গুজবে বিভ্রান্ত দেশি ও প্রবাসীদের প্রতি
ছবি: বার্তা২৪.কম
ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, ব্যাংকে এক লাখ টাকার চেকও ক্যাশ হচ্ছে না, ব্যাংক নিয়ে এমন কিছু গুজব ছড়ানো হয়েছে অনলাইনে। প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহী করা হচ্ছে। বৈধ পথের বিকল্প হিসেবে অবৈধ হুন্ডি ব্যবসাকে চাঙা করার একটা প্রবণতা সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ব্যাংক নিয়ে গুজব, অবৈধ হুন্ডিকে উৎসাহ দেওয়ার ধারাবাহিক প্রবণতায় কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছে। বেশিরভাগ গুজব বিশ্বাস না করলেও এক শ্রেণির মানুষ ঠিকই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে গেছেন।
দেশে ডলার সঙ্কট আছে, এটা অস্বীকারের উপায় নেই। এটা কেবল আমাদের দেশেরই সমস্যা না। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত বৈশ্বিক উত্তুঙ্গু পরিস্থিতিতে পৃথিবীর সকল দেশই কমবেশি সমস্যায়। দেশে-দেশের এই সমস্যায় পৃথিবীর অন্য কোথাও এটাকে পুঁজি করে সরকারবিরোধিতার নামে দেশবিরোধিতার কোন নজির অদ্যাবধি কোথাও দেখা যায়নি। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে, দেশের মানুষের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ করতে সরকারবিরোধীরা জোট বেঁধে দেশের বিরোধিতায় নেমে পড়েছে। টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতিতে যেখানে আমাদের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার পথ খোঁজার কথা সেখানে আমাদের এক শ্রেণির মানুষ স্রেফ রাজনৈতিক সংকীর্ণতায় রাষ্ট্রকেই প্রতিপক্ষ বানিয়ে দিয়েছে।
দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, মানুষের আয় কমেছে, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষের জীবনে নাভিশ্বাস ওঠার উপক্রম। এগুলো সব ঠিক আছে। কিন্তু দুর্দিন মোকাবেলায় যেখানে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার কথা সেখানে আমরা শতভাগ ব্যর্থ। এই ব্যর্থতা ইচ্ছে করেই। সরকারকে এখানে সহযোগিতা করা উচিত ছিল সকলের। কিন্তু সহযোগিতা দূরের কথা, সরকারবিরোধীরা সরকাবিরোধিতার নামে দেশ বিরোধিতায় নেমেছে। অনলাইনে গুজব ছড়াচ্ছে। মানুষদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠাতে নিরুৎসাহিত করছে।
বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে দেশের রিজার্ভে এই টাকা যুক্ত হয়। এই রেমিট্যান্স দেশের ডলার অ্যাকাউন্টে যুক্ত হয়। এমন না যে প্রবাসীরা এর বিনিময় মূল্য পাচ্ছে না। প্রবাসীরা বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে সমমানের বাংলাদেশি মুদ্রার পাশাপাশি অতিরিক্ত আড়াই শতাংশ ইনসেনটিভ তাদের পরিবারপরিজনেরা পেয়ে থাকেন। এখানে দেশের অর্থনীতিকে শক্ত ভিত্তি দিচ্ছেন যেমন প্রবাসীরা, তেমনি সরকারও তাদের দিচ্ছে সর্বোচ্চ সুবিধা। বৈধ পথে এই রেমিট্যান্সে যেমন রাষ্ট্র লাভবান হয় তেমনি লাভবান প্রবাসীরাও।
অন্যদিকে অবৈধ পথে বা হুন্ডিতে টাকা পাঠালে প্রবাসীদের এই অর্থ বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যুক্ত হচ্ছে না। প্রবাসীদের স্বজনেরা দেশে থেকে দেশের টাকা পেয়ে যাচ্ছেন সত্য কিন্তু এর প্রাথমিক লেনদেন বিদেশে সম্পাদিত হওয়ায় একটা সময়ে সেটা কনভার্ট হয়ে অবৈধ পথে বিদেশেই চলে যাচ্ছে। এটা মানি লন্ডারিং। আইনত দণ্ডনীয়, পাশাপাশি নৈতিকতা বিবর্জিত। আপনি কষ্টে-শ্রমে উপার্জন করলেন যে অর্থ সেই অর্থ দেশের অর্থনীতিকেই ধ্বংস করে দেওয়ার পথ রচনা করল, এটা কি মেনে নেওয়ার মতো? ন্যূনতম বিবেচনাবোধ ও সততা থাকলে এই পথ মাড়াবার কথা নয় কারও।
বৈধ পথে পাঠানো টাকায় রাষ্ট্রের বৈদেশিক রিজার্ভ স্ফীত হয়, এই অর্থ রাষ্ট্রের আমদানি ব্যয় নির্বাহে কাজে লাগে। এই যে আমদানি ব্যয় এটা কীসের? ভালো করে খবর নিলে দেখবেন আমরা যে সকল অত্যাবশকীয় পণ্য ব্যবহার করছি সেগুলোর অনেকটাই আমদানি করতে হয়। চাল-ডাল-তেল-রসুন; কী আমদানি না করতে হয়? আপনি যখন আপনার লাভ, দেশের লাভকে উপেক্ষা করে অবৈধ পথে আপনার বৈধ আয়কে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন/পাঠাচ্ছেন তখন সেটা দেশের প্রতিপক্ষ হিসেবেই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
এর মাধ্যমে আপনার বৈধ আয়কে অবৈধ আয়ে রূপান্তর ঘটালেন না? অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত, কিংবা তৃতীয় কারও উসকানিতে কেন আপনি এটা করবেন? কেন দেশের বিরুদ্ধে কাজে লাগাবেন আপনার বৈধ টাকা? আপনার মা-বাবা-ভাই-বোন-সন্তান-স্বজনেরা আপনার উপার্জিত যে অর্থে প্রাত্যহিক ব্যয় নির্বাহ করছে সেই অর্থকে কেন অবৈধ পথে আনবেন? কেন অবৈধ উপার্জনকে অবৈধ বানিয়ে সেটা তাদের খাওয়াবেন?
