খুলনা-সাতক্ষীরায় বেড়িবাঁধ ভাঙনে অর্ধশত গ্রাম প্লাবিত
খুলনা: খুলনা ও সাতক্ষীরা জেলায় নদী ভাঙনের কারণে একাধিক পোল্ডার দিয়ে নোনা পানি প্রবেশ করছে লোকালয়ে। এতে গত দুই দিনে নোনা পানিতে অর্ধশত গ্রামের মৎস্য ঘের ও ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। ধসে পড়ছে সহস্রাধিক কাঁচা-পাকা ঘর। গৃহহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ।
উপকূলীয় জেলা খুলনার কয়রা ও দাকোপ উপজেলা এবং সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার হাজরাখালী এলাকার নদী ভাঙন সংস্কারে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ (পাউবো)।
দাকোপ: ৩১নং পোল্ডারের কামিনী বাসিয়া পুলিশ ক্যাম্পের পশ্চিম পাশে ঢাকী নদীর ভয়াবহ ভাঙনের পর এবার ৩২নং পোল্ডারের নলিয়ান ফরেস্ট অফিসের দক্ষিণ পাশে ওয়াপদা বেড়িবাঁধের ৫০ গজ রাস্তা শিবসা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে। নদীর পানি লোকালয়ে প্রবেশ করায় নলিয়ান গ্রামের প্রায় ৪শ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে ৩১নং পোল্ডারে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দীর্ঘ কোনো পরিকল্পনা না থাকায় এবং দায়সারা ওয়াপদার বাঁধ নির্মাণ ও মেরামত করায় শত চেষ্টা করেও এ নদী ভাঙন রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে ভুক্তভোগী পরিবারগুলো অভিযোগ করেছে।
এদিকে কামিনী বাসিয়া নদী ভাঙনে সহায়-সম্বলহারা পরিবারগুলো ওয়াপদা বেড়িবাঁধের উপর মানবেতর জীবনযাপন করছে। ওয়াপদার বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় শত শত কৃষক তাদের আমন ধানের বীজতলা নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে।
সুতারখালী ইউপি চেয়ারম্যান মাসুম আলী ফকির জানান, সোমবার (১৩ আগস্ট) বিকেল সাড়ে ৩টায় শিবসা নদীর প্রবল জোয়ারের তোড়ে নলিয়ান ফরেস্ট অফিসের দক্ষিণ পাশে প্রায় ৫০ গজ ওয়াপদা বেড়িবাঁধ ভেঙে নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। এতে নলিয়ান গ্রামের বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানসহ প্রায় ৪শ পরিবার সম্পূর্ণভাবে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।
তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে বাঁধটি সংস্কারের জন্য বারবার চেষ্টা করা হলেও নদীর প্রবল জোয়ারের তোড়ে তা আবারো ভেঙে যাচ্ছে।
তিলডাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান রনজিত কুমার মণ্ডল জানান, পাউবো কর্তৃপক্ষ কামিনী বাসিয়া পুলিশ ক্যাম্পের পশ্চিম পাশের ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধটি সংস্কারে এগিয়ে না আসার কারণে আজ এ নদীতে ভয়াবহ ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। এ বাঁধটি সংস্কারের জন্য পাউবো কর্তৃপক্ষকে বারবার বলা হলেও তারা এখন পর্যন্ত সংস্কার বা বিকল্প বাঁধ নির্মাণে এগিয়ে আসেনি। ৩৪টি পরিবার তাদের বসতঘর বাড়ি হারিয়ে ওয়াপদা রাস্তার উপর খোলা আকাশের নিচে তাদের পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। শিবসা ও ঢাকী নদীর মোহনায় ভেঙে যাওয়া বাঁধটি দ্রুত সংস্কার বা বিকল্প বাঁধ নির্মাণ করা না হলে এ বাঁধের বাকি অংশ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে ৩১ পোল্ডারের চালনা পৌরসভাসহ তিলডাঙ্গা ও পানখালী ইউনিয়ন প্লাবিত হওয়ার সম্ভবনা রয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মারুফুল আলম বলেন, ‘সরেজমিনে কামিনি বাসিয়া নদী ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছি। নদী গর্ভে বিলীন হওয়া ৩৪টি পরিবারের আর্থিক সহায়তা ও পুনর্বাসনের জন্য সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। এ নদী ভাঙনের কারণে অনেক পরিবারের বসতঘর তলিয়ে যাওয়ায় তারা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছে। সকল ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতির পরিমাণ ও নামের তালিকা প্রস্তুত করার জন্য উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উপজেলার ৩২ ও ৩৩ নং পোল্ডারের বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে বিশ্বব্যাংক কাজ শুরু করেছে। তাই ওই পোল্ডার দুটির রক্ষণাবেক্ষণের দায় দায়িত্ব এখন তাদের। তাই এই মুহূর্তে ওই দুটি পোল্ডারের কাজ পাউবো করতে পারছে না। তবে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে চলমান বাঁধ নির্মাণ কাজের অংশ হিসেবে তারা নলিয়ান ফরেস্ট অফিসের পাশে ভেঙে যাওয়া বাঁধটি দ্রুত সংস্কার করবেন।
৩১নং পোল্ডারের উপ-সহকারী প্রকৌশলী হুমায়ুন কবির বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভাঙন এলাকায় কাজ চলছে। ৩১নং পোল্ডারে কোনো দায়সারা কাজ করা হয়নি। কোনো প্রকল্পের কাজ শেষ হলে কেন্দ্রীয় টিমের কর্মকর্তারা যাচাই-বাছাই করেই তবে বিল দেয়।
