ইস্তাম্বুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের বিশালত্ব দেখে আমার চোখ ছানাবড়া। নবনির্মিত, ঝকঝকে, তকতকে। মুহূর্তে সহস্র যাত্রী একজায়গায় মিলিত হয়ে দূরগ্রামী হচ্ছে। বছরে এই বিমানবন্দরের ধারণক্ষমতা নাকি ২০ কোটি বলে শুনেছি। ইউরোপের বহু হাওয়াই জাহাজ কোম্পানির ব্যবসা পরিচালনার কেন্দ্র এখন এই বন্দর।
চলন্ত সিঁড়িতে ট্রান্সফার টার্মিনালের দিকে এগিয়ে যাই। এ যাত্রায় ইস্তাম্বুল আমাদের গন্তব্য না। চারঘণ্টা লেওভার শেষে উড়াল দেবো মার্কিন মুলুক মুখো। চলন্ত সিঁড়ির শেষ মাথায় লিফট ও সিঁড়ি। দোতলা থেকে তিনতলায় উঠতেই বৃত্তাকার বিশাল প্রাঙ্গণ। এখানে বিশাল আকারের ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে ঘাড় ঘুরিয়ে ট্রান্সফারযাত্রী পরবর্তী ফ্লাইটের গেট নম্বর জেনে নিচ্ছে। চত্বর ঘিরে চারপাশে আলো ঝলমল বিপনী। তাতে বহুবর্ণিল পোশাক, সুগন্ধী, গহনা আর সৌখিন সামগ্রীর বিপুল সম্ভার পকেট উজাড়ের হাতছানি দিচ্ছে। সেসব হাতছানিকে উপেক্ষা করে আমি বরং পকেটে হাতড়ে ফিরছি প্রায়োরিটি পাস কার্ড।
তুসুকে বললাম, এয়ারপোর্টের ওয়াইফাই সুবিধা নিয়ে লাউঞ্জ কোন দিকে তার হদিস করতে। তাতে সুবিধা করতে না পেরে সামনে দাঁড়ানো ইউনিফর্মধারী ফর্সা দীর্ঘাঙ্গিনীর কাছে জিজ্ঞেস করি। সে দেখিয়ে দেয়- সামনে এগিয়ে বাঁ দিকে এসকেলেটর। ওপরে উঠলেই ডানে ইস্তাম্বুল গ্রান্ড এয়ারপোর্ট-আইজিএ লাউঞ্জ।
আইজি এ লাউঞ্জের দেয়াল মরিচবাতিসজ্জিত
লাউঞ্জে যেতে যেতে আমার স্মরণঅলিন্দে জাবর কাটে পূর্বরাতে হাওয়াই জাহাজে ভেসে আসার সম্পূর্ণরঙিন উড়ালচিত্র। ঢাকা থেকে টেকঅফ করেই টার্কিশএয়ারের সুপরিসর এয়ারবাসটি চলে যায় পশ্চিমবঙ্গের আকাশে। জলি উইন্ডো আসনে। আমি তার দিকে ঝুঁকে পড়ে নিচের আলোকমালায় উদ্ভাসিত কলকাতা, হলদিয়া, বকখালি দেখি। মনে ভেসে ওঠে বিশ্বপর্যটক অমরেন্দ্র চক্রবর্তী, বৃক্ষবন্ধু কমল চক্রবর্তী, ‘তুই লালপাহাড়ের দেশে যা’খ্যাত অরুণ চক্রবর্তী, কবি বন্ধু সৌমিত বসুসহ অংসখ্য বন্ধুসুহৃদের মুখ। যে আকাশ দিয়ে উড়ছি, এর নিচে বসবাসরত এই বন্ধুস্বজনরা কি এখন ঘুমিয়ে? আসনলাগোয়া মনিটরে স্ক্রিনটাচ বাটন চেপে যাত্রাপথের মানচিত্র বের করি। দেখি কানপুরের ওপর দিয়ে জয়পুরকে বাঁয়ে আর অমৃতসরকে ডানে রাখছে উড়োজাহাজ। মাটি থেকে পঁয়ত্রিশ হাজার ফুট বিচ্ছিন্ন থাকলেও যেন অপূর্ব যোগাযোগ মৃত্তিকার সঙ্গে। যে মৃত্তিকা একদা মাতৃগর্ভ থেকে আশ্রয় দিয়েছিল নিজবুকে।
ছুটে চলেছি ইসলামবাদ হয়ে কাবুলের দিকে। সৈয়দ মুজতবা আলী, মঈনুস সুলতানের প্রিয় কাবুল। তালেবানরা কি অলরেডি ক্ষমতায়? সেখানে এখন যে অস্থিরতা, এর অবসান হবে কবে? তালেবানের উত্থান দুনিয়াকে কোন বার্তা দিচ্ছে? এসব জিজ্ঞাসা মনে এই জন্য এলো যে, টার্কিশ এয়ালাইন্সে তুরস্ক হয়ে যাচ্ছি আমেরিকায়। আমেরিকা আর তুরস্ক অশান্ত কাবুলে বড় প্রসঙ্গ হয়ে উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র কাবুল ছাড়ছে, কাবুলের সহযোগিতায় এগুচ্ছে তুরস্ক। আমার মতো নিরেট ভ্রামণিকের মাথায় রাজনীতি- ভূরাজনীতি ঢোকে না। এতোটুকু বুঝি, এই পৃথিবী বড় জটিল এক জায়গা।
পাখিচোখ সোজা নিচে ছাড়াও দূরের শহরকে চোখের ওপর প্রতিভাত করে। মানচিত্র যাত্রাপথের তিনশ কিলোমিটারের মধ্যকার শহরগুলোর নাম দেখাতে থাকে। তাই এই পথে নানা শহরের নাম আসছে। মজার ব্যাপার, ঢাকা থেকে তুরস্কের পথে এয়ারলাইন্সটি ভারতছাড়া মুসলিমপ্রধান দেশের ওপরকার রুট বেছে নিয়েছে। ভারতের পর পাড়ি দিচ্ছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, আজারবাইজান, তুর্কমেনিস্তান।
ইতোমধ্যে দীর্ঘাঙ্গিনী তুর্কিসুন্দরী ডিনারের পাট চুকিয়ে আলো নিভিয়ে দিয়েছে। চারদিক আসছে নাকডাকার মজার মিহিন শব্দ। চিকন সুগন্ধিচালের বাটার রাইস, চিকেন, সালাদ আর কালোজাম খেয়ে আমি নির্ঘুমচোখে দেখে চলেছি ভূরাজনীতির সংঘাতময় এই উড়োজাহাজের রুট। যেখান থেকে সিরিয়া, বাগদাদ কিংবা ইসরাইল অধিকৃত ফিলিস্তিন খুব বেশি দূরে নয়।
আইজিএ লাউঞ্জ
বিমান এখন উড়ছে ইরানের ওপর। ‘শাহনামা’র কবি ফেরদৌসী, কবি হাফিজ ও কবি রুমির কথা মনে ভেসে ওঠে আমার। মনে ভেসে ওঠে সেই বিখ্যাত শায়ের ‘আগার আঁ তুর্কে শীরাজী বদস্ত আ রাদ দিলে মারা/ বখালে হিন্দওয়াশ বখশাম সমরকন্দ ও বোখারা রা’ (সিরাজ শহরে যে তুর্কিসুন্দরী করেছে হৃদয়হরণ/ ফিরিয়ে তা দিলে তা করবো তাকে সমরকন্দ ও বোখারার উপহারে বরণ)। মনে পড়ে, বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের পারস্য ভ্রমণের কথা। তার পারস্য ভ্রমণগদ্য পড়ে হয়েছি একদা উতলা। সে দেশের ওপর দিয়ে এখন উড়ে চলেছি। তেহরান বাঁয়ে, তুর্কমেনিস্তান ডানে দেখা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে কাস্পিয়ান সাগর পাড়ি দিয়ে জাহাজ উড়তে থাকে আজারবাইজানের বাকু নগরীর দিকে। রাতের অন্ধকারে নিচে তাকিয়ে মানচিত্রের সঙ্গে শহরের আলোকমালা মেলাতে থাকি। চোখে ঘুম নেই। সাগর পাড়ি দেয়ার পর বাকু শহরের আলোকমালা। ডানে জর্জিয়ার রাজধানী তিবলিসি, বামে আর্মেনিয়া ভেসে ওঠে মানচিত্রে। সিভাস শহরের ওপর দিয়ে তার্কিশ এয়ার প্রবেশ করে নিজ জন্মভূমে। দীর্ঘপথ পাড়ির পর উড়োজাহাজ আঙ্কারাকে বাম পাশ কাটিয়ে যেতে থাকে। আঙ্কারায় এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মসয়ূদ মান্নান। পেশায় গম্ভীর কূটনীতিক, নেশায় সংগঠনপ্রিয়-সংস্কৃতিপ্রাণ রাষ্ট্রদূত আমাদের বন্ধুজন। তার কথা ভাবতে ভাবতেই তুরস্কের পর্বত ও সাগরময় অনেক শহর পেরিয়ে জাহাজ কৃষ্ণসাগর ও মারামার ওপর থিতু হয়ে চক্কর দিতে থাকে। বসফরাসকে আমাদের চোখের সামনে মেলে ধরার পর শহর থেকে দূরে বিমানবন্দরে নামে।
