ভাসানচর- এক টুকরো পরিকল্পিত বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়



ব্রি. জে. (অব.) হাসান মো. শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতন ও দমন অভিযানের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ শুরু থেকেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।এই প্রক্রিয়া এখনও শুরু না হওয়ায় বর্তমান পরিস্থিতিতে সামিয়কভাবে রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে থাকতে পারে, সে কারণে ভাসানচরে তাদের জন্য নতুন ঘরবাড়ি ও অন্যান্য স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।

সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ বিপর্যয় এবং কক্সবাজারের আশ্রয় শিবিরগুলো থেকে চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যা একটি দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ।

জাতিসংঘ শুরুতে এর বিরোধিতা করেছিল এবং ২০১৯ সালের মার্চ মাসে, জেনেভায় জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক তদন্তকারী কর্মকর্তা জাতিসংঘের মিয়ানমারবিষয়ক বিশেষ দূত ইয়াংহি লি কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া ২৩ হাজার রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার পরকিল্পনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছিল যে, এই দ্বীপ মানুষের বসবাসের উপযোগী হতে পারে না। রোহিঙ্গাদের সেখানে সরিয়ে নেওয়া হলে তা নতুন সঙ্কট তৈরি করতে পারে।

বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মার্চ মাসে জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের ১৮ সদস্যের একটি দলকে ভাসানচরে চার দিনের সফরে নিয়ে যায়। সেখানকার উন্নয়ন কার্যক্রম সরেজমিনে দেখার পর জাতিসংঘ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের ‘মানবিক সহায়তা ও সুরক্ষার চাহিদার’ স্বীকৃতি দেয় এবং ভবিষ্যতের অপারেশনাল কার্যক্রম নিয়ে আলোচনা করতে সম্মত হয়। পরবর্তীতে ২০২১ সালের ১৮ মে, ইউএনএইচসিআর এবংআন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা ভাসানচর পরিদর্শন করে সেখানকার পরিস্থিতি, সুযোগ-সুবিধা এবংসার্বিক অবস্থাস ম্পর্কে অবগত হয়।

পরিদর্শন শেষে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের সাথে ইউএনএইচসিআর ৯ অক্টোবর ২০২১, একটি সমঝোতা স্মারকে সই করে। চুক্তি অনুযায়ী, ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের খাদ্য ও পুষ্টি, সুপেয় পানি, পয়ঃনিষ্কাশন, চিকিৎসা, মিয়ানমারের পাঠ্যক্রম ও ভাষায় অনানুষ্ঠানিক শিক্ষা এবং জীবিকা সংস্থানের ব্যবস্থা করতে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে জাতিসংঘ যৌথভাবে কাজ করতে সম্মত হয়। জাতিসংঘের সঙ্গে চুক্তির পর ভাসানচরে বিদেশি অর্থায়ন শুরু হয়েছে।বর্তমানে ভাসানচরে স্থানান্তরিত রোহিঙ্গাদের জীবন ও জীবিকা স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের (আরআরআরসি) কার্যালয়ের সঙ্গে ইউএনএইচসিআর, ডব্লিউ এফ পি ও অন্যান্য এন জি ও সেখানে তাদের কার্যক্রম সুন্দরভাবে পরিচালনা করছে।

কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৭ সালের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার আশ্রয়ণ-৩ নামের এই প্রকল্প হাতে নেয় এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। নৌ বাহিনী সফলতার সাথে এই প্রকল্প সম্পন্ন করে। প্রকল্পে রোহিঙ্গাদের জন্য বসবাসের জন্য ১২০টি ক্লাস্টার এবং ১২০টি শেলটার স্টেশন রয়েছে। ভাসানচরের ক্লাস্টার হাউজ ও শেল্টার স্টেশনগুলো ভূমি থেকে চার ফুট উঁচু করে কংক্রিটের ব্লক দিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে আছে ১২টি হাউজ। এখানে সব মিলিয়ে ১,৪৪০টি ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিটি ঘরে ১৬টি কক্ষ রয়েছে এবংপ্রতিটি কক্ষে দুটো ডাবল বাঙ্কার বা দোতলা খাট আছে যাতে একটি পরিবারের চারজন থাকতে পারে। পরিবারে সদস্য সংখ্যা চারজনের বেশি হলে তাদের জন্য দুটো কক্ষ বরাদ্দ করার ব্যবস্থা রয়েছে। জাতিসংঘের আদর্শ মান অনুযায়ী আবাসনের ক্ষেত্রে মাথাপিছু ৩৭ বর্গফুট জায়গা দরকার, এসব কক্ষে তার চেয়ে বেশি জায়গা রাখা হয়েছে। প্রতি ৮টি কক্ষের জন্য তিনটি টয়লেট এবং দু'টি গোসলখানা রয়েছে, নারী-পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা গোসলখানা ও টয়লেট। রান্নার জন্য প্রতিটি পরিবারের জন্য একটি করে চুলার জায়গা বরাদ্দ করা আছে।সেখানে সিলিন্ডারে এল পি জি গ্যাস সরবরাহ করা হচ্ছে।রান্নায় গ্যাস সাশ্রয়ের জন্য একটা এন জি ও বিশেষ বাক্সের ব্যবস্থা করছে। রান্নাঘর, গোসলখানা এবং টয়লেটে পানির সরবরাহ রয়েছে। প্রতিটি হাউজের ওপরে রয়েছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল।

প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য আছে একটি করে শেল্টার স্টেশন। ভাসানচরে বড় ধরনের ঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা মোকাবিলায় গত ১৭১ বছরের ঘূর্ণিঝড় সংক্রান্ত তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করার জন্য ভাসানচরে পাঁচ তলা বিশিষ্ট ১২০টি শেল্টার স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড় হলেও টিকে থাকতে সক্ষম এই শেলটার স্টেশন। ভাসানচরে কর্মরত ইউএনএইচসিআর ও আরআরআরসি’র প্রতিনিধি জানায় যে, কিছুদিন আগে সাইক্লোন মোখার সময় দুই ঘণ্টার মধ্যে ভাসানচরের সবাইকে সাইক্লোন শেল্টারে নেওয়া হয়েছিল, এবং তারা সবাই নিরাপদ ছিল, এটা ভাসানচরের জন্য একটা বড় অর্জন।

ভাসানচরে শিশুদের জন্য দুটি খেলার মাঠ, এতিমখানা, ডে-কেয়ার, সুপারশপ, সেলুন, মসজিদ ও বাজার আছে। সেসব বাজারে নোয়াখালী হাতিয়া ও অন্যান্য জেলা থেকে ব্যবসায়ীরা এসে ব্যবসা করছে এবং প্রায় সব প্রয়োজনীয় জিনিস সেখানে পাওয়া যায়। প্রকল্প এলাকায় পুকুর এবং লেক কাটা হয়েছে। রোহিঙ্গারা এখানে মাছ ধরে এবং এখানে মাছের চাষ হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস্টারে ও ১০ ফুট গভীর একটি পুকুর আছে। এসব পুকুরের পানি গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতিটি ক্লাস্টার একই আকৃতিতে বানানো হয়েছে, এখানকার সব ঘর দেখতে একই রকম। ঘরের পাশের অল্প ফাঁকা জায়গায় মহিলারা শাক সবজি চাষ করছে। প্রতিটি ঘরের সামনে ২০ থেকে ২৫ ফুট চওড়া পাকা রাস্তা রয়েছে। বাংলাদেশের সব গ্রামে এত সুন্দর মজবুত ও পরিচ্ছন্ন রাস্তা দেখা যায় না। প্রকল্পের ভেতরে পানি নিষ্কাশনের জন্য ড্রেন এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য কেন্দ্রীয় সংরক্ষণাগার আছে। এনজিওদের তত্ত্বাবধানে রোহিঙ্গারা সমস্ত আবর্জনা সেখানে এনে জমা করছে। এর ফলে এলাকা পরিচ্ছন্ন থাকছে এবং এই আবর্জনা থেকে জৈব সার তৈরি করে তা কৃষি জমিতে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভাসান চরে ৪৩২ একর জমিতেরোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনানির্মিতহয়েছে।ভবিষ্যতে প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও বনায়নের জন্য বাঁধের ভেতর ৯১৮ একর এলাকা খালি রাখা হয়েছে।

