যেভাবে দাঁত ব্রাশ করা আমাদের প্রতিদিনের কাজ হয়ে উঠল
ঘুম থেকে জেগেই আমাদের প্রাথমিক কাজগুলো একটি হলো দাঁত ব্রাশ করা। দিনের পর দিন একই কাজে অভ্যস্ত আমাদের কাছে ব্যাপারটিকে যতই স্বাভাবিক মনে হোক, নানান ধাপ অতিক্রম করেই স্বাভাবিক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে প্রতিদিন দাঁত ব্রাশ করার এই অভ্যাস।
সম্প্রতি প্রায় ২,৫০০ বছর আগের কিছু টুথ পিক, দাঁতের সরঞ্জাম এবং দাঁতের সুরক্ষার কিছু বিবরণ থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বেশ কিছু নিদর্শন খুঁজে পান যেগুলো থেকে সেই সময়ের দাঁতের চিকিৎসা এবং যত্নের নিয়ম-কানুন সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গিয়েছে। হাজার বছর আগেও মানুষ দাঁতের সুরক্ষা এবং এর সুস্থতার ব্যাপারে সচেতন ছিল। গবেষণা থেকে দাঁতের চিকিৎসায় ব্যবহৃত বেশ কিছু উপাদানেরও খোঁজ মিলেছে।
প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন বিখ্যাত গ্রিক ডাক্তার হিপ্পোক্রেটিস ছিলেন প্রথম ডাক্তার যিনি দাঁত পরিষ্কার রাখার কথা উল্লেখ করে চিকিৎসা প্রদান করেছিলেন। প্রাপ্ত কিছু নথিপত্র মারফত জানা যায়, তিনি মূলত এক প্রকার শুকনো টুথপেস্ট দিতেন যেটা দাঁত পরিষ্কার রাখতে সহায়তা করত। সেখান থেকেই ক্রমান্বয়ে আজকের এই আধুনিক টুথ পেস্টের আগমন বলে অনেকেরই ধারণা।
প্রাচীন চীনা এবং মিশরীয় চিকিৎসা-গ্রন্থগুলো স্বাস্থ্যরক্ষায় দাঁত পরিষ্কারের এবং ক্ষয় অপসারণের পরামর্শ দিয়েছে। এক্ষেত্রে পশুর পশম, মাছের হাড় এবং বিভিন্ন পাখির পাখা ব্যবহারের প্রমাণও পাওয়া যায়। তারা দাঁতের মেরামত করতে বা সাজানোর জন্য রৌপ্য এবং সোনার মতো উপকরণ ব্যবহার করত যেটার ব্যবহার এখনো লক্ষ্য করা যায়।
আরব উপদ্বীপ, উত্তর আফ্রিকা এবং ভারতীয় উপমহাদেশের লোকেরা গাছ থেকে তৈরি চিবানো কাঠি দিয়ে ঐতিহ্যগতভাবে দাঁত পরিষ্কার করতেন। কাঠিগুলো সাধারণত জয়তুন কিংবা নিমের ডালের হতো। গাছের চিকন ডালের সম্মুখ অংশকে চেছে দাঁত পরিষ্কারের কাজে টুথব্রাশ হিসেবে ব্যবহার করা হতো এবং এটি ‘চিউই স্টিক’ বা চিবানোর কাঠি, দাঁতন বা মেসওয়াক নামে পরিচিত। আমাদের দেশেও দাঁতন বা মেসওয়াকের ব্যাপক প্রচলন ছিল একসময়। শহরাঞ্চলে টুথব্রাশের আগমন ও ব্যাপক প্রচলনের ফলে দাঁতনের ব্যবহার কমে গেলেও গ্রামাঞ্চলে এখনো চোখে পড়ে। ইউরোপিয়ানরা দাঁত পরিষ্কার রাখতে ব্যবহার করত লবণ কিংবা কাচের ক্ষুদ্রক্ষুদ্র কণাকে।
