অগাস্ট কোঁত এর ত্রি স্তর আইন তত্ত্ব ও বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা



মো: বজলুর রশিদ
অগাস্ট কোঁত এর ত্রি স্তর আইন তত্ত্ব ও বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা

অগাস্ট কোঁত এর ত্রি স্তর আইন তত্ত্ব ও বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থা

  • Font increase
  • Font Decrease

 

মানব সমাজের শুরু থেকেই প্রতিটি সমাজের নিজস্ব সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। আর সমাজ ও সংস্কৃতি সর্বদা পরিবর্তনশীল। কিন্তু এই পরিবর্তন রাতারাতি ঘটে না। পরিবর্তন হয় ধীর গতিতে, ক্রমান্বয়ে। আর এই ধীর লয়ের পরিবর্তনকে সমাজবিজ্ঞানীরা সামাজিক বিবর্তন হিসাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন। তবে প্রতিটি সমাজে শত পরিবর্তনের পরও একটি বিষয় স্থির হয়ে থাকে আর তা হল সত্য।

সমাজবিজ্ঞানের জনক ইসিডোর ম্যারি অগাস্ট ফ্রাংকোসিস কোঁত সংক্ষেপে অগাস্ট কোঁত এর মতে, যে কোনো সমাজ চূড়ান্ত সত্যের সন্ধান না পাওয়া পর্যন্ত তিনটি পর্যায় অতিক্রম করে। প্রতিটি ধাপে মানুষ ধীরে ধীরে কল্পনা ও কুসংস্কারের জাল ছিন্ন করে আরও বুদ্ধিমান হয়। একদিকে যেমন সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়, অন্যদিকে মানুষের মানসিক পরিবর্তনও ঘটে সমান্তরালভাবে। আর এই সামাজিক ও মানসিক পরিবর্তনের তিনটি পর্যায় সম্পর্কে কোঁত যে তত্ত্ব প্রদান করেছেন তাকে ‘ত্রি স্তর আইন তত্ত্ব’ (Law of Three Stages) বলা হয়।

সামাজিক বির্বতনে অগাস্ট কোঁত এর তত্ত্বের প্রথম স্তর হল ধর্মতাত্ত্বিক বা কাল্পনিক সমাজ। তেরো শতকের পূর্বের সামাজিক ব্যবস্থাগুলি প্রধানত এই স্তরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই সমাজে মানুষ সমস্ত ঘটনা এবং সমস্ত জীবন্ত বস্তু বা জড় বস্তুতে, তা সাধারণ, অতি সাধারণ বা অসাধারণ যাই হোক তাতে অতিপ্রাকৃত কিছুর স্পর্শ খুঁজে পেত। এই সমাজে সত্য আবিষ্কারের জন্য যৌক্তিকতা ও ন্যূনতম প্রচেষ্টার প্রয়োজন ছিল না। এই সমাজের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যে কোনো অস্বাভাবিক ঘটনার পেছনে অতিপ্রাকৃত কিছু জড়িত ছিল বলে ধারণা করা। মূলত, এই ধরনের বিশ্বাসগুলি আদিম সমাজে প্রচলিত ছিল, যেখানে সবকিছুর পিছনে অতিপ্রাকৃত শক্তির সম্পর্ক খোঁজা হত।

পুরোহিতদের দ্বারা শাসিত এই সমাজে, এমনকি মানুষের স্বাভাবিক আবেগও ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বলে মনে করা হত। আর এই সমাজ নিয়ন্ত্রিত হতো সামরিক বাহিনী দ্বারা, যারা পুরোহিতদের আদেশ ও শৃঙ্খলা মেনে চলত। সেই সমাজে যুক্তির কোন স্থান ছিল না। সামাজিক বিবর্তনের এই ধর্মতাত্ত্বিক স্তরের আবার তিনটি উপ-স্তর রয়েছে যথা 'ফেটিসিজম' বা বস্তুবাদ, 'পলিথিজম' বা বহুদেববাদ এবং 'মনোথিজম' বা একেশ্বরবাদ।

ফেটিসিজম বা বস্তুবাদ হল এই বিশ্বাস যে অতিপ্রাকৃত শক্তিগুলি জড় বস্তুতে বাস করে। যখন এই বিশ্বাসের সূচনা হয়েছিল, তখন কোন যাজক বা পুরোহিতের প্রয়োজন ছিল না। কারণ মানুষ ভেবেছিল প্রকৃতির প্রতিটি জড় বস্তুর মধ্যেই কিছু অতিপ্রাকৃত শক্তি বিদ্যমান। কাঠের টুকরো হোক, বড় পাথর হোক, বিশাল বটগাছ হোক বা পাহাড় হোক, সবকিছুর ভেতরেই রয়েছে রহস্যময় ক্ষমতা। তাই তাদের পূজা করতে হবে এবং সেই মহান শক্তিকে সন্তুষ্ট করতে হবে। কিন্তু আর কতদিন? ধীরে ধীরে, মানুষ প্রচুর পরিমাণে বস্তুর সাথে পরিচিত হয়ে বিভ্রান্ত হয়। তাদের সবার মধ্যে কি একই পরাশক্তি বিদ্যমান?

এই বিভ্রান্তি থেকেই বহুদেববাদের সূচনা হয়। লোকেরা ধরে নিয়েছিল যে একই অতিপ্রাকৃত শক্তির সমস্ত জিনিসের মধ্যে তার অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। ফলে শুরু হলো সীমাহীন ও বাধাহীন 'দেবতা' বানানোর সমাজ! এই সমাজে মানুষ প্রতিটি ভিন্ন প্রাকৃতিক সত্তার জন্য আলাদা আলাদা দেবতা নিযুক্ত করে (বিশ্বাস করতে শুরু করে)। তদনুসারে, সমাজে পুরোহিত এবং পুরোহিতের উদ্ভব হয়েছিল, যারা দেবতাদের সান্নিধ্য লাভ করেছিল এবং সাধারণ মানুষের চেয়ে উচ্চে পৌঁছেছিল। কিন্তু দিনে দিনে দেবতাদের সংখ্যা এত বেড়ে গেল যে মানুষ আবার বিভ্রান্তিতে পড়ে গেল।

দ্বিতীয় বিভ্রান্তিটি ধর্মতাত্ত্বিক পর্যায় বা ধর্মতাত্ত্বিক সমাজের সমাপ্তির শুরুকে চিহ্নিত করে। পূর্ববর্তী দুটি উপ-স্তর ছিল মানুষের কল্পনা এবং অযৌক্তিকতার চরম উদাহরণ। এই স্তরে যুক্তি কল্পনাকে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে। মানুষ এখন বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে সমগ্র বিশ্ব এক ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্টি হয়েছে এবং তিনিই সর্বশক্তিমান। এই বিশ্বাস থেকেই মানুষ সীমাহীন বিভ্রম পরিহার করে যুক্তি ও যুক্তির বিকাশ শুরু করে। ধর্মতাত্ত্বিক সমাজে ধর্মযাজক বা প্রচারক, রাজা, সামরিক বাহিনী জনগণের দ্বারা বিশেষভাবে সম্মানিত ও প্রিয় ছিল। পরিবারকেন্দ্রিক এই সমাজে স্থিতিশীলতার ভিত্তি ছিল সামরিক শক্তি।

অগাস্ট কোঁত এর মতে মেটাফিজিক্যাল স্টেজ বা আধিভৌতিক বা আধ্যাত্মিক বা বিমূর্ত স্তর শুরু হয় তেরো শতকে। ধর্মতাত্ত্বিক স্তরের তুলনায় এই স্তরটি দৈর্ঘ্যে খুব ছোট। মধ্যযুগ এবং রেনেসাঁর সময় সামাজিক বিবর্তনের এই স্তরটিকে অন্য কথায় বলা যেতে পারে ধর্মতাত্ত্বিক স্তরের বৃদ্ধি বা প্রসারণ। অনেকটা ধর্মতাত্ত্বিক সমাজের মতোই এই সমাজে চিন্তাধারা ছিল। তাই একে অনেকে ধর্মতাত্ত্বিক সমাজের বর্ণ সংকর বা সংক্রামক বলেও মনে করে থাকে।