ভাসানচরে দুটি ২০ শয্যার হাসপাতাল এবং চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। প্রকল্প এলাকায় সরকারি কর্মকর্তা, জাতিসংঘ প্রতিনিধি, আরআরআরসি প্রতিনিধি, রেডক্রস, আন্তর্জাতিক এনজিও প্রতিনিধি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জন্যও আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের থাকার জন্য যেসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর তুলনায় অনেক টেকসই ও উন্নতমানের। কক্সবাজারের ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের ঘরগুলোতে বিদ্যুতের সরবরাহ না থাকলেও ভাসানচরে সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে আলোর ব্যবস্থা রয়েছে।

ভাসানচরে জোয়ার ও জলোচ্ছাসের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ করতে ১৭০২ একর জমির চারপাশে ৯ ফুট উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই বাঁধ ১৫ ফুট পর্যন্ত উঁচু করা হবে। ভাঙনের কবল থেকে রক্ষা করার জন্য প্রায় তিন কিলোমিটার জুড়ে তীর রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সমুদ্রের যে পাশ থেকে ঢেউ চরে আঘাত করে, সেই পাশেই শোর প্রোটেকশন দেওয়া হয়েছে। শোর প্রোটেকশন থেকে ৫০০ মিটার ভেতরে বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। অনেক শক্তিশালী ঝড় এই চরের উপর দিয়ে গেলে ও মানুষের জীবন বিপন্ন হবে না।

১৩,০০০ একরের এই দ্বীপে সারাবছর সুপেয় পানি, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ, কৃষি জমি, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, দুটি হাসপাতাল, চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক, মসজিদ, গুদামঘর, টেলিযোগাযোগ পরিষেবা, একটি পুলিশ স্টেশন, বিনোদন ও শিক্ষা কেন্দ্র, খেলার মাঠ এবং আরও অনেক কিছু রয়েছে।ভাসানচরে ডব্লিউএফপি খাদ্য সহযোগিতা দিচ্ছে, পাইলট প্রকল্প আকারে ই ভাউচারের মাধ্যমে এখন ৫০০০ রোহিঙ্গা কে খাদ্য সহায়তা দেয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে সবাইকে এই সুবিধার আওতায় আনা হবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলি থেকে রোহিঙ্গাদেরকে ভাসানচরে স্থানান্তরিত করা শুরু হয়। ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের চেয়ে ভাসানচরে নিরাপদ আর স্বস্তিতে আছে। স্বাস্থ্যসেবাসহ ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের আধুনিক সুযোগ-সুবিধাগুলি রয়েছে যা বাংলাদেশের সব জায়গায় পাওয়া যাবে না।

রোহিঙ্গারা বর্তমানে ভাসানচরের জীবনকে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও কক্সবাজারের নিরাপত্তাহীনতা থেকে মুক্তির সুবাতাস হিসেবে দেখছে। ভোর থেকেই ভাসানচরে কর্মচাঞ্চল্য শুরু হয়ে যায়। রোহিঙ্গাদের কেউ সাগরে কিংবা চরের ভেতরের পুকুর বা লেকে মাছ ধরতে যায়। কেউ ভ্যান কিংবা রিকশা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। কেউ তাদের জন্য বরাদ্দ কৃষি জমিতে চাষ করতে চলে আসে। কিছু রোহিঙ্গা তাদের পশুদের চড়াতে বের হয়। এক সময়ে জাতিসংঘ ও অন্যান্য দাতা সংস্থা যে ভাসানচরের উপর তাদের আস্থা রাখতে পারেনি আজ সেখানেই নিরাপদে উন্নত পরিবেশে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা যা বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী নেতৃত্বের একটা গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

ভাসানচরে রোহিঙ্গারা এখন গবাদিপশু লালন পালন, মাছধরা ও চাষাবাদের মত জীবিকা নির্বাহের সুযোগ আছে। ভাসানচরে কাজ করা এনজিওগুলো সেলাই, পাটজাত পণ্য তৈরি, ব্লকের কাজ, স্কিন প্রিন্ট, সূচিকর্ম এবং আরও অন্যান্য ভোকেশনাল ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেছে। এখানে পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, জীবিকার নিশ্চয়তা, মৌলিক অধিকার নিরাপদ আশ্রয় নিশ্চিত করা হচ্ছে। ভাসানচরের স্কুলগুলো এখন কলরব মুখর, শিশুরা সকাল বেলা সেখানে যাচ্ছে এবং সামনে তাদের কেন্দ্রিয়ভাবে পরীক্ষা নেওয়া হবে পরবর্তী ধাপে যাওয়ার জন্য। ভাসানচরে রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের ভাষায় পাঠ্যক্রম অনুসরণ, দক্ষতা বৃদ্ধি কার্যক্রম ও জীবিকা অর্জনের সুযোগ পাচ্ছে।

সবশেষে বলা যায় যে, পরিকল্পিতভাবে নির্মিত এক টুকরো বাংলাদেশ এই ভাসানচর যা এখন রোহিঙ্গাদের নিরাপদ সাময়িক আশ্রয়।

   

কক্সবাজারে ওভার ট্যুরিজমের আর্থ-সামাজিক প্রভাব



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত একটি মনোরম উপকূলীয় শহর কক্সবাজার দীর্ঘকাল ধরে বিশ্বের অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে হয়ে পরিগণিত হয়ে আসছে। বঙ্গোপসাগর বরাবর ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ অবারিত বালুকাময় উপকূলরেখার জন্য পরিচিত, কক্সবাজার কয়েক দশক ধরে অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আকষর্ণীয় স্থান হয়ে উঠেছে। যাই হোক, আদিগন্ত সৈকত এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি একটি ক্রমবর্ধমান সমস্যা হাজির হয়েছে – আর তা হল ওভারট্যুরিজম বা অতি-পর্যটন।

কক্সবাজারকে প্রায়ই পৃথিবীর অন্যতম পর্যটন স্থান হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এর সূর্যস্নাত সৈকত, প্রশান্তিদায়ক তরঙ্গ এবং প্রাণবন্ত স্থানীয় সংস্কৃতি বিশ্বের সমস্ত কোণ থেকে পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে। শহরটি বিলাসবহুল রিসর্ট থেকে শুরু করে বাজেট-বান্ধব আবাসন, ভ্রমণকারীদের জন্য বিভিন্ন রকম উপাদেয় খাবারের পাশাপাশি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে গর্বিত। শহরের আইকনিক সমুদ্রের তীরে প্রমোনেড, যা লাবনি পয়েন্ট নামে পরিচিত, স্থানীয় উপাদেয় খাবার, হস্তশিল্প এবং সীশেল স্যুভেনির বিক্রি করে এমন বিক্রেতাদের দ্বারা ভরা একটি ব্যস্ততাপূর্ণ কেন্দ্র।

