কোরবানির প্রয়োজনীয় কিছু মাসয়ালা



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
গাবতলীর বিখ্যাত কোরবানির পশুর হাট, ছবি: সুমন শেখ, বার্তা২৪.কম

গাবতলীর বিখ্যাত কোরবানির পশুর হাট, ছবি: সুমন শেখ, বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

কোরবানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি আদায় করা ওয়াজিব। সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও যে ব্যক্তি কোরবানি আদায় করে না তার ব্যাপারে হাদিস শরীফে কঠিন হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, ‘যার কোরবানির সামর্থ্য রয়েছে কিন্তু কোরবানি করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহে না আসে।’ -মুস্তাদরাকে হাকেম, হাদিস: ৩৫১৯

ইবাদতের মূলকথা হলো- আল্লাহতায়ালার আনুগত্য এবং তার সন্তুষ্টি অর্জন। তাই যেকোনো ইবাদতের পূর্ণতার জন্য দু’টি বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি। ১. ইখলাস তথা একমাত্র আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে তা পালন করা ও ২. ইসলামি শরিয়তের নির্দেশনা মোতাবেক সহিহ-শুদ্ধভাবে বিধি মোতাবেক তা সম্পাদন করা। এ উদ্দেশ্যে এখানে কোরবানির কিছু প্রয়োজনীয় মাসয়ালা উল্লেখ হলো।

যাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব: প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ জিলহজ ফজর থেকে ১২ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সব আসবাবপত্র কোরবানির নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। আর নেসাব হলো- স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হলো- এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে, কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব। -আল মুহিতুল বুরহানি: ৮/৪৫৫, ফাতাওয়া তাতারখানিয়া: ১৭/৪০৫

নেসাবের মেয়াদ: কোরবানির নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কোরবানির তিন দিনের মধ্যে যেকোনো দিন থাকলেই কোরবানি ওয়াজিব হবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার: ৬/৩১২

কোরবানির সময়: মোট তিনদিন কোরবানি করা যায়। জিলহজের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে জিলহজের ১০ তারিখেই কোরবানি করা উত্তম। -মুয়াত্তা মালেক: ১৮৮, ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ৫/২৯৫

নাবালেগের কোরবানি: নাবালেগ শিশু-কিশোর তদ্রূপ যে সুস্থমস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কোরবানি করলে তা সহিহ হবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার: ৬/৩১৬

নাবালেগের পক্ষ থেকে কোরবানি: নাবালেগের পক্ষ থেকে কোরবানি দেওয়া অভিভাবকের ওপর ওয়াজিব নয়; বরং মুস্তাহাব। -রদ্দুল মুহতার: ৬/৩১৫, ফাতাওয়া কাজিখান: ৩/৩৪৫

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/19/1534663762617.jpg
চলছে কোরবানির পশু কেনাবেচা, ছবি: সুমন শেখ, বার্তা২৪.কম

মুসাফিরের জন্য কোরবানি: যে ব্যক্তি কোরবানির দিনগুলোতে মুসাফির থাকবে (অর্থাৎ ৪৮ মাইল বা প্রায় ৭৮ কিলোমিটার দূরে যাওয়ার নিয়তে নিজ এলাকা ত্যাগ করেছে) তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়। -ফাতাওয়া কাজিখান: আদ্দুররুল মুখতার: ৬/৩১৫

দরিদ্র ব্যক্তির কোরবানির হুকুম: দরিদ্র ব্যক্তির ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়, কিন্তু সে যদি কোরবানির নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কোরবানি করা ওয়াজিব হয়ে যায়। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/১৯২

কোরবানি করতে না পারলে: কেউ যদি কোরবানির দিনগুলোতে ওয়াজিব কোরবানি দিতে না পারে তাহলে কোরবানির পশু ক্রয় না করে থাকলে তার ওপর কোরবানির উপযুক্ত একটি ছাগলের মূল্য সদকা করা ওয়াজিব। আর যদি পশু ক্রয় করার পরও কোনো কারণে কোরবানি দেওয়া সম্ভব না হয়; তাহলে ওই পশু জীবিত সদকা করে দেবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৪, ফাতাওয়া কাজিখান: ৩/৩৪৫

