মুক্তিযুদ্ধের গান : আমাদের সাংস্কৃতিক বিপ্লব



রায়হান রহমান রাহিম, কন্ট্রিবিউটর
জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি

জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি

  • Font increase
  • Font Decrease

“মুক্তির মন্দির সোপান তলে
কত প্রাণ হলো বলি দান
লেখা আছে অশ্রু জলে”

পরাধীনতা শেঁকল ভেঙে ১৯৭১ সালে বিশ্ব মানচিত্রে বাঙালি জাতির পূর্ণাঙ্গ আত্মপ্রকাশ ঘটে। জাতি হিসেবে কাগজে কলমে স্বাধীনতার এই স্বীকৃতির সমস্ত ইতিহাস খুঁজলে আজও শুধু রক্তগঙ্গার উত্তাল ঢেউ প্রিয়জন হারিয়ে চিরস্থায়ী শূন্যতার খতিয়ানে তীব্র যন্ত্রণার ইতিবৃত্ত আমাদের বারবার শুধু স্তব্ধই করে দিয়ে যায়। দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধে যাওয়া সমস্ত সূর্য-সন্তানদের এই মহান আত্মত্যাগের পাশাপাশি বাঙালি জাতির একটা বিরাট সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময়কালও কিন্তু ১৯৭১ সাল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন নানা সাংস্কৃতিক চিন্তা, কর্মকাণ্ডের ইতিহাসের দিকে গভীর মনোনিবেশ করলে একটা বিষয় সেখানে খুব স্পষ্ট চোখে পড়ে। সেটি হলো যুদ্ধ চলাকালীন জাতি হিসেবে আমাদের ঐক্যের বুনিয়াদ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে ভেসে আসা ওই গানগুলোই গড়ে দিয়েছিল। উত্তাল সেই দিনগুলোতে প্রিয়জন হারানোর বিভৎস কষ্টে ভেঙে না পড়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ধাবমান প্রত্যেকটি সত্তার কাছে এই গানগুলো এসে এমনভাবে মিশেছিল যেন একেকটা গানই শুধু হতে পারে সম্মুখ সমরে লড়াই চালিয়ে যাবার একমাত্র শক্তি। বিজয়ের এই দিনে রক্ত সংগ্রামে মাখা সেই শক্তিমান গানগুলোকে নিয়ে রইল আজকের পাঠকদের জন্য বিশেষ আয়োজন।

মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গান, তার মনস্তত্ত্ব এবং ইতিহাস সমন্ধে ভালোভাবে জানতে হলে আমাদের একটু পিছনে ফিরে যেতে হবে। কারণ দেশ ও জনতাকে স্বাধীনতাকামী এবং অধিকার সচেতন করে গড়ে তোলার প্রয়াসে গান রচনার ঐতিহ্য শুরু হয়েছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের সময়ে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের তখন দুইটি অংশ ছিল। একটি পূর্ব পাকিস্তান আরেকটি পশ্চিম পাকিস্তান। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানই বর্তমান বাংলাদেশ এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলত। পাকিস্তানের এই দুই অংশের প্রথম বিবাদ শুরু হয়েছিল মাতৃভাষার প্রশ্নে। অন্যায়ভাবে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে চাপিয়ে দেয়ার প্রশ্নে আপোসহীন বাঙালি জনতার ওপর ১৯৫২ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সরকার গুলিবর্ষণ করে। সালাম, বরকত, শফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরো অনেকেই গুলির আঘাতে শহিদ হন। মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দানের ঘটনা সারা পৃথিবীতে এটিই ছিল প্রথম। এবং সে ঘটনার পরপরই চাপের মুখে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল। বলা যায়, জাতির পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার প্রথম প্রচেষ্টাটিই ছিল মাতৃভাষার স্বীকৃতির প্রশ্নে এই প্রাণদানের সংগ্রামী ইতিহাস।

তৎকালীন ২১ শে ফেব্রুয়ারির সেই মর্মান্তিক ঘটনার ওপর ভিত্তি করে বাগেরহাটের চারণ কবি শামসুদ্দিন আহমেদ একটি গান রচনা করেছিলেন—

“রাষ্ট্রভাষার আন্দোলনও
করিলিরে বাঙালি
তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি”

প্রথমে তিনি নিজেই গানটিতে লোকসুর আরোপ করে গাইতেন। পরবর্তীতে শহীদ আলতাফ মাহমুদ গানে নতুন করে সুরারোপিত করেন এবং রথীন্দ্রনাথ রায়ের কন্ঠে গানটি বিখ্যাত হয়।

সে সময়েই ফজল এ খোদা রচনা করেছিলেন আরেকটি গান—

“সালাম সালাম হাজার সালাম
সকল শহীদ স্মরণে
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাঁদের স্মৃতির চরণে
মায়ের ভাষায় কথা বলাতে
স্বাধীন আশায় পথ চলাতে
হাসিমুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ
সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যাই গান
তাদের বিজয় মরণে
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই
তাঁদের স্মৃতির চরণে”

আব্দুল জব্বার সুরে এই গান আব্দুল জব্বারের কণ্ঠেই দেশ জুড়ে প্রবল সমাদৃত হয়।

একুশের যে গানটি আমাদের জাতীয় চেতনার সাথে মিশে আছে সে গানটি রচনা করেছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। ওইদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ শহিদ রফিকের লাশ দেখে ফেরার পর তিনি লেখেন—

“আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু
ঝরা এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি?”

