রোহিঙ্গা সংকট– ফিরে দেখা ২০২২



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

২০২২ সালে রোহিঙ্গা সংকট অনেক ঘটনাবহুল সময় অতিক্রম করলেও বছর শেষে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসন এখনো শুরু হয়নি। তবে আশার কথা হচ্ছে বাংলাদেশ সফলতার সাথে রোহিঙ্গা সংকট আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে পেরেছে এবং এই সংকটে বাংলাদেশের ভুমিকা গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। দেশের মধ্যেও এই সমস্যার বিষয়ে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে জনগণের সচেতনতা বাড়াতে সমর্থ হয়েছে যা কৃতিত্বের দাবী রাখে। যুক্তরাষ্ট্র ২১ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর দেশটির সেনাবাহিনীর চালানো সহিংসতাকে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সহিংসতাকে আনুষ্ঠানিকভাবে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দিল।

রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ১৪ জুন পঞ্চম জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে রোহিঙ্গাদের দ্রুত মিয়ানমারে ফিরে যাবার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ২৭তম আন্তর্জাতিক নিক্কেই সম্মেলনের বার্তায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনে এশিয়ার দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৩ জুন ২০২২, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক মহাসচিবের বিশেষ দূত ড. নোলিন হাইজারকে দ্বিপাক্ষিক প্রত্যাবাসন ব্যবস্থার দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে রাখাইনে কর্মসূচি বাড়াতে অনুরোধ জানি‌য়ে‌ছেন জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার হাইকমিশনার ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দিয়ে এই সমস্যার মূল সমাধান প্রত্যাবাসনে জন্য, আঞ্চলিক দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। কোভিড-১৯ মহামারি পরবর্তী ইউক্রেন ও আফগানিস্তান সমস্যার ফলে সৃষ্ট বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার কারণে ‌রোহিঙ্গাদের তহবিল সংকটের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতা না কমানোর অনুরোধ জানানো হয়। ২০২২ সালে জে আর পি তে ৮৮ কোটি মার্কিন ডলারের বিপরীতে মানবিক কার্যক্রমের জন্য মাত্র ৪৪ শতাংশ বরাদ্দ পাওয়া গেছে যা বিবেচনার অবকাশ রাখে।প্রতি বছর ক্যাম্পগুলোতে প্রায় ৩৫ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে, জনসংখ্যার এই বাড়তি চাপ মোকাবেলা ক্রমেই মানবিক সহায়তার উপর চাপ ফেলছে।

১৯ জুন ২০২২ বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থানকারী রোহিঙ্গারা বিশ্ব সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য 'বাড়ি চলো' কর্মসূচির আয়োজন করে। এর মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের দাবী তুলে ধরে ও মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে। ৩১ ডিসেম্বর নতুন বছরে নিজ দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে ‘গো হোম ক্যাম্পেইন-২০২৩’ স্লোগানে সমাবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। এ সময় ‘এনাফ ইজ এনাফ, লেটস গো হোম, ২০২৩ শুড বি রোহিঙ্গা হোম ইয়ার’ সংবলিত পোস্টার-প্ল্যাকার্ড হাতে দেশে ফেরার দাবি তোলে রোহিঙ্গারা।

মিয়ানমারে আসিয়ান চেয়ারের বিশেষ দূত কম্বোডিয়ার উপ-প্রধানমন্ত্রী প্রাক সোখোন, রোহিঙ্গা ইস্যুর টেকসই সমাধানে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বাস দিয়েছে। ৬ আগস্ট বাংলাদেশ সফরের সময় রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান খুঁজতে আন্তরিকভাবে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন চীনের স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই। ২০১৯ সালের ১১ নভেম্বর আই সি জে তে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানি এ বছর ২৮ ফেব্রুয়ারী শেষ হয়। ২২ জুলাই আদালত মামলার এখতিয়ার নিয়ে মিয়ানমারের আপত্তি খারিজ করে দেয় এবং অভিযোগের বিষয়ে মিয়ানমারকে ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিলের মধ্যে জবাব দেয়ার নির্দেশ দেয়। এন ইউ জি এই বিচার প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করবে বলে জানায়। তারা রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য রাখাইন অঞ্চলের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে মিয়ানমারে সাধারণ জনগণের মধ্যে প্রচারনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর মাধ্যমে তাদেরকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীতে পরিনত করা হয়েছিল এর থেকে উত্তরনের উপায় দ্রুত বের করতে হবে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে সামাজিক সমস্যা তৈরি এবং মাদক ও নারী পাচারে জড়িত হয়ে পড়ার বিষয়ে তার উদ্বেগের কথা কানাডিয়ান হাইকমিশনারকে অবহিত করার পর হাইকমিশনার জানায় যে কানাডা সব সময় বাংলাদেশকে সহায়তা দেবে। কানাডা রোহিঙ্গাদের জন্য দাতব্যের মাধ্যমে একটি অতিরিক্ত তহবিল তৈরি করছে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর উপর চাপ কমাতে বাংলাদেশ সরকার ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রম হাতে নিয়েছে যা একটি দূরদর্শী ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ । জাতিসংঘ শুরুতে এর বিরোধিতা করেছিল। পরবর্তীতে জাতিসংঘ ও জাপান এই প্রকল্পের সাথে যুক্ত হয়। ২০২২ সালের আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা জাতিসংঘ ও জাপানের পর ভাসানচর প্রকল্পে যুক্ত হয়েছে। এ পর্যন্ত প্রায় ৩০ হাজার ৭৯ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে। জাপান ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের সহায়তায় দুই মিলিয়ন মার্কিন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সরকারের আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে নেয়া উদ্যোগের প্রশংসা করেছে জাপান।

স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও টেকসই প্রত্যাবর্তনের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হওয়াতে রোহিঙ্গাদের হতাশা ক্রমে তীব্র হচ্ছে এর ফলে নানা ধরনের নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। গত ৫ বছরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অস্ত্র, মাদক, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, পুলিশের ওপর হামলা, হত্যা ও মানব পাচারসহ নানা অপরাধে ২ হাজার ৪৩৮টি বিভিন্ন ধরনের মামলা হয়েছে। ক্যাম্পের মধ্যে এসব হত্যাকাণ্ডের লক্ষ্য ছিল রোহিঙ্গা নেতা ও স্বেচ্ছাসেবকরা। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ৩২টি রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ১২৫টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। মিয়ানমার থেকে অন্যান্য প্রতিবেশী দেশে মানব পাচার ও অবৈধ ভাবে মেথামফেটামিন বা ইয়াবা পাচার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। সেখানে স্থিতিশীলতা ফিরে না আসলে সংগঠিত অপরাধ দেশের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়বে এবং সামনের দিনগুলোতে বিশ্বব্যাপী নিরাপত্তা হুমকির সৃষ্টি করবে। ১৪ নভেম্বর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব ও ডি জি এফ আই বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের তমব্রু এলাকায় মাদকবিরোধী যৌথ অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান চলাকালে মাদক চোরাচালানিদের সাথে তাদের সংঘর্ষের সময় রোহিঙ্গা মাদক চোরাচালানকারীদের গুলিতে দায়িত্বরত অবস্থায় নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য নিহত এবং একজন আহত হয়। যতই দিন যাচ্ছে রোহিঙ্গা শিবিরে হত্যা, গুম, মাদক চোরাচালান ও অপহরণসহ নানা অপরাধ বেড়েই চলছে। প্রতিদিনই রোহিঙ্গাদের হাতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে স্থানীয়রা।

১৬ নভেম্বর, ২০২২, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে প্রথমবারের মতো 'মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি' শীর্ষক রেজুলেশনটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য একটি সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে মিয়ানমার, ইউএনএইচসিআর ও ইউএনডিপির মধ্যে স্বাক্ষরিত ত্রিপক্ষীয় সমঝোতা স্মারকটির পুনঃনবায়ন পূর্বক সেটার কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য বলা হয়েছে। রোহিঙ্গা সমস্যার টেকসই সমাধানে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা জোরদার করতে প্রস্তাবটি উল্লেখযোগ্য ভুমিকা রাখবে।

রোহিঙ্গাদের একটি অংশকে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বেশি ঝুঁকিপূর্ণ রোহিঙ্গাদের জন্য একটি পুনর্বাসন কার্যক্রম হাতে নিতে পেরে যুক্তরাষ্ট্র সরকার অত্যন্ত আনন্দিত। প্রথম দফায় ৬০ জনের মতো রোহিঙ্গার একটি তালিকা নিয়ে কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। গত ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ থেকে ২৪ জন রোহিঙ্গা যুক্তরাষ্ট্রে উদ্দেশে রওয়ানা হয়েছে। ২০১৭ সালের আগস্ট মাস থেকে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া মোট সহায়তার পরিমাণ দাঁড়ায় ১.৯ বিলিয়নডলার ।

রাখাইন রাজ্যে গত চার মাসেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং আরাকান আর্মি (এ এ)’র মধ্যে তীব্র লড়াই চলছিল। আগস্ট মাসে উত্তর মংডুতে বাংলাদেশ সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সাথে এ এ’র মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয় ও প্রায় তিন মাস ধরে চলে। সীমান্ত উত্তেজনা কমাতে গত ২৩ নভেম্বর থেকে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত বিজিপি ও বিজিবি মহাপরিচালক পর্যায়ের অষ্টম সীমান্ত সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এসময় বিজিবি ও বিজিপি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা জানানো হয়। সীমান্তের দুই পাশের অপরাধী চক্র ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর অবস্থান চিহ্নিত হলে তাদের অপতৎপরতা রোধে তাৎক্ষণিক তথ্য আদান-প্রদানসহ একে অপরকে কার্যকরভাবে সহযোগিতা করতে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছে।

