নদী দখলের বিরুদ্ধে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল চায় নদী কমিশন
আইনি দুর্বলতার কারণে নদী দখলদারদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। তাই বিদ্যমান আইন সংশোধনের প্রস্তাব করবে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। প্রস্তাবিত আইনে নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য করে শাস্তির প্রস্তাব থাকবে। স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করার প্রস্তাবও রাখা হবে। সম্প্রতি উচ্চ আদালতের একটি রায়ে বলা হয়েছে নদীর অভিভাবক হচ্ছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে নদ-নদীগুলো রক্ষায় নেওয়া নদী রক্ষা কমিশনের পরিকল্পনাগুলো তুলে ধরেছেন কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মজিবুর রহমান হাওলাদার। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট শাহজাহান মোল্লা।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: দেশের নদীগুলো রক্ষায় আপনাদের কী ভূমিকা রয়েছে?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: দেখুন নদী রক্ষায় ২০১৩ সালে করা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইনের ১২, ১৩ ধারায় আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যের কথা বলে দিয়েছে। আইনে নদী দূষণ রোধ, নদী উদ্ধার, পানি, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ করার কথা বলা আছে। সেই সঙ্গে নদী রক্ষায় জনসচেতনতা বৃদ্ধির কথাও বলা হয়েছে। আমরা এরইমধ্যে জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে সভা সেমিনার করেছি। আমাদের ৬৪টি জেলায় নদী রক্ষা কমিটি আছে। এমনকি উপজেলা পর্যায়েও কমিটি আছে। ওই কমিটিতে পরিবেশবিদ, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা রয়েছেন। তাদের সুপারিশগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থা কাজ করছে।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: দেশের নদীগুলো রক্ষায় আপনাদের পরিকল্পনাগুলো কী কী?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: আপনি জানেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশের নদীগুলো রক্ষার জন্য ডেল্টা প্লান করেছেন। সেই ডেল্টা প্লান বা ব-দ্বীপ পরিকল্পনায় প্রধানমন্ত্রী স্বাক্ষর করেছেন। আমরা জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনসহ অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ শুরু করেছি।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: ঢাকার চর্তুদিকের নদীসহ সারা দেশের নদী রক্ষায় কী কী কাজ শুরু করেছেন?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: আমাদের ডেল্টা প্লানে আবার স্বল্প মেয়াদী, মধ্য মেয়াদী, দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা আছে। আমরা স্বল্প মেয়াদী পরিকল্পনার অংশ হিসেবে প্রথম এক বছর সারা দেশের নদীর দখল উচ্ছেদ করব। যা এরইমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। এরইমধ্যে কয়েক শ’ একর নদীর জায়গা দখলমুক্ত করা হয়েছে। প্রয়োজনে আমরা নদীর পাড়ে হাঁটার পথ করে দেব, সবুজ বেষ্টনি করে দেব। সবচেয়ে বড় কাজ হবে শক্ত সীমানা পিলার করা যেন চিহ্নিত হয় এটা নদীর জায়গা।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: নদী দূষণ রোধে আপনাদের পরিকল্পনা কী?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: নদী দূষণ দুই ধরনের। একটা আছে তরল বর্জ্যের মাধ্যমে দূষণ। আরেকটা ক্লিনিক্যাল বর্জ্য বা গৃহস্থালীর বর্জ্য। বিশেষ করে শহর বা আরবান এলাকায় নদী দুষণের মাত্রা অনেক বেশি। তবে ঢাকার আশপাশে যেমন, গাজীপুর, মুন্সিগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ, মানিকগঞ্জ এসব এলাকার নদীতেও ব্যাপক দূষণ হয়েছে। আমাদের শিল্পকারখানাগুলোর ২৪ ঘণ্টা ইটিপি চালু করার কথা আছে। কিন্তু দেখা যায় তারা সব সময় ইটিপি চালু রাখেন না। তাই আমরা বলেছি, পরিবেশ অধিদফতর ও অন্যান্য বিভাগ কাজ শুরু করেছে। পরিবেশ অধিদফতর অন লাইন মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করবে। অন্যদিকে ক্লিনিক্যাল বর্জ্য বা গৃহস্থালীর বর্জ্য উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে রিসাইকেলের মাধ্যমে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় সরকারের বিভাগ যেমন সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, জেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদকে বলা হয়েছে। শুধু বলার জন্য না তারা যেন প্রয়োজনীয় আধুনিক যন্ত্র পায় সেই ব্যবস্থা করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ প্রদান করা হয়েছে।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: নদী দখলমুক্ত করতে আপনারা কোনো বাধার সম্মুখীন হচ্ছেন কি না? বিদ্যমান আইন দখলদারদের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিতে পারছেন?