প্রথম দিন কখন থেকে কোরবানি করা যাবে: যেসব এলাকার লোকদের ওপর জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাজের আগে কোরবানি করা জায়েয নয়। অবশ্য বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো সমস্যা থাকার কারণে যদি প্রথম দিন ঈদের নামাজ না হয় তাহলে ঈদের নামাজের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেও কোরবানি করা জায়েয। -সহিহ বোখারি: ২/৮৩২, কাজিখান: ৩/৩৪৪

রাতে কোরবানি করা: ১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতেও কোরবানি করা জায়েয। তবে দিনে কোরবানি করাই ভালো। -মুসনাদে আহমাদ: ১৪৯২৭, মাজমাউয যাওয়াইদ: ৪/২২

কোরবানির উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পশু সময়ের পর জবাই করলে: কোরবানির দিনগুলোতে যদি জবাই করতে না পারে তাহলে খরিদকৃত পশু সদকা করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তা-ও সদকা করতে হবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০২, আদ্দুররুল মুখতার: ৬/৩২০-৩২১

কোন কোন পশু দ্বারা কোরবানি করা যাবে: উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কোরবানি করা জায়েয। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ- বন্যগরু, গয়াল ইত্যাদি দ্বারা কোরবানি করা জায়েয নয়। -কাজিখান: ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৫

নর ও মাদী পশুর কোরবানি: যেসব পশু কোরবানি করা জায়েয সেগুলোর নর-মাদী দু’টোই কোরবানি করা যায়। -কাজিখান: ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৫

কোরবানির পশুর বয়সসীমা: উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয়; তাহলে তা দ্বারাও কোরবানি করা জায়েয। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে।

উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কোরবানি জায়েয হবে না। -কাজিখান: ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৫-২০৬

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/19/1534663871538.jpg

চলছে কোরবানির পশু কেনাবেচা, ছবি: সুমন শেখ, বার্তা২৪.কম

এক পশুতে শরিকের সংখ্যা: একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কোরবানি দিতে পারবে। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে কোরবানি করলে কারোটাই সহিহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরিক হতে পারবে। সাতের অধিক শরিক হলে কারো কোরবানি সহিহ হবে না। -সহিহ মুসলিম: ১৩১৮, কাজিখান: ৩/৩৪৯

সাত শরিকের কোরবানি: সাতজনে মিলে কোরবানি করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারো অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারো আধা ভাগ, কারো দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরিকের কোরবানিই সহিহ হবে না। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭

মাসয়ালা: উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কোরবানি করা জায়েয। -সহিহ মুসলিম: ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৭

কোনো অংশীদারের নিয়ত গলদ হলে: যদি কেউ আল্লাহতায়ালার হুকুম পালনের উদ্দেশ্যে কোরবানি না করে শুধু গোশত খাওয়ার নিয়তে কোরবানি করে তাহলে তার কোরবানি সহিহ হবে না। তাকে অংশীদার বানালে শরিকদের কারো কোরবানি হবে না। তাই অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে শরিক নির্বাচন করতে হবে। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২০৮, কাজিখান: ৩/৩৪৯

কোরবানির পশুতে আকিকার অংশ: কোরবানির গরু, মহিষ ও উটে আকিকার নিয়তে শরিক হতে পারবে। এতে কোরবানি ও আকিকা দু’টোই শুদ্ধ হবে। -তাহতাবি আলাদ্দুর: ৪/১৬৬, রদ্দুল মুহতার: ৬/৩৬২

মাসয়ালা: শরিকদের কারো পুরো বা অধিকাংশ উপার্জন যদি হারাম হয় তাহলে কারো কোরবানি সহিহ হবে না।

মাসয়ালা: যদি কেউ গরু, মহিষ বা উট একা কোরবানি দেওয়ার নিয়তে কিনে আর সে ধনী হয় তাহলে ইচ্ছা করলে অন্যকে শরিক করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে একা কোরবানি করাই শ্রেয়। শরিক করলে সে টাকা সদকা করে দেওয়া উত্তম। আর যদি ওই ব্যক্তি এমন গরিব হয়, যার ওপর কোরবানি করা ওয়াজিব নয়, তাহলে সে অন্যকে শরিক করতে পারবে না। এমন গরিব ব্যক্তি যদি কাউকে শরিক করতে চায় তাহলে পশু ক্রয়ের সময়ই নিয়ত করে নিবে। -কাজিখান: ৩/৩৫০-৩৫১, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২১০

