ড. ইউনূসের ‘মেগাফোন কূটনীতি’, বিস্মিত ভারত

  • আন্তর্জাতিক ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস (বায়ে) ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস (বায়ে) ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি

গত ৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনার পদত্যাগের পর দেশে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। এতে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে এই সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি ঘটতে শুরু করে।

হাসিনার ভারতে অবস্থান বিরক্তিকর বিষয় হিসেবে রয়ে গেছে পাশাপাশি সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার একটি সাক্ষাতকারও ভারতকে অবাক করেছে। বিবিসির আনবারসান ইথিরাজান এসব বিষয় পর্যালোচনা করে দেখছেন আসলে এই মুহূর্তে ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক ঠিক কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিজ্ঞাপন

শেখ হাসিনাকে ভারতপন্থী হিসেবে দেখা হতো। কারণ তার শাসনামলে গত ১৫ বছরে দুই দেশের মধ্যেই ছিল ভালো সম্পর্ক। কৌশলগত ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ছিল এক অপরের পরিপূরক। এছাড়াও তার শাসনামলে কিছু সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিসহ বাংলাদেশে ভারত বিরোধীদের দমনে তিনি ছিলেন সোচ্চার। যেটি ভারতের নিরাপত্তার জন্যও সহায়ক ছিল।

কিন্তু ভারতে তার আশ্রয় ও তিনি কতদিন সেখানে থাকবেন সে বিষয়ে কোনোরকম বার্তা না থাকায় দুই দেশের মধ্যে থাকা শক্তিশালী সম্পর্কে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে।  

গত সপ্তাহে ভারতের বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) দেওয়া এক সাক্ষাতকারে মুহাম্মদ ইউনূস দিল্লিতে থাকা অবস্থায় কোন ধরণের রাজনৈতিক বিবৃতি দেওয়া থেকে হাসিনাকে বিরত রাখতে ভারতের প্রতি আহ্বান জানান।

সাক্ষাতকারে তিনি বলেন, "ভারতে বসে কোন বক্তব্য নয়, বাংলাদেশে প্রত্যর্পণ না করা পর্যন্ত শেখ হাসিনাকে চুপ থাকতে হবে।"

এই মন্তব্যের মাধ্যমে ড. ইউনূস স্পষ্টতই গত ১৩ আগস্ট শেখ হাসিনার বক্তব্যের কথাই উল্লেখ করেছেন। ওই সময় শেখ হাসিনা ‘ন্যায়বিচার’ দাবি করেছিলেন এবং বলেছিলেন, সাম্প্রতিক ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’, হত্যা ও ভাঙচুরের সাথে জড়িতদের অবশ্যই তদন্ত, চিহ্নিত এবং শাস্তি দিতে হবে।

হাসিনার এই বক্তব্য বাংলাদেশে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছিল এবং এরপর থেকে তিনি (হাসিনা) আর কোনো প্রকাশ্য বক্তব্য বা বিবৃতি দেননি।

শেখ হাসিনাকে (বামে) তার ১৫ বছরের শাসনামলে ভারতপন্থী হিসেবে দেখা গেছে

বর্তমানে দুই দেশের সম্পর্ক নিম্ন পর্যায়ে উল্লেখ করে ওই সাক্ষাতকারে তিনি আরও বলেছেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতি করতে ভারত-বাংলাদেশ একসঙ্গে কাজ করবে।

অধ্যাপক ইউনূসের এই বক্তব্যের জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে মন্তব্য করেনি। তবে দেশটির কর্মকর্তারা “বিচলিত” বলে জানা গেছে।

ভারতীয় একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেছেন, “ভারত অপেক্ষা করছে এবং বাংলাদেশের চলমান ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর রাখছে। ঢাকা থেকে আসা সরকারি মতামত ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের প্রকাশিত মতামত বিবৃতিগুলোকে নোট করছে ভারত।”

