লক্ষ্মীপুরে বন্যায় প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার কাঁচা ঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পানি নেমে যাওয়ার পর এসব ঘরের বাসিন্দারা নতুন করে দুঃশ্চিন্তায় পড়েছেন। এরা সকলেই নিম্ন আয়ের মানুষ। তদুপরি বন্যার কবলে পড়ে কয়েকদিন কর্মহীন থাকায় এসব ঘর মালিকরা এখন রয়েছেন ব্যাপক অর্থ সংকটে। তাই ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামত নিয়ে তারা এখন ফের দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা ভাঙাখাঁ ইউনিয়নের জাগিদার বাড়ি এলাকার গৃহবধূ রাবেয়া আক্তার বলেন, 'আমার ঘরের খুঁটি নড়বড়ে হয়ে গেছে। ঘরের কোমর পানি ছিল। আশ্রয় কেন্দ্রে আছি। বন্যার পানিতে ঘরের অবস্থা এমন হয়েছে যে- বসবাসের মতো পরিবেশ নেই। মেরামত করা ছাড়া ঘরে উঠা যাবে না। আমার স্বামী দিনমজুর। বন্যা আমাদেরকে দুর্দশাগ্রস্ত করে দিয়েছে। ঘর মেরামত কোন উপায় আমাদের নেই। ঘরে তো যেতে হবে, আশ্রয় কেন্দ্রে আর কতদিন থাকবো?'
একই উপজেলা মান্দারী ইউনিয়নের যাদৈয়া গ্রামের নাছরিন ও সাবিনা ইয়াছমিন বলেন, 'ঘরের অবস্থা একেবারে জীর্ণ হয়ে গেছে। আশ্রয়কেন্দ্রে আছি। কিন্তু ঘরে যেতে হলে ঘর মেরামত করতে হবে। মেরামতের মতো অর্থ নেই আমাদের।'
একই সদর উপজেলার পশ্চিম দিঘলী গ্রামের মমিন উল্যার ঘরে হাঁটু পানি ছিল। প্রায় দুই সপ্তাহের মতো ঘরের ভিটি তলিয়ে ছিল পানিতে। এখন পানি ঘর থেকে নেমেছে। তবে দেখা দিয়েছে ক্ষতচিহ্ন।
মমিন উল্যার ঘরের ভিটি দেখলে মনে হবে চাষকৃত কোন ফসলি জমি। অবস্থা এমন হয়েছে যে- ঘরে পা দেওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়ছে। আর ঘরের বেড়া এবং খুঁটি এখন নড়বড়ে হয়ে আছে। ভেঙে পড়ে কিনা সে ভয় তো আছেই। ঘরের আসবাবপত্র পানিতে পঁচেও নষ্ট হয়েছে।
মমিন উল্যার পেশায় একজন কৃষক। বন্যায় কৃষিও শেষ। আয় রোজগার নেই। তাই ঘর মেরামত করারও অর্থ নেই তার।
মমিন উল্যা বলেন, 'বন্যার পানি উঠা শুরু হলে শুরুতে ঘরে থাকার চেষ্টা করি। কিন্তু পানি বাড়তে বাড়তে খাটের উপরও উঠে গেছে। তখন কিন্তু অবস্থা বেগতিক হওয়ায় ঘরে থাকতে পারিনি। অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে উঠেছি পাশের বেড়িবাঁধের উপর। সেখানে ঝুপড়ি ঘরে ছিলাম এখন ঘর থেকে পানি নেমেছে। ঘরের টানে স্ত্রী জরাজীর্ণ ঘরে চলে আসে। কিন্তু ঘরের যে অবস্থা থাকার মতো পরিবেশ নেই। শুধু খাটের উপর বসে থাকা ছাড়া কোন উপায় দেখছি না।'
মমিন উল্যাদের বাড়ির আশেপাশে বহু কাঁচাঘর পানির নিচে তলিয়ে থেকে নষ্ট হয়েছে। এখনো অনেকের ঘরে হাঁটু পানি, কারো ঘরে কিছুটা কম। যেসব ঘরের পানি নেমেছে, সেগুলো বসবাসের উপযোগী নয়। ঘরের ভিটির মাটি নরম হয়ে আছে। ঘরের নীচের অংশের কাঠ পঁচে গেছে। ঘরের ভেতরে থাকা আসবাবপত্রও নষ্ট হয়েছে অনেকের।
মমিন উল্যার প্রতিবেশি জাহাঙ্গীর বলেন, 'এখনো ঘরের ভেতের অনেক পানি। এ পানি সরতে আরও অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে ঘর পানিতে তলিয়ে থাকায় অনেক মালামাল নষ্ট হয়েছে। ঘরের মাটি নরম হয়ে আছে। এ মাটিতে পা রাখা যায় না। ঘরের পানি সরলেও উঠা যাবে না। মাটিগুলো সরিয়ে নতুন মাটি দিয়ে ভিটি ঠিক করতে হবে। বেড়ার কাঠ পঁচে গেছে, সেগুলোও পরিবর্তন করতে হবে। বন্যায় অনেক দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। কৃষি কাজ করতাম, বীজতলা পঁচে গেছে। জমিতে রোপা আমন নষ্ট হয়েছে। পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। সবদিক দিয়ে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। এ অবস্থায় ঘর মেরামত করবো কি দিয়ে?'
ওই এলাকার রোকসানা বেগম বলেন, 'বন্যার পানি খাটের ওপর উঠেছে। বন্যার পানি থেকে তেমন কিছু রক্ষা করতে পারিনি। পানিতে নষ্ট হয়ে গেছে। ঘরও এখনো পানির নীচে। এ ঘরে সহজে ওঠা যাবে না।'
জোহরা বেগম নামে এক নারী বলেন, 'বেড়িবাঁধের পাশে সরকারি জমিতে ঘর করে থাকতাম। ঘরে এখনো পানি। ঘরের অবস্থা একেবারে খারাপ। কিভাবে এ ঘর মেরামত করবো, সে অবস্থা নেই।'
একই এলাকার নুর হোসেন, শিরিন আক্তার, জাহেদা বেগমসহ অনেকে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরের চিত্র তুলে ধরেন। বন্যার পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত এসব ঘর মেরামত নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। আবার ঘর মেরামত করে বসবাসের উপযোগী করতেও দীর্ঘ সময় লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন তারা।
তারা জানান, চারিদিকে এখনো অনেক পানি। কোথাও বুক পরিমাণ, কোথাও কোমর বা হাঁটু। বসতভিটিও তলিয়ে আছে। যতক্ষণ পানির নীচে থাকবে, তত ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে। ঘরের ভিটির মাটি সরিয়ে নতুন মাটি দেওয়ার মতো উপযুক্ত পরিবেশ নেই। তাছাড়া ঘর মেরামতের অর্থও নেই অনেকের কাছে।
লক্ষ্মীপুর জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয়ের হিসবে মতে জেলাতে এবারের বন্যায় ১৮ হাজার ৩৬৫ টি কাঁচাঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। যা মেরামত করতে ব্যয় হবে ১২৬ কোটি এক লাখ ৪৮ হাজার টাকা।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইউনুস মিয়া বলেন, 'আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠিয়েছি।'