প্রাথমিকভাবে গানটিতে আবদুল লতিফ সুরারোপিত করেছিলেন। পরে শহীদ আলতাফ মাহমুদের সুরে গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।

একুশে ফেব্রুয়ারির আরেকটি গান বেশ বিখ্যাত। আবদুল লতিফের সে গানটি হলো—

“ওরা আমার মুখের ভাষা
কাইড়া নিতে চায়
ওরা কথায় কথায় শিকল পরায়
আমার হাতে পায়”

আবদুল লতিফ নিজেই এই গানটিতে সুর দিয়েছিলেন।

১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ দিবাগত রাতে ঘুমন্ত জনতার ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অতর্কিত হামলা এই দেশের মানুষকে হতবাক করে দেয়। সেই রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার পর পর দেশের প্রায় সব জায়গায় আপামর জনতা পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। দীর্ঘ নয় মাসের সেই যুদ্ধে লক্ষ প্রাণের ঝরে যাবার মধ্য দিয়েই আমরা স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম।

যুদ্ধকালীন আঘাত-পাল্টা আঘাতের পাশাপাশি মননশীলতার যে সংগ্রাম, সেটিও যুদ্ধকে দারুণভাবে গতিশীল করেছিল ৷ ২৫ শে মার্চের ‘অপারেশন সার্চলাইট’-পরবর্তী ২৮ শে মার্চ যত্রতত্র বিমান হামলায় করণীয় সম্পর্কে নির্দেশমালা চট্টগ্রাম বেতার থেকে প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে ৩০ শে মার্চ বেতারে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটি বাজানোর মধ্য দিয়েই ধারণা করা যায় মুক্তিযুদ্ধে দেশের গানের ভূমিকা ইতিহাসের সূচনা।

ওইদিন বেতার কেন্দ্রে পাক বাহিনীর বিমান হামলায় কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায় এবং তারপরই প্রতিষ্ঠাতাগণ দুটি দলে ভাগ হয়ে কিছু অক্ষত বেতার যন্ত্রসহ আগরতলা ও শিলিগুড়ি সংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েন। এবং সেখান থেকেই দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এই মহৎপ্রাণ মানুষেরা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বেতারে সম্প্রচার করতেন। ১০ই এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন-পরবর্তী সরকার ও বেতার কর্মীদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ভারত সরকার তাদের একটি শক্তিশালী ট্রান্সমিটার প্রদান করেছিলেন। তার পরপরই সমস্ত বেতার কর্মীরা ধীরে ধীরে মুজিবনগরে এসে জড়ো হতে থাকেন এবং কলকাতার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি দোতলা বাড়ি থেকে পুনরায় নতুন করে বেতার সম্প্রচার শুরু হয়, যার নাম ছিল ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’।

এই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রই ছিল পুরো মুক্তিযুদ্ধে সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মূল কেন্দ্রবিন্দু। এখানে বসেই গান লিখে, তৎক্ষণাৎ সুর প্রদান করে গেয়ে গেয়ে প্রচার ছিল যুদ্ধের ভেতর আরেক যুদ্ধের মতো কঠিন কাজ। তবে প্রাথমিক অবস্থায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কোনো নিজস্ব গান ছিল না। ডিএল রায়, রবিঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গানগুলোর সাথে গণনাট্য সংঘের গানগুলো প্রচার করা হতো, প্রচার করা হতো একুশে ফেব্রুয়ারির সময়কার গানগুলোও। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে মুক্তিকামী মেধাবী গীতিকার, সুরকার, গায়কেরা স্বেচ্ছায় এসে যোগ দেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে। ধীরে ধীরে তাদের কাছ থেকে একের পর এক কালজয়ী দেশাত্মবোধক গান উঠে আসতে থাকে যা মুক্তি সংগ্রামের লড়াইকে অভূতপূর্ব গতিময়তা প্রদান করেছিল।

সে সময় একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল যাদের নাম না বললেই নয়। ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামের ওই সংগঠনটি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের গান শোনাতে যেতেন। তারা ট্রাকে করে এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে দেশের গান পরিবেশন করে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্বু্দ্ধ করতেন। জানা যায়, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সংগীত পরিচালক সমর দাসের ডাকে সারা দিয়ে তারা বেতারেও গান পরিবেশন করেছিলেন। তাদের এই সংগ্রাম মার্কিন চলচ্চিত্র পরিচালক, আলোকচিত্র শিল্পী লিয়ার লেভিন ফুটেজ আকারে ধারণ করে দেশে ফিরে গেলে পরবর্তীতে সে ফুটেজ থেকেই তারেক মাসুদ এবং ক্যাথরিন মাসুদ নির্মাণ করেন বিখ্যাত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘মুক্তির গান’৷

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে যেসব বিখ্যাত গান তৈরি হয়ে পরবর্তীতে প্রচারিত হয়েছিল সেগুলোই ছিল মুক্তিযোদ্ধা এবং আপামর দেশবাসীর কাছে লড়াইয়ের সাংস্কৃতিক রসদ। সেসব বিখ্যাত গানগুলো সমন্ধে এবার একটু জেনে আসা যাক।

“মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি
মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি”

গোবিন্দ হালদারের লেখা আপেল মাহমুদের সুর এবং কণ্ঠের এই গান শুনলেই বোঝা যায় ঠিক কোন পরিস্থিতিতে পড়ে বাঙালি জাতি যুদ্ধে নেমেছিল।

চিরকালীন শোষণ আর নিপীড়নের বিরুদ্ধে আচমকা যুদ্ধের ইতি বাঙালি বিজয় দিয়েই দেখতে চেয়েছিল যাতে এসে সামিল হয়েছিল অসংখ্য দেশপ্রেমী মানুষের মহান দেশপ্রেমের অনুভব আর প্রাণপণ লড়ে যাবার গৌরবদীপ্ত বাসনা। সে সময় নঈম গহর লিখেছিলেন—

“নোঙ্গর তোলো তোলো
সময় যে হলো হলো
নোঙ্গর তোলো তোলো”

পরবর্তীতে সমর দাস তাতে সুরারোপিত করলে বাঙালি যেন স্বাধীনতার লড়াইয়ে নতুন করে মনে বল অনুভব করে।

গৌরিপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘মাগো ভাবনা কেন’ গানটি শুনতে শুনতে কত তরুণ মুক্তিযোদ্ধা যে ঘর ছেড়ে যুদ্ধে গিয়েছিল ইতিহাসে আজ সেসব হিসেব নেই।

মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মানুষদের মাঝে সংখ্যায় একটা বিরাট অংশ যারা ছিলেন বয়সে তরুণ। তরুণদের বাঁধনভাঙা রক্ত টগবগ করা সাহস স্বাধীনতার সংগ্রামকে দিয়েছিল একটা নতুন মাত্রা। সেইসব তরুণ প্রাণকে উদ্দীপনা প্রদান করতে সে সময়ে রচিত হয়েছে প্রচুর গান। তার মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ গান হচ্ছে গোবিন্দ হালদারের লেখা, সমর দাসের সুর করা—

“পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে
রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল
জোয়ার এসেছে জন সমুদ্রে
রক্ত লাল রক্ত লাল রক্ত লাল
বাঁধন ছেঁড়ার হয়েছে কাল”

গেরিলা যোদ্ধাদের তড়িৎ আক্রমণে পাকবাহিনী প্রায় নাজেহাল দশায় থাকত। মাত্র নয় মাসেই দেশ স্বাধীন হতো না, যদি এই তরুণ গেরিলারা বড় বড় অপারেশনগুলো চোখের পলকে সম্পন্ন করে দিয়ে না আসতেন। তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের সেই উত্তাল সময়ে যে গান প্রবল সাহস দিয়েছিল সেই গানটি আপেল মাহমুদই লিখেছিলেন এবং সুর করেছিলেন—

“তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর
পাড়ি দিব রে
আমরা ক’জন নবীন মাঝি
হাল ধরেছি, শক্ত করে রে”

স্বাধীনতার অনেক বছর পর আজও গানটি সমানভাবে তরুণদেরকে প্রেরণা দেয়।

সে সময়ই গীতিকার নঈম গহরের লেখা আজাদ রহমানের সুরে ফিরোজা বেগম গাইলেন—

“জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো
এমন করে আকুল হয়ে
আমায় তুমি ডাকো
তোমার কথায় হাসতে পারি
তোমার কথায় কাঁদতে পারি
মরতে পারি তোমার বুকে
বুকে যদি রাখো আমায়
বুকে যদি রাখো মাগো”

সর্বস্তরের জনতার অংশগ্রহণ আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে দাবিয়ে রাখতে পারত না। সিকান্দার আবু জাফর সে বুঝেই হয়তো লিখেছিলেন—

“জনতার সংগ্রাম চলবেই
আমাদের সংগ্রাম চলবেই
জনতার সংগ্রাম চলবেই”

পরে সুরকার শেখ লুৎফর রহমানের সুরে শিল্পীরা যখন সম্মিলিত সুরে এই গান গাইলেন তা এক আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতন চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল।

এ ছাড়াও যারা ট্রাকে করে ঘুরে ঘুরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন ক্যাম্পে গান শুনিয়ে আসতেন তারাও সেইসব উত্তাল দিনকে রাঙিয়েছেন সুরের ঐশ্বরিক মূর্ছনায়। লিয়ার লেভিনের রেকর্ডকৃত ১১ টি গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য গানগুলি ছিল—‘পাক পশুদের মারতে হবে’, ‘এই না বাংলাদেশের গান’, ‘আমার সোনার বাংলা’-সহ আরো অনেক অনেক দেশাত্মবোধক গান।

পুরো বিশ্ব জুড়ে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া এই মর্মান্তিক যুদ্ধ সমন্ধে জানান দিতে এগিয়ে এসেছিলেন পণ্ডিত রবিশংকর, জর্জ হ্যারিস, জোয়ান বায়েজের মতো শিল্পীরা। তারাও গানে গানেই জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের কথা, আয়োজন করেছিলেন ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এর।

জোয়ান বায়েজ গেয়েছিলেন—

“Bangladesh, Bangladesh
when the sun sinks in the west
Die a million people of the Bangladesh”

বিটলস এর জর্জ হ্যারিসন গেয়েছিলেন—

“My friend came to me
with sadness in his eyes
told me that he wanted help
before his country dies...”

আশ্চর্যের বিষয় হলো পাকিস্তানিদের এই ধ্বংসতাণ্ডব বাঙালিরা মাত্র নয় মাসেই থামিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু প্রায় ত্রিশ লক্ষ শহিদের হারিয়ে যাওয়ার শূন্যতা আজও দেশবাসী নিজেদের প্রত্যেকটি জাতীয় অর্জনেই সবচেয়ে বেশি অনুভব করে। তাই বিজয়ের মাস এলেই কানে বাজে—

“সব ক’টা জানালা খুলে দাও না
ওরা আসবে চুপি চুপি
যারা এই দেশটাকে ভালোবেসে
দিয়ে গেছে প্রাণ”

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে গীতিকার হিসেবে ছিলেন সিকান্দার আবু জাফর, আবদুল গাফফার চৌধুরী, নির্মলেন্দু গুণ, আসাদ চৌধুরী, টি এইচ শিকদারসহ প্রমুখ গুণী ব্যক্তিত্ব।
আলতাফ মাহমুদ, সমর দাস, আবদুল জব্বার, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, অরুণ গোস্বামী, মান্না হক, মাধুরী চ্যটার্জী, এম চান্দ, ইয়ার মোহাম্মদ, প্রবাল চৌধুরী, কল্যাণী ঘোষ, উমা খান, নমিতা ঘোষ, স্বপ্না রায়, জয়ন্তী লালা, অজিত রায়, সুবল দাশ, কাদেরী কিবরিয়া, লাকি আখন্দ, ইন্দ্রমোহন রাজবংশী, বুলবুল মহালনবীশ, ফকির আলমগীর, মকসুদ আলী সাই, তিমির নন্দী, মিতালী মুখার্জী, মলয় গাঙ্গুলী, রফিকুল আলমসহ আরো নানা শিল্পীর কণ্ঠে সে সময়ে গানগুলো পূর্ণতা পেত। শাহীন সামাদ, বিপুল ভট্টাচার্য, মাহমুদুর রহমান বেনী, তারেক আলী, ডালিয়া নওশীন, শারমীন মোর্শেদ, লতা চৌধুরী, ইনামুল হক, স্বপন চৌধুরী, বেবী চৌধুরীসহ আরো নাম না জানা অনেক শিল্পীদের ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে গান মুক্তির এই সংগ্রামে যোগ করেছিল একটি নতুন মাত্রা।

