বৃন্দাবনে তাঁবুর মেলা



লেখা ও ছবি: মনিরুল ইসলাম
বৃন্দাবনে তাঁবুর মেলা

বৃন্দাবনে তাঁবুর মেলা

  • Font increase
  • Font Decrease

প্রথম যেবার "আউটডোর বিডি" তাঁবুর মেলা আয়োজন করেছিলো সেদিন ছিল কোজাগরী পূর্ণিমা। সে প্রায় দু’বছর আগের কথা আর এবার বসেছে রাস পূর্ণিমায়। যদিও রাস পূর্ণিমা দিন তিনেক আগে গত হয়েছে তবুও তার রেশ এখনো বিদ্যমান। আগেরবার এই তাঁবুর মেলা বসেছিল পাদ্মহেম ধামে আর এবার গাজীপুরের মাওনার অদূরের ক্যাম্পসাইট ও রিসোর্ট বৃন্দাবনে। তবে মজার ব্যাপার হল এখানেও একটি সাধুসঙ্গ আছে যার নাম “সত্য নিকেতন”।

হিন্দুধর্মের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের কাছে বৃন্দাবন একটি তীর্থস্থান। বৃন্দাবন আর রাস পূর্ণিমা একে অপরের পরিপূরক। রাস পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনেশ্বরী রাধা ও বৃন্দাবনেশ্বর কৃষ্ণা গোপীদের নিয়ে মত্ত হয়ে উঠতেন লীলা খেলায়। আমাদের তাঁবুবাসের উদ্দেশ্য সেরকম কিছু না হলেও, ভ্রামণিকদের সাথে প্রকৃতির কোলে আনন্দময় আড্ডার  সাথে নিভৃতে রাত্রিযাপনই ছিল মুল উদ্দেশ্য।   

বিগত দুবছর ক্যাম্পিং-এর মৌসুম শুরু করেছিলাম আউটডোর বিডি আয়োজিত তাঁবুবাসের মাধ্যমে, এবছরও তার ব্যাতিক্রম হচ্ছেনা। আউটডোর বিডির স্বত্বাধিকারী জুয়েল রানা আগেই ক্যাম্পিং এর দিনক্ষণ জানিয়ে রেখেছিল যাতে করে মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত থাকতে পারি। প্রথমবার একা অংশগ্রহণ করলেও দ্বিতীয়বার নিয়েছিলাম প্রিয়তয়া স্ত্রী কানিজকে। আর এবার নতুন সদস্য হিসেবে যোগ হয়েছে আমার ছোট মেয়ে "প্রকৃতি"। প্রকৃতির সান্নিধ্যে আমার মেয়ে প্রক্ক্রিতির এতাই প্রথম ক্যাম্পিং অভিজ্ঞতা, হ্যামক, তাঁবু , স্লিপিং ব্যাগ এইসব নিয়ে সে খুব উত্তেজিত হয়ে ছিল। তিনজনের সরঞ্জামের লটবহর নিয়ে যাত্রা শুরু হল  ১১ নভেম্বর সকাল ৮ টায়।  ঢাকা ছেড়ে কোথাও যেতে গেলে পথের ভোগান্তির চিন্তায় রাস্তার মত আঁকাবাঁকা ভাঁজ কপালেও ফুটে উঠে , পরিবহন ও রাস্তার কথা চিন্তা করে । তার উপরে যেতে হবে গাজীপুর জেলার  শ্রীপুর উপজেলায়! অনেকগুলো বিকল্প পথ নিয়ে চিন্তা ভাবনা করেও শেষমেষ উত্তরা , টঙ্গী হয়ে গাজীপুর চৌরাস্তা ধরেই যাত্রা স্থীর করলাম। শ্লথগতির উন্নয়নের তোড়জোড়ে রাস্তা ঘাটের অবস্থা ভয়াবহ। অনেক শংকা নিয়ে রওনা হলেও সৌভাগ্যের এলবাট্রস উড়ে এস বসেছিল আমাদের গাড়ির উপর। তাই হবে হয়তো, কেননা অনুমিত সময়ের আগেই মাওনা চৌরাস্তা পৌঁছে গেলাম। তারপর এমসি বাজার থেকে ইউটার্ন নিয়ে অতঃপর বামের রাস্তা ধরে টেঁপির বাড়ীর দিকে রওনা দিলাম । “টেঁপির বাড়ী” নামটার মধ্যে একটা আদর আদর ভাব আছে! এই টেঁপির বাড়ীর এলাকায় অবস্থিত আমাদের ক্যাম্প সাইট “বৃন্দাবন”। কয়েক কিমি এগিয়ে সেই রাস্তা ছেড়ে হাতের ডানের খানিকটা অপ্রসস্থ কিছুটা আঁকাবাঁকা একটা রাস্তা ধরলাম। অসম্ভভ নির্জন, স্নিগ্ধ এবং সবুজে ঘেরা সেই রাস্তা।  রাস্তার দুধারের গাছেরা যেন আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। আচ্ছা গাছেরাও কি মানুষের মত সর্বক্ষণ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকে, সবাইকে ছাড়িয়ে যাওয়ার! নাকি বেঁচে থাকার জন্য যটুকু আলো, বাতাস বা পানির দরকার ততটুকুর জন্যই শুধু প্রতিযোগিতা করে। কি জানি বাপু , ওদের মনস্তত্ত্ব বোঝা আমার কম্ম নয়। যাইহোক দার্শনিক ভাব ছেড়ে গল্পে ফেরা যাক। 

