দশ বছর ধরে হ্যান্ডমাইকে নামাজের আহ্বান বৃদ্ধ মোসলেমের
ইসলাম
গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজারসহ মানুষ সমাগমের স্থানে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম পদ্ধতিতে নামাজের জন্য তাগাদা দেন এবং আহবান জানান হ্যান্ডমাইকে। হেঁটে হেঁটে মুসলমান ভাই-বোনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিগত ১০ বছর ধরে নামাজের এই আহবান জানাচ্ছেন ৬৪ বছর বয়সী মোসলেম উদ্দিন প্রধান নামের এক বৃদ্ধ।
বৃদ্ধ মোসলেম উদ্দিন প্রধানের বাড়ি গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার ভাতগ্রাম ইউনিয়নের ভগবানপুর গ্রামে। তিনি ওই গ্রামের মরহুম মহিম উদ্দিন প্রধানের ছেলে।
বিজ্ঞাপন
সম্প্রতি উপজেলার ধাপেরহাটে দেখা যায়, হ্যান্ডমাইকে মানুষকে নামাজের দাওয়াত দিচ্ছেন তিনি। কখনো হেঁটে কখনো একস্থানে দাঁড়িয়ে চারদিক ঘুরে ঘুরে মুসলমান ভাই-বোনদের নামাজের আহবান জানান তিনি।
মোসলেম উদ্দিনের পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১০ বছর ধরে তিনি এ কাজ করে আসছেন। আগে তিনি ঢাকায় কাজ করতেন। কর্মজীবন শেষে বাড়ি ফিরে নিজ খরচে একটি হ্যান্ডমাইক কিনে সাধারণ মুসলমানদের নামাজের জন্য আহবান শুরু করেন।
বিজ্ঞাপন
তারা জানান, মোসলেম উদ্দিন প্রতিদিন বিভিন্ন শহর ও হাট-বাজারে হেঁটে হেঁটে নামাজের আহ্বান জানাতে থাকেন। সাদুল্লাপুর উপজেলা শহরসহ ধাপেরহাট, মীরপুরহাট, ঘোগার বাজার এবং আশেপাশের এলাকাগুলোর মানুষ তাকে মাইকিং করে নামাজের আহবানের বিষয়টি দেখতে দেখতে অভ্যস্ত হয়ে গেছেন বলেও জানান তারা।
মোসলেম উদ্দিন প্রধান বলেন, ‘কোরআনে কারিমে একবার দুইবার নয়, ৮২ বার নামাজের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, নিজে নামাজ পড় এবং অন্যকেও নামাজ পড়তে তাগিদ দাও। আল্লাহর এই বিধান মেনেই হ্যান্ডমাইকে হেঁটে হেঁটে মুসলমানদের নামাজের জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আহবানে সাড়া দিয়ে প্রচারের সময় অনেক মানুষ আমার সঙ্গেই নামাজ আদায় করেছে, এটাই আমার স্বার্থকতা।’
এ সময় সামর্থ্য হলে হজে যাওয়ার ইচ্ছা আছে বলেও জানান বৃদ্ধ মোসলেম উদ্দিন।
ভাতগ্রাম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মাহফুজার রহমান (মাফু) মোবাইল ফোনে বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘ধর্মভীরু এই ব্যক্তির নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা স্থানীয়দের মাঝে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে এবং বিষয়টি আমাদেরকে নামাজে উৎসাহিত করে। মানুষের কল্যাণে হেঁটে হেঁটে হ্যান্ডমাইকে নামাজের আহবানের বিষয়টি সত্যিই ইতিবাচক এবং প্রশংসার।’
উল্লেখ্য, বৃদ্ধ মোসলেম উদ্দিন একসময় পাটের ব্যবসা করতেন। কিন্তু ব্যবসায় লোকসান হলে পরে জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় যান। সেখানেই মসজিদের মুসল্লিদের মাধ্যমে নামাজের অনুপ্রেরণা পান। এরপর থেকে তিনি নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন এবং ধীরে ধীরে আল্লাহভীরু হন। পরে গ্রামে ফিরে পথে পথে মানুষকে নামাজের আহবান জানাতে শুরু করেন।
সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর বিজয় ভাষণে আবু মোহাম্মদ আল-জোলানি (এখন প্রকৃত নাম আহমেদ আল-শারা ব্যবহার করছেন) দামেস্কের ঐতিহাসিক উমাইয়া মসজিদ থেকে বক্তব্য দেন। তিনি সিরিয়ার জনগণকে বলেন, নতুন দেশ গড়তে হবে ‘কঠোর পরিশ্রমে।’
সিরিয়ার স্বাধীনতাকামী প্রধান সংগঠন হায়াত তাহরির আল শাম (এইচটিএস) এর নেতা আল-জোলানি বলেন, বাশার আল-আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর সিরিয়ার জনগণই দেশের প্রকৃত মালিক এবং এ বিজয়ের মাধ্যমে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নতুন ইতিহাস লেখা হয়েছে।