আধিভৌতিক মানে এমন কিছু যা বস্তু দ্বারা বা কোনো বাহ্যিক রূপ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না। সেই অবর্ণনীয় জিনিস হল জ্ঞান, বুদ্ধি, বিবেক, নীতি, যুক্তি। এই স্তরে, মানুষ কল্পনাকে বাদ দিয়ে সম্পূর্ণ যৌক্তিকতা এবং বিচারের সাথে চিন্তা করতে শুরু করে। সামাজিক বিবর্তনের এই পর্যায়ে মূর্ত ঈশ্বরের ধারণা সম্পূর্ণরূপে অদৃশ্য হয়ে যায়। মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করে যে ঈশ্বর সম্পূর্ণ বিমূর্ত সত্তা

আধিভৌতিক স্তরে পাদ্রীদের স্বৈরাচারী বা একচেটিয়া ক্ষমতা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বরং সমাজ পরিচালিত হতো আইন দ্বারা। কিন্তু পরোক্ষভাবে পুরোহিতরাই এই আইনকে প্রভাবিত করেছিল। এই সমাজের সবচেয়ে প্রভাবশালীদের মধ্যে রয়েছে চার্চের অধীনস্ত আইনজীবীরা এবং সমস্ত আইন রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সমাজের এই স্তর থেকে সবকিছু কঠোর নিয়ম-কানুন দ্বারা পরিচালিত হতে থাকে।

ধর্মতাত্ত্বিক এবং আধিভৌতিক স্তরের বাইরে, সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত সামাজিক ব্যবস্থা অবশেষে শুরু হয়। আর এটাই ইতিবাচক (Positive) বা বৈজ্ঞানিক সমাজ। এই সমাজের মূল ধর্মতাত্ত্বিক থেকে বিপরীত দিকে চলে, এমনকি অধিবিদ্যামূলক সমাজের যুক্তিগুলি এখানে খুব বেশি কাজ করে না। পরিবর্তে, একটি ইতিবাচক বা দূরদর্শী সমাজে সবকিছুর মূলে থাকবে বিজ্ঞান এবং বিজ্ঞান আসে অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণযোগ্য তথ্য এবং উপাত্ত থেকে।

শিল্পায়নের শুরু থেকেই সামাজিক কাঠামো বিজ্ঞান দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এবং মানুষ বিশ্বাস করে যে কোন ঐশ্বরিক বা অলৌকিক শক্তির কারণে নয়, প্রকৃতির সবকিছুই কিছু নির্দিষ্ট প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলে। তাই কোনো বস্তুকে রহস্য না ভেবে পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে এর পেছনের কারণ আবিষ্কার করা সম্ভব। আর এই বিশ্বাসকে বলা হয় পজিটিভিজম বা দৃষ্টবাদ।

উনিশ শতকের শুরু থেকে, ইতিবাচক বা আদর্শবাদী চিন্তা গতি পেতে শুরু করে। এ সময় সবকিছুর পেছনে প্রকৃত কারণ খোঁজার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় মানুষের মধ্যে। মানুষ সব বিষয়ে সম্পূর্ণ সন্দেহমুক্ত হতে চায়। ফলস্বরূপ, ঈশ্বরের ধারণাটি অদৃশ্য হয়ে যায়, কারণ একটি বিমূর্ত ঈশ্বরের অস্তিত্ব বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণ করা যায়নি। মানুষ সব তাত্ত্বিক বিষয় বৈজ্ঞানিকভাবে বোঝার চেষ্টা করে। আর যেহেতু বিজ্ঞানে বিশেষ বিশ্বাস বা সংস্কারের কোনো স্থান নেই, তাই চিন্তার এই স্তরে মানুষ ধর্মকে একপাশে ঠেলে দেয়।

ইতিবাচক সমাজ, বিজ্ঞান দ্বারা পরিচালিত হয়। শিল্পপতি, প্রযুক্তিবিদ এবং সুবিধাবাদীরা এই সমাজে আধিপত্য বিস্তার করে। বোঝাপড়া-নৈতিকতা, এবং অনুভূতি ও আবেগ, সব ধরনের ধর্ম-বিশ্বাস এই সমাজ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়। এটি সামাজিক বিবর্তনের পর্যায়। অনেক কিছুই রূপান্তর প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এই সমাজে এসেছে। আর এই পথেই মানুষের মনের মুক্তি হয় এবং বৈজ্ঞানিক যুক্তির মাধ্যমে প্রকৃত সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তবে এই সমাজ পরিবর্তিত হতে থাকবে, কিন্তু সমাজ ব্যবস্থায় বিজ্ঞান থেকে যাবে।

অগাস্ট কোঁত এর  ত্রি স্তর আইন তত্ত্বটি বিভিন্ন দার্শনিক এবং সমাজবিজ্ঞানীদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। তবে আমাদের সমাজব্যবস্থায় এখনও দেখতে পাই অগাস্ট কোঁত বর্ণিত তিনটি পর্যায়ই বিদ্যমান। এখানে ধর্মতাত্ত্বিক সমাজের বৈশিষ্ট্য থেকে শুরু করে, আধিভৌতিক ও বৈজ্ঞানিক যুক্তি নির্ভর সমাজ সবই রয়েছে। অর্থাৎ অগাস্ট কোঁত এর ‘ত্রি স্তর আইন তত্ত্ব’ আমাদের সমাজে পুরোপুরি প্রতিফলিত হয় না।

মো: বজলুর রশিদ: সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, তেজগাঁও কলেজ, ঢাকা।

   

এক জায়গায় সবাই একাকার!



প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম
ছবি: বার্তা২৪

ছবি: বার্তা২৪

  • Font increase
  • Font Decrease

ছেলেবেলার এক বন্ধু এসেছিল আমাদের বাসায় বেড়াতে। বহুদিন আগে সে এই রাজধানীতে এসেছিল। তখন রাস্তাঘাট এত উঁচুনিচু ছিল না। তাই, বাসা চিনতে তার কষ্ট হতো না।

এবার দুপুর বেলা কমলাপুরে ট্রেন থেকে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় করে বাসার কাছাকাছি এসেও বাসা খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই, মোবাইল ফোনে বার বার কল দিচ্ছিল। অটোরকিশাওয়ালা বন্ধুটির অসহায়ত্ব বুঝে ফেলে বোধহয় মওকা খুঁজছিল কীভাবে তার যাত্রীর সঙ্গে প্রতারণা করা যায়।

আড়াইশ’ টাকার ভাড়া মেটাতে গিয়ে খুচরা টাকা না থাকায় একটি এক হাজার টাকার নোট এগিয়ে দেয়। সে আবার আমাকে কল দেওয়ার সময় অটোরকিশাওয়ালা একহাজার টাকার নোটটি নিয়ে বাকি টাকা ফেরত না দিয়ে দ্রুত অটো চালিয়ে পালিয়ে যায়!

এই, থামো, থামো বলে বাকি টাকা আর ফেরত পাওয়া যায়নি।

এরকম চুরি, ছ্যাঁচড়ামি, হাইজ্যাকিং, প্রতারণা, জালিয়াতি, দুর্নীতি আমাদের সমাজের নিত্যদিনের ঘটনা। এসব নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষ বাহিনীরা তদারকিতে দিনরাত ব্যস্ত রয়েছেন। এজন্য বিভিন্ন প্রকারের দুর্নীতিদমনকারী সংস্থার কার্যক্রম প্রচলিত রয়েছে। তাদের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা হচ্ছে কি না তা পর্যবেক্ষণের জন্য রয়েছে আরো অনেক গোয়েন্দা উইং।

সব ধরনের প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিদর্শন বিভাগ নামক শাখা রয়েছে। কিন্তু দমনকারীরাই যখন দুর্নীতিবাজ হয়ে যায়, তখন সমস্যা আরো জটিলতর রূপ ধারণ করে ফেলে।

সেগুলো পরিদর্শনের জন্য নিয়োজিত রয়েছেন শত শত পরিদর্শক। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছে নিজস্ব পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের রয়েছে স্কুল, কলেজ পরিদর্শন শাখা-উপশাখা। সহকারী শিক্ষা পরিদর্শকগণ মাঠ পর্যায়ে শিক্ষা সংক্রান্ত কর্মসূচি তদারকি করে থাকেন। এজন্য তাদের ট্যুর প্রোগাম নির্ধারণ করা হয়।

