ক্ষমতার পালাবদলে দেশের বড় ধরনের পরিবর্তন আমরা দেখতে পাচ্ছি। আগে ছিল এক দলের রাজনীতি, এখন দুই দলের। আগের বিপুল ক্ষমতার আওয়ামী লীগ কার্যত মাঠছাড়া। আগের মাঠছাড়া রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণে মাঠ। যদিও দলীয় রাজনীতি নেই এখন, আছে কেবল টেবিল-রাজনীতি এবং এই প্রক্রিয়ার রাজনীতিতে তারা এগিয়ে।
আওয়ামী লীগের নেতারা আত্মগোপনে, কর্মীদের অবস্থাও একই। হয়রানির শিকার সমর্থকেরাও। তারা হচ্ছেন একের পর এক মামলার আসামি। থানায়-আদালতে ধারাবাহিকভাবে মামলা হচ্ছে এবং এসব মামলায় গণহারে আসামি দেওয়া হচ্ছে। আসামিদের বেশিরভাগকেই চেনেন না খোদ বাদীও। অনেক মামলার বাদী জানাচ্ছেন, তাদের কাছ থেকে জোর করে কাগজে স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে, কাদের আসামি করা হচ্ছে, কাদের সাক্ষী করা হচ্ছে, তা তারা জানেন না। তবু এসব মামলা নথিভুক্ত হচ্ছে। ফলে এই মুহূর্তে মামলা ভীতিতে রয়েছে দেশ। কে কখন কাকে কোথায় কোন মামলায় আসামি করে দেয়, এটা কেউ জানে না।
রাজনীতিবিদ ও রাজনৈতিক দলের সমর্থকদের জন্যে ভীতির এই পরিবেশের পাশাপাশি সাংবাদিকেরাও রয়েছেন ভীতিতে। সারাদেশে এরইমধ্যে অন্তত অর্ধশতাধিক সাংবাদিককে বিভিন্ন মামলার আসামি করা হয়েছে। এসবের অধিকাংশই হত্যা মামলা। হুমকি দেওয়া হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রেসক্লাব দখল হচ্ছে। বিএনপি-জামায়াতের লোকজন প্রেসক্লাবে নতুন কমিটি দিচ্ছেন। কোন কোন প্রেসক্লাবে সাংবাদিকেরাই আগের কমিটিকে বাদ দিয়ে নতুন করে কমিটি করে প্রেসক্লাবের দখল নিচ্ছেন। এসব হচ্ছে সংস্কারের নামে। স্রেফ সংস্কার শব্দের জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে লোকজন নিজেদের এবং নিজেদের লোকদের প্রতিষ্ঠার পথে নেমেছে।
সাংবাদিকদের জন্যে ‘নিউ নরমাল’ এই সময়ে প্রকৃত অর্থে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। একের পর এক হত্যা মামলার আসামি এবং মামলার আসামি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার মুখে থাকা সাংবাদিকেরা দেশের প্রকৃত তথ্য উপস্থাপন করতে পারছেন না। অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি ও জামায়াতের বিপক্ষে যেতে পারে এমন কোন সংবাদ তাই কমই ওঠে আসছে গণমাধ্যমে। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন আওয়ামী লীগের আমলে কেবল একটাই ছিল বিটিভি, এখন সবকটা টেলিভিশন চ্যানেল ও অন্যান্য গণমাধ্যমে চলছে কেবলই ‘বাতাবি লেবুর চাষ’। এটা হালকা ঢঙে বলা কথা হলেও এর আবেদন ও অর্থ-ব্যাপ্তি কিন্তু বিশাল।
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আমরা দেখেছি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্যাডে প্রেসক্লাবে দেওয়া এক চিঠি, যেখানে বেশ কজন সাংবাদিকের নামোল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ। চিঠির পর আমরা দেখেছি প্রেসক্লাবের নেতৃত্ব বদল এবং কয়েকজন সাংবাদিককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি। এরপর দেখা গেল একাধিক গণমাধ্যম থেকে কয়েকজন সাংবাদিককে বরখাস্তের খবর। দেখা গেল একাধিক মিডিয়ার আক্রান্ত হওয়ার খবর। এরপর জানা গেল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে সঙ্গে সাংবাদিকদেরও নামে অভিযোগ। দেখা গেল দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সাংবাদিকদের নামে হত্যা ও ভাঙচুর মামলা। ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে) এক বিবৃতিতে বলছে, পঞ্চাশের বেশি সাংবাদিকের নামে মামলা হয়েছে। প্রকৃত তথ্য হচ্ছে এর সংখ্যা আরও বেশি। কারণ সব মামলার খবর যে গণমাধ্যমে আসছে এমন না।