রবিবার (৮ ডিসেম্বর) দামেস্ক দখলের পর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই রাজধানীতে পৌঁছে আল-জোলানি ঐতিহাসিক উমাইয়া মসজিদে বিজয় ভাষণ দেন। উমাইয়া মসজিদে তার ভাষণের আগে স্থানীয় জনতা তাকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে স্বাগত জানায়।
যুদ্ধের আবহে ভোরে যখন সূর্যের আলো ফুটে উঠল, তখন সিরিয়ার জনগণ একটি নাটকীয় পরিবর্তিত দেশে ঘুম থেকে জাগে। মুক্তিকামী বাহিনী দ্রুত আক্রমণের মাধ্যমে দামেস্কে প্রবেশ করে এবং দুই যুগের বেশি সময় ধরে জগদ্দল পাথর হয়ে সিরিয়ার মসনদে বসে থাকা স্বৈরাচারী বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের ঘোষণা দেয়। আসাদ ভোরের প্রথম প্রহরে সিরিয়া ছেড়ে রাশিয়ায় পালিয়ে যায় বলে রাশিয়ান মিডিয়ার খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।
উমাইয়া মসজিদে জড়ো হওয়া জনতার উদ্দেশে আল-জোলানি বলেন, ‘আসাদ অন্যায়ভাবে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষকে কারাগারে আটকে রেখেছে। আমরা সিরিয়ার জনগণ এই দেশের প্রকৃত মালিক। আমরা লড়াই করেছি, আজ আমরা এই বিজয়ের পুরস্কার পেয়েছি। সিরিয়ার কত মানুষ বিশ্বজুড়ে বাস্তুচ্যুত হয়েছে? কত মানুষ তাঁবুতে বসবাস করেছে? কত মানুষ সমুদ্রে ডুবে মারা গেছে? তার হিসাব নেই। আমার ভাইয়েরা! এই মহান বিজয়ের পর পুরো অঞ্চলে একটি নতুন ইতিহাস রচিত হচ্ছে। একটি নতুন সিরিয়া গড়তে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে যা মুসলিম উম্মাহর জন্য আলোর বাতিঘর হবে।’
তিনি প্রার্থনার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘এই বিজয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। দয়াময় আল্লাহ আপনাদের ব্যর্থ করবেন না। এই বিজয় সব সিরিয়ানের, সবাই এই বিজয়ের অংশীদার।’
বক্তব্যে আল-জোলানি ঐক্যের ওপর জোর দেন। উমাইয়া মসজিদে দেওয়া ভাষণের ছত্রে ছত্রে এটা প্রতিফলিত হয়েছে।
লেবানন-সিরিয়া সীমান্ত থেকে আল-জাজিরার সংবাদদাতা জেইন বাসরাভি বলেন, এইচটিএস নেতার ভাষণের দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে। তিনি এই ধারণার ওপর জোর দিয়েছেন যে, প্রতিশোধ নেওয়া উচিত নয়। সিরিয়া সব সিরিয়ানের জন্য হওয়া উচিত, এটাই জনগণের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হওয়া উচিত।
রবিবার দামেস্কে পৌঁছে আল-জোলানি প্রথমে নামাজ আদায় করেন। পরে সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে পাঠ করা এক বিবৃতিতে আল-জোলানি বলেন, ‘আমরা বিপ্লবের লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় সংকল্পে কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। আমরা ২০১১ সালে শুরু করা পথ সম্পন্ন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। সিরিয়ার জনগণের সমস্ত অধিকার অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই বন্ধ করব না। ভবিষ্যৎ আমাদের এবং আমরা বিজয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।
রবিবারের এই জয় ১৩ বছরের নৃশংস যুদ্ধের পর আসে, যা আল-আসাদ পরিবারের অর্ধ শতাব্দীর শাসনেরও অবসান ঘটায়।
সিরিয়ার যুদ্ধ ২০১১ সালের মার্চ মাসে আল-আসাদের বিরুদ্ধে একটি মূলত নিরস্ত্র বিদ্রোহ হিসাবে শুরু হয়েছিল, কিন্তু পরবর্তীতে এটি একটি সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত হয়। এতে বিদেশি শক্তিগুলোর জড়িত হওয়া, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং শরণার্থী হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এটা মোটেও আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, তিনি তার বার্তা প্রদানের জন্য দামেস্কের ঐতিহাসিক উমাইয়া মসজিদকে বেছে নেন। কোনো টিভি স্টুডিও বা সদ্য খালি হওয়া প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ নয়, বরং এক মহিমান্বিত ধর্মীয় স্থান। ১৩০০ বছরের পুরোনো এই মসজিদ বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদগুলোর একটি এবং ইসলামের ইতিহাসে এক বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা।
