আদম ধর্ম ও এক পরিবারের ৯ সদস্যের ট্রেনে কাটা পড়ে আত্মহত্যার কাহিনী



ওসমান জাফর, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট
ঘটনাস্থল ময়মনসিংহ পৌরসভার কাশর এলাকা

ঘটনাস্থল ময়মনসিংহ পৌরসভার কাশর এলাকা

  • Font increase
  • Font Decrease

১১ জুলাই, ২০০৭ সাল। জামালপুরের জগন্নাথগঞ্জ স্টেশন থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত নিয়মিত চলাচল করে জিএম এক্সপ্রেস ২৫৪ ডাউন নামক লোকাল ট্রেনটি। আজ ট্রেন চালাচ্ছেন ড্রাইভার (লোকো মাস্টার) আব্দুল মতিন এবং মোঃ এনায়েত খান। ময়মনসিংহ পৌরসভার কাশর এলাকার ইটখলায় যখন ট্রেনটি আসে, তখন ঘড়িতে সময় বেলা ৩টা ১০ মিনিট। হঠাৎ ড্রাইভাররা দেখেন, রেলপথের বাঁ পাশ থেকে বেশ কয়েকজন নারী-পুরুষ একে অন্যকে ধরাধরি করে রেল লাইনের দিকে আসছে।

মোট ৯ জন। পুরুষ, নারী, শিশু—সবাই একই পরিবারের সদস্য। রেললাইন ধরে চুপচাপ বসে পড়ে তারা।

প্রথমে ড্রাইভাররা কিছুই বুঝতে পারেননি। পরে খেয়াল করলেন, তারা রেললাইন পার হচ্ছে না, লাইনের ওপরেই বসে আছে। ড্রাইভার হুইসেল দিলেন। তারা লাইন থেকে সরল না। ড্রাইভাররা বুঝতে পারলেন এরা সবাই আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে। ট্রেন ইমার্জেন্সি ব্রেক করালেন। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেছে। চোখের সামনে ৯ জন মানুষকে চাপা দিয়ে ট্রেন বেশ খানিকটা সামনে গিয়ে থামে।

এ বাড়ি থেকে বের হয়েই আত্মহত্যা করে তারা

গাড়ি থেকে নেমে সবাই দেখতে পায়, ২ জন তখনও বেঁচে আছে। একটা বাচ্চা ছেলে এবং একজন তরুণী ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন শরীর নিয়ে ‘পানি পানি’ চিৎকার করছে। স্থানীয় লোকজন তাদেরকে পানি খাইয়ে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করে, কিন্তু তারা পথেই মারা যায়। রেললাইনের কয়েক কিলোমিটার জায়গা জুড়ে ৯ জন মানুষের শরীরের বিভিন্ন অংশের কাটা টুকরো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল। রক্ত, মাংস আর হাড়ে পুরো রেললাইন রক্তাক্ত। গাড়ি থেকে নেমে এই দৃশ্য দেখে একজন ড্রাইভার জ্ঞান হারান।

ঘটনাস্থলে দ্রুত পুলিশ পৌঁছায়। আশেপাশের মানুষদের সাথে কথা বলে নিহতদের নাম ঠিকানা জানতে পারে। মা, ২ ছেলে, ৪ মেয়ে এবং ২ নাতি নাতনী আত্মহত্যা করেছিল একসাথে। এরা হলো—মা হেনা আনোয়ার (৬০), পুত্র আরিফ আনোয়ার (৩০) ও রাহাত আনোয়ার (২২), কন্যা আক্তারী আনোয়ার (৩৫), মুর্শেদা আনোয়ার (২৭), মুন আনোয়ার ওরফে মবি (৩০) ও শবনম আনোয়ার (১৮), নাতি মৌলা আনোয়ার (৮) এবং নাতনী মৌ আনোয়ার (১০)। রেললাইনের পাশেই তাদের বাড়ি।

ওই বাড়ির ভেতর গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কেউ নেই। একটি পাকা ঘর। পাঁচ-ছয়টি কক্ষ। উঠানে কবরের মতো বড় একটি গর্ত খোঁড়া। বারান্দায় লাশ নেওয়ার খাট। রান্নাঘরে কাটা ছোট মাছ পড়ে আছে। তরিতরকারিও কেটেকুটে রাখা হয়েছে।

খুঁড়ে রাখা কবর

একজন সাংবাদিকের বর্ণনায়—মা, ২ নাতি, ৫ মেয়ে এবং এক ছেলের কথা বলা হয়েছে। আসলে ডেডবডিগুলো এমনভাবে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যে, কে ছেলে আর কে মেয়ে সেটা বের করা বেশ কঠিন।

বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ বেশ কিছু ডায়েরি ও হাতে লেখা কাগজপত্র উদ্ধার করে। এগুলোর কিছু বাংলায় আবার কিছু ইংরেজিতে লেখা। এগুলোয় বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য ছিল। ইংরেজিতে একটি ডায়েরিতে লেখা ছিল—“আমরা পৃথিবীর একমাত্র পরিবার যারা স্বাধীন ও আত্মনির্ভরশীল। মোহাম্মদের আইনের বাইরে এবং সব ধর্মের সব কার্যকলাপের বাইরে। তাহলে আমরা কে? আমরা হলাম আদম।”

এ ছাড়া “সবার উপরে আদম সত্য, জুলুমের বিচারের ব্যবস্থা করিব”—ইত্যাদি ধরনের বেশ কিছু মন্তব্য ছিল।

ময়মনসিংহ পৌরসভার স্থানীয় ওয়ার্ড কমিশনার মোজাম্মেল হক ইউসুফ বলেন, এ পরিবারটির সঙ্গে এলাকার কারো সম্পর্ক ছিল না। কেউ তাদের বাসায় যেত না। তারাও এলাকায় অন্য কারো বাসায় যেত না। আশপাশের কোনো পরিবারের সঙ্গে তাদের খারাপ সম্পর্ক বা রেষারেষিও ছিল না।