বর্তমানে মিয়ানমার সেনাবাহিনী পি ডি এফ ও জাতিগত সশস্ত্র সংগঠন গুলোর সাথে বহুমুখী যুদ্ধ করছে। সেনাবাহিনী দেশের মাত্র ১৭% নিয়ন্ত্রণ করছে এবং ২৩% এলাকায় সংঘর্ষ চলছে। মিয়ানমারে ৩৩০ টি শহরের মধ্যে ৭১% শহর এখন এনইউজি এবং জাতিগত প্রতিরোধ সংস্থার (ইআরও) নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। ২৬ নভেম্বর এ এ এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যে একটি অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি হয়েছে। বেশ কয়েক দিন আলোচনার পর সামরিক বাহিনী এবং এএ রাখাইন রাজ্যে এই যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। নিপ্পন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মিঃ ইয়োহেই সাসাকাওয়া এই যুদ্ধবিরতিতে মধ্যস্থতা করেছে।

রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতারা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের জন্য একটি ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী, বিশ্বাসযোগ্য এবং একমাত্র রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্মের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছিল। এর প্রেক্ষিতে গত ২০ নভেম্বর ২০২২ সারা বিশ্বের রোহিঙ্গা সম্প্রদায় আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স (এ আর এন এ) নামে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। এই সংগঠনটি রোহিঙ্গাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে তাদের বার্তা পৌঁছানো, মিয়ানমার এবং সারা বিশ্বের সকল সহযোগীদের সাথে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে সাহায্য করবে।

২০২২ সালের ২১ ডিসেম্বর, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে প্রথমবারের মতো মিয়ানমার নিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে, প্রস্তাবটিতে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের পাশাপাশি অং সান সুচি সহ সব রাজবন্দীর মুক্তির আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রস্তাবটিতে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবটির পক্ষে ১২টি দেশ ভোট দেয়। ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে চীন, ভারত ও রাশিয়া ভোটদানে বিরত ছিল। এতে আসিয়ানের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর ২০২১ সালে গৃহীত পাঁচ দফা ঐকমত্যের দ্রুত ও পূর্ণ বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। নিরাপত্তা পরিষদ প্রস্তাবটি অনুমোদন করায় রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের নিয়মিত কার্যকলাপের অংশ হয়ে গেল। প্রস্তাবটি রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত ও স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশের এতদসংক্রান্ত অব্যাহত প্রচেষ্টাকে আরো শক্তিশালি ও ত্বরান্বিত করবে।

নিরাপত্তা পরিষদের গৃহীত প্রস্তাবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়, নিরাপত্তা ও মানবিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য বাংলাদেশের গৃহীত কার্যক্রমের প্রশংসা করা হয়। বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে রোহিঙ্গা সমস্যা মোকাবেলার পাশাপাশি ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখে আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে যা প্রশংসার দাবী রাখে। ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর কার্যক্রমে বর্তমানে জাতিসংঘের সাথে জাপান, ইউ এস এবং কানাডা যুক্ত হয়েছে। এতে বোঝা যায় যে এই সিধান্তটি একটি বাস্তবসম্মত, ও সময়োপযোগী পদক্ষেপ ছিল। বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক ফোরামে রোহিঙ্গা সমস্যা সংক্রান্ত কার্যক্রম তুলে ধরে এর দ্রুত সমাধানে সক্রিয় সহযোগিতার জন্য আহ্বান করে আসছে। এর ফলে দেরিতে হলে ও বর্তমানে এই সংকট আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে স্থান করে নিয়েছে এবং বাংলাদেশের উদ্যোগের স্বীকৃতি মিলছে।

২০১৭ থেকে ২০২৩ সাল, এই দীর্ঘ সময়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হওয়ায় সংকটের মোকাবেলায় একটি দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা প্রনয়ন করতে হবে। যে কোন পরিস্থিতিতে ত্রান ও আর্থিক সাহায্য চলমান রাখতে জরুরী ভিত্তিতে আপতকালিন ব্যবস্থা গ্রহন ও রিজার্ভ গড়ে তোলার ব্যবস্থা নিতে হবে। এ আর এন এ এবং রোহিঙ্গাদের নিয়ে কাজ করা অন্যান্য সংগঠনগুলোকে মিলিতভাব রাখাইনে প্রত্যাবাসন সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করার ব্যবস্থা নিতে হবে। সংকট সমাধানে গৃহীত চলমান সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যেতে হবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ২০২২ সালে নেয়া উদ্যোগের অগ্রগতি নিশ্চিত করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এসব কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন করা গেলে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান আলোর মুখ দেখবে বলে আশা করা যায়।

ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি,  এএফডব্লিউসি,  পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

ফলস এলার্ম ও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ মহড়া



প্রফেসর ড. মো: ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বসন্তের ‘হানামি’বা চেরিফুল ফোঁটার মৌসুমে ছুটির দিনে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরে বেশ মজা করা হয়েছিল। রাতে আরেক অনুষ্ঠানে যেতে হবে। সারাদিন লম্বা ড্রাইভ করে চেরি বাগান ঘুরে ঘুরে বহুদূরের ওপেন লেকে মাছ ধরে সবাই ক্লান্ত। মাছের বারবিকিউ রাতের খাবারের একটি মেন্যু। কিন্তু বাইরে হঠাৎ ঝির ঝির বৃষ্টি ও ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলে ক্যাম্পাসের চেরিতলার স্পট পরিত্যাগ করে সবাই আমাদের ডর্মের দ্বিতীয় তলার হলঘরে গিয়ে উঠলাম। সেখানে ফ্রি চুলায় রান্নাসহ সব ব্যবস্থা ছিল।

সবাই খুব ব্যস্ত হয়ে রান্না-বান্নার কাজে মনোযোগ দিয়েছিল। বিদেশের ওসব পার্টিতে কারো বাবুগিরি করা চলে না। সবাই খুশীমনে সবকাজে অংশ নেয়ার নিয়ম। রান্না শেষে খাবার সাজানো হয়েছে। এমন সময় ডর্মের ‘ফায়ার এলার্ম’ বেজে উঠলো। বেশ কর্কশ স্বরে একবার, দুইবার নয়- তিনবার বাজতে লাগলো। উপরের তলায় কোথাও আগুন লেগেছে এই ভেবে সবাই অতি দ্রুত হলঘর থেকে বের হয়ে বাইরের পার্কিং লটে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে গিয়ে কিছুক্ষণ পর জানা গেল আমাদের ভবনে আগুন লাগেনি। আমাদের মাছ বারবিকিউ করার চারকোলের অতিরিক্ত ধোঁয়ায় এক্সজস্টর চালু করে না দেয়ায় বদ্ধ কিচেনের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ মেশিন আগুনের ধোঁয়া আঁচ করে গোটা ভবনে জরুরি এলার্ম বাজিয়ে সবাইকে আগুনের সতর্কবার্তা পৌঁছে দিয়েছে। সবাই জরুরি নির্গমণ পথ অনুসরণ করে নিরাপদে নিচে চলে গেছে।

তখন মনে হয়েছিল- কত সেন্সেটিভ ওদের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন! একটু বেশিমাত্রার ধোঁয়ার সন্ধান পেলে আর রক্ষা নেই। সেটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এলার্ম দিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। এই মেশিন জাপানের সব ভবনের সবঘরেই লাগানো থাকে। শুধু দাউ দাউ আগুন নয়, ধোঁয়ার সূত্রপাত হলেই সেগুলো বেজে উঠে সবাইকে সতর্ক করে দেয়। যাহোক, যারা সেবছর নতুন গিয়েছিল আমাদের ক্যাম্পাসে তারা এলার্ম শুনে অনেকটা ভয় পেয়েছিল। আমরা যারা পুরনো বাসিন্দা ছিলাম তারা এরকম ফায়ার এলার্ম অনেকবার শুনেছি। যেগুলো ছিল সতর্কতামূলক মহড়া মাত্র। পরে সে রাতে আমাদের পার্টি ঠিকমতোই শেষ হয়েছিল।

গত ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার গুলশানের এক আধুনিক বহুতল আবাসিক ভবনের ৭ম তলায় আগুনের সূত্রপাত হয়। সে আগুন উপরের দিকে ছড়িয়ে গেলে ১২ তলা থেকে দুজন লাফিয়ে নিচে পড়লে মারা যান। ঐ অগ্নিকাণ্ডে শিশুসহ ২২ জন আহত হয়।

জানা গেছে, সেই ভবনটিতে আধুনিক অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল। জরুরি নির্গমণ পথ ছিল। ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার মতো ওদের ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’মেশিন প্রতিটি ফ্লোরে লাগানো ছিল। তবে অনেকে ফায়ার এলার্ম শোনেননি। যারা শুনেছিল তারা ভেবেছে সেটা ছিল ‘ফলস্ ফায়ার এলার্ম’! অথবা রাস্তা দিয়ে অ্যম্বুলেন্স জরুরি এলার্ম বাজিয়ে সব সময় যাতায়ত করে। সেরকম কিছু একটার শব্দ হতে পারে। তাই তারা এলার্মের গা করেননি। আর এরকম একটি আধুনিক ভবন যেখানে কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে সেখানে অগ্ন্কিান্ডের সময় বাইরে না বেরিয়ে ঘরের ভিতর বসে থাকই ভাল!

