৭ মার্চের অমর কবিতা ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়



প্রফেসর ড. সৈয়দ সামসুদ্দিন আহমেদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পরতে পরতে মিশে আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসামান্য অবদান। মহান ভাষা আন্দোলন থেকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন-এই দীর্ঘ বন্ধুর পথে তাঁর অপরিসীম সাহস, সীমাহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সঠিক দিক-নির্দেশনা জাতিকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দিয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সাথে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বজ্রকণ্ঠে স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন।

তিনি বলেছিলেন, ‘... এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা। জয় বাংলা।’

মূলত এটাই ছিল স্বাধীনতার ডাক। তবে গ্রেফতার হওয়ার আগে একাত্তরের ২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির পিতা ঘোষণা করেন বাঙালি জাতির বহুকাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দীর্ঘ ন’মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে তাই ৭ মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম।

এই ভাষণকে ধারণ করেই মরণপণ যুদ্ধ করেছে বাংলার দামাল ছেলেরা। যার যেভাবে সুযোগ হয়েছে সেভাবেই দেশমাতৃকার জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেকে।

বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ন'মাস পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে থাকলেও সর্বক্ষণ বাংলার মানুষের সঙ্গে ছিলেন তিনি। তাঁর বজ্রকণ্ঠের বক্তৃতায় রক্ত টগবগিয়ে উঠতো এ দেশের মানুষের। তাইতো শত কষ্টের মাঝেও জীবন দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করেছেন তারা।

আজ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় বঙ্গবন্ধুর দেওয়া সেই ঐতিহাসিক ভাষণ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ঐতিহ্য হিসেবে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি পেয়েছে।

ভাষণটিকে ‘মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রারে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে যেসব তথ্যভিত্তিক ঐতিহ্য রয়েছে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী প্রজন্ম যাতে তা থেকে উপকৃত হতে পারে সে লক্ষ্যেই এ তালিকা প্রণয়ন করে ইউনেস্কো।

এরই পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমবারের মতো ‘ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ’কে জাতীয় দিবস হিসেবে উদযাপন করছে সরকার। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে দিবসটি উদযাপনে অনুষ্ঠানমালা কিছুটা সীমিত করলেও বিভিন্ন আঙ্গিকে তা উদযাপন করা হচ্ছে।

ধারাবাহিক রাজনৈতিক আন্দোলনের পটভূমিতে ৭ই মার্চের প্রেক্ষাপট রচিত হয়। পাকিস্তানের চব্বিশ বছরের ইতিহাস ছিলো শোষণ-বঞ্চনার। দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত কৃত্রিম রাষ্ট্রটি শুরু থেকেই ছিল বাঙালি বৈরী। মূলত এরপর থেকেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি অব্যাহতভাবে তার অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। এভাবে বাঙালি জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

এরমাঝে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ২৩ বছরের মধ্যে পাকিস্তানে কোনো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭১-এর জানুয়ারি। সেই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের ১৬৭টি লাভ করে।

পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ছিল ৩১৩ আসনবিশিষ্ট। পশ্চিম পাকিস্তানে ৮৩ আসন পেয়ে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে। ওই নির্বাচন ছিল বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার প্রতি জনগণের রায়।

নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পর পাকিস্তানের সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, জুলফিকার আলী ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি), কাইয়ুম খানের মুসলিম লীগ প্রভৃতি চক্র গণতান্ত্রিক রীতিনীতির বাইরে গিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু করে।

সব মিলিয়ে তাদের আচরণে স্পষ্ট ছিল যে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। অন্যদিকে নানা কৌশলে কালক্ষেপণ করছিল আর বাঙালির বিরুদ্ধে হামলে পড়ার জন্য সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল।

এদিকে বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক রাজনীতির রীতিনীতিতে অবিচল থাকেন। ১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি তাঁর দলের জনপ্রতিনিধিদের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এক জনসভায় শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।

৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা এবং জনগণের রায়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার শপথ পাঠ করান। এর মাঝেই ১৩ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন।

১৫ ফেব্রুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে ভুট্টো জানান, তিনি ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবেন না। তিনি অধিবেশন ‘বয়কট’ করবেন।

এর কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ৬ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচিত হলে পাকিস্তানের স্থিতিশীল ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা নেই। তা ছাড়া ঢাকায় এলে তাঁর দলের সদস্যরা জিম্মি হয়ে পড়বেন। এসব ছিল তাঁর দায়িত্বজ্ঞানহীন উক্তি ও ষড়যন্ত্রের অংশ।

