চেনা অচেনা কলকাতা
শ্যামবাজারের পাঁচ মাথার মোড়ে দাঁড়িয়ে অশ্বারোহী নেতাজির মূর্তিটি আমি বার বার দেখি। বাসে, গাড়িতে যা দেখা যায় না, তা দেখতে হয় পায়েদলে। পদাতিক হয়েই কোনও শহরকে একনিষ্ঠতায় দেখা শ্রেয়।
কিছুক্ষণ আগে বিটি রোডের (ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোড) উপরে মূল কলকাতার আরও উত্তরের বেলঘড়িয়া থেকে হেঁটে কাছাকাছি পয়েন্ট কামারহাটি পৌরসভা ভবনের সামনের রবি ঠাকুরের মূর্তিটি এক পলক দেখে বাসে চড়েছি। শহরের আরেক প্রান্তমুখী বাস থেকে নেমে শ্যামবাজারের মোড়ে নেতাজি মূর্তিতে আকৃষ্ট হয়ে ভাবছি কলকাতার রূপান্তর নিয়ে।
মধ্যযুগের শেষ বেলায় ইংরেজ কোম্পানির হাতে তৈরি শহরটি কয়েক শ বছরে সমাজ-রাজনীতি-ধর্ম-সংস্কৃতির নানা অদল-বদলের পথে যেন হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়েছে। চেনা আর অচেনা অবয়বে মনে হলো বার বার দোলা দিচ্ছে উপমহাদেশের প্রাচীনতম শহর কলকাতা।
জনবহুল-চলবহুল মোড়ের ভয়াবহ ভিড় ঠেলে সন্তর্পনে ট্রাম রাস্তা এড়িয়ে পায়ে পায়ে সামনে এগুতে থাকি। গন্তব্য কলকাতার হৃৎপিণ্ডের দিকে। খানিক চলার পর মোহনবাগান ক্লাবের পাশের ফুটপাতে টগবগে গরম তেলে ভাজা নানা খাদ্যের লোভ সামাল দিতে পারিনা। 'আপনার না ফ্যাটি লিভার!' সহযাত্রী-ভ্রমণ সঙ্গী আঁতকে ওঠেন। আমি মুখে কুলুপ এঁটে চুপ থাকি। একমনে খাওয়া শেষ করার পর কথার বদলে সৌজন্যের এক ফালি হাসি উপহার দিই বন্ধুকে, যার অর্থ হলো, 'আপনার সুপরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। তবে সব সময় সব পরামর্শ গ্রহণ করা যায় না!'
সমঝদার বন্ধুও কথা না বাড়িয়ে মুচকি হাসিতে আমাকে সঙ্গ দিয়ে কলকাতার ঐতিহাসিক পথে পা বাড়ান। চারপাশে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের রোশনাই আর স্টার থিয়েটারের নবরূপের আড়ালে তখন ধীর লয়ে খেলা করছে হারিয়ে যাওয়া ঔপনিবেশিক আমলের কিছু অন্ধকার। আমিও ধীরে ধীরে হাতিবাগান, হেঁদুয়া পেরিয়ে পুরনো কলকাতার এক ভাঙাচোরা বাড়ির বহুম্তর অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থমকে গেলাম।
আচমকা মনে হলো, এ কোন জগতে এসে পৌঁছেছি? ফ্রানৎস কাফকা বা স্যামুয়েল বেকেট-এর নির্মিত জগতের সঙ্গে ঘুণ ধরা পুরনো কলকাতার এতো মিল যে মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। অথচ এঁরা কেউই কলকাতায় আসেন নি। কিন্তু এঁরা না এলেও কয়েক বার এসেছেন এঁদের সমকক্ষ বলে বিবেচিত আরেক জন। তিনি সাংঘাতিক স্বীকারোক্তির জন্য সমকালীন পৃথিবীতে বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব। নাম গুন্টার গ্রাস। নোবেল বিজয়ী জার্মান সাহিত্যিক।
