রাহুল আনন্দের বাড়িতে আগুন-ভাঙচুর, সপরিবারে ঘরছাড়া

  • বিনোদন ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

রাহুল আনন্দের বাড়িতে আগুন-ভাঙচুর

রাহুল আনন্দের বাড়িতে আগুন-ভাঙচুর

জলের গানের দলনেতা রাহুল আনন্দ দেশের বিনোদন দুনিয়ার জনপ্রিয় মুখ। তার বাড়িতে হামলা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। সোমবার (৫ আগস্ট) তার বাড়িতে থাকা সহস্রাধিক যন্ত্র ভাঙচুর করা হয়েছে। 

স্ত্রী ঊর্মিলা শুক্লা এবং ১৩ বছরের সন্তানকে নিয়ে রাহুল বসবাস করতেন ধানমণ্ডি ৩২ এর সেই বাড়িতে৷ শেখ হাসিনা পদত্যাগের পর দেশে সৃষ্টি হওয়া অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ধ্বংসের মুখে পড়ে আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সব কিছু৷ শেখ মুজিবুর রহমানের ৩২ নম্বরের বাড়িতে আগুন জ্বালিয়ে দেয় দুর্বৃত্তকারীরা৷ সেইসময় রাহুল আনন্দের বাড়িতেও আগুন দেওয়া হয়৷

বিজ্ঞাপন

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ গতবছর বাংলাদেশ ভ্রমণে এসেছিলেন৷ দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থান পরিদর্শন করার সময় সারাদেশে সাড়া পড়ে যায় যখন তিনি এক শিল্পীর বাড়ি ভ্রমণ করতে যান৷ সেই শিল্পী আর কেউ নন, জলের গান ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা রাহুল আনন্দ৷ প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল সেখানে রাহুলের নিজের হাতে তৈরি করা ঐতিহ্যবাহী অসংখ্য বাদ্যযন্ত্রগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন৷ প্রায় ১ ঘণ্টা ৪০ মিনিট আড্ডা গানে সময় কাটে৷ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশংসা পাওয়া সেই রাহুল আনন্দের সাজানো বাড়িটি আর নেই৷

জলের গান ব্যান্ডের গুরুত্বপূর্ণ অনেক গান এবং বাদ্যযন্ত্র সব রাহুল আনন্দের বাড়িতে রাখা ছিল৷ অগ্নিকাণ্ডে তার বাড়ির সবকিছু পুড়ে গেছে৷ সেই বাড়িতেই কাঠের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতেন রাহুল৷ কোনো রকমে পরিবারের সদস্যরা প্রাণে বেঁচে বাড়ি থেকে বের হতে পেরেছে৷

বিজ্ঞাপন

তারা নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার পর দলের সবাই মিলে একটি গান গেয়ে ভিডিও রেকর্ড করেছেন৷ জলের গানের অফিশিয়াল ফেইসবুক পেইজ থেকে সেই ভিডিওটি পোস্ট করে তার ক্যাপশনে ৫ আগস্ট ঘটে যাওয়া সেই ঘটনার বিশদ বর্ণনা করা হয়৷ বার্তা২৪.কমের পাঠকদের জন্য পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

‘স্বপ্নে তুমি দাগ দিও না।
সরলরেখার স্বপ্নে কারো বাঁক দিওনা! বাঁক দিওনা!’

জলের গানের ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরের এই বাড়িটি শুধু রাহুল আনন্দের বসত বাড়ি ছিলোনা; ছিলো পুরো দলটির স্বপ্নধাম, আনন্দপুর। যেখানে তৈরি হয়েছে কত গান, কত সু্র, আর দাদার ভাবনা প্রসূত শত শত বাদ্যযন্ত্র। শুধু তাই নয়। জলের গানের অফিশিয়াল স্টুডিও হিসেবেও ব্যবহৃত হতো বাড়িটি। দলের সকলের দলগত সংগীত চর্চা থেকে শুরু করে, সকল স্টুডিও ওয়ার্ক – রেকর্ডিং, মিক্সিং, এডিটিং এখানেই হতো।

যারা নিয়মিত এই বাড়িতে যাতায়াত করতেন, তারা জানেন যে রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার বাড়িটির সাদা গেটটি সবসময় খোলাই থাকতো। তাতে তালা দেয়া হতোনা। যে কেউ, যেকোনো দরকারে যেন দাদার কাছে পৌঁছোতে পারে সেই ভাবনায়। আর যারাই দিনের যেকোন প্রান্তে এই বাড়িতে এসেছেন, সকলেই একটি চিত্রের সাথে খুব পরিচিত, তা হলো- রাহুল আনন্দ মাটিতে বসে একটি সিরিশ কাগজ হাতে নিয়ে তাঁর নতুন বাদ্যযন্ত্রের কাঠ ঘষছেন।