তার ভাষণে সদ্য মুক্ত হওয়া সিরিয়ান জনগণের জন্যও একটি প্রতীকী বার্তা বহন করে। যাতে তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়েরা! এই বিজয় এসেছে সর্বশক্তিমান আল্লাহর কৃপায় এবং শহীদ, বিধবা ও এতিমদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে। যারা কারাগারে দুর্বিষহ দিন কাটিয়েছে, তাদের কষ্টের মধ্য দিয়ে আমরা এই বিজয় অর্জন করেছি।’
উমাইয়া মসজিদ থেকে আল-জোলানি একটি শক্তিশালী এবং সুস্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন। তিনি একজন সুন্নি মুসলিম, যারা সিরিয়ার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। কিন্তু সিরিয়ার এই মাটি খ্রিস্টান, দ্রুজ, শিয়াসহ ইসমাইলি সম্প্রদায়েরও আবাসস্থল। সবাই এই বিজয়ের অংশীদার
তবে এই ভাষণ শুধুমাত্র সিরিয়ানদের জন্য নয়, এটি ছিল আন্তর্জাতিক মহলের জন্যও। এটি এমন একটি বার্তা, যা ইরায়েলের তেলআবিব এবং ওয়াশিংটনে পৌঁছাবে। যেখানে জোলানি এখনও একটি নিষিদ্ধ সংগঠনের নেতা হিসেবে চিহ্নিত এবং যার মাথার দাম ১০ মিলিয়ন ডলার।
উমাইয়া মসজিদের অবস্থান সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কে। এটি গ্রেট মস্ক অব দামাসকাস নামেও পরিচিত। এটি শুধুমাত্র একটি মসজিদ নয় বরং পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এবং অতি মূল্যবান একটি সম্পদ বা স্থাপনা।
বর্তমান বিশ্বে যে কয়টি প্রাচীন ইসলামি স্থাপত্য আদি অবকাঠামোর ওপর এখনো টিকে আছে, তার মধ্যে অন্যতম এটি। এর বয়স ১৩শ’ বছরের বেশি। এ মসজিদকে ইসলামি স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম পথিকৃত হিসেবে বিবেচনা করা হয় সারাবিশ্বে। এ মসজিদের অভ্যন্তরে রয়েছে হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর কবর।
এ ছাড়া ক্রুসেডের সময় জেরুজালেম বিজয়ী বীর সালাহউদ্দিন আইয়ুবীসহ তার বংশধরদেরও অনেকের কবর রয়েছে এ মসজিদের পাশে। বিখ্যাত মুসলিম পণ্ডিত ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এ মসজিদে বসে কোরআনে কারিমের ব্যাখ্যা করতেন মানুষের কাছে।
যে স্থানে উমাইয়া মসজিদ অবস্থিত, ওই স্থানটি প্রাচীনকাল থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিশেষ করে মূর্তি পূজারীদের উপাসনালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। মসজিদ নির্মাণের হাজার বছর আগে থেকে বিভিন্ন দেবতার উপাসনা করা হতো এখানে। দীর্ঘকাল ধরে এখানে ছিল রোমনাদের জুপিটার মন্দির। পরে ৩৯১ সালে জুপিটার মন্দিরকে খ্রিস্টান চার্চে পরিণত করা হয়। পরে এ চার্চ হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর নামে উৎসর্গ করা হয়। প্রাচীনকাল থেকে বিদ্যামন উপাসনালয় এবং পরবর্তীতে মসজিদ নির্মাণের পরে এখানে থাকা অনেক মূল্যবান প্রত্ন নিদর্শন বর্তমানে সিরিয়ার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
৬৩৪ সালে খালিদ ইবনে আল ওয়ালিদের নেতৃত্বে দামেস্ক জয় হয়। ৬৬১ সালে ইসলামি খেলাফত উমাইয়া বংশের অধীনে আসে। এরপর দামেস্ক হয় মুসলিম বিশ্বের প্রশাসনিক রাজধানী। ষষ্ঠ উমাইয়া খলিফা প্রথম আল ওয়ালিদ ৭০৫ সালে এখানে মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন।
এ মসজিদ যখন নির্মাণ করা হয় তখন এটি ছিল বিশ্বের অন্যতম ব্যয়বহুল একটি প্রকল্প। ভারত, ইরান, গ্রিস ও মরক্কো থেকে ১২ হাজার দক্ষ কারিগর সংগ্রহ করা হয় এর স্থাপত্যশৈলীর জন্য। এ ছাড়া বাইজানটাইন কারিগরদের নিয়োজিত করা হয় এর মোজাইকের কাজে। ৭১৫ সালে শেষ হয় মসজিদ নির্মাণ।
