গুলিবিদ্ধ স্বামীর চিকিৎসায় ৩ দিনের শিশু বিক্রি

  • ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, দিনাজপুর
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

গুলিবিদ্ধ আব্দুর রশিদ

গুলিবিদ্ধ আব্দুর রশিদ

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশের পরিস্থিতি তখন উত্তপ্ত। এর মধ্যেই গর্ভবতী স্ত্রী রোকেয়া বেগমকে নিয়ে গত ৪ আগস্ট দিনাজপুর ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে নিয়মিত চেকআপ করতে গিয়েছিলেন দিনমজুর আবদুর রশিদ। কিন্তু হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে টিকিট নেওয়ার আগেই আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে ছোড়া শটগানের গুলি এসে লাগে আব্দুর রশিদের গায়ে। হাসপাতালেই প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে হামলা-মামলার ভয়ে স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ি চলে যান তিনি।

তিন দিন বাড়িতে থাকার পর তার পেটে গুলিবিদ্ধ স্থানে পচন ধরলে ও ব্যথা শুরু হলে ৮ আগস্ট তিনি দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। রাতেই হয় অস্ত্রোপচার, এরপর আইসিইউতে। পরদিন বাড়িতে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তানের জন্ম দেন রোকেয়া। কিন্তু সেই ফুটফুটে সন্তানের মুখ আর দেখা হয়নি রশিদের। কারণ তার চিকিৎসার খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন স্ত্রী রোকেয়া। তাই চিকিৎসার খরচ জোগাতে তিন দিনের শিশু সন্তানকে বিক্রি করে দেন রোকেয়া। নির্মম সেই বাস্তবতা মেনেও নিয়েছেন তারা। তবে সরকারের তরফ থেকে গণ-অভ্যুত্থান ঘিরে আহতদের সব ধরনের চিকিৎসাব্যয় বহন করার কথা বলা হলেও রশিদের ক্ষেত্রে সেটি হয়নি কেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি হাসপাতালের অস্বাভাবিক চিকিৎসাব্যয় নিয়ে।

বিজ্ঞাপন

জানা যায়, দিনমজুর আব্দুর রশিদের সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা চললেও ওষুধ, অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামাদিসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে খরচ হয় ৩৬ হাজার টাকা। এতে বিপাকে পড়েন তার পরিবার। কারণ যার মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকুও নেই। থাকেন অন্যের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে। এই অবস্থায় উপায় না পেয়ে তিন দিনের কন্যা সন্তানকে বিক্রি করে দেন রোকেয়া বেগম।

এদিকে, রশিদের অবস্থা এখনও পুরোপুরি ভালো নয়, তার শরীরে আরও গুলি ও পিলেট রয়েছে। একটি পিলেট রয়েছে তার প্রসাবের রাস্তায়। ডান পায়ের উরুর উপরে রয়েছে আরও তিনটি। এ ছাড়াও হাতে ও পেটেও আরও রয়েছে বলে জানান রশিদ। প্রতিদিন ওষুধ লাগছে, প্রসাবের জন্য ড্রেন করে দেওয়া হয়েছে নাভি দিয়ে। সেই থলিও বদলাতে হয় কয়েকদিন পর পর। এরপর রয়েছে তার বড় সন্তান, তার দাদা-দাদি ও তার স্ত্রীর খাওয়া। সবমিলিয়ে এক অসহায় পরিবার।

প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা রোকেয়া বেগমের। এসময় চাপা কষ্ট নিয়ে তিনি বলেন, ৪ আগস্ট দিনাজপুর হাসপাতালে টিকিট কাটার সময় আমার স্বামীর পেটে, নাভিতে, পায়ে ও প্রস্রাবের রাস্তায় গুলি লাগে। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানে আমার স্বামীর অপারেশন হয়। অপারেশনের পর আমার স্বামীর অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। এর মধ্যে আমার বাচ্চা হয়। এদিকে স্বামীর চিকিৎসার খরচ। হাতে একটি টাকাও নেই। পরে নিরুপায় হয়ে তিন দিনের বাচ্চাকে ২৫ হাজার টাকায় বিক্রি করে দিছি। সেই টাকা দিয়ে স্বামীর চিকিৎসা করছি। খারাপ তো লাগবে। কিন্তু সেই সময় কোনো উপায় ছিল না। স্বামীকে তো বাঁচাতে হবে।

গুলিবিদ্ধ রশিদ বলেন, অন্যের একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে স্ত্রী ও সন্তান নিয়ে দিনমজুরির কাজ করি। আমার আয় দিয়ে সংসার চলে। আক্ষেপ করে বলেন, আমার বাড়ি পঞ্চগড়ের ভজনপুরে। সেখানে সৎ মা ও দুই ভাই রয়েছে। বাবার জমিজমা বলতে কিছুই নেই।

তিনি বলেন, গুলিবিদ্ধের ঘটনার সঙ্গে আমার কোনও অপরাধ ছিল না, স্ত্রীকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পর গুলি লাগে। কিন্তু এখন আমাকে যন্ত্রণা নিয়ে বসবাস করতে হচ্ছে। স্ত্রী সেবাযত্ন করছে। আমাকে বলেছে, যদি বাচ্চাটাকে নিয়ে আসি তাহলে তোমার সেবাযত্ন ঠিকভাবে করতে পারবো না। প্রতিনিয়তই হাসপাতালে যেতে হচ্ছে, যেসব ওষুধ পাচ্ছি, তাছাড়াও বাইরের দোকান থেকেও কিনতে হচ্ছে। ছাত্ররা সহযোগিতা করছে, এছাড়াও অনেকে সহযোগিতা করছে। আমার আরও অপারেশন করা লাগবে, আমি বাঁচতে ও সুস্থ হতে চাই।

দিনাজপুর এম. আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. আব্দুস সালাম বলেন, যেসব রোগী হাসপাতালে এসেছে তাদেরকে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। সরকারের দেওয়া যেসব ওষুধ ও সরঞ্জামাদি সাপ্লাই রয়েছে সেসব আমরা দিচ্ছি। আর যেসব নেই সেগুলো লিখে দেওয়া হচ্ছে।