নমোফোবিয়া : ফোন হারানো চার্জ ফুরানোর ভয় যখন একটা রোগ



আহমেদ দীন রুমি, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
মোবাইল ফোন বুঁদ করে ফেলেছে আধুনিক প্রজন্মকে

মোবাইল ফোন বুঁদ করে ফেলেছে আধুনিক প্রজন্মকে

  • Font increase
  • Font Decrease

মোবাইল ফোন আমাদের আধুনিক জীবনকে অনেকাংশেই সহজ করে দিয়েছে। অনেক বড় সমাধান থেকে অতি তুচ্ছ প্রয়োজনের জন্যেও হাতের মোবাইলের উপর ঝুঁকে পড়ে অনেকেই। তার ওপর নতুন মাত্রা যোগ করেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। সুবিধার চূড়ান্ত দেবার মাধ্যমে এই যে নির্ভরশীলতা তৈরি করেছে, তা জন্ম দিচ্ছে এক নতুন ধরনের সমস্যার। নমোফোবিয়া, ফোন হারানোর উৎকণ্ঠা কিংবা চার্জ ফুরিয়ে যাবার ভয়।

নমোফোবিয়া শব্দটি এসেছে ইংরেজি কয়েকটি শব্দের মিশ্রণে। Nomophobia = No + Mobile + Phone + Phobia। নমোফোবিয়াকে প্রথম সংজ্ঞায়ন করে যুক্তরাজ্যের গবেষণা সংগঠন YouGov। সাদামাটাভাবে বললে ফোবিয়া হলো অযৌক্তিক ভয় বা অকারণ উৎকণ্ঠা। আর নমোফোবিয়া বলতে বোঝায় মোবাইলবিহীন থাকার ভয়। সিগনাল কিংবা ব্যাটারিজনিত কারণে মোবাইলের সাথে সংযোগ ছিন্ন হতে পারে, ক্ষণিকের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়তে পারে; প্রভৃতি কারণে প্রিয়াবিরহের মতো মোবাইলপ্রেমিকের ভেতরে যে উৎকণ্ঠা, তাই নমোফোবিয়া। ২০০৮ সালে চালানো এক গবেষণায় দেখা গেছে মোবাইল ব্যবহারকারীদের মধ্যে শতকরা ৫৩ জন এই সমস্যায় আক্রান্ত। অর্ধেকের বেশি ব্যবহারকারী তাদের ফোন বন্ধ করেন না। গবেষণায় আরো দেখা গেছে এই সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/18/1566135919566.jpg

◤ নমোফোবিয়া: আধুনিক প্রযুক্তির প্রতিক্রিয়া ◢


ভ্রমণে কিংবা বাসায়—প্রায়ই এই ধরনের মানসিক বিভ্রান্তির দেখা মেলে। মনোবিজ্ঞানীরা একে “লো-ব্যাটারি অ্যাংজাইটি” বলে চেনেন। মানুষের জীবন দিনকে-দিন বিভিন্ন প্রযুক্তিতে ঘিরে ফেলছে। মানুষের কাজ করে দিচ্ছে নতুন নতুন ডিভাইস। সরাসরি কথা, সামাজিক যোগাযোগ, জিপিএস, গাড়ির সেবা, খাবারের অর্ডার, গেইম, ভিডিও বিনোদন, ব্যাংকিং, ক্যালেন্ডার, ক্যালকুলেটর, পরিবারের ছবি প্রভৃতি এখন কেবলমাত্র একটি ছোট্ট যন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব—সেলফোন।

জীবন যাপনের সুবিধার জন্যই মানুষ ক্রমশ এনালগ ছেড়ে ডিজিটাল পৃথিবীতে প্রবেশ করছে। সকল ধরনের কাজে সরাসরি নিজেকে না জড়িয়ে ঝুঁকছে অনলাইন সুবিধার প্রতি। আর তাই, অল্প সময়ের জন্য ব্যাটারিতে চার্জ না থাকা কিংবা কোনো কারণে সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়া ভয়ের উদ্রেক করে। হারিয়ে ফেলা কিংবা একা হয়ে যাবার ভয়।