বৃন্দাবনে ঢোকার পথ

রিসোর্টের প্রধান ফটক দিয়ে ঢুকতেই ডান দিকটায় সবুজ ঘাসে মোড়ানো এক প্রস্থ মাঠ। এই মাঠকে ঘিরেই রিসোর্টের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা। বাদিকটায় পরিকল্পিত বন, আর বনের ভিতরে ক্যাম্প সাইট। ইতিমধ্যে অনেকই হাজির হয়েছেন মোটর বাইক, গাড়ী , বাইসাইকেল সওয়ারি হয়ে। রঙ বেরঙের তাঁবু আর হ্যামকে রংধুনুর রঙে সেজেছে পুরো বন। আমর' সময় নষ্ট না করে তাঁবু খাটানোয় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমার মেয়ে প্রকৃতি অস্থির হয়ে আছে হ্যামকে গা এলানোর জন্য তাই হ্যামক টানাতে ব্যাতিব্যস্ত হতে হলো। হ্যামক টানাতে গিয়ে রোপ-৪ এর মাহি ভাইয়ের দেখা পেলাম, তিনি সদ্য ইয়েলা পিক আরোহণ করে দেশে ফিরেছেন । ঊনার থেকে সাহায্য চাইলাম হ্যামক টানাতে। তিনি সহজেই শিখিয়ে দিলেন কিভাবে হ্যামক বাধতে হয়। আগে যে পারতাম না তা নয়, সে ছিল দড়ি পেঁচিয়ে কিছু একটা করা। বোনাস হিসেবে শিখলাম হ্যামকে উঠার সবচেয়ে নিরপাদ পদ্ধতি। আমার মত ঘরকুনোদের ক্যাম্পে আসার ফায়দা হল সবসময় নতুন কিছু জ্ঞান অর্জন।

আমার মেয়ের হ্যামক বিলাস

লাঞ্চ সেরে বড়রা দলপাকিয়ে আড্ডা দিচ্ছি আর ছোটরাও দল বানিয়ে নানাও খেলার ব্যস্ত হইয়ে পরলো। বেলা পরে এলে চারদিকটা একটু ঘুরে দেখবো বলে রওনা হলাম, কিন্ত মাঠের কাছাকাছি আসতেই দেখলাম প্রকৃতি ব্যথা পেয়ে ফুটবল খেলা ক্ষান্ত দিয়ে মাঠের পাশে বসে আছে। আমাকে দেখে তার ব্যথার অনিভুতি গেলো বেড়ে, জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। ক্ষুদে ফুটবলারদের নেতৃত্বে ছিলেন শাহিন ভাই, ঔষধ পত্র নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পরলেন। আমার মেয়ে এর আগে এত বড় ব্যথা কখনো পায়নি। পায়ের বুড়ো আঙ্গুলটা খানিকটা ফুলে উঠেছে, তবে আমি অন্য সময়ের মত বিচলিত হলাম না। কানিজ বরাবরই আমার চেয়ে শক্ত মনের অধিকারী। খেলতে গেলে এরকম একটু আধটু ব্যথা পেতেই হয়। ছোট বেলায় খেলতে গিয়ে আমারা কত ব্যথা পেয়েছি বলে সে এক ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিলো সব।