অর্থ্যাৎ, আধুনিক যন্ত্রপাতি লাগানো হলেও সেগুলোর ব্যবহার বিধি সম্পর্কে সচেতনতামূলক জ্ঞান তাদের সবার মধ্যে ছিল না। তাইতো একজন বাবুর্চি ও একজন গৃহকর্মী জরুরি নির্গমণ পথ দিয়ে বের হবার চেষ্টা না করে আতঙ্কে ১২ তলার বেলকুনি থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে মারা গেছেন।

আমাদের দেশে অগ্নিকাণ্ডের প্রতি মানুষের ভয় বেড়েছে। কিন্তু সচেতনতা বাড়েনি। পুরাতন বড় বড় ভবনে এত আধুনিক মানের ফায়ার ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার মতো যন্ত্রপাতি বসানো না হলেও অধূনা এব্যাপারে সচেতনতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কারণ, বিল্ডিং কোডের মধ্যে ‘ফায়ার এলার্ম’ দেবার প্রয়োজনীয় যথপোযুক্ত ব্যবস্থা রাখার আইনী বিধান রয়েছে। এটা অমান্য করলে ভবন মালিকের শাস্তি অবধারিত।

তবে বিল্ডিং কোডের এথিকস্ মেনে আংশিক কাজ করে পুরো কাজের জন্য সনদ তুলে নিয়ে ঘরে রাখলেই মানুষ ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ঠেকানো কঠিন। তাই আন্তরিকতার সাথে প্রতিটি ভবনে বিল্ডিং কোডের এথিকস শতভাগ মেনে আধুনিক ফায়ার নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু রাখা প্রয়োজন।

পাশাপাশি এলার্ম বাজলো আর আমি শুনেও ঘুমিয়ে থাকলাম সেট করা হলে বিপদ অনিবার্য। অনেক অলস ব্যক্তি জরুরি কাজের জন্য ঘড়িতে জেগে ওঠার সময় এলার্ম দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েন। এলার্ম ঠিকসময় বেজে উঠলে রাগ করে ঘড়িকে থাপ্পর দিয়ে এলার্ম বন্ধ করে দিয়ে পুনরায় ঘুমিয়ে যেতে দেখা যায়। এর পরিণতি সম্পর্কে তারা মোটেও ভাবেন না। এমন বদঅভ্যাস থাকলে ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে না ঘুমানোই শ্রেয়।

যেটা ঘটতে শোনা গেছে গুলশানের বাড়ির বাসিন্দাদের মুখ থেকে। তাদের কেউ কেউ বলেছেন, অগ্নিকাণ্ডের জরুরি ফায়ার এলার্ম শুনেছেন কিন্তু সেটাকে তারা ‘ফলস এলার্ম’ ভেবেছেন। তাই ভবনের বাইরে যেতে চাননি। এরূপ বিপদের সময় এটা শুধু নিতান্ত অবহেলাই নয়- চরম হেঁয়ালীপনার নামান্তর। এরকম হেঁয়ালীপনা নিজের ও পরিবারের সদস্যদের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে।

তাই এই অবস্থা নিরসনের জন্য প্রয়োজন ঘন ঘন সতর্কতামূলক মহড়ার আয়োজন করা। আমাদের দেশে যে হারে সুউচ্চ ভবন তৈরি হচ্ছে এবং যেভাবে মানুষ বহুতল ভবনে বসবাস করতে আগ্রহী হয়ে পড়েছে সেই হারে ফায়ার নিরাপত্তা ব্যবস্থা বিকশিত হয়নি।

আজকাল বহুতল ভবনে ফায়ার প্রতিরোধী স্প্রে, ফায়ার প্রতিরোধী গ্যাস সিলিন্ডার, পানির পাইপ, মুখোশ, পোশাক ইত্যাদি সংরক্ষণ করতে দেখা যায়। অনেক অফিসের বিভিন্ন তলার কোণায় কোণায় এসব নিরাপত্তা সরঞ্জাম সাজানো থাকে।

কিন্তু কথা হলো সেগুলো শুধু সাজিয়ে রাখার জিনিস নয়। কারণ, মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে গেলে বা বেশি পুরনো হয়ে গেলে সেগুলো অকার্যকরী হয়ে পড়ে। সেজন্য প্রতি তিন বা ছয় মাস পর পর সেসব জিনিষ ব্যবহার উপযোগী আছে কি-না তা পরীক্ষা করার জন্য জরুরি মহড়ার আয়োজন কার উচিত। বিপদের সময় সেগুলো ঠিকমতো সেবা দেয় না। আবার অনেকেই সেসব নিরাপত্তা সামগ্রীর ব্যবহার করতে জানেন না। এসব জিনিষের মেয়াদ পার হলে সেগুলো ফেলে দিয়ে নতুন নিরাপত্তা কিট্স কেনা উচিত।

এজন্য প্রতিটি ভবনে অফিসে, কারখানায় বাধ্যতামূলক বাজেট রাখার নির্দেশনা বস্তবায়ন করা উচিত। উঁচু অফিস, হোটেল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল ও বসত ঘরের প্রতিটি কক্ষে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে ‘ফায়ার এক্সটিংগুইশার’ মেশিন লাগানো বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন। যারা একটু ধোঁয়া পেলেই জরুরি সংকেত দিবে।

এছাড়া হাসপাতাল, তেলের ডিপো, পাম্প, গুদাম, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বাজার এমনকি পল্লী অঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গুলোতে নিয়মিত অগ্নিনির্বাপণ মহড়া গ্রহণ করে মানুষকে অগ্নিকাণ্ডের ভয়াবহতা থেকে সচেতন করার পদক্ষেপ হাতে নেয়া উচিত।

সেসব মহড়ায় বাড়ির বা অফিসের ছোট-বড় সবার অংশগ্রহণ আবশ্যিক করা উচিত। কারণ প্রশিক্ষণ নেয়া থাকলে বিপদের সময় একটি শিশুও অনেক মূল্যবান জান-মাল রক্ষায় বড় ভূমিকা রাখতে পারে।

আমাদের দেশে প্রতিটি বিপর্যয় ঘটে যাবার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, বোর্ডসভা করা হয়। কিন্তু যেসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব সেগুলো নিয়ে পূর্বপরিকল্পনা মাফিক দায়িত্ব পালন বা কাজ সুসম্পন্ন করা হয় কি-না তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাই প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা বাড়ানো এবং অত্যাধুনিক সরঞ্জাম সংগ্রহ করে অগ্নিকাণ্ডের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে জোরদার করতে ও পুরনো নিরাপত্তা সরঞ্জাম পরখ করতে ঘন ঘন অগ্নি-নির্বাপণ মহড়ার আয়োজন করা খুব জরুরি।

*লেখক রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডীন। E-mail: [email protected]

;

রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাপানের কার্যকরী সহায়তা



ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট রাখাইনে সেনা অভিযান শুরুর পর সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বর্তমানে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছে। জাপান সরকার ২০১৭ সালে এই সংকট শুরুর পর পরই রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা হিসাবে ৪মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। একই বছর রোহিঙ্গা শিশু, নারী এবং ঝুঁকিপূর্ণ স্থানীয়দের জরুরি মানবিক সহায়তার জন্য জাপান১৫.৭ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছিল। সংকটের প্রথম ৬ মাসে অতি প্রয়োজনীয় এই সহায়তা পাওয়ায় ইউনিসেফ তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পেরেছিল এবং এজন্য সংস্থাটি জাপান সরকার ও জনগণের কাছে সেসময় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তারো কোনো মিয়ানমারকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদেরকে দ্রুত ফিরিয়ে নিতে অনুরোধ জানায় ।জাপান সে সময় মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা পুনর্বাসনে জন্য ৩০ লাখ মার্কিন ডলার বরাদ্দ দেয়। রাখাইন রাজ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার জন্য কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে জাপান মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে সহায়তা প্রদানে প্রস্তুত। জাপান সরকার এবং জনগণ রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় সহায়তা প্রদানের পাশাপাশি নিরাপদ, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণভাবে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাবে। ২০১৯ সালে জাপান রোহিঙ্গা এবং স্থানীয় জনগণের জন্য মানবিক সহায়তা হিসেবে ৯৯.২মিলিয়ন ডলার দিয়েছিল।

জাপান সরকার সঙ্কট সমাধানে সবসময় বাংলাদেশের পাশে আছে এবং জাপান বিশ্বাস করে যে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে দ্রুত, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ এবং স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই এই সংকটের সমাধান সম্ভব হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইন রাজ্যে অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করা মিয়ানমারের জন্য অপরিহার্য। জাপান রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার সরকারকে ‘আরও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানায় এবং এই সনসজা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত জাপান সরকার মিয়ানমারকে এই অনুরোধ জানিয়ে যাবে। ২০১৯ সালে, জাপান রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিল এবং দুই দেশের মধ্যে সংলাপ অব্যাহত রাখার কথা জানিয়েছিল। জাপান রোহিঙ্গা সমস্যার দ্রুত সমাধান চায় তাদের দীর্ঘস্থায়ি অবস্থান উদ্বেগজনক বলে মনে করে। জাপান বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চলমান আলোচনায় সহায়তা করতে আগ্রহী যাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ত্বরান্বিত হয়।

জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। জাপান এই দুই দেশের সঙ্গে সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে থাকে। জাপান উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারকে এই সমস্যা সমাধানে সহযোগিতা করতে আগ্রহী। উভয় দেশে জাপানের ব্যাপক বিনিয়োগ রয়েছে। ৩১০টি জাপানি কোম্পানি বাংলাদেশের উন্নয়নে সহায়তা দিয়ে করছে। দায়বদ্ধতা ও নৈতিকতাবোধ থেকে জাপান রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু থেকে নীরবে কাজ করে যাচ্ছে এবং এর সমাধানের জন্য তৎপর রয়েছে। বাংলাদেশে কর্মরত জাপানের রাষ্ট্রদূতগণ বিভিন্ন সময়ে বহুবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে। জাপানিরা ব্যক্তি, সাংগাঠনিক ও সরকারি ইত্যাদি নানা পর্যায়ে সমস্যাটির একটি স্থায়ী ও টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। জাপানের জনগণ, নানা সংগঠন ও জাপান সরকার অবিরত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী ও সেবা দিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর সহায়তা চলমান রেখেছে। কূটনৈতিকভাবে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, প্রত্যাবাসনও বাস্তু সমস্যা সমাধানকল্পে জাপান সরকার মিয়ানমার সরকার, আসিয়ান ও জি-৭ ইত্যাদি নানা আন্তর্জাতিক সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে। জাপান প্রলম্বিত রোহিঙ্গা সমস্যার একটি টেকসই সমাধান চায় এবং এ বিষয়ে বাংলাদেশকে যেকোন ধরনের সহায়তা দিতে প্রস্তুত রয়েছে।