ব্যাটারি যখন শেষ

আধুনিক যামানার ভৌতিক সিনেমাগুলোতেও দেখা যায়, সেলফোনের ব্যাটারি শেষ হয়ে যাওয়ার মানে একটা খারাপ কিছু ঘটতে চলছে। ব্যক্তিকে একা করে ফেলা ক্লাসিক হররগুলোর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৯৬০ সালের Psycho, ১৯৭৪ সালের The Texas Chain Saw Massacre, ১৯৮০ সালের The Shining এমনকি গত ২০১৭ সালের Get Out প্রায় একইভাবে ফুটিয়ে তুলেছে বিষয়টা। মোবাইল না থাকার দরুণ সৃষ্ট এই নিঃসঙ্গতায় ভীতি।

লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি প্রযুক্তির ওপরেই মূলত আমরা দৈনন্দিন জীবনে ভরসা করে থাকি। ১৯৭০ সালের দিকে ইংরেজ রসায়নবিদ স্টেনলি হুইটিংহাম এর আবিষ্কার করেন। তিনি তখন Exxon Corporation-এ গবেষণায় মগ্ন। তবে লিথিয়াম-পলিমার ব্যাটারির আগমন ছিল রীতিমতো বিপ্লবের মতো। লিথিয়াম-আয়ন এবং লিথিয়াম-পলিমার ব্যাটারির মধ্যেকার পার্থক্য ইলেক্ট্রোলাইটের ব্যবহারে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/18/1566135953565.jpg

◤ ব্যাটারি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিস্ময়করভাবে ◢


লিথিয়াম-পলিমার ব্যাটারিতে কঠিন পলিমার ইলেক্ট্রোলাইট ব্যবহার করা হয়। যেমনটা polyacrylonitrile এবং এনোডে প্লাস্টিকজাতীয় পদার্থ। অন্যদিকে লিথিয়াম-আয়নে জৈব দ্রবণে ইলেক্ট্রোলাইট হিসাবে ব্যবহৃত হয় লিথিয়াম লবণ। ফলে লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারি তাড়াতাড়ি অতিরিক্ত গরম হয়ে পড়তে পারে।

আধুনিক যামানায় সেলফোনপ্রযুক্তির সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে ব্যাটারিপ্রস্তুতি। ব্যাটারি প্রস্তুতকারীরা মনোযোগী অধিক ধারণ ক্ষমতা আনতে। কিন্তু যখনই তারা ব্যাটারির সক্ষমতা বৃদ্ধি করছে, সেলফোন প্রস্তুতকারীরা সাথে সাথেই বের করছে নতুন কোনো ফিচার, যা পাওয়ার কমাবে। এভাবে সেলফোনের ফিচারগুলো ব্যাটারির পাওয়ার নামিয়ে আনে, আর প্রস্তুতকারীরা যোগ করে।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/18/1566136128928.jpg

◤ মোবাইল কোম্পানিগুলো এই উদ্বেগ কাজে লাগাচ্ছে ◢


মোবাইল কোম্পানিগুলো ক্রেতার এই উদ্বেগকে ব্যবহার করছে বেশ ভালোভাবেই। চার্জ দেবার জন্য ওয়্যারলেস সুবিধাসহ নতুন সেলফোন আসছে আজকাল। Qi Standard (উচ্চারণ. চি স্ট্যান্ডার্ড) পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। আরোহী পদ্ধতিতে চার সে.মি. দূরত্ব পর্যন্ত চার্জ দেওয়া সম্ভব।

চি পদ্ধতিটা মূলত তড়িৎচৌম্বকক্ষেত্র সৃষ্টির মধ্য দিয়ে কাজ করে। সেলফোন কোম্পানিগুলো এই বিশেষত্বকে খুব দ্রুত ক্রেতার চাহিদার সাথে মানিয়ে নিচ্ছে। এই সুবিধাহীন পুরানা ধাঁচের মোবাইলগুলোর জন্য এডাপ্টরের মাধ্যমে পোর্টে সংযোগ দেওয়া যায়। এমনিতেই তারের মাধ্যমে চার্জ দেওয়ার চেয়ে ওয়্যারলেস চার্জ সময়বহুল। আর যদি এডাপ্টার ব্যবহার করা হয়, তবে তো কথাই নেই।

