তৈমুর লঙ : ঘোড়ার পিঠে বিশ্ববিজয়

(পর্ব-১)



আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
মায়ের দিক থেকে ধরলে তৈমুরের শিরায় ছিল চেঙ্গিসের রক্ত

মায়ের দিক থেকে ধরলে তৈমুরের শিরায় ছিল চেঙ্গিসের রক্ত

  • Font increase
  • Font Decrease

চেঙ্গিস খানের মৃত্যুর পর একশ বছর পেরিয়ে গেছে। তার সাম্রাজ্য খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে আছে উত্তরাধিকারীদের মধ্যে। অনেকেই রীতিমতো তখতবিহীন। চেঙ্গিসের এক পুত্রের নাম চাগতাই, তার মৃত্যুর পর বংশধররা ১২২৭ সাল থেকে ১৩৬৯ সাল পর্যন্ত মধ্য এশিয়ায় শাসন অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছিল। তার নাম অনুসারেই বংশধরদের নাম হয় চাগতাই বংশ।

চাগতাইয়ের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় বসে তার নাতি কারা হালাকু। কিন্তু এ দফায় বেশিদিন টিকতে পারেননি। মোঙ্গল নেতা কুয়ুক খান তাকে সরিয়ে চাগতাইয়ের পঞ্চম পুত্র ইসু মসুকিকে সিংহাসনে বসান। মোঙ্গল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রভূমি কারাকোরামে স্থিত মঙ্গু খানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হত্যা করা হয় ইসু মসুকিকে। ফলে আবার ক্ষমতায় আসেন কারা হালাকু। তার মৃত্যুর পর স্ত্রী ওরগানা সাময়িকভাবে শাসনকার্য চালাতে থাকেন। সময় হলে ১২৬৬ সালে মসনদে বসেন কারা হালাকুর পুত্র মোবারক শাহ।

চাগতাই সাম্রাজের তারুণ্যে তার অবস্থান


চাগতাইদের মধ্যে তিনিই প্রথম গ্রহণ করে ফেলেছিলেন ইসলাম ধর্ম। ফলে শাসন ব্যবস্থাতে আগাগোড়া পরিবর্তন আসে। আগেকার অভিজাত ও প্রতিষ্ঠিতদের বিষয়টা না মেনে নেওয়াই স্বাভাবিক। শীঘ্রই তাকে সরিয়ে দিয়ে সামনে আসলেন চাচাত ভাই বুরাক খান। বুরাক খানের পর পুত্র দুয়া খান এবং তারও পরে দুয়া খানের তিন পুত্র ইসেন বুকা, কাবাক এবং তারমাশিরিন একের পর এক গদিতে বসেন। সর্বশেষ জনের নাম তারমাশিরিন, যিনি ক্ষমতায় ছিলেন ১৩২৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তিনি ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে আলাউদ্দীন নাম নেন।

তৈমুর পর্ব

আলাউদ্দীনের মৃত্যুর পর চাগতাই সাম্রাজ্য চরম গোলযোগে পতিত হয়। তখন চাগতাই মোঙ্গলদের সাথে তুর্কিদেরও যোগাযোগ বেড়ে গেছে। ঠিক সেই রকম এক বংশধর তরুণী তাকিনাহ খাতুন, যার বিয়ে হয়েছিল আমীর তুরঘাই নামের তুর্কি দলপতির সাথে।

আট দশটা বিয়ের মতো এই বিয়েটাও সাধারণ হতে পারত; কিন্তু হয়নি। কারণ তাদের ঘরে এমন এক সন্তান জন্ম নেয়, যার হাতে সৃষ্টি হয়েছে নতুন ইতিহাস। আমৃত্যু রহস্যময় মানুষটির নাম তৈমুর; জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনায় তার বিস্ময়কর নাটকীয়তা সাহিত্যিকের কল্পনাকেও হার মানায়। শত্রু শিবিরের ধ্বংসস্তূপের ওপর তার নৃশংস উল্লাস আর একই সাথে শিল্পের প্রতি অপরিসীম মমত্ববোধ—বিপরীত বৈশিষ্ট্য খাপ খেয়েছিল তার সাথে। শত্রুকে যুদ্ধের মাঠে রেখেই মজে থাকতে পারতেন দাবা খেলায়। ইতিহাসের অনেকেই তাকে ‘এ ম্যান অব প্যারাডক্স’ বলে ডাকতে পছন্দ করেন।