আই জি এ লাউঞ্জের গেটমুখ পৌঁছে দেখি একযুগোল যুবক-যুবতী সামলাচ্ছে বড়সড় লাউঞ্জের রিসেপশন। একজনের পর আমার পালা এলে ‘গুনাইদেন’ বা ‘শুভসকাল’ অভ্যর্থনা পেলাম। ভুলভাল উচ্চারণে বিপরীতে বললাম, ‘তেসিকুল্লের এদেরিম’। সফরসঙ্গী কনিষ্ঠ পুত্র তুসু ঢাকার তুর্কিশ হোপ স্কুলে পড়েছে। কয়েকবছর তুর্কি ভাষাটির কোর্স করতে হয়েছে তাকে। সে সুবাদে আমারও দুয়েকটি তুর্কি শব্দ- বাক্য জানা। তা এস্তেমাল করার মওকা পেয়ে খুশিই হলাম। প্রায়োরিটি লাউঞ্জের এক্সেস ওপেন করে ওয়াইফাই আইডি আর পাসওয়ার্ড হাতে দিয়ে সহাস্যবদন যুবক যুবতী লাউঞ্জে স্বাগত জানালো আমাদের। বোর্ডিং পাসটি স্বয়ংক্রিয় গেটের বারকোড রিডারে ছোঁয়াতেই গেটখুলে গেলো। ভেতরে সুলতান সোলেমান স্টাইলের রাজকীয় আতিথ্যরাজ্যে প্রবেশ হলো আমাদের।
বিমান চলাচলের ঢাউস বিলবোর্ড
প্রযুক্তিযুগে আধুনিক ভ্রামণিকের ভ্রমণের এই এক মজা। ইবনে বতুতার মতো দিনমান ক্লান্তিকর পদব্রজ পরিভ্রমণই শুধু নেই। এখানে আছে ভ্রমণক্লান্তির পরই ঘরোয়া প্রশান্তি। পকেটের পাস বিশ্বজুড়ে বিমানপোতগুলোতে রেখে দিয়েছে বাঁধা সেবিকার বহুমাত্রিক শুশ্রুষা-যার নাম প্রায়োরিটি লাউঞ্জ। সেখানে খানাপিনা, হোতনা, বসনা, গল্প করনার মতো সব এন্তেজামই খাসা, পাঁচতারকামানের।
আইজিএ’র লম্বা করিডোর পেরিয়ে বাম হাতে প্রথমে ওয়েটিং লাউঞ্জ। অর্ধবৃত্তাকার টানা সোফাসহ সামনে জোড়ায় জোড়ায় সোফা। নিশিজাগা রাত্রিদের অনেকে গা এলিয়ে ঝিমু্চ্ছে। উল্টোদিকে লাগেজ রাখার সেফবক্স। একটু সামনে ডানে বড় হলের একপাশে রেস্টুরেন্ট। জনা ত্রিশেক একসঙ্গে খানাপিনা করতে পারে এমন সংখ্যায় চেয়ার টেবিলসজ্জিত। রেস্তোরাঁর একদিকে ব্যুফে খাবারের লোভনীয় রকমারি আইটেম ক্ষুৎপিপাসাকাতর যাত্রীর জিহবায় আত্মাহুতি দিতে অপেক্ষমান। বিপরীতে দিকের দেয়াল মরিচবাতিসজ্জিত। অন্যপাশে বিশাল টানা বারান্দা থেকে নিচের বিপনীবাজারের বিশাল লাইভ ক্যানভাস। দোকানের বেচাকোনা, ফ্লাইট ধরতে বোচকাবুচকি নিয়ে যাত্রীদের হন্তদন্ত ছোটাছুটি চোখে পড়ে সে ক্যানভাসে দৃশ্যমান। এসব পেরিয়ে যতোই লাউঞ্জের গভীরে যাই, ততোই আবিষ্কার করি নতুন নতুন সুবিধা। ভেতরে ডান পাশে বাথরুম-রেস্টরুম কমপ্লেক্স। নরনারীর আলাদা বাথরুম, গোসলখানা, ওজুখানা। রেস্টুরুম বা বাথরুম নাম শুনলে মনে যে চিত্রকল্পের উদয় হয়, এটি তার উল্টো। পুরো লাউঞ্জের বাথরুমই সবচেয়ে আকর্ষণীয়। পরিচ্ছন্ন, সুগন্ধিময় ও দৃষ্টিনন্দন বাথরুমে বহুঘন্টা পার করে দেয়া যায়। সবচেয়ে আকর্ষণ এর মাল্টিফেইথ প্রেয়ার রুম। ওজুখানাসহ গোলাকৃতি নামাজঘর যেমন আছে, তেমনি আছে প্রার্থনা ও পড়ার ব্যবস্থা। এই রেস্টরুম পেরিয়ে বাঁয়ে উন্মুক্ত ক্যাফেতে আবেশ ছড়ানোর পানীয়ের ব্যবস্থা। ওয়েটাররা অপেক্ষমান আদেশের অপেক্ষায়।
পছন্দমতো জায়গা বেছে নিতে সব হল ঘুরে দেখি। নিশিজাগা যাত্রীরা বিশ্রামরত। যে যেখানে পেরেছে ঘুমিয়ে আছে স্বপ্নের জগতে। পছন্দমতো চারটি সিঙ্গেল সোফা ও গোলাকার সেন্টার টেবিলে দেখে আমরা হাতের লাগেজপত্র নামাই। হাতমুখ ধুয়ে আসি। থরে থরে সজ্জিত তুর্কিশ ক্যুইজিন থেকে নানারকম খাবার নিয়ে আরাম করে খাই। রাইস স্যুপ, ব্রেড, হানি, জেলি, স্যামন সালাদ এসব।
আইজিএ লাউঞ্জের একাংশ
চারদিকের পরিবেশ ঘুমানোর এন্তার এন্তেজাম। মাত্র চারঘন্টা পরই বোর্ডিংগেটে চলে যেতে হবে বলে ঘুমাতে চাচ্ছি না। সফরসঙ্গী জলি ও তুসুকে ঘুমানোর সুযোগ দিয়ে আমি জেগে বইয়ে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করি। কিছুক্ষণ পর ঘুমজড়ানো চোখেই জলি উঠে বসে-
‘তুসু থাক, চলো নিচে ঘুরি আসি’।
সে বোধ হয় কিছু কিনতে চায়। ডিউটি ফ্রি’তে গিয়ে কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে তেমন কিছুই কেনার পাই না বা কিনি না। ফিরে আসি।
আমেরিকার পশ্চিম উপকূলশহর সানফ্রানসিস্কোর উদ্দেশে আমাদের পরের ফ্লাইট টি কে ২৮৯ ছেড়ে যাবে সকাল আটটা পঁচিশে। ঘণ্টাকাল আগেই আইজিএ লাউঞ্জের ইলেকট্রনিক বিলবোর্ডে বোর্ডিংগেটের নম্বর ভেসে ওঠে-ডি ১১। লাউঞ্জ থেকে এর দূ্রত্ব আধকিলোমিটারের কম নয়। তাই সোলেমানী আতিথ্যের পাট চুকিয়ে আমরা হাতব্যাগ গুছিয়ে সেদিকে রওনা দেই। আমেরিকার ফ্লাইট। আমাদের পাসপোর্টে মাহমুদ আর মাহমুদ, আমরা বিশ্বাসী মুসলিম। নিরাপত্তার তোড়জোড় একটু বেশিই।
নাদির অন দ্য গো আয়োজন করল প্রথম মিটআপ। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন হাজারো নাদির ভক্ত। যারা সরাসরি নাদিরের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের অভিজ্ঞতা বিনিময়ের সরাসরি সুযোগ পেয়েছেন। অনুষ্ঠানটি সৌজন্য করে শেয়ারট্রিপ। আয়োজক ছিল দ্য মার্বেল বি ইউ।
‘নাদির অন দ্য গো’ সুপরিচিত পুরস্কার প্রাপ্ত কনটেন্ট নির্মাতা। দেশে-বিদেশে লাখের বেশি ফলোয়ার প্রতিদিন তার কনটেন্ট উপভোগ করছেন।
নাদির মার্বেল অব টুমরো, বাংলাদেশের অন্যতম ইনফ্লুয়েন্সার প্ল্যাটফর্মের ট্রাভেল ক্যাটাগরিতে পুরস্কার বিজয়ী। নাদির ও ভ্রমণ ভক্তরা তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, তার থেকে অনুপ্রেরণাও নিয়েছেন।
কনটেন্ট সহযোগী হিসেবে আয়োজনকে উজ্জীবিত করেছে ডিজিটাল ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর অরিজিনালস’। তা ছাড়া সার্ভিস সহযোগিতায় ছিল ‘ইউনিভার্সিটি অব স্কলার্স’। কমিউনিটি এনগেজমেন্টে কাজ করেছে ‘কলোনি অব আর্টস’।
নাদির জানালেন, দারুণ একটি দিন ছিল। ভক্তদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা আর দেখা করতে পারা সত্যিই আনন্দের। মার্বেল বি ইউ আর শেয়ারট্রিপ যৌথভাবে দারুণ আয়োজন করেছে।
শেয়ারট্রিপ মার্কেটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার সামিউর রহমান জানালেন, যখন ভ্রমণের বিষয় আসে, নাদির তখন লাখো ভক্তের অনুপ্রেরণা। শুধু নাদিরের জন্য নয়, ভ্রমণ উদ্যোগে উৎসাহ দিতে শেয়ারট্রিপ সবসময়ই কনটেন্ট নির্মাতাদের সঙ্গে কাজ করবে।
দেশি-বিদেশি ভ্রমণকে উৎসাহ ও তথ্যবহুল করতে ভবিষ্যতে আরও অভিনব সব উদ্যোগ নিয়ে কাজ করবে ‘দ্য মার্বেল বি ইউ’।