দ্য এন্ড্রয়েড পাই অপারেটিং সিস্টেম ব্যাটারি লো হয়ে গেলে ব্যবহারকারীকে নোটিফিকেশন পাঠায়। উপরের কোনায় চার্জের শতকরা প্রদর্শন তো আছেই। আইফোন এক্স তাদের ফোনের ব্যাটারি আইকন থেকে আইকন সরিয়ে ফেলেছে। দেখতে হলে যেতে হবে কন্ট্রোল সেন্টার। সে যা-ই হোক, উভয় ক্ষেত্রেই চার্জ ফুরিয়ে আসতে গেলে নোটিফিকেশন আসে, লো পাওয়ার মুডে চালানোর জন্য; যাতে কম চার্জ ফুরায়।

কাজ হোক আর না হোক, ব্যাটারির সক্ষমতা ক্রেতাকে ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করে। ব্যবসার ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর কাছে এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ টোপে পরিণত হয়েছে।

নমোফোবিয়ার লক্ষণ

বছর দশেক আগেও হয়তো কেউ প্রিয়তমার উদ্দেশ্যে বলত, আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না। কিন্তু হাল আমলে সেই স্থান দখল করেছে সেলফোন। মনোবিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য মতে, নিম্নোক্ত বিষয়গুলোকেই ধরে নিতে হবে নমোফোবিয়ার লক্ষণ—
১) রাতে ঘুম ভেঙে যদি প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর সেলফোন চেক করতে হয়।
২) দুপুরে কিংবা রাতে খাবার সময়েও যদি মোবাইল প্রাধান্য পায়।
৩) ব্যাটারি ফুরিয়ে যেতে চাইলে যদি চার্জে দেবার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে পড়ে।
৪) ফোনে সিগনাল না থাকলে যদি মনে হয়, জীবন থেকে বাইরে।
৫) যত ব্যস্ততাই থাক, যদি ফোনের জবাব দেবার জন্য ভেতর থেকে তাড়না আসে।
৬) ওয়াশরুমে পর্যন্ত ফোন হাতে করে নিয়ে যাবার অভ্যাস গড়ে উঠলে।
৭) এই আর্টিকেল পড়ার মধ্যে বেশ ক’বার যদি ফোন চেক করে ফেলা হয় 

নমোফোবিয়ার ক্ষতি

বেশিরভাগ সমস্যাই মনস্তাত্ত্বিক। তবে এর ফলাফল সদূরপ্রসারী। ব্যক্তিগত জীবন থেকে সামাজিক জীবনে বাধাগ্রস্ত হতে পারে তুচ্ছ এক অভ্যাসের কারণে। ক্রমানুসারে উল্লেখ করলে—
১) যেহেতু উদ্বেগ বাড়িয়ে দেয়, সেহেতু রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে ব্যক্তির নিজের কাজের দিকে মনোযোগ কমিয়ে দেয়। ফলে উৎপাদন ক্ষমতায় কমে যায়।
২) সময়ের দারুণ অপচয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, একসাথে বহু কাজ করার মানে কোনো কাজই না করা। হাতে মোবাইল নিয়ে অন্য কাজ করতে চাওয়াটা অন্য অর্থে সময় নষ্টের নামান্তর।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/18/1566136283424.jpg

◤ নমোফোবিয়া ক্ষতিগ্রস্ত করে ঘুমের প্যাটার্নে ◢


৩) ঘুমের প্যাটার্ন বিঘ্নিত করে। ফোন থেকে নীল আলো চোখে পড়া ঘুমের জন্য ক্ষতিকর। এর কারণে মেলাটোনিন হরমোনের ক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। বলা বাহুল্য, মেলাটোনিন হরমোন ঘুমের ছন্দ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দায়ী।
৪) লাগাতার ফোনের সাথে লেগে থাকা চর্মরোগ, এলার্জি কিংবা নানা ধরনের রোগের জন্ম দিতে পারে।
৫) সর্বোপরি বন্ধু ও পরিবারের সাথে বিদ্যমান সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলে। বন্ধু বা পরিজনের সাথে কথা বলার সময় ঘন ঘন মোবাইলের নোটিফিকেশন চেক করা নিশ্চই ভালো দেখায় না। এই অভ্যাস কর্মক্ষেত্রে ও ব্যক্তিগত জীবনে ভয়াবহ ক্ষতিকর।