তার রহস্যময়তার জন্যই ঐতিহাসিকদের কাছে তিনি আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু


১৩৩৬ সালে মধ্য এশিয়ার কেস নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আমীর তুরঘাই ছিলেন বারলাস গোত্রের গুরগান শাখার প্রধান। গুরগান শব্দের মানে গৌরবময় আর তৈমুর মানে লৌহ। নিজের জীবনে নামের অর্থ ভালোভাবেই প্রমাণ করেছেন আমীর তৈমুর গুরগান।

বাল্যকাল থেকেই তার দাপুটে স্বভাবের পরিচয় পাওয়া যেতে থাকে। সামরিক বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠেন মাত্র বারো বছর বয়সেই। পিতার মৃত্যুর পর থেকেই মূলত নানা বিপদ আর প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে থাকেন। তখন ট্রান্সঅক্সিয়ানার সিংহাসন নিয়ে গোলযোগ চলছে। মঙ্গোলীয় শাসনকর্তা তুঘলক তৈমুর খানের আক্রমণের কারণে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হন তৈমুর। সন্তুষ্ট হয়ে তুঘলক খান প্রথমে শাসক এবং পরে পুত্রের উপদেষ্টা মনোনীত করেন। কিন্তু শীঘ্রই ষড়যন্ত্রের কারণে সমরকন্দ ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি।

এক ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবন

চরম সহায়হীন অবস্থায় এক হতভাগ্যের জীবন কাটছে তখন তৈমুরের। ভাগ্যান্বেষণে কী না করেছেন? খিভার শাসনকর্তার কাছে সাহায্যের আবেদন করলে তিনি মুখে হ্যাঁ করলেও বাস্তবে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। অবস্থা বুঝতে পেরে মরুভূমিতে পলায়ন করেন তৈমুর। সময়টা ছিল আসলে তার পরীক্ষার, অন্তত ভাগ্যবিধাতা তাকে প্রস্তুত করছিলেন এভাবেই। নাহলে বিপদের পরে আরো বিপদে কেন পড়বেন? একদল তুর্কি তাকে বন্দী করলে তিনি আরো একবার কঠিন কৌশলে সেখান থেকে পলায়ন করলেন।

ভাগ্য বিড়ম্বিত তৈমুর এখানে-সেখানে ঘুরে ক্লান্ত। কোথাও আশার কোনো বাতি নেই। তারপরেও তিনি অধৈর্য হননি। ইতোমধ্যে সিস্তানের শাসনকর্তা জালালউদ্দীন মাহমুদ এক বিদ্রোহ দমনের জন্য তার কাছে সাহয্য প্রার্থনা করল। তিনি সাড়া দিলেন। অধিকৃত হলো বিদ্রোহীদের দূর্গ।

এত দ্রুত কি আর ভাগ্য বদলায়? দ্রুত পাল্টে গেল দাবার ছক। শত্রুরা যাবার আগে জালালউদ্দীনকে তৈমুরের ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে যায়। তাছাড়া তৈমুরের সম্ভাবনা এবং ব্যক্তিত্বের জন্য তিনি তাকে ভবিষ্যৎ বিপদ হিসাবে গণ্য করলেন। ফলে আক্রমণ করলেন তৈমুরকে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করলেও পায়ে গুরুতররূপে আঘাত পান। সারাজীবন আর সেই পা ভালো হয়ে ওঠেনি। এই খোঁড়া পায়ের জন্যই তার নামের সাথে ‘লঙ’ যুক্ত হয়।