ডিজিটাল কুরআন শরীফ আ.লীগ সরকার করে দিয়েছে: প্রধানমন্ত্রী
স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
ট্রাভেল
আওয়ামী লীগের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিভিন্ন স্কুল কলেজে শিক্ষকদের জন্য কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। সেই সাথে সাথে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য মসজিদ মন্দির সবখানে ধর্মীয় প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। এছাড়া ডিজিটাল কুরআন শরীফ আওয়ামীলীগ সরকার করে দিয়েছে।
রোববার (২৯ জানুয়ারী) দুপুরে রাজশাহী জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী এ মন্তব্য করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, এই রাজশাহীতে নৌকায় ভোট দেওয়ার কারণে বিএনপি-জামায়াত জোট সাধারণ মানুষকে পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে। কিন্তু নৌকায় ভোট না দিলে দেশ স্বাধীন হতো না, দেশ স্বাধীন না হলে জিয়াউর রহমান মেজর জেনারেল হতো না, দেশ স্বাধীন না হলে খালেদা জিয়া ক্ষমতায়ও আসতে পারতো না।
সরকার প্রধান বলেন, এদেশের কোনো মানুষ গৃহহীন-ভূমিহীন থাকবে না। যারা বাকি আছে তাদেরও পর্যায়ক্রমে দেওয়া হবে। এই বঙ্গবন্ধুর বাংলায় কেউ গৃহহীন-ভূমিহীন থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, গত ১৪ বছরে রাজশাহী জেলা ও মহানগরে ১০ হাজার ৬৬০ কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। শুধুমাত্র রাজশাহী নগরীতেই ৪ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ হয়েছে। আজকে ১ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকার ২৬ টি প্রকল্প উদ্বোধন করলাম। ৩৭৫ কোটি টাকার ছয়টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধন করলাম। এই প্রকল্পগুলো আপনাদের জন্য উপহার হিসেবে দিয়ে গেলাম।
সরকার প্রধান বলেন, ক্ষমতা হারালে আওয়ামী লীগের নেতারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে বলে বিএনপি অনেক নেতারা বক্তব্য দিয়ে আসছিলেন। গতকাল ঢাকায় আয়োজিত পদযাত্রা কর্মসূচিতেও এমন বক্তব্য দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল। সরকারকে উদ্দেশ্য করে ফখরুল বলেছিলেন, ‘কালবিলম্ব না করে পদত্যাগ করুন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করুন, নতুন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণকে তার ভোটের অধিকার প্রয়োগ করার ক্ষমতা দিন। অন্যথায় আপনাদের ভারাক্রান্ত হয়ে চলে যেতে হবে। পালাবার পথ খুঁজে পাবেন না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিরোধী দল অনেক কথাই বলে। আমরা নাকি পালানোর পথ পাব না। আওয়ামী লীগ কখনো পালায় না। আওয়ামী লীগ জনগণের জন্য কাজ করে। পালিয়ে যায় আপনাদের (বিএনপি) নেতারাই।
শেখ হাসিনা বলেন, বিএনপি নাকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করবে। অথচ তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত। দুর্নীতিতে সাজাপ্রাপ্ত খালেদা-তারেক। তাই তাদের মুখে দুর্নীতির কথা মানায় না।
আগরতলায় মুসলিম রেস্টুরেন্ট-দিল্লিকা মসুর চিকেন বিরিয়ানি
এটিএম মোসলেহ উদ্দিন জাবেদ
আগরতলায় মুসলিম রেস্টুরেন্ট-দিল্লিকা মসুর চিকেন বিরিয়ানি রেস্টুরেন্ট
ট্রাভেল
ত্রিপুরার রাজধানী শহর আগরতলা বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছে অবস্থিত ভারতের ছোট্ট একটি শহর। মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধের আগে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার কারণে বাংলাদেশের মানুষের কাছে খুবই পরিচিত নাম আগরতলা। ট্রেনে আখাউড়া হয়ে খুব সহজে ও কম খরচে পৌঁছানো যায় সেখানে। অনেকেরই ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে জেনেছি আগরতলায় কোনো মুসলিম রেস্টুরেন্ট নেই। তাই সেখানে ভ্রমণে গিয়ে খাওয়া নিয়ে হালকা একটু চিন্তা ছিলো।
গত শুক্রবার ৪ নভেম্বর দুদিনের ভ্রমণে আগরতলা ভ্রমণে গিয়েছি পরিবার নিয়ে। ঢাকা থেকে ট্রেনে করে আখাউড়া হয়ে দুপুর ১২ টার মধ্যেই পৌঁছে যাই আগরতলা। হোটেলে চেকইন করে ফ্রেশ হয়ে বের হয়েছি লাঞ্চ করার জন্য। গুগলে সার্চ করে দেখলাম আগরতলা শহরের শান্তিপাড়া মসজিদ পট্টি নামক জায়গাটি মুসলিম বসতি এলাকা। আমার চিন্তায় এলো সেখানে অবশ্যই কোনো মুসলিম রেস্টুরেন্ট পাওয়া যাবে। একটা ব্যাটারি চালিত অটো ঠিক করে শান্তিপাড়া মসজিদ পট্টি এরিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম।
মসজিদ পট্টিতে গিয়ে কয়েকজনকে জিজ্ঞেস করলাম মুসলিম রেস্টুরেন্ট কোথায় আছে। সেখানের লোকজন জানালো মেইন রাস্তা ধরে একটু এগুলে মোটর স্ট্যান্ড নামক জায়গায় 'দিল্লিকা মসুর চিকেন বিরিয়ানি রেস্টুরেন্ট' আছে। এগিয়ে চললাম মোটর স্ট্যান্ড নামক জায়গার উদ্দেশ্যে। মোটর স্ট্যান্ড পৌঁছেই রাস্তার ডান পাশে রেস্টুরেন্টটি নজরে আসলো। নরমাল একটা রেস্টুরেন্ট, কিন্তু অনেক কাস্টমার। তারা দুপুরে শুধু হায়দারাবাদী বিরিয়ানি ও মুরাদাবাদী বিরিয়ানি বিক্রি করে। আমরা একটা টেবিলে বসে পড়লাম।
আমরা দুরকম বিরিয়ানিই অর্ডার করেছি স্বাদ চেখে দেখার জন্য। বাসমতী চাউল আর চিকেন দিয়ে রান্না করা বিরিয়ানি হাফ ৬০ রূপী আর ফুল ১২০ রূপী। হায়দারাবাদী বিরিয়ানি সাথে মিশিয়ে খাওযার জন্য একটি চাটনী এবং মুরাদাবাদী বিরিয়ানির সাথে মিশিয়ে খাওয়ার জন্য তারা একটা ঝোল দেয়। হায়দারাবাদী বিরিয়ানি সামান্য ঝালযুক্ত, মুরাদাবাদী বিরিয়ানির ঝাল খুবই কম। খুবই সুস্বাদু ছিলো দুরকম বিরিয়ানি। পরিমাণও যথেষ্ট ছিলো। আমার কাছে বেশি ভালো লেগেছে মুরাদাবাদী বিরিয়ানি।