কোরবানির গোশত জমিয়ে রাখা: কোরবানির গোশত তিনদিনের অধিক জমিয়ে রেখে খাওয়া জায়েয। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২৪

https://img.imageboss.me/width/700/quality:100/https://img.barta24.com/uploads/news/2018/Aug/19/1534663956837.jpg

চলছে কোরবানির পশু কেনাবেচা, ছবি: সুমন শেখ, বার্তা২৪.কম

কোরবানির গোশত বণ্টন: শরিকে কোরবানি করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েয নয়। -আদ্দুররুল মুখতার: ৬/৩১৭, কাজিখান: ৩/৩৫১

মাসয়ালা: কোরবানির গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকিনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২৪, ফতোয়ায়ে আলমগিরি: ৫/৩০০

গোশত, চর্বি বিক্রি করা: কোরবানির গোশত, চর্বি ইত্যাদি বিক্রি করা জায়েয নয়। বিক্রি করলে পূর্ণ মূল্য সদকা করে দিতে হবে। -ইলাউস সুনান: ১৭/২৫৯, বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২৫

জবাইকারীকে চামড়া, গোশত দেওয়া: জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কোরবানির পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েয নয়। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্বচুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসাবে গোশত বা তরকারি দেওয়া যাবে।

জবাইয়ের অস্ত্র: ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করা উত্তম। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২৩

পশু নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা: জবাইয়ের পর পশু নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরূহ। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২২৩

অন্য পশুর সামনে জবাই করা: এক পশুকে অন্য পশুর সামনে জবাই করবে না। জবাইয়ের সময় প্রাণীকে অধিক কষ্ট না দেওয়া।

কোরবানির গোশত বিধর্মীকে দেওয়া: কোরবানির গোশত হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীকে দেওয়া জায়েয। -ইলাউস সুনান: ৭/২৮৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০০

অন্য কারো ওয়াজিব কোরবানি আদায় করতে চাইলে: অন্যের ওয়াজিব কোরবানি দিতে চাইলে ওই ব্যক্তির অনুমতি নিতে হবে। নতুবা ওই ব্যক্তির কোরবানি আদায় হবে না। অবশ্য স্বামী বা পিতা যদি স্ত্রী বা সন্তানের বিনা অনুমতিতে তার পক্ষ থেকে কোরবানি করে তাহলে তাদের কোরবানি আদায় হয়ে যাবে। তবে অনুমতি নিয়ে আদায় করা ভালো।

কোরবানির পশু চুরি হয়ে গেলে বা মারা গেলে: কোরবানির পশু যদি চুরি হয়ে যায় বা মারা যায় আর কোরবানিদাতার ওপর পূর্ব থেকে কোরবানি ওয়াজিব থাকে তাহলে আরেকটি পশু কোরবানি করতে হবে। গরিব হলে (যার ওপর কোরবানি ওয়াজিব নয়) তার জন্য আরেকটি পশু কোরবানি করা ওয়াজিব নয়। -বাদায়েউস সানায়ে: ৪/২১৬, খুলাসাতুল ফাতাওয়া: ৪/৩১৯

   

মসজিদের নগরী এখন মসজিদের দেশে পরিণত হয়েছে



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত অতিথি, ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভায় আমন্ত্রিত অতিথি, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমাজের অনাচার দূর করা সম্ভব। বিশেষ করে দুর্নীতি, মাদকাসক্তিসহ সব সমস্যা দূরীকরণে সামাজিক সংঠনগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। তাই সমাজের ইতিবাচক পরিবর্তনে সামাজিক সংগঠনগুলোকে নিষ্ঠার সঙ্গে আরও ব্যাপকভাবে কাজ করা দরকার।

বৃহস্পতিবার (২৮ মার্চ) রাজধানীর কাকরাইলস্থ ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ আয়োজিত আলোচনা সভা ও সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।

বক্তারা আরও বলেন, উগ্রবাদীদের টার্গেটে যখন বাংলাদেশ, তখন এগিয়ে এসেছেন আলেম-উলামা এবং সংগঠনসমূহ। একসময় ঢাকা শহরকে মসজিদের নগরী বলা হতো। এখন সেটা ছাপিয়ে পুরো বাংলাদেশ মসজিদের দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। আর সেটা সম্ভব হয়েছে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং সামাজিক সংগঠনগুলোর কারণে।

ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান উপদেষ্টা ধর্মবিষক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মো. ফরিদুল হক খান এমপিকে পূর্ণ মন্ত্রী, প্রধান পৃষ্ঠপোষক প্রধানমন্ত্রীর প্রাক্তন মূখ্যসচিব মো. আবুল কালাম আজাদ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ায় এবং আসাদুজ্জামান খান কামাল এমপিকে পরপর তিনবার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ায় সংগঠনের বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়।

ফাউন্ডেশনের সভাপতি মাওলানা ওমর ফারুকের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন মুফতি আবুল বাশার নুমানি, মাওলানা মুজিবুর রহমান, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব আব্দুল হামিদ জমাদ্দার, ডি আইজি নাফিউর রহমান, মুফতি মুনিরুল ইসলাম এবং মুফতি রেজাউল হক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ প্রমুখ।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ দ্বীনি সেবা ফাউন্ডেশন একটি অরাজনৈতিক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান। এর প্রতিষ্ঠাকাল থেকে বিভিন্ন সামাজিক কাজের মধ্য দিয়ে এটি আলোচনায় আসে।

২০২২ সালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ‘বিশ্বজয়ী হাফেজদের সংবর্ধনা ও জাতীয় হিফজুল কুরআন প্রতিযোগীতা’ আয়োজনের মধ্য দিয়ে ফাউন্ডেশনটি ব্যাপক কার্যক্রম শুরু করে।

২০২৩ সালের ১৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বপ্রথম দেশসেরা হাফেজদের সম্মাননা প্রদান করা হয়।

কাজের ধারাবাহিকতায় ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে সিলেটের বন্যা পরিস্থিতিতে ত্রাণ সহায়তা প্রদান, ঢাকার মিরপুরে পুলিশ কনভেনশন হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতিতে সচেতনতামূলক সেমিনার, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় ‘এডিস মশা ও ডেঙ্গু বিস্তাররোধে করণীয়’ সম্পর্কে ইমাম-খতিবদের নিয়ে সেমিনারের আয়োজন ছাড়াও সারাদেশে ধর্মীয় ও সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।

;

রমজানে উমরাকারীর সংখ্যা ২ কোটি ছাড়িয়ে যাবে



ইসলাম ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
কাবা তওয়াফ করছেন উমরাকারীরা, ২৮ মার্চ সকালের দৃশ্য, ছবি : হারামাইন পেইজ

কাবা তওয়াফ করছেন উমরাকারীরা, ২৮ মার্চ সকালের দৃশ্য, ছবি : হারামাইন পেইজ

  • Font increase
  • Font Decrease

সৌদি আরবের পবিত্র মক্কা ও মদিনায় এখন শুধু মানুষ আর মানুষ। দৃষ্টি যতদূর যায় শুধুই মানুষের ভিড়। তাদের কেউ ইহরাম পরিহিত, কেউ স্বাভাবিক পোষাকে। তবে সবার লক্ষ্য এক জায়গা- মসজিদে হারাম।

সোমবার (২৫ মার্চ) এক প্রতিবেদনে সংবাদমাধ্যম আল আরাবিয়া জানিয়েছে, সৌদি আরবের হজ ও উমরা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, পবিত্র এই মাস শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত মোট ৮২ লাখ ৩৫ হাজার ৬৮০ জন মুসল্লি উমরা পালন করেছেন।

সৌদি কর্তৃপক্ষ বলছে, এর আগে এত বিপুল সংখ্যক মুসল্লি এভাবে ভিড় করেননি। তাদের আশা আগামী ১৫ দিনে এই সংখ্যা ২ কোটি পার হয়ে যাবে।

প্রতিবেদন অনুসারে রমজান মাস শুরুর পর থেকে ৭২ লাখ ৫৯ হাজার ৫০৪ জন উমরা সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে দেশটিতে ৯ লাখ ৭৬ হাজার ১৭৬ জন অবস্থান করছেন।

মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, স্থলপথে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক উমরাযাত্রী সৌদি আরব এসেছেন। এরপর যথাক্রমে আকাশপথ ও সমুদ্রপথে এসেছেন। স্থলপথে ৯ লাখ ৮০ হাজার ৫৫৬ জন আগমন করেছেন। আর আকাশপথে সাত লাখ ৯৮৩ জন এবং সমুদ্রপথে ৫৪ হাজার ১৪১ জন এসেছেন। রমজান মাসে পবিত্র মসজিদে হারামে ভিড় নিয়ন্ত্রণে এবং স্বাচ্ছন্দ্যে উমরা পালন নিশ্চিত করতে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে সৌদি আরব।

বিশেষ করে নুসুক অ্যাপের মাধ্যমে চলতি রমজানে উমরা পালনের কোনো ব্যক্তি দ্বিতীয়বারের মতো অনুমতি পাননি। অ্যাপে আবেদন করলে একটি বার্তা ভেসে ওঠে। তাতে লেখা থাকে, ‘অনুমতি প্রদান ব্যর্থ হয়েছে। সবাইকে সুযোগ দিতে রমজানে দ্বিতীয়বার কেউ উমরা করতে পারবেন না।’

অন্য আরেক নির্দেশনায় পবিত্র কাবাঘরের প্রাঙ্গণ তথা মাতাফে নামাজ না পড়ে মসজিদে হারামে নামাজ পড়তে বলা হয়েছে। যেন ওই সময় উমরাযাত্রীরা তওয়াফ করতে পারেন। এ ছাড়া রমজান মাসে একবারের বেশি উমরা পালনে বারণ করাসহ মক্কার বাসিন্দাদের মসজিদে হারামে ভিড় না করে আশপাশের মসজিদে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করা হয়।

উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে এক কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজারের বেশি মুসলিম উমরা পালন করেছে, যা ছিল সৌদি আরবের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যা।

;

শিক্ষাদানের শর্তে যে যুদ্ধের বন্দিরা মুক্তি পায়



মাওলানা সাইফুল ইসলাম, অতিথি লেখক, ইসলাম
বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সহযোগিতায় আসমান থেকে ফেরেশতা এই পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়, বর্তমান নাম জাবালে মালাইকা, ছবি : সংগৃহীত

বদর যুদ্ধে মুসলমানদের সহযোগিতায় আসমান থেকে ফেরেশতা এই পাহাড়ে অবতীর্ণ হয়, বর্তমান নাম জাবালে মালাইকা, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

বদর যুদ্ধে বিপুলবৈভব কুরাইশদের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভাবনীয় বিজয় অর্জিত হয়। এই যুদ্ধে ৭০ জন কুরাইশ যোদ্ধা নিহত হয় এবং সমপরিমাণ ব্যক্তি বন্দি হয়। যুদ্ধ শেষে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) মদিনায় পৌঁছার পর সাহাবায়ে কেরামের সঙ্গে যুদ্ধবন্দিদের ব্যাপারে পরামর্শ করলেন। হজরত আবুবকর সিদ্দিক (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল, ওরা তো চাচাতো ভাই এবং আমাদের আত্মীয়-স্বজন। আমার মত হলো, ওদের কাছ থেকে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হোক। এতে অর্জিত সম্পদ অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে আমাদের শক্তিতে পরিণত হবে। আর এমনও হতে পারে, আল্লাহতায়ালা তাদের হেদায়েত দেবেন এবং তারা একসময় আমাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।

হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রা.) ভিন্ন মত দিলেন। তিনি বললেন, কুরাইশ যোদ্ধাদের হত্যা করা হোক, যেন ইসলামের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের সাহস কেউ না পায়। এ ছাড়া এ যুদ্ধবন্দিরা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি। তাদের অনুপস্থিতি অবিশ্বাসী শিবিরকে দুর্বল করে দেবে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত আবুবকরের পরামর্শ গ্রহণ করলেন। কিন্তু আল্লাহতায়ালা হজরত ওমরের সিদ্ধান্তটিই অধিক সঠিক ছিল বলে জানিয়ে দেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) নিকটবর্তী একটি গাছের প্রতি ইশারা করে বললেন, আমার কাছে ওদের আজাব এই গাছের চেয়ে নিকটতর করে উপস্থাপন করা হয়েছে। -তারিখে ওমর ইবনে খাত্তাব, ইবনে জওজি, পৃষ্ঠা ৩৬