আজ ১৬ই ডিসেম্বর। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেছন ফিরে তাকালে উত্তাল একাত্তরের সেই সংগ্রামের দিনগুলো যখন সামনে আসে তখন সম্মুখ সমর শেষে একটি মাত্র রেডিওকে খুব কম সাউন্ডে কানের কাছাকাছি এনে মুক্তিযোদ্ধাদের সেইসব জ্বালাময়ী গান শোনাকে কেমন স্বপ্ন মনে হয়।

যদি স্বাধীনতা একটি দেশের প্রাণ হয় সংস্কৃতি তার সৌন্দর্য। সংস্কৃতিকে বুকে আগলে স্বাধীনতার লড়াই মুক্তিযুদ্ধকে যে মহান আবেগের বস্তু বানিয়েছিল, সে ঘটনাই জাতি হিসেবে আমাদের চূড়ান্ত দেশপ্রেমের নিদর্শন।

“এক সাগর রক্তের বিনিময়ে
বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা
আমরা তোমাদের ভুলব না”

গানে গানে মুক্তিযোদ্ধাদের এই মহান আত্মত্যাদের স্বীকৃতি কিন্তু সংগীত শিল্পীরাই প্রথমেই দিয়েছিলেন। সম্মুখ সমর থেকে তাদের লড়াই যে কোনো অংশ থেকে কম ছিল তাও নয়। এখন সেসব জাগরণের গানের সঠিক সংরক্ষণই এই প্রজন্মকে আলোর পথের রাস্তা দেখিয়ে স্বাধীনতার সম্মান ধরে রাখার শক্তি এবং তা আগলে রাখাসূচক গর্বের স্বরূপ কী তা পূর্ণাঙ্গ ভাবে দেখাতে পারে। প্রজন্ম সেদিকে মনোযোগী হবে সে আশাই রইল।

   

ইতিহাসে ২৮ মার্চ: বর্ণবাদের প্রতিবাদে কিংয়ের পক্ষে ২৫ হাজার মানুষ



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

বর্ণবাদের বিরুদ্ধে মিছিলে নামেন মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র

  • Font increase
  • Font Decrease

মানব ইতিহাস আমাদের অতীতের কথা বলে। আজ যা কিছু বর্তমান তার ভিত্তি তৈরি হয়েছিল আমাদের অতীতের কারণেই। সেই অতীতের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলো ছাপ রেখে যায় ইতিহাসের পাতায়।  

আজ ২৮ মার্চ, ২০২৪। ইতিহাসের পাতা ওল্টালে দেখঅ যাবে, আজকে ঘটেছিল নানা ঐতিহাসিক ঘটনা। জেনে নেয়া যাক, কি ঘটেছিল আজকের তারিখে!

*মার্টিন লুথার কিং ছিলেন বর্ণবাদের বিপরীত আন্দোলনকারী আফ্রিকান নেতা। ১৯৬৫ সালে তিনি কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন। সেখানে ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ তাকে সমর্থন করে মিছিলে নেমেছিলেন আজকের তারিখে। এই বিক্ষোভ পরবর্তীতে আলাবামায় জাতি, ধর্ম বা বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার তৈরিতে বিশেষ প্রভাব ফেলেছিল।    

*যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভেনিয়ায় থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক কেন্দ্রে ১৯৭৯ সালে পানির পাম্প ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটে। সেখান থেকে চারপাশে তেজস্ক্রিয় বাষ্প এবং আয়োডিন ছড়াতে শুরু করে। নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্লান্টে কর্মরত ৫০০ জন কর্মী এই বাষোপর সংস্পর্শে আসায় শারীরিক সমস্যার আশঙ্কায় ছিল। আমেরিকার জনগণ এই ঘটনায় দুশ্চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে।  

*১৯৮৬ সালে অ্যাচেসন এবং লিলিয়েনথাল পারমারবিক শক্তি সম্পর্কিত একটি রিপোর্ট তৈরি করেন। সেখানে আন্তর্জাতিকভাবে পারমাণবিক শক্তির নিয়ন্ত্রণের পরিকল্পনা উল্লেখ করেন তারা। ২৮ মার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট তাদের সেই রিপোর্টটি প্রকাশ করে।

*হিলসবোরো দুর্ঘটনায় প্রায় ১শ লোকের প্রায় গিয়েছিল ১৯৯১ সালে। শেফিল্ডে পিষ্ট হয়ে ৯৬ জন লিভারপুল ফুটবল সমর্থক নিহত হন। এছাড়া আরও দেড় শতাধিক ভক্ত আহত হন। এই বিপর্যয়ে আদালতের রায়ে অসন্তুষ্ট ছিল নিহতদের পরিবার। তাই, আজকের তারিখে তারা রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছিল।

*১৯৩৬ সালে শুরু হওয়া স্পেনের গৃহযুদ্ধ ১৯৩৯ সালের ২৮ মার্চ শেষ হয়েছিল।

;

তালপাতার পাখায় ঘোরে সংসারের চাকা



মাহবুবা পারভীন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বগুড়া
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

