নবীকুল শিরোমণি হজরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আগমন ছিল বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। এই মহান রাসুল সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিচ্ছেন, ‘আর আমি তোমাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যই সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি। কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না।’ (সুরা সাবা: আয়াত ২৮)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে কেবল মক্কা শহর বা সেই যুগের লোকদের জন্যই আবিভূর্ত করেননি বরং তিনি কিয়ামত পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীর মানুষ ও জাতির জন্য প্রেরিত হয়েছেন। তার (সা.) মাধ্যমে পৃথিবীতে শান্তির বাতাস প্রবাহিত হয়েছে।
কতই না অতুলনীয় ছিল মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনাদর্শ। হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, হজরত আবু হুরায়রাহ রাদিয়াল্লাহ আনহু বর্ণনা করেন, ‘একদা মসজিদে এক মরুচারী বা বেদুঈন আসে আর সেখানেই প্রস্রাব করতে বসে পড়ে। লোকজন তার দিকে ধেঁয়ে আসে বা ছুটে যায়। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লোকদের বারণ করে বলেন, একে ছেড়ে দাও আর সে যেখানে পেশাব করেছে সেখানে পানির বালতি ঢেলে দাও। তোমরা লোকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সৃষ্টি হয়েছ, কাঠিন্যের জন্য নয়।’ (বুখারি)
হজরত আবু বাকারা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যায়ভাবে কোনো অমুসলিম নাগরিককে হত্যা করবে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’ (মুসনাদে আহমদ)। এছাড়া মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এটিও বলেছেন, ‘তোমরা মজলুমের বদদোয়া থেকে বেঁচে থেকো, যদিও সে কাফির হয়। তার মাঝখানে আর আল্লাহর মাঝখানে কোনো পর্দা নেই (অর্থাৎ তার বদদোয়া দ্রুত কবুল হয়ে যায়)’ (মুসনাদে আহমদ)।
প্রতিবেশির অধিকারের বিষয়েও মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশেষ তাকিদ দিয়েছেন। মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, প্রতিবেশির সাথে সদ্ব্যবহার করা অনেক বড় একটি নৈতিক গুণ। হজরত জিব্রাঈল আলাইহিস সালাম সর্বদা আমাকে প্রতিবেশির সাথে সদ্ব্যবহার করার তাগিদ দিয়েছেন, এমনকি আমার ধারণা হয়, সে তাকে আবার উত্তরাধিকারীই না বানিয়ে দেয়। প্রতিবেশির সাথে সদ্ব্যবহারের গুরুত্ব এত বেশি।
এরপর রয়েছে শাসকের আনুগত্য। এ সম্পর্কে তিনি সবসময় তাগিদ দিয়েছেন আর বলেছেন, শাসকের আনুগত্য করা তোমাদের জন্য অপরিহার্য আর উন্নত নৈতিকতার এটিই দাবি আর সুনাগরিকের হওয়ার দাবি হল, নিজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার আনুগত্য কর। যদি কোন কৃষ্ণাঙ্গ কৃতদাসও তোমাদের আমির নিযুক্ত হয় তাহলে তার আনুগত্য কর, এরপর যে দেশে বসবাস করছ, যেখানকার নাগরিক, সেদেশকে ভালোবাসা সম্পর্কে বলেছেন, ‘দেশ প্রেম ঈমানের অঙ্গ’। এজন্য যেখানে এই নৈতিক চরিত্রের দাবি হল, নিজ কর্মকর্তাদের আনুগত্য করা আর স্বদেশকে ভালোবাসা সেখানে স্মরণ রেখ, এ বিষয়গুলো ঈমানের অঙ্গও বটে। এজন্য একজন মুসলমানকে, যে দেশেই সে বসবাস করুক না কেন-দেশীয় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রেখে বসবাস করা উচিৎ।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আন্তর্জাতিক পর্যায়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্যও বিভিন্ন উপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমাদের কাছে যখনই কোন জাতির কোন সম্মানিত ব্যক্তি আসবে তাকে সম্মান করো।’ (জামিউল মাসানিদ ওয়াল সুনান, ৮ম খণ্ড, পৃ: ৩৫৩)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সম্পর্কে একথা প্রসিদ্ধ ছিল যে, তিনি কোন জাতির দূতকে-ই কোনরূপ কষ্ট দিতেন না। (সহিহ বুখারি) বরং তিনি তার শেষ দিনগুলোতে ওসীয়্যত হিসেবে এই তাগিদ দিয়েছিলেন, তোমাদের কাছে যখনই কোন জাতির কোন প্রতিনিধি আসেন তখন তাকে উপহার-উপঢৌকন ইত্যাদি দিও, যেভাবে আমি দিয়ে থাকি। (সহিহ বুখারি)
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিশ্ববাসীর সংশোধনের কাজ করেছেন। যেখানে না কোন স্কুল ছিল আর না-ই মাদ্রাসা। তিনি বাড়িতে উঠা-বসা, শয়ন-জাগরণ, কথাবার্তা বলায় এবং জ্ঞানার্জনের শিষ্ঠাচার থেকে আরম্ভ করে দেশীয় এবং জাতীয় আর পৃথিবীতে রাজত্বকরার সকল নিয়ম-নীতি অত্যন্ত স্নেহ ও ভালোবাসার সাথে শিখিয়েছেন। মক্কা-মদিনার ছোট-ছোট বাহ্যত দরিদ্র ও অনুন্নত জনবসতিতে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাতে শিক্ষা প্রাপ্তরা নিজেদের যুগে ইরান, রোম, মিশর, সিরিয়া আর দজলা ও ফুরাত নদীর তীরে বসবাসকারীদের অজ্ঞতা ও নিস্পেষণমূলক সমাজ ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করে তাদের মধ্যে জ্ঞান ও তত্ত্বের এমন ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করেছেন যা পরবর্তীতে শত শত বছর ধরে গোটা মানবজাতীকে সরল-সুদৃঢ় পথ প্রদর্শনের কাজ করেছে। তাঁর শিষ্যরা প্রাচ্য ও প্রতীচ্যের জ্ঞান, সাহিত্য এবং ধর্মীয় জগতের চিত্রই পাল্টে দিয়েছেন। বরং যদি একথা বলা হয় তাহলে তা ষোলআনা সত্য ও যথার্থ হবে যে, আজও বিশ্বে মানবীয় সম্পর্কের পবিত্রতাকে বহাল করার আর সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মাঝে ভালোবাসা ও প্রেম-প্রীতির সম্পর্ক গড়ার জন্য মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের শিক্ষা এবং তার আদর্শ ছাড়া আর কোন মাধ্যম নেই।
অশান্ত বিশ্বকে শান্তির ছায়াতলে আনতে হলে চাই বিশ্বনবির আদর্শ অনুসরণ।
মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আদর্শ ও শিক্ষা অনুসরণের ফলেই আমরা লাভ করতে পারি সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি। কেননা এর মাঝেই রয়েছে সর্বপ্রকার কল্যাণ।
লেখক: ইসলামী গবেষক ও কলামিস্ট