ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) ৯ জন শিক্ষকের ছবি ও নামে বিতর্কিত ব্যানার করে তাদের অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে মধ্যরাতে ব্যানার টানানো হয়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক পরিষদের সদস্যরা ব্যানার নামিয়ে তা একসাথে করে পুড়িয়ে দেন।
বৃহস্পতিবার (১২ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিভিন্ন একাডেমিক ভবন, প্রশাসন ভবন এবং আবাসিক হলের সামনে থেকে এসব ব্যানার নামিয়ে নেন সমন্বয়কদের একাংশ।
বিজ্ঞাপন
সরেজমিনে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক, প্রশাসন ভবন, পাঁচটি একাডেমিক ভবন এবং ৭টি হলের সামনে ব্যানার টানানো ছিলো। পরবর্তীতে সমন্বয়করা বিষয়টি অবগত হলে সাথে সাথে তা নামিয়ে নেয়। এরপর তারা এসব ব্যানার মেইন গেইটে নিয়ে একত্রিত করে আগুনে জ্বালিয়ে দেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ইবি সহ-সমন্বয়ক তানভীর মন্ডল বলেন, কে বা কারা এই কাজটা করেছে সে সম্পর্কে সমন্বয়ক পরিষদ অবগত না। এটা যে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে করা হয়েছে সেটা বোঝাই যাচ্ছে। স্বার্থান্বেষী মহল যে এই কাজ করেছে তা নিশ্চিত। কয়েকজন শিক্ষক যারা অনলাইনে অফলাইনে আমাদের সাথে যুক্ত ছিল খোঁজখবর নিয়েছে, তাদেরকেও এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এসব ব্যানারের মাধ্যমে শিক্ষকদের অবশ্যই অবমাননা করা হয়েছে।
কোন কোন শিক্ষককে অবমাননা বা লাঞ্ছিত করা হয়েছে বলে মনে করেন - এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমার কাছে যে তথ্য আছে সে মোতাবেক ইংরেজি বিভাগের সাজ্জাদ হোসেন স্যার অনলাইনে আমাদের সাথে যুক্ত ছিলেন। বিভিন্ন সময় ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন শিক্ষার্থীদের খোঁজখবর নিয়েছেন। এছাড়া মিঠুন বৈরাগী স্যারের ব্যাপারেও আপত্তি এসেছে। পাশাপাশি জার্নালিজম বিভাগের তন্ময় স্যারের ব্যাপারে স্যারের শিক্ষার্থীরা ব্যানার থেকে তার নাম কেটে দিচ্ছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেহেতু শিক্ষকদের পক্ষে আছে সেক্ষেত্রে এটা অবশ্যই বিবেচনার বিষয়।
রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) এক নারী শিক্ষার্থীকে ইভটিজিং করাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে ৪ জন শিক্ষার্থী আহত হন।
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে মূল ফটকের সাঈদ চত্বর মসজিদের সামনে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীকে মারধর করেন স্থানীরা কয়েকজন।
জানা যায়, হামলাকারীর কয়েকজন হচ্ছে সামির, মিজান, বাবু ও নয়ন। আহত ওই দুই শিক্ষার্থী হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং মোস্তফা ভূঁইয়া। পরে তাদের দুই জুনিয়র ঘটনাস্থলে গেলে পুনরায় স্থানীয়দের দ্বারা মারধরের শিকার হন একই বিভাগের ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী হাজিম উল হক ও দীপ্ত তালুকদার।
পরবর্তী বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তাবিউর রহমান ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের মিমাংসা করিয়ে দেন। কিন্তু স্থানীয়রা পুনরায় মারমুখী হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবু সাঈদ সংলগ্ন গেটের সামনে কুড়িগ্রাম-ঢাকা মহাসড়ক অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা স্থানীয় দুইজনকে আটক করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের নিকট সোপর্দ করেন।