পরবর্তী-জীবনে আর পা-টা ঠিক হয়নি


সিস্তান বিজয়ের পর তার চোখ পড়ল সাম্রাজ্য বৃদ্ধির দিকে। ধীরে ধীরে কুনদুজ থেকে কেস পর্যন্ত দখল করে আধিপত্য বৃদ্ধি করলেন তৈমুর। ততদিনে তুঘলক খানের মৃত্যু হয়ে পুত্র খাজা ইলিয়াস পরবর্তী শাসক হিসাবে সমরকন্দের গদিতে বসেছেন। সুযোগ পাওয়া মাত্রই আক্রমণ করে সমরকন্দ দখল করে নেন তৈমুর। এবার যেন পা রাখার একটা জায়গা হলো।

ক্ষমতায় আরোহণ

এতদিন এতগুলো অভিযানে তৈমুরের সাথে আরো এক ব্যক্তি সবসময় পাশে ছিলেন—আমীর হুসাইন। ক্ষমতার প্রবেশদ্বারে এসে তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরল। আমীর হুসাইন সাবেক শাসনকর্তার পুত্র বলে দুজনের সমান যোগ্যতার অর্জনকেও তিনি নিজের হাতে রাখলেন। উপরন্তু বারলাস বা তৈমুরের গোত্রের ওপর কর বাড়িয়ে দিলেন। মনঃক্ষুণ্ণ তৈমুর তার সীমাবদ্ধ ক্ষমতাকে মেনে নিলেন উদারভাবে।

সময় তো আর একরকম যায় না। হঠাৎ তৈমুরের প্রিয়তমা স্ত্রী আলজাই মৃত্যুবরণ করলেন। আলজাইয়ের আরেক পরিচয় ছিলে আমীর হুসাইনের বোন হিসাবে। মূলত আলজাইয়ের কারণে আত্মীয়তার বন্ধন হেতু এতদিন সংঘর্ষ হয়নি। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে তা সম্ভব হলো। তৈমুর এবার ক্ষমতা হাতে নেবার জন্য সচেষ্ট হলেন।

আরো পড়ুন ➥ চেঙ্গিস খান : রহস্যময় এক বিশ্ববিজেতা

প্রথম দিকে আমীর হুসাইন মোটামুটি নিশ্চিন্ত ছিলেন নিজের শক্তির অধিকতার কারণে। কিন্তু জাঠ বিদ্রোহ দমনের জন্য দীর্ঘ ছয় বছর ব্যস্ততার দরুন শক্তি অনেকটাই ক্ষয়ে এসেছিল তার। এই সুযোগটাই নিলেন কৌশলী তৈমুর। দু্ই পক্ষের মধ্যকার সিদ্ধান্তমূলক যুদ্ধে পরাজিত ও নিহত হলেন হুসাইন। দীর্ঘ হতভাগ্য জীবনের শেষে ১৩৬৯ সালে সিংহাসনে আরোহণ করলেন আমীর তৈমুর। রাজধানী হলো সমরকন্দ। যেন অন্ধকারের বুক ছিঁড়ে সবেমাত্র ভোর হলো।

পারস্য বিজয়

তৈমুরের বিশ্বাস ছিল—“আসমানে যেমন একজন খোদা, জমিনেও তেমনি একজন বাদশাহ থাকবে।” তাই সিংহাসন লাভের সাথে সাথেই রাজ্য বিজয়ে মনোনিবেশ করেন। মধ্য এশিয়ার রাজনৈতিক গোলযোগ তাকে উক্ত অঞ্চল জয় করতে প্ররোচিত করে। ১৩৬৯ সাল থেকে ১৩৮০ সাল পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময় জাঠ এবং খাওয়ারিজম রাজ্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকেন তিনি। তারপর নজর ঘুরান পারস্যের দিকে। ১৩৮০ সালে তৈমুর খোরাসান আক্রমণ করে শাসক গিয়াসউদ্দীন পীর আলিকে পরাজিত করেন। তারপর একে একে দখল করেন হেরাত, কান্দাহার এবং কাবুল। কালাত-ই নাদিরী এবং তুরশীজ নামে দুটি দুর্গ বিজয় করেন।