গ্রাসের দেখা কলকাতা লুই মাল কিংবা দমিনিক লাপিয়েরের মতো নয়। ‘হিরোশিমা সানামুর’-এর রচয়িতা এবং কোনো দিন কলকাতায় না-আসা ফরাসি ঔপন্যাসিক মার্গারেট দ্যুরাসের ‘ইন্ডিয়া সং’-এ কলকাতা যেমন হয়েছে এক চূড়ান্ত-অবর্ণনীয় যন্ত্রণার বিমূর্ত প্রতীক, গুন্টার গ্রাসের দেখা কলকাতা ঠিক তেমন না হলেও কাছাকাছি। বরং গ্রাসের কাছে কলকাতা হলো শুধুই এক ‘জঞ্জালের চাঙারি’। গ্রাসের লেখনি ও অভিজ্ঞতার সততা, সম্মান ও বিশ্বাস্যতা নিয়ে কারো মনে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন নেই। সবাই তাই তিলোত্তমা চেহারার আড়ালে লুকিয়ে থাকা কলকাতার অন্ধকার তাকিয়ে তাকিয়ে খোঁজে । যেমনটি আমি উত্তর কলকাতার একটি প্রাচীন বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেয়েছিলাম। প্রতিটি ম্যাগাসিটি আর কসমোপলিটনেরই এমন দ্বান্দ্বিক চেহারা থাকে। একদিকে আলোর প্রপাত তো অন্যদিকে অন্ধকারের কুণ্ডলী। কলকাতাও নগরায়নের এই নিয়তির বাইরে থাকতে পারেনি।
গ্রাসের কলকাতা দর্শন ও ভাবনার স্থানাঙ্ক একটি নয়, একাধিক। এটি কলকাতা-ক্ষুব্ধ পশ্চিমী ভ্রামণিকের মর্মান্তিক বিবরণ। এবং এটি ভিনদেশী এক শিল্পীর দেখা মৃত্যুময়তা। যে শিল্পী মৃত্যুময়তার সামনে দাঁড়িয়ে এক প্রাক্তন-আক্রান্ত হিসাবে মানব-অস্তিত্বের চিরকালীন প্রশ্ন নিয়ে উদ্বেলিত। যে শিল্পী তাঁর স্বদেশীয় জার্মান ভাষায় একজন Hofnarr বা বিদূষক, যিনি অরুচিকর বাস্তব থেকে সত্য নিষ্কাষণ করাকেই নিজের পবিত্র কর্তব্য-কর্ম মনে করেন।
আমি মোটেও তা নই। আমি স্মৃতিভারাক্রান্ত পর্যটক। যে স্মৃতি ব্যক্তিগতভাবে আমার নয় অথচ আমাকেই বহন করতে হচ্ছে সামাজিক-ভৌগোলিক পরিবর্তনের রাজনৈতিক অতীত, ঐতিহ্য ও পরম্পরায়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে বয়ে চলেছে তেমনই ভারী ও বেদনাদীর্ণ স্মৃতির সঞ্চালন। ব্যক্তি থেকে পরিবার ও গোষ্ঠী ছাড়িয়ে তা প্রবহমান প্রজন্ম-প্রজন্মান্তরে।
পথ চলতে চলতে ভাবছি কলকাতার নানা বিশেষণ নিয়ে। ‘সংস্কৃতির শহর’, ‘সিটি অব জয়’ এবং আরও কত কি নামে ডাকা হয় কলকাতাকে! হাল আমলে বেশ ভারিক্কি একটা শিরোনাম দিয়েছেন লেখক সুধীর চৌধুরী: ‘আজব’! যদিও শহর কলকাতার নানা বিশেষ শোনা যায়। তার মধ্যে ‘আজব’ শব্দটা আজকাল বেশ চলছে এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম এই শহরটির ক্ষেত্রে। কারণ জন্মের ৩২৮ বছরে ভোজবাজির মতো প্রতিদিনই কলকাতা বদলাচ্ছে। আজব সে পরিবর্তন। ইংরেজ কোম্পানির সাহেব জোব চার্ণকের তিনটি অখ্যাত গ্রাম উন্নয়ন, ক্ষয়, দারিদ্র্য মিশিয়ে আজগুবি চেহারা পেয়েছে। ‘ক্রেতাই ঈশ্বর’ বলে যে আদি কলকাতায় দোকানদারি শুরু হয়েছিল, তা এখন ধনী-গরিবের মিলিত মানবস্রোতে বিশ্বের অন্যতম বড় মার্কেটপ্লেস।