রোহিঙ্গাদের ব্যাপক উপস্থিতি কক্সবাজারের স্থানীয় জনগণের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করে জাপান। ‘অবাধ ও মুক্ত ইন্দো-প্যাসিফিক’ বাস্তবায়ন করা গেলে এই অঞ্চলে শান্তি, স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে জাপান বাংলাদেশের পাশে থাকবে এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের দ্রুত প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করে যাবে।

২০২২ সালের ২২ নভেম্বর, ভাসানচরে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সহায়তার জন্য জাপান ও জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপি) মধ্যে ৩.৭ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি হয়েছে। ভাসানচরে আশ্রয় নেওয়া বিভিন্ন বয়সী নারীদের নিরাপত্তা এবং কিশোর ও যুবকদের ক্ষমতায়নের জন্য এই অর্থ ব্যয় করা হবে। জাপানের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তাকেই শুনসুকে জানিয়েছে যে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন নিশ্চিতে মিয়ানমারে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। বর্তমানে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য একটি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে, ক্যাম্পে নতুন শিশুর জন্মের ফলে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের অনেকেই মাদক ও অস্ত্র পাচারের সাথে জড়িত।

গত পাঁচ বছরে কোনো রোহিঙ্গাই দেশে ফিরে যেতে পারেননি। প্রত্যাবাসন চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হলেও সরকার উন্নত দেশগুলোকে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদেরকে তৃতীয় কোনো দেশে স্থানান্তরের আহ্বান জানিয়ে আসছে। জাপান কিছু রোহিঙ্গাকে সেদেশে পুনর্বাসনের কথা ভাবছে বলে জানিয়েছে জাপানের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি। জাপান ২০২২ সালে বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য ২ কোটি ৭৮ লাখ মার্কিন ডলার দিয়েছে, ২০২১ সালে এই বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। জাপান, কক্সবাজার ও ভাসানচরে রোহিঙ্গা শিবিরের ভেতরে রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রার সংকট নিরসনের যথাসাধ্য চেষ্টা করছে।

রাখাইনের পরিস্থিতি নিরাপদ না হওয়াতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব হচ্ছে না। জাপানের ‘বিশেষ প্রতিনিধি’ নিপ্পন ফাউন্ডেশন ও সাসাকাওয়া পিস ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যানইউহেই সাসাকাওয়ার মধ্যস্থতায় রাখাইনে ২০২২ সালের জুলাই থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে শুরু হওয়া যুদ্ধ বন্ধে রাজি হয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী, এরপর যুদ্ধরত দুইপক্ষ যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়। এর ফলে রাখাইন অঞ্চলে এখন আপাত শান্তি বিরাজ করছে। ইউহেই সাসাকাওয়া মিয়ানমার সরকার ও সেখানকার বিভিন্ন অঞ্চলের সশস্ত্র আন্দোলনকারীদের মধ্যে ‘জাতীয় ঐক্যের’ লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে।২০১৯ সালেও সাসাকাওয়ার মাধ্যমেআরাকানে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল।২০২০ সালে জাপান সরকার তাকে মিয়ামারে নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের প্রধান করে পাঠায়।সে সময় এনএলডির সঙ্গে আরাকান আর্মির সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছিল, তবে সাসাকাওয়ার মধ্যস্থতায় আরাকানে নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হয়। এতে বোঝা যায় যে রাখাইনের রাজনৈতিক অঙ্গনে এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কাছে সাসাকাওয়ার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে জাপান বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা অব্যাহত রেখে মিয়ানমারের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে বলে জানিয়েছে।

বাংলাদেশে নবনিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জাপানের কার্যক্রম অব্যাহত রাখার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছে।২০১৭ সালের পর থেকে, আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং এনজিওগুলোর মাধ্যমে কক্সবাজারের পাশাপাশি ভাসান চরে বিভিন্ন সহযোগিতামূলক কার্যক্রমে ১৭৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি সহায়তা দিয়েছে জাপান। এর মধ্যে খাদ্য, স্বাস্থ্যসেবা, পানি স্যানিটেশন স্বাস্থ্যবিধি (ওয়াশ), আশ্রয়, সুরক্ষা এবং লিঙ্গভিত্তিক সহায়তা রয়েছে।বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ও মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে জাপান সরকার ও ইউএনএইচসিআরের মধ্যে ২২ ফেব্রুয়ারি ৪.৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই হয়েছে। এ সহায়তা কক্সবাজার ও ভাসানচরের রোহিঙ্গাদের দক্ষতা উন্নয়ন কার্যক্রম বাড়বে এর ফলে রোহিঙ্গারা ক্রমহ্রাসমান মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে সক্ষম হবে। এর পাশাপাশি স্থানীয় সম্প্রদায়ের ঝুঁকিতে থাকা নারীরা বিভিন্ন কারুশিল্প তৈরির প্রশিক্ষণ ও নতুন আয়ের সুযোগ পাবে। ভাসানচরে জাপানের এই সহায়তায় ইউএনএইচসিআর রোহিঙ্গাদের শিক্ষা ও জীবিকামূলক কার্যক্রম সম্প্রসারণে কাজ করবে। জাপান সরকার ইউএনএইচসিআর ও বাংলাদেশে জাতিসংঘের অন্য সংস্থা ও এনজিওগুলোকে এ পর্যন্ত ২০৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা দিয়েছে।

বাংলাদেশের কক্সবাজার ও ভাসান চরে রোহিঙ্গা ও আশ্রয়দাতা জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার উন্নয়ন এবং আশ্রয়কেন্দ্রের উন্নয়নে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থায় (আইওএম) ৫.৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাপান সরকার। জাপান রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য উন্নত জীবনযাত্রা নিশ্চিত করতে আইওএমসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করবে। জাপান সরকারের অব্যাহত সহায়তা আইওএমকে বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং ভাসান চরের রোহিঙ্গা ও স্থানীয় সম্প্রদায়কে জীবন রক্ষাকারী সহায়তা দিতে সাহায্য করবে। এই সহায়তা আরও ভালো বসতি, সুরক্ষা এবং জীবিকার সুযোগ প্রদান নিশ্চিত করবে। সাইট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড সাইট ডেভেলপমেন্ট (এসএমএসডি) প্রকল্পের মাধ্যমে ভাসান চরের রোহিঙ্গাদের জীবনযাত্রার অবস্থার উন্নয়ন হবে এবং উন্নত জীবিকার সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে রোহিঙ্গা নারী ও যুবকদের আত্মনির্ভরশীল করবে। জাপান আইওএম ও অন্যান্য জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর পাশাপাশি বাংলাদেশে এনজিওগুলোতে ২০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি সহায়তা করেছে। জাপান রাখাইনের আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি উন্নয়নে কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পারে। এর ফলে দারিদ্র পীড়িত রাখাইনের জনগণের জীবনমান উন্নত হবে এবং ফলশ্রুতিতে রাখাইনে বসবাসকারী রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে চলমান বৈষম্যে কমে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের উন্নয়ন হবে।জাপানের নিপ্পন ফাউন্ডেশন রাখাইনে সাফল্যের সাথে মানবিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় ভুমিকা রেখেছে। চিন ও রাখাইনদের কাছে এই সংস্থাটি এবং এর চেয়ারম্যানের জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। এই পরিস্থিতি কাজে লাগিয়ে তারা রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন তৈরি করে চলমান পরিস্থিতির উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে।রাখাইনে উপযুক্ত কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা গেলে চলমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব। এই লক্ষ্যে বাংলাদেশের ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদেরকে আত্মকর্মসংস্থানের প্রশিক্ষণ দিলে তারা ফিরে গিয়ে রাখাইনের উন্নয়নেও ভুমিকা রাখতে পারবে।

রোহিঙ্গা সমস্যা দীর্ঘয়িত হলে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর ক্রম অবনতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জাপান রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে স্থানান্তরে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে পারে।

আরও বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা ভাসান চরে স্থানান্তরের লক্ষ্যে জাপান ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো একত্রে নতুন অবকাঠামো নির্মাণের মাধ্যমে কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর উপর থেকে চাপ কমিয়ে নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নে ভুমিকা রাখতে পারে। রোহিঙ্গা সংকটের ষষ্ঠ বছরে চলছে, চলমান বৈশ্বিক সমস্যার কারনে এই নিপীড়িত জনগোষ্ঠীঅনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি, তাই জাপানের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের জন্য প্রয়োজনীয় সহায়তা অব্যাহত রাখা উচিত। এ যাবতকাল জাপানের গৃহীত কার্যক্রম প্রশংসনীয় এবং ভবিষ্যতে জাপানের সক্রিয় অংশগ্রহণে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের পথে এগিয়ে যাবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: ব্রিঃ জেঃ (অবঃ) হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এনডিসি, এএফডব্লিউসি, পিএসসি, এম ফিল, মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক।