সমসাময়িক শিল্পীর আঁচড়ে তৈমুরের পারস্য আক্রমণ


তৈমুরের পরের লক্ষ্য সিস্তান। সিস্তানের যুবরাজ কুতুবউদ্দীন শাহের নিকট সন্ধিপ্রস্তাব পাঠানো হলো। তারা প্রস্তাবে তেমন কোনো গুরুত্ব দিল না। বরং নতুন গজিয়ে ওঠা শাসক ভেবে আক্রমণ করে বসল। তার মাশুল গুনতে হলো শীঘ্রই। তৈমুর প্রবল প্রতাপে তাদের পরাজিত করলেন। পরাজিত সিস্তানিরা আরো বড় ভুল করল পরে রাতের অন্ধকারে আবার আক্রমণ করে। এবার তৈমুরের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। শুধু বিজয় অর্জন করেই থেমে গেলেন না; নিলেন চরম প্রতিশোধ। ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তা পরিণত হলো জনমানবহীন শ্মশানে। এই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পি সাইক্স বলেছেন, “নগরটি এখন হিংস্র জন্তু ও পেঁচাদের আবাসে পরিণত হয়েছে।”

খোরসান ও সিস্তান বিজয় নিশ্চিত হলে তৈমুর বের হন উত্তর পারস্য বিজয়ের উদ্দেশ্যে। ১৩৮৪ সালে অতিক্রম করলেন অক্সাস নদী। দীর্ঘ একমাস অবরোধের পর দখলে এলো অস্ত্রাবাদ। নিজের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করলেন রাই, মাজেনদারান, সুলতানিয়াসহ একের পর এক নগরী। এক ভাগ্য বিড়ম্বিত তরুণ থেকে এখন একটা সম্ভাবনাময় রাজ্যের অধিপতি।

কিন্তু তখনও তৈমুরের গল্পের মূল আখ্যান শুরুই হয়নি। গোল্ডেন হোর্ড থেকে অটোম্যান সুলতান অব্দি তার কাছে পরাজিত হতে বাধ্য হয়েছে সিনেমার মতো। সেই গল্প আসবে পরবর্তী পর্বে।

● পর্ব-২ পড়তে ক্লিক করুন

   

ইতিহাসে ২৮ মার্চ: বর্ণবাদের প্রতিবাদে কিংয়ের পক্ষে ২৫ হাজার মানুষ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

  • Font increase
  • Font Decrease

মানব ইতিহাস আমাদের অতীতের কথা বলে। আজ যা কিছু বর্তমান তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমাদের অতীতের কারণেই। সেই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ছাপ রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়।  

আজ ২৮ মার্চ, ২০২৪। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখঅ যাবে, আজকে ঘটেছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। জেনে নেয়া যাক, কি ঘটেছিল আজকের তারিখে!

*মার্টিন লুথার কিং ছিলেন বর্ণবাদের বিপরীত আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। সেখানে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাকে সমর্থন করে মিছিলে নেমেছিলেন আজকের তারিখে। এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে আলাবামায় জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।    

*যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৭৯ সালে পানির পাম্প ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে চারপাশে তেজস্ক্রিয় বাষ্প এবং আয়োডিন ছড়াতে শুরু করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত ৫০০ জন কর্মী এই বাষোপর সংস্পর্শে আসায় শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় ছিল। আমেরিকার জনগণ এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।  

*১৯৮৬ সালে অ্যাচেসন এবং লিলিয়েনথাল পারমারবিক শক্তি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন তারা। ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।

*হিলসবোরো দুর্ঘটনায় প্রায় ১শ লোকের প্রায় গিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শেফিল্ডে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন লিভারপুল ফুটবল সমর্থক নিহত হন। এছাড়া আরও দেড় শতাধিক ভক্ত আহত হন। এই বিপর্যয়ে আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট ছিল নিহতদের পরিবার। তাই, আজকের তারিখে তারা রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

*১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ শেষ হয়েছিল।

;

