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ হয়েছে, সেখানে তা আরও পরিণত।
তবে ওয়াজিদ আলির নাট্যপ্রয়াস কলকাতার নাটমঞ্চকে আদৌ প্রভাবিত করেছিল এমন তথ্য পাওয়া যায় না। কিন্তু কত্থক নাচের সংস্কৃতিকে ওয়াজিদ আলি যে স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন, কলকাতায় সেই লখনউ ঘরানাকে রসিক মহলে আদৃত করে তোলার পিছনে তাঁর ভূমিকা নিয়ে সংশয়ের বিশেষ অবকাশ নেই। ওয়াজিদ নিজে মহারাজ ঠাকুর প্রসাদের কাছে কত্থক শেখেন। ১৮৭৫-এ তিনি ‘মুসাম্মি বা বানি’ নামে কত্থক নিয়ে একটি সচিত্র বই লেখেন যা মেটিয়াবুরুজে লিথোগ্রাফ করে ছাপা হয়। কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে এই বইয়ের পাণ্ডুলিপি ও মুদ্রিত রূপ দু’টিই আছে।
বইয়ে ওয়াজিদ লিখেছেন, তাঁর সময়ে লখনউয়ে কত্থক শুধু হিন্দু শিল্পীদের মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, মুসলিম শিল্পীরা একে গ্রহণ করে আরও পরিণত করেন। কলকাতায় তিনি লখনউয়ের অনেক শিল্পীকেই ডেকে নিয়েছিলেন। শোনা যায়, ১৮৬৭-তে হোলির সময় মেটিয়াবুরুজের দরবারে ওয়াজিদ আলি স্বয়ং নর্তকীর বেশে নৃত্য পরিবেশন করেন, গেয়ে শোনান ঠুমরিও। কলকাতার সংগীতরসিকদের মধ্যে অঘোরনাথ চক্রবর্তী, সাজ্জাদ মহম্মদ এবং আরও অনেকে নাকি সেই অনুষ্ঠানে ছিলেন। আবদুল হালিম ‘শরর’ অবশ্য জোর দিয়ে বলেছেন, ওয়াজিদ নিজে কখনও নাচতেন না। লখনউ ঘরানার কত্থকশিল্পীরা ওয়াজিদের সূত্রেই কলকাতায় সমাদৃত হন।
আর ঠুমরির তো কথাই নেই। সংগীতবেত্তা রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর (১৮৪০-১৯১৪) পাথুরিয়াঘাটা থেকে মেটিয়াবুরুজ যেতেন লখনউ ঠুমরির টানে। যদুনাথ ভট্টাচার্য বা যদুভট্ট, অঘোরনাথ চক্রবর্তী নবাবের দরবারি ঠুমরির রীতিমত ভক্ত ছিলেন। বস্তুত ওয়াজিদ আলির দাক্ষিণ্যে মেটিয়াবুরুজ হয়ে উঠেছিল ধ্রুপদী কণ্ঠ ও যন্ত্রসঙ্গীতের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। লখনউয়ে ওয়াজিদ আলির দরবারেই ঠুমরি জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছয়। আর মেটিয়াবুরুজ থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে কলকাতার বুকে। নবাব নিজে কম গান লেখেননি। এমনকী দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত ‘বাঙালীর গান’-এও (১৯০৬) ওয়াজিদ আলির লেখা তিনটি গান ঠাঁই পেয়েছে, সব চেয়ে বিখ্যাত বোধহয় ‘যব ছোড়ে চলে লক্ষ্ণৌ নগরী’।
বিরিয়ানি থেকে সরোদ শিখিয়েছিলেন তিনি কলকাতাকে। রাজ্যহারা নবাব ওয়াজিদ আলি শাহ জীবনের শেষ তিরিশ বছর কাটিয়েছিলেন কলকাতাতেই। কলকাতাতেই নির্মাণ করেছিলেন একখণ্ড লক্ষ্ণৌ। দক্ষিণ কলকাতার মেটিয়াবুরুজের সুদূর লক্ষ্ণৌর এই রাজ্যবিহীন রাজা নবাবি হালেই জীবন কাটিয়েছেন। সময় যত এগোচ্ছে, কলকাতা শহরের ওপর তাঁর সাংস্কৃতিক প্রভাব তত ফুটে উঠছে।