৭৫০ সালে উমাইয়াদের পতনের পর আব্বাসীয়রা ক্ষমতায় আসে এবং ইসলামি খেলাফতের রাজধানী হয় বাগদাদ। আব্বাসীয়দের সময়ও এ মসজিদ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মিসরের ফাতিমিদের দখলে আসে এ শহর। এরপর আবার তুরস্কের সেলজুক রাজার মাধ্যমে উদ্ধার হয় এ শহর। এরপর ক্রুসেডের সময়ও এ শহরের আধিপত্য নিয়ে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে লড়াই চলে এবং শেষ পর্যন্ত নুরউদ্দিন জঙ্গি দখল করেন এ নগরী। পরে সুলতান সালাহউদ্দিন আইউবী, তার কাছ থেকে মামলুক এবং মামলুকদের কাছ থেকে তুরস্কের উসমানীয়রা ১৫১৬ সালে দখলে নেয় এ নগরী।
দখল-পাল্টা দখলে বিভিন্ন সময় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এ মসজিদ। বিশেষ করে ১৪০০ সালে তিমুর দামেস্ক নগরী পুড়িয়ে দেওয়ার আদেশ দিলে মসজিদের মূল গম্বুজসহ একটি মিনার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। বিভিন্ন সময় এ মসজিদ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় তেমনি বিভিন্ন সময় মুসলিম শাসকরা এ মসজিদের সংস্কারও করেন। উসমানীয়দের পর সর্বশেষ বড় আকারে এ মসজিদ সংস্কার করেন সিরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট হাফিজ আল আসাদ।
১৩ শ’ বছর পার হলেও এখনো এ মসজিদের আদি অলঙ্করণ এবং সাজসজ্জা অমলীন যা মুগ্ধ করে দর্শকদের। এ মসজিদ সিরিয়ার অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
এ মসজিদের পাশে অনেক বীরযোদ্ধার কবর রয়েছে। ২০০১ সালে দ্বিতীয় পোপ জন পল পরিদর্শন করেন এ মসজিদ। মসজিদের তিনটি মিনারের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু ঈসা মিনার ২৫৩ ফিট।
পারস্য ইতিহাসবিদ ইবনে আল ফকিহ লিখেছেন, ৭০৫ সালে মসজিদ নির্মাণ শুরুর পর খননের সময় এর নিচে একটি গোপন বাক্সে রক্ষিত একটি মস্তক পাওয়া যায়। এ মস্তক হজরত ইয়াহইয়া (আ.)-এর বলে বিশ্বাস। খলিফা প্রথম ওয়ালিদ এটি জানার পর তিনি মস্তকটি মসজিদের মধ্যে সমাহিত করে তার ওপর একটি বিশেষ পিলার নির্মাণের নির্দেশ দেন। পরে এ স্থানে মাজার ও গম্বুজ নির্মাণ করা হয়। হজরত ইয়াহইয়া (আ:)-কে খ্রিস্টানরাও তাদের নবী দাবি করে। সে কারণে এ মসজিদ খ্রিস্টানদের কাছেও গুরুত্বপূর্ণ। তা ছাড়া আগে থেকেই এখানে ছিল তাদের চার্চ।
বর্তমান সময়ের সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখণ্ডকে প্রাচীনকালে ‘মুলকে শাম’ বলা হতো। শাম মূলত নবী-রাসুলদের ভূখণ্ড। কোরআন-হাদিসের একাধিক জায়গায় এর ফজিলতের কথা এসেছে।
এক আয়াতে আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যাদের দুর্বল মনে করা হতো তাদেরকেও আমি উত্তরাধিকার দান করেছি, এই ভূখণ্ডের পূর্ব ও পশ্চিম অঞ্চলের যাতে আমি বরকত সন্নিহিত রেখেছি।’ -সুরা আরাফ : ১৩৭
অন্য আয়াতে আল্লাহতায়ালা এর বরকত সম্পর্কে বলেন, ‘পরম পবিত্র ও মহিমাময় সত্তা তিনি, যিনি স্বীয় বান্দাকে রাতের বেলায় ভ্রমণ করিয়েছিলেন মসজিদে হারাম থেকে মসজিদে আকসা পর্যন্ত। যার চারদিকে আমি পর্যাপ্ত বরকত দান করেছি, যাতে আমি তাকে কুদরতের কিছু নিদর্শন দেখিয়ে দিই। নিশ্চয়ই তিনি পরম শ্রবণকারী ও দর্শনকারী।’ -সুরা বনি ইসরাঈল : ১
সব মোফাসসির এ বিষয়ে একমত যে, উল্লেখিত আয়াতে ‘পবিত্র ভূমি’ এবং ‘বরকতময় ভূমি’ দ্বারা শামের ভূমিই উদ্দেশ্য।
আর আয়াতে বরকত দ্বারা কেউ বেলেছেন, এখানে দুনিয়ার বরকত উদ্দেশ্য। যেমন- এই পবিত্র ভূখণ্ড সর্বদা অধিক পরিমাণে আহার্য, ফলমূল, নদী-নালা, খাদ্যশস্য ও রিজিকের প্রশস্ততায় পরিপূর্ণ থাকবে। আর কেউ বলেছেন, এখানে বরকত দ্বারা দ্বিনের বরকতে ধন্য হওয়া উদ্দেশ্য। কারণ এখানে বহুসংখ্যক নবী-রাসুল বসবাস করেছেন, এখানেই ফেরেশতারা তাদের কাছে আসমানি অহি নিয়ে অবতরণ করেছেন।
তবে বিশুদ্ধ মত হলো, এখানে দ্বিন-দুনিয়া উভয় দিকের বরকতই রয়েছে। হাদিস শরিফে এসেছে, নবী কারিম (সা.) শামের জন্য দোয়া করে বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! আমাদের শাম দেশে ও ইয়েমেনে বরকত দান করুন।’ -সহিহ বোখারি : ১০৩৭
তা ছাড়া বরকতময় এই ভূমিকে আল্লাহতায়ালা অনেক মর্যাদা দান করেছেন। তার কয়েকটি হলো-