আঁকাবাঁকা রাস্তার দুই ধারে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি তালগাছ। যা দেখে মনে পড়ে যায় রবী ঠাকুরের কবিতা ‘তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সব গাছ ছাড়িয়ে, উঁকি মারে আকাশে।’ বলছি বগুড়ার কাহালু উপজেলার আড়োলা গ্রামের কথা। বর্তমানে গ্রামটি তাল পাখার গ্রাম নামে পরিচিত। এই গ্রামে প্রবেশ করতেই দেখা যায় নারী-পুরুষ সবাই তালপাতা দিয়ে পাখা বানানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। গরমে তালপাতার পাখার বাতাস গা জুড়িয়ে যায়।

বগুড়ার কাহালু উপজেলার পাইকড় ইউনিয়নের পাশাপাশি দুটি গ্রাম। একটির নাম যোগীরভবন, অপরটি আড়োলা আতালপাড়া। ইতোমধ্যে গ্রাম দুটি পাখার গ্রাম হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি গিয়ে দেখা যায়, দুটি গ্রামে একেক পাড়ায় একেক ধরনের পাখা তৈরি হয়। যোগীরভবন গ্রামে নারীরা তৈরি করেন হাতলপাখা বা ডাঁটপাখা। আর আড়োলা আতালপাড়ায় তৈরি হয় ঘোরানো পাখা বা ঘুন্নী পাখা আর পকেট পাখা। পাখা তৈরির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছেন দুটি গ্রামের সব নারী। শীতের শেষে বসন্তকালে, অর্থাৎ ফাল্গুন মাস থেকে পাখা তৈরির কাজ শুরু হয়।

পাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী

গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে বাড়ির উঠানে রং তুলির আঁচড়ে ঘুরানো পাখা রাঙিয়ে তুলছেন সখিনা বেগম। রাঙানো পাখা বাঁধায় করছেন গোলজার। বাঁধা হয়ে গেলে পাখাটি বিক্রি করবেন তিনি।

হাতপাখার গ্রামে এবার ২০ লাখ পাখা বিক্রির প্রস্তুতি চলছে। এই পাখা চৈত্র মাস থেকে ভাদ্র মাস পর্যন্ত বিক্রি হবে।

গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা অবসর সময়ে পাখা তৈরির কাজ করেন। বংশ পরম্পরায় এই দুই গ্রামের মানুষ তালপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন বলে জানান গ্রামের বাসিন্দারা। গরমে ঘনঘন লোডশেডিংয়ের কারণে দিন দিন বাড়ছে পাখার চাহিদা, সেই সঙ্গে বাড়ছে পাখা তৈরির কাজের পরিধি।

আড়োলা গ্রামের খন্দকার বলেন, দাদার আমল থেকে তারা তাল পাতা দিয়ে হাতপাখা তৈরির কাজ করে আসছেন। কৃষি কাজের পাশাপাশি তালপাখা তৈরির কাজ করেন তিনি। তার স্ত্রীও সংসারের কাজের ফাঁকে রঙের আচর দিয়ে তাল পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ করে থাকেন। আকরাম আকন্দ বলেন, গত বছর তিনি পাখা বিক্রি করে সংসার খরচ বাদে এক লাখ টাকা সঞ্চয় করেছেন। তার মতে গত বছর দুই গ্রাম থেকে ১৫ লাখ তালপাখা বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এবার চাহিদা বাড়ায় ২০ লাখ পাখা বিক্রি হবে বলে তিনি জানান।

জানা যায়, তালগাছের পাতা (স্থানীয় ভাষায় তালের ডাগুর) দিয়ে তিন ধরনের পাখা তৈরি হয়। স্থানীয়ভাবে নাম দেয়া হয়েছে- পকেট পাখা, ঘুরানী পাখা এবং ডাগুর পাখা।

পাখা তৈরিতে তালের পাতা ছাড়াও বাঁশ, সুতা এবং লোহার তার প্রয়োজন হয়। পাখা তৈরির পর বিভিন্ন রঙের আচর দিয়ে সৌন্দর্য বাড়ানো হয়। ১০ টাকায় কেনা তাল গাছের একটি পাতা বা ডাগুড় দিয়ে তৈরি হয় বড় পাখা বা ডাগুর পাখা ২টি, ঘুরানী পাখা ৪টি এবং পকেট পাখা ৬টি।

তালপাতার পাখা

পাখা তৈরির কারিগর জানান, বছরের আশ্বিন মাস থেকে শুরু হয় বাঁশ এবং তালপাতা সংগ্রহের কাজ। এরপর বাঁশ ছোট ছোট আকারে কাটতে হয়। তালপাতাও কেটে পাখা তৈরির উপযোগী করা হয়। ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে পাখা তৈরির কাজ। চৈত্র মাসের শুরু থেকে পাখার সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য বাহারি রঙ করে বিক্রয় উপযোগী করা হয়।

রাজধানী ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, রংপুর, সৈয়দপুর, কুড়িগ্রাম, নীলফামারি থেকে শুরু করে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যাপারীরা আসেন তালপাখা কিনতে।

যোগীর ভবন গ্রামের মামুনুর রশিদ বলেন, তিনি প্রতি বছর ১৭ থেকে ১৮ হাজার ডাগুর পাখা তৈরি করেন। এই পাখাগুলো বরিশাল, সিরাজগঞ্জ, নওগাঁসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি হয়। গত বছরের তুলনায় এ বছর পাখার চাহিদা বেশি বলে জানান মামুনুর রশিদ। তিনি বলেন, একটি তাল পাতা বা ডাগুরের দাম ১০ টাকা হলেও বাঁশ ও রঙের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে খরচ বেড়ে গেছে।

আতাইল পাড়া গ্রামের পারভীন, মর্জিনা, সাবিনা, বেবি, সুমি জানান, তারা প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি হাত পাখা তৈরি করে বিক্রি করেন। বছরের ছয় মাস সংসারের কাজের ফাঁকে হাতপাখা তৈরির কাজ করে তারা বাড়তি আয় করছেন। এইসব নারীরা তাদের সৌখিন জিনিস কিনে থাকেন নিজের টাকায়।