খাওয়ার পরে রেস্টুরেন্টের মালিক ইকবালের সাথে কথা বললাম। ইকবালের বাড়ি ভারতের উত্তর প্রদেশে, হিন্দিতে কথা বলে। আগরতলা থাকতে থাকতে বাংলা বুঝে কিন্তু বলতে পারে না। সে জানালো তার ছোট ভাইয়ের নাম আফজাল এবং আফজালই হলো রেস্টুরেন্টের বাবুর্চী। দুইভাই মিলেই মুলত এই রেস্টুরেন্ট ব্যবসা চালায়। অন্যান্য স্টাফদের মধ্যে তার নিজ এলাকার ও আগরতলার লোকও আছে। তাদের খাবার সুস্বাদু হওয়ায় সব কমিউনিটির লোকজনই এখানে খেতে আসে।
লেখক: ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট ও সদস্য-বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন
বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা বলেছিলেন, ভ্রমণ প্রথমে তোমাকে নির্বাক করে দেবে তারপর তোমাকে গল্প বলতে বাধ্য করবে। ভ্রমণ প্রিয় মানুষ আমি, সময় সুযোগ পেলে বেরিয়ে পড়ি পৃথিবীর সৌন্দর্য উপভোগ করতে ও অজানাকে জানতে। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২০ এবং ২১ তারিখ শুক্র ও শনিবার দুই দিনে আমি আমার স্কুল জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু (পিপলু) ও তার একজন সহকর্মী (আজাদ) মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম মেঘালয় ঘুরতে যাবো। যেহেতু আমাদের তিন জনেরই আগে থেকেই ইন্ডিয়ান ভিসায় ডাউকি পোর্ট এড করা ছিলো। তাই মাত্র এক সপ্তাহের সিদ্ধান্ত আমরা ট্রাভেল টেক্স, ডলার এনডোর্সমেন্ট করাসহ প্রয়োজনীয় কাজকর্ম শেষ করে ভ্রমণের প্রস্তুতি নিয়েছি। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা আমাদের এই ভ্রমণের রির্টান পরিবহন ব্যবস্থাপনা বিশেষ করে সিলেট থেকে তামাবিল বর্ডার যাওয়া-আসার মাইক্রোবাস ও ডাউকি বর্ডার থেকে মেঘালয়ে দুই দিন বেড়ানোর প্রাইভেটকার আগে থেকেই আমাদের স্কুল জীবনের আরেক বন্ধু ও সিলেটের বাসিন্দা জুলহাসের মাধ্যমে ঠিক করে রেখেছিলাম।
পরিকল্পনামত আমরা ১৯ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ৫০ মিনিটে এনা পরিবহনের ভলবো বাসে রওনা করলাম মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে। পিপলু যেহেতু উত্তরা থাকে তাই সে উঠলো উত্তরা থেকে। আর পিপলুর সহকর্মী আজাদ অফিসের কাজে আশুগঞ্জ ছিলেন বিধায়, উনি বৃহস্পতিবার বিকেলেই সিলেট গিয়ে রাতে হোটেলে ছিলেন। আমরা ভোর ছ’টায় পৌঁছে গেলাম সিলেট বাস টার্মিনালে। সেখান থেকে একটা সিএনজিচালিত অটো যোগে আমরা চলে আসলাম নুরজাহান হোটেলে যেখানে আজাদ উঠেছে। আজাদ আগে থেকেই হোটেলে থাকায় আমার আর পিপলুর জন্য ভালোই হয়েছে, এসে ভালোভাবে ফ্রেশ হতে পারলাম। এর মধ্যে মাইক্রোবাসের ড্রাইভার সাহেব হোটেলের সামনে এসে ফোন দিয়ে জানালো তিনি হাজির। এই ড্রাইভার সাহেব আমাদের আজ তামাবিল বর্ডারে নিয়ে যাবে এবং আগামীকাল বিকেলে তামাবিল থেকে সিলেটে ফিরিয়ে আনবে। আমরা হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে সকালের নাস্তা করার জন্য চলে আসলাম সিলেটের বিখ্যাত পানসী রেস্টুরেন্টে। এই সকালে পানসীতে কানায় কানায় পূর্ণ মানুষজন। বেশির ভাগই হচ্ছে সিলেটে বেড়াতে আসা পর্যটক। নাস্তা সেরে আমরা রওনা করলাম তামাবিল বর্ডারের উদ্দেশ্যে। সিলেট শহর থেকে ৫৪ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত তামাবিল বর্ডার। পথে চলতে চলতে ভোরের কোমল প্রকৃতি, চা বাগান, কাজে বের হওয়া মানষের আনাগোনা দেখতে দেখতে আমরা সোয়া নয়টার সময় পৌঁছে গেলাম তামাবিল স্থলবন্দরে। পৌঁছে দেখি মেঘালয়গামী অনেক বাংলাদেশি টুরিস্ট। এখানে উল্লেখ্য তামাবিল ও ডাউকি বর্ডারে ইমিগ্রেশন কর্ম চলে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত।
মেঘালয়
গাড়ি থেকে নেমে ফরম সংগ্রহ করে ইমিগ্রেশনের জন্য লাইনে দাঁড়ালাম। মিনিট পনেরোর মধ্যে ইমিগ্রেশন শেষ করে কাস্টমস ক্লিয়ারেসের জন্য আবার লাইনে দাঁড়ালাম। তামাবিল স্থলবন্দরে কাস্টমসের কার্যক্রম ম্যানুয়াল, লাইন খুব ধীরে এগুচ্ছিলো। এর মধ্যে মেঘালয়ের ড্রাইভার আলিম মজুমদার হোয়াটসঅ্যাপে কল করে জানালো সে ডাউকি ইমিগ্রেশন অফিসের পাশে গাড়ি পার্কিং করে দাঁড়িয়ে আছে। আমরা কাস্টমস শেষে বিজিবি চেক শেষে পায়ে হেঁটে ডাউকি প্রবেশ করে প্রথমে বিএসএফ চেক সেরে চলে গেলাম ইন্ডিয়ান ইমিগ্রেশন অফিসে। সেখানকার কার্যক্রমও ম্যানুয়াল। বেশ সময় নিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করে আমাদের নির্ধারিত গাড়িতে উঠে রওনা করলাম। ড্রাইভার আলিম মজুমদার খুব আন্তরিক ও চমৎকার মানুষ। তার বাসা শিলং শহরে, সে বাংলা, হিন্দি, খাসিয়া, আসামীয়, ইংরেজি ভাষায় কথা বলতে পারে। সে আমাদেরকে সব বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতো এবং পুরো দুদিন আন্তরিকতা ও আনন্দের সাথে ঘুরালো। আমি তার ফোন নম্বর (+৯১৯৪৮৫১৬৪৯৩৯) দিয়ে দিলাম। এখানে উল্লেখ্য, যারা শেয়ার জিপে করে ঘুরতে যান তাদের ডাউকি বর্ডার থেকে প্রায় এক কিলোমিটার পায়ে হেঁটে এসে জিপস্ট্যান্ড থেকে গাড়িতে উঠতে হয়।
মেঘের রাজ্য মেঘালয়। বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা উত্তর-পূর্ব ভারতের একটি প্রদেশ। এই রাজ্যের উত্তর ও পূর্ব দিকে আসাম রাজ্য এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম দিকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র অবস্থিত। মেঘালয় উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার রাজ্যগুলির অন্যতম। শিলং হচ্ছে তার রাজধানী। শিলংকে বলা হয় প্রাচ্যের স্কটল্যান্ড। সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে ৪৯০৮ ফুট উচ্চতায় শিলংয়ের অবস্থান। খাসিয়া এবং গারো প্রধানত এই দুই জনগোষ্ঠীর বসবাস এই রাজ্যে। মেঘালয় ভারতের তিনটি খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের মধ্যে একটি। রাজ্যের ৭৫% মানুষ খ্রিস্টধর্মের অনুগামী। বেশিরভাগ খ্রিস্টান হওয়ায় তারা গরু শূকর সবই খায়। খাসিয়া ভাষা ও গারো ভাষা এই রাজ্যের প্রধান দুই প্রচলিত ভাষা। তবে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে ইংরেজির প্রচলনও রয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল এলাকা চেরাপুঞ্জির অবস্থান এই রাজ্যে। রয়েছে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিননং। মেঘালয়ে অনেক নদী রয়েছে, এদের অধিকাংশই বৃষ্টি নির্ভর ও মৌসুমী। মেঘালয়ের মোট জেলার সংখ্যা ১১টি। পুরো মেঘালয় রাজ্যজুড়ে অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যা ভ্রমণ পিপাসুদের পছন্দের তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। পর্বত সংকুল হওয়ায় এই রাজ্যে কমিউনিটি বেইজড ট্যুরিজম গড়ে উঠেছে।