তবে আল্লাহতায়ালা ফিদইয়া গ্রহণের সিদ্ধান্তের বৈধতা দেন এবং প্রদেয় মুক্তিপণকে মুসলিমদের জন্য হালাল ঘোষণা করেন। তবে আল্লাহতায়ালা এ জন্য করেছেন যে তারা শুধু যুদ্ধবন্দি ছিল না; বরং তারা ইসলাম, মুসলমান ও মানবতার বিরোধী অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিল।

যুদ্ধবন্দিদের কাছ থেকে নেওয়া মুক্তিপণের পরিমাণ ছিল এক হাজার থেকে চার হাজার দিরহাম পর্যন্ত। যাদের মুক্তিপণ দেওয়ার সামর্থ্য ছিল না, তাদের পেশা দক্ষতার বিনিময়ে মুক্তি লাভের সুযোগ দেওয়া হয়। যেমন- মক্কাবাসী লেখাপড়া জানত। পক্ষান্তরে মদিনায় লেখাপড়া জানা লোকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। ফলে যাদের মুক্তিপণ প্রদানের সামর্থ্য নেই এবং লেখাপড়া জানে, তাদের সুযোগ দেওয়া হলো যে তারা মদিনায় ১০টি করে শিশুকে লেখাপড়া শেখাবে। শিশুরা ভালোভাবে লেখাপড়া শেখার পর শিক্ষক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হবে।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) কয়েকজন বন্দিকে বিশেষ দয়া করায় তাদের কাছ থেকে ফিদইয়া গ্রহণ করা হয়নি, এমনিতেই মুক্তি দেওয়া হয়। তারা ছিল মোত্তালিব ইবনে হানতাব, সাঈফি ইবনে আবু রেফায়া ও আবু আযযা জুমাহি। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) তার জামাতা আবুল আসকে এই শর্তের ওপর ছেড়ে দিয়েছিলেন যে তিনি নবীনন্দিনী হজরত জয়নব (রা.)-র পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন না।

এর কারণ ছিল যে হজরত জয়নব (রা.) আবুল ইবনে আসের ফিদইয়া হিসেবে কিছু সম্পদ পাঠিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি হারও ছিল। হারটি হজরত খাদিজা (রা.) হজরত জয়নব (রা.)-কে আবুল আসের ঘরে পাঠানোর সময় উপহারস্বরূপ দিয়েছিলেন। মহানবী (সা.) তা দেখে অশ্রুসজল হয়ে ওঠেন এবং আবেগে তার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে আসে। তিনি আবুল আসকে ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে সাহাবাদের মতামত চান। সাহাবারা প্রিয় নবী (সা.)-এর এই প্রস্তাব সশ্রদ্ধভাবে অনুমোদন করেন। অতঃপর মহানবী (সা.) তার জামাতা আবুল আসকে এই শর্তে ছেড়ে দেন যে তিনি হজরত জয়নব (রা.)-কে মদিনায় আসার সুযোগ করে দেবেন। স্বামীর অনুমতি পেয়ে জয়নব (রা.) মদিনায় হিজরত করেন।

হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) হজরত জায়েদ ইবনে হারেসা এবং অন্য একজন আনসারি সাহাবিকে মক্কায় প্রেরণ করেন। তাদের বলা হয়, তোমরা মক্কার উপকণ্ঠ অথবা জাজ নামক জায়গায় থাকবে। হজরত জয়নব (রা.) তোমাদের কাছ দিয়ে যখন যেতে থাকবেন, তখন তাকে সঙ্গে নিয়ে আসবে। এই দুজন সাহাবি মক্কায় গিয়ে হজরত জয়নব (রা.)-কে মদিনায় নিয়ে আসেন। হজরত জয়নব (রা.)-এর হিজরতের ঘটনা অনেক দীর্ঘ এবং মর্মস্পর্শী।

;

ইতিহাস বদলে দেওয়া বদর যুদ্ধের প্রেক্ষাপট



মাওলানা আবদুল জাব্বার, অতিথি লেখক, ইসলাম
বদর যুদ্ধে যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাঁবু ছিল সেখানে পরে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে, নাম মসজিদে আরিশ, ছবি : সংগৃহীত

বদর যুদ্ধে যেখানে রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর তাঁবু ছিল সেখানে পরে এই মসজিদটি নির্মিত হয়েছে, নাম মসজিদে আরিশ, ছবি : সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