উপায় ও প্রতিকার

সব সমস্যারই সমাধান থাকে। নমোফোবিয়ার সমাধানও গবেষকদের ধারণায় বেরিয়ে এসেছে। তবে তা পুরোটাই নির্ভর করে ব্যক্তির অভ্যাস ও আত্মনিয়ন্ত্রণের ক্ষমতার ওপর—
১) ঘুমের আগে মোবাইল বন্ধ করে ঘুমানো, যেন নিদ্রা বিঘ্নিত না হয়।
২) নোটিফিকেশন নিয়ন্ত্রণে আনা। সবরকম অ্যাপ থেকে সব ধরনের নোটিফিকেশন বিরক্তিকর।

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2019/Aug/18/1566136344305.jpg

◤ মোবাইল না দেখে চালু করতে হবে ঘড়ি দেখার অভ্যাস ◢


৩) অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ্লিকেশনগুলো ডিলিট করে দেওয়া। 
৪) মোবাইল না, সময় দেখার জন্য ঘড়ি ব্যবহারের অভ্যাস করা।
৫) নিজের জন্য ফোন-ফ্রি জোন তৈরি করা। কাজের সময় ফোন দূরে সরিয়ে রাখা।
৬) বন্ধু ও পরিবারের সাথে বেশি সময় ব্যয় করা। ফোনের সাথে সীমিত ও হিসাব করে সময় দেওয়া।

জীবন যাপনে আধুনিকায়ন মানুষকে সমাজবিমুখ করে দিয়েছে। নির্ভরশীল করে দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ওপর। আর তাই হাতের সেলফোনটা কেবল সেলফোন হয়ে নেই, পরিণত হয়েছে সবথেকে মূল্যবান সঙ্গী হিসাবে। মোবাইল হারানোর যে উদ্বেগ, তার পেছনের মনস্তত্ত্ব মূলত এটাই। আর তাই আগামী প্রজন্ম নমোফোবিয়া থেকে কিভাবে বের হবে কিংবা আদতে বের হতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা।

   

ইতিহাসে ২৮ মার্চ: বর্ণবাদের প্রতিবাদে কিংয়ের পক্ষে ২৫ হাজার মানুষ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

  • Font increase
  • Font Decrease

মানব ইতিহাস আমাদের অতীতের কথা বলে। আজ যা কিছু বর্তমান তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমাদের অতীতের কারণেই। সেই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ছাপ রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়।  

আজ ২৮ মার্চ, ২০২৪। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখঅ যাবে, আজকে ঘটেছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। জেনে নেয়া যাক, কি ঘটেছিল আজকের তারিখে!

*মার্টিন লুথার কিং ছিলেন বর্ণবাদের বিপরীত আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। সেখানে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাকে সমর্থন করে মিছিলে নেমেছিলেন আজকের তারিখে। এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে আলাবামায় জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।    

*যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৭৯ সালে পানির পাম্প ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে চারপাশে তেজস্ক্রিয় বাষ্প এবং আয়োডিন ছড়াতে শুরু করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত ৫০০ জন কর্মী এই বাষোপর সংস্পর্শে আসায় শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় ছিল। আমেরিকার জনগণ এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।  

*১৯৮৬ সালে অ্যাচেসন এবং লিলিয়েনথাল পারমারবিক শক্তি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন তারা। ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।

*হিলসবোরো দুর্ঘটনায় প্রায় ১শ লোকের প্রায় গিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শেফিল্ডে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন লিভারপুল ফুটবল সমর্থক নিহত হন। এছাড়া আরও দেড় শতাধিক ভক্ত আহত হন। এই বিপর্যয়ে আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট ছিল নিহতদের পরিবার। তাই, আজকের তারিখে তারা রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

*১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ শেষ হয়েছিল।

;