সংবাদমাধ্যমে দেখা গেছে, এই ট্যুর প্রোগাম ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যাপার ঘটছে। এসব ট্যুর প্রোগাম করতে যাওয়া বেশ লাভজনক বিবেচিত হওয়ায় এটা বিক্রয় করার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

কারণ, এখানে ‘নাই’কে ‘হ্যাঁ’ বা মন্দটাকে ভালো বলে রিপোর্ট প্রদান করলেই আর্থিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। ফলে, কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকেও চাকরি করা যায় অথবা নির্দিষ্ট পরিমাণ জমি, ভবন, খেলার মাঠ, ল্যাবসুবিধা না থাকলেও কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার অনুমতি মেলে। এসব অনুমতি মেলার পেছনের শক্তিকে অবৈধ অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করে দেন দুর্নীতিবাজ দায়িত্বশীলরা।

দেশে ভাগ-বাটোয়ারার মাধ্যমে বহুলাংশে পরিচালিত হচ্ছে, বড় বড় নির্মাণকাজগুলো। অনেক ঠিকাদারের ঠিকাদারি সনদ নেই। অনেকের সনদ আছে কিন্তু ভেজাল অথবা ধার করা। এখানে কাজ প্রাপ্তির আগে টাকা ভাগ-বাটোয়ার বিনিময়ে কাজ বাগানো হয়। অভিজ্ঞ একজনের নাম ভাঙিয়ে অনভিজ্ঞ আরেকজন বা বহুজন সেসব কাজের অংশীদার সেজে কাজ করতে গিয়ে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে তোলেন এবং নির্দিষ্ট সময়ে কাজ সমাপ্ত করতে না পেরে সরকারী অর্থের অপচয় ঘটিয়ে বাজে বাড়িয়ে দেবার আন্দোলনের নামে কাজ বন্ধ করে রাখেন।

এটা আমাদের দেশের নির্মাণ সরকারি কাজের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠেছে। এজন্য জাপান বা মালয়েশিয়ার চেয়ে আমাদের দেশে নির্মাণ কাজের খরচ বেশি গুণতে হচ্ছে।

এখনও নতুন পাসপোর্টের জন্য পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে কালক্ষেপণ সমস্যা টাকা ছাড়া সমাধান হবার নজির নেই। সরকারি চাকরি পেতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে হেনস্তা হবার ঘটনা আমাদের দেশে স্থায়ী রূপ লাভ করেছে। এজন্য একজন বিসিএস ক্যাডারকেও প্রমোশনের জন্য ভেরিফিকেশন রিপোর্ট পেতে অবৈধ অর্থ খরচ করার নজির রয়েছে।

কিছুদিন আগে একজন এমপি ঘোষণা দিলেন, তার ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা নির্বাচনি খরচের কথা! যেটা নির্বাচন কমিশনের তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবার কথা। কিন্তু নির্বাচনক কমিশন সেটাকে পাশ কাটিয়ে গেছে!

এসব লেখা নিয়ে যখন ভাবছিলাম তখন হঠাৎ মাথায় বজ্রাঘাতের মতো একটি জাতীয় বাংলা দৈনিকের প্রথম পাতায় সংবাদ শিরোনাম এসে সবকিছু ওলটপালট করে দিলো। তা হলো- র‌্যাবের সাবেক এক মহাপরিচালকের অর্থিক নিয়মের বিষয়টি।

পত্রিকাটিতে নানান অনিয়মসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে জমি, ফ্ল্যাট, স্থাপনা ক্রয় এবং একটি বিলাসবহুল রিসোর্ট তৈরির জন্য ছবিসহ নানা তথ্য।

পত্রিকাটি আবাদি জমিতে রিসোর্ট তৈরির জন্য লিখেছে, ‘কেনা জমির কয়েকজন মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ক্রমাগত চাপ ও ভয়ভীতি দেখিয়ে তাঁদের জমি বিক্রি করতে বাধ্য করেন। ভয়ভীতিতে কাজ না হলে ভেকু দিয়ে জমির মাটি নিয়ে যেতেন। গভীর গর্ত করে শেষ পর্যন্ত জমি বিক্রি করতে বাধ্য করতেন। পুলিশ বাহিনীর ঊর্ধ্বতন পদে থাকায় তাঁর অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে সাহস পাননি জমির মালিকরা।’

পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়েছে, ‘শুধু তাই নয়, রিসোর্টটির নিরাপত্তায় পাশেই বসানো হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি। আশপাশের বিভিন্ন এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নতি না হলেও এই রিসোর্টে প্রবেশ স্বাচ্ছন্দ্য করতে সাত কিলোমিটার সড়ক পাকা করা হয়েছে সরকারি খরচে।’

এছাড়া ওয়াসার সাবেক এমডি, কতিপয় সাবেক ভিসি, মহাপরিচালক ইত্যাদির দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির খবর বেশ চাউর হলেও সেগুলোর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়াতে খুবই ধীরগতি লক্ষণীয়।

এদেশে ছাত্র সংসদের নেতা হওয়া বেশ লাভজনক। তাই ছাত্রনেতা হবার দৌড়ে লবিং, তোয়াজ-তোষণ, তোড়জোর, নির্বাচনি প্রচার খরচের বাহুল্য পৃথিবীর অন্য কোনো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আছে কি না তা জানা যায়নি। দেশের টেকনিক্যাল ও গবেষণাধর্মী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে রাজনীতির বাইরে রাখার আহ্বান কেউ কর্ণপাত করছেন না।

দেশের সিংহভাগ আমলা ও রাজনীতিবিদরা সন্তানদেরকে বিদেশে পড়াশোনার জন্য পাঠান। স্কলারশিপ ছাড়া বিদেশে পড়ার এত টাকা একজন সরকারি চাকুরে কীভাবে জোগাড় করেন!

একসময় রেলে ‘কালো বিড়াল’ ছিল বলে তৎকালীন মন্ত্রী সতর্ক করে দিয়েছিলেন। সেই কালো বিড়ালের অস্তিত্ব ডিজিটাল টিকিটসহ গোটা রেল পরিবহন ব্যবস্থাপনায় এখনো বিদ্যমান রয়েছে। এখন বলা হচ্ছে, ‘কালো বিড়াল বনের মধ্যে বসতি গেড়েছে’!

কিন্তু আমার তো মনে হয়, ‘কালো বিড়াল’ দেশের সব জায়গায় ওঁৎ পেতে থেকে গোঁফে তা দিচ্ছে। তাদের গায়ে ঢিল ছোড়ার কেউ নেই। কারণ, এই পৃথিবীতে যে যত বড় অপরাধী, তার নেটওয়ার্ক তত বেশি শক্তিশালী। এর সঙ্গে থাকে সমকালীন রাজনৈতিক যোগাযোগ ও ভাগ-বাটোয়ারা অর্থনীতির যোগসাজশ।

পদবিধারী ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালরা’ চটকদার কথা বলে নানান কায়দায় জাল বিস্তার করে ভয়ভীতি দেখিয়ে অসহায় মানুষের সম্পদ কুক্ষিগত করে নিজেদের ভোগবিলাসের পথ প্রশস্ত করছেন। বিপদ আঁচ করে এসব মাফিয়া স্মার্টরা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আরো বেশি প্রচারে অর্থ খরচ করে ও মেগাদুর্নীতি শুরু করে দিয়েছেন।

দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের সাবেক সচিব বলেন, ‘আইন সবার জন্য সমান। কেউ যদি জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেন, দুদক তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।’… আইনে প্রভাবশালী নিয়ে কিছু বলা নেই। সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীরও দুর্নীতির বিচার হয়েছে। সুতরাং যে কারো দুর্নীতির বিষয়ে দুদক চাইলে অনুসন্ধান করে ব্যবস্থা নিতে পারে।’