সন্ধ্যা নেমে এলে বরাবরের মত কবির আর সুজন চায়ের আয়োজনে নেমে পড়লো। ক্যাম্পের জন্য বিশেষায়িত চুলা নিয়ে যাওয়াতে সুবিধা হয়েছে, চাইলেই চা বানিয়ে ফেলা যাচ্ছে। ওদিকে আউটডোর বিডি'র বার্ষিকী সেল শুরু হয়েছে ততক্ষনে। ক্রেতাদের ভিড়ে হট্টগোল লেগে গিয়েছে কিন্তু বিক্রি-বাট্টা আশানুরূপ নয়। অনেকটা আলী হুসেনের মত করে বলতে হয় “ আইয়া খালি হাতায় বাজান, দাম হুইন্না আর কিনে না”।

এর মধ্যেই শাহিন ভাই হাত ধরে নিয়ে গেলেন সত্য নিকেতনের গানের আসরে। সেখানে গদিতে আসীন এই রিসোর্টের স্বত্বাধিকারী বীর মুক্তিযোদ্ধা আমীর হামজা মৃধা। এদিকে গান গেয়ে চলেছেন নুরু পাগলের এক ভক্ত। শুধু ভক্ত নয় সে একজন নুরু পাগলের দর্শনের প্রচারক । আমীর হামজা নিজেও গান লিখেন এবং সুর দেন। একসময় আমীর হামজার মৌলিক কয়েকটা গানও শোনা হলো।  শুভ্র চুল ও শশ্রুশোভিত সফেদ পাঞ্জাবি পরিহিত এক রহস্যময় পুরুষ এই মৃধা সাহেব । জীবন সম্পর্কে তার কিছু নিজস্ব চিন্তা ভাবনা আছে যেগুলো ব্যানার ও ফেস্টুনে লিখে ঝুলিয়ে দিয়েছেন রিসোর্টের বিভিন্ন স্থানে । এমনকি নিজের কবরের স্থানটিও ঠিক করে রেখেছেন আগেভাগেই আধ্যাত্মিক এই লোকটি ।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আমীর হামজা মৃধা

ততক্ষণে সন্ধ্যায় গড়িয়ে রাতের আকাশের দখল চলে গিয়েছে  চাঁদ আর তারাদের হাতে। কিন্তু আমাদের ঘোরা নেশা তখনো মিটে যায়নি, মাহি ভাইকে অনুসরণ করে পিঁপড়ের লাইনের মত করে বনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলেছি আমরা কয়েকজন।  খানিক বাদে  কিছুটা দূরে একটা পুকুর পারে খোলা আকাশের নীচে এসে হাজির হলাম । উদ্দেশ্য মাহি ভাই আমদেরকে তারাদের সাথে পরিচিত করাবেন। পকেট থেকে লেজার পয়েন্টার দিয়ে দেখালেন দ্রুবতারা কিভাবে খুঁজে বের করতে হয়! সপ্তর্ষী মন্ডল এর প্রথম দুটি তারা, পুলহ এবং ক্রতু-কে সরলরেখায় বাড়ালে ধ্রুবতারাকে নির্দেশ করে। দিক নির্ণয়ে এই ধ্রুবতারা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন কালে দিক নির্ণয় যন্ত্র আবিষ্কারের পূর্বে সমূদ্রে জাহাজ চালাবার সময় নাবিকরা এই তারার অবস্থান দেখে দিক নির্ণয় করতো। এটি আকাশের একমাত্র তারা, যেটিকে এক অঞ্চল হতে বছরের যে কোন সময়েই ঠিক এক জায়গায় দেখা যায়। এরপর দেখালেন কালপুরুষ তারামন্ডলী যা দেখতে অনেকটা শিকারীর মত মনে হয়। তার এক হাতে ঢাল আর আরেক হাতে মুগুর, কটিতে রয়েছে খাপ খোলা তলোয়ার। এ সব কিছুই ছিল আমার কাছে নতুন। মাহি ভাই এতো সুন্দর করে দেখালেন একদম অভিভূত হয়ে গেলাম। যদিও জানি কিছুক্ষণ পরেই যদি আমকে এই তারা গুলো আবার খুঁজে বের করতে বলা হয়, আমি পারবো না।