মুসলিম ইতিহাসের প্রথম সশস্ত্র যুদ্ধ বদর। দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান মদিনার উপকণ্ঠে বদর নামক স্থানে মুখোমুখি হয় মুসলিম ও কুরাইশ বাহিনী। ঐতিহাসিক এ যুদ্ধ ছিল অসত্যের বিরুদ্ধে সত্যের লড়াই। ইসলাম ও মুসলিমদের অস্তিত্বের সংগ্রাম। বদর যুদ্ধে আল্লাহতায়ালা অসম প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে মুসলিম বাহিনীকে বিজয় দান করেন। অস্তিত্বের সংকট থেকে মুসলিম উম্মাহকে মুক্তি দিয়ে অমিত সম্ভাবনার দুয়ারে পৌঁছে দেন।

৬২৪ খ্রিস্টাব্দ তথা দ্বিতীয় হিজরির ১৭ রমজান সংঘটিত হয়েছিল ইসলামে চিরস্মরণীয় ও গৌরবময় অধ্যায় বদর যুদ্ধ। এটি ছিল সত্য ও মিথ্যার, হক ও বাতিলের, মুসলিম ও কাফেরদের মধ্যকার ঐতিহাসিক যুদ্ধ, ইসলামের প্রথম যুদ্ধ। মদিনার অদূরে অবস্থিত একটি কূপের নাম ছিল বদর। সেই সূত্রে এই কূপের নিকটবর্তী আঙিনাকে বলা হতো বদর প্রান্তর। এই বদর প্রান্তরেই মহান আল্লাহ তার প্রিয় হাবিব নিরস্ত্র মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ (সা.) ও তার সঙ্গীদের বিজয়ী করেছিলেন হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার মোকাবেলায়।

ঘটনার সূত্রপাত
মদিনায় বইতে থাকা ইসলামের বসন্তের হাওয়া মক্কার কাফেরদের বেশ ভাবিয়ে তুলেছিল। না জানি কখন এই হাওয়া দমকা হাওয়ায় রূপ নিয়ে তাদের উড়িয়ে নিয়ে যায়, কিংবা তাদের ব্যবসার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই মুসলমানদের চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার জন্য অর্থ জোগান ও অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র ক্রয় করার উদ্দেশ্যে আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মক্কার একটি বিশাল বাণিজ্য কাফেলা শামে গিয়েছিল। মক্কার প্রতিটি ঘর থেকে প্রত্যেকের সামর্থ্য অনুযায়ী অর্থ দিয়ে গঠন করা হয়েছিল ৪০ জন সশস্ত্র অশ্বারোহী যোদ্ধার পাহারায় এক হাজার মালবাহী উটের একটি বাণিজ্যিক বহর।

বিষয়টি আঁচ করতে পেরেছিল মুসলমানরাও। তাই যখন তারা শাম থেকে ব্যবসা শেষে অস্ত্র নিয়ে ঘরে ফিরছিল, তখন তাদের ওপর হামলা করার সিদ্ধান্ত হলো। মুসলমানদের আত্মরক্ষার্থে হামলা করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না। বিষয়টি আবু সুফিয়ান টের পেয়ে দ্রুত সাহায্যের জন্য মক্কায় খবর পাঠায়। তবে খবরটি ছিল, মুসলমানরা আবু সুফিয়ানের কাফেলার ওপর হামলা করেছে। খবর পেয়ে তৎক্ষণাৎ আবু জাহেলের নেতৃত্বে এক হাজার সশস্ত্র যোদ্ধার এক বিশাল বাহিনী মদিনা আক্রমণের জন্য বের হয়। অথচ মুসলমানরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে আসেনি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শুধু আবু সুফিয়ানকে আটকানো।

এই যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে যেসব বিষয় প্রত্যক্ষভাবে কাজ করেছিল তা ছিল নাখলার খণ্ডযুদ্ধ, কাফেরদের রণপ্রস্তুতি, আবু সুফিয়ানের অপপ্রচার, যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য অহি লাভ ও মক্কাবাসীর ক্ষোভ ইত্যাদি। আর পরোক্ষ কারণ হিসেবে দেখা হয়, মদিনা শরিফে সাফল্যজনকভাবে ইসলাম সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কুরাইশদের হিংসা, আবদুল্লাহ বিন উবাই ও ইহুদিদের ষড়যন্ত্র, কুরাইশদের যুদ্ধের হুমকি, তাদের বাণিজ্য বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা, কাফেরদের আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা, ইসলামের ক্রমবর্ধমান শক্তির ধ্বংসসাধন এবং রাসুল (সা.)-কে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করার কাফেরদের অশুভ বাসনা।