ডাউকি বাজারে এসে গাড়ি থামলো। ডাউকি বাজার সীমন্তবর্তী একটি ছোট বাজার, বিভিন্ন দোকানে মোটামুটি সব জিনিসের সমাগম আছে। মানি এক্সচেঞ্জ সংখ্যায় কম এবং সাধারণ মুদি দোকানেও এক্সচেঞ্জ করা যায়, এখানে বাংলা টাকার রেট ডলারের চেয়ে ভালো। আমরা দরাদরি করে টাকা এক্সচেঞ্জ করে নিয়ে কিছু প্যাকেটজাত খাবার, জুস কিনে নিয়ে রওনা হলাম। কিছুদূর এগোতেই আমরা চলে আসলাম ডাউকি ব্রিজের ধারে। যেটা আমরা জাফলং থেকে দেখতে পাই। নিচে প্রবাহমান ডাউকি নদীর স্বচ্ছ পানির উপর দুই পাহাড়ের সংযোগ স্থাপনকারী ব্রিজটি দেখতে ভালোই লাগে। এই ব্রিজ পার হয়েই সকল গাড়ি শিলং-চেরাপুঞ্জি অভিমুখে যায়। ড্রাইভার আলিম ভালো ছবি তুলতে পারে। তাকে দিয়েই আমাদের ছবি তোলার কাজ সারলাম। পাহাড়ের নিচে নদীর দুই ধারে খাসিয়া সম্প্রদায়ের লোকজন বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে, অনেকে আবার নৌকায় করে পর্যটকদের নদীতে ঘুরাচ্ছে। কিছুক্ষণ ওখানে সময় কাটিয়ে আমরা রওনা করলাম পরবর্তী গন্তব্যে উমক্রেম ফলসের দিকে।
পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয়
পাহাড়ি রাজ্য মেঘালয় জুড়ে দেখা মেলে অজস্র ঝর্ণা। উমক্রেম ফলস, বোরহিল ফলস, ক্রাংসুরি ফলস, নোকালিকাই ফলস, সেভেন সির্স্টাস ফলস, এলিফেন্ট ফলস, সুইট ফলস, রেংথিয়াম ফলস, স্প্রেড ঈগল ফলস, বিশপ ফলস ও বিডেন ফলস সহ অসংখ্য ঝর্ণা রয়েছে। চলতি পথে নাম না জানা অনেক ঝর্ণা চোখে পড়বে। সবগুলো ঝর্ণা দেখতে গেলে কয়েকদিন সময় লেগে যাবে। আমরা এখন পর্যায়ক্রমে এই দুই ঝর্ণা দেখতে যাবো, এই দুটির অবস্থান একই পথে। বেশ কিছু পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম উমক্রেম ফলসের ধারে। পাহাড়ি স্বচ্ছ জলরাশির নয়নাভিরাম একটি ঝর্ণা। কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে ছবি তুলে এবার রওনা করলাম বোরহিল অভিমুখে। এই পুরো পথটাই বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ের ভাঁজে। একপাশে ভারতের মেঘালয় রাজ্যেও পাহাড় অন্যপাশে বাংলাদেশের সমতলভূমি, মাঝে মাঝে কাঁটাতারের বেড়া, কিছুদূর পরপর বিএসএফ সীমান্ত ফাঁড়ি পাড়ি দিয়ে এগিয়ে চলছে আমাদের বহনকারী টাটা অল্টো মিনি কার। বেশি কিছু সময় পর আমরা এসে পড়েছি বোরহিল ফলসের কাছে, যেটা বাংলাদেশের পাংতুমাই গ্রাম থেকে দেখা যায়। গাড়ি থেকে নেমে ঝর্ণার দিকে তাকাতেই আমাদের চোখ ছানাবড়া। বিশাল বিশাল কালচে রঙের পাথরের উপর বেয়ে পড়ছে পাহাড়ি সাদা জলারাশি। দেখে মনে হচ্ছে এযেনো দুগ্ধ ধারা বেয়ে পড়ছে। একটি বেইলি ব্রিজের নিচ দিয়ে গড়িয়ে জলধারা এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের দিকে। অসাধারণ সুন্দর একটি ঝর্ণা দেখে মনে প্রশান্তি এলো। কিছুক্ষণ সেখানে অবস্থান করে ছবি তুলে আবার আমাদের যাত্রা শুরু হলো। এবারের গন্তব্য লিভিং রুট ব্রিজ ও এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিননং।
কিছু পথ এগিয়ে আমাদের গাড়ি বাঁক নিয়ে উঠে গেলো পাহাড়ি রাস্তা ধরে ভিতরের দিকে। দীর্ঘ পথ চলতে চলতে একসময় চোখে ঘুম এসে গেলো। ঘুম ভাঙার পর দেখি উঁচু-নিচু ছায়াঘেরা পথ ধরে এগিয়ে চলছে আমাদের বাহন। দুপাশে বৃক্ষরাজি আর পাখ-পাখালির ডাক। মাঝে মাঝে দেখা মেলে পাহাড়ি লোকালয়ের ঘরবাড়ি আর মানুষজন, স্থানীয়দের বাজার, দোকান। খুব ভালো লাগা একই বিষয় লক্ষ্য করলাম কিছু দূর পরপর রাস্তার ধারে ও মোড়ে মোড়ে দেখা মেলে বাঁশের তৈরি ময়লার ঝুঁড়ি বা ডাস্টবিন। পুরো মেঘালয় জুড়ে রাস্তার পাশে কোথাও কোনো চিপসের প্যাকেট, পানি-জুসের বোতল, ছেঁড়া কাগজ বা দৃশ্যদূষণ সৃষ্টিকারী কোনো ময়লা আবর্জনা দেখিনি। যেতে যেতে কথা হচ্ছিলো ড্রাইভার আলিম মজুমদারের সাথে জানালো, তার বাড়ি আসাম। স্ত্রী সন্তান নিয়ে থাকেন শিলংয়ে। তারা স্ত্রী শিলংয়ে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। বাংলাদেশের সিলেটে তাদের আত্মীয়-স্বজন আছে। তাদের সাথে যোগাযোগ ও নিয়মিত আসা-যাওয়া রয়েছে। আমাদের বন্ধু জুলহাসের সাথে কিভাবে সম্পর্ক জিজ্ঞাসা করতেই জানালো, জুলহাস ভাই অনেকবার শিলং এসেছেন, প্রথমবার পরিচয় থেকেই প্রতিবারই উনি আসলে আমাকে আগেই ফোন দিয়ে জানায়। আমি ডাউকি বর্ডারে এসে উনাকে নিয়ে ঘুরাই, যে কদিনই থাকেন সবসময় উনার সাথে আমাকে রাখেন। অন্যরকম একটা আন্তরিকতার সম্পর্ক যা আত্মীয়তার চেয়ে বেশি। জুলহাস ভাই কিছু বললে আমি ফেলতে পারি না। উনার পরিচিত যে কেউ আসলেই আমাকে আগেই ফোন করে জানিয়ে দেন। উনার কথামত আমি সবাইকে সেবা দিয়ে যাই।
পাহাড়ি পথ