;

বিরিয়ানি বিতর্ক ও মাংস সমাচার



আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু
ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

  • Font increase
  • Font Decrease

সম্প্রতি ঢাকার একটি নামিদামি রেস্টুরেন্টে কুকুর-বিড়ালের মাংস সহযোগে বিরিয়ানি তৈরির অভিযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মোটামুটি একটি আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। বরং বলা যায় আলোড়নের চেয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও রসিকতা অধিক। কুকুর-বিড়াল, এমনকি ছাগল নিয়ে আমার দুর্বলতা রয়েছে। কুকুর-বিড়ালের মাংস কেউ খেতে পারে তা কল্পনাও করতে পারতাম না, যদি না যথেষ্ট পরিণত বয়সে জানতে পারতাম যে পৃথিবীর অনেক দেশে কুকুরের মাংস ভক্ষণ করা হয়।

কুকুরভুক দেশগুলোতে বাঘ-ভালুক-বানরের মতো জন্তুর মাংস এবং সাপ, কুমির, গিরগিটির মতো সরীসৃপের মাংসও খাওয়া হয়। কোনো কোনো প্রাণী, বিশেষ করে ডোরাকাটা বাঘের অস্থিচূর্ণ, কুমিরসহ বিভিন্ন প্রাণির লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ দিয়ে তৈরি স্যুপ যৌন উত্তেজক দাওয়াই হিসেবে সেবন করা হয়। যারা কৌতুহলি হয়েও হংকং, হ্যানয় ও ব্যাংককের মাংসের বাজারে অথবা এসব শহরের কোনো কোনো এলাকায় বিশেষ রেস্টুরেন্টের সামনেও গিয়ে থাকেন, তারা কুমির, বাঘ ও সাপের লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ দিয়ে তৈরি স্যুপের বিজ্ঞাপন দর্শন করেছেন এবং পর্যটক বা খদ্দের আকৃষ্ট করার জন্যে রেস্টুরেন্টের লোকদেরও কোরাস শুনতে পেয়েছেন, ‘সেক্স স্ত্রং (স্ট্রং), সেক্স স্ত্রং।’

আমার শৈশব-কৈশোর কুকুর-বিড়াল ও ছাগল ছাড়া কাটেনি। গাছপালায় ঢাকা আমাদের শহরের বাড়িতে গৃহপালিত প্রায় সকল প্রাণি, বাছুরসহ একটি গাভি, ছাগল, কুকুর, বিড়াল, হাঁস, মুরগি, কবুতর তো ছিলই, ঘুঘু, ময়না, টিয়াও ছিল। এমনকি ঘরের দরজার ঠিক সামনে একটি ডালিম গাছে প্রতিবছর একটি টুনটুনি বাসা করতো, সেটির দীর্ঘ ঠোঁট বাসার বাইরে বের হয়ে থাকত এবং আমার সেই টুনটুনির এক হাত দূরে দরজা দিয়ে ঘরে প্রবেশ ও নির্গমণের সময়ও টুনটুনি ভয়ে উড়ে যেত না। বাচ্চা ফোটানোর পর কোনো একসময় বড় হয়ে উড়ে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত টুনটুনি পরিবার আমাদের পরিবারের সদস্যের মতই থাকত। পরের বছর আবার একজোড়া টুনটুনি সেই পুরোনো বাসায় ফিরে আসত, বাসা ঝড়ে পড়ে গেলে তারা একই জায়গায় নতুন বাসা বানিয়ে সংসার সাজিয়ে বসত।

আমি যখন ক্লাস এইটে পড়ি, তখন দীর্ঘ ঝোলানো কানসহ আমার একটি ছাগল ছিল, যাকে তখন রামছাগল বলা হতো। সেটিকে কখনো বেঁধে রাখা হয়নি। ছাগলটির বয়স যখন মোটামুটি এক বছর, হঠাৎ একদিন সেটি মাটিতে পড়ে পা ছুঁড়তে শুরু করল। আমার মা কাঁচা হলুদ ছেঁচে পানির সঙ্গে মিশিয়ে খাওয়ালেন, কপালের লোম চেছে হলুদ ও লাল মরিচ পেস্ট করে প্রলেপ দিলেন, কিন্তু অবস্থার উন্নতি হলো না। আব্বা কৃষি বিভাগে কাজ করতেন, তিনি সেটিকে দ্রুত পশু হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললেন, আমি অপর একজনকে সঙ্গে নিয়ে ছাগলকে কোলের ওপর শুইয়ে মাইল খানেক দূরে পশু হাসপাতালে নিয়ে যাই। পশু চিকিৎসক নেড়েচেড়ে ছাগল পরীক্ষা করেন। ইঞ্জেকশন দেন। আমার প্রিয় ছাগলটি হাসপাতালেই মরে গেল। আমি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে মৃত ছাগলকে কোলে নিয়ে ফিরে আসি। বাড়ি এসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদি। সেদিন আমার অংক পরীক্ষা ছিল। আমার ছাগল নেই, পরীক্ষা দিয়ে কী হবে! আম্মা, আব্বা আমার কান্না থামাতে চেষ্টা করেন, আমি আরো কাঁদি। অনেক কষ্টে তারা আমার কান্না থামিয়ে পরীক্ষা দিতে পাঠান।

পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফেরার পর আমার বোন আমার হাতে একটি কাগজ ধরিয়ে দেয়। আমি ঝাপসা চোখে কাগজের লেখাগুলো পাঠ করি: ‘ছাগলের মৃত্যুতে শোকসভা।’ আমি পরীক্ষা দিতে যাওয়ার পর আমার ভাইবোনেরা শোকসভা করেছে, আমার কান্নাকাটির কথা বর্ণনা করেছে এবং ছাগলের আত্মার শান্তি কামনা করেছে। তাদের কাছে ব্যাপারটি রসিকতা হলেও ছাগলের মৃত্যুশোক আমি দীর্ঘদিন পর্যন্ত কাটিয়ে উঠতে পারিনি।

পাকিস্তানি সৈন্যদের আগমন আশঙ্কায় ১৯৭১ সালের এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে লোকজন শহর ছাড়তে শুরু করে। বড় ধরনের সংকট অনুমান করে মাস খানেক আগে থেকেই আমাদের পোষা প্রাণীগুলোর বিধিব্যবস্থা করার কাজ শুরু হয়েছিল। হাস-মুরগিগুলো প্রতিদিন জবাই করে খাওয়া হচ্ছিল। ময়না, টিয়া খাঁচামুক্ত করে দেওয়া হলো। কবুতরগুলোকে ছেড়ে দেওয়া হলো ওদের অদৃষ্টের ওপর। গাভি ও বাছুরকে হাটিয়ে ও দু’তিনটা বিড়ালকে চটের থলেতে ভরে গ্রামের বাড়িতে নেয়া হলো।

কিন্তু আমাদের কুকরটিকে শহরের বাড়ি থেকে ছয় মাইল দূরে গ্রামের বাড়িতে নেয়া কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আমি আস্তে আস্তে সাইকেল চালিয়ে যাই, কুকুর পেছন পেছন আসে। বাংলাদেশে ওয়ারিশসহ ও বেওয়ারিশ কুকুরের অভাব নেই, আগেও ছিল না। রাস্তার পাশে যেখানেই বাড়িঘর আছে, নতুন কুকুর নিয়ে সেসব এলাকা অতিক্রম করা অনেকটা দুঃসাধ্য। পাড়ার সকল কুকুর অপরিচিত কুকুরকে তাড়া করে। এই কুকুরের পালের হাত থেকে রক্ষা পেতে আমার কুকুর প্রথমে আমার কাছে সহায়তার আশা করে, আমার অসহায়ত্ব দেখে কুকুর মাঠের দিকে দৌড় দিয়ে আত্মরক্ষা করে। পাড়া অতিক্রম করার পর কুকুর আবার আমার সঙ্গে মিলিত হয়। পাড়া এড়িয়ে খোলা মাঠের ভেতর দিয়ে কুকুর নিয়ে যাই। তবুও পাঁচ-ছটি স্থানে আমার কুকুর তাড়া খায় এবং শেষ পর্যন্ত সেটিকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছি। গ্রামের বাড়িতেও একটি কুকুর ছিল, সেটির সঙ্গে বন্ধুত্ব হতেও শহুরে কুকুরের কয়েকদিন লেগে যায়।

শহরের বাড়িতে যে ছাগলটি ছিল, সেটি তখন গর্ভবতী। একেবারে এডভান্সড স্টেজ বা যখন তখন অবস্থা। ভালোভাবে নড়াচড়াও করতে পারে না। কোনো উপায়েই ছাগলটিকে গ্রামের বাড়িতে নেয়া সম্ভব ছিল না। এবার ছাগলের জন্যে আম্মা কাঁদেন, কী আছে সেটির ভাগ্যে! সিদ্ধান্ত হলো, ছাগলের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে কাঁঠালের পাতা, শেওড়া পাতা, ডালের ভূষি এবং যথেষ্ট পরিমাণে পানি রেখে ছাগলটি যে ঘরে থাকত, সেই ঘরের দরজা খোলা রেখে সেটির গলায় বাঁধা রশি কেটে দেওয়া হবে। বাকিটা ওপরওয়ালার হাতে। তখন শিয়ালের প্রচুর উৎপাত ছিল। অতএব ছাগলের ভবিষ্যৎ মোটামুটি নির্ধারিত। আমরা ছাগলের জন্যে আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করি, আম্মা দোয়া দরুদ পড়ে ছাগলের গায়ে ফুঁ দেন। অসহায় ছাগলটিকে ভাগ্যের ওপর ছেড়ে ঝাপসা নয়নে আমরা বাড়ি ত্যাগ করি। মে মাসে শেষ দিকে পরিস্থিতি একটু স্থিতিশীল হলে শহরের বাড়িতে এসে আমরা ছাগলটিকে আর দেখিনি। ছাগলটির জন্যে এখনো মর্মবেদনা ভোগ করি।

এসব প্রাণির মাংস মানুষ খায় কীভাবে?