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: আসলে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০১৩ অনুযায়ী আমরা তেমন কোনো শস্তি দিতে পারছি না। তারপরও সিআরপিসিতে এনে শাস্তি দিচ্ছি। এজন্য সংসদের স্থায়ী কমিটি, উচ্চ আদালত ও মন্ত্রণালয় আইন সংশোধনের কথা বলেছেন। আমরা আইনে পেনাল কোডের বিষয়টা সংযুক্ত করতে চাই। নদী দখলকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে দখলদারদের শাস্তি নিশ্চিত করতে চাই। প্রয়োজনে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা সেভাবেই আইনের সংশোধন আনার চেষ্টা করছি।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: বছরের পর বছর নদীগুলো দখলদারদারে কবলে পড়ে মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। সেই নদীগুলো রক্ষার করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন কী?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: নদীর প্রকৃত গতিপথ চিহ্নিত করতে বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানকে (স্পারসো) দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। তারা হাইড্রো মফলোজিক্যাল স্ট্যাডি করবে। এতে ১০০ বছর আগে নদী কোথায় ছিল, কোথায় কতটুক জায়গা দখল হয়েছে। এসব বিষয় বেরিয়ে আসবে। বৈজ্ঞানিকভাবে নদীর সীমানা চিহ্নিত হলে পরে উচ্ছেদকাজ সহজ হয়ে যাবে। সেই ম্যাপিং হওয়ার পর সেটা আর্কাইভেও রাখা হবে।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: নদী রক্ষায় ঢাকার বাইরে থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: একটা বিষয় পরিবর্তন আসছে। এখন যেখানেই যাচ্ছি সবাই নদী রক্ষার জন্য এগিয়ে আসছে। কেউ নদীর জায়গা দখল করলে দেখিয়ে দিচ্ছে। এরইমধ্যে ৫২টি জেলার জেলা প্রশাসক আমাদের জানিয়েছে তাদের কর্ম এলাকায় কতটুক নদী দখল হয়েছে, কে দখল করেছে সব বিস্তারিত চলে এসেছে। এগুলো আমরা অনলাইনে দেব।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: নদীগুলো হারিয়ে যাওয়ায় বন্যায় কোনো প্রভাব পড়ছে কী?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: দেখুন প্রকৃতিগত ভাবেই আমরা ভাটির দেশ। উজান থেকে বর্ষার সময় পানি আসবেই। কিন্তু সেই পানি ধারণ করার ক্ষমতা আমাদের থাকতে হবে। সেজন্য প্রয়োজন ড্রেজিং করা। তবে সেই ড্রেজিং সঠিকভাবে হচ্ছে কি না সেগুলো মনিটর করা হবে। ড্রেজিং করে নদীর পাড়ে মাটি রেখে দিলে আবার ভরাট হয়ে যাবে এই পদ্ধতিতে আর ড্রেজিং করা যাবে না। এখন সঠিক জায়গায় মাটি নিয়ে যেতে হবে। বন্যা থেকে বাঁচতে আমাদের নদী রক্ষা করতে হবে। নদী সংরক্ষণ করতে হবে। নদী পাড়ের প্লাবন ভূমি সংরক্ষণ করতে হবে। এজন্য নদী পাড়ে হাইড্রোলজিক্যাল বাউন্ডারি দিতে হবে। সিএস ম্যাপ অনুযায়ী নদীর সীমানা নির্ধারণ করতে হবে।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: নদী রক্ষায় আপনাদের গৃহিত পদক্ষেপগুলো দ্রুত দৃশ্যমান হবে কী না?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: মাস্টার প্লানে চার ধরণের প্রোগ্রাম নেওয়া আছে। এক বছর মেয়াদি ক্র্যাশ প্রোগ্রাম, এই প্রোগ্রামে এনফোর্সমেন্ট শুরু হয়েছে। এটা ঠিক করার পর দুই বছর দুই বছর ভাগ করে আগামী ৫ বছরের মধ্যে অনেক ভাল কিছু দেখতে পাবেন। সেখানে নদীর পাড়ে বনায়ন, হাটারপথসহ নানাকিছু দৃশ্যমান হবে। তবে এই নদী দখল তো একদিনে হয়নি, একদিনে সমাধানও হবে না। আস্তে আস্তে সমাধানের দিকেই যেতে হবে।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: নদী যেভাবে বিলিন হচ্ছে তাতে দেশের জন্য কি ধরণের হুমকি হতে পারে?
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: নদী হচ্ছে মানুষের হৃদপিন্ডের মতো। প্রধানমন্ত্রী সেভাবেই নির্দেশনা দিয়েছেন। আমাদের মানুষের শরীরের ধমনীতে যেমন কোথাও ব্লক হলে মানুষের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে যায়, তেমনি নদী যদি কোথাও গতিপথ বন্ধ করা হয়, ব্লক করা হয় তাহলে কিন্তু আমাদের নদী বাঁচবে না। নদী ব্যবস্থাপনায় যদি বাধার সন্মুখীন হয়, দখলের সন্মুখীন হয় তাহলে দেশের অর্থনীতি, দেশের নদী ব্যবস্থাপনা, পানি সম্পদ বিপর্যয়ের সন্মুখীন হবে। নদী দলমত জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সবার। নদী বাঁচানোর দায়িত্বও সবার। সকলে মিলে যেভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল সেভাবেই সন্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। তবেই নদী বাঁচবে, দেশ বাঁচবে। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা যুদ্ধে ডাক দিয়েছিলেন তখন একটা স্লোগান ছিল তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। এখন সেই পদ্মা মেঘনা যমুনা যদি না থাকে আমাদের স্বাধীনতার স্লোগান ম্লান হয়ে যাবে। তাই সম্মিলিতভাবে নদী রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। এটা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব না।
বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান: আপনাকেও ধন্যবাদ। বার্তাটোয়েন্টিফোর.কম এর মাধ্যমে সাবাই জানুক, সবাই ঐক্যবদ্ধ হই নদী রক্ষায়।