পকেট পাখা ১১ টাকা, ঘুরানী পাখা ২০ টাকা এবং ডাগুর পাখা ৩০ টাকা দরে ব্যাপারীরা পাইকারি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। তারা আবার বিভিন্ন মেলা কিংবা হাটে বাজারে খুচরা বিক্রেতার কাছে বিক্রি করছেন।

গরমের সময় বিদ্যুতের লোডশেডিং বেড়ে যাওয়ার কারণে হাতপাখার চাহিদা বাড়ছে বলে পাখা কিনতে আসা ব্যাপারী করিম জানান। শহর এবং গ্রামে তীব্র গরম থেকে একটু প্রশান্তি পেতে ধনী-গরিব সবাই হাত পাখার ব্যবহার করে আসছেন যুগ যুগ ধরে।

;

ইতিহাসে ২৭ মার্চ:স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

স্পেনে জোড়া বিমান সংঘর্ষে নিহত ৫৮৩

  • Font increase
  • Font Decrease

সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। সময়ের সাথে বছরের পর বছর কেটে যায়। বর্তমান হয় অতীত। তার সাথেই তৈরি হয় ইতিহাসের। মানব সভ্যতায় ঘটে যাওয়া ইতিহাস হয়ে থাকে জাতির কাছে স্মরণীয়। প্রতি বছর যখন ক্যালেন্ডারে একই তারিখগুলো ফিরে আসে, মানুষ পুরনো ঘটনার স্মৃতিচারণ করে।

আজ ২৭ মার্চ, ২০২৪। বিগত বছরগুলোতে এই তারিখে ঘটা অনেক ঘটনা হয়েছে স্মৃতিতে অমলিন। ইতিহাসের পাতায় জুড়ে গেছে নতুন নতুন ঘটনা। চলুন জেনে নিই,আজকের তারিখে কি ঘটেছিল!    

১৯৭৭ সালে স্পেনে টেনেরিফ বিমান দুর্ঘটনা ঘটে। ডাচ এয়ারলাইনের সেই দুর্ঘটনায় কাউকেই জীবিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। রানওয়েতে দু’টো জেট বিমানের সংঘর্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। সেখানে উৎপন্ন বিধ্বংসী দাবানলে সর্বমোট ৫৮৩ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হয়।

বিশাল এক ঢেউয়ের আঘাতে ১৯৮০ সালে উত্তর সাগরের প্ল্যাটফর্ম ধসে পড়ে। রিগটি ডান্ডি থেকে ২৩৫ মাইল পূর্বে সেই আবাসন প্ল্যাটফর্ম দুর্ঘটনায় ১২৩ জন শ্রমিক মারা যান।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই নির্বাচনে কমিউনিটি পার্টির অনেক রাশিয়ান উচ্চতর কর্মকর্তা পরাজিত হন। তৎকালীন সময়ে এই ঘটনাকে একটি বিদ্রোহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল।     

১৯৬৩ সালে ব্রিটেনে রেললাইন কম ব্যবহৃত হওয়ার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপুল ক্ষতি হয়। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় মোট রেলব্যবস্থার এক-চতুর্থাংশ সেবা কমিয়ে দেওয়া হবে। এই নিয়ে সুদূরপ্রসারী একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল ২৭ মার্চ।

তথ্যসূত্র: বিবিসি

;

আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয় ‘পাক বিধান’



সম্পাদকীয় বিভাগ, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৯৪৭ সালে ভ্রান্ত দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, স্বল্প সময়েই এর প্রবক্তাদের উচ্চাশা কোটি কোটি অধিবাসীদের দুরাশায় পরিণত হয়। বিশেষ করে পূর্ববঙ্গকে ‘পূর্ব পাকিস্তান’ করে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রের উদ্ভব হয়, তা পাকিস্তানি শাসকদের সীমাহীন অবিচার আর দুঃশাসনে এক নব্য ঔপনিবেশিক শাসনের চরিত্র ধারণ করে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ ধ্বনিতে মোহিত করা অধুনা পূর্ববঙ্গবাসীর আকাঙ্খা বছর গড়াতেই দুঃস্বপ্নের রূপ নেয়। শুরু হয় নব্যঔপনিবেশিক পাকিস্তানি শাসকদের কবল থেকে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের প্রাণান্তর চেষ্টা। আমরা জানি, পূর্ববঙ্গের ন্যায্যতা প্রশ্নে উদাসীন পিন্ডির শাসকদের বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে উঠা প্রতিরোধ আন্দোলন ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত পরিণতি পায়। ভাষা আন্দোলনে শহিদদের রক্তস্রোতের মধ্য দিয়ে পরবর্তী বছরগুলোতে আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠে বাংলা। ঊনসত্তুরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে একাত্তরের মহান স্বাধীনতা সংগ্রাম ‘মুক্তিযুদ্ধে’ ত্রিশ লাখ শহিদের রক্তে ও দুই লক্ষ নারীদের চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত হয় চূড়ান্ত মুক্তি।

আজ ঐতিহাসিক ২৬ মার্চ, বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে আমরা জানার চেষ্টা করব ঊনসত্তরের উত্তাল দিনগুলিতে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল বাঙালি জাতি কি আত্মপ্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে মুক্তিসংগ্রামের পথে ধাবিত হয়েছিল। ১০ চৈত্র ১৩৮৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯) কলকাতার ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ তাদের সম্পাদকীয় পর্যবেক্ষণে তুলে ধরেছে সেই সময়কার দৃশ্যপট। স্বাধীনতা দিবসের বিশেষ আয়োজনে বার্তা২৪.কম পুনঃপ্রকাশ করছে আনন্দবাজার পত্রিকার সেই অবিস্মরণীয় সম্পাদকীয়।