তালপাতার পাখায় ঘোরে সংসারের চাকা



মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। যা দেখে মনে পড়ে যায় রবী ঠাকুরের কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ বলছি বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের কথা। বর্তমানে গ্রামটি তাল পাখার গ্রাম নামে পরিচিত। এই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গরমে তালপাতার পাখার বাতাস গা জুড়িয়ে যায়।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম যোগীরভবন, অপরটি আড়োলা আতালপাড়া। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি গ্রামে একেক পাড়ায় একেক ধরনের পাখা তৈরি হয়। যোগীরভবন গ্রামে নারীরা তৈরি করেন হাতলপাখা বা ডাঁটপাখা। আর আড়োলা আতালপাড়ায় তৈরি হয় ঘোরানো পাখা বা ঘুন্নী পাখা আর পকেট পাখা। পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দুটি গ্রামের সব নারী। শীতের শেষে বসন্তকালে, অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়।

পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী

গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বাড়ির উঠানে রং তুলির আঁচড়ে ঘুরানো পাখা রাঙিয়ে তুলছেন সখিনা বেগম। রাঙানো পাখা বাঁধায় করছেন গোলজার। বাঁধা হয়ে গেলে পাখাটি বিক্রি করবেন তিনি।

হাতপাখার গ্রামে এবার ২০ লাখ পাখা বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এই পাখা চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হবে।

গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা অবসর সময়ে পাখা তৈরির কাজ করেন। বংশ পরম্পরায় এই দুই গ্রামের মানুষ তালপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। গরমে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে পাখার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পাখা তৈরির কাজের পরিধি।

আড়োলা গ্রামের খন্দকার বলেন, দাদার আমল থেকে তারা তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরির কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রীও সংসারের কাজের ফাঁকে রঙের আচর দিয়ে তাল পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকেন। আকরাম আকন্দ বলেন, গত বছর তিনি পাখা বিক্রি করে সংসার খরচ বাদে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার মতে গত বছর দুই গ্রাম থেকে ১৫ লাখ তালপাখা বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার চাহিদা বাড়ায় ২০ লাখ পাখা বিক্রি হবে বলে তিনি জানান।

জানা যায়, তালগাছের পাতা (স্থানীয় ভাষায় তালের ডাগুর) দিয়ে তিন ধরনের পাখা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে নাম দেয়া হয়েছে- পকেট পাখা, ঘুরানী পাখা এবং ডাগুর পাখা।

পাখা তৈরিতে তালের পাতা ছাড়াও বাঁশ, সুতা এবং লোহার তার প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরির পর বিভিন্ন রঙের আচর দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। ১০ টাকায় কেনা তাল গাছের একটি পাতা বা ডাগুড় দিয়ে তৈরি হয় বড় পাখা বা ডাগুর পাখা ২টি, ঘুরানী পাখা ৪টি এবং পকেট পাখা ৬টি।

তালপাতার পাখা

পাখা তৈরির কারিগর জানান, বছরের আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহের কাজ। এরপর বাঁশ ছোট ছোট আকারে কাটতে হয়। তালপাতাও কেটে পাখা তৈরির উপযোগী করা হয়। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ করে বিক্রয় উপযোগী করা হয়।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসেন তালপাখা কিনতে।

যোগীর ভবন গ্রামের মামুনুর রশিদ বলেন, তিনি প্রতি বছর ১৭ থেকে ১৮ হাজার ডাগুর পাখা তৈরি করেন। এই পাখাগুলো বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখার চাহিদা বেশি বলে জানান মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, একটি তাল পাতা বা ডাগুরের দাম ১০ টাকা হলেও বাঁশ ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

আতাইল পাড়া গ্রামের পারভীন, মর্জিনা, সাবিনা, বেবি, সুমি জানান, তারা প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। বছরের ছয় মাস সংসারের কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরির কাজ করে তারা বাড়তি আয় করছেন। এইসব নারীরা তাদের সৌখিন জিনিস কিনে থাকেন নিজের টাকায়।

পকেট পাখা ১১ টাকা, ঘুরানী পাখা ২০ টাকা এবং ডাগুর পাখা ৩০ টাকা দরে ব্যাপারীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।

গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে হাতপাখার চাহিদা বাড়ছে বলে পাখা কিনতে আসা ব্যাপারী করিম জানান। শহর এবং গ্রামে তীব্র গরম থেকে একটু প্রশান্তি পেতে ধনী-গরিব সবাই হাত পাখার ব্যবহার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

;

ইতিহাসে ২৭ মার্চ:স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

  • Font increase
  • Font Decrease

সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান হয় অতীত। তার সাথেই তৈরি হয় ইতিহাসের। মানব সভ্যতায় ঘটে যাওয়া ইতিহাস হয়ে থাকে জাতির কাছে স্মরণীয়। প্রতি বছর যখন ক্যালেন্ডারে একই তারিখগুলো ফিরে আসে, মানুষ পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।

আজ ২৭ মার্চ, ২০২৪। বিগত বছরগুলোতে এই তারিখে ঘটা অনেক ঘটনা হয়েছে স্মৃতিতে অমলিন। ইতিহাসের পাতায় জুড়ে গেছে নতুন নতুন ঘটনা। চলুন জেনে নিই,আজকের তারিখে কি ঘটেছিল!    

১৯৭৭ সালে স্পেনে টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ডাচ এয়ারলাইনের সেই দুর্ঘটনায় কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রানওয়েতে দু’টো জেট বিমানের সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে উৎপন্ন বিধ্বংসী দাবানলে সর্বমোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৮০ সালে উত্তর সাগরের প্ল্যাটফর্ম ধসে পড়ে। রিগটি ডান্ডি থেকে ২৩৫ মাইল পূর্বে সেই আবাসন প্ল্যাটফর্ম দুর্ঘটনায় ১২৩ জন শ্রমিক মারা যান।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কমিউনিটি পার্টির অনেক রাশিয়ান উচ্চতর কর্মকর্তা পরাজিত হন। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাকে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।     

১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে রেললাইন কম ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষতি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোট রেলব্যবস্থার এক-চতুর্থাংশ সেবা কমিয়ে দেওয়া হবে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২৭ মার্চ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

;

আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয় ‘পাক বিধান’



সম্পাদকীয় বিভাগ, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, স্বল্প সময়েই এর প্রবক্তাদের উচ্চাশা কোটি কোটি অধিবাসীদের দুরাশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তা পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন অবিচার আর দুঃশাসনে এক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র ধারণ করে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে মোহিত করা অধুনা পূর্ববঙ্গবাসীর আকাঙ্খা বছর গড়াতেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। শুরু হয় নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের প্রাণান্তর চেষ্টা। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা প্রশ্নে উদাসীন পিন্ডির শাসকদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে বাংলা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ও দুই লক্ষ নারীদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত মুক্তি।

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জানার চেষ্টা করব ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বাঙালি জাতি কি আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিল। ১০ চৈত্র ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯) কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে সেই সময়কার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে বার্তা২৪.কম পুনঃপ্রকাশ করছে আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয়।

গত চার মাস ধরিয়া পাকিস্তানে যে তুলকালাম কা- চলিয়াছে নানা জন নানা ভাবে তাহার ব্যাখ্যা করিতে চাহিবেন এটাই স্বাভাবিক। কেহ বলিতেছেন, পাকিস্তান আর একটি বিয়াফ্রা বা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হইতে চলিয়াছে। মৌলানা ভাসানিরও মনে হয় তাহাই অভিমত, তিনি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়াছেন, বলিয়াছেন, সে মহৎ কর্মে কুড়িলক্ষ পাকিস্তানীর জান কোরবানি করিতে তিনি তৈয়ার। লারকানরি আমুদে-যুবা ভুট্টো ‘প্লেবয়’ হিসাবে খ্যাত হইলেও আগুন লইয়া খেলায় কতখানি মাতিবার সামর্থ্য রাখেন, সে বিষয়ে অনেকেরই বিলক্ষণ সন্দেহ। বিশেষতঃ, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু ফৌজীদের ঘাঁটি নয়, মওদুদি তথা মোল্লাদেরও ছাউনি পড়িয়াছে। শুধু ভুট্টোর ধারণা নাকি পাকিস্তানে ‘বিপ্লব’ চলিয়াছে, এবং এ বিপ্লব যদিও অন্তরে ঐশ্লামিক, লক্ষ্যে-সমাজতান্ত্রিক।

চারিদিকে সকলের মুখে মুখে যখন ‘‘বিপ্লবের’’ ফুলঝুরি, তখন পাক-আইনমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ জাফর অনায়াসে প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকেও আখ্যা দিতে পারিতেন-‘‘বিপ্লব’’। একসঙ্গে শাসনতন্ত্রের নব্বুইটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে বিপ্লবাত্মক। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে আয়ুব যখন আচমকা গদীয়ান হন , সে ঘটনা অন্যের চোখে বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান হইলেও পাকিস্তানে বলা হয় ‘অক্টোবর রিভলিউশন’, আইনমন্ত্রী নির্দ্বিধায় ফেডারেল ব্যবস্থা নামক বিলটির নাম দিতে পারিতেন ‘‘মার্চ রিভলিউশন’’-আয়ুব এক জনমে দুইটি বিপ্লবের কৃতিত্ব লাভ করিতেন!

জাফর সাহেব আয়ুব খাঁর তরফ হইতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা শুনাইয়াছেন তাহার সারমর্মঃ পাকিস্তান এক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। সরকার পরিচালনা করিবেন মন্ত্রিসভা; তাহার শীর্ষে থাকিবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিও থাকিবেন একজন, তবে তিনি থাকিবেন রবার স্ট্যাম্প মাত্র। তাঁহাকে নির্বাচন করিবেন রাজ্য আইনসভার সদস্যবৃন্দ। অন্যরা সকলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত হইবেন, ইত্যাদি কথাবার্তার ধরণ দেখিয়া মনে হইতে পারে চৌদ্দমাস ধরিয়া বিস্তর কাঠখড় পোড়াইয়া মাথা খাটাইয়া ১৯৬২ সনে আয়ুব যে শাসনতন্ত্র তাঁহার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন সেটির খোলনলচে বুঝি সবই পাল্টাইতে চলিয়াছে। বলা হইয়াছে পরিকল্পিত নূতন শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যÑইহা এককেন্দ্রীয় নয়, ফেডারেল বা যুক্ত রাষ্ট্রীয়; দ্বিতীয়ত ইহাতে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত, তৃতীয়ত স্বীকৃত জনসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিও।

শেষোক্ত অধিকারটি নিশ্চয়ই পাক নাগরিকদের কাছে মস্ত পাওনা, এক যুগেরও পরে তাঁহারা একটি মৌলিক অধিকার পাইতে চলিতেছেন। এবিষয়ে পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য আয়ুব অবশ্য ১৯৬৩ সনে একটি কমিশন বসাইয়াছিলেন। তাহারাও বলিয়াছিলেন-প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মানিয়া লওয়া সঙ্গত। আয়ুব তাহাতে রাজী হইতে পারেন নাই, আর একটি কমিটী বসাইয়া সিদ্ধান্তটিকে নিজের পছন্দসই করাইয়া লইয়াছিলেন। আইনমন্ত্রী জাফর বলিয়াছেন-আগামী মাসেই জাতীয় পরিষদে একটি ‘বিল’ আনিয়া সকলকে ভোটের অধিকার দেওয়া হইবে। ‘‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ: না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই’Ñতবু মনে হইতেছে নীট লাভ এইটিই।

যুক্তরাষ্ট্রের যে রূপরেখা মিলিয়াছে তাহাতে মনে হয়, খোল নলচে পালটাইলেও কলকেতে সেই পুরনো তামাকই পুড়িবে। নলটি প্রেসিডেন্টের নয়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগানো থাকিবে-এই যা। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘এক ইউনিট’ কর্তার ইচ্ছায় অতঃপর দুই হইবে হয়তো কিন্তু জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘বহু’ হইতেছে না। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সংসদে সব ত্যাগের সমনাধিকার , অর্থাৎ চলতি নিয়মই বহাল থাকিবে, আসন জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টিত হইতেছে। ফলে পূর্বের উপর পশ্চিমীদের আধিপত্য থাকিয়াই যাইবে।

