‘পেটে ভাত জুটাতে কষ্ট হয়, ঘর মেরামত করবো কি দিয়ে। দুধ বিক্রি করে কোনমতে সংসার চালাই। বন্যা আসায় গরুর খাবার জোগাড় করতে পারি না, তাই দুধও দেয় না। এখন সংসারই চলে না। ভাঙা ঘর মেরামত করার টাকা পাব কই?’
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দিঘলী ইউনিয়নের পূর্ব দিঘলী গ্রামের বন্যার্ত বিধবা জাহেদা বেগমের আকুতি এমনই। বন্যায় তার ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু জাহেদার সামর্থ নেই ঘরটি মেরামত করার। জরাজীর্ণ এ ঘর নিয়ে দুঃশ্চিন্তার শেষ নেই তার।
বেড়িবাঁধের কূলে বসতি বিধবা জাহেদা বেগমের। গত দেড় মাস আগে তার ঘরে বন্যার পানি উঠে। পানি যখন ঘরে থাকা খাটের কাছাকাছি তখন ছেলে-মেয়ে দুইটা আর গবাদি পশু নিয়ে চলে আসেন বেড়িবাঁধে। এখন বেড়িবাঁধে ঝুপড়ি করে চলছে তাদের কষ্টের বাস। এদিকে পানিতে অর্ধনিমজ্জিত ঘরটি পঁচে ভেঙে পড়ছে। কিন্তু মেরামতের কোন উপায় নেই।
একই বেড়িবাঁধের কূলে বসবাস গৃহবধূ রানু বেগমের। স্বামী প্রবাসী। এক সন্তান এবং শাশুড়ি নিয়ে ছোট্ট টিনের তৈরি ঘরে থাকতেন তিনি। পানি উঠার পর
ঘরে আর থাকা সম্ভব হয়নি রানুর। ছেলে এবং শাশুড়িকে নিয়ে বেড়িবাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন তিনি। দীর্ঘদিন ঘরের অর্ধেকাংশ পানির নিচে তলিয়ে থাকায় বাঁশ বেড়া পঁচে যায়। এছাড়া ঘরের পাশে থাকা বড় একটি কড়ইগাছ পড়ে ঘরটি পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে। ঘরে থাকা খাটসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও ভেঙে গেছে। রানু বেগম এখন ঘর মেরামতের কাজ শুরু করেছেন। পুরো মেরামত করতে তার লাখ টাকার বেশি খরচ হবে। রানু জানান, মেরামতের ব্যয়ভার বহন করবেন ধারদেনা করে।
কিন্তু রানুর মতো ধারদেনা করে ঘর মেরামত করার সামর্থ নেই ওই এলাকার বেশিরভাগ লোকজনের।
সরেজমিনে গিয়ে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের বাসিন্দাদের হাহাকার দেখা গেছে। বহু লোকজনকে ক্ষতিগ্রস্ত ঘর নিয়ে দুঃচিন্তায় থাকতে দেখা যায়।
বেড়িবাঁধের পাশে বৃদ্ধ মোস্তফা এবং নুরজাহান দম্পতির বসবাস। ঝুপড়ি একটি ঘর ছিল, সেটিও বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যায় বাঁধের ওপর আশ্রয় নিয়েছেন তারা। এখন পানি নামার পর ঘরে ঢুকেছেন। তাদের ঘরটির বেড়া দিয়েছেন সিমেন্টের বস্তা দিয়ে। আর ঘরের ওপরে টিনের চালা থাকলেও ফুটো দিয়ে পানি পড়ে। তাই সে জরাজীর্ণ টিনের ওপরও সিমেন্টের বস্তা দিয়ে রেখেছেন।
এ দম্পতি জানায়, আয় রোজগার নেই। প্রতিবেশীদের কাছ থেকে খুঁজে আহারের জোগান দিতে হয়। তাই ঘর মেরামতের কোন ব্যবস্থা নেই।
লক্ষ্মীপুরে ভয়াবহ বন্যায় ৪০ হাজার ৮০১টি ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ঘরের বেশিরভাগই কাঁচাঘর। ঘর মেরামত নিয়ে এখন দুঃচিন্তায় ঘরের বাসিন্দারা। দীর্ঘ সময় ধরে বন্যা থাকায় দুর্গত এলাকার বাসিন্দাদের আয় রোজগার অনেকটা বন্ধ ছিল। এ সময় তাদেরকে খাদ্যের জোগান দিতেই কষ্ট হয়েছে। এখন বন্যার পানি নামার সাথে সাথে নতুন সংকট দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকট ঘর মেরামত।