ঘটনার নেপথ্যে আনোয়ার দরবেশ-প্রতিষ্ঠিত ‘আদম ধর্ম’
আনোয়ার দরবেশের ছোট ভাই, অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য আব্দুল হান্নান থাকেন ময়মনসিংহের গোহাইলখালিতে। সাংবাদিকদের তিনি জানান, “আমার ভাই (আনোয়ার দরবেশ) হার্ট অ্যাটাকে মারা গিয়েছিল। মৃত্যুর পরে ওর পরিবারের বাকি সবাই খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে। তারপর থেকে তারা আমাদের এবং অন্যান্য আত্মীয়দের সাথে দূরত্ব তৈরি করে। কেউ ওদের খোঁজখবর নিতে গেলে দুর্ব্যবহার করে তাড়িয়ে দিত।”

তবে ওই বাসায় যেসব ডায়েরি এবং অন্যান্য বই পুস্তক পাওয়া গেছে সেখানে খ্রিস্টধর্মের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায়নি। ময়মনসিংহ এলাকার চার্চে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই পরিবারটি কখনো কোনো খ্রিস্টধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেয়নি।

আদম বাড়ির নামফলকে লেখা সতর্কবার্তা

এরই মাঝে ঘটনায় যোগ হয় নতুন টুইস্ট। ১৪ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মেদ্দা এলাকায় এক নারী নিজেকে আনোয়ার দরবেশের মেয়ে মবি বলে দাবি করেন। সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “আমার নাম মবি। পেপারে দেখছি আমি মৃত বলে খবর ছাপা হয়েছে। আমি বেঁচে আছি। ওই বাড়িতে আমি ছিলাম না, কিন্তু আমার ছেলে মওলা আর মুন ওই বাসায় ছিল। ওরা খুন হয়েছে।”

মবি এই ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে মানতে নারাজ। তিনি দাবি করেন, এটি সুপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, “আমার ভাই, আনোয়ার মাহিন, অক্সফোর্ড ইনিভার্সিটিতে পড়ত। ২০০৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর অজ্ঞাত কিছু লোক ওকে খুন করে। সেই একই লোকজন আমাদের বাড়ি দখল করতে চায়। তারাই আমার পরিবারের ৯ জনকে ট্রেনের তলায় ফেলে দিয়েছে। তবে মবি তার ছেলে এবং মেয়ের ডেডবডি আনার জন্য ময়মনসিংহে যাননি।

পুলিশ তখন নতুন করে ডেডবডির স্তূপ ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে। এতদিন ধরে যাকে মবির ডেডবডি বলে ধারণা করা হচ্ছিল, এটা তাহলে মবি নয়, মবি বেঁচে আছে। তাহলে এই অজানা মেয়েটি কে?

উদ্ধারকৃত ডায়েরিগুলোর মধ্যে লিনা নামে একজনের ডায়েরিও পাওয়া যায়। ডায়েরি থেকে যানা যায়, লিনা এই পরিবারের সদস্য নয়। লিনার মা আর বাবা আনোয়ার দরবেশের মুরিদ ছিলেন। তারা মাঝে মাঝে এই বাড়িতে এসে থাকতেন। লিনাও আসতেন নিয়মিত। একসময় লিনা আনোয়ার দরবেশের প্রতিষ্ঠা করা ‘আদম ধর্ম’ গ্রহণ করেন এবং নিজের পরিবার ছেড়ে এই পরিবারে এসে থাকতে শুরু করেন। এর আগে বাড়ির ‘কাজের মেয়ে’ হিসেবে তাকে কোনো কোনো সাংবাদিক উল্লেখ করেছিলেন। তবে পরিবারের অন্য কোনো সদস্যের ডায়েরিতে লিনার কথা উল্লেখ নেই।

আনোয়ার দরবেশ সম্পর্কেও বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেল। সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়ার পরে তিনি বেশ ধর্মকর্ম শুরু করেন। এলাকার মানুষ তাকে দরবেশ/ ফকির ও পীর বলে ডাকত। তবে ধীরে ধীরে তার চিন্তাভাবনা প্রচলিত ইসলামিক চিন্তা চেতনার চেয়ে একটু ভিন্ন হয়ে গেল। অন্যান্য ধর্মীয় অনুসারীদের সাথে তিনি আলোচনা করতে বসলে প্রায়ই তর্ক শুরু হয়ে যেত। ১৯৯৫ সালে গ্রামের একটি চায়ের দোকানে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাথে তর্কের একপর্যায়ে হাতাহাতি হয়। চায়ের দোকানের লোকজন তখন তাকে মারধোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়।

এ ঘটনার পর থেকে তিনি বাড়ির বাইরে যাওয়া একেবারে কমিয়ে দেন। পরিবারের অন্যরাও তাই করে। সম্ভবত এরপর থেকে তিনি তার ভক্ত কিংবা মুরিদদের বাদ দিয়ে শুধুমাত্র পরিবারের সদস্যদেরই নিজধর্মে দীক্ষিত করতে শুরু করেন। তার সবচেয়ে বড় শিষ্য হয়ে ওঠে তার বড় ছেলে আরিফ আদম। ২ জন মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধ্যান করতেন ।

আনোয়ার দরবেশ মারা যান ২০০০ সালের ১১ জুলাই ঢাকার একটি হাসপাতালে। মৃত্যুর পরে তার ডেডবডি কিভাবে সৎকার করা হবে সে বিষয়ে তিনি একটি লিখিত নির্দেশনা দিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে বলেছিলেন—“মৃত্যুর পরে আমার কোনো জানাজা দিবা না, গোসল করাবা না, কাফনের কাপড় পরাবা না। যে কাপড় পরে মারা যাব, সেই কাপড়ে সেই অবস্থাতেই আমাকে কবর দিবা। কোনো কবরখানায় আমাকে নিবে না, বাড়ির ভিতরে গর্ত খুঁড়ে আমাকে কবর দিবে। আমার মাথা থাকবে পূর্বে, পা থাকবে পশ্চিমে আর মুখ দক্ষিণ দিকে ঘুরানো থাকবে। যদি অন্য রকমভাবে কবর দাও, তাহলে আমি কঠিন প্রতিশোধ নিব।”

