‘ওবায়দুল কাদেরের এক কথায় দেশ পালাইছে, নিচে আগুন লাগাই দিছে, আর সব লুটপাট কইরা নিয়া গেছে। কয়দিন পর আর ইটও খুঁইজা পাওয়া যাইবো না’—অনেকটা ক্ষোভের সঙ্গেই কথাগুলো বলছিলেন মধ্যবয়স্ক (ছদ্মনাম) সাইফুদ্দিন।
গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে অবস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের দরজার কপাট খুলে নিতে দেখে কথাগুলো বলছিলেন তিনি। এর আগে কে বা কারা যেন কার্যালয়টির প্রবেশমুখে ‘সেলিব্রিটি ওয়েডিং’ সৌজন্যে লেখা তিনটি ব্যানার টাঙিয়ে দেয়। বিষয়টি নিয়ে সেলিব্রিটি ওয়েডিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা জনি বার্তা২৪.কমের কাছে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ৫ আগস্ট এরকম প্রায় ১৫টি ব্যানার আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে টাঙিয়ে ছিলাম। পরে হয়তো সেখান থেকে নিয়ে কেউ কার্যালয়টির সামনে টাঙিয়েছে হয়তো।
মূলত টাঙিয়ে দেয়া ব্যানারগুলো দেখতেই লোকজন জড়ো হচ্ছিলেন কার্যালয়টির সামনে। প্রতাপশালী সরকারের এমন অসহায় আত্মসমর্পণ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া নিয়েও করছিলেন বিভিন্ন হাস্যরস। কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সড়ক দিয়ে হেঁটে যেতেও সমস্যায় পড়তে হতো জানিয়ে করছিলেন তির্যক মন্তব্য।
কার্যালয়টির সামনে দিয়ে হেঁটে যাবার সময় উৎসুক জনতা ও ব্যানারগুলো দেখে এগিয়ে আসেন বিল্লাল হোসেন নামের আরও একজন। ব্যানারগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ও কার্যালয়টির এপাশ-ওপাশ দেখে নিয়ে অন্যদের সঙ্গে যোগ দেন কথায়; বিল্লাল বলেন, ‘আহা কত খেলা খেলছে, এখন আল্লাহর মাইর। পুরাটা পুড়ায় নাই কিন্তু মালামাল সব নিয়া গেছে। এরশাদও তো এত মানুষ মারে নাই, দুই জন মরার পরই ক্ষমতা ছাইড়া দিচ্ছিল। এইটা আল্লাহ ছাড়া আর কেউ করে নাই’।
শুধু সাইফুদ্দিন আর বিল্লালই নয়, এই রাস্তা দিয়ে চলাচলের সময় প্রায় সবাই একবার করে তাকাচ্ছিলেন ভবনটির দিকে, কেউ কেউ কৌতূহল নিয়ে যাচ্ছিলেন কাছে, পড়ছিলেন ব্যানারে লেখা শব্দগুলো। কেউবা আবার ফোন বের করে; স্মৃতি মনে করে রাখছেন ছবি তুলে। তবে সবার চোখেমুখেই বিস্ময়, হতাশা আর ক্ষোভের মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
সরেজমিনে শনিবার (৭ সেপ্টেম্বর) দুপুরে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এমন চিত্রের দেখা মেলে। তবে লুটপাট বন্ধ হয়নি এতদিনেও। ৫ আগস্টে আগুন ও তৎপরবর্তী সময়ে ভবনটিতে থাকা সকল মালামাল নিয়ে যাবার পরও বন্ধ হয়নি লুটপাট। এদিনও দেখা মিলে এক লুটপাটকারীর। ভবনের দরজার কপাট খুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন ভ্যানে করে।
এসময় কার্যালয়টির সামনে থাকা এক ফল বিক্রেতার কাছে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাউকে আসতে দেখেন কিনা জানতে চাইলে সেই ফল বিক্রেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ৫ তারিখের পর থেকে এখানে আর কাউকে দেখি না। এখন তো চোর ও লুটপাটকারীরা সব কিছু নিয়ে যাচ্ছে। দেখার কেউ নাই। কিন্তু যে এই ভবন বানাইছে সে জানে যে, সে কতটা কষ্ট করে বানাইছে।
এদিন কার্যালয়টির সামনে থাকা সড়কও হকার ও বিভিন্ন গাড়ির পার্কিং স্থলে পরিণত হতে দেখা যায়। একসময়ের হুংকার উঠানো নেতা ও সরকারি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা সংস্থার অনুপস্থিতিতে পরিত্যক্ত অবস্থা ভবনটির। আগুন লাগানোর ফলে পুড়ে যাওয়া ছাইগুলোও আছে একই জায়গায়। নিচতলার ফ্লোর জুড়ে ছড়িয়ে আছে সে সব ছাই, ছড়ানো ছিটানো আছে ভাঙা কাচের টুকরো।
কার্যালয়টির ঠিক সামনেই পার্কিং করা ছিল বেশ কয়েকটি প্রাইভেটকার। এরপর থেকে মাওলানা ভাসানী জাতীয় হকি স্টেডিয়ামের সামনের সড়ক পর্যন্ত সারি সারি চৌকি বিছিয়ে সড়ক দখল করছেন হকাররা। পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ হকারও। তবে কেউ বলার কিছু নেই। নেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিও। লোকজন হাঁটছেন, যাচ্ছেন গন্তব্যে, পথিমধ্যে একপলক তাকিয়ে দেখছেন এমন ধ্বংসলীলা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ভবনটিকে।
প্রসঙ্গত, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। খবরটি ছড়িয়ে পড়লে ছাত্র-জনতার ক্ষোভ উগড়ে পড়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্থাপনায়। সে ক্ষোভের মাত্রা এতোটাই তীব্র হয় যে, দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়, সভানেত্রীর কার্যালয়, বঙ্গবন্ধু যাদুঘরসহ গণভবনেও করা হয় ভাঙচুর। সেই সঙ্গে দুর্বৃত্তরা লুট করে নিয়ে যায় বিভিন্ন মালামাল, লাগিয়ে দেয় আগুন।
এরপর থেকে দলটির কেন্দ্রীয় পর্যায়ের আর কোন নেতাকে প্রকাশ্যে আসতে দেখা যায়নি। দেশ ছেড়ে পালাতে গিয়ে অনেক মন্ত্রী-এমপি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হয়ে আছেন জেল-হাজতে। বাকিদের কেউ কেউ দেশ ছেড়ে পালাতে পারলেও এখনো আসছেন না প্রকাশ্যে। আবার যারা পালাতে পারেননি তারা দেশের ভিতরেই আছেন আত্মগোপনে। আন্দোলনে প্রায় সহস্রাধিক মৃত্যু ও কয়েক হাজার মানুষের আহত হবার ঘটনায় হওয়া মামলায় গ্রেপ্তার আতঙ্কও পিছু ছাড়ছে না নেতাদের।