জলের গানের বাদ্যযন্ত্র। রাহুল আনন্দের বিরাট ভাবনা ও স্বপ্নের দিকে ধাবমান এক নিরন্তর প্রয়াস। আমাদের দেশীয় কাঠে তৈরি, আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্র। শুধুই কি আমাদের? এই দলের? জলের গানের? না! এই প্রয়াস সকল নবীন মিউজিশিয়ানদের জন্য, যারা বিশ্বাস করবে - আমরাও আমাদের বাপ দাদার মতো নিজেদের বাদ্যযন্ত্র নিজেরাই তৈরি করে নিতে পারি! এই প্রয়াস সেই স্বকীয়তার; যার বলে এই দেশের মানুষ গর্বের সাথে বলতে পারে, এই আমাদের নিজেদের বাদ্যযন্ত্রে বেজে ওঠা অনন্য শব্দতরঙ্গ যা কিনা পুরো পৃথিবীর বুকে কেবল এই বাংলাদেশের মাটিতেই ঝনঝন করে বাজে, সুর তোলে, স্বপ্ন দেখায়। যেই স্বপ্নের ঝিলিক সুদূর ফ্রান্স থেকে আরেকজন মিউজিশিয়ানকে আমাদের দেশে টেনে আনে। পুরো পৃথিবীর লক্ষ কোটি মানুষের চোখের আলো পড়ে আমাদের এই দেশে। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের এই বাড়িটিতে।

তবে কি এই ঠিকানায় আবাস হওয়াটাই কিছু মানুষের এত ক্ষোভের কারণ? এত রাগের বহিঃপ্রকাশ? যারা ইতিমধ্যে সেখানে গিয়েছেন কিংবা ফেসবুকে পোস্ট দেখেছেন তারা সকলেই খবরটি জানেন।

হ্যাঁ! - রাহুল আনন্দ ও উর্মিলা শুক্লার, এবং আমাদের সকলের প্রিয় জলের গানের এই বাড়িটি আর নেই। সব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তবে সৃষ্টিকর্তার কৃপায় এবং আশীর্বাদে বাড়ির সকল সদস্য নিজের প্রাণ হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন এবং এখন নিরাপদে আছেন। কিন্তু, রাহুল দা এবং আমাদের দলের সকল বাদ্যযন্ত্র ,গানের নথিপত্র এবং অফিশিয়াল ডকুমেন্টস ছাড়াও, দাদার পরিবারের খাট-পালং, আলনা আর যাবতীয় সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে! সব! সকলের জন্য নিরন্তর ভেবে যাওয়া মানুষটিকে পরিবারসহ এক কাপড়ে তাঁর নিজ ঘর থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। এর প্রভাব হয়তো আজীবন লালিত থাকবে তাঁর সন্তানের মনে; যার বয়স কিনা মাত্র ১৩ বছর – ভাবতেই কষ্ট হয়। এতদিন ধরে তিলতিল করে গড়ে তোলা স্বপ্ন সংসারের সবকিছু দাউদাউ করে জ্বলেছে চোখের সামনে। কিছু মানুষের ক্রোধ এবং প্রতিহিংসার আগুনে!

এই বাদ্যযন্ত্র, গান বা সাজানো সংসার হয়তো আমরা দীর্ঘ সময় নিয়ে আবার গড়ে নিতে পারবো। কিন্তু, এই ক্রোধ আর প্রতিহিংসার আগুনকে নেভাবো কিভাবে! কেন আমরা ভালবাসা আর প্রেম দিয়ে সবকিছু জয় করে নিতে পারি না? যেই স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখি, সেই স্বাধীনতার রক্ষায় যদি একইভাবে এগিয়ে আসতে ব্যর্থ হই, তাহলে চরম নিরাশা, অপমান ও লজ্জায় নিজেদের গানই গেয়ে উঠি এক ভগ্ন হৃদয়ে-

‘কোন ছোবলে স্বপ্ন আমার হলো সাদা কালো?
আমার বসত অন্ধকারে; তোরা থাকিস ভালো!’

সকল প্রাণ ভালো থাকুক। নতুন আগামীর স্বপ্নকে আমরাও অভিবাদন জানাই একইভাবে। কিন্তু, নিজের উল্লাসের চিৎকার এবং সজোর হাততালিতে কারো স্বপ্ন ভেঙে না দেই!

এই গানটি আমাদের এই ঘরে রেকর্ড করা শেষ গান। ভিডিওতে যা দেখছেন, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। উত্তাল সময়ের সাথে আমরাও একাত্ম ছিলাম গানে গানে। এই শেষ কাজটিই তবে সকলের জন্য আনন্দ উপহার।

জয়তু
জলের গান