আনোয়ার আদমের বাড়ির হোল্ডিং প্লেট

আদম পরিবার ঠিক এইভাবেই বাবার ডেডবডি কবর দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু স্থানীয় জনগণ তা হতে দেয়নি। পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট এবং স্থানীয় হুজুরদের উপস্থিতিতে তার গোসল, জানাজা এবং কবর দেওয়া হয় ইসলামী পদ্ধতিতে। আদম পরিবারের কেউ সেই জানাজায় উপস্থিত হয়নি।

এই ঘটনার পর আদম পরিবার ঢাকায় চলে যায়। সেখানে বড় ছেলে আরিফ কোনো এক কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন এবং পরিবারের খরচ চালাতেন (একজনের ডায়েরি থেকে দেখা যায়, আরিফ ঢাকার ৫২টা ইউনিভার্সিটির ডিন ছিল!)।

২০০৫ সালে ঢাকায় আরিফ মারা যায় কিংবা খুন হয়। পুরো পরিবার তখন আবার গ্রামে ফিরে আসে। পরিবারের একমাত্র পুরুষ সদস্য তখন রাহাত। তার ওপর দায়িত্ব পরিবারের ভরণপোষণের। তিনি কী ধরনের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন কিংবা তার পরিবারের সদস্যরা অর্থাভাবে না খেয়ে থাকত কিনা, তা জানা যায়নি। তবে তার ডায়েরিতে তিনি লিখেছেন—We are the only family in the world that is independent and selfdepanded. We are the only one family in the world that is totally independed and selfdepended and out of mohamod’s rules.,law and relisious activities and relisions. (ডায়েরির মূল বানান অবিকৃত রাখা হয়েছে)

বড় ভাইয়ের মৃত্যুর পরে বড় বোন আক্তারী আনোয়ার সংসারের হাল ধরেন। তিনি অন্যান্য ভাইবোনের মধ্যে আদম ধর্মের উপাচারগুলো চালু রাখেন। বাবা এবং বড় ভাইয়ের আত্মার সাথে কথা বলার জন্য পরিবারটি তখন নিয়মিত ধ্যান শুরু করে। একসময় তারা সফল হয়। বাবার আত্মা প্রথমে আক্তারীর দেহে ভর করে। আক্তারীর মুখ দিয়ে আনোয়ার দরবেশ তখন আদেশ-নিষেধ দেওয়া শুরু করলেন। (আক্তারী আনোয়ারের ডায়েরির কিছু অংশ তিনি লিখেছেন তার নিজের জবানীতে। কিছু অংশ লেখা আছে তার বাবা আনোয়ার আদমের জবানীতে) ধীরে ধীরে সবার শরীরেই তার বাবা এবং ভাইয়ের আত্মা ভর করে। ডায়েরিতে লিনার ভাষ্যানুযায়ী, এই পরিবার সারাদিন ঘুমাত আর সারারাত জেগে জেগে ধ্যান করত।

প্রত্যেক সদস্যই মৃত্যুর আগে তাদের নিজেদের কথা গুছিয়ে ডায়েরিতে লিখেছিল। অধিকাংশ লেখাই ইংরেজিতে, কিছু আছে বাংলায়। মা হেনা আনোয়ার সম্ভবত লেখাপড়া জানতেন না, তার পক্ষ থেকে এক মেয়ে তার কথাগুলো লিখে দিয়েছেন। এমনকি ২টা বাচ্চাও তাদের কথা ডায়েরিতে লিখেছে। তারা স্বেচ্ছায় লিখেছে নাকি অন্য কেউ তাদেরকে ডিক্টেশন দিয়ে লিখিয়েছে তা পরিষ্কার নয়।

ডায়েরি থেকে জানা যায়, তারা অনেক আগে থেকেই এই আত্মহত্যার প্ল্যান করছিল। এটা তাদের কাছে আত্মহত্যা নয়, এটা তাদের কাছে ছিল বাবা এবং বড় ভাইয়ের সাথে মিলিত হওয়ার উপলক্ষ। জুলাই মাসের ৭ তারিখে তারা একবার আত্মহত্যার পরিকল্পনা করেও পরে বাতিল করে। বাবা আনোয়ার আদমের মৃত্যু দিবস ১১ জুলাই পর্যন্ত তারিখ পেছানো হয় এবং ওইদিনই তারা একসাথে আত্মহত্যা করে। তাদের ভাষায়—‘বাবা এবং বড় ভাইয়ের সাথে মিলিত হতে যায়।’

প্ল্যানচেট : মৃত বাবা ও ভাইয়ের আত্মার সাথে যোগাযোগের সরঞ্জাম

ডায়েরি থেকে উদ্ধারকৃত লেখাপত্র অনুযায়ী—আদম হচ্ছেন বিশ্বের প্রথম মানুষ। তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন। অন্যান্য সব মানুষ আদমেরই অংশ (বনি আদম)। আদম বিভিন্ন সময়ে মারা যান, আবার পরবর্তী সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে জন্মগ্রহণ করেন। বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশে আদম হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আনোয়ার আদম।

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী এবং স্থানীয় বাসিন্দা আবু বকর সিদ্দিকী ওই সময় বাড়িটিতে ঢুকতে পেরেছিলেন এবং কিছু ছবি তুলতে পেরেছিলেন। প্রথম ছবি বাদে এই লেখায় ব্যবহৃত সব ছবিই তার তোলা। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে—বাড়ির জানালায় সাইনবোর্ডের মতো করে একটি হোয়াইট বোর্ড টানানো। সেখানে মার্কার পেন দিয়ে ভুল গ্রামারের ইংলিশে কিছু কথা লেখা আছে। ভাবানুবাদ করলে সম্ভবত এইরকম দাঁড়ায়, “এটা আদমের বাড়ি। বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা হচ্ছে আদম। সবার উপরে আদম সত্য। এই বাড়িতে কেউ ঢুকবে না এবং কেউ কিছু টাচ করবে না। যদি কেউ আমাদের আদেশ অমান্য করে বাসায় ঢোকো, তাহলে আমরা প্রতিশোধ নিব। আদেশক্রমে-আদমেরা।”