আমি বিশ্বাস করি না যে সুলতান’স ডাইন কুকুর-বিড়ালের মাংস দিয়ে বিরিয়ানি বানিয়েছিল। কারো যদি অপকর্ম করার ইচ্ছা থাকে, তাহলেই তার পক্ষে এ ধরনের কর্ম করা সম্ভব। তবে সাধারণত তাও ঘটে না। ১৯৭৭ সালের প্রথমদিকে ঢাকার ফুলবাড়িয়ায় ‘হোটেল আল হায়াত’ নামে এক হোটেলে এক ব্যক্তি খেতে বসে মাছের তরকারিতে মানুষের হাতের একটি আঙুল পায়। এ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড। রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যায়, মালিককে গ্রেফতার করা হয়। তদন্তে প্রমাণিত হয়, আঙুলটি বোয়াল মাছের পেটে ছিল। মাছ কাঁটাবাছা করার পর্যায়েও কারো চোখে ধরা পড়েনি এবং সেটি গ্রাহকের পাতে চলে গেছে। ২০০১ সালে আরিচা ঘাটের একটি বাঁশচাটাইয়ের বেড়া দিয়ে বানানো এক হোটেলে খাওয়া শেষে হোটেলের পেছনে হাত ধুঁতে গিয়ে জবাই করা অবস্থায় একটি কুকুর দেখে। এ নিয়ে মহা শোরগোল। হোটেল মালিক পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, আসলেই তিনি দীর্ঘদিন যাবত মানুষকে কুকুরের মাংস খাওয়াচ্ছিলেন। এ নিয়ে আমরা মানিকগঞ্জবাসী আমার প্রিয় সুমন ভাইয়ার সঙ্গে রসিকতা করতাম, যে তার বাড়িতে দাওয়াত দিলে অন্তত মাংস খাওয়া যাবে না।

আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে কোরিয়ান ঠিকাদার আমাদের এলাকায় শেরপুর-জামালপুর সড়ক নির্মাণ করে। কোরিয়ার বেশ কিছু ইঞ্জিনিয়ার, টেকনিশিয়ান এ প্রকল্পে কাজ করছিল। তারা নাকি রাস্তা থেকে লাওয়ারিশ কুকুর ধরে সেটির মাংস খেত। এলাকার লোকজন এটা জানার পর তাদের কাছে পাঁচশো, হাজার টাকায় কুকুর বিক্রি করত। এ নিয়ে ঝামেলাও হয়েছিল ইতর কিসিমের লোকজন অনেকে পোষা কুকুর ধরেও কোরিয়ানদের কাছে বিক্রি করত। অভিযোগ প্রশাসন পর্যন্ত গড়ায়। প্রশাসন তাদের ওপর আদেশ জারি করে যে প্রকল্প চলাকালে তারা আর কুকুর খেতে পারবে না।

আমার শ্যালক সংখ্যা মাশাআল্লাহ অনেক। তাদের একজন খুরশিদ আলম বেশ ক’বছর দক্ষিণ কোরিয়ায় ছিল। সে ফিরে আসার পর জানতে চেয়েছি, সে কুকুরের মাংস খেয়েছে কিনা। সে ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কিছু বলে না ।পরিবেশ বিষয়ক আমাদের একটা এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম ছিল, কম্বোডিয়ার দুটি ছেলে ঢাকায় আমাদের সঙ্গে কাজ করছিল। প্রথম দফা বিনিময়ে নকশি নামে আমাদের এক মেয়ে কর্মীকে কম্বোডিয়ায় পাঠানো হয়। দুই সপ্তাহের মধ্যে মেয়েটি দেশে ফিরে আসে। কম্বোডিয়ার সে কেনাকাটা করতে গিয়ে বাজারে জ্যান্ত সাপ বিক্রি করতে দেখেছে, রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে সাপ দিয়ে তৈরি ফ্রাই, স্ট্যু, স্যুপ ইত্যাদি দেখেছে। এসব দেখে নাকি তার নাড়িভূড়ি বের হয়ে আসার উপক্রম। তাকে বলা হলো, ফিরে আসা চলবে না। টিকেটের মূল্যসহ অন্যান্য খরচ ফেরত দিতে হবে। টাকা ফেরত দেওয়ার পরিবর্তে সে নিজের টাকায় টিকেট কিনে আবার কম্বোডিয়ায় যায়। এক বছর পর ফিরে আসলে নকশির কাছে জানতে চাই, শেষ পর্যন্ত সে সাপ খেয়েছে কিনা। নকশি উৎসাহে উত্তর দেয়, ‘খেয়েছি স্যার, পাঁচটা। খেতে খারাপ লাগে না। বাইম মাছের মতো।’

‘যস্মিন দেশে যদাচার’ বলে একটি কথা আছে। বাংলাদেশে কুকুর-বিড়ালের মাংস ভক্ষণ আইনত নিষিদ্ধ কিনা, আমার জানা নেই। ধর্মীয়ভাবে নিষিদ্ধ, সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য। এসব বিধিনিষেধ মান্য না করারও লোক যথেষ্ট। হরিণের গোশত খাওয়া আইনত নিষিদ্ধ এটি সংরক্ষিত প্রাণীর শ্রেণিতে গণ্য বলে। কিন্তু মানুষ চুরি করে হরিণ শিকার করে এবং জবাই করে মাংস খায়। মদ সাধারণভাবে নিষিদ্ধ, মেডিকেল গ্রাউন্ডে মদ পান করার সুযোগ আছে। কিন্তু যারা পান করতে আগ্রহী তারা অনুমোদন ও অনুমোদন ছাড়াও পান করে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব খাতের অনেক চিনি কারখানায় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মদ তৈরি ও রফতানি হয়। ঘুষ খাওয়া ধর্মীয়ভাবে ও আইনগতভাবে অন্যায়, মানুষ ঘুষ খায়। পরনারী সংসর্গ পাপ, আইনগর্হিত, সুযোগ পেলেই লোকজন তা করে। অতএব, কেউ যদি কুকুর-বিড়াল খেতে চায়, আইনে বাধা না থাকলে তারা খেতেই পারে। তবে যারা বিক্রি করবেন, তাদের বলা উচিত তারা গ্রাহকে কি পরিবেশন করছেন।

বিশ্বে কি পরিমাণ কুকুর মাংস খাওয়ার উদ্দেশ্যে নিধন করা হয়, তা জানলে চোখ কপালে উঠবে। বার্ষিক কমবেশি ৩০ মিলিয়ন বা তিন কোটি। চীনারা বছরে প্রায় ৪০ কোটি বিড়াল খায়। প্রায় দুই কোটি কুকুর শুধু চীনারাই খায়। ৫০ লাখ কুকুর খায় ভিয়েতনামীরা, ২০ লাখ দক্ষিণ কোরীয়রা, ১০ লাখ ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রের হ্ওায়াই ও ফিলিপাইনসের লোকজনও কুকুর খায় এবং প্রায় এক লাখ কুকুরের মাংস থাই, লাওস ও কম্বোডিয়া আমদানি করে। আফ্রিকার কমবেশি ২০টি দেশের কুকুরের মাংস খাওয়ার প্রচলন রয়েছে, তার মধ্যে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ছোট দেশ বারকিনা ফাসোতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কুকুর খাওয়ার উদ্দেশ্যে হত্যা করা হয়। উত্তর ভারতের নাগাল্যাণ্ডবাসীরাও কুকুর খেতে অভ্যস্ত। এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে তাইওয়ান সর্বপ্রথম কুকুর ও বিড়ালের মাংস খাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

কুকুরখোর প্রতিটি জাতি অতীতে যেমনই থাকুক, বর্তমানে সমৃদ্ধ জাতি। একসময় তাদের অবস্থাও পঞ্চাশের দশকের বাংলাদেশের মতো দীনহীন অবস্থা ছিল। কিন্তু ষাটের দশকের মধ্যেই দেশগুলো ঘুরে দাঁড়ায়, যখন বাংলাদেশ বা সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্যাভাব ছিল সাংবাৎসরিক ব্যাপার। ওই দেশগুলোর লোকজন কুকুর খেয়েই তরক্কি করেছে কিনা তা গবেষণার বিষয়। মরহুম সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরী রসিয়ে রসিয়ে গল্প বলতে উস্তাদ ছিলেন। তিনি বরিশালের লতিকুল্লাহ নামে এক নেতার ভাষণ শোনাতেন, বরিশালবাসীর উদ্দেশ্যে ওই অঞ্চলের টানে লতিকুল্লাহ’র বক্তৃতা নাকি এমন ছিল: ‘চীন জাগিল, কোরিয়া জাগিল, মালয়েশিয়া জাগিল, সিঙ্গাপুর জাগিল, ইন্দোনেশিয়া জাগিল, আপনারা কি জাগিবেন আপনাদের গুয়ার ভেতর দিয়া বাঁশ গেলে?’ লতিকুল্লাহ সাহেব জানতেন না যে চীনসহ ও দূরপ্রাচ্যের দেশগুলোর উন্নয়ন সাধনের পেছনে কুকুরের মাংস খাওয়ার কোনো যোগসূত্র আছে কিনা।

ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, আমেরিকান সিভিল ওয়ারের সময় আমেরিকান সেনাবাহিনী ও কনফেডারেট বাহিনীকে খাদ্যাভাব দেখা দিলে তারা প্রথমে ঘোড়া, এরপর গাধা এবং সবশেষে কুকুরের মাংসের ওপর জীবন ধারণ করেছে। বাংলাদেশে কুকুর খাওয়া না হলেও কুকুরের দংশন থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য কুকুর নিধন করা হয় এবং ঢাকা সিটি করপোরেশন বছরে প্রায় ৩০ হাজার লাওয়ারিশ কুকুর নিধন করে। কুকুরখোরদের জন্য এটা দুঃসংবাদ!