গল্প করতে করতে দীর্ঘ পাহাড়ি পথ পাড়ি দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম রিওয়াই গ্রামে। লিভিং রুট ব্রিজ নামে পরিচিত সেতুটি দেখার জন্য ছবির মত সাজানো গোছানো রিওয়াই গ্রামের রাস্তা ধরে এগিয়ে যেতে হবে। শিলং থেকে প্রায় ৯০ কিলোমটার দূরে রিওয়াই গ্রাম। গ্রামের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে রাস্তা ধরে হাঁটলেই পেয়ে যাবেন সাইনবোর্ডে লেখা নির্দেশনা। সেই অনুযায়ী হেঁটে যেতে যেতে পাহাড়ি সিঁড়ি খুঁজে পাবেন। সেই সিঁড়ি ধরে বেশ কিছু দূর ট্রেকিং করে নামার পরই চোখ আটকে যাবে আশ্চর্য এই সেতুতে। এখানকার এন্ট্রি ফি ৪০ রুপি। গ্রামের পাহাড়ি নদী থাইলং এর উপরে প্রাকৃতিক ভাবে গাছের শেকড়ে তৈরি সাঁকোটি দেখতে প্রতিদিনই ভিড় জমান অসংখ্য পর্যটক। বিশাল দুটি গাছের শেকড় জড়াজড়ি করে আছে ঝিরির উপরে। একটু একটু করে বেড়ে প্রাকৃতিক সেতু তৈরি করেছে গাছ দুটি। সেই সেতুর উপর দিয়ে অনায়াসে পার হয়ে যেতে পারবেন। ঝিরির পাশে থাকা বিশাল পাথরের উপর বসে গাছের সঙ্গে গাছের শেকড় দিয়ে তৈরি অভূতপূর্ব এই সেতু। ব্রিজে উপর দাঁড়াতে দেওয়া হয় না এটির যথাযথ সংরক্ষণের খাতিরে। সেতুর নিচ দিয়ে কুলকুল শব্দে বয়ে চলেছে পাহাড়ি নদী থাইলং। ব্রিজের উপর দাঁড়াতে না পারলেও নদীর পাড়ে বসে কিংবা পাহাড়ের উপর থেকে এর সৌন্দর্য দেখতে পারবেন ইচ্ছেমতো। লিভিং রুট ব্রিজের নিচের পাহাড়ি নদীর হিমশীতল পানিতে পা ভিজিয়ে বেশ কিছু সময় কাটিয়ে ফিরে আসার সময় পথের পাশের স্থানীয়দের দোকান থেকে তাজা পাহাড়ি সুস্বাদু ফল আনারস, জাম্বুরা, পেঁপে কিনে তিনজনে মিলে খেলাম। এই গ্রামটি পরিষ্কার গুছানো ও সুন্দর। এখানকার সব গ্রামেই পর্যটকদের জন্য রয়েছে হোমস্টে ব্যবস্থা, কয়েক জায়গায় দেখলাম বড় বড় গাছের ডালে বাঁশ-কাঠ দিয়ে মাচাং টাইপের ঘর বানিয়ে পর্যটকদের থাকার জন্য আকৃষ্ট করা হয়, সেগুলোতে উঠার জন্যও তারা বাঁশ-কাঠ দিয়ে সিঁড়ি বানিয়ে রাখা হয়েছে। সহজ কথায় বলা যায় পরিবেশ বান্ধব পর্যটন। সেখানে ঘুরেফিরে গাড়িতে উঠলাম, এবার আমাদের মাওলিননং গ্রামে যাবার পালা।
মিনিট পাঁচেক গাড়ি চালিয়েই আমার পৌঁছে গেলাম এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিননং। ৫০ রুপি জনপ্রতি এন্ট্রি ফি দিয়ে টিকেট করলাম। প্রথম দর্শনেই গ্রামটি আমাদের খুবই ভালো লেগে যায়। সবুজে সবুজে আচ্ছাদিত চারপাশ। কোথাও লতাবৃক্ষ, কোথাও পাতাবাহার, কোথাও রঙিন ফুলের গাছ। ঝকঝক করছে রাস্তাঘাট। একবিন্দু ময়লা পড়ে নেই কোথাও। এতই পরিচ্ছন্ন এখানকার রাস্তায় জুতা পায়ে হাঁটতেও মায়া লাগে। বলছিলাম এশিয়ার সবচেয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গ্রাম মাওলিননং এর কথা। শিলং শহর থেকে ৯০ কিলোমিটার দূরে খাসিয়া সম্প্রদায়ের নিবাস মাওলিননং গ্রামটি। পূর্ব খাসি পাহাড়ের এ মাওলিননং গ্রামকে বলা হয়, ‘সৃষ্টিকর্তার নিজস্ব বাগান’। ২০০৩ সালে এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করা হয় মাওলিননংকে। গ্রামের মানুষেরাই সমিতির মাধ্যমে এটিকে অনুকরনীয় গ্রামে পরিণত করেছেন, যেখানে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের ব্যবস্থা রয়েছে। সকলের চেষ্টায় ছবির মতো গ্রামটি তৈরি সম্ভব হয়েছে। এখানকার সব বাড়িই ঘিরে রেখেছে সবুজ। কোথাও কোথাও পর্যটকদের জন্য বসেছে ছোট দোকান। এখানে স্থানীয় অধিবাসীদের হাতে তৈরি বিভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। গ্রামে পাহাড়ি শিলাখন্ডও চোখে পড়ে, যেগুলো একটির ওপর আরেকটি গায়ে গায়ে লেগে আছে। গ্রামটি পাহাড়ের ওপর থেকে ঢাল বেয়ে বেয়ে নিচে নেমে গেছে। গ্রামের পথ পাহাড় বেয়ে ওঠা-নামা করেছে। পথের ধারে বাঁশের তৈরি ডাস্টবিন রয়েছে। পাহাড় বেয়ে ওঠা-নামার সময় বাঁশের মাচায় একটু জিরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। সেখানে চা’য়ে চুমুক দেওয়া যায়। সঙ্গে বিস্কুট বা হালকা নাস্তাও জুটবে। এ গ্রামে শিক্ষার হার শতভাগ। সর্বত্র রয়েছে স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটেশন ব্যবস্থা। আর পর্যটকদের সেবা দিতে অভিজ্ঞ ছেলে-যুবক-বৃদ্ধ সকলেই কাজ চালিয়ে যাওয়ার মতো ইংরেজিতেও দক্ষ। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার জানালেন, এই গ্রামে প্রতিদিনই আসেন অসংখ্য পর্যটক। মাওলিননংয়ে পর্যটকদের জন্য রয়েছে হোমস্টে সুবিধাও। সাধারণত ইউরোপীয়ানরা এখানে এসে বেশ কিছু দিন থাকে। হয়তো নিরিবিলি এ সবুজ প্রকৃতিতে একটুখানি শান্তি ও নিজেকে খুঁজে পেতে। গ্রামের একটা হোটেলে লাঞ্চ সারলাম। এবার আমাদের গন্তব্য শিলং।
মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকা
মেঘালয় ভ্রমণের অন্যতম আনন্দময় অভিজ্ঞতা হলো এখানকার সড়কপথে ভ্রমণ। মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশের সাথে সাথেই আবহাওয়ারও পরিবর্তনও লক্ষ্য করলাম। এই গরমেও তখন শীত লাগে। ঠান্ডা শীতল আবহাওয়া চলার পথের ক্লান্তি দূর করে দেয়। মেঘ আচ্ছাদিত পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ ধরে চলতে চলতে যাওয়া যায় একস্থান থেকে অন্য স্থানে। হুট করে ছুটে আসা মেঘ কখন যে জড়িয়ে ধরে টেরই পাওয়া যায় না। আবার এক হাত দূরেই গেলেই মনে হয় মেঘের লেশমাত্র নেই। চলতি পথে দেখা মেলে অসংখ্য ঝর্ণা। মেঘালয়ের পাহাড়গুলো যেনো এক একটা ঝরনার খনি। পাহাড়ের আনাচে কানাচে লুকিয়ে থাকে উন্মাতাল সব ঝর্ণা। আবার বৃষ্টির কারণেও অনেক সময় অস্থায়ী সব ঝরনার জন্ম হয় এখানে। মেঘালয়ের বিশাল সব পাহাড়ের সৌন্দর্য তো রয়েছেই। পুরো মেঘালয়টা যেন সারিসারি পাইন গাছের স্বর্গ বাগান। চলতি পথের সৌন্দর্যের কারণে আনমনে মেঘালয়কে ভালোবাসে ফেলা যায়। সে এক অন্য রকম অনুভূতি। শিলং শহরে প্রবেশের কিছু আগে রয়েছে ভারতীয় বিমান বহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সদর দফতর ও ক্যান্টনমেন্ট এরিয়া।