গত চার মাস ধরিয়া পাকিস্তানে যে তুলকালাম কা- চলিয়াছে নানা জন নানা ভাবে তাহার ব্যাখ্যা করিতে চাহিবেন এটাই স্বাভাবিক। কেহ বলিতেছেন, পাকিস্তান আর একটি বিয়াফ্রা বা ভিয়েৎনাম সৃষ্টি হইতে চলিয়াছে। মৌলানা ভাসানিরও মনে হয় তাহাই অভিমত, তিনি গৃহযুদ্ধের হুমকি দিয়াছেন, বলিয়াছেন, সে মহৎ কর্মে কুড়িলক্ষ পাকিস্তানীর জান কোরবানি করিতে তিনি তৈয়ার। লারকানরি আমুদে-যুবা ভুট্টো ‘প্লেবয়’ হিসাবে খ্যাত হইলেও আগুন লইয়া খেলায় কতখানি মাতিবার সামর্থ্য রাখেন, সে বিষয়ে অনেকেরই বিলক্ষণ সন্দেহ। বিশেষতঃ, পশ্চিম পাকিস্তানে শুধু ফৌজীদের ঘাঁটি নয়, মওদুদি তথা মোল্লাদেরও ছাউনি পড়িয়াছে। শুধু ভুট্টোর ধারণা নাকি পাকিস্তানে ‘বিপ্লব’ চলিয়াছে, এবং এ বিপ্লব যদিও অন্তরে ঐশ্লামিক, লক্ষ্যে-সমাজতান্ত্রিক।

চারিদিকে সকলের মুখে মুখে যখন ‘‘বিপ্লবের’’ ফুলঝুরি, তখন পাক-আইনমন্ত্রী সৈয়দ মহম্মদ জাফর অনায়াসে প্রস্তাবিত শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতিগুলিকেও আখ্যা দিতে পারিতেন-‘‘বিপ্লব’’। একসঙ্গে শাসনতন্ত্রের নব্বুইটি অনুচ্ছেদের পরিবর্তনের চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে বিপ্লবাত্মক। ১৯৫৮ সনের অক্টোবরে আয়ুব যখন আচমকা গদীয়ান হন , সে ঘটনা অন্যের চোখে বিশুদ্ধ সামরিক অভ্যুত্থান হইলেও পাকিস্তানে বলা হয় ‘অক্টোবর রিভলিউশন’, আইনমন্ত্রী নির্দ্বিধায় ফেডারেল ব্যবস্থা নামক বিলটির নাম দিতে পারিতেন ‘‘মার্চ রিভলিউশন’’-আয়ুব এক জনমে দুইটি বিপ্লবের কৃতিত্ব লাভ করিতেন!

জাফর সাহেব আয়ুব খাঁর তরফ হইতে যে শাসনতান্ত্রিক পরিবর্তনের কথা শুনাইয়াছেন তাহার সারমর্মঃ পাকিস্তান এক যুক্তরাষ্ট্রে পরিণত হইবে। সরকার পরিচালনা করিবেন মন্ত্রিসভা; তাহার শীর্ষে থাকিবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতিও থাকিবেন একজন, তবে তিনি থাকিবেন রবার স্ট্যাম্প মাত্র। তাঁহাকে নির্বাচন করিবেন রাজ্য আইনসভার সদস্যবৃন্দ। অন্যরা সকলে প্রাপ্তবয়স্কের ভোটে নির্বাচিত হইবেন, ইত্যাদি কথাবার্তার ধরণ দেখিয়া মনে হইতে পারে চৌদ্দমাস ধরিয়া বিস্তর কাঠখড় পোড়াইয়া মাথা খাটাইয়া ১৯৬২ সনে আয়ুব যে শাসনতন্ত্র তাঁহার দেশকে উপহার দিয়েছিলেন সেটির খোলনলচে বুঝি সবই পাল্টাইতে চলিয়াছে। বলা হইয়াছে পরিকল্পিত নূতন শাসনতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্যÑইহা এককেন্দ্রীয় নয়, ফেডারেল বা যুক্ত রাষ্ট্রীয়; দ্বিতীয়ত ইহাতে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার স্বীকৃত, তৃতীয়ত স্বীকৃত জনসাধারণের ভোটাধিকারের দাবিও।

শেষোক্ত অধিকারটি নিশ্চয়ই পাক নাগরিকদের কাছে মস্ত পাওনা, এক যুগেরও পরে তাঁহারা একটি মৌলিক অধিকার পাইতে চলিতেছেন। এবিষয়ে পুনর্বিবেচনা করিয়া দেখিবার জন্য আয়ুব অবশ্য ১৯৬৩ সনে একটি কমিশন বসাইয়াছিলেন। তাহারাও বলিয়াছিলেন-প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকার মানিয়া লওয়া সঙ্গত। আয়ুব তাহাতে রাজী হইতে পারেন নাই, আর একটি কমিটী বসাইয়া সিদ্ধান্তটিকে নিজের পছন্দসই করাইয়া লইয়াছিলেন। আইনমন্ত্রী জাফর বলিয়াছেন-আগামী মাসেই জাতীয় পরিষদে একটি ‘বিল’ আনিয়া সকলকে ভোটের অধিকার দেওয়া হইবে। ‘‘ঠগের বাড়ির নিমন্ত্রণ: না আঁচাইলে বিশ্বাস নাই’Ñতবু মনে হইতেছে নীট লাভ এইটিই।

যুক্তরাষ্ট্রের যে রূপরেখা মিলিয়াছে তাহাতে মনে হয়, খোল নলচে পালটাইলেও কলকেতে সেই পুরনো তামাকই পুড়িবে। নলটি প্রেসিডেন্টের নয়, প্রধানমন্ত্রীর মুখে লাগানো থাকিবে-এই যা। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের ‘এক ইউনিট’ কর্তার ইচ্ছায় অতঃপর দুই হইবে হয়তো কিন্তু জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী ‘বহু’ হইতেছে না। দ্বিতীয়ত কেন্দ্রীয় সংসদে সব ত্যাগের সমনাধিকার , অর্থাৎ চলতি নিয়মই বহাল থাকিবে, আসন জনসংখ্যার অনুপাতে বন্টিত হইতেছে। ফলে পূর্বের উপর পশ্চিমীদের আধিপত্য থাকিয়াই যাইবে।