ড. ইউনূসের কূটনীতিকে “মেগাফোন কূটনীতি” হিসাবে বর্ণনা করে সাবেক ভারতীয় কূটনীতিকরা বলছেন, ইউনূসের এই “মেগাফোন কূটনীতিতে” তারা বিস্মিত হয়েছেন। এর মাধ্যমে মিডিয়ার মাধ্যমে বিতর্কিত দ্বিপাক্ষিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করছেন ড. ইউনূস।

ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীনা সিক্রি বলেছেন, "ভারত অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে কথা বলার জন্য এবং বাংলাদেশ ও ভারতের সকল উদ্বেগ নিয়ে আলোচনা করার জন্য নিজের প্রস্তুতির ইঙ্গিত দিয়েছে।"

অবসরপ্রাপ্ত এই কূটনীতিক আরও বলেছেন, দু'দেশের মধ্যে যে সমস্যার রয়েছে সেসব বিষয় নিয়ে শান্ত আলোচনা হতে পারে। কিন্তু কিসের ভিত্তিতে তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তা স্পষ্ট নয়।

তবে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ সমালোচনা প্রত্যাখ্যান করেছে।

সমালোচনা যেকোন বিষয় নিয়েই হতে পারে উল্লেখ করে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বিবিসিকে বলেছেন, “ভারতীয় নেতারা কি কোনো মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন না? ড. ইউনূসকে যদি নির্দিষ্ট বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, তিনি অবশ্যই তার মতামত প্রকাশ করতে পারেন। আপনি যদি সমালোচনা করতে চান তবে যেকোনো বিষয়েই সমালোচনা করতে পারেন”।

 মুহাম্মদ ইউনূস (মাঝে) গত মাসে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

কয়েক সপ্তাহ আগে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং ইউনূসের মধ্যে ফোনালাপ হলেও এখন পর্যন্ত কোনো মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক হয়নি।

ভারতে একটি বিস্তৃত ঐকমত্য রয়েছে বলে মনে হচ্ছে যে— হাসিনা ততক্ষণ ভারতে থাকতে পারবেন যতক্ষণ না অন্য দেশ তাকে সেই দেশে প্রবেশ করতে দিতে রাজি হয়। তবে, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের নবনিযুক্ত প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেছেন, বিক্ষোভের সময় হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে তাকে প্রত্যর্পণের জন্য তারা পদক্ষেপ নিচ্ছেন।

তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “যেহেতু তাকে বাংলাদেশে গণহত্যার প্রধান আসামি করা হয়েছে, আমরা তাকে আইনিভাবে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করার চেষ্টা করব।”

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক অনুরোধ করলেও হাসিনাকে প্রত্যর্পণ করার সম্ভাবনা কম।

এ বিষয়ে ঢাকায় দায়িত্ব পালন করা সাবেক রাষ্ট্রদূত রিভা গাঙ্গুলী দাস বলেছেন, “তিনি এখানে ভারতের অতিথি হিসেবে অবস্থান করছেন। আমরা যদি আমাদের দীর্ঘদিনের বন্ধুর প্রতি মৌলিক সৌজন্য না করি, তাহলে ভবিষ্যতে কেন কেউ আমাদের বন্ধু হিসেবে গুরুত্বের সাথে নেবে।"

ইউনূস তার সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে কোন রকম যোগাযোগ না করারও জন্যও দিল্লির সমালোচনাও করেন।

 শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক মাস পূর্তি উপলক্ষে ৫ই সেপ্টেম্বর হাজার হাজার মানুষ সমাবেশ করে।

সাক্ষাৎকারে তিনি বাংলাদেশ-ভারতের সুসম্পর্কের কথা উল্লেখ করে জানিয়েছেন, নয়াদিল্লিকে অবশ্যই সেই ধারণার বাইরে যেতে হবে যেখানে আওয়ামী লীগ ছাড়া অন্য সব রাজনৈতিক দলকে ইসলামপন্থি এবং শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশ আফগানিস্তানে পরিণত হবে বলে চিত্রিত করা হয়।

কিন্তু তার এই ধারণার সঙ্গে ভারতীয় বিশ্লেষকরা ভিন্ন মত পোষণ করেন।

বীনা সিক্রি বলেন, “আমি এই বক্তব্যের সাথে একেবারেই একমত নই। বাংলাদেশে, আমাদের হাইকমিশনাররা কোনো লেবেল না দিয়েই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কথা বলেন।”

২০০১ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের সময় ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলো থেকে আসা বিদ্রোহীদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য দিল্লি ঢাকাকে অভিযুক্ত করার পর দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। তবে বিএনপি বরাবরই এই অভিযোগ অস্বীকার করে।

অবশ্য বাংলাদেশের অনেকেই উল্লেখ করেছেন, ভারতের উচিত বিএনপির সাথে যোগাযোগ করা, কারণ যখনই (আগামী) নির্বাচন অনুষ্ঠিত হোক, সেই নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে তারা আত্মবিশ্বাসী।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘৫ আগস্ট (হাসিনার সরকার পতনের) পর থেকে কোনো ভারতীয় কর্মকর্তা আমাদের সঙ্গে দেখা করেননি। আমি এর কারণ জানি না”।

উল্টো বিএনপির সঙ্গে ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ও ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা নিয়মিত বৈঠক করছেন।

শেখ হাসিনা ভারত পালানোর পর গণভবন দখলে নেয় ছাত্র জনতা।

হাসিনার পতনের পরে ইসলামপন্থীদের দ্বারা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে এবং এ নিয়ে ভারত ইতিমধ্যে বেশ কয়েকবার উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।

গত কয়েক সপ্তাহে, স্থানীয়ভাবে মাজার নামে পরিচিত বেশ কয়েকটি সুফি মাজারও কট্টরপন্থিরা ভাংচুর করেছে। বাংলাদেশে সুন্নি মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং কট্টরপন্থিরা শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের মাজার ও সমাধিকে অনৈসলামিক বলে মনে করে থাকে।

সিরাজগঞ্জ জেলায় আলী খাজা আলী পাগলা পীরের মাজারের তত্ত্বাবধায়কের স্ত্রী তামান্না আক্তার বলেন, “কয়েকদিন আগে একদল লোক এসে আমার শ্বশুরের সমাধি ভাংচুর করে এবং কোনো অনৈসলামিক অনুষ্ঠান না করার জন্য আমাদের সতর্ক করে।”

বাংলাদেশের ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এএফএম খালিদ হোসেন বলেছেন, যারা ধর্মীয় স্থানকে টার্গেট করবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসলামপন্থি কট্টরপন্থিরা যদি একটি দৃঢ় উপস্থিতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে, তবে বাংলাদেশে তা যত ছোটই হোক না কেন, তা দিল্লির জন্য বিপদের ঘণ্টা বাজিয়ে দেবে।

গত কয়েক সপ্তাহে একজন দণ্ডিত ইসলামি জঙ্গিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ৯ জন সন্দেহভাজন জঙ্গি গত মাসে জেল ভেঙে পালিয়ে যায় — যদিও তাদের মধ্যে চারজনকে পরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

অন্যদিকে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান জসিমুদ্দিন রাহমানীও গত মাসে কারাগার থেকে বেরিয়ে এসেছেন। এই সংগঠনকে ২০১৬ সালে হাসিনার সরকার সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে ঘোষণা করেছিল। ২০১৫ সালে একজন নাস্তিক ব্লগার হত্যার অভিযোগে তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

অন্যান্য বিচারাধীন মামলার কারণে কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরেও তিনি কারাগারে ছিলেন।

সাবেক ভারতীয় হাইকমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাস এটিকে “গুরুতর বিষয়” বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, “গত মাসে বেশ কিছু জঙ্গিকে মুক্ত করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কয়েকজন ভারতের কাছেও পরিচিত।”

সূত্র: বিবিসি