বোর্ডের উপরে হেডলাইন লেখা ‘এডামস হোম’ এবং নিচে তারিখ লেখা—১১ জুলাই ২০০৭। আবু বকর সিদ্দিকীর ভাষ্যে জানা যায়, বাসার ভেতরে একটি রুমের ছাদে বেশ কয়েকটা দড়ি ঝোলানো ছিল। সম্ভবত ওরা প্রথমে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করার প্ল্যান করেছিল। আরেকটি ছবিতে দেখা যায়, খাটের ওপরে চেয়ার রাখা। সম্ভবত গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল।

ট্রেনে কাটা পড়ার আগে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যার প্রস্তুতি

অন্য ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটি রুমের ভিতরে মোমবাতি, কাগজ এবং কিছু থালাবাসন রাখা। দৃশ্যটা দেখে মনে হতে পারে কেউ রান্নাবান্না করছিল। আবার রান্নাবান্না বাদে অন্য কোনো স্পিরিচিয়াল কাজেও কেউ এগুলো ব্যবহার করে থাকতে পারে। মৃত ব্যক্তির আত্মার সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য প্লানচেট এবং কাগজ ব্যবহৃত হয়।

বেশ কিছুদিন পুলিশের হেফাজতে লাশগুলো (ডেডবডির ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন অংশগুলো) থাকলেও সেগুলো কেউ নিতে আসেনি। অবশেষে আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলামের কাছে সেগুলো হস্তান্তর করা হয়। আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম মুসলিম রীতি মেনে দাফন সম্পন্ন করে।

এই ঘটনার আগে বা পরে আর কেউ কখনো আদম ধর্ম সম্পর্কে কথা বলেনি কিংবা আদম ধর্মের অনুসারী হওয়ার দাবি করেনি।

আদম ধর্ম প্রতিষ্ঠা ও অনুসারীদের আত্মহত্যার বৈজ্ঞানিক কারণ
কলকাতার সাইকোলজিস্ট প্রফেসর নাসিমা সেলিম এই ঘটনা নিয়ে একটি থিসিস পেপার লেখেন। তিনি সকল তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনা করে দাবি করেন, আদম ফ্যামিলি Shared Delusion অথবা Shared Psychotic Disorder (SPD) নামক মানসিক রোগে ভুগছিল। পরিবারের খারাপ আর্থিক অবস্থা, এলাকাবাসীর অপমান ইত্যাদি কারণে আনোয়ার দরবেশ সম্ভবত সিজোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং নিজেকে তিনি আদম দাবি করা শুরু করেন। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা যেহেতু তার প্রতি খুব নির্ভরশীল ছিল, তাই তার সব কথা বিশ্বাস করল। নিজেরাও হয়ে উঠল আদম ধর্মের অনুসারী। এক মেয়ে যখন দাবি করলেন, আমার শরীরে আদমের আত্মা ভর করেছে, তখন সবাই তাকে বিশ্বাস করল, বাকিদের শরীরেও আদমের আত্মা আসতে শুরু করল। শুধুমাত্র মেজো মেয়ে মবি—শক্ত মানসিকতার ছিলেন বলে তিনি শেয়ারড ডিলুশনের শিকার হননি। অন্য সবাই দুর্বল মানসিকতার বলে সবার শেয়ার্ড ডিলুশন হয়েছে।

নাসিমা সেলিম তার থিসিসে দেখান—বড় মেয়ে আক্তারীর বিবাহবিচ্ছেদ হয়েছিল। মুর্শেদা এবং শবনমের বয়স হয়ে গেলেও বিয়ে হচ্ছে না। প্রচলিত অর্থে তাদের সামনে সুনিশ্চিত কোনো ভবিষ্যত ছিল না। তাই তারা মানসিকভাবে ছিলেন দুর্বল ও ভেঙে পড়া। অন্যদিকে মবির বিয়ে হয়েছিল, ২ বাচ্চা নিয়ে সুখের সংসার তার। এ নিশ্চয়তায় তিনি মানসিকভাবে অন্যদের চেয়ে সবল ছিলেন।

বড় ছেলে আরিফ মানসিকভাবে খুব একটা সুখী ছিলেন এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। অন্যদের ডায়েরি থেকে তার এক প্রেমিকার উল্লেখ পাওয়া যায়, যার নাম ফাতেমা। সেই ফাতেমাকেও আদম ধর্ম সম্পর্কে জানানো হয়েছিল, কিন্তু ফাতেমা আদম ধর্ম গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে নিজের প্রেমিকা এবং পরিবারের মধ্যে সম্ভাব্য টানাপোড়েনের আশঙ্কায় আরিফ সম্ভবত মানসিকভাবে অশান্তিতেই ছিলেন। শেয়ার্ড ডিলুশন, সিজোফ্রেনিয়া কিংবা অন্য যে কোনো মানসিক রোগের জন্য যা সুবিধাজনক অবস্থা।

প্রফেসর নাসিমা সেলিম

এছাড়া প্রফেসর নাসিমা সেলিম এই রোগকে সম্ভাব্য Folie a` famille বলে চিহ্নিত করেছেন। ‘ফলি এ ফ্যামিলি’ রোগে সাধারণত পরিবারের সদস্যরা অদ্ভুত আচরণ শুরু করে। বিশেষত একজন সদস্যের কোনো অস্বাভাবিক প্রবণতা অন্যদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। ২০০৮ সালে সুইডেনের উরুসুলা এরিকসন রাস্তায় বের হয়ে ট্রাকের নিচে চাপা পড়ার চেষ্টা করেন। ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। একটুপরেই তার যমজ বোন সাবিনা এরিকসনও একইভাবে হাইওয়েতে বের হয়ে গড়ির সাথে ধাক্কা খাওয়ার চেষ্টা করেন। ভাগ্যক্রমে তিনিও বেঁচে যান। পুলিশ তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। সাইকোলজিস্টরা তাদের ফলি এ ফ্যামিলি রোগের শিকার বলে চিহ্নিত করে।