তারা সম্পর্কে বেশ খানিকট আজ্ঞান অর্জন করে ক্যাম্প সাইটে ফিরলাম। খাওয়া দাওয়ার পর শুরু হল ক্যাম্প ফায়ার এবং আড্ডা। শত অনুরোধেও আমাদের মধ্যে লুকায়িত প্রকৃত শিল্পীরা গলা ছাড়লেন না। অগত্যা সুযোগ বুঝে সবুজ ভাই গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলেন । তার গলা যতই বেসুরো হোক, প্রচেষ্টা যখন হৃদয় থেকে উৎসারিত হয় তখন তা হয়ে উঠে মধুর ও স্বপ্নময়- তার জলজ্যান্ত প্রমাণ সবুজ ভাই। যাইহোক তার গান নিয়ে বেশী কিছু বলা যাবে না। এদিকে তিনি ম্যাসেঞ্জার গ্রুপে আগেই হুমকি দিয়ে রেখেছে যে তার সংগীত প্রতিভা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে তাকে আং ফ্রেং (মানে ফেসবুকে আনফ্রেন্ড করে দিবে, সান্দাকফু ট্রেকে তিব্বতি ও ভুটিয়া ভাষা রপ্ত  করে এসেছে সে) করে দিবে । পরিশেষে পরিত্রাতা হিসেবে এগিয়ে এলেন বেশ কয়েকজন সত্যিকারের শিল্পী। তাদের সংগীতের মাঝে মাঝেই শিয়াল পণ্ডিতেরা দোহারের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে , যা ছিল আমার মেয়ের কাছে নতুন এক অভিজ্ঞতা। নানান অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে শুরু হলো আমদের তাঁবুবাস।

ক্যাম্প ফায়ার ও রাতের আড্ডা

সকাল হতেই মাহি ভাই স্বরূপে আবির্ভূত হলেন। কিছু রশি ও পেরেক দিয়ে একটা খেলার বোর্ড বানিয়ে ফেললেন। আমার মেয়ের প্রশ্নের উত্তরে বলল তিনি বললেন এটা টিক-ট্যাক-টো খেলা, তবে আমার একটু অন্যভাবে মজা করে খেলবো।  উনার কোন কার্যকলাপ কায়িক পরিশ্রম ছাড়া শেষ হবে, উনার সম্পর্কে পূর্বধারণা রাখে এমন কেউ সাধারণত বিশ্বাস করে না।  তাই আমিও উনার এই সহজ সরল কথায় ভুললাম না, সিধান্ত নিয়ে ফেললাম যে যাই বলুক এই খেলার ভিতরে আমি ঢুকছি না। যখন নিয়মকানুন বুঝিয়ে দেওয়া হলে তখন আমি যে সঠিক ছিলাম তা বিলক্ষণ বুঝতে পারলাম। যাতে কেউ জয়ী হতে চালাকির আশ্রয় না নেয় সেই বিবেচনায় আমার দায়িত্ব পড়লো বিচারকের।  খেলা শুরু হতেই বিচার বিবেচনা শিকেই তুলে খেলা দেখায় মত্ত হয়ে গেলাম।

খেলা শেষ হতেই তাঁবুর এই মিলন মেলা ভাঙ্গার বিউগলের সুর বেজে উঠলো। নাস্তা সেরে রওনা হতেই হলো সেই চিরচেনা ঢাকা শহরের জীবনে। শত সমস্যায় জর্জরিত এই শহরে, ফিরে আসি, আসতে হয়, ভালোবেসেই আসি, স্টকহোম সিনড্রোমে আক্রান্তের  মত।

   

আমার হাতের পাখা যেন তাদের আরাম দিচ্ছে!