পাক শাসনতন্ত্রে অমুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই, নয়া-শাসনতন্ত্রে বাঙালী মুসলমানের পক্ষে সে সম্ভাবনা সামান্য। সাত কোটি বাঙালীর উপর পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসন শোষণ চলিতেই থাকিবে। বিশেষত, পাক সামরিক বাহিনীতে বা দেশরক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলে নাই। পাকিস্তানের সামরিক খরচ বাজেটের শতকরা ষাট ভাগের বেশী সেখানে টাকা দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেও কিন্তু বাহিনীতে তাহার ভূমিকা নামমাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাহার আসল বল হাতের ওই মুগুরটি হাতছাড়া করিবে কি?

খাঁটাইয়া দেখিলে সন্দেহ থাকে না, আয়ুব স্বায়ত্বশাসনের ধোঁকা দিতেছেন মাত্র। যে আঞ্চলিক স্বাধীনতার কথা জাফর শুনাইয়াছেন, অন্য ভাষায় পুরনো শাসনতন্ত্রেও সে-সব প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অঙ্গে বৈষম্য তবু বাড়িয়াছে বই কমে নাই। মোটকথা শেখ মুজিবর রহমান যে ছয়দফা চাহিয়াছিলেন তাহার সামান্যই দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাইতেছে। শেখ মুজিবর তাহার ইঙ্গিত পাইয়াই গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলকে আখ্যা দিয়াছিলেন-শূণ্য। তিনি এবং তাঁহার দল নাকি একটি বিকল্প ফেডারেল শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করিতেছেন।

আগামী মাসে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তাহা উত্থাপিত হইবে। তদানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হইবে চারিটি রাজ্য, পূর্বে একটি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লওয়া হইবে। সরকারী ‘‘বিল’’ এবং এই বেসরকারী ‘‘বিল’’-দুইয়ের ভাগ্যই কিন্তু এখন অবধি অনিশ্চিত। আয়ুবের মতলব নাকি-যাবতীয় পরিবর্তনের প্রস্তুতি আগামী বছর ২৩ মার্চের মধ্যে শেষ করা-এক যুগ পরে প্রেসিডেন্টের তখনই বানপ্রস্থে যাত্রার ইচ্ছা। তাঁহার দ্বিতীয় বাসনা, সব পরিবর্তনই নিয়মতান্ত্রিক পথে হোক। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, পাক জাতীয় পরিষদের সম্মতি লইয়া শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্ভব নাও হইতে পারে।

দুই পাকিস্তানেরই প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে সমান, সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ুব কি প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাইবেন? আর মুজিবুরের ‘‘বিল’’ যদি পাস হইয়া যায়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি তাহা মানিয়া লইবেন? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না পাকিস্তানের সংকট কাটিবার মুখে। বরং মনে হইতেছে, প্রকৃত সংকট ক্রমে আরও ঘনাইয়া আসিতেছে। দিশাহারা আয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর বদল করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তানেও মোনেম খাঁর বদলে নূতন গভর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন হুদা।

পশ্চিম হইতে পুবে সৈন্য আমদানির কথাও শোনা যাইতেছে। পাকিস্তান কোন্ পথে চলিয়াছে? বিলাতের একটি কাগজ বলিতেছে-বিচ্ছিন্নতার পথে। নূতন শাসনতন্ত্রে জোড়াতালির যতো চেষ্টাই করা হোক, একটি সত্য আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট, ধর্মীয় ঐক্য খানিকদূর অবধি কাজে লাগে, বেশীদূর নয়। যদি তাহা না হইত তবে লাহোর অধিবেশনের আটশ বছর পরে, পাকিস্তান-স্বপ্নের তথাকথিত ঐতিহাসিক জন্মতারিখের দুইদিন আগে পাক নেতাদের এই মেকি ‘ফেডারেল-ইজম’ এর স্তোকবাক্য শুনাইতে হইত না!

প্রকাশকাল: সোমবার ১০ চৈত্র ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯): আনন্দবাজার পত্রিকা

সংগ্রহ: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;