২০১৬ সালে অস্ট্রেলিয়ায় ৫ সদস্যের একটি পরিবার বাড়ি থেকে বের হয়ে ১৬০০ কিলোমিটার দূরে চলে যান উদ্দেশ্যহীনভাবে। তাদের কারো একজনের মনে হচ্ছিল, বাড়ি থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই ভালো। বাকিরাও প্রভাবিত হন। তারাও ফলি এ ফ্যামিলি রোগে আক্রান্ত ছিলেন।


আরো পড়ুন ➥ গত শতকের সবচেয়ে নৃশংসতম গণ-আত্মহত্যার কাহিনী

পাখিরা সংকটাপন্ন



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,
বিলুপ্তপ্রায় তালগাছ ও বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা। ছবি: এবি সিদ্দিক

বিলুপ্তপ্রায় তালগাছ ও বাবুই পাখির শৈল্পিক বাসা। ছবি: এবি সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলার পাখিরা এখন সংকটাপন্ন। এ কথার মানে বিপদগ্রস্থ। এক সময় পাখির কলকাকলীতে গ্রামবাংলার মানুষের ঘুম ভাংলেও এখন আর গ্রাম বাংলার আনাচে-কানাচে আগের মত ব্যাপকভাবে পাখির ডাক আর শোনা যাচ্ছে না। কালের আবর্তে গ্রাম-বাংলার প্রকৃতি থেকে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে পাখি।

নির্বিচারে বৃক্ষ নিধনের মাধ্যমে পাখির আবাসস্থল ধ্বংস ও বিভিন্ন ফসলের ক্ষেতে প্রয়োগ করা কীটনাশকের প্রভাবে এসব পাখি আজ বিলুপ্ত প্রায়। বিশেষ করে জাতীয় পাখি দোয়েল, বাবুই, মদনটাক, ঘুঘু, ময়না, শালিক, টিয়া, টুনটুনি, কাঠটোকরা, শ্যামা, কোকিল, চোখগ্যালো, ডাহুক, সারস, মাছরাঙা, মৌটুসি, প্যাঁচাসহ আরো অনেক পাখিকে আর দেখা যায় না।

শোনা যায়না এসব পাখির মধুর ডাক। আগে রাতের ঘুম ভাঙতো পাখির কলতানে অথচ এখন যান্ত্রিক যুগে ঘুম ভাঙে যানবাহন ও মাইকের শব্দে। রাতের প্রতিটি প্রহরে ডাকতো পাখি কিন্তু এখন প্রহর জানার যেন কোন উপায় নেই।

এমনকি বলাবাহুল্য যে, বর্তমান প্রজন্ম এসব পাখি চিনেই না, এসব পাখির ডাক শোনেনি কোন দিন। ফলে কিশোর-কিশোরদের কাছে এসব পাখি হয়ে যাচ্ছে গল্প আর ইতিহাস। অবাক লাগে এদেশের জাতীয় পাখি দোয়েল সেটিও আজ বই অথবা ছবিতে দেখে পরিচিত হয় শিশু-কিশোররা। তারা কখনো দেখেনি মুক্ত আকাশে উড়ান্ত এসব নামকরা পাখি, শোনেনি পাখির ডাকও।

শৈল্পিক বাসা তৈরি করছে বাবুই পাখি। ছবি: এবি সিদ্দিক

বলা যাক - বাবুই পাখির কথা। নিপুণ শিল্পকর্মে গড়ে তোলা কুঁড়ে ঘর সদৃশ্য দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখি বিখ্যাত। চিরচেনা বাবুই পাখির স্বাধীনতা আর সুখ দুই-ই আজ হুমকির মুখে। বসবাস উপযোগী পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে শৈল্পিক বাসার কারিগর বাবুই । মাত্র এক যুগ আগেও বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বত্র চোখে পড়তো বাবুই পাখি। গ্রাম বাংলার মাঠের ধারে, পুকুর কিংবা মাঠের পাড়ে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ হারিয়ে গেছে ইটভাটার আগ্রাসনে। তেমনি হারাতে বসেছে প্রকৃতির শিল্পী পাখির ভোরবেলার কিচিরমিচির সুমধুর ডাকাডাকি আর উড়াউড়ি।

এখন আর সারিবদ্ধ প্রহরী তালগাছের পাতায় ঝুলতে দেখা যায় না তাদের শৈল্পিক বাসা। কিচির মিচির শব্দে মুখর হয় না গ্রামবাংলার জনপদ। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, কীটনাশকের ব্যবহার, শিকারিদের নানা কৌশলের পাখি শিকার, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এ পাখি বিলুপ্ত হতে বসেছে। তাছাড়া সেই তালগাছের সারিও আজ খুব একটা চোখে পড়ে না।

সচেতনদের মতে, কৃষককূল কীট দমনে ফসলের ক্ষেতে কীটনাশক প্রয়োগ করে, এতে করে পাখির খাদ্য ফড়িং, ফুতি, প্রজাপতি, মশা, লেদা পোকা, গোয়ালি সহ বিভিন্ন প্রকার কীটপতঙ্গ আক্রান্ত হয় বা মারা যায়। আর এসকল মরা বা আক্রান্ত কীট খেয়ে পাখি মারা যাচ্ছে।

পশ্চিম হাইল হাওর এলাকার প্রায় সত্তর বছরের কৃষক ফজর আলী বললেন, আমরা আগে জমিতে কীটনাশক দিতাম না। ফলে সে সময় মাঠেঘাঠে হরেক রকম পাখি নেচে বেড়াতো। আমাদের ফসলী মাঠে পাখির অবাধ বিচরণের ফলে অতিষ্ঠ হয়ে মাঠে পাহারায় বসতে হতো, আবার কখনো নির্দ্দিষ্ট সময়ের আগেই ফসল ঘরে তুলতে হতো। আজ আর সেসব পাখি দেখা যায় না, পাখির ডাক শোনাও যায়না।