শেষ বিকেলে আমরা শিলং এসে পৌঁছালাম। শিলং এসে প্রথমে হোটেল ঠিক করলাম। আমাদের হোটেলের নাম হোটেল ইডেন রেসিডেন্সি, তিনটি সিঙ্গেল বেডের একটা রুমের ভাড়া চাইলো ৩০০০ রুপি ব্রেকফাস্টসহ। ওরা ব্রেকফাস্ট পরিবেশন করে সকাল ৮টার সময়, আইটেম হচ্ছে পরোটা ডিম ডাল। যেহেতু আমরা সকাল ৭টার আগেই হোটেল থেকে চেকআউট করবো তাই দরদাম করে ব্রেকফাস্ট ছাড়া ২০০০ রুপিতে ঠিক করলাম। শিলং সেন্টার পয়েন্টের ঠিক পিছনে ৫/৬টা বিল্ডিং পরে এর অবস্থান। ভালো মানের পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুন্দর পরিপাটি রুম। রুমে রয়েছে তিনজনের জন্য তিনটা টাওয়েল, ক্যাবল টিভি, ইলেক্ট্রিক কেটলি, টি-ব্যাগ, বাথরুমে গিজার, সাবান। ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিলাম। তারপর একটু ঘুরাঘুরি, কিছু শপিং ও রাতের খাবার খাওয়ার জন্য বের হলাম। কারণ রাত ৯টার মধ্যে মোটামুটি ৯৯% দোকান বন্ধ হয়ে যাবে। রাতে বেশ ঠান্ডা পড়ে এখানে। আমরা পুলিশ বাজার ঘুরে কিছু কেনাকাটা করে চলে আসলাম পুলিশ বাজার মসজিদ সংলগ্ন সাভেরা হোটেলে, এটি মূলত একটি মুসলিম রেস্টুরেন্ট। রাতের খাবার খেয়ে আরও কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে আমরা পৌনে দশটার দিকে হোটেলে ফিরলাম। কিছুক্ষণ আড্ডা-গল্প করে ঘুমিয়ে পড়লাম এগারোটার দিকে, কারণ আমাদেরকে সকাল ৬টার মধ্যে উঠতে হবে।
ভোর ছটায় মোবাইল এলার্মে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে আমাদের ব্যাগ গোছাতে শুরু করলাম। সাড়ে ছয়টায় ড্রাইভার আলিম মজুমদার ফোন দিয়ে জানালো সে হাজির। আমরা সাতটার কিছু আগে চেকআউট করে সেন্টার পয়েন্ট মোড়ে পার্কিং করে রাখা আমাদের গাড়িতে ব্যাগগুলো রেখে রাস্তার পাশে একটা স্ট্রিট ফুডের দোকান থেকে রুটি ডাল ডিম চা দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারলাম। সকালের ঠান্ডায় রোদে দাঁড়িয়ে ব্রেকফাস্ট করতে ভালোই লাগলো। এখন আমাদের আবার ভ্রমণ শুরুর পালা, গন্তব্য এলিফ্যান্ট ফলস। পথে যেতে যেতে আলিম মজুমদার শহরের বিভিন্ন এলাকাগুলোকে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকলো। বিশাল বিশাল পাইন গাছের সারি দেখে মন ভুলিয়ে যায়। কৈশোরে পাইন গাছ সম্পর্কে বেশি পড়েছি সম্ভবত মাসুদরানা সিরিজে। চারপাশের প্রকৃতি দেখতে দেখতে একসময় আমাদের গাড়ি চলে আসলো এলিফ্যান্ট ফলসের পার্কিয়ে। গাড়ি থেকে নেমে জনপ্রতি ২০ রুপির এন্ট্রি টিকেট নিয়ে প্রবেশ করলাম গেট দিয়ে। এখানে অনেকখানি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। তিন ধাপে এই ফলসের তিনরকমের সৌন্দর্য দেখা যায়। সেখানে নামতে নামতে এলিফেন্ট ফলসসহ নরেন্দ্র মোদির একটা বিশাল ছবি দেখতে পেলাম। সেখানকার একজন থেকে জানলাম কিছুদিন আগে তিনি মেঘালয় সফরে এসে এলিফেন্ট ফলস দেখতে এসেছিলেন। খুবই সুন্দর চাওড়া একটা ঝর্ণা। আমরা কিছুক্ষণ সেখানে থেকে ছবি তুলে ফিরে এলাম গাড়িতে। এবারের গন্তব্য পৃথিবীর সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল স্থান চেরাপুঞ্জি।
ঝর্ণা
মেঘালয়ের পাহাড়গুলো পাথর, চুনাপাথর, জিপসাম, কয়লা ইত্যাদি প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর। স্থানীয়দের বাড়িঘরগুলো খুব সুন্দর। প্রত্যেকটা লোকালয় পরিচ্ছন্ন। রাস্তার পাশ দিয়ে উঁচুনিচু পাহাড়ি পথ বেয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের স্কুলে যাওয়ার দৃশ্য মনকে উৎফুল্ল করে তুলবে। বৃষ্টি হলে পাহাড়ি আঁকাবাঁকা ছড়াগুলো স্বচ্ছজলে টইটুম্বর হয়ে ছুটে চলে। পথে দেখা যায় পাহাড়ি লোমশ কুকুর, সর্বত্র সাইনবোর্ডে লেখা আছে এদের বিরক্ত বা ক্ষতি না করতে, কুকুরগুলোও কারো কোন ক্ষতি করে না। চলতে চলতে আমরা এসে গেলাম ডুয়ান সিং সাইয়েম ব্রিজ যা একটি ঝুলন্ত লোহার ব্রিজ ও ডুয়ান সিং সাইয়েম ভিউ পয়েন্ট। ড্রাইভার আলিম জানালেন, ডুয়ান সিং সাইয়েম ব্রিজটি স্থানীয়দের কাছে কোরবানি ব্রিজ নামেও পরিচিত। কারণ, বলিউডের প্রয়াত অভিনেতা ফিরোজ খানের কোরবানি সিনেমাটির শুটিং হয়েছিলো এই ব্রিজে। তারপর থেকে স্থানীয়দের কাছে এটি কোরবানি ব্রিজ। এখানে বেশকয়েকটি দোকান আছে। পাশেই রয়েছে জিপ লাইন করার ব্যবস্থা। এখন থেকে মেঘালয়ের পাহাড়গুলোর সুন্দর ভিউ দেখা যায়। আমরা গাড়ি থেকে কিছুক্ষণ অবস্থান করে কয়েকটি ছবি তুলে আবার চলতে শুরু করলাম।
উঁচুনিচু পাহাড়ি পথের দুধারের মনোরম প্রকৃতি, ঝর্ণা, ছোট ছোট গ্রাম, সবুজ উপত্যকা, খন্ড খন্ড কৃষিজমি, পাইন গাছের ছায়া, নাসপাতি-কমলালেবুর বাগান, চুনাপাথরের গুহা, বৃক্ষরাজি, দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম চেরাপুঞ্জি। শহরে ঢোকার একটু আগেই পড়বে ওয়াকাবা ফলস। পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা সরু জলধারা হারিয়ে গেছে নিচে। চারিদিক উন্মুক্ত। দূরে দেখা যায় শুধু পাহাড়ের সারি। নিচের দিকে তাকালে দেখা যায় না ঝর্নার প্রবাহপথ।
শিলং থেকে ৫৬ কিলোমিটার দূরে বিশ্বের সর্বাধিক বৃষ্টিপাতের স্থান চেরাপুঞ্জি। ছোট্ট শহর চেরাপুঞ্জির আরেক নাম সোহরা। চেরাপুঞ্জিতে দু-একটি অত্যাধুনিক সহ বেশিকিছু হোটেল রির্সোট গড়ে উঠেছে। বিস্ময়কর সেভেন সিস্টার্স ফলস এখানকার অন্যতম আকর্ষণ। রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় পুরো সেভেন সিস্টার্স ফলস দেখা যায়। ঝর্ণায় পানি ধারা একদম কম। ড্রাইভার আলিম জানালো, গত দুইদিন বৃষ্টি না হওয়ায় ফলে ঝর্ণার পানি কম। বৃষ্টিতে এটি পূর্ণতা পায়। একটি পাহাড়ের উপর থেকে পাশাপাশি সাতটি আলাদা ধারা। আমার দেখা আরেকটি সেভেন সিস্টার্স ফলস রয়েছে সিকিমে, সেটা অবশ্য একটা ধারা একটা পাহাড়ের উপর থেকে সাতটা ধাপে নিচে পড়ে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে নামা এসব ঝরনার উপরেও চলে যাওয়া যায় ইকো পার্কের ভিতর দিয়ে। সেখানে রয়েছে প্রাকৃতিকভাবে গাছের শেকড়ে সৃষ্টি একটি ডাবল ডেকার ন্যাচারাল রুট ব্রিজ। তবে এখানে যেতে হলে অনেকটা পথ পায়ে হেঁটে যেতে হবে। সেক্ষেত্রে একদিন সময় শুধু রাখতে হবে এই সেতু দেখার জন্য। যদিও আমরা সময় স্বল্পতার কারণে সেখানে যাইনি। চেরাপুঞ্জিতে রয়েছে একটি রামকৃষ্ণ মিশন ও মিশন পরিচালিত স্কুল, মন্দির ও নৃতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। আমরা সেখানেও যায়নি। চেরাপুঞ্জিতে রয়েছে ১৮৪০ সালে স্থাপিত সুন্দর একটি প্রেসবিটারিয়ান চার্চ, এটির অবস্থান চলতি পথে রাস্তার ধারে। এটি মেঘালয়ের সবচেয়ে পুরোনো চার্চ। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য প্রয়োজনীয় ছাতা বা রেইনকোট সাথে রাখা ভালো। এখানে বৃষ্টি বলে কয়ে আসে না, হঠাৎ শুরু হয় যায় ঝুম বৃষ্টি।