প্রত্যক্ষদর্শী ও আহত শিক্ষার্থীরা বলেন, মূল ফটকের সামনে এক নারী শিক্ষার্থীকে কুরুচিপূর্ণ শব্দ ব্যবহার করায় তাদের দিকে ফিরে তাকায় সহপাঠী আব্দুল্লাহ। ফিরে তাকানোকে কেন্দ্র করে সেসময় ওই শিক্ষার্থীর দিকে তেড়ে যান ওই স্থানীয়রা। এ সময় বাকবিতণ্ডা হলে পরবর্তীতে সাঈদ চত্ত্বর মসজিদের সামনে গেলে দুই শিক্ষার্থীকে এলোপাতাড়ি মারধর করেন স্থানীয়রা। পরে আবার তাদের জুনিয়ররা ঘটনাস্থলে গেলে স্থানীয়রা লাঠিসোটা, বাঁশ দিয়ে আঘাত করে। এরপর শিক্ষার্থীরা রাস্তা ব্লকেড করে এবং দুইজন স্থানীয়কে আটক করে প্রক্টরকে সোপর্দ করেন।
তবে জানা যায়, আটককৃত ওই দুইজনের সাথে ঘটনার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।
এই বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড.ফেরদৌস রহমান বলেন, হামলাকারীদের বিচারের আওতায় আনতে আইনি প্রক্রিয়া চলছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড.শওকাত আলী বলেন, এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করা হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই ধরণের আর কোনো ঘটনা হতে দেওয়া হবে না।
কোটা সংস্কার আন্দোলন তথা জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) আহত শিক্ষার্থীদের জন্য ১ লাখ টাকা আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি এ্যালামনাই এসোসিয়েশন অব যুক্তরাজ্য (জুয়াক)।
মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) বিকাল সাড়ে ৪ টায় প্রশাসনিক ভবনের কনফারেন্স কক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসানের নিকট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিনিধিগণের উপস্থিতিতে সংগঠনটির সভাপতি শহিদুল ইসলাম এ চেক হস্তান্তর করেন।
চেক গ্রহণকালে উপাচার্য ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ‘জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি এ্যালামনাই এসোসিয়েশন অব যুক্তরাজ্য’কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। তিনি বলেন, এই অনুদান শুধু আর্থিক সহযোগিতা নয়; এটি আহত শিক্ষার্থীদের প্রতি তাদের সহমর্মিতার বহিঃপ্রকাশ।
উপাচার্য বলেন, জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানে দেশব্যাপী হতাহতদের মধ্যে অনেকেই অর্থের অভাবে যথাযথ চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারছেন না। তাদের পাশে দাঁড়ানো জরুরি। আহত ছাত্র-জনতার প্রতি সহযোগিতায় অবিলম্বে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য উপাচার্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান।
সংগঠনের সভাপতি শহিদুল ইসলাম বলেন, তাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। এই বৃত্তির ফান্ড তারা বৃদ্ধি করবেন। এই ফান্ডের বাইরে জুলাই-আগস্টে ছাত্র- জনতার গণ অভ্যুত্থানে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন, তাদের আর্থিক সহযোগিতায় পাশে থাকবে। এই সহযোগিতা তারা অব্যাহত রাখবেন।
উল্লেখ্য, যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থীরা ২০০৮ সালে জুয়াক গঠন করে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কামরুল আহসান সেই সময়ে পিএইচডি গবেষণায় যুক্তরাজ্যে ছিলেন। তিনি এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা আহবায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সব ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ হলেও প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিমুক্ত শেকৃবি ক্যাম্পাস হতে পারবে কিনা সেই প্রশ্নের সমাধান মেলেনি এখনো। মূলত ক্যাম্পাসে সব ধরনের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করার পরে গত ৭ অক্টোবর আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ছাত্রদলের ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে শোক পালন, মিছিল এবং রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়াকে কেন্দ্র করে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে বহুমুখী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