হাশরের ময়দান হবে শাম ইমাম কুরতুবি, ইবনে কাসির ও ইবনে হাজার (রহ.) বলেন, শাম হলো হাশরের ভূমি। প্রথমবার ইহুদিদের শামে বহিষ্কার করার দ্বারা প্রথম হাশর সংঘটিত হয়েছে।
আর দ্বিতীয়বার সেখানেই সমগ্র মানবজাতির জন্য হাশরের ময়দান হবে। হাদিস শরিফে এসেছে, হাকিম বিন মুয়াবিয়া (রহ.) তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সেখানেই তোমাদের হাশর হবে (তোমরা একত্র হবে)। সেখানেই তোমাদের হাশর হবে। সেখানেই তোমাদের হাশর হবে। তখন লোকেরা আরোহী, পদাতিক ও অধঃমুখী এই তিনটি দলে বিভক্ত হয়ে যাবে। ইবনে বুকাইর (রহ.) বলেন, সেখানেই তোমাদের হাশর হবে বলার সময় তিনি শাম দেশের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। -মুসনাদে আহমদ : ৩৩/২১৪)
যেখানে ফেরেশতারা নিজের ডানাকে ছড়িয়ে দেন ফেরেশতারা শামের ওপর নিজের ডানা দিয়ে আবৃত করে রাখেন, যা এই ভূখণ্ডের মাহাত্ম্যকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। হজরত জায়েদ বিন সাবেত (রা.) বলেন, আমি নবী কারিম (সা.)-কে বলতে শুনেছি, শামের জন্য সৌভাগ্য, শামের জন্য মারহাবা! আমি বললাম, শামের জন্যই কেন? তিনি উত্তর দিলেন, ফেরেশতারা শামের ওপর নিজের ডানা ছড়িয়ে দেন। -জামে তিরমিজি : ৩৯৫৪
আল্লাহতায়ালা শাম ও তার অধিবাসীদের দায়িত্ব নিয়েছেন ইবনু হাওয়ালা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, শিগগিরই ইসলামের ব্যাপক প্রসার ঘটবে, যখন জেহাদের জন্য তিনটি সেনা দল গঠিত হবে- সিরিয়ার সেনাবাহিনী, ইয়েমেনের সেনাবাহিনী ও ইরাকের সেনাবাহিনী। ইবনু হাওয়ালা (রা.) বললেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি সেই যুগ পেলে আমার জন্য কোন দলের সঙ্গী হওয়া মঙ্গলজনক মনে করেন? তিনি বললেন, তুমি অবশ্যই সিরিয়ার সেনাবাহিনীতে যোগ দেবে। কেননা তখন এই এলাকাই আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উত্তম গণ্য হবে। আল্লাহ তার সত্কর্মশীল বান্দাদের এখানে একত্র করবেন। আর তুমি সিরিয়া যেতে রাজি না হলে অবশ্যই ইয়েমেনি সেনাবাহিনীর সঙ্গী হবে। তোমাদের নিজেদের এবং তোমাদের কূপগুলো থেকে পানি উত্তোলন করো। কেননা মহান আল্লাহ আমার অসিলায় সিরিয়া ও এর অধিবাসীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়েছেন। -সুনানে আবু দাউদ : ২৪৮৩
শাম হবে কোরআন ও ইসলামের ঘাঁটি হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, আমি (দিব্যদৃষ্টি বা স্বপ্নে) দেখলাম যে কিতাবুল্লাহকে আমার বালিশের নিচ থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে। অতঃপর আমি স্পষ্টরূপে দেখলাম যে তা যেন এক উজ্জ্বল আলোতে রূপান্তরিত হলো, যার উৎস শাম থেকে। জেনে রেখো! যখন ফেতনা ছড়িয়ে পড়বে তখন ঈমান শামেই অবস্থান করবে এবং কিতাবুল্লাহ এবং ইসলামের মজবুত ঘাঁটিও সেখানেই থাকবে। আর শামবাসীরা তার হেফাজতে অবিচল থাকবে। -মুসতাদরাকে হাকিম : ৫/৭১২-১১৩
আল্লাহর সাহায্যপ্রাপ্ত দল শামে অবস্থান করবে নবী কারিম (সা.)-এর বর্ণিত সাহায্যপ্রাপ্ত বিজয়ী দলটি শামেই অবস্থান করবে। হজরত মোয়াবিয়া ইবনু কুররা (রহ.) তার বাবা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যখন শামবাসীরা খারাপ হয়ে যাবে তখন তোমাদের আর কোনো কল্যাণ থাকবে না। তবে আমার উম্মতের মধ্যে একটি দল সব সময়ই সাহায্যপ্রাপ্ত (বিজয়ী) থাকবে। যেসব লোক তাদের অপমানিত করতে চায় তারা কেয়ামত পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে পারবে না। -জামে তিরমিজি : ২১৯২
অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত সাদ ইবনে আবি ওয়াক্কাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, পশ্চিম দেশীয়রা বরাবর হকের ওপর বিজয়ী থাকবে কেয়ামত পর্যন্ত। -সহিহ মুসলিম : ৪৮৫২
ইমাম নববি পশ্চিম দেশীয়ের ব্যাখ্যা করেছেন, আরব বা শামবাসী। -মুখতাসারু শরহে মুসলিম : ৫/১৮৫
ইমাম আহমদ ও শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া (রহ.) এই মতটি সমর্থন করেছেন।