চেরাপুঞ্জির নিকটের একটি অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হল মাউসমাই কেভ। আমাদের দেশের অনেক পর্যটক একে মৌসুমী কেভ বলে থাকেন। এটি লাইমস্টোন বা চুনাপাথর শক্ত হয়ে এবং প্রাকৃতিক ভাবে সৃষ্ট একটি গুহা। এক আরণ্যক পরিবেশে এই প্রাকৃতিক গুহায় প্রবেশের অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে রোমাঞ্চকর। এই গুহায় এন্ট্রি ফি জনপ্রতি ২০ রুপি। গুহার ভিতরে বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা আছে। আগে পর্যটকেরা টর্চ ও গাইডের সাহায্যে এই গুহায় প্রবেশ করতেন। এখন আলোর ব্যবস্থা থাকায় আর সে প্রয়োজন হয় না। কখনও বসে, কখনও সরু ফাঁকের মধ্যে দিয়ে শরীরকে গলিয়ে এগিয়ে যেতে হয়। গুহার ভিতরে প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্টি হয়েছে নানা আকৃতি। গুহার এক মুখ দিয়ে প্রবেশ করে রোমাঞ্চের স্বাদ নিয়ে আর এক মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলাম। সেখানেই আমরা একটা রেস্টুরেন্টে হালকা নাস্তা করে রওনা দিলাম।
পরবর্তী গন্তব্য নোহকালিকাই ফলস। এখানে এন্ট্রি ফি ২০ রুপি। প্রায় ১০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের মাথা থেকে অনেক নিচে সটান আছড়ে পড়ছে ঝর্ণার জল। বিশাল উন্মুুক্ত অঞ্চল। বিস্তীর্ণ স্থান জুড়ে পাহাড়ের পাথুরে শরীরটার মাথাটা সবুজ চাদরে ঢাকা। অনেক নিচে সৃষ্টি হয়েছে ছোট জলাশয়। স্নিগ্ধ নীল তার রং। হাজার সিঁড়ি বেয়ে নেমে যাওয়া যায় জলাশয়ের কাছে। বর্ষায় ঝর্ণাটি জলরাশিতে ভরপুর হয়ে ওঠে। নোহকালিকাই ফলসের কাছেই আছে বাংলাদেশ ভিউ পয়েন্ট। পরিষ্কার আবহাওয়ায় দেখা যায় বাংলাদেশ। স্বল্প সময় অবস্থান করে আবার যাত্রা শুরু। এখানে চলার পথে দূর পাহাড়ের গায়ে দেখা মেলে অসংখ্য খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী কবরস্থানের।
এবার আমরা ফিরব ডাউকির উদ্দেশ্যে, সময় পেলে আমরা সোনেঙ পেডেঙ দেখতে যাবো। আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে পাহাড়ি উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা পথ ধরে। আমার দৃষ্টিতে মেঘালয় ভারতের অন্যতম পরিচ্ছন্ন একটা রাজ্য। সুন্দর প্রকৃতি এবং পরিচ্ছন্ন লোকালয়, রাস্তাঘাট সহজকথায় পর্যটনবান্ধব একটা সুন্দর পরিবেশ। ইউরোপ আমেরিকার অনেক পর্যটক সেখান বেড়াতে আসে। চলতে চলতে আমরা এসে গেলাম নংলিম নামক একটা খুব সুন্দর স্থানে। এটা মাওম্যার্সিয়াং থেকে লাইলংকট যাওয়ার একটা বাইপাস রোডের মাঝামাঝি খুব সুন্দর একটা স্থান। স্থানটির দুপাশের পাহাড়ের গায়ে সারি সারি পাইন গাছের বাগান। মাঝখান দিয়ে বেয়ে চলা একটা পাহাড়ি স্বচ্ছ পানির ছড়া। একটা জায়গায় কৃত্রিম ভাবে বাঁধ দিয়ে ছোট্ট একটা ঝর্ণার মতো তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু বোঝাই যায় না এখানে কোনো কৃত্রিমতা রয়েছে। অপূর্ব এক দৃশ্য। এই রাস্তাটির দুধারেও পাইন গাছের সমাহার। সেখান কিছুক্ষণ থেকে আমরা আমাদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে পুনরায় যাত্রা শুরু করলাম।
এর মধ্যে মেঘ-বৃষ্টির হানা। পাহাড়ি পথে আমাদের গাড়ির গতি কমে গেলো। সম্মুখের পথ ঠিকমতো দেখা যায় না। মেঘালয়ে এটাই আমাদের প্রথম একসাথে মেঘ-বৃষ্টির দর্শন। অনেকক্ষণ ধরে চললো মেঘ-বৃষ্টির দাপাদাপি, থামলো প্রায় ৪০ মিনিট পর। থামার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আবার রোদ। অদ্ভুদ আবহাওয়া! এর আগে মেঘ-বৃষ্টির দাপাদাপি দেখেছি আমাদের দেশের জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য সাজেকে। কিন্তু এই মেঘ-বৃষ্টির দাপাদাপিতে গাড়ি ধীরে চলায় আমাদের এই ভ্রমণের শেষ ভ্রমণ স্পট সোনেঙ পেডেঙ দেখতে যাওয়া অসম্ভব করে তুলেছে। আমরা জাফলং থেকে যে নদীটা দেখি তার ভিতরের অংশ হলো সোনেঙ পেডেঙ। ওই অংশে নদীটির পানি খুবই স্বচ্ছ এবং উপর থেকে স্পষ্টভাবে নদীর তল দেখা যায়। কিন্তু সময়ের স্বল্পতার কারণে সেখানে যাওয়া হয়নি। বিকাল সাড়ে তিনটার দিকে আমরা পৌছালাম ডাউকি বাজার। ডাউকি বাজার থেকে কিছু শপিং করে এবং ইন্ডিয়ান রুপিগুলো এক্সচেঞ্জ করে বাংলা টাকা নিয়ে নিলাম। চারটার দিকে ইন্ডিয়ান বর্ডারে ইমিগ্রেশনের কাজ শেষ করে সোয়া চারটার দিকে বাংলাদেশে প্রবেশ করলাম। ফিরতি পথে দুদেশের ইমিগ্রেশন অফিসেই ভিড় ছিল না।
যেহেতু আমাদের ভ্রমণ ছিল দুই দিনের, তাই সময় স্বল্পতার কারণে এ যাত্রায় দেখা হয়নি লেডি হায়দারি পার্ক, ওয়ার্ডস লেক, ডন বসকো মিউজিয়াম, চেরাপঞ্জিরইকো পার্ক, সোনেঙ পেডেঙ। যদি আরেকদিন বেড়ানো যেতো তাইলে এই স্থানগুলো ঘুরে আসতে পারতাম। ভবিষ্যতে যদি আবার যাওয়া হয় তাহলে ওই স্পটগুলো দেখে আসবো। আমাদের নেয়ার জন্য মাইক্রোবাস নিয়ে তামাবিলে হাজির ড্রাইভার। সন্ধ্যার কিছুসময় আগে আমরা চলে এলাম হযরত শাহজালাল (র.) দরগায়। সেখানে মাগরিবের নামাজ আদায় করে ও মাজার জিয়ারত করলাম। এরমধ্যে আমাদের বন্ধু জুলহাস এসে হাজির। এবার ওর সাথে আড্ডা, খাওয়াদাওয়া শেষে আমরা রাতের গাড়িতে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা করলাম। বড় তাড়াতাড়িই শেষ হলো আমাদের এই ভ্রমণ। এবার ঘরে ফেরার পালা। মেঘালয়ের অনন্য সুন্দর মুহূর্তগুলোর জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ।
লেখক: ফ্রিল্যান্স কলামিস্ট ও সদস্য বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স অ্যাসোসিয়েশন