মৃত্যুঞ্জয় রায়, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, সাতক্ষীরা
ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

ছবি: বার্তা২৪, তালপাতার পাখা বিক্রি করছে পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ

  • Font increase
  • Font Decrease

আবু বক্কর (৬২)। বয়সের ভারে অসুস্থ হয়ে তিনি এখন পাকা বিক্রেতা। প্রচণ্ড তাপদাহে মানুষ যখন ঠান্ডা বাতাসের প্রশান্তি খুঁজছে, তখন তিনি গ্রামে গ্রামে গিয়ে তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন।

আবু বক্কর বার্তা২৪.কমকে বলেন, স্ত্রীসহ ছয় মেয়ে নিয়ে আমার সংসার। তবে মেয়েদের বিয়ে দিতে পেরেছি। কিন্তু বয়সের ভারে ঠিকই আমরা একা থেকে গেলাম। শেষ বয়সে গ্রামে গ্রামে তালপাতা পাখা বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছি। শুধু সংসার না, এই টাকায় আমার পায়ের শিরার ব্যথার ওষুধও কিনতে হয়। একবেলা ওষুধ না খেলে চলতে পারি না।

এদিকে, পুরনো ব্যবসার ঋণের বোঝা আর অন্যদিকে অসুস্থ হয়ে ওষুধসহ সংসারের খরচ। শেষ বয়সে তালপাতার পাখাই আমার একমাত্র জীবনসঙ্গী বলেন আবু বক্কর।

তালপাতার পাখা বিক্রি করছেন আবু বক্কর, ছবি- বার্তা২৪.কম

বুধবার (২৪ এপ্রিল) সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার কলাগাছি গ্রামের কবিগানের অনুষ্ঠানে সরেজমিন দেখা যায়, একপাশে তালপাতার পাখা বিক্রি করতে ব্যস্ত ছোট্ট পাঁচ বছরের শিশু মাহমুদুল্লাহ। এই গরমে যখন তার ঘরে থাকার কথা, তখন সে নানা-নানীর সঙ্গে এসে তালপাতার পাখা বিক্রি করছে। কবিগানে বসে থাকা সব শ্রোতার কাছে গিয়ে বলছে, পাখা লাগবে, পাখা! কথা বলতে চাইলেও এ পাশ ওপাশ দিয়ে চলে যাচ্ছে, ক্রেতার কাছে।

এক ফাঁকে তাকে কাছে পেয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়, এই বয়সে পাখা বিক্রি করছো কেন! এ প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে মাহমুদুল্লাহ বলে, প্রচণ্ড গরমে স্কুল ছুটি। তাই, নানা-নানীর সঙ্গে চলে এসেছি মেলায় পাখা বিক্রি করতে। মানুষজন আমার কাছ থেকে যেন বেশি পাখা কেনে (ক্রয়), তাই আমি মেলায় তাদের সঙ্গে এসেছি।

অনেক উৎসাহের সঙ্গে সে বলে, গরমে আমার হাতের পাখায় যেন তাদের আরাম দিচ্ছে! মেলা হলে আমি সেখানে চলে যাই পাখা বিক্রি করতে। ঘোরাঘুরিও হয় আর টাকা ইনকামও হয়। টাকার জন্য বের হয়ে পড়েছি। আমরা পাখা বিক্রি করে পেট চালাই। নানা-নানী বুড়ো হয়ে গেছে। তাই, আমি সঙ্গে এসে তাদের কষ্টটাকে একটু ভাগাভাগি করে নিচ্ছি।

যেখানে প্রচণ্ড তাপে মানুষজন নাজেহাল, সেখানে ছোট্ট মাহমুদুল্লাহ ছুটে চলেছে এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে পাখা বিক্রি করতে। ছোট্ট শিশু হলেও গরম যেন তার কাছে কিছু না, পেটের তাগিদে!

আরেক পাখা বিক্রেতা তালা উপজেলার হরিণখোলা গ্রামের বাসিন্দা ভদ্রকান্ত সরকার (৭০)। ১২-১৪ বছর ধরে এই পেশায় আছেন তিনি।

চলছে তালপাতার পাখার বিকিকিনি, ছবি- বার্তা২৪.কম

শেষ বয়সে পাখা কেন বিক্রি করছেন এমন প্রশ্নের উত্তরে বার্তা২৪.কমকে ভদ্রকান্ত বলেন, চাল কিনে খেতে হয়। খুব কষ্টের সংসার! ছেলে-মেয়ে আছে। তারা তাদের মতো কাজ করে খায়। মা বাবার বয়স হয়ে গেলে ছেলে আর আমাদের থাকে না। আমরা বৃদ্ধ বয়সে কেমন আছি, সেটা জানার সুযোগ তাদের থাকে না। শেষজীবনটা এভাবে পাখা বিক্রি করে কাটিয়ে দেবো। কী আর করবো! কপালে যা আছে, শেষপর্যন্ত তাই হবে। কপালে ছিল, এমন বৃদ্ধ বয়সে গ্রামে গ্রামে পাখা বিক্রি করতে হবে!