ভারতে কুকুর নিধন নিষিদ্ধ। কারণ, হিন্দু ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী কুকুর ভগবান ভৈরবের অবতার। হিন্দুবাদে ত্রিমূর্তির (ব্রক্ষ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর) অবতার ভগবান দাত্তাতরায়ার সঙ্গে কুকুরের যুগসূত্র রয়েছে। এই ভগবান সবসময় চারটি কুকুরকে অনুসরণ করেন, যা প্রতীকীভাবে চার বেদ এর প্রতিনিধিত্ব করে। তবে কুকুরের বংশবৃদ্ধি রোধ করার জন্যে তারা পুরুষ কুকুর ধরে ধরে নিবীর্যকরণ কর্মসূচি কার্যকর করে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট অনুযায়ী গুজরাটের সুরাট শহরে দৈনিক প্রায় ১০০ কুকুরকে নিবীর্য করা হয়।

আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু, আমেরিকা প্রবাসী সিনিয়র সাংবাদিক, বিশিষ্ট অনুবাদক।

;

খোকা থেকে জাতির পিতা



কবির য়াহমদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

‘কেউ জন্মগতভাবে মহান, কেউ মহত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মায় আর কেউ স্বীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করে’—উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের কথা। মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায় এখানে উল্লিখিত বলে মনে করি। তবে ব্যক্তিগতভাবে মনে করি তারাই আদতে মহান যারা এই উদ্ধৃতির তৃতীয় অংশের। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষেত্রে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় নিয়ে আমার ভাবনা নাই, তবে নির্দ্বিধায় বলতে পারি ‘খোকা’ থেকে ‘শেখ সাহেব’ হয়ে বঙ্গবন্ধু এবং অতঃপর বাঙালি জাতির পিতা হয়েছেন তিনি স্বীয় প্রচেষ্টায়, নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যমে।

বাংলাদেশ নামের দেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব ও সম্পর্ক নিবিড়ভাবে জড়িয়ে। যখন কথা বলার অধিকারসহ বিবিধ অধিকার নিয়ে কথা বলি-লিখি তখন বায়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, ঊনসত্তর একাত্তরসহ দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রামের পথ ধরে স্বাধীনতা অর্জনের প্রক্রিয়াগুলো চেতনার আলোয় আলোকিত করে। দীর্ঘ এই মুক্তির সংগ্রামকে স্বাধীনতায় রূপদান করতে বঙ্গবন্ধুর যে ভূমিকা একজন ‘সৎ লেখক’ হিসেবে তা আমি অস্বীকার করতে পারি না। কোন সৎ লেখকের অস্বীকারের উপায়ও নাই।

স্বাধীনভাবে কথা বলা, স্বাধীনভাবে লিখতে পারার সুযোগ সৃষ্টির পথ দেখিয়ে দেওয়ার একজন বংশীবাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে দেখছি। তিনি নিজেকে নিবেদনের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন সে পথ, তিনি অনুসন্ধান করতে বলেছেন সে পথ। আমরা অনুসন্ধান করেছি, আমরা পেয়েছি। আমাদের এ অনুসন্ধানের নাম মুক্তির সংগ্রাম আর প্রাপ্তিযোগের নাম একাত্তর এবং স্বাধীনতা।

আমার-আমাদের লেখালেখি ও স্বীকারোক্তিতে তাকে বাদ দেওয়াকে তাই আত্মপ্রতারণা বলেই মনে করি। আশার কথা, আমি আত্মপ্রতারক নই, বাংলাদেশের উল্লেখ করার মতো অধিকাংশ সৎ লেখকই আত্মপ্রতারক নন; তাই বঙ্গবন্ধু আমার কাছে, আমাদের কাছে প্রচলিত রাজনৈতিক সমীকরণধর্মী কোন নেতা নন; প্রকৃতই জাতির পিতা!

রাজনীতি মুজিবকে জাতির পিতা করেছে, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি করেছে। রাজনীতির মাধ্যমে অর্জিত এই অভিধা হলেও স্বীকৃতিতে কোন রাজনীতি নেই। কারণ অস্বীকারের মাধ্যমে বাংলাদেশের জন্ম-প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করা হয়। শেখ মুজিব বাংলাদেশের জাতির পিতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক—এসব স্বীকৃতির মধ্যে রাজনীতি নেই; এটা ইতিহাসের দায় শোধ। এই দায়শোধে আমরা যদি অস্বীকার করি তবে আত্মপ্রবঞ্চক হব।

বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ—সবখানেই অবধারিতভাবে ছিল শেখ মুজিবের উপস্থিতি। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের পরেও এর স্বীকৃতিতে কারও বাধা ছিল না। কিন্তু পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক দৃশ্যপটের পর শেখ মুজিবকে ইতিহাসের সোনালি অধ্যায় থেকে মুছে দেওয়ার একটা প্রবণতা শুরু হয়। তাকে মুছে ফেলার যে নীলনকশা সম্পাদিত হয় সেটা মূলত রাজনীতির কারণেই হয়েছে। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। ওই সময়ে স্বাধীন দেশের পক্ষে আর বড় কোন রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব না থাকার কারণে দলীয়ভাবে এই কৃতিত্ব তারা দাবি করতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর সেই অবদানকে অস্বীকার করার যে চেষ্টা শুরু হয়েছিল তা এখনও চলমান। আওয়ামী লীগবিরোধী বৃহৎ একটি রাজনৈতিক দলের গঠন বঙ্গবন্ধুর হত্যার কয়েক বছর পর হওয়ার কারণে দেশের জন্মপ্রক্রিয়ায় দলটির কোন অবদান নেই। অথচ এক শ্রেণির রাজনৈতিক কর্মী মুক্তিযুদ্ধের এগারো সেক্টরের মধ্যকার একটা সেক্টর কমান্ডারকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে মুক্তিযুদ্ধে দলটির অবদানকে সামনে আনতে মরিয়া। অথচ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে যে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার পুনঃপাঠ করেন সেটাও কোনভাবেই ছাব্বিশ মার্চে নয়, জিয়ার ঘোষণা পাঠ ছিল সাতাশ মার্চ। জিয়ার এই সাতাশ মার্চের ঘোষণার পুনঃপাঠকেও অস্বীকার করা যাবে না, যেমনটা আলোচনার বাইরে রাখা যাবে না আরও অনেকের মত আবদুল হান্নানের পাঠকেও।

স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আরও ভুল ধারণা, ভুল প্রচারণা আছে আছে যা সাত মার্চ কেন্দ্রিক। বাংলাদেশের অতি-উৎসাহী অনেকেই স্বাধীনতার ঘোষণা সংক্রান্ত ভুল করে থাকেন, কিন্তু সাত মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা দেননি। এই তারিখে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হলে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকালীন বৈশ্বিক সমর্থন পেত না, এটাকে গৃহযুদ্ধ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে পাকিস্তানসহ তাদের মিত্র দেশগুলো প্রমাণ করে ছাড়ত। এখানে আছে দূরদর্শী এক নেতার চিত্র। উত্তাল রেসকোর্সের স্বাধীনতাকামী লক্ষ বুভুক্ষু জনতার চাওয়ার বিপরীতে ১৯ মিনিটের সেই সে ভাষণ যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশের বার্তাও ছিল প্রকাশ্য, কিন্তু ছিল না বিচ্ছিন্নতাবাদ। সেই ভাষণ এবং দিকনির্দেশনা একটি দেশকে নিয়ে গিয়েছিল মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি মুক্তিযুদ্ধের দিকে। একাত্তরের বাংলাদেশে সেই মহাকাব্য দিয়েছিল মুক্তির পথ। সেই ভাষণের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও মিলেছে ইতোমধ্যে। বিশ্ব ঐতিহ্যের স্মারক হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে এ ভাষণ। লেখক ও ইতিহাসবিদ জ্যাকব এফ ফিল্ডের বিশ্বসেরা ভাষণ নিয়ে লেখা ‘উই শ্যাল ফাইট অন দ্য বিচেস: দ্য স্পিচ দ্যাট ইনস্পায়ার্ড হিস্টোরি’ গ্রন্থেও স্থান পেয়েছে এ ভাষণ।

সাত মার্চ নিয়ে কবিতায় নির্মলেন্দু গুণ লিখেন—“একটি কবিতা লেখা হবে তার জন্য কি দারুণ অপেক্ষা আর উত্তেজনা নিয়ে লক্ষ লক্ষ উন্মত্ত অধীর ব্যাকুল বিদ্রোহী শ্রোতা বসে আছে ভোর থেকে, জনসমুদ্রের উদ্যান সৈকতে: ‘কখন আসবে কবি?’…. শত বছরের শত সংগ্রাম শেষে রবীন্দ্রনাথের মত দৃপ্ত পায়ে হেঁটে অতঃপর কবি এসে জনতার মঞ্চে দাঁড়ালেন…. কে রোধে তাহার বজ্রকন্ঠ বাণী? গণসূর্যের মঞ্চ কাঁপিয়ে কবি শোনালেন তার অমর-কবিতাখানি: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। সেই থেকে স্বাধীনতা শব্দটি আমাদের।” কবির সে কবিতা ইতিহাসের এক দলিল, এক জীবন্ত সাক্ষী হয়ে সাক্ষ্য দিয়ে যাচ্ছে অহর্নিশ। জনসমুদ্রের ব্যাকুলতায় কবি যখন লিখেন ‘কখন আসবে কবি’ তখন ভাষণের প্রতি বার্ষিকীতে, প্রতি স্বাধীনতা দিবসে, প্রতি বিজয় দিবসেও টের পাই এক ঠান্ডাস্রোত; যে স্রোতে নিজেকেও হাজির করি রেসকোর্সে। আর ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বাক্যের প্রতি শব্দে টের পাই উত্তেজনার বারুদ, এই সাড়ে পাঁচ দশকের বেশি সময় পরেও। ‘সেই থেকে স্বাধীনতা আমাদের’—বাক্যে যেন পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার এক ভবিষ্যৎ পাঠ।