রাজধানী ঢাকা নিয়ে আলোচনা স্বাভাবিকভাবে হয় বেশি। সিলেট-চট্টগ্রামসহ অনেক এলাকার খবর গণমাধ্যমে গুরুত্বের দিক থেকে নিচের দিকে পড়ে থাকে। কিন্তু মামলার ক্ষেত্রে কোন এলাকাই পিছিয়ে নেই। এই মামলার বাইরে অনেকেই আছেন হামলা ও মামলার ঝুঁকিতে-হুমকিতে। অনেককে লেখালেখির কারণে দেখে নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হচ্ছে। এটা প্রমাণের উপায় নাই যদিও, তবু নিজে সাক্ষী বলে প্রমাণ-অপ্রমাণের মুখাপেক্ষী আমি থাকছি না।
আমার এলাকার অন্তত সাত সাংবাদিকের নামে মামলার খবর আমি জানি। এদেরকে যারা আসামি করেছে সেই বাদীরা চেনেন না আসামিদের। আসামিরাও চেনেন না বাদীদের। অনেক ক্ষেত্রে বাদী নিজেই জানাচ্ছেন, মামলার আসামি কারা সেটা তিনি নিজেও জানেন না, কেউ কেউ বলছেন তারা মামলা করতে রাজি ছিলেন না জোর করে কাগজে সই নিয়ে মামলা করা হয়েছে, অনেক পরিবার গণমাধ্যমকে বলছেন, তারা মামলা চালাতে আগ্রহী নন, এখন প্রাণভয়ে মামলা তুলে নিতে পারছেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে তারাও জিম্মি। তবে কাদের কাছে? এই মামলার বাদীরা নিশ্চয় পতিত আওয়ামী লীগের কেউ নয়, তাহলে কে তাদের জিম্মি করছে? এখানে কি রাষ্ট্রের দায় নেই?
সিলেটের সাংবাদিক দেবাশীষ দেবু। আমার পরিচিত, এবং কাছের লোক। তার বিরুদ্ধে একটা মামলার স্পট তার স্টেশন থেকে অন্তত ৬০ কিলোমিটার দূরে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ছাত্রজনতার উল্লাসের সময়ে রামদা, ভুজালি, কিরিচ ইত্যাদিতে সজ্জিত হয়ে আন্দোলনকারী ছাত্রজনতাকে ঘেরাও, ধাওয়া ও আক্রমণ করে গুলিবর্ষণ ও ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অসংখ্য জনতাকে আহত করার। ওই মামলায় আছে হত্যার অভিযোগ। আরেক মামলাও প্রায় অভিন্ন অভিযোগ। এরবাইরে আরও কয়েকজন সাংবাদিক একইভাবে হত্যা, হামলা ও ভাঙচুর মামলার আসামি হয়েছেন। তারা এসবে জড়িত ছিলেন না। তারা আন্দোলনের আগে-পরে পেশাগত দায়িত্ব পালন করেছেন শুধু। এই পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময়ে কেউ সংক্ষুব্ধ হলেও হতে পারে, কিন্তু তাই বলে এভাবে মিথ্যা মামলা...? এরবাইরে আরও কিছু মামলা নথিভুক্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে বলেও জানি, কিছু মামলা থেকে সাংবাদিকদের বাদ দেওয়ার চেষ্টাও চলছে বলে জেনেছি। শেষ পর্যন্ত যাই হোক না কেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা যে হচ্ছে সেটাই বাস্তবতা।