এ বিষয়ে বলা হয়েছে, ‘… কারো বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির তথ্য উঠে এলে অবশ্যই সরকারকে গুরুত্বসহকারে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে। দুদকসহ সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও সরকারি দপ্তরের এ বিষয়ে বিশদভাবে অনুসন্ধানে নামা উচিত।

তিনি আরো বলেন, সরকারের যেকোনো পর্যায়েই চাকরি করুন না কেন, বৈধ উপায়ে কোনোভাবেই এত সম্পদ অর্জন করা সম্ভব নয়।...যদি সত্যিই এত সম্পদের মালিক হয়ে থাকেন, সেটি বিস্ময়কর। ...তার দুর্নীতির পুরো চিত্র উন্মোচন করা উচিত। কারণ আইন সবার জন্য সমান।’

অন্য এক পত্রিকায় বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে ...অনেকে ষড়যন্ত্র বা সন্দেহও প্রকাশ করতে পারেন। কিন্তু তাতে কারো দুর্নীতি কিংবা রাজকীয় আবাসস্থল, রিসোর্ট, বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার এসবকে তো আর বায়বীয় বলা যাবে না। একজন সরকারি চাকরিজীবী, যার মাসিক বেতন এক লাখ টাকাও নয়, তিনি কীভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা মূল্যের এত সম্পদের মালিক হলেন! এমন প্রশ্নের জবাব তো দেশের মানুষ চাইতেই পারে’।

সেদিন এক ভিক্ষুক প্রচণ্ড গরমের মধ্যে দড়িতে পা বেঁধে রাজপথে বস্তা গায়ে গড়াগড়ি দিয়ে শুয়ে থালা পেতে ভিক্ষা করছেন… নিকটস্থ এক দোকানি দীর্ঘসময় সেটা পর্যবেক্ষণ করে তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বললে তিনি রাজী হননি। কিন্তু একটি লাঠি হাতে নিয়ে তাড়া করতেই সেই ভিক্ষুক উঠে দৌড়ে পালিয়ে গেল!

এদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতিবাজ ও মেগা-অপরাধীদের অমিল কোথায়! মিল একজায়গায় অবশ্যই আছে। তা হলো ভিক্ষুকেরা ভিক্ষার পয়সা দিয়ে চাঁদা দেয় মাস্তানদের। আর বড় অপরাধীরা বড় অংকের ঘুষ দিয়ে মুখ বন্ধ করে দেশের নীতি-নির্ধারকদের।

আসলে ছোট-বড়, ভদ্র, স্মার্ট, সব দুর্নীতিবাজরাই এক জায়গায় সবাই একাকার হয়ে গেছেন! তা হলো, অবৈধ উপায়ে অর্থ অর্জন।

স্বজনপ্রীতি, ঘুষ, চাঁদাবজি, পরিদর্শন, জালিয়াতি, চুরি, ভেজালকরণ ইত্যাদি যেন সবার মজ্জাগত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলবাজ অপরাধীরা সবসময় দলের কৃপা ও দয়া পেয়ে ছাড় পাবার নিয়ম আমাদের কৃষ্টিতে নতুন করে বিকশিত হচ্ছে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে হেডলাইন সংবাদ বের হলেও তাদের বিরুদ্ধে তদন্তেও দুদকের ধীরগতির কথা সংবাদে প্রচরিত হচ্ছে। ‘হোয়াইট কলার ক্রিমিনালদের’ পক্ষে রাজনৈতিকভাবে একচোখা ও দলকানা নীতিও সাড়ম্বরে চালু হয়ে গেছে। তাই, এখন শুধু অপেক্ষা এসব মেগা-অপরাধমূলক ঘটনার প্রেক্ষিতে কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তা দেখার।

*লেখক- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের সাবেক ডিনE-mail: [email protected]

;

রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে কী করা হচ্ছে



ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন (অবঃ)
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বাংলাদেশ সাতবছর ধরে মিয়ানমার সৃষ্ট রোহিঙ্গা সংকটের বোঝা বহন করে চলছে। বর্তমানে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে আরাকান আর্মি (এ এ) এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনীর মধ্যেকার সংঘর্ষে বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চলের বাসিন্দারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এবং এর পাশাপাশি এ এ’র তীব্র আক্রমণ সহ্য করতে না পেরে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী (বিজিপি) এবং সেনাবাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর এদেশে পালিয়ে আসা একটা নতুন ধারার সৃষ্টি করেছে এবং এর ধারাবাহিকতায় তাদেরকে ফেরত পাঠানোর কার্যক্রম ও অন্যান্য প্রাশাসনিক কাজ বেড়ে গেছে।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ ও সেনাবাহিনীর ২৮৫ জন সদস্যকে মিয়ানমারের জাহাজে নৌপথে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চলছে। প্রায় সাড়ে বার লাখ রোহিঙ্গার বোঝা বহনের পাশাপাশি বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কে এন এফ) সন্ত্রাসীদের কার্যক্রম এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে তাদের সংঘর্ষের ফলে হতাহতের সংখ্যা বাড়ছে। নিরাপত্তার দৃষ্টিকোন থেকে এই ধরনের ঘটনা আদৌ কাম্য নয়। বাংলাদেশের এই অঞ্চল বিভিন্ন কারণে অতীব গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, পার্বত্য চত্তগ্রামে কয়েক দশক ধরে চলমান সংঘাত পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে নিরসন করায় বেশ কয়েক দশক ধরে সেখানে শান্তি বিরাজ করছিল এর ফলে এই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও আর্থসামাজিক উন্নয়ন বেগবান হয়েছিল।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুনরায় এই এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে একত্রে কাজ করতে হবে। বাংলাদেশের পার্বত্য জেলাগুলো এবং কক্সবাজার জেলার সাথে আমাদের প্রতিবেশী দেশ মিয়ানমার ও ভারতের সীমান্ত রয়েছে। কক্সবাজার ও এই অঞ্চল পর্যটনের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা। বাংলাদেশের নিরাপত্তা ও আর্থ সামাজিক উন্নয়নে এই অঞ্চলের বিশেষ ভুমিকা আছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ পূর্বক শান্তি ফিরিয়ে আনা জরুরি।

কক্সবাজারে গত সাত বছর ধরে আশ্রয় নেয়া বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফিরে যাবার কার্যক্রম ও উদ্যোগগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। রোহিঙ্গাদেরকে মিয়ানমারে ফিরে যেতে হলে ও সেখানে রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর সাথে শান্তিপূর্ণ সহবস্থানের জন্য একটা সহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি। বহু বছর ধরে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক প্রচারণার মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে সেই পরিবেশ নষ্ট করা হয়েছিল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত নির্মম সেনাঅভিযানের আগে তাদের বিরুদ্ধে ফেসবুকের মাধ্যমে বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ও ঘৃণা ছড়ানো হয়েছিল এবং এর পেছনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাত ছিল বলে জাতিসংঘের তদন্তে উৎঘাটিত হয়েছে। ফেসবুক রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিচালিত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য বন্ধ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে ২০২১ সালে রোহিঙ্গারা ফেসবুকের বিরুদ্ধে ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মামলা করে। এখন জাতিসংঘের ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইনভেস্টিগেটিভ মেকানিজম ফর মিয়ানমারের (আইআইএমএম) তথ্য থেকে প্রমানিত হয়েছে যে, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গোপনে ঘৃণামূলক বক্তব্য প্রচারণা চালিয়েছিল।

তদন্তকারীদের প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, সেনাবাহিনী 'নিয়মতান্ত্রিক ও সমন্বিতভাবে' সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভয় ও ঘৃণা ছড়ানোর জন্য পরিকল্পিত উপাদান ছড়িয়েছিল। এসব বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিষয়বস্তু প্রায়ই রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে প্রচলিত বৈষম্যমূলক ও অবমাননাকর বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে চালানো হয়। রোহিঙ্গারা সহিংসতা, সন্ত্রাসবাদ বা 'ইসলামীকরণের' মাধ্যমে মিয়ানমারের জন্য অস্তিত্বের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে সেখানে জানানো হয় এবং তারা বার্মিজ জাতিগত বিশুদ্ধতার জন্য হুমকি হয়ে উঠেছে বলেও উল্লেখ করা হয়েছিল। এসব প্রচারণার কারণে রাখাইনের সাধারণ জনগণও রোহিঙ্গা নিধনে অংশ নিয়েছিল। সেনাবাহিনীর বিদ্বেষমূলক বক্তব্য প্রচারণার কারণে সময় হাজার হাজার রোহিঙ্গা পুরুষ, নারী ও শিশুকে মারধর, যৌন নিপীড়ন এবং হত্যা করা হয় ও তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এখনও রাখাইনে রোহিঙ্গাদের তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। রোহিঙ্গাদের প্রতি এই মনোভাব দূর করতে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে বা হয়েছে বলে জানা যায় নাই।