যুদ্ধের ফলাফল ও প্রভাব

ঐতিহাসিক বদর যুদ্ধ ইসলামের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। মহান আল্লাহ এই যুদ্ধকে ‘ইয়াওমুল ফুরকান’- সত্য ও মিথ্যার মধ্যে পার্থক্য স্পষ্টকারী দিন বলে আখ্যা দিয়েছেন। আল্লাহর এই নামকরণ থেকেই বদর যুদ্ধের প্রভাব ও ফলাফল সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মূলত প্রতিষ্ঠিত শক্তি কুরাইশদের বিরুদ্ধে সদ্যঃপ্রসূত মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রের জন্য বদর ছিল অস্তিত্বের লড়াই। বদর যুদ্ধের বিজয় ছিল মুসলিম উম্মাহর জন্য প্রথম রাজনৈতিক স্বীকৃতি। এ যুদ্ধই ইসলামি রাষ্ট্রের পথচলার গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছিল। বদর যুদ্ধের পূর্বাপর অবস্থা বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এই যুদ্ধ শুধু মদিনা নয়; বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপে মুসলিম উম্মাহর ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছিল।

ঐতিহাসিকরা মনে করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর হিজরতের পর মদিনায় যে ইসলামি রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন হয়েছিল, তার প্রকৃত প্রতিষ্ঠা বদর প্রান্তে বিজয়ের মাধ্যমেই হয়েছিল। এই বিজয়ের আগে মদিনার মুসলিমরা ছিল একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র। কিন্তু কুরাইশদের মতো প্রতিষ্ঠিত শক্তির বিরুদ্ধে সামরিক বিজয় এই ধারণা পাল্টে দেয় এবং আরব উপদ্বীপে মদিনার মুসলিমদের একটি রাজনৈতিক পক্ষের মর্যাদা এনে দেয়। শুধু তা-ই নয়, বদর যুদ্ধ আরবের বহু মানুষের হৃদয়ের সংশয় দূর করে দেয় এবং তারা ইসলাম গ্রহণের সৎসাহস খুঁজে পায়। এ ছাড়া অসম শক্তির বিরুদ্ধে এই অসাধারণ বিজয় মুসলিম উম্মাহর জন্য অনন্ত অনুপ্রেরণার উৎস।

আরবের অমুসলিমদের ওপরও বদর যুদ্ধের প্রভাব ছিল অপরিসীম। বদর যুদ্ধে কুরাইশ বাহিনীর ৭০ জন নিহত হয়। তাদের বেশির ভাগই ছিল শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্ব ও খ্যাতনামা আরব বীর। আবু জাহেল, উতবা ইবনে রাবিয়া, শায়বা ইবনে রাবিয়া, ওয়ালিদ ইবনে মুগিরা, নদর বিন হারেস ও উমাইয়া বিন খালাফের মতো কুরাইশ নেতাদের করুণ মৃত্যু তাদের হৃদয়াত্মাকে কাঁপিয়ে দেয় এবং তাদের চোখ থেকে অহমিকার পর্দা সরে যায়। কারণ সমকালীন ইতিহাসে কুরাইশ গোত্রের এমন বিপর্যয় আরবরা দেখেনি।

এ ছাড়া বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর বিজয় কুরাইশদের অবাধ বাণিজ্য এবং আরবের অন্যান্য গোত্রের ওপর অন্যায় প্রভাব খাটানোর পথ বন্ধ করে দেয়। মদিনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুণ্ঠনের যে ধারা যুগ যুগ ধরে চলে আসছিল- যার পেছনে কুরাইশ নেতাদের সহযোগিতা ও প্রশ্রয় ছিল, তা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে মুসলিম বাহিনীর এই বিজয়ে স্বস্তি প্রকাশ করে মদিনা ও আশপাশের সর্বস্তরের মানুষ। তারা স্বাগত জানায় সত্যপক্ষের এই মহান বিজয়কে।

;