বঙ্গবন্ধু সাধারণ থেকে অসাধারণ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর নেতৃত্বগুণ ও দেশের প্রতি ভালোবাসার কারণে। কিন্তু তার দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে প্রান্তিক পর্যায়ের নেতাকর্মীরা তাকে কেবল নিজেদের লোক বলেই প্রমাণ করতে মরিয়া। অথচ তিনি ছিল সারাদেশের নেতা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি। যে বা যারা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক তিনি যেমন তাদের নেতা, যে লোকগুলো আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক নন তিনি তাদেরও নেতা। বাংলাদেশের জন্মপ্রক্রিয়ার প্রতি ধাপ যেখানে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ-তিতিক্ষা আর শ্রমে সিক্ত সেখানে তিনি তো বাংলাদেশের নেতাই।

১৯২০ থেকে ২০২৩; ক্যালেন্ডারের হিসাবে ঠিক একশ তিন বছর। অন্য সকলের জন্যে হিসাবটা ক্যালেন্ডারের হলেও বাংলাদেশি বাঙালিদের জন্যে এ হিসাব কেবল ক্যালেন্ডারের নয়; এ হিসাব বাঙালির জাতির পিতা, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের। এই জন্মতারিখ নিয়ে বাঙালির আবেগ আছে, ঐতিহাসিক মূল্য আছে বাঙালির কাছে। তাই ক্যালেন্ডারের হিসাব স্রেফ ক্যালেন্ডারের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বাঙালির আবেগ আর উৎসবে স্থান পেয়েছে।

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম। এ জন্ম ঐতিহাসিক কোন জন্ম না হলেও কালক্রমে হয়ে গেছে ইতিহাসের অংশ। পরাধীনতার শৃঙ্খলে হাঁসফাঁস করা বাঙালির মুক্তির দূত হয়ে ওঠেছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া সেই ‘খোকা’ কিংবা মুজিব। আর দশটা শিশুর মত জন্ম থেকে বেড়ে ওঠা, এরপর মুক্তির কাণ্ডারি হয়ে যাওয়া মুজিব হয়ে ওঠেছিলেন সংগ্রামের স্মারক, মুক্তির সাইনবোর্ড। প্রখর মুক্তির চেতনা, দূরদর্শী নেতৃত্বগুণ তাকে নানা আন্দোলন-সংগ্রামে সামনে সারিতে নিয়ে এসেছে। নেতৃত্ব দিয়েছেন আন্দোলনে, নির্ধারণ করেছেন লক্ষ্য, পরিস্কার করেছেন উদ্দেশ্য। রাজনৈতিক জীবনের জেল-জুলুম উপেক্ষা করে লক্ষ্যে থেকেছেন তিনি স্থির, ধৈর্যের প্রতিমূর্তি হয়ে নানা উসকানিতে লক্ষ্যচ্যুত না হয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার পাশাপাশি তিনি দেখিয়েছেন আন্দোলনের সঠিক পথ। তাই বায়ান্ন থেকে একাত্তরের সকল পর্যায়েই তিনি থেকেছেন সামনের কাতারে, দিয়েছেন নেতৃত্ব, বাঙালিকে এনে দিয়েছেন স্বাধীন বাংলাদেশ। এই সময়ে বঙ্গবন্ধু উপাধি পেয়েছেন তিনি, যথাসময়ে পেয়েছেন জাতির পিতার স্বীকৃতি।

বঙ্গবন্ধুর এই স্বীকৃতি তাকে মহান করেনি, বরং স্বীকৃতি প্রদানে বাঙালি মহান হয়েছে। বাঙালির দায়শোধের এই চেষ্টার বিপরীতে যদিও আছে কলঙ্কের আরেক অধ্যায় যেখানে এই বাঙালির মধ্যে থাকা কিছু আততায়ী রাতের আঁধারে গুলি চালিয়েছে পিতার বুকে। ইতিহাসের এই দুঃখগাথার সঙ্গে জড়িয়ে যেসকল বিশ্বাসঘাতক তাদের কয়েকজনকেও আবার এই বাঙালি ফাঁসির রজ্জুতে ঝুলিয়ে দিয়েছে প্রাপ্য প্রায়শ্চিত্ত। ওখানে যদিও কজন পলাতক তবু একটা অংশ যেখানে শাস্তি পেয়েছে সেখানে অন্তত নিজেকে প্রবোধ দেওয়া বৃথাসম চেষ্টা আমাদের। তবে ওখানে পূর্ণ সন্তুষ্টি নাই যখন পলাতকদের শাস্তি কার্যকরের দাবিও আছে আমাদের। সরকারের কাছে আমাদের চাওয়া পলাতকদের দেশে এনে শাস্তি কার্যকরের।

ইতিহাসের স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহে দেশে-দেশে যেমন নায়কের আবির্ভাব হয়, তেমনি পার্শ্বচরিত্রেও থাকে কিছু খলনায়ক। পঁচাত্তরের বিয়োগান্তক ঘটনা সেই সকল খলনায়কদের সামনে এনেছিল। যাদের শাস্তি কার্যকর হয়েছে তাদের বাইরেও আরও অনেকেই ছিল যাদের বিচারিক আদালতেও তোলা যায়নি মূলত বিচারিক সীমাবদ্ধতার কারণে। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের আড়ালের অনেক খলনায়ক রাষ্ট্রীয়ভাবে দোষী সাব্যস্ত হয়নি। এ আমাদের সীমাবদ্ধতা। চাইলেও আমরা পারি না এই সীমাবদ্ধতা ঘুচাতে।

এত কিছু সত্ত্বেও বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ পালন করেছে। ২০২০ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে পালন করেছে বাংলাদেশ। এটাকে কেন্দ্র করে বছরব্যাপী নানা কর্মসূচি পালিত হয়েছে রাষ্ট্রীয়ভাবে। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই আয়োজন আন্তর্জাতিক রূপও পেয়েছিল।

আজ বঙ্গবন্ধুর ১০৩তম জন্মবার্ষিকী। আজ জাতীয় শিশু দিবস। শিশুদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ভালোবাসা স্মরণীয় করে রাখতে ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকার ১৭ মার্চকে জাতীয় শিশু দিবস ঘোষণা করে। এদিনে শিশুরা তাকে শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি নিজেদের বঙ্গবন্ধুর জীবনাদর্শে আলোকিত করার শপথ গ্রহণ করে। সরকারি নানা কর্মসূচির পাশাপাশি এবার দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও জাতির পিতা জন্মবার্ষিকী ও জাতীয় শিশু দিবস উদযাপিত হয়েছে। যে শিশুদের শিক্ষার নিশ্চয়তা দিতে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে জাতীয়করণ করেছিলেন সেই শিশুরা আজ তাদের বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিক উদযাপন করেছে।

বঙ্গবন্ধু নিজের জন্মদিন পালন করতেন না, কিন্তু তিনি জানতেন তার জন্মদিন পালিত হয়। কারাগারে বসে লেখা ডায়েরির গ্রন্থিত রূপ ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের ২০৯ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, “আজ আমার ৪৭তম জন্মবার্ষিকী। এই দিনে ১৯২০ সালে পূর্ব বাংলার এক ছোট্ট পল্লীতে জন্মগ্রহণ করি। আমার জন্মবার্ষিকী আমি কোনোদিন নিজে পালন করি নাই– বেশি হলে আমার স্ত্রী এই দিনটাতে আমাকে ছোট্ট একটি উপহার দিয়ে থাকত। এই দিনটিতে আমি চেষ্টা করতাম বাড়িতে থাকতে। খবরের কাগজে দেখলাম ঢাকা সিটি আওয়ামী লীগ আমার জন্মবার্ষিকী পালন করছে। বোধ হয়, আমি জেলে বন্দি আছি বলেই।” তারিখটি ছিল ১৯৬৭ সালের ১৭ মার্চ। ওই বইয়ে বঙ্গবন্ধু আরও লিখেন ‘আমি একজন মানুষ, আর আমার আবার জন্মদিবস’; নিজেকে কত ক্ষুদ্র দেখার প্রয়াত।

ফিরে আসি ফের শেক্সপিয়ারের উদ্ধৃতিতে, ‘কেউ জন্মগতভাবে মহান, কেউ মহত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মায় আর কেউ স্বীয় প্রচেষ্টায় মহানুভবতা অর্জন করে’; জন্মগতভাবেও মহান বলে তিনি নিজেকে এভাবে ক্ষুদ্র রূপে ভাবতে পারেন। মহত্বের লক্ষণ নিয়ে জন্মেছিলেন বলে নিজেকে নিয়ে তিনি ভাবেন এভাবে। শেক্সপিয়ারের উদ্ধৃতির তিনটা অংশই মিলে গেল জাতির পিতার ক্ষেত্রে।

টুঙ্গিপাড়ার সেই ছোট্ট খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু হয়ে জাতির পিতা; শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন এমনই। শিশু থেকে যুবা হয়ে বৃদ্ধ; সকলের কাছেই তিনি অনুকরণীয়। জন্মতারিখে শ্রদ্ধা জাতির পিতা!

;