;

৪ লাখ বছর আগে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু



ফিচার ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

ছবি: সংগৃহীত, নিউ সায়েন্টিস্ট থেকে

  • Font increase
  • Font Decrease

৪ লাখ বছর আগে রাশিয়ার সাইবেরিয়া থেকে আদিম মানুষের যাত্রা শুরু হয়েছিল বলে নতুন এক গবেষণা থেকে জানা গেছে। এখান থেকে যাত্রা শুরু করে এই গোত্রের মানুষ পরে উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায়।

নতুন এক গবেষণা জানাচ্ছে, সাইবেরিয়ায় নতুন একটি এলাকার সন্ধান পাওয়া গেছে, যেখানে ৪ লাখ ১৭ হাজার বছর আগে হোমিনিনস (Hominins) গোত্রের মানুষের উপস্থিতি ছিল। এই গোত্রের মানুষ ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বাস করতেন। সেখান থেকে তারা উত্তর আমেরিকায় পৌঁছে যায় বলে জানিয়েছেন চেক প্রজাতন্ত্রের এক গবেষক।

১৬ এপ্রিল চেক অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেসের গবেষক জন জেনসেন এক সংবাদ সম্মেলন করে নতুন এ তথ্য প্রকাশ করেন। গবেষণাবিষয়ক সংবাদ সাময়িকী নিউ সায়েন্সটিস্ট এ বিষয়ে একটি খবর প্রকাশ করেছে।

সংবাদ সম্মেলনে জন জেনসেন বলেন, আমরা আগে যে ধারণা করতাম, তারও আগে থেকে হোমিনিনস গোত্রের মানুষ সাইবেরিয়ার ডিরিং ইউরিআখ এলাকায় বসবাস করতেন। ৪ লাখ ১৭ বছর আগে থেকেই তারা এই এলাকায় বসবাস করতে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। তাদের অবস্থান ছিল উত্তর অক্ষাংশে।

তিনি বলেন, আরেকটি আদিম গোত্রের মানুষের সন্ধান পাওয়া যায়, যারা আর্কটিক অঞ্চলে বাস করতেন। ৪৫ হাজার বছর আগে তাদের সন্ধান পাওয়া যায়নি।

 

;

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা



মবিনুল ইসলাম, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

উদাল: রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা

  • Font increase
  • Font Decrease

উদাল, সোনালি হলুদ সৌন্দর্যে মুগ্ধতা ছড়ানো মাঝারি সাইজের বৃক্ষ। পত্রঝরা উদাম শরীরে পুরো গাছজুড়ে শুধুই সোনালি হলদে রঙের ফুল। বসন্তে হলদে পাপড়ি ঝরে রাস্তায় বিছিয়ে দেয় ফুলের গালিচা। প্রকৃতির এক অপর সৌন্দর্য উদাল বৃক্ষ ও তার ফুল।

উদাল আমাদের দেশীয় উদ্ভিদ। এদের প্রিয় আবাস পাহাড়ি এলাকা হলেও আগে সারাদেশেই কমবেশি দেখা যেত। নির্বিচারে গাছ উজাড় হতে থাকায় অন্য গাছের সাথে এ দেশী গাছটিও বিপন্ন। ঢাকার মিরপুর জাতীয় উদ্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেন, বাংলা একাডেমি, ঢাকার রমনা পার্ক, ময়মনসিংহের ব্রহ্মপুত্র তীরের শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন পার্কসহ সমতলের অনেক স্থানে উদাল দেখা যায়। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিশেষ করে বান্দরবান ও কক্সবাজারের মিশ্র চিরসবুজ বন এবং গাজীপুর, ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইলের পাতাঝরা শালবনের স্যাঁতসেঁতে জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে উদাল গাছ দেখা যায়।