ধনী-গরিবের চিত্রটিও কলকাতায় বেশ আজব। গরিব কলকাতা মিশে আছে মহানগরের বস্তি জীবনে। যদিও বস্তি যে কোনও শহরের সহজাত, তথাপি কলকাতার বস্তিবাসীর সংখ্যাটি বিরাট। ১৪ লাখ লোক থাকে কলকাতার বস্তিতে! কলকাতার বস্তি যেন পাল্লা দিচ্ছে বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ মুম্বাইয়ের ধারাভি বস্তির সঙ্গে। আর মুম্বাই প্রথম হতে লড়ছে নাইরোবির কিবেরি এবং দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের খায়েলিশা বস্তির সঙ্গে! পরিসংখ্যান অবশ্য জোর লড়াইয়ের ইঙ্গিত দেয়। কারণ, কলকাতার ৩১ শতাংশ মানুষই বস্তিবাসী। দিল্লিতে বস্তিবাসীর সংখ্যা শতকরা ১১ জন আর চেন্নাইয়ে শতকরা ২৯ জন।
ধনী কলকাতার সঙ্গে গরিব কলকাতার সম্পর্কটাও বেশ জটিল। ধনী কলকাতার চোখে গরিব কলকাতার অস্তিত্ব অসহ্য। অথচ গরিব কলকাতা না থাকলে ধনী কলকাতা অচল। বন্ধ রান্নাঘর, গাড়ির চাকা, অফিসের তালা। সাহিত্য বা চলচ্চিত্রের কোথাও কোথাও সংলাপের ভাষায় সম্পর্কটা চিত্রিত হতেও শোনা যায়। এক গৃহকর্মী মুখ দিয়ে বলানো হয়েছে, ‘আমি যদি না আসি তা হলে তোমাদের আপিস যাওয়া হবে না। আপিস না গেলে মাইনে পাবে কোত্থেকে? আমরা কাজ করে দিই বলে তোমাদের চলে, না হলে কীভাবে চলত ভেবেছ?’
পৃথিবীর পালাবদলের টানে কলকাতারও কত কত পরিবর্তন হয়েছে এবং হচ্ছে। সমাজ-রাজনীতি, এমনকি প্রতিটি দিনও বদল হচ্ছে। শহর বাড়ছে। লোক বাড়ছে। ইতিহাসের কঙ্কালের উপর দাঁড়াচ্ছে নতুন চাকচিক্য। শুধু বৈষম্য আর শ্রেণি বিভাজনের কোনও বদল হচ্ছে না। এই একটি মাত্র ক্ষেত্রে কলকাতা দক্ষিণ এশিয়ার অন্যসব শহরগুলোর বড় আপন, বড় নিকটজন, একান্ত সহযাত্রী।
অনাদি কাল থেকেই দারিদ্র্যের মৈত্রীতে বিশ্বের শহরগুলো অভিন্ন আত্মীয়তার মেলবন্ধনে দাঁড়িয়ে রয়েছে একই সমান্তরালে। অতি দূরের নিউইয়র্ক, টোকিও, লাস ভেগাস, চট্টগ্রাম, ঢাকা, কলকাতা, বেঙ্গালুরু মিশে আছে বুকে বুকে। অতি-আধুনিক ও অতি-অগ্রসর নাগরিক জীবন ও আরবান উন্নয়ন মোটেও বদলাতে পারছে না বড় বড় শহরের পাদ প্রদীপের তলদেশের না-পাওয়ার হাহাকার নিয়ে বেঁচে থাকা মানুষজনের নিবিড় নৈকট্য! বিশ্বায়ন তথ্য-প্রযুক্তি আর দ্রুত যোগাযোগের মসৃণ পথ খুলে দেওয়ার আগেই ভাগ্যন্বেষী গরিবের দল মাইগ্রেশনের লুকানো পথ খুঁজে খুঁজে পৌঁছে গেছে এক শহর থেকে আরেক শহরে। সেইসব ভাগ্যহত মানুষের জীবন সংগ্রামের চলমান সংস্কৃতিতে-সৃষ্ট আরবান ল্যান্ডস্কেপ না দেখতে পেলে নগরের সবটুকু কখনোই দেখা হয় না।