রোহিঙ্গাদের প্রতি মিয়ানমারের আচরণ এখনও অপরিবর্তিত রয়েছে। চলমান পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে রাখাইনে জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক ব্যবহার করে বুথিডং শহর জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা ও রোহিঙ্গা অ্যাক্টিভিস্টদরা জানায় যে, রাখাইন রাজ্যে জাতিগত বিভাজনের বীজ বপন করতে জান্তা রোহিঙ্গা রিক্রুটদেরকে রাখাইনদের বাড়িঘর ও গ্রাম জ্বালিয়ে দিতে বাধ্য করে। ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বাধ্যতামূলক সেনাবাহিনীতে যোগদানের বাধ্যবাধকতার আইন ঘোষণার পর রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের আটক করে সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ করা হচ্ছে ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়াতে রোহিঙ্গাদের ফ্রন্টলাইনে মানবঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে সেনাবাহিনী। রাখাইন রাজ্যে গত বছরের নভেম্বরে এ এ’র অভিযান শুরুর পর থেকে বেশ কিছু শহর এবং অনেক সেনা ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনী মার্চ মাসে বুথিডং, মংডু ও সিতওয়েতে এ এ’র বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা বিক্ষোভের আয়োজন করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক প্রধান ভোলকার টার্ক সতর্ক করে জানিয়েছেন যে, রোহিঙ্গা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের মধ্যে লড়াই ও উত্তেজনা বেসামরিক জনগণের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং এর ফলে অতীতের নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।

গ্রুপ অব সেভেন (জি-সেভেন) দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ১৯ এপ্রিল ইতালির ক্যাপ্রিতে অনুষ্ঠিত জি-সেভেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবাসনের পরিবেশ তৈরির প্রয়োজনীয়তা এবং রোহিঙ্গা ও অন্যান্য জাতিগত সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতার ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ওপর জোর দিয়েছে। তারা মিয়ানমার সামরিক বাহিনীকে সহিংসতা বন্ধ, নির্বিচারে আটক সব বন্দির মুক্তি এবং একটি অর্থবহ ও টেকসই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফিরতে সব অংশীজনের সঙ্গে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সংলাপের আহ্বান জানায়। এটা একটা গঠনমূলক উদ্যোগ কিন্তু এর বাস্তবায়ন কবে হবে এবং রোহিঙ্গাদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধিতে এর ভুমিকা তেমন স্পষ্ট নয়। আসিয়ান নেতৃবৃন্দ থাই সীমান্তের গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্র মায়াওয়াদ্দি অঞ্চলে তীব্র সংঘর্ষের পর সাম্প্রতিক সংঘাত বৃদ্ধিতে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং সংঘাতময় মিয়ানমারে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধের জন্য সব পক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। আসিয়ান মিয়ানমারের চলমান সঙ্কট নিরসনে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত সাড়ে বার লাখ রোহিঙ্গা গত সাত বছর ধরে বাংলাদেশে আশ্রিত এবং তাদের প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া থমকে আছে। মিয়ানমারে চলমান সংঘাত তীব্র আকার ধারণ করায় আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে চায় এবং তারা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সীমান্তে জড়ো হয়েছে। সীমান্ত এলাকা ঘেঁষে আরাকান আর্মির তৎপরতার পাশাপাশি নতুন করে কেএনএফ বেপরোয়া হয়ে ওঠায় সীমান্ত এলাকা অস্থির হয়ে উঠতে পারে। বিশ্লেষকদের মতে, মিয়ানমার সীমান্তের অস্থিরতার সুযোগে কেএনএফ বেপরোয়া আচরণ করছে ও হামলা চালানোর সাহস পাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার পার্বত্যাঞ্চলের আশপাশের সীমান্ত এলাকায় কঠোর নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলার কাজ করছে। অনেকের মতে এ এ’র সাথে কেএনএফের ভালো যোগাযোগ ও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। ভারতের মণিপুরের কুকিদের সঙ্গেও কেএনএফের যোগাযোগ আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেএনএফসহ তিন দেশীয় সন্ত্রাসীদের মধ্যে যোগাযোগ গড়ে ওঠার বিষয়টি একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

সীমান্তে অস্থিরতার সুযোগ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোও নিতে পারে। এর ফলে তাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়বে এবং কক্সবাজার এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি ঘটতে পারে। সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অস্ত্রের লেনদেন এবং পরস্পরকে সহায়তা করার বিষয়টিও ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। কেএনএফ পার্বত্য তিন জেলার প্রায় অর্ধেক এলাকায় তৎপর, তারা ‘কুকিল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। কুকি সম্প্রদায়ের লোকজন ভারতের মণিপুর ও মিজোরাম এবং মিয়ানমারে রয়েছে। ওই দুই দেশেও তাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা আছে। কেএনএফ ভারতের মণিপুর, মিজোরাম এবং মিয়ানমারে সক্রিয়। ওই সব এলাকায় চলমান অস্থিরতার প্রভাবে কেএনএফ ফের তৎপর হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চলমান প্রেক্ষাপটে সীমান্ত এলাকায় আমাদের নজরদারি বাড়াতে হবে।

রাখাইনে জাতিগত বিদ্বেষ সহনীয় অবস্থায় আনার জন্য পদক্ষেপ নেয়া জরুরি এবং গত সাত বছরে ও রোহিঙ্গাদের প্রতি সামরিক জান্তার মনভাব পরিবর্তন না হওয়ার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। রাখাইনের পরিস্থিতি যে রকমই হোক না কেন স্থানীয় জনগণের সাথে রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ সহবস্থান নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং প্রত্যাবাসনের সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য সকল পক্ষকে কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে। রাখাইনের উন্নয়ন কার্যক্রম শুরু ও তা অব্যাহত রাখতে হবে যাতে দারিদ্র পীড়িত জনগণের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয় । অর্থনৈতিক মুক্তি দুই সম্প্রদায়ের মধ্যেকার তিক্ত সম্পর্কের সুন্দর সমাধান হতে পারে। মিয়ানমার ও রাখাইনের রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজ, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সবাইকে পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন একটা সহনশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম পরিস্থিতি ও কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের এই সীমান্ত অঞ্চলে বিভিন্ন সন্ত্রাসী গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে শক্তহাতে এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। স্থায়ীভাবে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করতে হলে সমস্যার গভীরে গিয়ে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে তাই এ বিষয়ে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে।

ব্রিঃ জেঃ হাসান মোঃ শামসুদ্দীন, এন ডি সি, এ এফ ডব্লিউ সি, পি এস সি, এম ফিল (অবঃ)
মিয়ানমার ও রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক

;

আকাশ পথে স্বপ্নযাত্রার সঙ্গী ইউএস বাংলা



মো. কামরুল ইসলাম
আকাশ পথে স্বপ্নযাত্রার সঙ্গী ইউএস বাংলা

আকাশ পথে স্বপ্নযাত্রার সঙ্গী ইউএস বাংলা

  • Font increase
  • Font Decrease

ইউএস- বাংলা। এটা শুধু একটা নাম নয়। এটা একটা স্বপ্নের নাম। বাংলাদেশের একটি অন্যতম বেসরকারী এয়ারলাইন্স এটি। ইউএস-বাংলা আকাশে ডানা মেলে স্বপ্নের বাস্তবায়ন করে। একের পর এক সাফল্য যেন এই স্বপ্নের পরিধি আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। যতই দিন যাচ্ছে সেরাদের সেরা হয়ে উঠছে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্স। আকাশপথে ভ্রমণকারীদের চাহিদার শীর্ষে অবস্থান করছে ইউএস- বাংলা এয়ারলাইন্স। সাধারণ যাত্রীরা ভ্রমণ পরিকল্পনায় ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সকেই বেছে নিচ্ছেন। বিমান যাত্রীরা যেন শুধু ইউএস-বাংলাকেই বেছে নিচ্ছেন না, তারা বেছে নিচ্ছেন ইউএস- বাংলার স্বপ্নকেও। যে স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মানুন।