যারা মামলা দিচ্ছে তাদের বেশিরভাগই জানে না কারা আসামি। তাদের কাছ থেকে স্রেফ কাগজে সই নিয়ে নিচ্ছে বিএনপি ও জামায়াতের লোকজন, এবং এরপর সেখানে নাম বসিয়ে দিচ্ছে। এই নাম বসানোকে কেন্দ্র করে তারা তাদের ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক আক্রোশ মিটিয়ে নিচ্ছে। ফলে সাংবাদিক-সমাজে একটা আশঙ্কার স্রোত বইছে কে কখন মামলায় পড়েন। এতে ভীতির একটা পরিবেশ গড়ে ওঠেছে এবং এই পরিবেশ দেশের সাংবাদিকদের সুস্থ সাংবাদিকতার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছাত্রজনতার আন্দোলনের সময়ে সংবাদ প্রকাশের বাইরে কেউ ব্যক্তিগতভাবে পক্ষে-বিপক্ষে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতেই পারেন, এটাকে স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া উচিত। কিন্তু এই স্বাভাবিকতার ব্যাঘাত ঘটছে গণমামলাবাজিতে। রাজনৈতিক বিশ্লেষক হিসেবে আমি আন্দোলনের সময়ে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক লেখা লিখেছি, অনেক মন্তব্য করেছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও। এগুলোও এসে গেছে অনেকের মামলার রাফখাতায়। একজন লেখক হিসেবে যে স্বাধীনতা উপভোগের কথা আমাদের সেটা এখন সম্ভব হচ্ছে না। ফোন করে হুমকি, লেখা মুছে দেওয়ার সময় বেঁধে দেওয়া, দেখে নেওয়ার ঘোষণাসহ বিবিধ সমস্যায় এখন আমরা লেখক-সাংবাদিকদের অনেকেই। আমি নিজেই এর শিকার। উপায়ান্তর না পেয়ে ফেসবুক আইডিও সাময়িকভাবে নিষ্ক্রিয় করে নেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। অথচ এটা আগে কখনই ছিল না।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও ভিন্নমতকে কঠিনভাবে মোকাবিলা করা হতো, কিন্তু এখনকার মতো এমন ভয়াল পরিস্থিতি ছিল না। নির্বাচন ও ভারত বিষয়ে মন্তব্যের পর সাবেক এক মন্ত্রীর বিপক্ষে আমি অনলাইনে নিবন্ধে ও সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা করে লেখা লিখেছিলাম। সে সময় আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তার কাছে কয়েকজন গিয়েছিলেন বলে জেনেছিলাম, কিন্তু তিনি তাদেরকে ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, লেখকের কাজই তো এটা, সমালোচনা করা। লেখক লেখকের কাজ করেছেন, এমনই মন্তব্য ছিল তার। এরবাইরে আরও মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে যায় এমন অনেক লেখা লিখেছি, কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম বাদে বড় ধরনের বাধার মুখে পড়িনি। কিন্তু এখন এই কদিনে মনে হচ্ছে প্রাণখুলে লেখালেখির চেয়ে কঠিন কিছু জগতে নেই। এটা কেবল আমার অবস্থা নয়, এই অবস্থা অনেকের।
জানতে চাই, কেন এমন হবে? কেন ভীতির পরিবেশ থাকবে আমাদের? লেখালেখিতে যদি দেশবিরোধী কিছু থাকে, সাংবাদিকতায় যদি অন্যায় এবং অসত্য কিছু ওঠে আসে, তবে এর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিন, কিন্তু এভাবে ভীতির মধ্যে রাখা উচিত নয়। যে সাংবাদিকদের হত্যা মামলায় নাম দেওয়া হয়েছে, তারা একটা সময়ে ঠিকই অভিযোগ থেকে মুক্ত হবেন, কিন্তু এই সময়টা তাদের জন্যে ভীতির, ভোগান্তির এবং পরিবারের জন্যে অস্বস্তির।
গণআসামির তালিকায় কে লেখক-সাংবাদিক সেটা তাৎক্ষণিক বের করার উপায় নাই থানা-পুলিশ ও আদালতের। এখানে তাই দায়িত্ব নিতে হবে সংশ্লিষ্টদের। উচ্চ পর্যায় থেকে থানাপুলিশকে বার্তা দিতে হবে যে, অভিযোগ প্রমাণের আগে যেন কোন সাংবাদিককে হয়রানি করা না হয়। থানাপুলিশসহ সকল পর্যায়ের দুষ্কৃতিকারীরা সাংবাদিকদের কোণঠাসা করে রেখে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। গণমামলাবাজির এই সময়ে গণআসামির তালিকায় থাকা সাংবাদিকেরা যাতে এর শিকার না হতে হয়, এ দায়িত্ব নিতে হবে অন্তর্বর্তী সরকারকেই।