উদালের বৈজ্ঞানিক নাম স্টারকুলিয়া ভেলোসা। ইংরেজিতে এটিতে হেয়ারি স্টারকুলিয়া বা এলিফ্যান্ট রোপ ট্রি নামে ডাকা হয়। এ গাছের বাকল থেকে এক প্রকার উন্নতমানের তন্তু পাওয়া যায়। এ তন্তু দিয়ে হাতি বেঁধে রাখার দড়ি বানানো হতো বলেও ইংরেজিতে এমন নামকরণ। আমাদের দেশে স্থানীয়ভাবে এটি চান্দুল নামেও পরিচিত। এই উদ্ভিদ মগ ও মারমাদের কাছে ফিউ বান, গারোদের কাছে উমাক এবং ম্রোদের কাছে নাম সিং নামে পরিচিত।

উদাল ২০ মিটার বা ততোধিক লম্বা হয়। এদের বাকল সাদাটে রঙের। এদের পাতার বোঁটা লম্বা, ফলক বড় ও পাতা খাঁজকাটা, পাতার প্রশাখার আগায় পাতা ঘনবদ্ধ। ফুলগুলি সোনালি হলুদ রঙের, ফুলের ভেতর বেগুনি। এর ফল কাঁচা অবস্থায় সবুজ থাকলেও পাকলে গাঢ় লাল রঙের হয়। বীজের রং কালো। বীজ স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালীর প্রিয় খাবার। তবে মানুষও এর ফল খেয়ে থাকে। বাকল থেকে আঁশ পাওয়া যায়। এ আঁশ দিয়ে দড়ি তৈরি হয়। কাঠ বাদামি রঙের, সাধারণত নরম ও হালকা হয়। এই গাছের কাঠ দিয়ে চায়ের বাক্স বানানো হয়।

উদাল ফল খাচ্ছে ইরাবতী কাঠবিড়ালি। ছবি: তবিবুর রহমান

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বার্তা২৪.কম-কে জানান, এ গাছ দেশের বন-জঙ্গলে প্রচুর হতো। এ গাছের পাতার বোঁটা দিয়ে শরবত বানানো হয়। উঁচু গাছ থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা কষ্টসাধ্য হওয়ায় বড় বড় গাছ কেটে ফেলা হয়। এরপর এর গোড়া থেকে অনেক নতুন নতুন ডালপালা গজালে সেখান থেকে পাতার বোঁটা সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও উদাল গাছ থেকে স্বচ্ছ আঠা পাওয়া যায়। যা দিয়ে কনফেকশনারিসহ নানাবিধ কাজে ব্যবহার করা হয়।

তিনি আরও বলেন, এ উদ্ভিদ বর্তমানে বিপন্ন প্রজাতির। গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ তিনশ উদাল গাছের চারা বিভিন্ন স্কুল কলেজে বিতরণ করেছে। এবারও প্রায় পাঁচশ চারা বিতরণ করা হবে।


ড. জসীম বলেন, উদলের বাকলের শরবত খেলে শরীর ঠান্ডা থাকে। ফুলের বৃন্ত ছেঁচে জলের সঙ্গে চিনি দিয়ে শরবত করে খেলে প্রস্রাবের সমস্যা ও বাতের ব্যথা দূর হয়। তবে খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া উচিত।

রাঙ্গামাটি বনবিভাগের এসিএফ তবিবুর রহমান জানান, উদালের বীজের স্বাদ অনেকটা বাদামের মতো হওয়ায় কাঠবিড়ালির খুব প্রিয়। তবে এ বীজ মানুষও খেয়ে থাকে।

তিনি আরও জানান, ২০১২ সালের বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের তফসিল ৪ অনুযায়ী উদালকে বাংলাদেশের ‘মহাবিপন্ন’ প্রজাতির তালিকাভুক্ত উদ্ভিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

;

বরিশালের শত বছরের ঐতিহ্যের স্মারক শীতলপাটি



এস এল টি তুহিন, করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, বরিশাল
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

বরিশাল জেলার বাকেরগঞ্জ উপজেলার বেশ কয়েকটি গ্রামের পাটিকররা তাদের নিপুণ হাতের তৈরি শীতলপাটির জন্য বিখ্যাত।

উপজেলার দাড়িয়াল ইউনিয়নের কাজলাকাঠী গ্রাম, রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঠালিয়া, রাজাপুর গ্রাম ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো তৈরি হয়, ঐতিহ্যের অনন্য স্মারক দেশ বিখ্যাত শীতলপাটি।

