শিকলবন্দী হাশেমকে কী কেউ সাহায্য করবেন?
দিন-রাত ২৪ ঘণ্টাই শিকলবন্দী থাকতে হয় তাকে। অথচ এক সময় ছিলেন গার্মেন্টসকর্মী। সুখেই চলছিল জীবন সংসার। হঠাৎ হারিয়ে ফেলেন মানসিক ভারসাম্য। সঙ্গে হারিয়ে ফেলেন জীবনসঙ্গী শরীফা খাতুনকেও। সেই থেকেই যেন তার জীবনে নেমে এলো ঘোর দুর্দিন। স্মৃতিশক্তি হারিয়ে উন্মাদের মতো বনে গিয়ে মানুষকে ধরে মারপিট করতেন।
অত্যাচারে অতিষ্ঠ বাবা এক সময় তাকে বেঁধে রাখেন গাছের সঙ্গে। এরপর মাটির একটি ছোট্ট খুপরিতেই বছরখানেক যাবৎ শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে তাকে।
বন্দী জীবনে বাস করা অসহায় এই মানুষটির নাম আবুল হাশেম। ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া উপজেলার বিদ্যানন্দ গ্রামে তার বাড়ি।
ভিক্ষুক বাবা বৃদ্ধ আখতার আলীর সাধ্য নেই হাশেমের চিকিৎসা করানোর। উল্টো হাশেমের কাছে থাকা এক সন্তান হান্নান এবং পরিবারের অন্য সদস্যের আহারের ব্যবস্থাও তাকে করতে হয় ভিক্ষা করেই। শরীর না কুলিয়ে উঠলে উপোস থাকতে হয় তাদের। শেষ জীবনে নিজের সন্তানের এমন ভাগ্যের ফেরে শুধু ডুকরে কাঁদেন আক্তার আলী। আর ভাবেন, এমন কী কেউ নেই যে তার শিকলবন্দী সন্তানকে স্বাভাবিক জীবন নিশ্চিতে এগিয়ে আসবেন?
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছোট্ট একটি খুপরি ঘরে ঠাঁই হয়েছে হাশেমের। বছরখানেক ধরে এ ঘরটিতেই থাকছেন তিনি। অস্বাভাবিক হয়েছে তার চুল, দাড়ি, গোঁফ। হাতের নখগুলোও বেশ বড় বড়। বদ্ধ এ মাটির ঘরটিতেই জরুরি কাজসহ সবই করতে হয়। এমন কঠিন বাস্তবতায় দূরের মানুষ দেখলেই ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন হাশেম। ক্ষণে ক্ষণে আবার উত্তেজিতও হয়ে ওঠেন তিনি। হয়তো জীবনের সুখের পায়রাগুলো হারিয়ে যাওয়ায় চরম অসুখী থেকেই এমন ক্ষুব্ধ চেহারায় অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন তিনি।
জানা গেছে, তিন সন্তানের জনক আবুল হাশেম। ভিক্ষাবৃত্তি আর এলাকাবাসীর সহায়তায় তার বড় মেয়ে সুমি আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন দাদা আখতার আলী। মেজ ছেলে আব্দুল হান্নান স্থানীয় বিদ্যানন্দ উত্তর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। আর ছোট ছেলে শরীফ হোসেন থাকে মায়ের সঙ্গে।
সংসারে অভাব-অনটন থাকায় গাজীপুরের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতেন হাশেম দম্পতি। কয়েক বছর চাকরি করার পর ২০১৫ সালে হঠাৎ মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন হাশেম। পরের বছর তাকে ফেলে চলে যান স্ত্রীও। এরপরই অদ্ভুত আচরণ বাড়তে থাকে হাশেমের।
এক বুক হতাশা আর আক্ষেপ নিয়ে হাশেমের ছেলে হান্নান বলে, ‘আব্বা আমারে চিনে না। কবেত্তে (কবে থেকে) আব্বার আদর পাই না, আর আম্মা তো থাইক্কাও (থেকেও) নাই।’
হাশেমের বৃদ্ধ বাবা আখতার আলী বলেন, ‘কত আশা আছিলো পুলাডা কামাই কইরা আমগরে খাওয়াব। অহন শেষ বয়সে ভিক্ষা কইরা পুলা-নাতিগরে খাওয়াইতে অইতাছে। ভালা পুলাডা আমার পাগলা অইয়া গেছে। শিকল দিয়া বাইন্দা থুইছি। কী করমু, টেহার লেইগা ডাক্তরের বুগল (কাছে) নিবার পারি না। ডাক্তর দেহাবার পাইলে ভালা অইত মনে অয়, আপনেরা ইট্টু হেই ব্যবস্থা কইরা দেইন।’
স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক ও হাশেমের চাচা নিজাম উদ্দিন বলেন, ‘হাশেম এক সময় ভালো ছিল। হঠাৎ সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। গ্রামের মানুষের কাছ থেকে টাকা উঠিয়ে একবার চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু পর্যাপ্ত টাকার অভাবে আর চিকিৎসা করা সম্ভব হয়নি।’
ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) লীরা তরফদার বলেন, ‘আমরা এ বিষয়ে পাবনা মানসিক হাসপাতালে যোগাযোগ করে সেখানে তাকে চিকিৎসার ব্যবস্থা করব।’