বাংলাদেশের বেসরকারী বিমানসংস্থা হিসেবে প্রথমবারের মতো ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবীতে ফ্লাইট শুরু করে ইতিহাস স্থাপন করেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। গত শুক্রবার (১৯ এপ্রিল) বাংলাদেশ এভিয়েশন তথা বেসরকারী এয়ারলাইন্সের ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করেছে বেসরকারী এই বিমান সংস্থা। বর্তমানে দুবাই, শারজাহ এর পর মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র সংযুক্ত আরব আমিরাতের তৃতীয় গন্তব্য আবুধাবীতে ফ্লাইট শুরু করেছে ইউএস-বাংলা। দুবাই, শারজাহ ছাড়া বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম গন্তব্য মাস্কাট, দোহা, প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত কুয়ালালামপুর, সিঙ্গাপুর, মালে, পর্যটক বান্ধব অন্যতম গন্তব্য ব্যাংকক ও চীনের অন্যতম বাণিজ্যিক শহর গুয়াংজু, পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের কলকাতা ও চেন্নাইতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। আন্তর্জাতিক রুট ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে বিশেষ করে ঢাকা থেকে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, সৈয়দপুর, যশোর ও রাজশাহী ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স।

এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল নির্মান বাংলাদেশের এভিয়েশনকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডে উন্নিত করার পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে কক্সবাজার বিমানবন্দরের রানওয়ের পরিধি বিস্তার করে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে বিমান অবতরণের সুযোগ করে দিচ্ছে। যশোর, সৈয়দপুর বিমানবন্দরের টার্মিনালকে আন্তর্জাতিক মানদন্ডের রূপ দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। সিলেট এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের টার্মিনাল ও রানওয়ের সম্প্রসারণ দেশের এভিয়েশনের অগ্রযাত্রাই নির্দেশ করছে। এরমধ্য দিয়ে আরো কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে দেশের অন্যতম বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস-বাংলা।

ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সাথে কক্সবাজার ও সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নিত করার চেষ্টায় লিপ্ত বাংলাদেশ সরকার। সৈয়দপুর বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে উন্নিত করলে ভারতের সাতকন্যা খ্যাত রাজ্যগুলো, নেপাল ও ভুটানের সাথে দ্বিপাক্ষিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো বেশী জোরদার হবে।

বর্তমানে আটটি বিমানবন্দর দেশের অভ্যন্তরীণ যাত্রীদের আকাশ পথকে ব্যবহারের সুযোগ করে দিচ্ছে। যা মানচিত্রের অর্ধেক জনগোষ্টিকে সেবা দিয়ে থাকে। বর্তমানে চালু বিমানবন্দরগুলো হচ্ছে- ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর. চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, সিলেটের এমএজি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, যশোর বিমানবন্দর, রাজশাহীর শাহ মখদুম বিমানবন্দর, সৈয়দপুর বিমানবন্দর ও বরিশাল বিমানবন্দর।

যাত্রা শুরুর পর দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থেকে একটি এয়ারলাইন্স যাত্রীদের চলার পথে যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠে। যাত্রীবান্ধব হয়ে উঠতে অন-টাইম পারফর্মেন্স, নিরাপত্তা, ইন-ফ্লাইট সার্ভিস জরুরী হয়ে উঠে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ২০১৪ সালের ১৭ জুলাই যাত্রা শুরুর পর থেকে ৯০ শতাংশের উপর ফ্লাইট অন-টাইম বজায় রেখে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছে। এয়ারক্রাফটের পর্যাপ্ততা একটি এয়ারলাইন্স এর এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় ভূমিকা রাখে। ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স দু’টি ড্যাশ ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট দিয়ে যাত্রা শুরু করে এখন বহরে যুক্ত করেছে ২৪টি এয়ারক্রাফট। যার মধ্যে ২টি এয়ারবাস ৩৩০-৩০০, ৯টি বোয়িং ৭৩৭-৮০০, ১০টি এটিআর ৭২-৬০০ ও ৩টি ড্যাশ৮-কিউ৪০০ এয়ারক্রাফট রয়েছে। খুব শীঘ্রই অভ্যন্তরীণ রুটকে শক্তিশালী করার জন্য আরো একটি এটিআর ৭২-৬০০ এয়ারক্রাফট যুক্ত করতে যাচ্ছে। অন-টাইম পারফর্মেন্স বজায় রেখে অভ্যন্তরীণ সকল রুটে ফ্লাইট পরিচালনার পর আন্তর্জাতিক রুটে যাত্রীদের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠেছে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স। ২০১৬ সালের ১৫ মে ঢাকা থেকে কাঠমুন্ডু রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে দেশের গন্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে যাত্রা শুরু করে। একের পর এক নতুন নতুন আন্তর্জাতিক গন্তব্য শুরু করতে থাকে ইউএস-বাংলা। যাত্রীদের চাহিদাকে পরিপূর্ণতা দিয়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স ফ্লাইট সিডিউল ঘোষণা করছে। নূন্যতম ভাড়ায় ভ্রমণ করার সুযোগ করে দিচ্ছে। পর্যটকদের ভ্রমণকে আরো বেশী আকর্ষণীয় করতে নানা ধরনের ভ্রমণ প্যাকেজ ঘোষণা করছে। ইএমআই সুবিধা দিয়ে প্যাকেজ ঘোষণা পর্যটকদের ভ্রমণ পরিকল্পনাকে সহজতর করে দিচ্ছে। কলকাতা কিংবা চেন্নাইয়ে চিকিৎসার জন্য ভ্রমণ করলে এ্যাপোলো হাসপাতালে ডিসকাউন্ট অফার দিচ্ছে ইউএস-বাংলা। ইউএস-বাংলায় ভ্রমণকে উৎসাহিত করার জন্য ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লাইয়ার প্রোগ্রাম “স্কাইস্টার” চালু রয়েছে শুরু থেকেই। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম গন্তব্য মালদ্বীপের রাজধানী মালের সৌন্দর্য উপভোগের জন্য ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সরাসরি ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করেছে। যার ফলে ভারত মহাসাগরের নীলাভ সৌন্দর্য দর্শনে পর্যটকরা ঢাকা থেকে মালে ভ্রমণ করছে। বিভিন্ন ধরণের প্যাকেজ সুবিধা নিয়ে মালদ্বীপের আকর্ষণীয় দ্বীপগুলোতে ভ্রমণ করছে। মধ্যপ্রাচ্যে পর্যটকদের আকর্ষণীয় গন্তব্য দুবাই, শারজাহ ভ্রমণে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স প্রতিদিন ঢাকা থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করছে। এছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত মাস্কাট ও দোহাতে ফ্লাইট পরিচালনা করছে ইউএস-বাংলা। সিঙ্গাপুর, কুয়ালালামপুর, ব্যাংকক কিংবা গুয়াংজু রুটে বাংলাদেশি যাত্রীদের পছন্দক্রমে ইউএস-বাংলা অগ্রগণ্য। যাত্রী বিবেচনায় প্রবাসী শ্রমিক ও পর্যটকরা আরামদায়ক আসন ব্যবস্থা, ইনফ্লাইট সার্ভিস, সর্বোপরি অন-টাইম পারফর্মেন্স ইউএস-বাংলাকে পছন্দক্রমে এগিয়ে রাখতে সহায়তা করছে। বাংলাদেশে প্রাইভেট এয়ারলাইন্সসমূহের এর দশ বছর অতিক্রমকাল অত্যন্ত জটিল ও ক্যালকুলেটিভ। বিগত দিনে বন্ধ হওয়া বিমানসংস্থা ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ কিংবা জিএমজি এয়ারলাইন্স দশ বছর অতিক্রমকালীন সময়ে চরম বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে বন্ধ হওয়ার মিছিলে যোগ দিয়েছে। ঠিক সেই সময়ে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স তার বিমান বহরে যোগ করে চলেছে আধুনিক ওয়াইড বডি এয়ারবাস ৩৩০ এয়ারক্রাফট। সাথে গন্তব্যের পরিধিও বৃদ্ধি করে চলেছে। প্রতিনিয়ত যাত্রীদের আস্থার প্রতীক হয়ে উঠছে ইউএস-বাংলা। আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে জগৎখ্যাত এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে সেবা দিয়ে প্রতিযোগিতা করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। দেশের মানচিত্রকে সমুন্নত রেখে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স সেবাকে গুরুত্ব দিয়ে ব্যবসার পরিধির বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। পছন্দক্রমে যাত্রীরা ইউএস-বাংলাকে অগ্রগণ্য করেছে। স্বাধীনতা লাভের পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বল্পতম জীবদ্দশায় বেশ কতগুলি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন। তার মধ্যে জাতীয় বিমান সংস্থা গঠন। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বিজয় লাভের পর মাত্র ১৮ দিনের মাথায় ১৯৭২ সালের ৪ জানুয়ারী জাতীয় বিমান সংস্থা গঠন করে এবং ঠিক এক মাস পর ৪ ফেব্রুয়ারী প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট পরিচালনা করে। সর্বাধিক অগ্রাধিকারের মধ্যে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন গঠন করেন ১৯৭৩ সালে। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধুর সাড়ে তিন বছরের জীবদ্দশায় দেয়া দিক নির্দেশনার উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ আজ এগিয়ে চলছে উন্নয়নের সোপানে।

