ইউরোপের নাম কেন ইউরোপ হলো
হালের ভূ-তাত্ত্বিকেরা সাতটা মহাদেশ নিয়ে বিভোর। মানুষের ইতিহাসে মহাদেশের ধারণা বহু প্রাচীন। মধ্যযুগের ইবনে খালদুন কিংবা ইদ্রিসীদের রচনায় পৃথিবীকে ভাগ করে জলবায়ু বিশ্লেষণ করা চোখে পড়ে। তারও আগে টলেমি, হেরোডোটাস কিংবা থুসিডাইডিসের মতো পণ্ডিতেরা পৃথিবীর আকার-আকৃতি ও বিভাজন নিয়ে ভেবেছেন। প্রাচীন গ্রিকরা পৃথিবীকে তিনটা প্রধান ভাগে ভাগ করে ভাবতেন। ইউরোপ, এশিয়া এবং লিবিয়া। তৎকালীন লিবিয়া বলতে বোঝাত আফ্রিকার উত্তর অংশ। খ্রিস্টের জন্মের দুইশো বছর আগে টলেমি তার Guide to Geography অনুরূপ চিন্তার নজির দেখিয়েছেন। মোটকথা, ইউরোপের ধারণা মানুষের কাছে খুব পুরাতন। প্রশ্ন হচ্ছে, ইউরোপের নাম কেন ইউরোপ হলো?
বাস্তবিকপক্ষে ইউরোপের তল খুঁজে পেতে আছে নানা মুনির নানা মত। ইউরোপকে মধ্যযুগে আমেরিকা আবিষ্কারের মতো করে তো আর আবিষ্কার করা হয়নি। হোমো স্যাপিয়ান্স আফ্রিকা থেকে বের হয়ে ইউরোপে থিতু হয়েছে, এমনটাই ধারণা ইউভাল নোয়া হারারিসহ প্রায় সব ঐতিহাসিকদের। ইউরোপের স্থানীয় নিয়ান্ডার্থালদের বিলুপ্তির পেছনে এটাই মূলত প্রধান কারণ।
যা-ই হোক, ভাষাবিজ্ঞানীদের অনেকেই দাবি করেন ইউরোপ শব্দটি প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে আগত। মূলগত শব্দ Eurys এর অর্থ প্রশস্ত এবং Ops এর অর্থ মুখ বা চোখ। ইউরোপকে সেজন্য প্রশস্ত মুখমণ্ডল হিসাবে ধারণা করাটা অযৌক্তিক হবে না। মূলত এরকম নামের প্রধান কারণ ইউরোপের সুবিশাল উপকূল। একপাশে কার্থেজ এবং একপাশে ফিনিশীয়া, বাকি অংশ যেন পুরোটাই ইউরোপ। ভূমধ্যসাগরকেন্দ্রিক নৌবাণিজ্যে বিস্তৃত নৌবন্দর ক্রিট থেকে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত। অবশ্য তা গ্রিকদের প্রেক্ষাপটে। গ্রিকদের মতো করে বললে, ইউরোপ ছিল মূলভূমি, পূর্বে এশিয়া আর দক্ষিণে লিবিয়া। যারা কালেভদ্রে ইউরোপের উত্তর অংশে ভ্রমণ করেছে, তারা সাক্ষ্য দিয়েছে উপকূলভাগের অন্য অংশের তুলনায় ইউরোপের বিশালতা। ঘন বন, বিস্তীর্ণ পাহাড় এবং আদিম আবহাওয়াই এরকম নামের মনস্তত্ত্ব গড়ে তুলতে পারে।
পণ্ডিতদের আরেকটা শ্রেণী ইউরোপ শব্দের মধ্যে সেমিটিক আক্কাদিয় গন্ধ খুঁজে পান। তাইগ্রিস এবং ইউফ্রেটিসের কোল ঘেঁষে মেসোপটেমিয় সভ্যতা। হেরোডোটাসের মতে, পৃথিবীর অন্য যে কোনো অংশের তুলনায় তারা সভ্য এবং সমৃদ্ধ। উর্বর অর্ধচন্দ্রিকা হিসাবে খ্যাত কৃষিপ্রধান এই সভ্যতার যোগাযোগ ছিল প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সাথে সমানভাবে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননে প্রমাণিত হয়েছে সিন্ধু সভ্যতা এবং মিশরীয় সভ্যতার সাথে তাদের যোগাযোগ। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় আক্কাদিয় এরেবু শব্দের অর্থ সূর্যাস্ত। যেহেতু মেসোপটেমিয়া অঞ্চল থেকে সূর্যকে পশ্চিমে ডুবতে দেখা যেত, তাই তা পরিচিত হয় এরেবু নামে। ইউরোপ নামটা মূলত এরেবু নামের অপভ্রংশ। অন্য দিকে আক্কাদিয় আরেক শব্দ আসু-এর অর্থ সূর্যোদয়। যা নির্দেশিত করত পূর্বদিক। মনে করা হয়, এই আসু থেকেই এশিয়া শব্দের উৎপত্তি। অর্থাৎ মেসোপটেমিয়াকে কেন্দ্রভূমি ধরে পূর্বের পৃথিবী এশিয়া এবং পশ্চিমের পৃথিবী ইউরোপ।
ইউরোপ নামের আদি খুঁজতে গ্রিক মিথোলজির কথা সামনে না আনাটা অন্যায় হবে। ফিনিশীয় রাজকন্যা এবং দেবী ইউরোপাকে দেবতা জিউস অপহরণ করে নেন। গল্পটা খুবই পরিচিত। এই ইউরোপাই পরবর্তীতে ক্রিটের রাজা মিনোসের মা। কিছু কিছু পৌরাণিক বর্ণনা দেখিয়ে অবশ্য অনেকেই মনে করেন ইউরোপা ছিলেন সামুদ্রিক দেবী। গ্রিক মিথোলজিতে যাদের নামকরণ করা হয়েছে, এমন একচল্লিশ জনের একজন। বিভিন্ন সংস্করণে কৃষি ও শষ্যের দেবী ডিমিটিরের কন্যা বলে ইউরোপাকে উপস্থাপিত করা হয়। মিথোলজি গ্রন্থের লেখিকা এডিথ হ্যামিলটন একটা আখ্যানের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় আমাদের। পাতাল দেবতা হেডেস ইউরোপাকে অপহরণ করেন। কন্যাহারা ডিমিটির রাগে এবং ক্ষোভে শষ্য উৎপাদন বন্ধ করে দিলে মানুষেরা বিপদে পড়ে। বেকায়দায় পড়ে দেবতারাও। নাটকীয় আখ্যানের শেষে ইউরোপা ফিরে আসে ডিমিটিরের কাছে। আবার উৎপাদন ক্ষমতায় পায় শষ্যক্ষেতগুলো। পুরো গল্পটা মূলত গ্রিসে ঋতুধারণার সামগ্রিক ব্যাখ্যা। সেই সাথে ব্যাখ্যা ইউরোপেরও। অসম্ভব না, ইউরোপা ছিল গ্রিকসভ্যতার উত্থানের পূর্বেকার উর্বরতার দেবী। পরবর্তীতে তাকে অভিযোজিত করে নেওয়া হয়েছে। অন্যান্য পরবর্তী দেবতাদের সাথে। আর ইউরোপ নামের আবির্ভাবও সেখান থেকে।