বিশ্বাস করুন কিংবা না করুন, হাজার বছরের দাঁত মাজনের ইতিহাসে প্রথম যে ব্যক্তি প্রক্রিয়াটিতে অনাস্থা পোষণ করেন, তিনিই পরবর্তী সময়ে দন্ত্য-চিকিৎসার জনক হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। তার নাম পিয়ের ফ্যাচার্ড। ফরাসি এই চিকিৎসক ১৭০০ দশকের গোড়ার দিকে ব্রাশ করে দাঁত পরিষ্কার করতে নিষেধ করেন। ব্রাশের পরিবর্তে তিনি একটি টুথপিক বা স্পঞ্জ জল বা ব্র্যান্ডিতে ভিজিয়ে দাঁত পরিষ্কার করতে উত্সাহিত করেছিলেন।
প্রাচীনকালে পশুর পশম দিয়ে টুথব্রাশ তৈরি করা হতো। আজকে আমরা যেই ব্রাশ দেখি সেটা ১৭০০ শতকের দিকে উইলিয়াম অ্যাডিস নামের একজন ইংলিশ ব্যক্তির হাত ধরে প্রসার লাভ করে। তিনি এই ব্রাশের ব্যাপক বিপণন কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। কারাগারে থাকাকালীন হাড় এবং পশুর মাংস থেকে টুথব্রাশ তৈরির পরে তিনি এই ধারণাটি পেয়েছিলেন। এখনো কিছু কিছু জায়গায় পশুর পশম দিয়ে ব্রাশ তৈরি করা হয়।
১৯ শতকের দিকে আমেরিকায় টুথব্রাশের ব্যবহার ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। বাচ্চাদেরকে ব্রাশ করার নিয়ম শেখানো হয়। ফ্যাক্টরিগুলো শ্রমিকদের নিয়মিত ব্রাশ করার পরামর্শ দেয় যাতে দাঁতের ব্যথার কারণে তারা কাজে অনুপস্থিত না থাকে। এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সেনাবাহিনীর জন্য দাঁত ব্রাশ করাকে প্রাত্যহিক রুটিন হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯৩৮ সালে প্রথম নাইলনের টুথব্রাশ তৈরি করা হয় যা সেনাবাহিনীকে প্রদান করা হয়।
বর্তমানে চিবানো টুথব্রাশ নামে আরেক প্রকার টুথব্রাশ পাওয়া যায় যা দেখতে ক্ষুদ্র আকৃতির প্লাস্টিক বা কৃত্রিম বস্তুর ছাঁচ দিয়ে তৈরি এক ধরনের টুথব্রাশ। এরজন্যে কোনো পানির প্রয়োজন পড়ে না। এটি দেখতে খুবই ছোট প্রকৃতির। ভেজানোরও দরকার নেই। চিবানো টুথব্রাশে বিভিন্ন সুগন্ধি মিশ্রণ হিসেবে মিন্ট বা বাবলগামের মতো উপকরণ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু এটা একবারই ব্যবহার করা যায়।
আধুনিক সভ্য সমাজে টুথব্রাশ প্রচলনের অনেক আগে থেকেই বহুবিধ উপায়ে মুখের স্বাস্থ্য রক্ষা তথা দাঁতের পরিচর্যা করা হতো। সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন গবেষকদের কাছে টুথব্রাশের পূর্ব-পুরুষ হিসেবে বিভিন্ন উপকরণের বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এরমধ্যে লাঠি চিবানো, গাছের চিকন ডাল, পাখির পালক, পশুর হাড় এমনকি প্রাণীদেহের আত্মরক্ষামূলক ধারালো কাঁটা অন্যতম। নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ঘোড়ার চুল দিয়ে তৈরি টুথব্রাশের সাহায্যে দাঁত পরিষ্কার রাখতেন বলে জানা যায়।