১৭ কোটির অধিক জনসংখ্যার দেশে প্রায় ১৩/১৪ মিলিয়ন নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কাজের সূত্রে কিংবা শিক্ষার বা চিকিৎসার কারনে, ভ্রমণের সূত্রে আকাশপথ ব্যবহার করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ারের প্রায় ৭৫ ভাগ বিদেশি এয়ারলাইন্স এর দখলে সেখানে দেশীয় এয়ারলাইন্স এর কাছে মাত্র ত্রিশভাগ যা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারেনা। আরো বেশ কিছু বিদেশী এয়ারলাইন্স এর আগমনে অপেক্ষায় বাংলাদেশের এভিয়েশন।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স এর প্রসার বাংলাদেশ এভিয়েশন যেন কিছুটা পজিটিভ মেরুকরনের গতিপথ পাওয়ার আশা করছে। ভবিষ্যতে আন্তর্জাতিক রুটের মার্কেট শেয়ার বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকছে বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সের। দেশীয় এয়ারলাইন্সের অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ পর্যটন শিল্পসহ হোটেল ইন্ডাস্ট্রিও ঘুরে দাড়ানোর সুযোগ পাবে।

বাংলাদেশের যাত্রীদের উপর ভিত্তি করে বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলো ব্যবসায়িক পরিকল্পনা সাজায় অথচ বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সগুলো সঠিক গন্তব্যে পৌঁছাতে পারছে না, তা সত্যিই ভাবনার বিষয়। বাংলাদেশিরা পৃথিবীর অনেক জাতি থেকেই অনেক বেশী দেশপ্রেমিক। কিন্তু সেই দেশাত্ববোধকে সম্মানের জায়গায় রেখে দেশীয় এয়ারলাইন্সগুলোকে সেবা প্রদান করতে হবে। তাহলেই বাংলাদেশি যাত্রীরা বিদেশী এয়ারলাইন্সের তুলনায় দেশীয় এয়ারলাইন্সে ভ্রমণের মাত্রা বাড়িয়ে দিবে। ফলে শুধু এয়ারলাইন্সের আয় বাড়বে না, দেশীয় জিডিপিতে অধিক অংশগ্রহণ দেখা যাবে। বেকারত্ব দূরীকরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশি প্রবাসীরা পৃথিবীর যেসকল দেশে বসবাস করছে সবখানেই বাংলাদেশি এয়ারলাইন্সগুলো ফ্লাইট পরিচালনা করবে, একজন এভিয়েশন কর্মী হিসেবে সব সময়ের প্রত্যাশা। জাতীয় বিমান সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারী বিমান সংস্থা বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করবে এই স্বপ্ন প্রতিনিয়ত দেখি একজন বেসরকারী এয়ারলাইন্সের কর্মী হিসেবে। নীতি নির্ধারকগণ সবক্ষেত্রে জাতীয় বিমান সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারী এয়ারলাইন্স এর গুরুত্ব অনুধাবন করে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরী করে ব্যবসায়িক প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার সুযোগ করে দিলে বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলোর এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরী হবে। পরিচালন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে এয়ারলাইন্সগুলোর স্বপ্ন পূরণে সহযোগিতা করলে বাংলাদেশ এভিয়েশন এগিয়ে যাবে। বিদেশী এয়ারলাইন্সগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে সহায়তা করবে। সুবর্ণ সময়ের প্রত্যাশায় স্বপ্ন দেখি আর স্বপ্ন উড়াই বাংলাদেশ এভিয়েশনে।

লেখক: মহাব্যবস্থাপক (জনসংযোগ) ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্স

;

হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ের ক্ষতিতে বিপদের ‘রেডএলার্ট‘



মায়াবতী মৃন্ময়ী, কন্ট্রিবিউটিং করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ের ক্ষতিতে বিপদের ‘রেডএলার্ট‘

হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ের ক্ষতিতে বিপদের ‘রেডএলার্ট‘

  • Font increase
  • Font Decrease

 

কেন বাংলাদেশের মতো একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও নাতিশীতোষ্ণ দেশ আবহাওয়ার চরম আচরণের মুখোমুখি হচ্ছে? এই প্রশ্ন এখন সবাইকে ভাবচ্ছে এবং এই মারাত্মক সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা করছে সবাই।

এজন্য ভাবাচ্ছে যে, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি অন্যায় আচরণের প্রতিফল পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশও। চরম উষ্ণতার দিকে ধাবিত হচ্ছে দেশের আবহাওয়া। বৈশাখের শুরুতেই যে তীব্র গরম অনুভূত হচ্ছে, সামনের মাসগুলোতে তা আরও বৃদ্ধি পেয়ে চরমতম হওয়ার শঙ্কাও রয়েছে। বন-জঙ্গল-বৃক্ষ কেটে সাফ করা, নদী ভরাট করে দখল করা, পাহাড় কর্তন করা, এমনকি, প্রাকৃতিক জলাধার, মাছ ও জীববৈচিত্র্যের অভয়ারণ্য হাওরের পরিবেশ-প্রকৃতিতে বিকৃতি সাধন করার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের কুফল ক্রমেই ঘিরে ধরেছে সবাইকে। আর এসব কারণে বাড়ছে বিপদ আর ভবিষ্যতের দিনগুলোতে অপেক্ষা করছে আরও বড় আকারের বিপর্যয়।

বিগত কয়েক বছর ধরে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতির চরম আঘাত বাংলাদেশেও সরাসরি টের পাওয়া যাচ্ছে নানাভাবে ও নানা দিক থেকে। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নানা বিপদের যে আশঙ্কা করা হয়েছিল, তা আস্তে আস্তে বাস্তব আকার ধারণ করছে। বাংলাদেশও এই বিপদের মুখোমুখি হয়েছে স্থানীয় ক্ষেত্রে অসতর্কতার কারণে। যেমন:

এক) একদা নাতিশীতোষ্ণ বাংলাদেশে চলছে প্রচণ্ড দাবদাহ। তাপে পুড়ছে দেশের কয়েকটি অঞ্চল। গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত মানুষের। বিরূপ পরিস্থিতিতে স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সাত দিনের জন্য। কোথাও কোথাও হিটস্টোকে আক্রান্ত হওয়ার খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