কয়রা: কয়রা উপজেলার উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের গাববুনিয়া এলাকার পাউরোর বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে। সেখানে ভয়াবহ ভাঙনের কারণে নদীর পার্শ্ববর্তী জনসাধারণ রয়েছে আতঙ্কে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃপক্ষ জরুরি ভিত্তিতে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় সেখানে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে এলাকাবাসী কাজ করছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো ব্যবস্থা না নেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এ জনপদের সাধারণ মানুষ।
জানা গেছে, পাউবোর ১৩/১৪-২ পোল্ডারের শাকবাড়িয়া নদীর গাব্বুনিয়া বেড়িবাঁধ ভয়াবহ ভাঙনের কবলে পড়েছে। স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে বেশ কয়েক দিন ভাঙন রোধে কাজ করলেও গতকাল সোমবার দুপুরে নদীতে জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়িবাঁধ ছাপিয়ে পানি লোকালয়ে প্রবেশ করে।
উত্তর বেদকাশি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার নুরুল ইসলাম বলেন, ‘গাব্বুনিয়া এলাকার বেড়িবাঁধে ভয়াবহ ভাঙন ধরেছে। বেশ কিছু দিন সেখানে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করে কোনো রকমে পানি আটকানো সম্ভব হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে এই ভাঙন কবলিত এলাকায় চলাচলের জন্য সকল প্রকার যানবাহন বন্ধ রাখা হয়েছে। কিন্তু গতকাল সোমবার দুপুরে স্থানটির প্রায় ৫০/৬০ হাত বেড়িবাঁধ এলাকা ছাপিয়ে জোয়ারের পানি লোকালয়ে প্রবেশ করেছে। তাৎক্ষণিক বস্তায় মাটি ভরাট করে পানি আটকানো হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ রক্ষা করা না হলে এই এলাকার ৪/৫টি গ্রাম যেকোনো মুহূর্তে প্লাবিত হবে। ফলে চলতি মৌসুমের আমন ধানের পাশাপাশি মৎস্য সম্পদের মারাত্মক ক্ষতি হবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের আমাদী সেকশন কর্মকর্তা সেলিম হোসেন জানান, ভাঙনের খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে প্রাথমিকভাবে এলাকাবাসীকে সঙ্গে নিয়ে ভাঙনরোধে কাজ শুরু করা হয়েছে।
কয়রা উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিমুল কুমার সাহা জানান, গাব্বুনিয়া বেড়িবাঁধের বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষসহ জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হয়েছে। জরুরি ভিত্তিতে ভাঙনরোধে কাজ করা হবে।
সাতক্ষীরা: জেলার আশাশুনির হাজরাখালীতে খোলপেটুয়া নদীর বেড়িবাঁধটি স্থানীয়দের প্রাণপণ চেষ্টায় স্বেচ্ছাশ্রমে সংস্কার করা হলেও সোমবার দুপুরে জোয়ারে তা আবারো ভেঙে গেছে। নতুন করে আরও ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে শত-শত বিঘা মৎস্য ঘের ও ফসলি জমি। ধসে পড়েছে সহস্রাধিক কাঁচা পাকা ঘর। গৃহহীন হয়ে পড়েছে হাজার হাজার মানুষ।
অন্যদিকে শ্রীউলা ইউনিয়নের থানাঘাটা বেড়িবাঁধটি নির্মাণে আট লাখ টাকা বরাদ্দ হওয়ার পরও সময় মতো কাজ না হওয়ায় বাঁধটির শেষ রক্ষা হল না।
জানা গেছে, সম্প্রতি একই স্থান হতে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেলে স্থানীয় চেয়ারম্যান আবুহেনা সাকিলের নেতৃত্বে স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করে প্রাথমিকভাবে বাঁধটি নির্মাণ করা হয়। এরপর টেকসই মজবুত বাঁধ নির্মাণে সরকার কর্তৃক ৮ লাখ টাকা টেন্ডারের মাধ্যমে ঠিকাদার নিয়োগ করা হয়। কিন্তু ঠিকাদার কাজ না করায় শ্রীউলা ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ আজ সহায় সম্বল হারিয়ে উপকূলীয় ওয়াপদা বেড়িবাঁধের উপর ও সাইক্লোন সেল্টারে আশ্রয় নিয়েছে।
বর্তমানে পানিবন্দী হাজার হাজার মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। রোববার খোলপাটুয়া নদীর জোয়ারের পানি বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে নড়বড়ে ৫০-৬০ হাত বেড়িবাঁধ ভেঙে ৪টি গ্রাম প্লাবিত হয়। ওই দিন বিকেলে ভাটার সময়ে স্থানীয় চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গ্রামবাসী স্বেচ্ছাশ্রমে বাঁধটির কাজ শুরু করে রাত ১২টার দিকে তা শেষ হয়। পুনরায় রাতে প্রচণ্ড জোয়ারের পানির চাপে আবারো তা ভেঙে যায়। এর ফলে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। খবর পেয়ে উপজেলা চেয়ারম্যান এবিএম মোস্তাকিম, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাফফারা তাসনীন, ইঞ্জিনিয়ার, পাউবোর কর্মকর্তা ও স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান আবুহেনা সাকিল ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
এ ব্যাপারে আশাশুনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাফফারা তাসনীন জানান, তিনি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ সংস্কারের জন্য ইতোমধ্যে কাজ চলছে।