;

পরার্থে উৎসর্গিত হোক ঈদের আনন্দ



মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
পরার্থে উৎসর্গিত হোক ঈদের আনন্দ

পরার্থে উৎসর্গিত হোক ঈদের আনন্দ

  • Font increase
  • Font Decrease

আনুমানিক শতবর্ষ আগে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন ‘‘জীবনে যাদের হররোজ রোজা ক্ষুধায় আসে না নিদ/ মুমুর্ষ সেই কৃষকের ঘরে এসেছে কি আজ ঈদ?'' কবিতা রচনার পটভূমি ছিল ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন ব্রিটিশ-বাংলা। আজকের পটভূমিতেও কবিতাটি এতটুকু প্রাসঙ্গিকতা হারায় নি।

কারণ, একদিকে ঈদের আনন্দে ভাসছে মানুষ। আবার আরেকদিকেই চলছে চাপা হাহাকার। প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির দ্বৈরথ তীব্রভাবে বিদ্ধ হয়েছে বহু মানুষে আনন্দ, উপভোগ, উৎসব ও উদযাপন।

অনেক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির পরেও একথা সত্য যে সমাজে বৈষম্য কমেনি। সম্পদের বণ্টন সুষম হয়নি। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মানুষের মধ্যে অনেকেরই স্বাভাবিক জীবনধারণ করতেই নাভিশ্বাস চলছে।

মুদ্রার আরেক পিঠে কেনাবেচা চলছে লাখ টাকার পাঞ্জাবি, বাহারি উপহার, অঢেল টাকাপয়সার সয়লাব। গণমাধ্যমের সংবাদে জানা গেছে, এবার ঈদ উপলক্ষে হরেক রকমের পাঞ্জাবি এসেছে। একেকটির দাম একেক রকম। কাপড়ের মধ্যেও আছে বিস্তর ফারাক। রাজধানীতে পোশাকের বিভিন্ন শোরুম ঘুরে একটিতে এমন একটি পাঞ্জাবি পাওয়া গেল, যেটির দাম ৭৯ হাজার টাকা। রাজধানীর গুলশান-১ নম্বরে এক ফ্যাশন ডিজাইনেট শোরুমে দেখা মিলল ‘সবচেয়ে দামি’ এই পাঞ্জাবির।

পলিনোজ জর্জেটের ওপর সূক্ষ্ম সেলাইয়ে জামদানির নকশা করা এই পাঞ্জাবি মাত্র একটি আনা হয়েছে। ‘আরোগ’ নামের একটি ব্র্যান্ডের জন্য এই পাঞ্জাবি তৈরি করা হয়েছে ভারতে। পাঞ্জাবির গায়ে থাকা মূল্য ৭৫ হাজার টাকা। তবে এর সঙ্গে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) যোগ করলে এটির মোট দাম দাঁড়ায় ৭৯ হাজার টাকা।

এমন এক পাঞ্জাবির টাকায় কয়েকটি পরিবারের মাসের খরচ চলে যাওয়ার কথা। বিশেষত সদ্য প্রবহমান দারুণ গরমে গ্রামবাংলার বিশাল কৃষকগোষ্ঠী যে নিদারুণ কষ্টে নিপতিত হয়েছে, তাদের কাছে এই গৌরবময় পাঞ্জাবির সংবাদ বজ্রাঘাত-সম। যে শ্রমিক ও দিনমজুর রোজার চরম কষ্টের পর সামান্য কটি টাকায় পরিবারপরিজনের মুখে ঈদ আনন্দের হাসি ফুটাতে লবেজান, তার কাছে দামি পাঞ্জাবির খবর তৃপ্তির বদলে কষ্ট বাড়ায়।

সামর্থ্যানুযায়ী মানুষ খরচ করবে, এতে কোনো অন্যায় নেই। কিন্তু সেই খরচ যদি হয় শুধুমাত্র আত্মসুখ কবলিত, তাহলে একটি নৈতিক চাপ থেকে যায়। বরং যে খরচে নিজের পাশাপাশি সমাজের বহু মানুষের মঙ্গল নিহিত থাকে, তেমন খরচই কল্যাণকর।

কবিতায় সবাই পড়েছি, "আপনারে লয়ে বিব্রত রহিতে আসে নাই কেহ অবনী পরে/সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে।" আরেকটি কবিতায় বলা হয়েছে, "আপনা রাখিলে ব্যর্থ জীবন সাধনা/ জনম বিশ্বের তরে পরার্থে কামনা।"

কবিতাগুলো এমনিতেই রচিত হয়নি। সামাজিক প্রয়োজনে ও মানবিক কল্যাণেই কবি আরো বলেছেন, "আত্মসুখ অন্বেষণে আনন্দ নাহিরে/বারে বারে আসে অবসাদ/পরার্থে যে করে কর্ম তিতি ঘর্ম-নীরে/সেই লভে স্বর্গের প্রসাদ।"

অতএব, পরার্থে জীবন উৎসর্গ করার মাধ্যমে মানবজীবন সার্থকতায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সমাজের কল্যাণে নিজেদের নিঃশেষে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যে আছে পরম সুখ, অনির্বচনীয় আনন্দ ও অপরিসীম পরিতৃপ্তি।

অন্যের উপকার সাধনই তাই সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত। মানুষ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল বলে তাকে সমাজবদ্ধভাবে বাস করতে হয়। এজন্য পরস্পর প্রীতি ও ভালােবাসা, নির্ভরতা ও সহযােগিতার পরিবেশ মানুষ নিজের প্রয়ােজনেই সৃষ্টির গােড়া থেকে গড়ে তুলেছে।