তালপাতার পাখায় ঘোরে সংসারের চাকা



মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। যা দেখে মনে পড়ে যায় রবী ঠাকুরের কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ বলছি বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের কথা। বর্তমানে গ্রামটি তাল পাখার গ্রাম নামে পরিচিত। এই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গরমে তালপাতার পাখার বাতাস গা জুড়িয়ে যায়।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম যোগীরভবন, অপরটি আড়োলা আতালপাড়া। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি গ্রামে একেক পাড়ায় একেক ধরনের পাখা তৈরি হয়। যোগীরভবন গ্রামে নারীরা তৈরি করেন হাতলপাখা বা ডাঁটপাখা। আর আড়োলা আতালপাড়ায় তৈরি হয় ঘোরানো পাখা বা ঘুন্নী পাখা আর পকেট পাখা। পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দুটি গ্রামের সব নারী। শীতের শেষে বসন্তকালে, অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়।

পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী

গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বাড়ির উঠানে রং তুলির আঁচড়ে ঘুরানো পাখা রাঙিয়ে তুলছেন সখিনা বেগম। রাঙানো পাখা বাঁধায় করছেন গোলজার। বাঁধা হয়ে গেলে পাখাটি বিক্রি করবেন তিনি।

হাতপাখার গ্রামে এবার ২০ লাখ পাখা বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এই পাখা চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হবে।

গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা অবসর সময়ে পাখা তৈরির কাজ করেন। বংশ পরম্পরায় এই দুই গ্রামের মানুষ তালপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। গরমে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে পাখার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পাখা তৈরির কাজের পরিধি।

আড়োলা গ্রামের খন্দকার বলেন, দাদার আমল থেকে তারা তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরির কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রীও সংসারের কাজের ফাঁকে রঙের আচর দিয়ে তাল পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকেন। আকরাম আকন্দ বলেন, গত বছর তিনি পাখা বিক্রি করে সংসার খরচ বাদে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার মতে গত বছর দুই গ্রাম থেকে ১৫ লাখ তালপাখা বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার চাহিদা বাড়ায় ২০ লাখ পাখা বিক্রি হবে বলে তিনি জানান।

জানা যায়, তালগাছের পাতা (স্থানীয় ভাষায় তালের ডাগুর) দিয়ে তিন ধরনের পাখা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে নাম দেয়া হয়েছে- পকেট পাখা, ঘুরানী পাখা এবং ডাগুর পাখা।

পাখা তৈরিতে তালের পাতা ছাড়াও বাঁশ, সুতা এবং লোহার তার প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরির পর বিভিন্ন রঙের আচর দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। ১০ টাকায় কেনা তাল গাছের একটি পাতা বা ডাগুড় দিয়ে তৈরি হয় বড় পাখা বা ডাগুর পাখা ২টি, ঘুরানী পাখা ৪টি এবং পকেট পাখা ৬টি।

তালপাতার পাখা

পাখা তৈরির কারিগর জানান, বছরের আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহের কাজ। এরপর বাঁশ ছোট ছোট আকারে কাটতে হয়। তালপাতাও কেটে পাখা তৈরির উপযোগী করা হয়। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ করে বিক্রয় উপযোগী করা হয়।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসেন তালপাখা কিনতে।

যোগীর ভবন গ্রামের মামুনুর রশিদ বলেন, তিনি প্রতি বছর ১৭ থেকে ১৮ হাজার ডাগুর পাখা তৈরি করেন। এই পাখাগুলো বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখার চাহিদা বেশি বলে জানান মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, একটি তাল পাতা বা ডাগুরের দাম ১০ টাকা হলেও বাঁশ ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

আতাইল পাড়া গ্রামের পারভীন, মর্জিনা, সাবিনা, বেবি, সুমি জানান, তারা প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। বছরের ছয় মাস সংসারের কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরির কাজ করে তারা বাড়তি আয় করছেন। এইসব নারীরা তাদের সৌখিন জিনিস কিনে থাকেন নিজের টাকায়।

পকেট পাখা ১১ টাকা, ঘুরানী পাখা ২০ টাকা এবং ডাগুর পাখা ৩০ টাকা দরে ব্যাপারীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।

গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে হাতপাখার চাহিদা বাড়ছে বলে পাখা কিনতে আসা ব্যাপারী করিম জানান। শহর এবং গ্রামে তীব্র গরম থেকে একটু প্রশান্তি পেতে ধনী-গরিব সবাই হাত পাখার ব্যবহার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

;

ইতিহাসে ২৭ মার্চ:স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

  • Font increase
  • Font Decrease

সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান হয় অতীত। তার সাথেই তৈরি হয় ইতিহাসের। মানব সভ্যতায় ঘটে যাওয়া ইতিহাস হয়ে থাকে জাতির কাছে স্মরণীয়। প্রতি বছর যখন ক্যালেন্ডারে একই তারিখগুলো ফিরে আসে, মানুষ পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।

আজ ২৭ মার্চ, ২০২৪। বিগত বছরগুলোতে এই তারিখে ঘটা অনেক ঘটনা হয়েছে স্মৃতিতে অমলিন। ইতিহাসের পাতায় জুড়ে গেছে নতুন নতুন ঘটনা। চলুন জেনে নিই,আজকের তারিখে কি ঘটেছিল!    

১৯৭৭ সালে স্পেনে টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ডাচ এয়ারলাইনের সেই দুর্ঘটনায় কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রানওয়েতে দু’টো জেট বিমানের সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে উৎপন্ন বিধ্বংসী দাবানলে সর্বমোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৮০ সালে উত্তর সাগরের প্ল্যাটফর্ম ধসে পড়ে। রিগটি ডান্ডি থেকে ২৩৫ মাইল পূর্বে সেই আবাসন প্ল্যাটফর্ম দুর্ঘটনায় ১২৩ জন শ্রমিক মারা যান।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কমিউনিটি পার্টির অনেক রাশিয়ান উচ্চতর কর্মকর্তা পরাজিত হন। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাকে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।     

১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে রেললাইন কম ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষতি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোট রেলব্যবস্থার এক-চতুর্থাংশ সেবা কমিয়ে দেওয়া হবে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২৭ মার্চ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

;

আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয় ‘পাক বিধান’



সম্পাদকীয় বিভাগ, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, স্বল্প সময়েই এর প্রবক্তাদের উচ্চাশা কোটি কোটি অধিবাসীদের দুরাশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তা পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন অবিচার আর দুঃশাসনে এক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র ধারণ করে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে মোহিত করা অধুনা পূর্ববঙ্গবাসীর আকাঙ্খা বছর গড়াতেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। শুরু হয় নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের প্রাণান্তর চেষ্টা। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা প্রশ্নে উদাসীন পিন্ডির শাসকদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে বাংলা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ও দুই লক্ষ নারীদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত মুক্তি।

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জানার চেষ্টা করব ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বাঙালি জাতি কি আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিল। ১০ চৈত্র ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯) কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে সেই সময়কার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে বার্তা২৪.কম পুনঃপ্রকাশ করছে আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয়।

গত চার মাস ধরিয়া পাকিস্তানে যে তুলকালাম কা- চলিয়াছে নানা জন নানা ভাবে তাহার ব্যাখ্যা করিতে চাহিবেন এটাই স্বাভাবিক। কেহ বলিতেছেন, পাকিস্তান আর একটি বিয়াফ্রা বা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হইতে চলিয়াছে। মৌলানা ভাসানিরও মনে হয় তাহাই অভিমত, তিনি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়াছেন, বলিয়াছেন, সে মহৎ কর্মে কুড়িলক্ষ পাকিস্তানীর জান কোরবানি করিতে তিনি তৈয়ার। লারকানরি আমুদে-যুবা ভুট্টো ‘প্লেবয়’ হিসাবে খ্যাত হইলেও আগুন লইয়া খেলায় কতখানি মাতিবার সামর্থ্য রাখেন, সে বিষয়ে অনেকেরই বিলক্ষণ সন্দেহ। বিশেষতঃ, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু ফৌজীদের ঘাঁটি নয়, মওদুদি তথা মোল্লাদেরও ছাউনি পড়িয়াছে। শুধু ভুট্টোর ধারণা নাকি পাকিস্তানে ‘বিপ্লব’ চলিয়াছে, এবং এ বিপ্লব যদিও অন্তরে ঐশ্লামিক, লক্ষ্যে-সমাজতান্ত্রিক।