পশ্চিম দিঘলী গ্রামের কৃষক মমিন উল্যার বসতঘরটি বন্যার পানিতে তলিয়ে ছিল। এতে ঘরের খুঁটি ভেঙে ঘরটি জরাজীর্ণ হয়ে আছে। বন্যায় তিনিও অর্থ সংকটে পড়ে ঘর মেরামত নিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন।
মমিন উল্যা বলেন, বন্যায় ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রান্না ঘর এবং গোয়াল ঘরও জরাজীর্ণ হয়ে গেছে। ঘরের ভিটির মাটি পানির তোড়ে চলে গেছে। ঘর মেরামত করতে দুই লাখ টাকার মতো লাগবে। আমি কৃষক। কৃষিকাজ করে সংসার চালাই। বন্যায় তো কৃষিও শেষ। এবার ঘর করবো কি দিয়ে? আয়-রোজগারও নেই। সংসারে খাবার জোগাতেই কষ্ট হয়।
ওই এলাকার সুরাইয়া বেগমের বাড়িতে এখনো বন্যার পানি। পানি ঘর থেকে নামলেও বাড়ির উঠোনে রয়ে গেছে। দীর্ঘ সময় পানি থাকায় বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তার ঘরটি। মাথাগোঁজার ঠাঁই নিয়ে এখন রাজ্যের চিন্তা ভর করেছে এ নারীর। কারণ তার সংসারই ঠিকমতো চলে না। প্রায় ২০ বছর আগে স্বামী ছেড়ে চলে গেছে। এক সন্তানকে নিয়ে থাকেন এ নারী। ঢাকায় একটি দোকানের কর্মচারী হিসেবে চাকরি করে তার ছেলে।
সুরাইয়া বলেন, বন্যার পানি আমার ঘরে উঠার সাথে সাথে ঘরের পশ্চিম পাশের অংশ ভেঙে পড়ে। এতে ঘরটি কাত হয়ে যায়। পানিতে ঘরের মাটি সব চলে গেছে। মেরামতের কোন ব্যবস্থা নেই। দুই লাখ টাকার মতো মেরামতে খরচ আসবে। কিন্তু টাকা জোগানোর কোন শক্তি নাই। কি-যে কষ্টে আছি, বলে বুঝাতে পারবো না। অন্যের বাড়িতে আপাতত আশ্রয় নিয়ে থাকি। ঘরে থাকার পরিবেশ নাই।
পূর্ব দিঘলী গ্রামের মারজান বেগম বলেন, বন্যার শুরুতে পানি ঘরের সামনে ছিল। পরে ঘরে ঢুকে পড়ে। প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ি। বন্যার পর বাড়িতে এসে দেখি ঘরের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এখন কোন রকমে থাকি। রান্নাঘর ভেঙে গেছে। স্বামী অসুস্থ, হাত ভেঙে ঘরবন্দী। আয় রোজগার নেই। ঘর মেরামতের অর্থও নেই।
একই এলাকার বৃদ্ধা মোবাশ্বেরা বেগম বলেন, ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করতাম। বন্যার পানি উঠলে আশ্রয় কেন্দ্রে উঠি। বন্যার পানিতে ঘরের বেড়া-খুঁটি ভেঙে ঘর একেবারে জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। একটা বেড়াও নেই। এগুলো মেরামত করার মতো কোন অর্থ বা সাধ্য আমাদের নেই। পরিবারের আটজন সদস্য এ ঝুপড়ি ঘরে বসবাস করি।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া বলেন, বন্যায় জেলাতে কাঁচা ও পাকা ৪০ হাজার ৮০১টি ঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ৩৮৫ কোটি ৯৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসারের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। সরকারি এবং বেসরকারিভাবে সহায়তা আসতে পারে। বরাদ্দ সাপেক্ষে অধিক ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হবে।