শামে অবস্থানের জন্য নবীর অসিয়ত নবী কারিম (সা.) তার উম্মতকে শামে অবস্থানের জন্য অসিয়ত করেছেন। হজরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের আগে হাজরামাউত সাগর বা এলাকা থেকে আগুন বের হয়ে মানুষকে এক জায়গায় একত্র করবে। সাহাবায়ে কেরাম (রা.) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলুল্লাহ! তাহলে তখন আমাদের প্রতি আপনার নির্দেশ কী? তিনি বললেন, তখন শামের ভূমিকে আঁকড়ে ধরবে। -মুসনাদে আহমদ : ৯/১৪৫
শাম সর্বোত্তম আবাসভূমি নবী কারিম (সা.) শামের প্রশংসা করেছেন এবং তাকে সর্বোত্তম আবাসভূমি বলে আখ্যা দিয়েছেন। হজরত আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, যুদ্ধের দিন মুসলিমদের শিবির স্থাপন করা হবে ‘গূতা’ নামক শহরে, যা সিরিয়ার সর্বোত্তম শহর দামেস্কের পাশে অবস্থিত। -সুনানে আবু দাউদ : ৪২৯৮
শাম হলো ঈসা নবীর অবতরণের স্থান হজরত ইসা ইবনে মারইয়াম (আ.)-এর অবতরণের স্থান হলো- শাম। নাওয়াস বিন সামআন (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, আল্লাহতায়ালা ঈসা ইবনে মারইয়ামকে প্রেরণ করবেন। তিনি দুজন ফেরেশতার কাঁধের ওপর ভর করে ওয়ারস ও জাফরান রঙের জোড়া কাপড় পরিহিত অবস্থায় দামেস্ক নগরীর পূর্ব দিকের উজ্জ্বল মিনারে অবতরণ করবেন। -সহিহ মুসলিম : ৭২৬৩
শামেই আল্লাহর শত্রু দাজ্জালকে হত্যা করা হবে শামেই ঈসা (আ.)-এর হাতে দাজ্জাল নিহত হবে। হাদিস শরিফে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী কারিম (সা.) বলেন, যখন মুসলিম বাহিনী যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করবে এবং সারিবদ্ধভাবে দণ্ডায়মান হতে শুরু করা মাত্র নামাজের সময় হবে। অতঃপর ঈসা (আ.) অবতরণ করবেন এবং নামাজে তাদের ইমামতি করবেন। আল্লাহর শত্রু (দাজ্জাল) তাকে দেখামাত্রই বিচলিত হয়ে যাবে, যেমন- লবণ পানিতে মিশে যায়। যদি ঈসা (আ.) তাকে এমনিই ছেড়ে দেন তবে সে-ও নিজে নিজেই বিগলিত হয়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। অবশ্য আল্লাহতায়ালা হজরত ঈসা (আ.)-এর হাতে তাকে হত্যা করবেন এবং তার রক্ত ঈসা (আ.)-এর বর্শায় তিনি তাদের দেখিয়ে দেবেন। -সহিহ মুসলিম : ৭১৭০
শাম খাঁটি মুমিনদের বাসস্থান খাঁটি মুমিনদের বাসস্থান হলো শামের পবিত্র ভূমি। হজরত সালামা বিন নুফাইল (রা.) বলেন, নবী কারিম (সা.) বলেছেন, জেনে রেখো! মুমিনদের বাসভূমির উৎস হবে শাম। -মুসনাদে আহমদ : ২৮/১৬৫
কেয়ামতের আগে শাম হবে নিরাপদ ও ফেতনামুক্ত কেয়ামতের আগে শাম নিরাপদ ও ফেতনামুক্ত থাকবে। ইমাম ইবনে আসির (রহ.) বলেন, ইসলামের মূল উৎস হবে শাম। যেন হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ফেতনার যুগের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। অর্থাৎ শাম তখনো নিরাপদ থাকবে এবং মুসলিমরা সেখানে ফেতনামুক্ত থাকবে। -আন নিহায়া ফি গরিবিল : ৩/২৭১
সিরিয়ায় আসাদবিরোধী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)-এর হাতে বাথ পার্টির ৬১ বছরের শাসনের অবসান হলো। ১৯৬৩ সালে সামরিক অভ্যুত্থানে আরব সোশ্যালিস্ট বাথ পার্টি সিরিয়ার ক্ষমতা দখল করে। ১৯৭১ সালে বাশার আল আসাদের বাবা হাফিজ আল আসাদ পার্টির ভেতরে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে আমিন আল হাফিজের কাছ থেকে ক্ষমতা দখল করেন। হাফিজ আল আসাদের মৃত্যুর পর বাশার আল আসাদ ক্ষমতায় আরোহণ করেছিলেন ২০০০ সালে।
২০১১ সালে শুরু হওয়া ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধ শেষে রবিবার (৮ ডিসেম্বর) বাশার আল আসাদ দামেস্ক ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বিদ্রোহীরা দামেস্কের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন। গত এক সপ্তাহের একপক্ষীয় যুদ্ধে হুড়মুড় করে বাশারের শাসনের পতন ঘটল। এর মাধ্যমে অবসান ঘটে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে শাসন করা আসাদ পরিবারের।