পাক শাসনতন্ত্রে অমুসলমানদের রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার অধিকার নাই, নয়া-শাসনতন্ত্রে বাঙালী মুসলমানের পক্ষে সে সম্ভাবনা সামান্য। সাত কোটি বাঙালীর উপর পাঁচ কোটি পশ্চিম পাকিস্তানীর শাসন শোষণ চলিতেই থাকিবে। বিশেষত, পাক সামরিক বাহিনীতে বা দেশরক্ষা ব্যবস্থায় কোন পরিবর্তনের প্রতিশ্রুতি মিলে নাই। পাকিস্তানের সামরিক খরচ বাজেটের শতকরা ষাট ভাগের বেশী সেখানে টাকা দিতে হয় পূর্ব পাকিস্তানকেও কিন্তু বাহিনীতে তাহার ভূমিকা নামমাত্র। পশ্চিম পাকিস্তান তাহার আসল বল হাতের ওই মুগুরটি হাতছাড়া করিবে কি?

খাঁটাইয়া দেখিলে সন্দেহ থাকে না, আয়ুব স্বায়ত্বশাসনের ধোঁকা দিতেছেন মাত্র। যে আঞ্চলিক স্বাধীনতার কথা জাফর শুনাইয়াছেন, অন্য ভাষায় পুরনো শাসনতন্ত্রেও সে-সব প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু পাকিস্তানের দুই অঙ্গে বৈষম্য তবু বাড়িয়াছে বই কমে নাই। মোটকথা শেখ মুজিবর রহমান যে ছয়দফা চাহিয়াছিলেন তাহার সামান্যই দেওয়ার উদ্যোগ দেখা যাইতেছে। শেখ মুজিবর তাহার ইঙ্গিত পাইয়াই গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফলকে আখ্যা দিয়াছিলেন-শূণ্য। তিনি এবং তাঁহার দল নাকি একটি বিকল্প ফেডারেল শাসনতন্ত্রের খসড়া রচনা করিতেছেন।

আগামী মাসে জাতীয় পরিষদের বৈঠকে তাহা উত্থাপিত হইবে। তদানুযায়ী পশ্চিম পাকিস্তানে গঠিত হইবে চারিটি রাজ্য, পূর্বে একটি। কেন্দ্রীয় আইনসভায় আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব মানিয়া লওয়া হইবে। সরকারী ‘‘বিল’’ এবং এই বেসরকারী ‘‘বিল’’-দুইয়ের ভাগ্যই কিন্তু এখন অবধি অনিশ্চিত। আয়ুবের মতলব নাকি-যাবতীয় পরিবর্তনের প্রস্তুতি আগামী বছর ২৩ মার্চের মধ্যে শেষ করা-এক যুগ পরে প্রেসিডেন্টের তখনই বানপ্রস্থে যাত্রার ইচ্ছা। তাঁহার দ্বিতীয় বাসনা, সব পরিবর্তনই নিয়মতান্ত্রিক পথে হোক। কিন্তু অনেকেই আশঙ্কা করিতেছেন, পাক জাতীয় পরিষদের সম্মতি লইয়া শাসনতন্ত্র সংশোধন সম্ভব নাও হইতে পারে।

দুই পাকিস্তানেরই প্রতিনিধি সংখ্যা সেখানে সমান, সুতরাং বর্তমান পরিস্থিতিতে আয়ুব কি প্রয়োজনীয় দুই তৃতীয়াংশ সদস্যের সমর্থন পাইবেন? আর মুজিবুরের ‘‘বিল’’ যদি পাস হইয়া যায়, তবে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা কি তাহা মানিয়া লইবেন? সুতরাং লক্ষণ দেখিয়া মনে হয় না পাকিস্তানের সংকট কাটিবার মুখে। বরং মনে হইতেছে, প্রকৃত সংকট ক্রমে আরও ঘনাইয়া আসিতেছে। দিশাহারা আয়ুব পশ্চিম পাকিস্তানে গভর্নর বদল করিয়াছেন, পূর্ব-পাকিস্তানেও মোনেম খাঁর বদলে নূতন গভর্নর নিযুক্ত হইয়াছেন হুদা।

পশ্চিম হইতে পুবে সৈন্য আমদানির কথাও শোনা যাইতেছে। পাকিস্তান কোন্ পথে চলিয়াছে? বিলাতের একটি কাগজ বলিতেছে-বিচ্ছিন্নতার পথে। নূতন শাসনতন্ত্রে জোড়াতালির যতো চেষ্টাই করা হোক, একটি সত্য আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট, ধর্মীয় ঐক্য খানিকদূর অবধি কাজে লাগে, বেশীদূর নয়। যদি তাহা না হইত তবে লাহোর অধিবেশনের আটশ বছর পরে, পাকিস্তান-স্বপ্নের তথাকথিত ঐতিহাসিক জন্মতারিখের দুইদিন আগে পাক নেতাদের এই মেকি ‘ফেডারেল-ইজম’ এর স্তোকবাক্য শুনাইতে হইত না!

প্রকাশকাল: সোমবার ১০ চৈত্র ১৩৭৫ বঙ্গাব্দ (২৪ মার্চ ১৯৬৯): আনন্দবাজার পত্রিকা

সংগ্রহ: আশরাফুল ইসলাম, পরিকল্পনা সম্পাদক, বার্তা২৪.কম

ঋণস্বীকার: ন্যাশনাল লাইব্রেরি, কলকাতা।

;