তদুপরি, কক্সবাজার সেন্ট মার্টিন দ্বীপের প্রবেশদ্বার হিসাবে কাজ করে, যা বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর প্রবাল প্রাচীরের আবাসস্থল। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মতো প্রধান শহর থেকে এর প্রবেশযোগ্যতা পর্যটকদের মধ্যে এর জনপ্রিয়তাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। যদিও পর্যটনের বৃদ্ধি অনস্বীকার্য সুবিধা নিয়ে এসেছে, এটি এই বৃদ্ধির স্থায়িত্ব এবং স্থানীয় সম্প্রদায় এবং পরিবেশের উপর এর প্রভাব সম্পর্কে উদ্বেগও সৃষ্টি করেছে।

অতি-পর্যটন, সাম্প্রতিক বছরগুলিতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। এটি এমন পরিস্থিতিকে বোঝায় যেখানে অত্যধিক সংখ্যক পর্যটক একটি গন্তব্যে যান, যা পরিবেশ, স্থানীয় সংস্কৃতি এবং বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মানের ক্ষতি করে। অত্যধিক পর্যটনের নেতিবাচক পরিণতি কক্সবাজার বিভিন্নভাবে ভোগ করছে।

প্রথমত, কক্সবাজার ভ্রমণকারী পর্যটকদের বিপুল সংখ্যা এই অঞ্চলের ভঙ্গুর বাস্তুতন্ত্রের উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করেছে। সমুদ্র সৈকতের ক্ষয় যা একসময় একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া ছিল, সমুদ্রের খুব কাছাকাছি হোটেল এবং রিসর্ট নির্মাণের কারণে এটি আরও তীব্র হয়েছে। অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়নের কারণে এই অঞ্চলের আদি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য যা পর্যটকদের আকর্ষণ করত তা ক্রমশ বিলুপ্ত হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, শহরটির অবকাঠামো পর্যটকদের আগমনের সাথে মানিয়ে নিতে হিমশিম খাচ্ছে। যানজট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা এবং অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্থানীয় সরকার এবং কর্তৃপক্ষ পর্যটন শিল্পের চাহিদা পূরণের জন্য অবিরাম চেষ্টা করছে, যার ফলে এই শহরের স্থায়ী বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার ওপর এর প্রভাব পড়ছে।

কক্সবাজারে অতি-পর্যটনের আর্থ-সামাজিক প্রভাব জটিল এবং বহুমুখী। যদিও পর্যটন এই অঞ্চলে অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দিয়েছে, এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন চ্যালেঞ্জও তৈরি করেছে। পর্যটন নিঃসন্দেহে স্থানীয় অর্থনীতিতে অর্থ যোগান দিচ্ছে। এটি আতিথেয়তা, পরিবহন এবং খুচরাসহ বিভিন্ন সেক্টরে চাকরি তৈরি করেছে। পর্যটকদের অবিরাম আগমনের কারণে ছোট ব্যবসা, যেমন রেস্তোরাঁ এবং স্যুভেনির শপগুলি সমৃদ্ধ হয়েছে৷ উপরন্তু, বর্ধিত অর্থনৈতিক কার্যকলাপ কিছু বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করেছে।

পর্যটন খাতও উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ খুলে দিয়েছে। দর্শনার্থীদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় উপকৃত হয়ে স্থানীয়রা তাদের নিজস্ব গেস্টহাউস এবং রেস্তোরাঁ চালু করেছে। এর ফলে অনেকের আয় বেড়েছে এবং জীবিকার উন্নতি হয়েছে।

যদিও পর্যটন অর্থনৈতিক সুবিধা নিয়ে এসেছে, এই খাতের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা স্থানীয় অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলেছে। মৌসুমী পর্যটনের কারণে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সারা বছর আয়ের ওঠানামা অনুভব করে। অফ-পিক সিজনে, অনেক প্রতিষ্ঠান টিকে থাকার জন্য সংগ্রাম করে, যার ফলে ব্যবসার মালিক এবং তাদের কর্মচারী উভয়ের জন্যই অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা দেখা দেয়।

কক্সবাজারে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় স্থানীয় জনগণের উপরও বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। পর্যটন খাত থেকে আবাসন এবং জমির চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে সম্পত্তির দাম বেড়েছে, সাধারণ বাসিন্দাদের জন্য বাড়ি ও জমি কেনা কঠিন হয়ে পড়েছে। এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে মিশ্র অনুভূতি তৈরিতে অবদান রেখেছে, কারণ তারা তাদের শহরকে প্রাথমিকভাবে পর্যটকদের জন্য পরিবর্তিত হতে দেখেছে।

কক্সবাজারে অতি-পর্যটন শুধু শহরের ভৌগোলিক ল্যান্ডস্কেপই পরিবর্তন করেনি বরং এর সাংস্কৃতিক বুননেও প্রভাব ফেলেছে। পর্যটকদের আগমন ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং সাংস্কৃতিক চর্চাকে হ্রাস করেছে। পর্যটক-বান্ধব অভিজ্ঞতার চাহিদা প্রায়ই স্থানীয় রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যের পণ্যীকরণের দিকে নিয়ে যায়, যা দর্শনার্থীদের বিনোদনের জন্য নিছক দৃশ্য পণ্যে পরিণত করে।

অধিকন্তু, বহুজাতিক চেইন হোটেল এবং বিদেশী মালিকানাধীন ব্যবসার উত্থান স্থানীয় সংস্কৃতিকে আরও সংকোচিত করেছে। ঐতিহ্যবাহী বাজার এবং খাবারের দোকানগুলির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলির দ্বারা ছেয়ে গেছে, যা স্থানীয় অভিজ্ঞতার স্বতন্ত্রতাকে নষ্ট করে দিয়েছে। এই সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে কক্সবাজারের পরিচিতি ও ঐতিহ্যের ক্ষেত্রে।

কক্সবাজারে অতি-পর্যটনের পরিবেশগত প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। উপকূলরেখা বরাবর হোটেল এবং রিসর্টের অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণ কাঠামো উল্লেখযোগ্য সৈকত ক্ষয়ের দিকে পরিচালিত করেছে। এই ভাঙন শুধুমাত্র শহরের পর্যটন আকর্ষণকেই হুমকির মুখে ফেলে না বরং স্থানীয় জেলেদের জীবিকাকেও ঝুঁকির মুখে ফেলে, কারণ সমুদ্রে তাদের প্রবেশাধিকার ব্যাহত হয়।

অধিকন্তু, পর্যটকদের ফেলে দেয়া প্লাষ্টিক কাপ, পানির বোতল ও অন্যান্য দ্রব্যাদি প্রচুর পরিমাণে বর্জ্য তৈরি করে, যা প্রায়শই সমুদ্র এবং আশেপাশের অঞ্চলকে দূষিত করে। অপর্যাপ্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকাঠামো এবং অনুশীলনের ফলে সমুদ্র সৈকতে এবং শহরে দৃশ্যমান আবর্জনা দেখা দিয়েছে। এটি শুধুমাত্র পরিবেশেরই ক্ষতি করে না বরং পর্যটকদেরও নিরুৎসাহিত করে যারা আদি
প্রাকৃতিক পরিবেশ খুঁজতে আসে।

কক্সবাজারে অত্যধিক পর্যটন সমস্যা সমাধানের জন্য একটি বহুমুখী পদ্ধতির প্রয়োজন যা পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের সাথে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির ভারসাম্য বজায় রাখে। পর্যটকদের আগমনকে আরও দক্ষতার সাথে পরিচালনা করার জন্য পর্যটন ব্যবস্থার উন্নতি এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থার মতো বিষয়গুলোতে বিনিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

উপকূলরেখার কাছাকাছি হোটেল ও রিসর্ট নির্মাণের ক্ষেত্রে কঠোর প্রবিধান প্রয়োগ করা এবং দায়িত্বশীল নির্মাণ কাঠামো অনুশীলনের প্রচার করা সৈকত ক্ষয় কমাতে সাহায্য করতে পারে। পর্যটন পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্থানীয় সম্প্রদায়কে জড়িত করা নিশ্চিত করতে পারে যে তাদের স্বার্থ বিবেচনায় নেওয়া হয় এবং তারা শিল্প থেকে উপকৃত হয়।

পর্যটন ব্যতীত অন্যান্য শিল্পকে সমর্থন করে এমন অর্থনৈতিক বৈচিত্র্যকে উৎসাহিত করে পর্যটনের মৌসুমী দুর্বলতা হ্রাস করতে পারে। সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং স্থানীয় অভিজ্ঞতার সত্যতা প্রচার কক্সবাজারের অনন্য পরিচয় বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে।

দায়িত্বশীল এবং টেকসই পর্যটন অনুশীলন সম্পর্কে পর্যটকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পরিবেশ ও সংস্কৃতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে অবদান রাখতে পারে। এলাকাটি টেকসইভাবে ধারণ করতে পারে এমন সর্বাধিক সংখ্যক পর্যটক নির্ধারণ করা এবং পিক সিজনে দর্শনার্থীদের অবস্থানের সময়সীমা নির্ধারণ করা কিছু পরিবেশগত চাপ কমিয়ে দিতে পারে।

একটি শান্ত উপকূলীয় শহর থেকে একটি ব্যস্ত পর্যটন কেন্দ্রে কক্সবাজারের অভিযাত্রা অতি-পর্যটনের কারণে একটি চ্যালেঞ্জের তৈরি করেছে যা এই শহরের টেকসই পর্যটনকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। যদিও পর্যটন অর্থনৈতিক সুযোগ এনে দিয়েছে, এটি স্থানীয় সম্প্রদায়ের উপর গভীর আর্থ- সামাজিক এবং পরিবেশগত প্রভাবও ফেলেছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং স্থায়িত্বের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে যাতে কক্সবাজার তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভ্রমণকারীদের জন্য একটি আশ্রয়স্থল হয়ে থাকে। এই মনোরম উপকূলে টেকসই পর্যটনের একটি রূপরেখা প্রণয়ন সরকারি, বেসরকারি, ব্যবসায়ী ও পর্যটকসহ সকল স্টেকহোল্ডারের অন্যতম দায়িত্ব।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী

;

রোহিঙ্গা সংকটে ত্রান সহায়তার নিম্নমুখী প্রবণতা রোধে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

দীর্ঘ ছয় বছরেরও বেশী সময় ধরে চলমান রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলায় আন্তর্জাতিক সহায়তা নিম্নমুখী এবং এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মহলে এই বৈশ্বিক সংকটটির গুরুত্ব কমে আসার প্রবনতা দেখা যাচ্ছে। মানবিক বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছিলেন। সেই মহানুভবতার কথা বিবেচনায় না নিয়ে, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন না করে ইদানিং বাংলাদেশের সমালোচনা করার প্রবনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যা কারো কাম্য নয়। এ বছর বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউ এফ পি) রোহিঙ্গাদের জন্য খাদ্য সহায়তা ৩৩% কমিয়ে প্রতিমাসে মাথাপিছু ৮ ডলারে নামিয়ে এনেছে, ফলস্রুতিতে ৪৫% রোহিঙ্গা পরিবার পর্যাপ্ত খাবার পাচ্ছে না এবং কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতিসংঘের কোর্ডিনেশন অব হিউমেনিটেরিয়ান অ্যাফেয়ার্সের পরিসংখ্যান মতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে এ বছর  জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানের(জেআরপি) ৮৭৬ মিলিয়ন ডলার চাহিদার বিপরীতে এখন পর্যন্ত মাত্র ২৬৮ মিলিয়ন সহায়তা পাওয়া গেছে যা চাহিদার এক তৃতীয়াংশ। এই পরিস্থিতি নিরসনে,  মানবাধিকার সংস্থা ফোর্টিফাই রাইটসের পরিচালক জন কুইনলি জানায় যে, দাতাদেশগুলোর বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারের সুযোগ নিশ্চিত করা উচিত। 

বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করা জাতিসংঘ শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) মতে, ২০২২ সাল পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলার বিষয়টি সর্বোচ্চ আর্থিক মানবিক সহায়তার মধ্যে ছিল। বর্তমানে রোহিঙ্গা সমস্যাটি আনুষ্ঠানিকভাবে জরুরি পরিস্থিতি নয় এবং তাঁরা একে এখন প্রলম্বিত পরিস্থিতি হিসেবে মনে করে। এর ফলে মানবিক জরুরি তহবিল এখন বিশ্বজুড়ে চলমান অন্যান্য জরুরি অবস্থা মোকাবেলায় ব্যবহার হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বে অনেক জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হলেও প্রধান দাতা দেশগুলোর সামগ্রিক সাহায্য বাজেট কমে যাওয়ায় অনেক মানবিক কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

২০২২ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক রোহিঙ্গা সহায়তা তহবিলের ৪০% আসত যুক্তরাষ্ট্র থেকে। ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ ছিল ৩৩৬ মিলিয়ন ডলার, এ বছর যুক্তরাষ্ট্রের থেকে সহায়তা কমে ১০০ মিলিয়ন আসায় তহবিল সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা এবং তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য ১.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে এবং তাদের এই সমর্থন চলমান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, মিয়ানমারের অবস্থার উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানায় এবং সমগ্র অঞ্চল জুড়ে রোহিঙ্গাদের দুর্ভোগ কমাতে সম্ভাব্য সব বিকল্প খুঁজতে অবিচল থাকার উপর গুরুত্ব আরোপ করে। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের সহায়তায় মিয়ানমার, বাংলাদেশ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের জন্য অতিরিক্ত ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার মানবিক সহায়তার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, এই সংকট মোকাবেলায় দেশটি এ পর্যন্ত মোট ২.২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি সহায়তা প্রদান করেছে।

যুক্তরাজ্য পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রবিষয়ক কমিটির প্রথম নারী সভাপতি এলিসিয়া কিয়ার্নস বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির ওপর গুরুত্ব দিয়ে জানান যে, জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের চাপের মাধ্যমে মিয়ানমারকে তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করতে আরও কাজ করা প্রয়োজন। যুক্তরাজ্যের ফরেন, কমনওয়েলথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অফিসের (এফসিডিও) স্থায়ী আন্ডার সেক্রেটারি স্যার ফিলিপ বার্টন জানান যে, মিয়ানমারে অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত যুক্তরাজ্য বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা স্থানীয়দের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা সমস্যার একটি দীর্ঘ মেয়াদী সমাধানের জন্য মিয়ানমারে চাপ অব্যাহত রেখেছে যাতে রোহিঙ্গারা নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণভাবে মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারে। এফসিডিও কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের স্বাস্থ্যসেবা, বিশুদ্ধ পানি, স্বাস্থ্যবিধি এবং স্যানিটেশন পরিষেবা ও রান্নার জ্বালানি নিশ্চিত করতে ৩০ লাখ পাউন্ড প্রদানের ঘোষণা দেয়, এই সহায়তা কার্যক্রম ইউএনএইচসিআরের মাধ্যমে পরিচালিত হবে। ২০১৭ সাল থেকে যুক্তরাজ্য রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা বাংলাদেশি মানুষের জন্য ৩৬৫ মিলিয়ন পাউন্ড আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।

রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ইউএনএইচসিআর, হিউম্যান রাইট ওয়াচ, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, এবং এনজিওগুলোর মতো বিশ্বসম্প্রদায়ও মিয়ানমারকে কার্যকরভাবে চাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এই সংকট আঞ্চলিক নিরাপত্তাকেও অস্থিতিশীল করে তুলছে। মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞ টম অ্যান্ড্রুজ জানায় যে,  আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও রোহিঙ্গাদেরকে পর্যাপ্ত সমন্বিত সহায়তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং  জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলোর আর্থিক অনুদান কমিয়ে দেওয়ায় রোহিঙ্গাদের খাদ্য সহায়তা কমিয়ে দেয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরে জেনেভাতে আসন্ন গ্লোবাল রিফিউজি ফোরামে রোহিঙ্গাদের সহায়তা দিতে অংশীদারদের আহ্বান জানিয়েছে ইউএনএইচসিআর। এটি একটি বৃহত্তর মানবিক সংকটে আর্থিক সহায়তার হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে।

বাংলাদেশ, মিয়ানমারের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের বিষয়টি চলমান রাখার পাশাপাশি রোহিঙ্গা সমস্যা যেন বিশ্ব ভুলে না যায় সেজন্য বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা ইস্যুটি সামনে রাখতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ চলমান রেখেছে।  ১৪ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যেকার ভিসা সেবা সংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) অধীনে কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা অব্যাহতি পুনর্বহাল করা হয়েছে। এই সমঝোতা স্মারকের অধীনে উভয় দেশের কূটনৈতিক ও অফিসিয়াল পাসপোর্টধারীরা ভিসার প্রয়োজন ছাড়াই সর্বাধিক ৯০ দিনের জন্য ভ্রমণ করতে পারবে। এই সিধান্তের ফলে সরকারি সফর সহজতর হওয়ার পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরো শক্তিশালী করবে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের চলমান উদ্যোগের প্রস্তুতি হিসেবে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে একটি ট্রানজিট ক্যাম্প ও একটি রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্প নির্মাণের কার্যক্রম গ্রহন করা হয়েছে বলে শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তসংলগ্ন এলাকা থেকে আসা রোহিঙ্গাদের তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে ফেরত পাঠানো হবে। প্রত্যাবাসন শুরু হলে রোহিঙ্গাদের প্রথমে ঘুমধুমের ট্রানজিট ক্যাম্পে আনার পর সেখান থেকে রিপ্যাট্রিয়েশন ক্যাম্পে নেয়া হবে। সেখানে দুই দেশের দাপ্তরিক কাজ সম্পন্ন হলে তাদেরকে মিয়ানমারে পাঠানো হবে।

সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘে দেয়া ভাষণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রতি বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানান যে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। প্রত্যাবাসন নিয়ে অনিশ্চয়তা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক হতাশার জন্ম দিয়েছে। এই অবস্থা চলমান থাকলে এটি আমাদের আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে গিয়ে সেখানে শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন করতে আগ্রহী, সেজন্য রোহিঙ্গাদের নিজের দেশে যাওয়া নিশ্চিত করতে তিনি সবার কাছে আহ্বান জানান। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক আদালতে (আইসিজে) গাম্বিয়ার দায়ের করা মামলায় বিশ্ব সম্প্রদায়ের  সমর্থন চেয়েছেন। ফ্রান্স, কানাডা, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক ও মালদ্বীপ এই সাতটি দেশ মামলার প্রতি সম্মতি দিয়েছে।

২০ সেপ্টেম্বর, ১৮তম এশিয়া কোঅপারেশন ডায়লগ (এসিডি) পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন চলমান রোহিঙ্গা সংকট ও মানবিক বিপর্যয় মোকাবেলায় দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায়। রোহিঙ্গারা যাতে দ্রুত তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চিত করার জন্য সমাধান খুঁজে বের করার উপর গুরুত্বারোপ করেন এবং রোহিঙ্গা সঙ্কটের ইস্যু আলোচ্যসূচির শীর্ষে রাখতে অনুরোধ জানান। কক্সবাজারে থাকা প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার নিরাপদ প্রত্যাবাসনে জাপানের সহায়তা  চেয়েছে বাংলাদেশ। জাপানের সংসদের উচ্চকক্ষের সদস্য এবং জাপানের বিদেশি সহায়তা কমিটির (ওডিএ) প্রধান নাকানিশি ইয়োসুকে সেপ্টেম্বরে তার বাংলাদেশ সফরের সময় এই আহ্বান জানানো হয়। রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র সহ অন্যান্য বন্ধু প্রতীম দেশগুলো ভুমিকা রাখতে পারে। একই সাথে তাঁরা রোহিঙ্গাদের স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করে মিয়ানমারে তাদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের জন্য প্রস্তুত করতে পারে। চলমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমা দেশগুলো, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রগুলো তাদের দক্ষতা ও সক্ষমতা দিয়ে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের ত্রান সহায়তা চলমান রাখার জন্য খাদ্য ও অর্থের সংস্থান নিশ্চিত করতে পারে। 

সম্প্রতি দি ইয়থ কংগ্রেস রোহিঙ্গা (ওয়াই সি আর) নামে রোহিঙ্গাদের স্বার্থনিয়ে কাজ করা একটা সংগঠনের কথা জানা যায়। এই সংগঠনটি প্রায় এক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে নানা ধরনের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এই সংগঠনটি প্রত্যাবাসন ও রোহিঙ্গাদের দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং মিয়ানমারে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির দিকে গুরুত্ব না দিয়ে ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তর ও আরও কিছু বিষয়ে বাংলাদেশের নেয়া পদক্ষেপের সমালোচনা করেছে যা অনাকাঙ্ক্ষিত। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহায়তায় তাদের সক্ষমতার বিষয়ে প্রতিবেদন থেকে কিছু জানা যায় নাই। বহু দশক ধরে পরিকল্পিত ভাবে রোহিঙ্গাদেরকে প্রান্তিক জনগুষ্টিতে পরিণত করা হয়েছিল ও তাদের নাগরিক অধিকার সহ অন্যান্য মানবিক সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত করে তাদেরকে এই অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ অবশ্যই সম্ভব এবং উপযুক্ত পদক্ষেপ নিয়ে এই প্রান্তিক জনগুষ্টিকে কর্মক্ষম শক্তিতে পরিনত করা যেতে পারে। এই সংগঠনটি এসব উদ্যোগ নিতে পারে।  আশা করা যায় তাঁরা রোহিঙ্গাদের ক্রমহ্রাসমান আর্থিক ও খাদ্য সহায়তার বিষয়টি সম্বন্ধে অবগত এবং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরনে ইতিবাচক ভুমিকা রেখে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তাদের আগ্রহ ও সহানুভুতির বাস্তব রূপ দিবে।

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো এই অঞ্চলে তাদের উপস্থিতি, আধিপত্য ও নিয়ন্ত্রন নিশ্চিত করতে তৎপর। এখানে রোহিঙ্গা সমস্যার মত একটা জটিল সমস্যা চলমান থাকবে তা কারো কাম্য হতে পারে না। বাংলাদেশ  আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে এই সংকট সমাধানে আঞ্চলিক, বৈশ্বিক সহ সব ধরনের উদ্যোগে সহায়তা ও সমর্থন দিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মানবিক সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে এই ইস্যুটিকে জরুরি পরিস্থিতি হিসেবে বিবেচনায় রাখতে হবে। চলমান প্রেক্ষাপটে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি ত্রান সহায়তার নিম্নমুখী প্রবনতা রোধে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহনের বিষয়টি এই সঙ্কটের সাথে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

 

;

ইতিহাস-পুরুষ ডা. মাজহারুল হক স্মরণের আলোয় অম্লান



শাহ ইসকান্দার আলী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর, বার্তা২৪.কম
ইতিহাস-পুরুষ ডা. মাজহারুল হক স্মরণের আলোয় অম্লান

ইতিহাস-পুরুষ ডা. মাজহারুল হক স্মরণের আলোয় অম্লান

  • Font increase
  • Font Decrease

শতবর্ষস্পর্শী জীবনেই তিনি পরিণত হয়েছিলেন জীবন্ত কিংবদন্তিতে। তিনি ছিলেন ইতিহাস-পুরুষ। শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বাদ জুৃমা চিরনিদ্রায় শায়িত হলেও শোক, শ্রদ্ধা ও স্মরণের আলোয় অম্লান হয়ে আছেন ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কিশোরগঞ্জের বরিষ্ঠ চিকিৎসক ডা. এ.এ. মাজহারুল হক।

বৃহস্পতিবার (২১ সেপ্টেম্বর) বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট আবাসিক এলাকার নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশের চিকিৎসা জগত হারিয়েছে প্রবীণতম ব্যক্তিত্বকে আর কিশোরগঞ্জে ইতিহাসে অবসান ঘটেছে একটি গৌরবময় যুগের।

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কিশোরগঞ্জের বরিষ্ঠ চিকিৎসক ডা. এ.এ. মাজহারুল হক মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, বরেণ্য শিক্ষাবিদ প্রফেসর আবদুল মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মশিউর রহমান হুমায়ুন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি, কলা অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. মাহবুবুল হক, লেখক-শিক্ষাবিদ প্রফেসর ড. মহীবুল আজিজ, নজরুল গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক প্রফেসর ড. আনোয়ার সাঈদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী ও শিক্ষকমণ্ডলী।

কিশোরগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট জিল্লুর রহমান শোক জানিয়ে বলেন, ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কিশোরগঞ্জের বরিষ্ঠ চিকিৎসক ডা. এ.এ. মাজহারুল হক ছিলেন আমার অভিভাবক ও সিনিয়র নেতা।

গণতন্ত্রী পার্টির কেন্দ্রীয় সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন শোকবার্তায় বলেন, পিতৃতুল্য স্বনামখ্যাত চিকিৎসক, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত, সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশে দীর্ঘ সময় অবদান রাখা ডা: এ. এ. মাজহারুল হক এর মৃত্যুতে আমরা গভীর শোকাহত। আমরা গণতন্ত্রী পার্টির পক্ষ থেকে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সকল সদস্য আত্মীয় স্বজন ও গুণ গ্রাহী দের প্রতি জানাই সহমর্মিতা।

কিশোরগঞ্জের প্রবীন এমবিবিএস ডাক্তার, বিশিষ্ট ভাষা সৈনিক, নিবিড় রাজনীতিক, সমাজ সেবক, কিশোরগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের সক্রিয় ভূমিকা পালনকারী আলহাজ্জ্ব ডা. এ এ মাজহারুল হকের ইন্তেকালে কিশোরগঞ্জ সাহিত্য সংস্কৃতি পরিষদের সভাপতি ইতিহাসবিদ মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক বঙ্গবন্ধু পদক প্রাপ্ত শিল্পী সৈয়দ নূরুল আউয়াল তারামিঞা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁরা ডাক্তারী সেবা ছাড়াও একজন সচেতন নাগরিকে হিসেবে দেশের মানুষের মুক্তির সংগ্রামে তাঁর নিরলস ভূমিকার জন্য তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদন করেন এবং তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারে পরিজনের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। পরিষদ সভাপতি মোহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম তাঁর বিষয়ে স্সৃতিচারণ করে বলেন- “তিনি কিশোরগঞ্জ টেক্সটাইল মিলের মেডিক্যাল অফিসার হিসেবে আমাদের স্যার ছিলেন। ছাত্র অবস্থা থেকেই আমি চিকিৎসা ক্ষেত্রে তাঁর রোগী হতাম। প্রথম দিন রোগী হওয়ার কথা আমার জীবনে স্মরনীয় হয়ে আছে। তিনি নিজ বাসায় তখন চেম্বার করতেন। ১৯৭৫ সালের কথা। তখন ফিস ছিলো ২০ টাকা।তিনি প্রেসক্রিপশন লেখার পর যখন পকেটে হাত দিলাম টাকা দেয়ার জন্য তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন কোথায় পড়ি। আমি গুরুদয়াল কলেজে পড়ি বলায় তিনি বল্লেন ফিস লাগবেনা। তিনি ছাত্রদের কাছ থেকে ফিস নেন না। তাঁর সে ঘটনা আমার জীবন স্মৃতি হয়ে আছে। তিনি অনেক বড় মনের মানুষ ছিলেন। তিনি ঢাকা মেডিকেলের ছাত্র হিসেবে সরাসরি ভাষা আন্দোলনে জড়িত ছিলেন যে ইতিহাস আমিই প্রথম ১৯৯১ সালে জাতীয় পত্রিকায় তুলে ধরি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষনার ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ সবকিছুর তিনি ছিলেন নীরব সাক্ষী। তাঁর সুযোগ্য পুত্র ড.মাহফুজ পারভেজ সহ পরিবারের সবার প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করছি। আল্লাহপাক এ পরহেজগার লোকটিকে জান্নাতের মেহমান হিসেবে কবুল করুন।আমিন।”

ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামী, ভাষাসৈনিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কিশোরগঞ্জের বরিষ্ঠ চিকিৎসক ডা. এ.এ. মাজহারুল হক মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা জানিয়েছেন সেন্টার ফর এশিয়ান স্টাডিজ এর নির্বাহী পরিচালক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানি ভূঁইয়া মনোয়ার কবির। চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি), শাহ মাহতাব আলী ফাউন্ডেশন, রাষ্ট্রবিজ্ঞানি প্রফেসর শেখ জহির আহমেদ, প্রফেসর ড. জিনাত আরা নাজনীন, আনন্দমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আমানুল্লাহ বুবুল, সাংবাদিক ও চিন্তক মারুফ কামাল খান, সাংবাদিক ও অনুবাদক আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, সাংবাদিকতা নিয়ামত মিয়া, কবি শাকিল রিয়াজ, নারীনেত্রী ফাতেমা জোহরা, কিশোরগঞ্জের রাজনীতিবিদ জাহাঙ্গীর মোল্লা, সাহিত্যিক সৈয়দ আজিম, সাংবাদিক আহমদ ফরিদ, কিশোরগঞ্জনিউজ সম্পাদক আশরাফুল ইসলাম, সাংস্কৃতিকজন মু, আ, লতিফ, লুৎফুন্নেছা চিনু, সৈয়দ শাকিল, সোহেল রানা, ফেসবুক গ্রুপ জন্মভূমি কিশোরগঞ্জ, উজানভাটি কিশোরগঞ্জসহ অসংখ্য ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। যাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন ডা. এ.এ. মাজহারুল হক এর বড় ছেলে বার্তা২৪.কম'র অ্যাসোসিয়েট এডিটর, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)'র নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. মাহফুজ পারভেজ ও মেয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা যুব মহিলা লীগের সভাপতি শায়লা পারভীন সাথী।

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের আদিপর্বের ছাত্র ডা. এ.এ. মাজহারুল হক মাতৃভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচির সঙ্গে সঙ্গে শহীদদের স্মরণে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের নির্মিত প্রথম ইটের শহীদ মিনার তৈরিতে যোগ দেন।

তিনি মাতৃভূমির প্রায় প্রতিটি বিজয়-সংগ্রামেই, বিশেষ করে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় অবদান রাখেন।

১৯৪৬-৪৭ সালে ছাত্রাবস্থায় ব্রিটিশ হটাও আন্দোলনে প্রবলভাবে যুক্ত থেকে তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন। ভাষা আন্দোলনে সংক্ষিপ্ত কারাবাসসহ সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।

১৯৭১ সালে তিনিই প্রথম মুক্তিকামী কিশোরগঞ্জবাসীকে স্বাধীনতার ঘোষণা অবহিত ও প্রচার করেন এবং তাঁর নেতৃত্বে নিজ বাসভবনেই আত্মসমর্পনের অনুষ্ঠান সম্পন্ন করেন রক্তপাতহীনভাবে কিশোরগঞ্জের পতন ঘটিয়ে সেখানে সর্বপ্রথম স্বাধীনতার পতাকা উড্ডীন করেন।

কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের গৌরাঙ্গবাজারের বাসিন্দা ডা. এ.এ. মাজহারুল হক প্রায় ৬৯ বছর কিশোরগঞ্জে নিরবিচ্ছিন্নভাবে চিকিৎসা-সমাজসেবা-রাজনীতির মহানব্রত পালনের মাধ্যমে মানুষের কল্যাণে নিরন্তর ভূমিকা রেখেছেন। ডা. এ.এ. মাজহারুল হক ও সমাজসেবী নূরজাহান বেগম প্রতিষ্ঠিত কিশোরগঞ্জের সমাজ-সংস্কৃতি-সাহিত্য বিষয়ক সমীক্ষাধর্মী মাজহারুন-নূর ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে মরহুম বিভিন্ন জনহিতকর ও সমাজসেবামূলক কাজ করে গেছেন।

এছাড়া বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসাসহ দ্বীনি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার সঙ্গে তিনি সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

ডা. এ.এ. মাজহারুল হক এর মৃত্যুতে কিশোরগঞ্জের সামাজিক, রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি উজ্জ্বল অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলেও তিনি স্মরণীয় হয়ে থাকবেন ইতিহাসের সত্যনিষ্ঠ ভাষ্যে, বস্তুনিষ্ঠ বিবরণে আর মানুষের বিনম্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়।

আরও শোক জানিয়েছেন আইন অনুষদের ডিন প্রফেসর ড. আবদুল্লাহ ফারুক, ইতিহাসবিদ প্রফেসর আনোয়ারুল ইসলাম, লায়ন হারুন অর রশীদ, কৃষক লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন বাচ্চু, আওয়ামী লীগ নেতা লুৎফুল আরেফিন গোলাপ, ছাত্রনেতা আমিনুল ইসলাম তৌহিদ, সাংবাদিক ফারুকুজ্জামান, নিসর্গী প্রফেসর মোহাম্মাদ আলম চৌধুরী, লেখক মুহাম্মদ ইসহাক, ইসলামী ব্যাংকের পরিচালক প্রফেসর ড. সালেহ জহুর, উন্নয়ন সংগঠক রেজাউল ইসলাম পিন্টু, সাংবাদিক সমরেশ বৈদ্য, সাংবাদিক মোহাম্মাদ শাহনেওয়াজ, মিডিয়া গবেষক ড. কামরুল হক, সামসাদ রানা প্রমুখ।

;

দেশে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব



ড. মতিউর রহমান
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সোশ্যাল মিডিয়ার আবির্ভাব আমাদের যোগাযোগ, সংযোগ এবং তথ্য ভাগ করার উপায়কে পরিবর্তন করেছে। যদিও তরুণ প্রজন্ম এটিকে ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছে, বয়স্ক ব্যক্তিদের ওপর এর প্রভাব ক্রমবর্ধমান আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের মতো একটি দেশে, যেখানে ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ এবং ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায়গুলি দীর্ঘকাল ধরে আদর্শ ছিল, বয়স্ক ব্যক্তিদের জীবনে সোশ্যাল মিডিয়ার একীকরণ একটি উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিনিধিত্ব করে।

ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি বাংলাদেশের আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। স্মার্টফোনের বিস্তার এবং সাশ্রয়ী মূল্যের ইন্টারনেট অ্যাক্সেস সমস্ত বয়সের মানুষকে এই প্ল্যাটফর্মগুলির সাথে যুক্ত হতে সক্ষম করেছে। যদিও শহুরে এলাকার যুবকরা দ্রুত সোশ্যাল মিডিয়া গ্রহণ করেছে, এর প্রভাব ক্রমশ গ্রামীণ এবং বয়স্ক জনসংখ্যায় ছড়িয়ে পড়ছে। বাংলাদেশের বয়স্ক ব্যক্তিরা কীভাবে অন্যদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে এবং তথ্য অ্যাক্সেস করে তার জন্য এই পরিবর্তনের সুদূরপ্রসারী ফলাফল রয়েছে।

বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ার অন্যতম উল্লেখযোগ্য সুবিধা হল সামাজিক সংযোগের সুযোগ। একটি সমাজে যেখানে ঐতিহ্যগত সামাজিক সমাবেশগুলি প্রায়শই পরিবার এবং ঘনিষ্ঠ সম্প্রদায়ের চারপাশে আবর্তিত হয়, সোশ্যাল মিডিয়া ভৌগলিক সীমানার বাইরে একজনের সামাজিক নেটওয়ার্ককে প্রসারিত করতে পারে। বয়স্ক ব্যক্তিরা দীর্ঘদিনের হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের সাথে পুনরায় সংযোগ স্থাপন করতে পারে, বিদেশে আত্মীয়দের সাথে যোগাযোগ রাখতে পারে এবং তাদের আগ্রহগুলি ভাগ করে এমন অনলাইন সম্প্রদায়গুলিতে জড়িত হতে পারে।

বাংলাদেশের বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সোশ্যাল মিডিয়া একটি মূল্যবান তথ্যের উৎস। বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে সংবাদ আপডেট, স্বাস্থ্য টিপস এবং শিক্ষামূলক বিষয় পাওয়া যায়। এটি বয়স্ক ব্যক্তিদের বর্তমান ঘটনা, স্বাস্থ্য সমস্যা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকতে সক্ষম করে, তাদের সামগ্রিক জ্ঞান এবং সুস্থতা বাড়ায়।

একাকীত্ব এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার মুখোমুখি হওয়া বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য সাধারণ চ্যালেঞ্জ। সোশ্যাল মিডিয়া পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার জন্য একটি ভার্চুয়াল স্থান প্রদান করে এই অনুভূতিগুলি উপশম করতে সাহায্য করতে পারে। মেসেজিং অ্যাপ বা ভিডিও কলের মাধ্যমেই হোক না কেন, বয়স্ক লোকেরা সংযোগের অনুভূতি বজায় রাখতে পারে এমনকি যখন শারীরিক দূরত্ব তাদের প্রিয়জনদের থেকে আলাদা করে। বাংলাদেশের একটি সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে, এবং সোশ্যাল মিডিয়া বয়স্ক ব্যক্তিদের সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ এবং অংশগ্রহণের অনুমতি দেয়। তারা তরুণ প্রজন্মের সাথে ঐতিহ্যবাহী রেসিপি, গল্প এবং রীতিনীতি শেয়ার করতে পারে, দেশের স্থায়ী সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নিশ্চিত করে ।

সোশ্যাল মিডিয়ার অনেক সুবিধা সত্ত্বেও বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রায়ই ডিজিটাল সাক্ষরতার সাথে সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ এই প্ল্যাটফর্মগুলি ব্যবহার জটিলতার মুখোমুখি হন, যা তাদেরকে হতাশা এবং বর্জনের দিকে পরিচালিত করে। এই ডিজিটাল যুগে প্রবীণদের আরও ক্ষমতায়নের জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির মাধ্যমে ডিজিটাল বিভাজন দূর করা অপরিহার্য।

সোশ্যাল মিডিয়াতে বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য গোপনীয়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্বেগ। অনেকেই জানেন না কিভাবে তাদের ব্যক্তিগত তথ্য রক্ষা করা যায় বা সম্ভাব্য ঝুঁকি যেমন অনলাইন স্ক্যাম এবং পরিচয় চুরি ঠেকানো যায়। এই উদ্বেগগুলি মোকাবিলা করার জন্য অনলাইন নিরাপত্তা বিষয়ে শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সোশ্যাল মিডিয়ার অত্যধিক ব্যবহার কিছু বয়স্ক ব্যক্তির জন্য সামাজিক বিচ্ছিন্নতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। অনলাইনে অত্যধিক সময় ব্যয় করা সামনাসামনি মিথস্ক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে পারে, সম্ভাব্য একাকীত্বকে হ্রাস করার পরিবর্তে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।

সোশ্যাল মিডিয়া বোঝার এবং ব্যবহার করার ক্ষেত্রে প্রজন্মগত ব্যবধান থাকতে পারে। এই ব্যবধানটি বিভিন্ন অনলাইন যোগাযোগ এবং গোপনীয়তার প্রত্যাশার সাথে পরিবারের বয়স্ক এবং অল্পবয়সী সদস্যদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি বা দ্বন্দ্বের কারণও হতে পারে।

অন্য কারো মতো, বয়স্ক ব্যক্তিরা অনলাইন হয়রানি বা সাইবার বুলিং এর লক্ষ্য হতে পারে। এই ধরনের পরিস্থিতি থেকে নিজেদের রক্ষা করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে তা নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক।

বাংলাদেশের বয়স্ক ব্যক্তিদের মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রজন্মগত ব্যবধান পূরণের প্রচেষ্টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকারি সংস্থা, এনজিও এবং সম্প্রদায় সংস্থাগুলি বিশেষভাবে বয়স্কদের জন্য ডিজাইন করা ডিজিটাল সাক্ষরতা প্রোগ্রামগুলি অফার করতে সহযোগিতা করতে পারে। এই প্রোগ্রামগুলির মৌলিক কম্পিউটার দক্ষতা, ইন্টারনেট নিরাপত্তা, এবং সামাজিক মিডিয়া ব্যবহার কভার করা উচিত। আন্তঃপ্রজন্মীয় শিক্ষার অভিজ্ঞতাকে উৎসাহিত করা অত্যন্ত উপকারী হতে পারে। পরিবারের অল্পবয়সী সদস্যরা তাদের প্রবীণদের সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডিজিটাল টুলস সম্পর্কে শিক্ষা দিতে পারে, একতা এবং পারস্পরিক সমর্থনের অনুভূতি জাগিয়ে তুলতে পারে।

অনলাইন নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তা কর্মশালার আয়োজন করার মাধ্যমে বয়স্ক ব্যক্তিদের সম্ভাব্য ঝুঁকি থেকে নিজেদের রক্ষা করার ক্ষমতা দিতে পারে। এই কর্মশালাগুলিতে ফিশিং প্রচেষ্টাকে স্বীকৃতি দেওয়া, শক্তিশালী পাসওয়ার্ড সেট করা এবং গোপনীয়তা সেটিংস কার্যকরভাবে ব্যবহার করার মতো বিষয়গুলিকে কভার করা উচিত ।

বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য তৈরি অনলাইন সম্প্রদায়গুলি তাদের সমবয়সীদের সাথে জড়িত থাকার জন্য একটি নিরাপদ স্পেস এবং স্বাগত জানাতে পারে। এই সম্প্রদায়গুলি ভাগ করা আগ্রহের উপর ফোকাস করতে পারে, যেমন শখ, স্বাস্থ্য উদ্বেগ, বা সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ। সরকার বয়স্ক বয়স্কদের জন্য ব্যবহারকারী-বান্ধব ইন্টারফেস তৈরি করতে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলিকে উৎসাহিত করে এবং কম আয়ের বয়স্কদের জন্য ইন্টারনেট অ্যাক্সেসে ভর্তুকি দিয়ে ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির প্রচার করতে পারে।

পরিবারগুলি সক্রিয়ভাবে বয়স্ক সদস্যদের তাদের অনলাইন কার্যকলাপে জড়িত করতে পারে, তাদের পারিবারিক চ্যাটে অংশগ্রহণ করতে এবং ভার্চুয়াল উদযাপন এবং সমাবেশের আনন্দ ভাগ করে নিতে উৎসাহিত করতে পারে।

সামাজিক যোগাযোগ, তথ্য অ্যাক্সেস এবং সাংস্কৃতিক সংরক্ষণের সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে বাংলাদেশের বয়স্ক ব্যক্তিদের জীবনে প্রজন্মগত বিভেদ ঘটানো এবং তাদের জীবনকে উন্নত করার ক্ষমতা সোশ্যাল মিডিয়ার রয়েছে।

ডিজিটাল সাক্ষরতা, গোপনীয়তার উদ্বেগ এবং সামাজিক বিচ্ছিন্নতার ঝুঁকির মতো এই সুবিধাগুলি সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করার জন্য তাদের চ্যালেঞ্জগুলিকে মোকাবিলা করা অপরিহার্য । লক্ষ্যযুক্ত উদ্যোগ বাস্তবায়ন করে এবং আন্তঃপ্রজন্ম সমর্থনের সংস্কৃতি গড়ে তোলার মাধ্যমে, বাংলাদেশ বয়স নির্বিশেষে তার সকল নাগরিকের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে সোশ্যাল মিডিয়ার শক্তিকে কাজে লাগাতে পারে।

ড. মতিউর রহমান: গবেষক ও উন্নয়নকর্মী।

;