সিরিয়ার দামেস্কসহ এর আশপাশের অঞ্চল নিয়ে নবী কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। বিশেষত কেয়ামতের আগের কিছু ঘটনা এ অঞ্চল ঘিরে সংঘটিত হবে। তাই বিভিন্ন হাদিসে এ অঞ্চলকে মুসলিমদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
তা ছাড়া ইমাম মাহদি (আ.)-এর অনুসরণ, দাজ্জালের আগমন ও হত্যা, হজরত ঈসা (আ.)-আবির্ভাব, শাসনকালসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় হাদিসে।
‘মুলকে শাম’ বা শাম ভূখণ্ড নবী-রাসুলদের ভূখণ্ড। কোরআন-হাদিসের বিভিন্ন জায়গায় তার বরকত ও পবিত্রতার বর্ণনা রয়েছে। ইতিহাসের অগণিত ঘটনাপ্রবাহ তার সঙ্গে জড়িত। মক্কা-মদিনার পরই যার মর্যাদা স্বীকৃত।
ভৌগোলিকভাবে আগের শাম অঞ্চল বর্তমানে কয়েকটি রাষ্ট্রে বিস্তৃত। বর্তমানের সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও পূর্ণ ফিলিস্তিন ভূখণ্ড প্রাচীন মুলকে শামের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই শামের সঙ্গে ভবিষ্যতের ও কেয়ামতপূর্ব অনেক ঘটনা জড়িত রয়েছে। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) শামের ব্যাপারে বেশ কিছু ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।
আল্লাহর অলিদের অবস্থান হজরত শুরাইহ ইবনে উবাইদ (রহ.) বলেন, হজরত আলী (রা.) ইরাকে অবস্থানকালে তাকে শামবাসীর ব্যাপারে বলা হলো, আপনি তাদের ওপর অভিশাপ করুন! তখন তিনি বলেন, না, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, শাম ভূখণ্ডে আবদালরা (আল্লাহর অলিদের বিশেষ দল) থাকেন। তারা ৪০ জন থাকেন। যখনই তাদের থেকে একজন মারা যান, আল্লাহতায়ালা তার স্থানে অন্য একজনকে রাখেন। তাদের বরকতে বৃষ্টি হয় ও শত্রুর ওপর জয়লাভ হয়। ভবিষ্যতে তাদের উসিলায় শামবাসীর ওপর থেকে আজাব তুলে নেওয়া হবে। -মুসনাদে আহমাদ : ৮৯৬
মুসলিমদের দ্বিতীয় হিজরতভূমি হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে বলতে শুনেছি, হিজরতের পর আরেকটি হিজরত শিগগিরই সংঘটিত হবে। তখন ভূপৃষ্ঠের সর্বোত্কৃষ্ট মানুষ হবে তারা, যারা হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর হিজরতভূমিতে (শাম দেশে) অবস্থান করবে। আর পুরো পৃথিবীতে সর্বনিকৃষ্ট মানুষরাই বাকি থাকবে। তাদের ভূমিগুলো তাদের নিক্ষেপ করবে। আল্লাহতায়ালা তাদের অপছন্দ করবেন। তাদের ফেতনার আগুন তাদের বানর ও শূকরের সঙ্গে মিলিয়ে রাখবে। (তাদের দুশ্চরিত্রের কারণে তারা যেখানেই যাবে সেখানেই ফেতনা লেগে থাকবে)।’ -সুনানে আবু দাউদ : ২৪৮২
ইবনে হাওয়ালা (রা.) বলেন, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ইসলামি বাহিনী শিগগিরই কয়েকটি দলে দলবদ্ধ হবে। একটি দল শামে, একটি ইয়েমেনে ও অন্য একটি ইরাকে। ইবনে হাওয়ালা (রা.) জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি যদি সে যুগ পাই, তখন আমি কোন দলে যুক্ত হব, তা বলে দিন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, তুমি শামের বাহিনীতে থাকবে। কেননা তা আল্লাহর পছন্দনীয় ভূমির একটি। সেখানে তিনি তার সর্বোত্কৃষ্ট বান্দাদের একত্রিত করবেন। আর যদি তুমি তাতে যুক্ত না হতে পারলে তুমি ইয়েমেনের বাহিনীকে গ্রহণ করো। আর তোমরা শামের কূপ থেকে পানি গ্রহণ করো। কেননা আল্লাহ আমার জন্য অর্থাৎ আমার উম্মতের জন্য শাম ভূখণ্ড ও তার বাসিন্দাদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।’ -সুনানে আবু দাউদ : ২৪৮৩
উম্মতে মুহাম্মদির কল্যাণ সম্পৃক্ত হজরত মুয়াবিয়া ইবনে কুররা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যখন শামভূমি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারীদের মাধ্যমে ধ্বংস হবে তখন তোমাদের মধ্যেও কোনো কল্যাণ থাকবে না। আর আমার উম্মতের একটি দল সর্বদা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে। তাদের যারা ক্ষতি করার চেষ্টা করবে তারা কেয়ামত পর্যন্ত তাদের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না।’ -জামে তিরমিজি : ২১৯২