দুই) ঢাকার বায়ু লাগাতার ভাবে অস্বাস্থ্যকর থাকার রেকর্ড করছে। বিশ্বের শীর্ষ দুষিত বায়ুর শহরের তালিকায় নিজের স্থান করে নিয়েছে ঢাকা, যেখানে বসবাস দিনে দিনে বিপদজনক হচ্ছে আর বাড়ছে নানা রোগের প্রকোপ।

তিন) চট্টগ্রামে পাহাড় কাটার জন্য ভূমিধস হচ্ছে বৃষ্টির দিনগুলোতে। যেজন্য ঘটছে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি।

চার) পাহাড়ের প্রাকৃতিক বিন্যাস নষ্ট হচ্ছে। রিসোর্ট, সুইমিং পুল ও অন্যান্য বিতর্কিত উন্নয়নের কারণে সেখানে ক্ষতি হচ্ছে মানুষ, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের।

পাঁচ) মধুপুর, ভাওয়ালসহ দেশের নানা স্থানে ছড়িয়ে থাকা বণাঞ্চলগুলো দখলের জন্য গাছ কাটা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে অবাধে, যা প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট করছে।

ছয়) দেশের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নদ-নদী দখল ও দুষণের শিকার। নদী ক্ষীণ হতে হতে খালে পরিণত হয়েছে বা লুপ্তই হয়ে গেছে। শিল্পায়নের বর্জ্য অনেক নদীকে এবং নদীর জীব ও উদ্ভিদ গোষ্ঠীকে মেরে ফেলছে। জল নিষ্কাষণ ব্যাহত হয়ে বাড়িয়েছে জলাবদ্ধতা।

সাত) পূর্ব-মধ্যাঞ্চলের কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোণা, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়ে যে বিশাল হাওরাঞ্চল, সেখানেও চলছে বিপর্যয়। প্রাকৃতিক এই জলাধারের কিশোরগঞ্জ অংশে রাস্তা, রিসোর্ট ও বিভিন্ন বাণিজ্যিক স্থাপনা নির্মাণের ফলের উজানের বৃহত্তর সিলেটে নজিরবিহীন বন্যা হয়েছে। হাওরের মিঠা পানির মাছের বংশ বিস্তার ও আবাদ হ্রাস পেয়েছে। নানা রকমের জ্বালানি, পলিথিন, ব্যবহার্য বস্তু ও কেমিক্যালের ব্যবহারে পানির মান দুষিত হচ্ছে। প্রাকৃতিক অঞ্চলটিও নদী, পাহাড় ও বনের মতো দখলের কারণে রয়েছে অবলুপ্ত হওয়ার আতঙ্কে।

কিশোরগঞ্জের হাওরে ঘটেছে আরেকটি মারাত্মক পরিবেশ হানিকর ঘটনা। বার্তা২৪.কম-এর স্থানীয় প্রতিনিধি সরেজমিন তথ্যের ভিত্তিতে জানিয়েছেন, প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সেলিব্রিটিরাও ধুমধাম করে হাওরে উদ্বোধন করেছেন সড়ক-আলপনা। কিন্তু এই সাময়িক সৌন্দর্য একসময় প্রকৃতির হুমকি হবে এটি চিন্তার মধ্যে আনেননি কেউ। কদিন পরেই হাওরে আসবে নতুন পানি। আর এই রঙের প্রভাব কতটুকু ক্ষতির কারণ হবে তাই নিয়ে এখন চলছে তুমুল আলোচনা।

খবরে প্রকাশ, বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে সম্প্রতি হাওরের অল-ওয়েদার সড়কের মিঠামইন জিরো পয়েন্ট থেকে অষ্টগ্রাম জিরো পয়েন্ট পর্যন্ত ১৪ কিলোমিটার জুড়ে দৃষ্টিনন্দন আলপনা আঁকা হয়েছে। আলপনার এসব রং বৃষ্টিতে ধুয়ে হাওরের পানিতে মিশলে তা হাওরে মাছের প্রজনন ক্ষতিগ্রস্ত করবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেকোনো রঙে স্বাভাবিকভাবে নানা ধরনের রাসায়নিক উপাদান থাকে। হাওরের সড়কে আঁকা আলপনায় যে পরিমাণ রঙ ব্যবহার হয়েছে, তাতে থাকা রাসায়নিকের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে সেখানকার জলজ উদ্ভিদ, মাছ ও অন্যান্য জলজ প্রাণি।

সাধারণত, প্রাকৃতিক বিশুদ্ধতা বজায় রাখতে জীববৈচিত্র্যময় স্পটগুলোকে রাসায়নিক ও কেমিক্যাল পদার্থ থেকে দূরে রাখতে হয়। সেখানে পলিথিন চলে না। বায়ুদূষণ রোধে যান্ত্রিক যান চলে না। শব্দ দুষণ বন্ধ রাখা হয়। সব ধরনের দুষণ বন্ধ রাখা হয়। হিমালয়ে, কাশ্মীরে, উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের শৈলশহরগুলোতে এমন ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

পক্ষান্তরে, কিশোরগঞ্জের হাওরে চলছে ফ্রি-স্টাইল অবস্থা। নদী আটকে হয়েছে রাস্তা। সেখানে ব্যাঙের ছাতার মতো হয়েছে হোটেল, মোটেল, রিসোর্ট, বাণিজ্যিক স্থাপনা। শত শত ইঞ্জিন চালিত নৌকা থেকে পোড়া তেল-মবিল ভাসছে পানিতে। হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন হাওরের মিঠামইন, অষ্টগ্রাম অংশে ঘুরতে গিয়ে নদীতে ফেলে আসছে অদ্রবীভূত প্যাকেট, বর্জ্য ও আবর্জনা। চরম নৈরাজ্যের কারণে প্রাকৃতিকভাবে সমৃদ্ধ হাওর এখন চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি।

ব্যক্তিগতভাবে কারো কারো ব্যবসা বা লাভ হলেও হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ের ক্ষতিতে সমগ্র জাতি বিপদের ‘রেডএলার্ট‘-এর সম্মুখীন। বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপদ, আবহাওয়ার বৈরী আচরণ, চরম ভাবাপন্ন পরিস্থিতিকে ‘আসমানি গজব‘ বলে নিজেকে সাধু বানানোর সুযোগ নেই। কতিপয় মানুষ ও গোষ্ঠী কর্তৃক হাওর, নদী, বন, পাহাড় তথা প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের চরম ক্ষতি সাধনের প্রতিফল হলো এইসব বিপদ। যাদের কারণে পুরো দেশের আবহাওয়া, পানি, বায়ু, পরিবেশ হচ্ছে বিপর্যস্ত। সমগ্র জাতি বিপদাপন্ন।

বাংলাদেশ সরকার সুনির্দিষ্টভাবে পবিবেশ রক্ষায় অঙ্গীকারবাদ্ধ। পরিবেশ বিপর্যয় রোধে সরকার আগ্রহী ও সচেতন। তারপরেও হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ে সীমাহীন ক্ষতির ঘটনা ঘটছে। এসব অপকর্ম কেউ লুকিয়ে করছে না। সরকার ও প্রশাসনের চোখের সামনে দিয়েই হচ্ছে। এতে দেশ ও জাতি প্রাকৃতিক বিপর্যয় কবলিত হচ্ছে। দেশে সামগ্রিক জলবায়ু ও আবহাওয়া ক্ষুণ্ণ হচ্ছে।

সামনের দিনগুলোতে বিপদ যখন আরও ভয়াবহ আকার নেবে, তখন পরিস্থিতি হবে আরও মারাত্মক। বর্তমান ও ভবিষ্যতের বিপদ রোধে চুপ থাকার অর্থ হলো জেনেশুনে ক্ষতির পথকে প্রসারিত করা। সরকার, সুশীল সমাজ, পরিবেশবাদীগণ এবং আমজনতার তরফে হাওর, নদী, বন ও পাহাড়ে চলমান ক্ষতিকর কাজের বিরুদ্ধে আর চুপ করে থাকার বিন্দুমাত্র সুযোগ নেই। এখনই ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে না দাঁড়ালে ‘বিপদের ‘রেডএলার্ট‘ অচীরেই সবাইকে গ্রাস করবে।

 

;