বিদেশে আপনি যে পেশাতেই থাকুন না কেন নিজের দেশ যদি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী হয় তবে আপনার পেশাগত ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে বাধ্য। আগে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো আমাদের শ্রমিকদের ‘মিসকিন’ বলত, এখনও হয়ত বলে; কিন্তু এটা নিশ্চিত আগের অবস্থা থেকে এখনকার অবস্থায় অনেক পার্থক্য এসেছে। এখন তারাও জানে বাংলাদেশের অর্থনীতিসহ সামগ্রিক অবস্থান আগের মতো নেই। আমাদের শ্রমিকদের প্রতি আচরণগত পরিবর্তন এসেছে মধ্যপ্রাচ্যসহ সব জায়গায়। এসবের মূলে একদিকে আছে যেমন রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক পরিবর্তন, অন্যদিকে আছে প্রবাসীদের দেশের প্রতি নিবেদন।
আমাদের প্রবাসীরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ক্ষেত্রে অনেকেই হয়তো উচ্চ পর্যায়ের নন, কিন্তু তাদের বেশিরভাগই দেশপ্রেমের দীক্ষায় উচ্চতম শ্রেণির বলে আমরা মনে করি। বৈধ পথে যারা দেশে অর্থ পাঠায় তাদের ‘রেমিট্যান্স যোদ্ধা’ বলছে রাষ্ট্র। যোদ্ধার এই স্বীকৃতি অনেক বড় অর্জন তাদের। বৈধ পথে আসা রেমিট্যান্স আয়করের আওতামুক্ত; এর জন্যে কর দিতে হয় না। বরং সরকারই এই রেমিট্যান্সের বিপরীতে রেমিটারকে অতিরিক্ত অর্থ দিচ্ছে। এখানে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেওয়ার পাশাপাশি দিচ্ছে সর্বোচ্চ আর্থিক সুবিধা।
দেশের ব্যাংকগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, চেক ক্যাশ হচ্ছে না, রিজার্ভ শেষ বলে যে সকল গুজব ছড়ানো হচ্ছে সেগুলো সবৈব মিথ্যা। বাংলাদেশ ব্যাংকও এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, দেশের ব্যাংকগুলোতে তারল্য সঙ্কট নেই। কিছুদিন আগে দেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যাচ্ছে বলেও গুজব ছড়ানো হয়েছিল। সেটা কি সত্য বলে প্রমাণ হয়েছে? হয়নি। দেশ শ্রীলঙ্কা হয়ে যায়নি। বাংলাদেশ আছে বাংলাদেশের মতোই।
হ্যাঁ, টালমাটাল বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে বিশ্বের প্রতি দেশের মতো আমরাও কিছুটা অসুবিধায় আছি সত্য, কিন্তু বেকায়দায় নই। আসছে বছরে বিশ্বের কিছু জায়গায় দুর্ভিক্ষ আসছে বলে যে পূর্বাভাস এসেছে, সেখানে আমাদের নিয়ে শঙ্কা নেই। দুর্ভিক্ষের শঙ্কা এবং প্রবল অর্থনৈতিক সংকটের মুখে থাকলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বহুজাতিক সংস্থাগুলো কাউকে ঋণ দেয় না, কিন্তু এইধরনের আলোচনা থাকা সত্ত্বেও আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে।
সবকিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় আমরা নই। তবু কিছু ভার্চুয়াল দুর্বৃত্ত এবং কিছু রাজনৈতিক দুর্বৃত্ত প্রবাসীদের নিরুৎসাহিত করছে। প্রবাসীদের বৈধ উপার্জনকে অবৈধ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। এরা দেশ ও জাতির শত্রু। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
প্রবাসীদের উচিত হবে নিজেদের বৈধ উপার্জনকে অবৈধ বানাতে তাদের ফাঁদে পা না দেওয়া। এরা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে। এসব দুর্বৃত্তদের প্ররোচনাকে বৃদ্ধাঙুলি দেখিয়ে নিজেদের বৈধ উপার্জনকে বৈধই রাখুন। বৈধ ও ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্ত রাখার পাশাপাশি নিজেরাও লাভবান হোন।
কবির য়াহমদ: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
ইমেইল: [email protected]