সন্তানের মুখ দেখা হয়নি কনস্টেবল সুজনের, ৩ সন্তান নিয়ে দিশেহারা এসআই খগেনের স্ত্রী

  • আল-আমিন রাজু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

উত্তরা পূর্ব থানা/ছবি: সংগৃহীত

উত্তরা পূর্ব থানা/ছবি: সংগৃহীত

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন দমাতে গিয়ে গণহত্যা চালিয়েছে শেখ হাসিনার সরকার। সরকারের হয়ে এই হত্যাকাণ্ডে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে পুলিশ। গুলি চালিয়েছে প্রকাশ্যে। এতে পুলিশের গুলিতে আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছাত্র-জনতার লাশের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, আন্দোলন দমাতে গিয়ে আক্রান্ত হয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। সরকারের হয়ে কিছু সুবিধাভোগী কর্মকর্তার কারণে পুলিশের শতশত সদস্যের জীবন ঝুঁকিতে পড়েছিলো। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধের মুখে ৪৪ সাধারণ পুলিশ সদস্যের প্রাণ যায়। আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয় শতশত পুলিশ সদস্যকে।

অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজধানীর উত্তরা পূর্ব থানা এলাকায় প্রাণ যায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএম) উত্তর বিভাগের কনস্টেবল সুজন মিয়ার। গত ৫ আগস্ট দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে গুরুতর আহত হন তিনি। এর কিছু সময় পরই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তরুণ এই পুলিশ সদস্য। এরপর কেটে গেছে এক মাস। কেমন আছে সুজনের পরিবার?

বিজ্ঞাপন

জানতে খোঁজ নিয়েছিলেন এই প্রতিবেদক। জানলেন, পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম মানুষটিকে হারিয়ে দিশেহারা সুজনের পরিবার। ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী যেনো বাকরুদ্ধ। বেঁচে থাকলে আর মাত্র কয়েক দিন পরই দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দেখতে পেতেন সুজন। দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে প্রাণ হারানো এই পুলিশ কনস্টবলের দেখা হলো না অনাগত সন্তানের মুখ।

কনস্টেবল সুজন কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার গোপালপুর এলাকার মো. বাছির মিয়ার সন্তান। তিন ছেলের মধ্যে সবার ছোট সুজন। তবে তিনিই ছিলেন পরিবারের ভরসা। বাবা বাছির মিয়া পেশায় কৃষক। বাবার যা আয় তা দিয়ে সংসার চলে না। বৃদ্ধ বাবার শেষ বয়সের সহায় হয়ে উঠেছিলেন সুজন।

বাছির মিয়া বার্তা২৪.কমকে বলেন, ৫ আগস্ট ছেলে আমাকে ফোন দিয়ে জানায় সে গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এর কিছু সময় পরই মারা যায়। ছেলের মৃত্যুর খবর পেয়ে আমার দুই ছেলেকে ঢাকা পাঠাই। তারা অনেক কষ্ট করে উত্তরা এলাকায় যায়। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর সহায়তায় লাশ গাড়িতে করে বাড়িতে এনে দাফন করি।

লাশ আনার সময়ে সেনাবাহিনী বলে দেয় কেউ যদি জিজ্ঞেস করে কার লাশ তাহলে পুলিশ সদস্যের লাশ সেটা বলা যাবে না। বলতে হবে, সাধারণ মানুষের লাশ, জানান বাছির মিয়া।

পাঁচ বছর আগে পুলিশে যোগ দেওয়া সুজন বিয়ে করেছিলেন একই উপজেলার জেরিন আকতারকে। তাদের সংসারে ১৮ মাসের এক সন্তান রয়েছেন। স্ত্রী জেরিন বর্তমানে ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

পুলিশের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সুজনের বাবা বলেন, এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই পাইনি। পুলিশের লোকজন বাড়িতে এসেছিলো। তারা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে গেছে। এর বাইরে আর কোনো কিছুই হয়নি।

তিন সন্তান নিয়ে দিশেহারা এসআই খগেন্দ্রের স্ত্রী দীপা

সুজনের মতো দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজধানীর উত্তরায় নিহত হয়েছেন উত্তরা পূর্ব থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) খগেন্দ্র চন্দ্র সরকার। গত ৫ আগস্ট রাতে উত্তরা পূর্ব থানায় বিক্ষুব্ধ জনতার হামলায় তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার তিন দিন পর নানা প্রক্রিয়ার পরে রাজারবাগ থেকে মরদেহ বুঝে পায় তার পরিবার। নিহত খগেন্দ্র কিশোরগঞ্জ সদর থানার বিন্নাতি এলাকার জ্ঞানেন্দ্র চন্দ্র সরকারের ছেলে। আট ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট ছিলেন খগেন্দ্র। তিন সন্তান নিয়ে সুখেই ছিলো তার পরিবার। হঠাৎই সব লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলো পুলিশের এই কর্মকর্তার পরিবারে। ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগে দীর্ঘদিন কর্মরত থাকার পরে মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে উত্তরা পূর্ব থানায় বদলি হয়ে যান খগেন্দ্র।

রোববার (৮ সেপ্টেম্বর) বিকেলে খগেন্দ্র চন্দ্র সরকারের স্ত্রী দীপা রায়ের সঙ্গে এই প্রতিবেদক যোগাযোগ করলে অজানা শঙ্কায় কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ করেননি। বরং প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান, কথা বললে কোনো সমস্যা হবে কি না।

স্বামীর সঙ্গে শেষ কি কথা হয়েছে জানতে চাইলে দীপা বলেন, ৫ আগস্ট সন্ধ্যায় তিন ফোন দিয়েছিলো। জানালো ভালো আছি। উত্তরায় কোনো সমস্যার কথা আমাদের জানায়নি। এরপর রাতেই মৃত্যুর খবর পাই।

খগেন্দ্রের তিন সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে দ্বাদশ শ্রেণি, মেঝো মেয়ে দশম শ্রেণি ও ৬ বছর বয়সী একমাত্র ছেলে প্রথম শ্রেণির শিক্ষার্থী।

পুলিশের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে কি না জানতে চাইলে দীপা বলেন, যোগাযোগ করেছে। কিন্তু আমার স্বামী তেজগাঁও থানায় ছিলো। তিনি কিছুদিন আগে উত্তরা পূর্ব থানায় বদলি হয়ে যায়। তার সব কাগজপত্র তেজগাঁও ডিসি অফিসে ছিলো। ডিসি অফিসেও তো হামলা হয়েছে। আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলেছে। সেখানে আমার স্বামীর কাগজ ছিলো। এজন্য পেনশনের কাজেও দেরি হবে।

স্বামী নিহতের ঘটনায় মামলা করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের পেটে নাই ভাত। মামলা করবো কি দিয়ে। আমাদের এখন খাদ্য দরকার।

দীপা আরও বলেন, আমার যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। এটা আর কোনো দিন ফিরে পাবো না। আমাদের খবর কেউ রাখেনি। তিনটা সন্তান নিয়ে কিভাবে বাঁচবো। যার আয়ে পরিবার চলে সেই তো এখন নেই। তাহলে বুঝতে পারছেন কিভাবে চলছি।