শুধু পরিবার বা সমাজ নয়, রাষ্ট্র নয়, সমগ্র পৃথিবী ও রাষ্ট্রপুঞ্জ এবং জাতিগােষ্ঠী পরস্পর সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্য, নির্ভরতা ও সহযােগিতার মধ্যে বাস করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। কারণ একজন মানুষ যেমন সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে বাস করতে পারে না, তেমনি পৃথিবীর বৃহৎ মানবগােষ্ঠীও পরস্পর নির্ভরশীলতা ছাড়া বাস করতে পারছে না।

এমন একটি বৈশ্বিক সমাজে আমরা নিজেদের নিয়ে আত্মকেন্দ্রিকভাবে, শুধু নিজের সুখ-শান্তির কথা চিন্তা করে বাস করতে পারব না। প্রকৃতপক্ষে, মানুষ শুধু ভােগ-বিলাস ও স্বার্থের জন্যেই জন্মগ্রহণ করে নি। পরের কল্যাণে জীবনকে উৎসর্গ করার মাঝেই তার জীবনের চরম ও পরম সার্থকতা। ঈদের সময় এই মনোভাবই সবার মধ্যে জাগ্রত হোক। ঈদ মোবারক।

;

ঠোকর দিয়ে খাদ্য সংগ্রহ করে ছোট হলদেকুড়ালি



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,
গাছের ডালে মুখোমুখি ছোট হলদেকুড়ালি দম্পতি। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

গাছের ডালে মুখোমুখি ছোট হলদেকুড়ালি দম্পতি। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

গাছে গাছে গাছের গায়ে ঠোকর দিয়ে বেড়ানো একটি বিশেষ প্রজাতির পাখির নাম ছোট হলদেকুড়ালি। এরা এক ধরণের কাঠঠোকরা জাতীয় পাখি। এদের ইংরেজি নাম Lesser Yellownape এবং বৈজ্ঞানিক নাম Picus chlorolophus। দেশের বিরল আবাসিক পাখি হিসেবে এরা পরিচিত।

বিরল আবাসিক পাখি -এ কথাটার অর্থ হলো – পাখিটিকে সচরাচর দেখা যায় না। আর যদিও বা দেখা যায় তারপরও খুবই কম সংখ্যায় দেখা যায়।

প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক বলেন, ছোট হলদেকুড়ালি বাংলাদেশসহ ভারত, শ্রীলঙ্কা, চীন, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, কম্বোডিয়া, লাওস, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বাস করে। ওরা সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের মিশ্র চিরসবুজ বন ও সুন্দরবনের বাসিন্দা। এছাড়া চা-বাগানেও দেখা মেলে। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট পারিবারিক দলে বিচরণ করে। চোখা চঞ্চুর মাধ্যমে গাছের বাকল থেকে পিঁপড়া, উইপোকা ও গাছ ছিদ্রকারী পোকা সংগ্রহ করে খায়। তবে রসাল ফলও খেতে পারে। সচরাচর নীরব, মাঝেমধ্যে নাকি সুরে ‘পি-য়া...’ শব্দে ডাকে।

পাখিটির শারীরিক গঠন সম্পর্কে তিনি বলেন, দেহের দৈর্ঘ্য ২৫-২৮ সেন্টিমিটার এবং ওজন প্রায় ৫৭-৭৪ গ্রাম। ঠকঠক শব্দে ডাল ঠোকরানো পাখিটি দেখতে বেশ সুন্দর। পিঠসহ দেহের ওপরটা সবুজাভ হলুদ। সবুজাভ মাথা ও জলপাই ঘাড়ে ছোট্ট সুদৃশ্য হলুদ–ঝুঁটি। লেজ কালচে, থুতনি সাদা ও বুক সবুজাভ। সাদা দেহতলে সবুজ ডোরা। চোখের রং গাঢ় লাল। চোখের চারপাশের ত্বক ধূসর। চঞ্চু কালচে বাদামি। পা ও পায়ের পাতা সবুজাভ, নখ বাদামি।

তিনি আরও বলেন, স্ত্রী-পুরুষে কিছুটা পার্থক্য থাকে। পুরুষের চোখ ও মাথার মাঝে গাঢ় লাল ডোরা থাকে। তাছাড়া একটি গাঢ় লাল রেখা চোখের ওপর দিয়ে চলে গেছে। স্ত্রী পাখির এই ডোরা না থাকলেও গাঢ় লাল রেখাটি চোখের পেছন থেকে ঘাড় পর্যন্ত চলে গেছে।

স্বভাব এবং খাদ্যতালিকা সম্পর্কে এ পাখি বিশেষজ্ঞ বলেন, ছোট হলদেকুড়ালি প্রশস্ত পাতার চিরসবুজ বন, পাতাঝরা বন, পাহাড়ি বনও প্যারাবনে বিচরণ করে; সাধারণত জোড়ায় ঘুরে বেড়ায়; মাঝে মাঝে ফিঙে, ছাতারে ও অন্যান্য পতঙ্গভুক পাখির সহযোগী হয়ে শিকার করতে দেখা যায়। ঠোকর দিয়ে গাছের বাকল থেকে এরা খাদ্য সংগ্রহ করে। খাদ্যতালিকায় রয়েছে পিঁপড়া ও উইপোকা, কাঠ ছিদ্রকারী পোকা, পিউপা ও রসালো ফল।

এপ্রিল থেকে মে প্রজনন মৌসুমে পুরুষ পাখি ঘাড়ের হলুদ–ঝুঁটি খাড়া করে মাথা এপাশ-ওপাশ ঘোরায় ও গাছের ফাঁপা ডালে আঘাত করে ড্রামের মতো শব্দ করে। গাছের ক্ষয়ে যাওয়া ডালে গর্ত করে বাসা বানায়। বাসা বানানো, ডিমে তা দেওয়া ও ছানাদের লালনপালন স্ত্রী-পুরুষ মিলেমিশে করে। ডিম পাড়ে ৩-৫টি, রং সাদা, যা ফোটে ১১-১৪ দিনে। আয়ুষ্কাল ৫-৬ বছর বলে জানান এই পাখি গবেষক।