মুসলিম বাহিনীর সেনাছাউনি হজরত আবু দারদা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মহাযুদ্ধের সময় মুসলিমদের ছাউনি হবে ‘গোতা’ শহরে, যা দামেস্ক শহরের পাশে অবস্থিত। এটি শামের উত্কৃষ্ট শহরগুলোর একটি।’ -সুনানে আবু দাউদ : ৪২৯৮
অন্য বর্ণনায় রয়েছে, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘অচিরেই তোমরা শাম বিজয় করবে। যখন তোমরা সেখানে বসবাসের সুযোগ পাবে তোমরা দামেস্ক নগরীতে থাকবে। কেননা তা যুদ্ধবর্তীকালীন মুসলিমদের আশ্রয়স্থল হবে। আর তাদের ছাউনি হবে ওই দেশের একটি ভূমি, যাকে ‘গোতা’ বলা হয়।’ -মুসনাদে আহমাদ : ১৭৪৭০
হজরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘খোরাসান ভূমি থেকে কালো পতাকাবাহী দল বের হবে। তাদের কোনো কিছুই প্রতিরোধ করতে পারবে না। যতক্ষণ না তারা তা ‘ইলিয়া’ তথা জেরুজালেমে না পৌঁছে।’ -জামে তিরমিজি : ২২৬৯
উল্লেখ্য, আব্বাসীয় খিলাফতের যুগ থেকে অনেকেই নিজেদের ওই দল বোঝানোর জন্য কালো পতাকা নিয়ে অভিযানে নেমেছে। কেউ বা নিজেকে মাহদিও দাবি করে বসেছে। তবে তাদের এমন দাবি সম্পূর্ণ ভুল ছিল। বরং আল্লাহই ভালো জানেন, তারা কেয়ামতের আগে কোন যুগের ও কারা হবে।
কেয়ামতের আগে মাহদির খেলাফত গ্রহণ হজরত উম্মে সালামা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘মুসলমানদের একজন খলিফার ইন্তেকালের পর মতানৈক্য হবে। তখন মদিনাবাসীর একজন ব্যক্তি (মতানৈক্য এড়িয়ে যাওয়ার জন্য) মক্কায় চলে আসবেন। অতঃপর মক্কাবাসীর অনেক লোক তার কাছে আসবে এবং তাকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও ঘর থেকে বের করে এনে মাকামে ইবরাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বায়াত হবে। (তিনিই হলেন ইমাম মাহদি) তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য শাম থেকে একটি (বাতিল) দলকে পাঠানো হবে। তবে তারা মক্কা-মদিনার মধ্যবর্তী বাইদা নামক স্থানে পৌঁছলে ভূমিধসে আক্রান্ত হবে। মানুষ তা দেখার পর শামের আবদালরা ও ইরাকবাসী উৎকৃষ্ট মানুষের দল আসবে। অতঃপর তারা মাকামে ইবরাহিম ও হাজরে আসওয়াদের মধ্যবর্তী স্থানে তার হাতে বায়াত হবে। অতঃপর কোরাইশ বংশের জনৈক ব্যক্তির উদ্ভব হবে। কালব গোত্র হবে তার মাতুল গোত্র। সে তাদের মোকাবেলায় একটি বাহিনী পাঠাবে। যুদ্ধে মাহদির অনুসারীরা কালব বাহিনীর ওপর বিজয়ী হবে। এ সময় যারা কালব থেকে যুদ্ধলব্ধ সম্পদ নিতে উপস্থিত হবে না তাদের জন্য আফসোস! মাহদি গনিমতের সম্পদ বণ্টন করবেন ও নবী কারিম (সা.)-এর সুন্নত অনুযায়ী মানুষের মধ্যে কার্য পরিচালনা করবেন। আর ইসলাম সারা পৃথিবীতে প্রসারিত হবে। অতঃপর তিনি সাত বছর অবস্থান করার পর মারা যাবেন। আর মুসলিমরা তার জানাজা পড়বে। ইমাম আবু দাউদ (রহ.) বলেন, কেউ কেউ হিশাম থেকে বর্ণনা করে বলেন, ৯ বছর অবস্থান।
দামেস্কে ঈসা (আ.)-এর অবতরণ হজরত নাউওয়াস ইবনে সামআন (রা.) সূত্রে বর্ণিত একটি হাদিসে দাজ্জাল সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে। তাতে হরজত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘দাজ্জাল ইরাক ও শামের মধ্যবর্তী এলাকা থেকে বের হবে এবং ডানে-বাঁয়ে গোটা পৃথিবীতে ফাসাদ সৃষ্টি করতে থাকবে। তাই হে আল্লাহর বান্দারা! তোমরা ঈমানের ওপর অটল থাকবে।
দীর্ঘ হাদিস বর্ণনার একপর্যায়ে নবী কারিম (সা.) বলেন, দীর্ঘ ৪০ দিন ধরে দাজ্জালের অনিষ্টতার পর আল্লাহতায়ালা হজরত ঈসা ইবনে মারিয়াম (আ.)-কে পাঠাবেন। তিনি দামেস্কের পূর্ববর্তী এলাকার শুভ্র মিনারের কাছে আসমান থেকে দুজন ফেরেশতার কাঁধে চড়ে অবতরণ করবেন। তখন তার শ্বাস-প্রশ্বাস যে কাফেরের গায়ে লাগবে সে মারা যাবে। আর তার দৃষ্টিসীমার শেষ প্রান্তে গিয়ে তার শ্বাস-প্রশ্বাস পড়বে। তিনি দাজ্জালকে তালাশ করবেন, অতঃপর শামের বাবে লুদ নামক স্থানে তাকে হত্যা করবেন।’ -সহিহ মুসলিম : ২৯৩৭