আওয়ামী সরকারের পতনের পরে গত ৫ সেপ্টেম্বর সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির প্রেক্ষিতে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিক্ষক শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা–কর্মচারীদের সব ধরনের দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় প্রশাসন। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরে এক বিজ্ঞপ্তিতে এই সিদ্ধান্ত জানানো হয়। যেখানে উল্লেখ করা হয়, ক্যাম্পাসে শিক্ষা ও গবেষণার সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সব ধরণের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। একই সাথে ক্যাম্পাসে শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও সব ধরণের দলীয় ও লেজুড়বৃত্তিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড (প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) নিষিদ্ধ করা হলো।
রাজনীতি নিষিদ্ধের এই সিদ্ধান্তের একমাস অতিক্রান্ত না হওয়ার মধ্যেই ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য কর্মসূচি সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। এ বিষয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে এক শিক্ষার্থী বলেন, আমরা বাংলাদেশের যেই সময়ের ছাত্ররাজনীতি নিয়ে গর্ববোধ করি সেই সময়ের ছাত্ররা লেজুড়বৃত্তির ছাত্ররাজনীতি করতো না। তখন ক্যামব্রিজ-অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো সংসদভিত্তিক ছাত্ররাজনীতি বিদ্যামান ছিল এবং তারা ছিল ক্লাসের সেরা ছাত্র। কিন্তু বর্তমানে যেভাবে ছাত্র রাজনীতি শুরুর পায়তারা দেখতেছি তা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে পূর্বের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির অনুরূপ বলেই মনে হচ্ছে। রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাস করা যদি অসম্ভবই হয় তাহলে সংসদবিত্তিক রাজনীতি চালু থাকুক কিন্তু লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি কোনোভাবেই কাম্য নয়।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক তাওহিদ আহমেদ আশিক বলেন, ইতিপূর্বে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে-ধরনের রাজনীতি দেখেছি তা শিক্ষার্থী কিংবা ক্যাম্পাসের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনেনি।ক্যাম্পাসের সামগ্রিক গঠনমূলক পরিবর্তনের থেকে বরং শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ ধ্বংসে বেশি ভূমিকা রেখেছে। আমরা আমাদের ক্যাম্পাসকে এই ধরনের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে মুক্ত রাখতে চাই।আমাদের প্রত্যাশা সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবির বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ক্যাম্পাসের সামগ্রিক পরিবেশ ঠিক রাখতে এবং গঠনমূলক পরিবর্তনের স্বার্থে সব ধরনের লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নে বর্তমান প্রশাসন দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আল রাকিব বলেন, একক আধিপত্যের ছাত্র রাজনীতি ক্যাম্পাসে চাই না। ছাত্র রাজনীতি থাকবে মুক্ত। যেখানে ছাত্র সংগঠনগুলোর মাঝে ভালো কাজের, দেশ গঠনের প্রতিযোগিতা থাকবে। বিগত দিনগুলোর মতো লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির পুনরাবৃত্তি না হোক সেটাই কাম্য।
ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের পরে রাজনৈতিক ব্যানারে প্রোগ্রাম করার কারণ জানতে চাইলে শেকৃবির ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, আমাদের প্রোগ্রামটি মূলত রাজনৈতিক প্রোগ্রাম ছিল না। এটি মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফরহাদের স্মরণে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণে আয়োজিত একটি প্রোগ্রাম ছিল। তিনি আরও বলেন, আমরা শেকৃবিতে রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের কোনো লিখিত চিঠি পাইনি। নিষিদ্ধের যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তা মৌখিক ও ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। রাষ্ট্রীয়ভাবে গৃহীত কোনো সিদ্ধান্ত নয়। আমরা মনে করি রাজনীতি বাংলাদেশের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার।
স্বল্পমূল্যে গবাদিপশুর রোগ ব্রুসেলোসিসের ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের দাবি করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) ভেটেরিনারি অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি এন্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম এবং তার গবেষকদল।
ড. মো. আরিফুল ইসলামের গবেষক দলে রয়েছেন একই বিভাগের অধ্যাপক ড. মোছা. মিনারা খাতুন, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পোল্ট্রি বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক মো. জামিনুর রহমান বাকৃবির স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী মো. রাইসুল ইসলাম, স্নাতকের শিক্ষার্থী নাহিদুজ্জামান এবং অর্ণব সাহা।
বাংলাদেশ একাডেমি অফ সাইন্সেস - ইউনাইটেড স্টেটস ডিপার্টমেন্ট অফ এগ্রিকালচার ( বিএএস - ইউএসডিএ) এর অর্থায়নে গবেষণাটি সম্পন্ন হয়েছে। ২০২০-২৩ সাল পর্যন্ত এই গবেষণাটি করা হয়।
ব্রুসেলোসিস রোগ সম্পর্কে অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ব্রুসেলোসিসে আক্রান্ত গরু, ছাগল, ভেড়া যদি গর্ভধারণ করে তখন তাদের গর্ভপাত হতে পারে। গর্ভাবস্থায় থাকাকালীন ৬ মাস পর সাধারণত গর্ভপাতটি হয়ে থাকে। ফলে খামারি একইসাথে বাছুরটি ও হারায় এবং গাভীর দুধের উৎপাদনও কমে যায়। অর্থাৎ খামারে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও ব্রুসেলোসিস অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি রোগ, যা ব্রুসেলা ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে হয়ে থাকে। দেশের প্রায় ৫-৬ শতাংশ গবাদিপশু এ রোগে আক্রান্ত। এতে পশু মারা না গেলেও প্রচুর অর্থনৈতিক ক্ষতি সাধিত হয়।
ব্রুসেলোসিস এর ভ্যাকসিন তৈরির উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল হক বলেন, ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথের (ডব্লিউওএএইচ) নির্দেশনা মোতাবেক ব্রুসেলোসিসে আক্রান্ত প্রাণীকে হত্যা করে তাকে পুঁতে ফেলতে হবে অথবা পুড়িয়ে ফেলতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই নির্দেশনা মানা হলেও বাংলাদেশে তা মানা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। কেননা অন্যান্য দেশে ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও বাংলাদেশে এর ব্যবস্থা থাকলেও প্রয়োগ বললেই চলে। বিদেশি অনেক ভ্যাকসিন থাকতেও এ ভ্যাকসিন টি তৈরির উদ্দেশ্য হলো প্রতিটি অণুজীবের ক্ষেত্রে ভৌগোলিক অবস্থান বিবেচনায় অনেক পার্থক্য দেখা যায়, এর উপর ভিত্তি করে ভ্যাকসিনের কার্যক্ষমতা। তাই বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে স্থানীয় জীবাণু নিয়ে গবেষণা করে ভ্যাকসিন টি তৈরি করা হয়েছে। অর্থাৎ কমমূল্যে খামারিদের ভ্যাকসিন সরবরাহ ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করেই আমাদের এ ভ্যাকসিনের উদ্ভাবন।
