বিশ্ব খাদ্য দিবস প্রতি বছর ১৬ অক্টোবর পালিত হয়, যেখানে বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা এবং অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করার গুরুত্বকে সামনে আনা হয়। ২০২৪ সালের বিশ্ব খাদ্য দিবসের থিম বা প্রতিপাদ্য হল "Right to Food for a Better Life and a Better Future," (উন্নত জীবন এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য খাদ্যের অধিকার)। খাদ্য শুধু একটি মৌলিক প্রয়োজন নয়, বরং এটি মানুষের মৌলিক অধিকার, যা মানুষকে টিকে থাকতে এবং উন্নত জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজন।
বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৪-এর এই থিম জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (SDG) ২-এর সঙ্গে সম্পৃক্ত, যার মূল লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে "শূন্য ক্ষুধা" নিশ্চিত করা। SDG ২-এর উদ্দেশ্য হলো নিশ্চিত করা যে, পৃথিবীর সব মানুষ বিশেষ করে দরিদ্র এবং ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী পুষ্টিকর এবং নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তিতে সক্ষম হবে।
তবে এই লক্ষ্য অর্জনে প্রয়োজনীয় অগ্রগতি উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর, এবং বিশ্বব্যাপী ক্ষুধার প্রকোপ আরো খারাপের দিকে যাচ্ছে। "শূন্য ক্ষুধা" অর্জনের জন্য দরিদ্রতা, বৈষম্য এবং সম্পদের অভাবের মতো ক্ষুধার মূল কারণগুলোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণও অপরিহার্য।
বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা এখনো একটি গুরুতর সমস্যা, যা ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৭৩৫ মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে প্রভাবিত করেছে। যদিও আগের কয়েক দশকে ক্ষুধা হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সমস্যার মারাত্মক বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে, যা পূর্বের অগ্রগতি অনেকাংশে বাধাগ্রস্ত করেছে। কোভিড-১৯ মহামারি, ক্রমবর্ধমান সংঘাত, অর্থনৈতিক অস্থিরতা এবং জলবায়ু সংকটের প্রভাবে খাদ্য নিরাপত্তা বিশেষ করে নিম্ন আয়ের দেশ এবং সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এই সমস্যার সঙ্গে ব্যাপকভাবে জড়িত, যেখানে ক্ষুধা এবং অপুষ্টির পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সোমালিয়া, ইয়েমেন, দক্ষিণ সুদানের মতো দেশগুলোতে এই অবস্থা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে, যেখানে যুদ্ধ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয় ক্ষুধার মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব অঞ্চলে শরণার্থী ও বাস্তুচ্যুত মানুষদের জন্য খাদ্য প্রাপ্তি অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং তারা মারাত্মক অপুষ্টির শিকার।
আফ্রিকার পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, যেখানে মহাদেশটির মোট জনসংখ্যার ২১% বা ২৮২ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ অপুষ্টিতে ভুগছে। সাব-সাহারান আফ্রিকা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর মধ্যে একটি, যেখানে দীর্ঘস্থায়ী সংঘাত এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দীর্ঘস্থায়ী খরা এবং অনিয়মিত আবহাওয়ার প্রভাবে খাদ্য সংকটের মাত্রা বেড়েছে, যা সেখানে বসবাসকারী জনসাধারণের মধ্যে অপুষ্টির ঝুঁকি আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এর ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারা আফ্রিকায় খাদ্য নিরাপত্তা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ফিলিস্তিন, ইয়েমেন এবং সিরিয়ার পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। ফিলিস্তিনের গাজায় ও ইয়েমেনে চলমান সংঘাতের কারণে দেশটি বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ মানবিক সংকটগুলোর একটির মুখোমুখি হয়েছে, যেখানে প্রায় ১৭ মিলিয়ন মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে ভুগছে। দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধ দেশটির কৃষি অবকাঠামোকে ধ্বংস করেছে, খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, এবং বেশিরভাগ মানুষ খাদ্য সহায়তার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে।