চারিদিকে সকলের মুখে মুখে যখন ‘‘বিপ্লবের’’ ফুলঝুরি, তখন পাক-আইনমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ জাফর অনায়াসে প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকেও আখ্যা দিতে পারিতেন-‘‘বিপ্লব’’। একসঙ্গে শাসনতন্ত্রের নব্বুইটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে বিপ্লবাত্মক। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে আয়ুব যখন আচমকা গদীয়ান হন , সে ঘটনা অন্যের চোখে বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান হইলেও পাকিস্তানে বলা হয় ‘অক্টোবর রিভলিউশন’, আইনমন্ত্রী নির্দ্বিধায় ফেডারেল ব্যবস্থা নামক বিলটির নাম দিতে পারিতেন ‘‘মার্চ রিভলিউশন’’-আয়ুব এক জনমে দুইটি বিপ্লবের কৃতিত্ব লাভ করিতেন!

জাফর সাহেব আয়ুব খাঁর তরফ হইতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা শুনাইয়াছেন তাহার সারমর্মঃ পাকিস্তান এক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। সরকার পরিচালনা করিবেন মন্ত্রিসভা; তাহার শীর্ষে থাকিবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিও থাকিবেন একজন, তবে তিনি থাকিবেন রবার স্ট্যাম্প মাত্র। তাঁহাকে নির্বাচন করিবেন রাজ্য আইনসভার সদস্যবৃন্দ। অন্যরা সকলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত হইবেন, ইত্যাদি কথাবার্তার ধরণ দেখিয়া মনে হইতে পারে চৌদ্দমাস ধরিয়া বিস্তর কাঠখড় পোড়াইয়া মাথা খাটাইয়া ১৯৬২ সনে আয়ুব যে শাসনতন্ত্র তাঁহার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন সেটির খোলনলচে বুঝি সবই পাল্টাইতে চলিয়াছে। বলা হইয়াছে পরিকল্পিত নূতন শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যÑইহা এককেন্দ্রীয় নয়, ফেডারেল বা যুক্ত রাষ্ট্রীয়; দ্বিতীয়ত ইহাতে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত, তৃতীয়ত স্বীকৃত জনসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিও।

শেষোক্ত অধিকারটি নিশ্চয়ই পাক নাগরিকদের কাছে মস্ত পাওনা, এক যুগেরও পরে তাঁহারা একটি মৌলিক অধিকার পাইতে চলিতেছেন। এবিষয়ে পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য আয়ুব অবশ্য ১৯৬৩ সনে একটি কমিশন বসাইয়াছিলেন। তাহারাও বলিয়াছিলেন-প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মানিয়া লওয়া সঙ্গত। আয়ুব তাহাতে রাজী হইতে পারেন নাই, আর একটি কমিটী বসাইয়া সিদ্ধান্তটিকে নিজের পছন্দসই করাইয়া লইয়াছিলেন। আইনমন্ত্রী জাফর বলিয়াছেন-আগামী মাসেই জাতীয় পরিষদে একটি ‘বিল’ আনিয়া সকলকে ভোটের অধিকার দেওয়া হইবে। ‘‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ: না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই’Ñতবু মনে হইতেছে নীট লাভ এইটিই।

যুক্তরাষ্ট্রের যে রূপরেখা মিলিয়াছে তাহাতে মনে হয়, খোল নলচে পালটাইলেও কলকেতে সেই পুরনো তামাকই পুড়িবে। নলটি প্রেসিডেন্টের নয়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগানো থাকিবে-এই যা। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘এক ইউনিট’ কর্তার ইচ্ছায় অতঃপর দুই হইবে হয়তো কিন্তু জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘বহু’ হইতেছে না। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সংসদে সব ত্যাগের সমনাধিকার , অর্থাৎ চলতি নিয়মই বহাল থাকিবে, আসন জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টিত হইতেছে। ফলে পূর্বের উপর পশ্চিমীদের আধিপত্য থাকিয়াই যাইবে।

পাক শাসনতন্ত্রে অমুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই, নয়া-শাসনতন্ত্রে বাঙালী মুসলমানের পক্ষে সে সম্ভাবনা সামান্য। সাত কোটি বাঙালীর উপর পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসন শোষণ চলিতেই থাকিবে। বিশেষত, পাক সামরিক বাহিনীতে বা দেশরক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলে নাই। পাকিস্তানের সামরিক খরচ বাজেটের শতকরা ষাট ভাগের বেশী সেখানে টাকা দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেও কিন্তু বাহিনীতে তাহার ভূমিকা নামমাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাহার আসল বল হাতের ওই মুগুরটি হাতছাড়া করিবে কি?

খাঁটাইয়া দেখিলে সন্দেহ থাকে না, আয়ুব স্বায়ত্বশাসনের ধোঁকা দিতেছেন মাত্র। যে আঞ্চলিক স্বাধীনতার কথা জাফর শুনাইয়াছেন, অন্য ভাষায় পুরনো শাসনতন্ত্রেও সে-সব প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অঙ্গে বৈষম্য তবু বাড়িয়াছে বই কমে নাই। মোটকথা শেখ মুজিবর রহমান যে ছয়দফা চাহিয়াছিলেন তাহার সামান্যই দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাইতেছে। শেখ মুজিবর তাহার ইঙ্গিত পাইয়াই গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলকে আখ্যা দিয়াছিলেন-শূণ্য। তিনি এবং তাঁহার দল নাকি একটি বিকল্প ফেডারেল শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করিতেছেন।

আগামী মাসে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তাহা উত্থাপিত হইবে। তদানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হইবে চারিটি রাজ্য, পূর্বে একটি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লওয়া হইবে। সরকারী ‘‘বিল’’ এবং এই বেসরকারী ‘‘বিল’’-দুইয়ের ভাগ্যই কিন্তু এখন অবধি অনিশ্চিত। আয়ুবের মতলব নাকি-যাবতীয় পরিবর্তনের প্রস্তুতি আগামী বছর ২৩ মার্চের মধ্যে শেষ করা-এক যুগ পরে প্রেসিডেন্টের তখনই বানপ্রস্থে যাত্রার ইচ্ছা। তাঁহার দ্বিতীয় বাসনা, সব পরিবর্তনই নিয়মতান্ত্রিক পথে হোক। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, পাক জাতীয় পরিষদের সম্মতি লইয়া শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্ভব নাও হইতে পারে।

দুই পাকিস্তানেরই প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে সমান, সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ুব কি প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাইবেন? আর মুজিবুরের ‘‘বিল’’ যদি পাস হইয়া যায়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি তাহা মানিয়া লইবেন? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না পাকিস্তানের সংকট কাটিবার মুখে। বরং মনে হইতেছে, প্রকৃত সংকট ক্রমে আরও ঘনাইয়া আসিতেছে। দিশাহারা আয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর বদল করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তানেও মোনেম খাঁর বদলে নূতন গভর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন হুদা।

পশ্চিম হইতে পুবে সৈন্য আমদানির কথাও শোনা যাইতেছে। পাকিস্তান কোন্ পথে চলিয়াছে? বিলাতের একটি কাগজ বলিতেছে-বিচ্ছিন্নতার পথে। নূতন শাসনতন্ত্রে জোড়াতালির যতো চেষ্টাই করা হোক, একটি সত্য আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট, ধর্মীয় ঐক্য খানিকদূর অবধি কাজে লাগে, বেশীদূর নয়। যদি তাহা না হইত তবে লাহোর অধিবেশনের আটশ বছর পরে, পাকিস্তান-স্বপ্নের তথাকথিত ঐতিহাসিক জন্মতারিখের দুইদিন আগে পাক নেতাদের এই মেকি ‘ফেডারেল-ইজম’ এর স্তোকবাক্য শুনাইতে হইত না!

প্রকাশকাল: সোমবার ১০ চৈত্র ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯): আনন্দবাজার পত্রিকা

সংগ্রহ: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;