গবেষণা পদ্ধতি নিয়ে অধ্যাপক বলেন, ক্লিনিক্যাল ও ফিল্ড ট্রায়ালের মাধ্যমে আমরা ভ্যাকসিন টি তৈরি করেছি। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আমরা ল্যাব প্রাণী সাদা ইঁদুরে ভ্যাকসিন টি প্রয়োগ করে দেখেছি। ইঁদুরগুলোকে দুই দলে ভাগ করা হয়েছে। একটি ভ্যাকসিন গ্রুপ আরেকটি কন্ট্রোল গ্রুপ। ভ্যাকসিন গ্রুপে ইঁদুরগুলোকে ভ্যাকসিন দেয়া ছিল কন্ট্রোলে ছিল না, এরপর আমাদের নিজের শনাক্ত করা ব্রুসেলা জীবাণু দিয়ে এদের নিয়মিত সংক্রমিত করা হয় এবং পরবর্তীতে বুস্টার ডোজ দিয়ে আবার সংক্রমিত করে দেখতে পাওয়া যায় ভ্যাকসিন গ্রুপে রোগের লক্ষণ তৈরি হয় নি কিন্তু কন্ট্রোল গ্রুপে হয়েছে। অর্থাৎ ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। তারপর আমরা ফিল্ড ট্রায়ালের জন্য ময়মনসিংহ, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের প্রায় ৪০০ গাভীর দেহে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করি এবং পরবর্তীতে ওই গাভীগুলোর এন্টিবডি টেস্ট এর মাধ্যমে নির্ণয় করতে পারি ব্রুসেলোসিসের বিরুদ্ধে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিন টি যথেষ্ট কার্যকর। প্রায় ১ বছর ভ্যাকসিনটির ফিল্ড ট্রায়াল চলে।
ভ্যাকসিন সম্পর্কে অধ্যাপক আরিফুল জানান, বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে ব্রুসেলা অ্যাবোরটাস’ (Brucella abortus) এর আধিক্য বেশি দেখা যায়। ব্রুসেলা অ্যাবোরটাস’র বায়োভার-৩ এর বিরুদ্ধে উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটি সবচেয়ে বেশি কার্যকর। তবে অন্যান্য বায়োভারের বিরুদ্ধেও এটি প্রতিরক্ষা দিবে অ্যান্টিজেনিক মিল থাকার কল্যাণে। আমাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনটি মৃত ভ্যাকসিনের অন্তর্গত। প্রতি ছয়মাস অন্তর অন্তর ভ্যাকসিনটির বুস্টার ডোজ দিতে হবে।
জীবিত ভ্যাকসিন না নিয়ে কেন মৃত ভ্যাকসিন নেয়া হলো এবং ভ্যাকসিনটির কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে কিনা জানতে চাইলে অধ্যাপক আরিফুল জানান, ভ্যাকসিন দুইধরণের: জীবিত ভ্যাকসিন, মৃত ভ্যাকসিন। জীবিত ভ্যাকসিনে অনুজীবটি জীবিত ও দুর্বল থাকে কিন্তু মৃত ভ্যাকসিনে অণুজীবটি মৃত থাকে কিন্তু এন্টিবডি বিদ্যমান থাকে। জীবিত ভ্যাকসিনের অসংখ্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেমন: ভ্যাকসিন দেয়ার সময় ইনজেকশনের সুঁচ ঠিকমতো না ফুটলে ওই জীবিত ব্যাকটেরিয়া মানুষ ও অন্য পশুর সংস্পর্শে এসে রোগ সৃষ্টি করতে পারে, গর্ভপাত করতে পারে, জীবিত ভ্যাকসিন সংরক্ষণের জন্য কোল্ড চেইন দরকার পরে এজন্যই আমরা মৃত ভ্যাকসিন নিয়েছি। আমাদের তৈরি ভ্যাকসিনের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় নি।
খরচের বিষয়ে অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, ভ্যাকসিনের ফর্মুলা তৈরি আছে তবে বাণিজ্যিক ভাবে উৎপাদন করা হয়নি। তবে পর্যাপ্ত ফান্ডিং এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হয়তো এর বাণিজ্যিক উৎপাদন সম্ভব। এছাড়াও কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি চায় তাহলে আমরা ভ্যাকসিনটি তৈরি করে তাদের সরবরাহ করতে পারবো। ভ্যাকসিনটির জন্য গবাদিপশু প্রতি খরচ পড়বে মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টাকা। বুস্টার ডোজের জন্যও একই খরচ পড়বে। উৎপাদন খরচ, সস্তা কাঁচামাল ও প্রযুক্তিগত বিষয়ে খরচ কম হওয়ায় এতো অল্প মূল্যে ভ্যাকসিনটি সরবরাহ করা সম্ভব হয়েছে।
উল্লেখ্য, অধ্যাপক ড. মো. আরিফুল হক ও তার গবেষকদল ২০১৬ সালে সর্বপ্রথম দেশে গবাদিপশুর দেহে ব্রুসেলার উপস্থিতি নির্ণয় করেছিলেন।