সিরিয়ার পরিস্থিতি একই রকম, যেখানে দীর্ঘকালীন গৃহযুদ্ধ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করেছে, যা খাদ্যের প্রাপ্যতা এবং সরবরাহে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে। শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসকারী লোকজন, যেমন লেবানন এবং জর্ডানের শরণার্থী শিবিরগুলোতে বসবাসকারীরা, মারাত্মক খাদ্য সংকটের সম্মুখীন, যেখানে অপুষ্টি এবং দুর্বল স্বাস্থ্য পরিস্থিতি স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সংকটও ক্ষুধার সমস্যার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ, ১০৮ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ যুদ্ধ, নির্যাতন বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। এই শরণার্থী শিবিরগুলোর বেশিরভাগে প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহের অভাব রয়েছে, যা শরণার্থীদের বিশেষ করে নারীদের এবং শিশুদের মধ্যে অপুষ্টির হারকে মারাত্মকভাবে বাড়িয়ে তুলেছে।
বাংলাদেশের কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোর পরিস্থিতি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। এখানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে, এবং খাদ্য নিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো খাদ্য সহায়তা প্রদান করছে, তবে শরণার্থীরা এখনও পুষ্টিকর খাবারের অভাবে ভুগছে।
ক্ষুধা মোকাবিলায় লিঙ্গ বৈষম্যও একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। পৃথিবীর অনেক অঞ্চলে নারীরা খাবার নিরাপত্তাহীনতার শিকার হয়, কারণ তারা প্রায়ই সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল অবস্থানে থাকে। বেশিরভাগ পরিবারে নারীই প্রধানত খাদ্য সরবরাহকারী হলেও, তাদের ভূমি বা সম্পদে প্রবেশাধিকার কম থাকে।
যখন খাদ্য সংকট দেখা দেয়, তখন নারীরা নিজেদের চেয়ে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দেয়, যা তাদের অপুষ্টির ঝুঁকি বাড়িয়ে তোলে। এছাড়াও, সংঘাত-সংকুল অঞ্চল এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে নারীরা যৌন হয়রানি এবং নির্যাতনের শিকার হয়, যা তাদের ক্ষুধা এবং অপুষ্টির সমস্যাকে আরও গভীর করে তোলে।
জলবায়ু পরিবর্তনও ক্ষুধার সমস্যার সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। পৃথিবীর অনেক অংশে কৃষি প্রধান আয়ের উৎস হলেও জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। প্রায়শই দেখা যায়, ক্ষুদ্র কৃষকরা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততার সমস্যা, বন্যা এবং ঘূর্ণিঝড়ের মাত্রা বৃদ্ধি কৃষি উৎপাদনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতএব, বিশ্বকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ এর ব্যর্থতা ক্ষুধার সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলবে।
বাংলাদেশ, যদিও সাম্প্রতিক কয়েক দশকে ক্ষুধা এবং দারিদ্র্য মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, তবে খাদ্য নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এখনো চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপদ, জনসংখ্যার ঘনত্ব এবং কৃষি জমির অভাব বাংলাদেশের খাদ্য ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করলেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এই সাফল্যকে বিপন্ন করছে। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং বন্যার কারণে কৃষি উৎপাদন কমে যাচ্ছে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করছে।
বিশ্ব খাদ্য দিবস ২০২৪ আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে খাদ্য কেবল পুষ্টিই নয়, এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার। এমন এক বিশ্বে যেখানে খাদ্য উৎপাদনের পরিমাণ সকলের চাহিদা মেটাতে যথেষ্ট, কারো ক্ষুধার্ত থাকা অগ্রহণযোগ্য। যদিও ক্ষুধা দূরীকরণের পথে বাধা অসংখ্য, আমাদের কাছে সমাধানের চাবিকাঠি রয়েছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষুধার মূল কারণগুলিকে চিহ্নিত করে সমাধান খুঁজে বের করার এবং আরও স্থিতিস্থাপক ও টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার জ্ঞান ও প্রযুক্তি রয়েছে। প্রত্যেকের নিরাপদ, পুষ্টিকর এবং পর্যাপ্ত খাবারের অ্যাক্সেস নিশ্চিত করে আমরা কেবল লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবনমান উন্নত করতে পারব না, বরং একটি আরও ন্যায়সঙ্গত, টেকসই এবং সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তুলতে পারব।
লেখক: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী