মাস্টারদার চেতনা, নেতাজীর ভারত অভিযান ও মহাজাতির অধরা স্বপ্ন



আশরাফুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

গর্বিত জাতির আত্মপরিচয় নির্ণীত হয় তার বীরসন্তানদের অকাতর আত্মত্যাগের মহিমায়। ঠিক এই মানদণ্ডে যখন বিশ্বের জাতিসমূহকে বিচার করা হবে তখন নিশ্চিতভাবেই বাঙালি জাতির আসন অত্যুজ্জ্বল এক উচ্চতায় সমাসীন হবে, তাতে সামান্য সন্দেহ নেই।

আত্মগৌরবের এই মহিমায় বলিয়ান হয়েই হয়তো কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩৯ সালের ১৯ আগস্ট কলকাতার মহাজাতি সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘জাগ্রত চিত্তকে আহ্বান করি, যার সংস্কারমুক্ত উদার আতিথ্যে মনুষ্যত্ত্বের সর্বাঙ্গীন মুক্তি অকৃত্রিম সত্যতা লাভ করুক... সেইসঙ্গে এই কথা যোগ করা হোক, বাঙালির বাহু ভারতের বাহুকে বল দিক, বাঙালির বাণী ভারতের বাণীকে সত্য করুক।’

বাঙালি জাতির সংগ্রামী ঐতিহ্যের সুদীর্ঘ গৌরবময় পরম্পরায় যারা আমাদের জন্য মর্যাদার এই আসন তৈরি করে গেছেন-সুভাষচন্দ্র বসু ও সূর্য কুমার সেন তাদের মধ্যে অগ্রগণ্য দুই নাম। সূর্য সেন ও সুভাষচন্দ্র যে কবিগুরুর কাঙ্খিত সেই বীর সন্তান তা বলার অপেক্ষাই রাখে না। রাজমণি সেন ও শশীবালা সেনের পুত্র সূর্য চট্টগ্রামে স্বদেশী আন্দোলনের আবহে বেড়ে উঠেন। কিন্তু তার সত্ত্বায় বিপ্লববাদের মন্ত্র প্রবলভাবে রেখাপাত করে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে অধ্যয়নের সময়। সেখানে সূর্য সেন বিপ্লবী বাঘা যতীনের শিষ্য অধ্যাপক সতীশচন্দ্র চক্রবর্তী ও অতুল ঘোষের সান্নিধ্য পান। চট্টগ্রামে ফিরে সূর্য সেন শিক্ষকতায় যোগ দিলেও বিপ্লবী কার্যই তাঁর ধ্যানজ্ঞান হয়ে উঠে। পরিবারের চাপে পুষ্পকুন্তলা দেবীকে বিয়ে করলেও বিপ্লবী জীবনের মহান ব্রত তাকে বৈবাহিক জীবনে প্রবেশ করতে দেয়নি।

বারীন্দ্র কুমার ঘোষের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী দল যুগান্তরে যুক্ত হন সূর্য সেন। ঔপনিবেশিক রাজশক্তির মূলোৎপাটনে সশস্ত্র সংগ্রামের পথকেই তিনি বেছে নেন। অম্বিকা চক্রবর্তীকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রাম শহরে সাম্য আশ্রম প্রতিষ্ঠা করে সূর্য সেন মূলতঃ বৈপ্লবিক কর্মকান্ডের ভীত মজবুত করতে প্রয়াসী হন।

পরবর্তীতে সূর্য সেন বৈপ্লবিক কর্মকা-ের সাংগঠনিক ভিত্তিকে আরও সুদৃঢ় করতে গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ, নির্মল সেন, লোকনাথ বল, অনুরূপ সেন ও নগেন্দ্রনাথ সেনের মতো বলিষ্ঠ বিপ্লবীদের পাশে পান। সুভাষচন্দ্র বসুর মতো কংগ্রেসের বৈপ্লবিক নেতার সঙ্গে ঘনিষ্ট যোগসাজশ ছাড়াও সূর্য সেন যোগাযোগ স্থাপন করেছিলেন হিন্দুস্তান স্যোশালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গেও। ভগত সিং, বটুকেশ্বর দত্ত ও সুখদেবের মতো বিশিষ্ট বিপ্লবীদের সঙ্গেও সূর্য সেনের সংযোগ ভিন্ন মাত্রা যোগ করে।

মাষ্টারদা সূর্য সেন ও নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শিক সংহতি নিয়ে আলোচনা এজন্য গুরুত্বপূর্ণ যে, সমকালীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজে এই মহানায়কদের মহিমান্বিত জীবন আমাদের পথনির্দেশকের ভূমিকা পালন করে। দেশের টালমাটাল পরিস্থিতিতে দুই মহান সংগ্রামীর এক অপূর্ব যুগলবন্ধী রচিত হয় কলকাতায় ১৯২৮ সালে কংগ্রেস অধিবেশনকে ঘিরে। এখানেই রচিত হয় চিরবিপ্লবী সুভাষচন্দ্রের সঙ্গে আরেক আজন্ম বিপ্লবী সূর্য সেনের গভীর সম্মিলন।

কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানে জাতীয় কংগ্রেসের ঐতিহাসিক অধিবেশন। সেখানে উপস্থিত স্বয়ং মহাত্মা গান্ধী, মতিলাল নেহেরুসহ জাতীয় নেতৃবৃন্দ। বিশাল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতৃত্বে তারুণ্যে উদ্দীপ্ত সামরিক পোশাকে অশ্বারোহী সুভাষচন্দ্র বসু। রণসাজে কুচকাওয়াজ দলের অভূতপূর্ব উপস্থিতি চট্টগ্রামের তরুণ বিপ্লবীদের মনে আনন্দের হিন্দোল বইয়ে দেয়। চট্টগ্রামে ফিরে সূর্য সেনের নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি’।

উল্লেখ করা প্রয়োজন, পার্ক সার্কাসে কংগ্রেসের জাতীয় অধিবেশনে অর্ভ্যথনায় সুভাষচন্দ্রের সামরিক অভিবাদন ভালো ভাবে নেননি গান্ধী। অধিবেশনই তিনি মন্তব্য করেন, ‘পার্ক সার্কাসে সার্কাস হচ্ছে।’ যা হবার তাই হলো অধিবেশনে ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি উত্থাপনে প্রবল দাবি সত্ত্বেও গান্ধীর হস্তক্ষেপে তা উপস্থাপিত হলো না। এতে ক্ষোভ ক্রমেই ফেনায়িত হতে থাকে। ফলশ্রুতিতে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রচেষ্টা কয়েক ধাপ এগিয়ে যায়। এগিয়ে চলতে থাকে চট্টগ্রামে সশস্ত্র যুব বিদ্রোহের প্রস্ততিও।

১৯২৯ সালের অক্টোবরে আহুত হয় চট্টগ্রামে কংগ্রসের জেলা সম্মেলন। সম্মেলনে কলকাতা থেকে আসেন সুভাষচন্দ্র বসু, নগেন্দ্র ব্যানার্জী ও লতিকা বসু। সুভাষচন্দ্র বসুর সভাপতিত্বে সম্মেলনে মহিমচন্দ্র দাশগুপ্ত সভাপতি ও সূর্য সেন সম্পাদক হন। যুব সংগঠনের নেতৃত্বে আসেন সূর্য সেনপন্থী গণেশ ঘোষ, অনন্ত সিংহ ও লোকনাথ বলসহ এক ঝাঁক তরুণ বিপ্লবী। যার মধ্য দিয়ে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্তের বলয় থেকে পরিপূর্ণভাবে সুভাষচন্দ্র বসুর বলয় চট্টগ্রামের রাজনীতি অধিকার করে। যার মধ্য দিয়ে প্রসারিত হয় সশস্ত্র বিপ্লবের পথ। বিশেষ করে চট্টগ্রামে মুসলিম তরুণদের সশস্ত্র বিপ্লবে প্রকাশ্যে কম দেখা গেলেও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে কোনো মতৈক্য ছিল না তাদের। বরং বিভিন্ন সময়ে বৈপ্লবিক প্রচেষ্টাকে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা দিয়ে মুসলিম যুবকরাও তাতে শামিল হয়ে ছিলেন।

এবিষয়ে গবেষক আহমেদ মমতাজ উল্লেখ করেছেন, ‘অসহযোগ আন্দোলনের প্রাক্কালে মুসলিম সমাজের স্বাধীনতাকামী যুবকদের একটি অংশ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত হতে শুরু করে। প্রদেশ কংগ্রেসের শীর্ষ স্থানীয় প্রভাবশালী নেতা সুভাষচন্দ্র বসুর প্রতি অনুগত ছিলেন যুগান্তর দলের বিপ্লবীরা। একজন দেশপ্রেমিক, সৎ, মেধাবী ও উদারপন্থী নেতা হিসেবে হিন্দু-মুসলিম সকল ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষ তাঁকে বিশ্বাস করতেন। কংগ্রেসের স্বাধীনতাকামী ও উদারপন্থী অংশটির তিনিই ছিলেন আস্থাভাজন নেতা।’

চট্টগ্রাম যুববিদ্রোহের পটভূমিটি কিভাবে রচিত হয়েছিল তা জানতে হলে একটি বিশেষ ঘটনার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই হবে। এবিষয়ে আহমদ মমতাজ লিখেছেন, ‘‘চট্টগ্রামের সূর্য সেনের নেতৃত্বাধীন অংশ সুভাষচন্দ্র বসুর অনুসারী ছিলেন। ১৯২৮ সালের ৩০-৩১শে ডিসেম্বর কলকাতা কংগ্রেসের প্রাক্কালে আগের রাতে ২৯শে ডিসেম্বর কংগ্রেসের স্বাধীনতাপন্থী বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে জে সি গুপ্তের বাড়িতে এক সভা আহ্বান করেন।

সে সভায় চট্টগ্রামের বিপ্লবীদের কয়েকজনের সাথে হাবীবুল্লাহ বাহার, মোহাম্মদ মোদাব্বের প্রমূখ মুসলমান যুবক উপস্থিত ছিলেন। সুভাষচন্দ্র সভায় ঘোষণা করেন কংগ্রেসের অধিবেশন শুরু হবে কবি নজরুলের ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ গান দিয়ে এবং সমাপ্তি সংগীতও হবে নজরুলের ‘চল্ চল্ চল্’ দিয়ে।’’ সুভাষচন্দ্র জানান, এতে অবাঙালি নেতারা আপত্তি জানিয়েছিলেন কিন্তু সুভাষ হুমকি দেন এই বলে যে, আপত্তি করলে কংগ্রেসের অধিবেশন পণ্ড করে দেব।’

সুভাষচন্দ্র কর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, ‘‘স্বাধীনতা সংগ্রামের রূপরেখায় পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। কংগ্রেসকে বহিরাবরণ হিসেবে ব্যবহার করে স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য গণসহযোগিতা প্রয়োজন। আয়ারল্যান্ডকে আদর্শ হিসেবে সামনে রেখে বৃহত্তর সংগ্রামের প্রস্তুতি নিতে হবে।’’

সভায় সুভাষচন্দ্র ভারতের মুক্তির অভিযানে ধর্মীয় গোঁড়ামীর বিষয়ে সতর্ক করে বলেন, ‘যুগান্তর দল তার পুরাতন সনাতনী ঐতিহ্য এখনও পুরোপুরি বিসর্জন দিতে পারেনি। মুসলমানরা সেজন্য এই পরিবেশে মিশতে পারছে না। এজন্য সব গোঁড়ামী বিসর্জন দিয়ে সর্ব ভারতীয় ও সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। ধর্ম ব্যক্তিগত বিশ্বাস, রাজনীতি সার্বজনীন সংগ্রামী নীতি।’

সুভাষচন্দ্রের আবেগমথিত সত্য উচ্চারণে সভায় প্রত্যেক সদস্য হাতের আঙুল কেটে রক্ত বের করে স্বাক্ষর করেন দলের শপথনামায়। অতঃপর কবি কাজী নজরুল ইসলাম শপথনামা পাঠ করান ও নিজের লেখা ‘টলমল টলমল পদভারে’ গান গেয়ে সভার সমাপ্তি করেন। সেই সময়কার ঘটনাপ্রবাহ মূল্যায়ন করে একথা আমরা দৃঢ়চিত্তেই বলতে পারি, ভারতের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্তপর্বের কান্ডারী নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর মাতৃভূমির মুক্তির সাধনায় সংগ্রামের যে পথকে বেছে নিয়েছিলেন একজন মাষ্টারদা সূর্য সেন ও তাঁর অকুতোভয় সহযোদ্ধারা তা বাস্তবায়নে সর্বাগ্রে এগিয়ে এসেছিলেন।

মাষ্টারদা’র নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল থেকে ২২ এপ্রিল অবধি চারটি দিন ব্রিটিশ শাসন থেকে কার্যত চট্টগ্রামকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলার যে মহাউপাখ্যান সৃষ্টি করেছিলেন-তা দারুণভাবে উদ্বেলিত করে সুভাষচন্দ্র বসুকে। লক্ষ্য করে দেখব, সুভাষচন্দ্র বসু ১৯৩৯ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করবার পর গোপানে ভারত ত্যাগ করবার পূর্বে ১৯৪০ সালে তাঁর শেষ প্রকাশ্য রাজনৈতিক সফর করেন পূর্ববঙ্গে। সুভাষচন্দ্রের পূর্ববঙ্গ সফরে ঢাকাসহ অন্যান্য কয়েকটি শহরে সভা করলেও বেশি সময় তিনি অবস্থান করেন বিপ্লবতীর্থ চট্টগ্রামেই।

ইতিহাস-ঐতিহ্য গবেষক ওয়াকার এ খান তাঁর ‘নেতাজী সুভাষ বোস ইন চট্টগ্রাম’ শীর্ষক লেখায় আমরা জানতে পারছি-নেতাজীর চট্টগ্রাম সফরের সময়কার ইতিবৃত্ত। সেই লেখায় আমরা জানতে পারছি, ১৯৩৮ সালে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি থাকার সময়ে চট্টগ্রাম সফরে সুভাষচন্দ্র বসু যে রাজকীয় অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন ১৯৪০ এ সভাপতির পদত্যাগ করার পরও তার কোনো ব্যতয় হয়নি। তিনি চট্টগ্রামের দেব জমিদার পরিবারের পরম আতিথ্যে পুরো সময়টা স্বাচ্ছন্দ্যে কাটিয়েছিলেন। আমরা সেই সফরের যেসব ছবি দেব জমিদার পরিবারের উত্তরপ্রজন্মের তনুশ্রী দে’র তরফে পাচ্ছি-তাতে দেখা যাচ্ছে কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ ছাড়াও স্বয়ং জমিদার নবীনচন্দ্র দেব বর্মন সুভাষচন্দ্রকে স্বাগত জানাচ্ছেন।

সুভাষচন্দ্র বসুর সঙ্গে ছবিতে অনেকের সঙ্গে জমিদার পরিবারের সদস্য উর্মিলা দেব বল ও তাঁর স্বামী সুবোধ বলকেও দেখা যাচ্ছে। সুবোধ বল মাষ্টারদা সূর্য সেনের অন্যতম সহযোগি এবং জালালাবাদ পাহাড় যুদ্ধে আহত বিপ্লবী লোকনাথ বলের ভাই। গোয়েন্দা নজরদারির মাঝেও সুভাষচন্দ্র বসু যে চট্টগ্রাম সফরে বিপ্লবীদের সঙ্গে একাধিক সভায় মিলিত হয়েছিলেন তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিয়ে নেতাজী সুভাষচন্দ্রের ভারতের স্বাধীনতার জন্য আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন করে যে অভিযান তিনি পরিচালনা করেছিলেন মাস্টারদা সূর্য সেনের চট্টগ্রাম মুক্তির সেই অভিযাত্রী দলকে স্বাগত জানাতে প্রস্তুত ছিল। একাধিক গ্রন্থে’র তথ্য অনুযায়ী, মৌলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী নেতাজীর আজাদ হিন্দ ফৌজ বার্মায় অবস্থানকালে গোপানে একাধিকবার ছদ্মবেশে যাতায়াত করেছিলেন। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডর নিকটে জঙ্গলাকীর্ণ একটি স্থানে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী আজাদ হিন্দ্ ফৌজের গোপন ঘাঁটি নির্মাণের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশঃ সেই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে গেলে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে কারা অন্তরীণ হন।

‘বিশ্বের মহান দেশ’ ‘শ্রেষ্ঠ জাতি’ ‘স্বর্গের দ্বার’ ইত্যাদি অভিধায় অভিষিক্ত হওয়ার যে গৌরব আমাদের রয়েছে তার চেয়েই বেশি ক্ষত আজও আমরা বয়ে বেড়াচ্ছি। সবচেযে বড় ক্ষত হচ্ছে নিশ্চিতভাবেই দেশভাগ। মহাবিপ্লবী রাসবিহারী বসু, বাঘা যতীন, ভগত সিং, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, মাস্টারদা সূর্য সেন-সহ অজস্র মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীর রক্তস্রোতের ওপর দাঁড়িয়ে আছে; যে ভূখণ্ড ঔপনিবেশিক শক্তির যোগসাজশে তাকে দ্বিখণ্ডিত করা হলো। বহুগুণে উত্থান হলো সাম্প্রদায়িক অপশক্তির। এক স্বাধীন মহাজাতির স্বপ্ন নিয়ে যেসব মহান স্বাধীনতা সংগ্রামীরা অকাতরে প্রাণদান করে দৃষ্টান্ত গড়ে গিয়েছিলেন, তাদের অন্তরাত্মার চিৎকার আমরা ক’জন শুনছি?

এবং একথাও উল্লেখ করতে হবে-যেসব মহান বিপ্লবীদের সংগ্রামী চেতনা ধারণ করে মুক্তিযোদ্ধারা ১৯৭১ এ বাংলাদেশ স্বাধীন করলেন সেই দেশের জাতীয় উদযাপনে অনেকটাই উপেক্ষিত মহান বিপ্লবীরা। স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রতি উপেক্ষা জাতিকে সম্মানিত করে না। আমরা এই মনেবৃত্তির পরিবর্তন আশা করি।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, বহুমাত্রিক.কম ও ইতিহাস গবেষক

প্রাইভেট এয়ারলাইন্স এগিয়ে যায় নিজের সক্ষমতাকে সঙ্গী করে



মো. কামরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

কিছুদিন যাবত প্রায় শুনে থাকছি এয়ারলাইন্সগুলোর ভাড়া অনেক বেশী। আগে তো এই ভাড়া ছিলো এখন কেনো এতো বেশী? প্রি-কোভিডে অর্ধেক ভাড়ায় বিদেশ যাওয়া যেতো, এখন অনেক বেশী টাকা প্রয়োজন হয়। ইত্যাদি নানাবিধ প্রশ্ন শুনতে হয় এয়ারলাইন্স ও ট্রাভেল এজেন্সির কর্মীদের।

কোভিড এর মাঝপথে বিশেষ করে ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে জেট ফুয়েলের প্রাইস ছিলো ৪৬ টাকা প্রতি লিটার। বর্তমানে তা দাড়িয়েছে ১১৮ টাকা প্রতি লিটার। মাস চারেক আগেও ছিলো ১৩০ টাকা লিটার। শতকরা হিসেবে দাম বেড়েছে ১৬০ শতাংশের অধিক। পূর্বে এয়ারলাইন্সগুলোর পরিচালন ব্যয়ের ৪০-৪২ শতাংশ ব্যয় হতো জেট ফুয়েল ক্রয়ে। আর বর্তমানে পরিচালন ব্যয়ের প্রায় ৫০ শতাংশের অধিক ব্যয় হয় জেট ফুয়েল বাবদ।

এয়ারক্রাফট কিংবা এয়ারক্রাফট যন্ত্রাংশ আমদানি বাবদ কাস্টমস ডিউটি বেড়েছে প্রি-কোভিড থেকে প্রায় ১২ থেকে ১৮ শতাংশ। যা সরাসরি ভাড়ার উপর প্রভাব বিস্তার করে।

বাংলাদেশে কোভিড কালীন সময়ে বিমানবন্দর উন্নয়ন চার্জ ও সিকিউরিটি বাবদ দু’টি চার্জ নতুন করে সংযোজিত হয়েছে যা প্রি-কোভিডে ছিলো না। এই চার্জগুলোও ভাড়ার উপর প্রভাব ফেলেছে।

এমআরও সেন্টারগুলোতে এয়ারক্রাফট মেইনট্যানেন্স এর জন্য খরচ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাথে কোভিড পরবর্তীতে মেইনট্যানেন্স সিডিউল না পাওয়ার কারনেও বিশ্বের অধিকাংশ এয়ারলাইন্স তাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট সিডিউল মেইনটেইন করতে পারছে না। ফলে সিট ক্যাপাসিটির চেয়ে যাত্রী চাহিদা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় তা ভাড়া বৃদ্ধিতে প্রভাব বিস্তার করেছে।

বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে ডলারের দামের সাথে টাকার অবমূল্যায়ন হওয়ার কারনে কোভিড-১৯ কিংবা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব মারাত্বকভাবে এয়ারলাইন্সগুলোর ভাড়া বৃদ্ধিতে নিয়ামক হিসবে কাজ করেছে। বছরখানেক আগেও ১ ডলারের বিনিময়ে ৮৩/৮৪ টাকা পাওয়া যেত এখন সেখানে ১ ডলারের বিনিময়ে ব্যয় করতে হয় ১১৫-১২০ টাকা। ফলে ভাড়ায় সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।

বাংলাদেশে এয়ারলাইন্সগুলো টিকেট বিক্রয় করছে টাকায় কিন্তু সকল ধরনের খরচগুলো বহন করছে ডলারে। বিশেষ করে ইন্স্যুরেন্স, লিজিংমানি, ব্যাংক ইন্টারেস্ট, ফুয়েল প্রাইস, বিভিন্ন দেশের এ্যারোনোটিক্যাল চার্জ, আইএটিএ পেমেন্টসহ নানাবিধ খরচ সবই ব্যয় করতে হয় ডলারে। ফলে এয়ারলাইন্সগুলো খরচের সাথে আয়ের সমন্নয় করতে ভাড়া বৃদ্ধি করেছে। বিভিন্ন দেশের সাথে ফ্লাইট ফ্রিকোয়েন্সি বৃদ্ধি পেলে, ডলারের বিনিময়ে টাকার মান বৃদ্ধি পেলে, জেট ফুয়েলের মূল্য হ্রাস পেলে আনুপাতিক হারে যাত্রী ভাড়া কমার সম্ভাবনাও আছে।

অপরদিকে অর্থনীতির সাধারণ সংজ্ঞা যোগানের চেয়ে মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা থাকলে স্বাভাবিকভাবেই দাম বেড়ে থাকে। কোভিড পরবর্তী সব দেশে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার পর কিংবা ভিসা সংক্রান্ত জটিলতা কেটে যাবার পর বিমান যাত্রী বেড়েছে কয়েকগুন। সেই তুলনায় আসন সংখ্যা বাড়ানোর কোনো সুযোগ ছিলো না। ফলে বিভিন্ন রুটে যাত্রী চাহিদার কারনেও কিছুটা ভাড়া বেড়েছে।

প্রাইভেট এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশে নিজেদের আয়ের সক্ষমতার উপর ভিত্তি করেই ব্যয় নির্বাহ করে থাকে। বিশ্ব এভিয়েশনে কিংবা বাংলাদেশে ব্যয়ের সূচক যদি উর্ধ্বগামী থাকে তাহলে এয়ারলাইন্সগুলো নিজেদের টিকিয়ে রাখার জন্য এবং পূর্ণাঙ্গ যাত্রী সেবাকে নিশ্চিত রাখার জন্য খরচগুলোকে ভাড়ার সাথে সমন্নয় করে থাকে।

এয়ারলাইন্সগুলো যাত্রীদের সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে পারবে যদি নিজেদের অস্তিত্ব বিপন্ন না হয়। বাংলাদেশ এভিয়েশন ব্যবসাটা পরিচালিত হচ্ছে ভর্তুকি বিহীন। বিগত দিনে নানাবিধ কারনে বাংলাদেশ এভিয়েশন থেকে হারিয়ে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নেয়া বিশ্বের আকাশ দাপিয়ে বেড়ানো জিএমজি, ইউনাইটেড কিংবা রিজেন্ট এয়ারওয়েজসহ সাত আটটি এয়ারলাইন্স।

বর্তমানে পরিচালিত জাতীয় বিমান সংস্থাসহ চারটি এয়ারলাইন্স খরচের সাথে অনেকটা যুদ্ধ করে বাংলাদেশ এভিয়েশনে টিকে থাকার চেষ্টা করছে, সাথে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে মার্কেট শেয়ার ধরে রেখে দেশের জিডিপিতে অবদান রাখার চেষ্টা করছে।    

লেখক: মোঃ কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।

;

জেনোসাইডের স্বীকৃতি



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশের স্বাধীনতার বায়ান্ন বছরেও একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালরাত্রির জেনোসাইডের বৈশ্বিক স্বীকৃতি মেলেনি। বৈরী ভাবাদর্শের রাজনীতি এবং জেনোসাইড নিয়ে অমনোযোগিতা আমাদের পিছিয়ে দিয়েছে। কালরাত্রির অপারেশন সার্চলাইট নামের যে জেনোসাইড চলে, তার স্বীকৃতির সুযোগ ছিল। কিন্তু সেটাও আমরা আদায় করতে পারিনি। বলা যায়, সময়মতো চেষ্টা করা হয়নি।

পঁচিশে মার্চের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আমরা না পেলেও এখনও সুযোগ আছে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নির্যাতনের স্বীকৃতির।

একাত্তরের আট মাস বাইশ দিনে ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা থেকে শুরু করে দুই লাখের অধিক নারী-শিশুর ওপর যৌনসহিংসতা চালিয়েছিল পাকিস্তান এবং তাদের এদেশীয় দোসরেরা। নির্যাতনের ধরনগুলো জাতিসংঘ ঘোষিত জেনোসাইডের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মেলে। জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন এন্ড পানিসমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’-এর আর্টিকেল ২ অংশে জেনোসাইডের পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা আছে, যার কোনো একটি সংঘটিত হলে জেনোসাইডে বলা যাবে। ওই আর্টিকেল বলছে— কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া। এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্যই পাকিস্তান বাহিনীর দীর্ঘ নয় মাসের নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের মধ্যে রয়েছে।

একাত্তরের নয় মাস পাকিস্তানিদের নির্যাতনের সঙ্গে জেনোসাইডের জাতিসংঘ ঘোষিত সংজ্ঞার মধ্যে পড়লেও ২৫ মার্চের জেনোসাইডের বৈশ্বিক স্বীকৃতি নেই। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করার পর ওই বছর থেকেই দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ পালিত হচ্ছে। এছাড়া দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেওয়ার জন্য একটি বিলও পাস হয় সংসদে। বাংলাদেশ যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘গণহত্যা দিবস’ পালন শুরু করে তার দুই বছর আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী ‘গণহত্যা দিবস’ নামে একটি দিবস পালন হয়। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করে। এর ফলে ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির আর সুযোগ থাকছে না। তবে ২৫ মার্চকে জেনোসাইড দিবস হিসেবে পালনের বৈশ্বিক সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের এখনও সুযোগ রয়েছে একাত্তরের নয় মাসের পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির। কিন্তু এই স্বীকৃতি আদায়ে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম কত দূর, এ সম্পর্কেও আমরা নিশ্চিত নই। মার্চ এলেই কেবল জেনোসাইড নিয়ে কথা হয়, তবে এই কথাগুলো এতটা ক্ষীণ স্বরে যে, একদিনের আলোচনাতেই তা সীমাবদ্ধ।

পঁচিশে মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের দাবি নতুন নয়। নব্বইয়ের দশক থেকে এই দাবি জানিয়ে আসছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। ১৯৯৩ সালে ওঠা ওই দাবিকে পাত্তা দেয়নি তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার। ২০০১ সালে জাতিসংঘের ইউনেস্কোর কাছে বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান। জবাবে ইউনেস্কো জানিয়েছিল, স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশকে জাতিসংঘে তা তুলে ধরতে হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিক্রমে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাস করতে হবে। ২০০৬ সালে নির্মূল কমিটি আন্তর্জাতিকভাবে চেষ্টা শুরু করে। ২০০৭ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কো এবং জেনোসাইডের ভিকটিম বিভিন্ন দেশে চিঠি লিখে, আইন প্রণেতাদের সঙ্গে কথা বলে জেনোসাইড দিবস পালন প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে নির্মূল কমিটি। ২০১৫ সালের মার্চে আর্মেনিয়া থেকে পাল্টা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি কীভাবে পালন করা হয় এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পাঠানোর জন্য বলা হলে, নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে তখন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়।বাংলাদেশে এখনো দিবসটি ঘোষণা হয়নি। তবে এই দিনে বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ জেনোসাইডের শহিদদের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকেন। দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে যে দিবসের স্বীকৃতি নেই, বিশ্বব্যাপী হবে কীভাবে? হয়ওনি। ফলে ২৫ মার্চ নয়, ৯ ডিসেম্বরকেই বেছে নেয় জাতিসংঘ। এর ফলে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও আমরা ২৫ মার্চের জেনোসাইডের স্বীকৃতি আদায়ের সুযোগ হারাই। এটা নিশ্চিতভাবেই আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতা।

আশার কথা, একাত্তরের নয় মাসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ের পথ এখনই বন্ধ হচ্ছে না আমাদের। আর্মেনিয়া, রুয়ান্ডা ও যুগোস্লাভিয়ার জেনোসাইডের জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আদালতের স্বীকৃতি আছে। আর্মেনিয়ানদের এজন্যে শত বছর চেষ্টা ও অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমাদের অপেক্ষা করতে আপত্তি নেই, কিন্তু এজন্যে রাষ্ট্রীয় চেষ্টা-তদবির তো থাকতে হবে! এটা কতখানি রয়েছে, এ নিয়ে আশ্বস্ত হওয়া যাচ্ছে না এখনও।

একাত্তরের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ এবং আত্মত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত বিজয় আমাদের গৌরবের স্মারক। এই গৌরবকে উঁচুতে তোলে ধরতে আমাদের ওপর চালিত পাকিস্তানিদের জেনোসাইডকে অস্বীকার কিংবা অবমূল্যায়ন করা যাবে না। গৌরবের যে অর্জন, তার সঙ্গে জড়িয়ে যতখানি রক্ত আর সম্ভ্রম তার স্বীকৃতি দরকার; রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে, বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে!

কবির য়াহমদ: সাংবাদিক, কলাম লেখক।

;

স্মৃতিতে একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শামীম শিকদার



সামিয়া মহসীন
একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শিল্পী শামীম শিকদার

একুশে পদকপ্রাপ্ত ভাস্কর শিল্পী শামীম শিকদার

  • Font increase
  • Font Decrease

গত ২১ মার্চ রাজধানী ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিশিষ্ট ভাস্কর শামীম শিকদার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মহান এই গুণী শিল্পী ২০০০ সালে একুশে পদক লাভ করেন। ৭০ বছর বয়সী এই ভাস্কর কার্ডিওভাসকুলার, শ্বাসতন্ত্র এবং কিডনির জটিলতাসহ নানা শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। মৃত্যুকালে শামীম শিকদার ২ সন্তান রেখে গেছেন। চারুকলা প্রাঙ্গণে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর পর ঢাকার মোহাম্মদপুর কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়েছে ।

অসম্পূর্ণ কিছু কাজ শেষ করার উদ্দেশ্যেই কয়েক মাস আগে লন্ডন থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। ঢাবির চারুকলা অনুষদে জয়নুল আবেদিনের ভাস্কর্যটি আবার নতুন করে গড়ার স্বপ্ন দেখছিলেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গুয়ের্নিকা ভাস্কর্যও নতুন করে করার পরিকল্পনা ছিল শামীম শিকদারের।


ঢাবির চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের অধ্যাপক শামীম শিকদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে 'স্বোপার্জিত স্বাধীনতা' এবং ফুলার রোডে 'স্বাধীনতা সংগ্রাম' নির্মাণ করেন। এর আগে ১৯৭৪ সালে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্মরণে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে একটি ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই উনাকে কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে অবস্থিত ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ শিরোনামের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। ভাস্কর্যটির মূল বেদীতে আছে একাত্তরের বিভিন্ন ঘটনার চিত্র। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এটি স্থাপন করা হয়। এই ভাস্কর্য টি যখন তৈরি করা হয়েছিল, তখন খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল। তিনি সিমেন্ট, ব্রোঞ্জ, কাঠ, প্লাস্টার অব প্যারিস, কাদা, কাগজ স্টিল ও গ্লাস ফাইভার মাধ্যমে কাজ করেছেন। প্রখ্যাত কম্যুনিস্ট বিপ্লবী নেতা সিরাজ শিকদার শামীম শিকদারের আপন বড় ভাই।


শামীম শিকদার যখন ভাস্কর্য নির্মাণ করতেন কখনো তাঁর পরণে থাকতো জিন্স আর সাদা টি শার্ট। আবার কখনো সাদা শার্ট প্যান্ট । সাদা রঙ; তাঁর প্রিয় রঙ ছিল বলেই মনে হত। কপালে কখনো কখনো  ব্যান্ডানা বাঁধতেন। সেই আশির দশকে এমন একজন ভাস্কর শিল্পীর পোশাক সেই সময়ের মানুষকে ভীষণভাবে অবাক করতো। দু’হাতে যতো  কাজই করুন না কেন, ঠোঁটের কোণে সিগারেট ধরাই থাকতো। তখন তো এখনকার মতো মোবাইল ফোন ছিল না। থাকলে উনার কাজ করার মুহূর্তগুলোর স্মৃতি ধরে রাখা যেত। তাঁর সেই কাজগুলো যেগুলো তিল তিল করে ভালোবাসা আর শ্রম দিয়ে তিনি করেছিলেন সেই ভাস্কর্যগুলো ঠাঁই পেয়েছে ফুলার রোডের সড়ক দ্বীপে। ফুলার রোড এলাকায় ‘স্বাধীনতাসংগ্রাম’-এ  তাঁর করা ১১৬টি ভাস্কর্য ঠাঁই পেয়েছে। এই ভাস্কর্য পার্ক টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাকে অলঙ্করণ করেছে। এখানে তিনি আরও ১৩৪টি ভাস্কর্য তৈরির কাজের উদ্দেশ্য নিয়েই দেশে আসেন। কিন্তু তাঁর স্বপ্ন অধরাই রয়ে গেল।


শামীম শিকদার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ১৯৯৪ সালে স্বামী বিবেকানন্দের ভাস্কর্য নির্মাণ করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়েই উনার স্টাইল এবং কাজের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিলাম। আমার তো মনে হয় আশির দশক থেকে আজ অবধি কেউ তাঁকে ছুঁতে পেরেছে বলে মনে হয় না। একজন নারী স্রোতের বিপরীতে চলেও তাঁর রুচি, শিক্ষা ও কর্ম দিয়ে কিভাবে স্বাক্ষর রেখে যেতে পারেন। শামীম শিকদার তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। নারী বিদ্বেষীরা সেদিনও ছিলো, আজও আছে। তবে তাঁর মতো সাহসী নারী শত বছরে হয়তো একবারই জন্মে। বেশিরভাগ সময়েই মোটরবাইক চালিয়ে চলাচল করতেন। সেই সত্তর আশির দশকে এমনটা ঘটনা আসলেই বিরল ছিল। শখের বশে জুডো শিখেছিলেন।

এমন দেশপ্রেমী শামীম শিকদারদের কখনোই মৃত্যু হয়না। তিনি আজীবন বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে, বাঙালির মননে, বাঙালির চেতনায়। এই কিংবদন্তীর প্রতি রইল শত সহস্র সালাম।

সামিয়া মহসীন‚ লেখক,নাট্যশিল্পী, তে কথামালা সাহিত্য-সংস্কৃতি আন্দোলন নেতা।

;

যাত্রীরাই ইউএস-বাংলার এক একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর



মো. কামরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

এশিয়ার আকাশ দাপিয়ে বেড়ানো বাংলার গর্ব ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকে শুনতে হয় না ‘নয়টার প্লেন কয়টায় যাবে’। শুনতে হয় না যাত্রীদের কাছ থেকে ‘ফ্লাইট কি অন-টাইম’? শুনতে হয় না ‘আপনাদের প্লেন পৌছানোর পর লাগেজ পেতে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়’? এই প্রশ্নগুলো না শুনতে পারাই ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট পরিচালনার স্বার্থকতা।

সুনামের সাথে দশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে ইউএস-বাংলা। ঢাকা থেকে যশোর রুটে ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই যাত্রা শুরু করার পর আজ অবধি শতকরা ৯০ ভাগের অধিক ফ্লাইটই অন-টাইম। আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চালুর পর থেকেই ফ্লাইট গন্তব্যে পৌঁছানোর ১৫ মিনিটের মধ্যে লাগেজ ডেলিভারী এক অনন্য উদাহরন। বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রুটে প্রথমবারের মতো ইউএস-বাংলা ব্র্যান্ডনিউ এয়ারক্রাফট দিয়ে ফ্লাইট পরিচালনা করছে।

বৈশ্বিক এভিয়েশনের মানচিত্রে উপরোক্ত প্রশ্নগুলো শুনলে মনে হয় দেশের এভিয়েশনের কি করুন দশাই না ছিলো এয়ারলাইন্সগুলোর। প্রশ্নগুলোর সত্যতা কতটুকু বাস্তব হলেই স্বাধীনতার ৫১ বছর পরও দিনের পর দিন যাত্রীদের মনে বাসা বেঁধে আছে। প্রশ্নগুলোর সত্যতা প্রমান করার প্রয়োজনীয়তাবোধ করেনি ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। একটি যাত্রীবান্ধব এয়ারলাইন্স হিসেবে নানা পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে ইউএস-বাংলা।

বাংলাদেশের প্রাইভেট এয়ারলাইন্সকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় নানাবিধ সমস্যাকে সঙ্গী করেই বাংলাদেশ এভিয়েশনে অগ্রসর হতে চেয়েছে। অবকাঠামোগত সমস্যা, আর্থিক অস্বচ্ছলতা, পরিবহননীতির অস্বামঞ্জস্যতা, জাতীয় বিমান সংস্থার সাথে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড না থাকা, বিভিন্ন ধরনের অতিরিক্ত অ্যারোনোটিক্যাল ও নন-অ্যারোনোটিক্যাল চার্জ।

এছাড়া বিশ্ব মার্কেটের সাথে জেট ফুয়েল প্রাইসের প্রার্থক্য, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট চলাচলের ক্ষেত্রে দ্বিমূখী নীতি, এয়ারক্রাফট কিংবা এয়ারক্রাফট পার্টসের অতিরিক্ত কাস্টমস্ ডিউটি নির্ধারন, যা বাংলাদেশ এভিয়েশনে প্রাইভেট এয়ারলাইন্স এর এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায় বলেই প্রতীয়মান।

নানাবিধ অস্বামঞ্জস্যতা থাকার পরও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স বাংলার আকাশে তথা বিশ্বের আকাশে উদীয়মান সূর্য হয়ে একবিংশ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছে। মাত্র দশ বছর সময়ে বিশাল জনগোষ্টির বাংলাদেশের আকাশ পরিবহনের যাত্রীরা পূর্ণ আস্থা রেখেছে ইউএস-বাংলার উপর। দু’টি ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ইউএস-বাংলায় এখন ৮টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ৮টি এটিআর৭২-৬০০ এয়ারক্রাফটসহ মোট উনিশটি এয়ারক্রাফট রয়েছে বিমান বহরে।

ইউএস-বাংলার ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুনের স্বপ্নযাত্রার স্বপ্ন যেন আকাশ সমান, স্বপ্নের বিস্তৃতি আর বাস্তবায়ন চলছে সমান্তরালে। দেশের এভিয়েশনকে নিয়ে যেতে চান সুউচ্চ মর্যাদায়। আজ ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিযোগিতা করছে এমিরেটস, কাতার এয়ারওয়েজ, সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্স, মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্স, থাই এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার এর মতো বিশ্ববিখ্যাত এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে।

স্বল্পতম সময়ে ইউএস-বাংলা বাংলাদেশী যাত্রীদের সেবা দেয়ার মানসে দুবাই, শারজাহ, মাস্কাট, দোহা, সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক, গুয়াংজু, মালে, চেন্নাই ও কলকাতা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। আগামী মে –জুনে ইউএস-বাংলা দু’টি ৪৩৯ সিটের এয়ারবাস ৩৩০ এয়ারক্রাফট বিমান বহরে যোগ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। যা দিয়ে এশিয়ার অন্যতম গন্তব্য আর বাংলাদেশী যাত্রীদের আকর্ষণ সৌদি আরবের জেদ্দা রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা করছে ইউএস-বাংলা।

ইউএস-বাংলা এয়ারলা্ইন্সে ২৫০০ এর অধিক কর্মকর্তা, কর্মচারী রয়েছে। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম আর ব্যবস্থাপনা পরিষদের সুচিন্তিত দিক নির্দেশনা এবং যাত্রীদের আস্থা ইউএস-বাংলাকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করছে।

ইউএস-বাংলা পরিবারের সকল সদস্য আর যাত্রীরাই এক একজন ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। যাত্রীদের আস্থাই ইউএস-বাংলার অগ্রযাত্রার মূল পাথেয়।

লেখক: মো. কামরুল ইসলাম, মহাব্যবস্থাপক-জনসংযোগ, ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

;