;

বহু দূর থেকে শোনা যেতো যে মায়াবী পাখির ডাক



বিভোর, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম,
চন্দনা টিয়ার সৌন্দর্য। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

চন্দনা টিয়ার সৌন্দর্য। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

  • Font increase
  • Font Decrease

আকাশের ওই কোণ থেকে মৃদু ভেসে আসলে একটা পাখির ডাক। কিছুক্ষণের মধ্যেই এই ডাকটি ক্রমশ স্পষ্ট হতে লাগলো। চা বাগান বা পাহাড়ি অঞ্চল অধ্যুষিত এলাকায় এই পাখিটি একা কিংবা দলগতভাবে উড়ে চলে। তখন ডাক ছড়ায়। দূর থেকে দূরে।

তবে বর্তমানে এ পাখিটি খুব কম চোখে পড়ে। কালেভাদ্রে হয়তো দেখা যায়। প্রজননজনিত সমস্যা কারণে এ প্রজাতিটি ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়ে পড়ছে।

বিলুপ্ত হয়ে পড়া এ পাখিটি নাম ‘চন্দনা’। কেউ কেউ ‘চন্দনা টিয়া’ও বলেন। পাখির নাম সবুজ টিয়া। তবে চন্দনা টিয়া নামেও উল্লেখ করা হয়। এর ইংরেজি নাম Alexandrine Parakeet বৈজ্ঞানিক নাম Psittacula eupatria দেখতে খুব সুন্দর। সবুজ দেহ। তোতা পরিবারের মধ্যে এ পাখিগুলোই বেশি আকর্ষণীয়। দেহের তুলনায় এদের লেজ অনেকটাই লম্বা। বিচরণ করে শুষ্ক ও আর্দ্র পাতাঝরা বনাঞ্চলে। ম্যানগ্রোভ অরণ্যেও দেখা যায়। এরা বাংলাদেশের বিরল আবাসিক পাখি।

বিশেষ করে ফল এবং বীজজাতীয় শস্য খেতের আশপাশে বেশি নজরে পড়ে। ঝাঁকবেঁধে শস্য খেতে বিচরণ করার কারণে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে এরা। যা খায় তার চেয়ে বেশি অপচয় করে। কৃষকদের সঙ্গে এদের বৈরিতার কারণ ফসল নষ্ট করা নিয়ে। মাঝে মধ্যে এদের একাকী কিংবা জোড়ায় জোড়ায়ও বিচরণ করতে দেখা যায়। কণ্ঠস্বর কর্কশ।

খাবার খেতে ব্যস্ত চন্দনা। ছবি: আবু বকর সিদ্দিক

কয়েক দশক আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে এ প্রজাতিটির সাক্ষাৎ পাওয়া গেলেও ইদানিং যত্রতত্র নজরে পড়ে না। খাঁচায় বন্দী এবং উঁচু গাছ-গাছালির সংকটের কারণে এদের প্রজননে বিঘ্ন ঘটছে। ফলে প্রজাতিটি দেশে ‘মহাবিপন্ন’ হয়ে পড়েছে। এদের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, নেপাল, ভুটান, থাইল্যান্ড, লাওস, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার পর্যন্ত। অত্রাঞ্চলে এই পাখিগুলো ভালো অবস্থানে রয়েছে।

প্রজাতির দৈর্ঘ্য ৫৬-৬২ সেন্টিমিটার। লেজ ২৯-৩২ সেন্টিমিটার। স্ত্রী-পুরুষ পাখির মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। পুরুষ পাখি আকারে কিছুটা লম্বা। তাছাড়া পুরুষ পাখির গলার পেছনে এবং ঘাড়ের পাশে রয়েছে গোলাপি বলয়। থুতনির কালো রেখা গলাবন্ধের সঙ্গে মিশেছে। সব দেহ ঘাস-সবুজ রঙের। কেবল ডানার মধ্য পালকে রয়েছে লালপট্টি। স্ত্রী পাখির ক্ষেত্রে গলার পেছনের গোলাপি বলয় নজরে পড়ে না। থুতনির কালো রেখার উপস্থিতি নেই। যুবক চন্দনার ক্ষেত্রেও এ রকমটি নজরে পড়ে। উভয়ের ঠোঁট গাঢ় লাল। ঠোঁটের ডগা কমলা-লাল। চোখের পাতা কমলা-হলুদ, বলয় নীল।

ফল, ধান, গম, ভুট্টা, ফুলের রস, গাছের কচি পাতা ইত্যাদি। প্রজনন মৌসুম নভেম্বর থেকে এপ্রিল। গাছের প্রাকৃতিক কোটরে বাসা বাঁধে। তবে প্রথম পছন্দ নারিকেল গাছের কোটর। এ ছাড়াও কাঠ ঠোকরার পরিত্যক্ত বাসায়ও ডিম পাড়ে। ডিমের সংখ্যা দুই-চারটি। ডিম ফুটতে সময় লাগে প্রায় তিন সপ্তাহ।

পাখি গবেষক সৌরভ মাহমুদ বলেন, চন্দনা টিয়া বাংলাদেশের ‘মহাবিপন্ন’ আবাসিক পাখি। বাসা করার জন্য বড় গাছের অভাব, গাছে ফোকরের অভাব এবং অবাধে বেচাকেনার কারণে এ টিয়া প্রজাতি কেবল দেশের কয়েকটি জেলায় দেখা যেত। ঢাকায় এ পাখির উপস্থিতি জানার পর থেকে চন্দনা টিয়া নিয়ে গবেষণা ও সংরক্ষণের কাজ শুরু করা হয়। দুই দফায় বাসা করার জন্য কাঠের ও পাইপের তৈরি কৃত্রিম বাসা ঝোলানো হয়, যেখানে এ পাখিটি বাসা করে। কারণ, ঢাকায় বয়সী গাছ কম এবং ফোকরহীন গাছই বেশি।

;