তাঁতপল্লীর খট খট শব্দ এখন আর নেই
নড়াইল: তাঁতপল্লীর কলগুলোর খট খট শব্দ এখন আর নেই। কিন্তু এমন এক সময় ছিল যখন তাঁতপল্লীর কারিগররা সকাল-সন্ধ্যা কাজে ব্যস্ত থাকতো। দম ফেলবারও ফুসরত ছিল না তাদের। নতুন রঙ করা সুতা, তাঁতের একটানা খট খট আওয়াজ আর নতুন গামছা, লুঙ্গি ও শাড়ির গন্ধ পাওয়া যেত। কাপড়ের পাইকারি বাজারগুলো ছিল মুখরিত। এখন সবই স্মৃতি। এসব রেখে জীবন বাঁচানোর প্রয়োজনে অন্য পেশায় চলে গেছে তাঁতপল্লীর কারিগররা।
জানা গেছে, নড়াইলের আফরা, কলোড়া, আগদিয়া, মাইজপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিল প্রায় এক হাজার তাঁতি পরিবার। কর্মসংস্থান ছিল কমপক্ষে তিন হাজার নারী-পুরুষের। ১০-১৫ বছর আগেও এখানের তাঁতপল্লীগুলো জমজমাট ছিল। এখন তাঁতিরা দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, ভ্যান-রিকশাচালক, কৃষিকাজ অথবা অন্য কোনো পেশায় চলে গেছে। তাঁতের কাজে নারীদেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণ ছিল, তবে তারা এখন বেকার। তাঁতের ঘরটিতে এখন গরু-ছাগল থাকে অথবা অন্য কাজে ব্যবহার করা হয়।
সদর উপজেলার আফরা গ্রামের আতিক হোসেন বার্তা২৪.কমকে জানান, গত এক বছর আগে চালু থাকা সর্বশেষ তাঁতটিতে গামছা বুনছিলেন। হঠাৎ সেটি অচল হয়ে যায়। এরপর আর তা মেরামত করেননি। এরপর থেকে ওভাবেই পড়ে আছে তাঁতটি। এ ঘটনার মধ্য দিয়েই এ এলাকায় তাঁতের অধ্যায় শেষ হয়ে যায়।’
তিনি জানান, তাদের গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে এখনো অযত্ন আর অবহেলায় পড়ে আছে সুতা কাটার চরকা আর কাপড় বোনার নানা অনুষঙ্গ। অথচ এক সময় আফরা গ্রামে প্রায় একশ পরিবারে তিন শতাধিক তাঁত ছিল।
তিনি আরও জানান, সাত আট বছর আগেও এ গ্রামের আনিছুর, রহমাত, আসলামের মতো অনেকেই সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করতেন। নিজেই একেকটা ব্র্যান্ড হয়ে গিয়েছিলেন তারা। নিজেদের নামে গামছা, লুঙ্গি বাজারজাত করতেন। কিন্তু নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে একে একে সবকটি তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। পূর্ব পুরুষের পেশা ছেড়ে বিকল্প পেশা বেছে নিতে বাধ্য হয়েছে তারা।
উপজেলা দূর্গপুর গ্রামের লিটন বিশ্বাস জানান, তার বাবা-দাদা এ কাজ করেই সংসার চালাতেন। এখন আর কেউ এ কাজ করেন না। এ কাজ ছেড়ে বর্তমানে কেউ মাঠে, কেউবা ভ্যান চালিয়ে জীবনযাপন করেন।
মাইজপাড়ার সলেমান তালুকদার জানান, ৩৪ বছর তাঁতের কাজ করে সংসার চালিয়েছেন। তবে ১২ বছর আগে এ পেশা ছেড়ে দিয়েছেন। আগে এলাকার তৈরি জিনিসের কদর ছিল। এখন সবকিছু বাইরে থেকে আসছে। তাই বর্তমানে ব্যবসা করে জীবনযাপন করেন তিনি।
আকদিয়া গ্রামের আরেক তাঁতি পরিবারের সন্তান রজব আলী জানান, তার পরিবার কয়েক যুগ ধরে তাঁতের কাজ করেছে। বছর দশেক আগেই তারা কাপড় বোনা ছেড়ে দিয়েছেন।
তাঁতিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুতার দাম বৃদ্ধি, আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়া, সর্বোপরি যন্ত্রচালিত তাঁতযন্ত্রের কাছে হস্তচালিত তাঁত প্রতিযোগিতায় কুলিয়ে উঠতে না পেরে ধারাবাহিক লোকসান দিতে দিতে একসময় বন্ধ হয়ে গেছে।
শহরের রূপগঞ্জ বাজারের কাপড়ের ব্যবসায়ী অলোক সাহা জানান, আগে তারা স্থানীয়ভাবে তৈরি জিনিসই বিক্রি করতেন। এখন তো আর পাওয়া যায় না। তাই কুষ্টিয়া, পাবনা, ঢাকার বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য কিনে বিক্রি করেন।
নড়াইল বিসিকের উপ-পরিচালক এস.এম কামরুল হাসান বার্তা২৪.কমকে জানান, বিভিন্ন টেক্সটাইল, গার্মেন্ট কারখানা অনেক কম দামে গামছা, লুঙ্গি, শাড়ি বিক্রি করছে। ফলে স্থানীয় তাঁতিরা মার খেয়ে যাচ্ছেন। বৃহৎ শিল্পের মারপ্যাঁচে কুটির শিল্প গুটিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি উপকরণের দামও বেড়েছে। তবে বিসিক থেকে কারিগরদের তালিকা তৈরি করে তাদের অর্থনৈতিক সহায়তা, প্রশিক্ষণ প্রদান ও বাজার সৃষ্টির পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।