এই উপজেলায় এখন এক হাজারের বেশি পরিবার শীতলপাটি তৈরি করে সংসার চালাচ্ছে।

উপজেলার রঙ্গশ্রী ইউনিয়নের কাঁঠালিয়া গ্রামে প্রবেশ করে যতদূর দু’চোখ যায়, দেখা মেলে পাইত্রাগাছের বাগান। গ্রামীণ সড়কের দুই পাশে দেখা মেলে বড় বড় পাইত্রা বা মোর্তাগাছের ঝোপ। বাড়ির আঙিনা, পরিত্যক্ত ফসলি জমি, পুকুর পাড়, সব জায়গাতেই বর্ষজীবী উদ্ভিদ তরতাজা পাইত্রাগাছ মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে। গ্রামীণ জনপদের আভিজাত্যের স্মারক শীতলপাটি তৈরি হয়, এই পাইত্রাগাছের বেতি দিয়ে।

জানা গেছে, এসব গ্রামে পাইত্রাগাছের আবাদ হয়ে আসছে শত শত বছর ধরে। পাটিকরদের পূর্বপুরুষেরা যে পেশায় নিয়োজিত ছিলেন, আজও সেই পেশা ধরে রেখেছেন বাকেরগঞ্জের পাটিকররা।

এখনো এই সব গ্রামে ‘পাটিকর’ পেশায় টিকে আছে প্রায় এক হাজার পরিবার। আর তাদের সবার পেশাই শীতলপাটি বুনন। ফলে, উপজেলার এসব গ্রাম এখন ‘পাটিকর গ্রাম’ নামে পরিচিত।

সরেজমিন দেখা যায়, কাঁঠালিয়া, রাজাপুর ও গারুড়িয়া ইউনিয়নের সুখী নীলগঞ্জ ও হেলেঞ্চা গ্রামে এখনো গ্রামীণ সড়ক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই ছোট ছোট টিনশেড ও আধাপাকা ঘরগুলোর বারান্দায় নারী-পুরুষ ও শিশুরা মিলে নানান রঙের শীতলপাটি বুনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

কাঁঠালিয়া গ্রামের সবিতা রানীর পরিবারের সবাই মিলে দিনরাত ব্যস্ত সময় কাটান শীতলপাটি তৈরি করতে। একটু সামনে এগুতেই কথা হয়, প্রিয়লাল পাটিকরের সঙ্গে।

তিনি বলেন, পরিবারের পাঁচ সদস্য মিলে একটি পাটি তৈরি করতে কয়েকদিন চলে যায়। প্রতিজনের দৈনিক মজুরি ১০০ টাকা করেও আসে না। তারপরেও কিছু করার নেই। বাপ-দাদার পেশা হিসেবে এখনো শীতল পাটি বুনে যাচ্ছি। একদিকে, এখন গরম বেড়েছে, অপরদিকে, বৈশাখ মাস চলছে। দেশের বিভিন্ন জেলা ও উপজেলায় বৈশাখী মেলায় শীতলপাটির চাহিদা থাকে। তাই, পাইকাররা এসে আমাদের এলাকা থেকে পাটি কিনে নিয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রি করেন।

স্থানীয় পাটিকররা জানান, এখানকার তৈরি শীতলপাটি আন্তর্জাতিক মানের। কিন্তু প্লাস্টিক পাটির কারণে বাজারে শীতলপাটির চাহিদা কমে গেছে। সে কারণে সরকারিভাবে বিদেশে শীতলপাটি রফতানির কোনো ব্যবস্থা করা হলে পাটিকরদের জীবন-জীবিকা ভালো চলতো।

পাশাপাশি শীতলপাটি টিকিয়ে রাখতে হলে সরকারের ক্ষুদ্রঋণ দেওয়া উচিত বলেও মনে করেন তারা। নয়ত এই পেশায় টিকে থাকা দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে মন্তব্য করেছেন কেউ কেউ।

এ বিষয়ে বরিশালের বাকেরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাইফুর রহমান বলেন, উপজেলা প্রশাসন, মহিলাবিষয়ক কর্মকর্তাসহ জাইকা সংস্থার মাধ্যমে উপজেলার পাটিকরদের মধ্যে বিভিন্ন রকম প্রশিক্ষণ প্রদান অব্যাহত রয়েছে। ফলে, নতুন নতুন ডিজাইনের শীতলপাটি তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। পাশাপাশি আমরা তাদের সরকারি বিভিন্ন রকম সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা করছি।

;