কলকাতার প্রথম মুসলিম মেয়র ববি'র মায়ের বাড়ি ফরিদপুর
ক্রমবর্ধমান সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে রুখে দিতে কলকাতায় ঐক্যের মাটি আরেকটু শক্ত করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধায়। মুসলমান নেতৃত্বের স্মৃতি বিজড়িত কলকাতা সিটি কর্পোরেশনে ভারত স্বাধীনের ৭১ বছর পর আবার মুসলমান মেয়র উপহার দিলেন তিনি। উন্নয়নের গতিকেও অব্যাহত রাখার সঙ্কল্প জানালেন।
পারিবারিক সঙ্কট ও বিপর্যয়ে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় পদত্যাগ করলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পুর ও নগর উন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমকে মেয়র পদে বেছে নেন। সাধারণের মাঝে ববি হাকিম নামে পরিচিত ফিরহাদ হাকিম মন্ত্রী হিসাবে কলকাতা নগর ও কর্পোরেশনের দেখভাল করতেন। এবার তিনি মন্ত্রী ও মেয়রের পদ দুটি একাই সামলাবেন।
তৃণমূলের শক্তিশালী স্তম্ভ ববি মধ্য ও দক্ষিণ কলকাতার রাজনৈতিক মাঠের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। ব্যক্তিগতভাবে অসাম্প্রদায়িক ইমেজের এই নেতা কলকাতার চেতলা, বালিগঞ্জ, কসবা, তিলজলা, পিকনিক গার্ডেন, হাজরা এলাকা থেকে একাধিক বার নির্বাচিত হয়েছেন। বিধায়ক থেকে হয়েছেন মন্ত্রী। এবার হলেন মেয়র। মহানগরের হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতর জন্য কাজ করেছেন তিনি তার পুরো রাজনৈতিক জীবন জুড়েই।
এক সাক্ষাৎকারে ফিরহাদ হাকিম বলেছিলেন, তার দাদা বিহারের গয়া জেলা থেকে কলকাতায় এসে ব্যবসা শুরু করেন। বাবা ছিলেন কলকাতা পোর্ট ট্রাস্টের আইন আধিকারিক। আর মা ছিলেন কলকাতার একটি স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষিকা।
ফিরহাদ হাকিমের মায়ের আদি বাড়ি ছিল বর্তমান বাংলাদেশের ফরিদপুরে। তার মা হিন্দু মুখার্জী পরিবারের সন্তান ছিলেন বলে জানিয়েছেন হাকিমের এক বাল্য বন্ধু ঋষিকেশ মুখার্জি। তিনি বলেন, "ববি ধর্মে মুসলমান ঠিকই, নিয়মিত নামাজও পড়েন, গত বছর হজ করে এসেছেন, কিন্তু ওর মধ্যে হিন্দু-মুসলিম প্রসঙ্গটা একেবারেই নেই। ওর মা ছিলেন পূর্ব বঙ্গীয় হিন্দু পরিবারের মানুষ, বোনের বিয়ে দিয়েছে হিন্দু পরিবারে।"
১৯২৪ সালে কলকাতা পুরসভার প্রথম মেয়র হয়েছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস৷ পরবর্তীকালে এই মেয়রের চেয়ারের বসেছেন অবিভক্ত বঙ্গীয় রাজনীতির বহু ডাকসাইটে নেতা। কলকাতা পুরসভার প্রথম মুসলমান মেয়র হন শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, তিনি হয়েছিলেন ১৯৩৫ সালে৷ তাছাডা় এ কে এম জাকারিয়া, আবদুর রহমান সিদ্দিকি,সাঈদ মহম্মদ উসমান প্রমুখ মুসলিম সম্প্রদায় থেকে মেয়র হয়েছিলেন৷ তবে স্বাধীনতার পরে ববি হাকিমই হতে চলেছেন বৃহত্তর মুসলিম সম্প্রদায় থেকে কলকাতার প্রথম মেয়র৷
বর্তমান আইন অনুযায়ী কাউন্সিলর না হলে মেয়র হওয়া যায় না৷ এমন পরিস্থিতিতে ববিকে মেয়র করতে এই সংক্রান্ত সংশোধনী বিল পেশ করা হবে আইন সংশোধনের জন্য৷ মেয়র পদে বসার ৬ মাসের মধ্যে কাউন্সিলর হিসেবে নির্বাচিত হতে হবে তাকে।
১৯২৩ সালে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলা সরকারের স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর তিনি আইন মোতাবেক কলকাতা কর্পোরেশনের গণতন্ত্রীকরণ করেন। সংস্থার দায়িত্ব বৃদ্ধি পায় ও সরকারের এর উপর হস্তক্ষেপের অধিকার খর্ব করা হয়। মানিকতলা, কাশীপুর, চিৎপুর ও গার্ডেনরিচ এবং নতুন বন্দর অঞ্চলের বিরাট অংশ তখন কলকাতা কর্পোরেশনের এক্তিয়ারভুক্ত হয়। পরে অবশ্য এই কলকাতা পুরসভার সীমানা বেড়েছে৷
ডিসেম্বের প্রথম সপ্তাহে ববি মেয়র পদে শপথ নেবেন। মমতা ডেপুটি মেয়র পদে অতীন ঘোষ ও পুরসভার চেয়ারপার্সন পদে মালা রায়কে স্বপদে বহাল রেখেছেন। বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রুখে দিয়ে মমতার এই টিম মহানগর কলকাতায় তৃণমূলের রাজনৈতিক শক্তি ধরে রাখতে কতটুকু কার্যকর হয়, তাই এখন দেখার বিষয়।
তবে আসন্ন নির্বাচনকে মাথায় রেখে মমতার সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। রাজ্য রাজনীতিতে থাবা বসাতে মমতার প্রতিপক্ষ বিভিন্ন উগ্র সাম্প্রদায়িক কৌশল অবলম্বন করায় মমতা এমন পদক্ষেপ নিয়েছেন বলেই অনেকের ধারণা। নগরের উন্নয়ন ধারা ও রাজনৈতিক কৌশলের দিক থেকে মমতার সিদ্ধান্ত প্রশংসনীয় হয়েছে। ববির নিয়োগকে দেখা হচ্ছে কলকাতায় মমতার 'উন্নয়ন ও সম্প্রীতি কার্ড' হিসাবে।