বিআরটিসি টার্মিনালে প্রতারণা, কলকাতার নামে যাত্রী নামায় বেনাপোলে
দু’মাস আগে মামুনুর রহমান (ছদ্মনাম) নামের একজন যাত্রী ঢাকা থেকে কলকাতা যাওয়ার জন্য কমলাপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে টিকিট কাটেন। কাউন্টার কর্মকর্তাদের কথা অনুযায়ী তাকে কলকাতায় নামানোর কথা থাকলেও নামানো হয় বেনাপোলে। পরে অনেক ঝক্কিঝামেলার মধ্য দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে আবার গাড়িতে উঠে তাকে গন্তব্যে পৌঁছাতে হয়। ফলে তিনি এক প্রকার প্রতারণার শিকার হন। দেশে ফিরে এ নিয়ে থানায় অভিযোগও করেন তিনি। কিন্তু কোনো সুরাহা মেলেনি।
ওই অভিযোগের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, রাজধানীর বিভিন্ন বাস কাউন্টারে যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করে ঢাকা-কলকাতা রুটের নামে যাত্রী টানছে ১৩-১৪টি পরিবহন কোম্পানি। অধিকাংশ যাত্রী প্রথমবার গিয়ে দ্বিতীয়বার এসব পরিবহনে আর যেতে চান না।
জানা গেছে, রাজধানীর কমলাপুরে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের (বিআরটিসি) আন্তর্জাতিক টার্মিনালে এমন একটি বাস কোম্পানি কাউন্টার খুলে যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। এতে সরকার নির্ধারিত পরিবহন কোম্পানিকে ঢাকা-কলকাতা রুটে যাত্রী সংকটে পড়তে হচ্ছে।
বিআরটিসি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার সঙ্গে কলকাতা-আগরতলা যুক্ত হয়ে ৫টি আন্তর্জাতিক বাস রুট আছে। এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে দরপত্র প্রক্রিয়া শেষে `শ্যামলী এন আর ট্রাভেলস’ কোম্পানিকে ঢাকা-কলকাতাসহ ৪টি রুটের বাস পরিচালনার অনুমতি দেয় বিআরটিসি। কোম্পানিটির কাউন্টার কমলাপুরে বিআরটিসি ডিপো সংলগ্ন। বিআরটিসির আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ও কাউন্টার হিসেবে এখান থেকেই বাস ছাড়ে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিআরটিসি’র আন্তর্জাতিক টার্মিনাল ও কাউন্টারের ঠিক সমানের অংশে ঢাকা-কলকাতা রুটের নামে টিকিট বিক্রি করছে ‘শ্যামলী এসপি পরিবহন’। কিন্তু ওই রুটে বাস পরিচালনার অনুমোদন নেই কোম্পানিটির। দু’বছর আগে কাউন্টারটি ঢাকা-বরিশাল রুটের টিকিট বিক্রির জন্য বরাদ্দ নিয়েছিল তারা।
যাত্রী সেজে ওই কাউন্টারে গিয়ে দু’জনকে পাওয়া যায়। ঢাকা-কলকাতার টিকিট কিনতে এসেছি বলে জানালে তারা টিকিট কাটা শুরু করেন। এ সময় বিআরটিসি’র সরাসরি কলকাতা রুটের বাস কাউন্টার কোথায়- জানতে চাইলে তারা জানেন না বলে জানিয়ে দেন। অথচ ভবনের ভেতরেই আন্তর্জাতিক রুটের কাউন্টার রয়েছে।
অভিযোগ আছে, যাত্রীদের বিআরটিসি’র কাউন্টার না দেখিয়ে শ্যামলী এসপি পরিবহন সার্ভিসের টিকিট কাটতে বাধ্য করা হয়। কলকাতার বাস বলে যাত্রীদের গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বেনাপোল নামিয়ে দেয়। সেখান থেকে সীমান্ত পার হয়ে ভারত অংশে গিয়ে অন্য বাস ধরতে হয় যাত্রীদের। ফলে নানা ঝাক্কি ঝামেলার পর তাদের গন্তেব্যে পৌঁছাতে হয়।
কলকাতায় যেতে এমনই প্রতারণার শিকার হন জেবিন আহমেদ। দু’মাস আগে রাজারবাগ থানায় অভিযোগ করলেও কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। পরে বাধ্য হয়ে তিনি ভোক্তা অধিকার আইনে অভিযোগ করেন।
এ বিষয়ে বিআরটিসি’তে অভিযোগ করেছে শ্যামলী এন আর ট্রাভেলস কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এখনও এ প্রতারণার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তবে বিআরটিসি’র চেয়ারম্যান ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া জানান, দুই দেশের মধ্যে অবৈধ কাটা সার্ভিস বন্ধে ইতোমধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।
কিন্তু বিআরটিসি’র নিজস্ব ভবনে কেন এ ধরণের অবৈধ কাটা সার্ভিসের টিকিট কাউন্টার খোলার অনুমতি দেওয়া হলো- এমন প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেননি তিনি।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের বিআরটিসি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব এহসান-ই-এলাহী জানান, বিআরটিসি টার্মিনালে কলকাতার রুটের নামে এরকম কাউন্টারের বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তবে অভিযোগ লিখিত পেলে তারা বিষয়টি খতিয়ে দেখবেন।
এদিকে শ্যামলী এন আর ট্রাভেলস’র মালিক রমেন্দ্রনাথ ঘোষ গত মে মাসে বিআরটিসি মতিঝিল বাস ডিপো ম্যানেজার বরাবর এ বিষয়ে একটি লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা-কলকাতা রুটে বাস সার্ভিস চালুর পর প্রথম ৪ মাসে সরকারকে তারা প্রায় ৮০ লাখ টাকা রাজস্ব দিয়েছে। কিন্তু আগে যারা (শ্যামলি এসপি) ঢাকা-কলকাতাসহ আন্তর্জাতিক রুটে বাস অপারেট করতেন তারা বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্র করছেন। ফলে সুষ্ঠুভাবে বাস পরিচালনা করতে বাঁধার মুখে পড়তে হচ্ছে। শ্যামলী এন আর ট্রাভেলস একমাত্র সরকার অনুমোদিত অপারেটর হলেও কয়েকটি কোম্পানি সরাসরি কলকাতায় নেওয়ার নামে যাত্রীদের সঙ্গে প্রতারণা করছে। ফলে যাত্রী হারাচ্ছে বিআরটিসি-শ্যামলী বাস। আর সরকার হারাচ্ছে রাজস্ব।