২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া হঠাৎ তাঁর মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করেন। পিপলস পার্টির মুখপাত্র আবদুল হাফিজ পীরজাদা দাবি করেন, তাঁদের দলের চাপেই প্রেসিডেন্ট তাঁর মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করেছেন। এসব আলামত দেখে বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।

এর মধ্যে ভুট্টো করাচিতে সাংবাদিকদের বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে তা হবে ‘ডিকটেটরশিপ অব দ্য মেজরিটি’ বা সংখ্যাগরিষ্ঠের একনায়কত্ম।

এ জাতীয় উসকানিমূলক বক্তব্যের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু কোনো উচ্চবাচ্য করেননি। তবে ২৮ ফেব্রুয়ারি বলেন, ভুট্টোর বক্তব্য গণতন্ত্রের পরিপন্থী। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলই সরকার গঠন করে।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ভুট্টো সাহেবের ইচ্ছা পাকিস্তানে সংখ্যালঘু দলের একনায়কত্ম প্রতিষ্ঠিত হোক, ডিকটেটরশিপ অব দ্য মাইনরিটি বাংলার মানুষ মেনে নেবে না।

তিনি বলেন, আমরা ৬ দফা কারও ওপরে চাপিয়ে দেব না। একজন সদস্যও যদি যুক্তিযুক্ত কোনো দাবি করেন, তা গ্রহণ করা হবে।

বঙ্গবন্ধু জানান, দেশের সর্বশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি মাওলানা ভাসানী, নূরুল আমিন, আতাউর রহমান খান, মোজাফ্ফর আহমদসহ অন্যান্য দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন।

৩ মার্চ জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে যোগদানের প্রস্তুতি হিসেবে পূর্বাণী হোটেলে ১ মার্চ আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের বৈঠক হয়। ওই সময়ই রেডিওতে ঘোষিত হয়, প্রেসিডেন্ট জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেছেন।

শাসকশ্রেণির স্বৈরতান্ত্রিক আচরণে বাংলাদেশের মানুষ আগেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিল। কিন্তু রেডিও-তে ইয়াহিয়ার এই ভাষণের সঙ্গে সঙ্গে দলমত-নির্বিশেষে জনগণ রাজপথে নেমে পড়ে।

তাদের ‘তোমার আমার ঠিকানা—পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘পিন্ডি না ঢাকা—ঢাকা, ঢাকা’ ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে চারপাশ।

লোকে লোকারণ্য হয়ে পড়ে পুরো ঢাকা শহর। এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু ছয়দিনের কর্মসূচি দেন। তা হচ্ছে- ২ মার্চ ঢাকায় পূর্ণ হরতাল ও ৩ মার্চ সারা দেশে হরতাল।

বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় ভাষণ দেবেন। দূরদর্শী নেতা বঙ্গবন্ধু এও বলেন, ভুট্টোর দল ও কাইয়ুম খানের মুসলিম লীগ ছাড়াও আমরা শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারব।

একই সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া হয়, ৭ মার্চের জনসভায় পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এমন প্রেক্ষাপটে রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন বঙ্গবন্ধু। পৃথিবীর সেরা রাজনৈতিক ভাষণের ইতিহাসে তাঁর এই ভাষণ ব্যতিক্রমী এবং অনন্য। অন্য সব সেরা ভাষণ ছিল লিখিত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভাষণটি অলিখিত।

তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাঁর মনের কথা জনতার উদ্দেশ্যে বলেছেন। প্রায় ১৯ মিনিটের ভাষণ শেখ মুজিব শুরু করেছিলেন জনতাকে ‘আপনি’ সম্বোধন করে।

বলেছিলেন ‘আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন’। তিনি জনতাকে তাঁর সহযাত্রী মনে করেছিলেন। সহযাত্রীর সব দুঃখ-বেদনা সম্পর্কে তিনি ছিলেন ওয়াকিবহাল। প্রকৃত নেতারা এমনই হয়, যেমনটা ছিলেন বঙ্গবন্ধু

তাঁর মনে প্রাণে ছিল শুধু বাংলার মানুষ। তাই তিনি সবার হয়ে তাদের দুঃখ-বেদনার কাব্য তুলে ধরেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে

ভাষণের একপর্যায়ে বাংলার আপামর জনসাধারণের অনুভূতিগুলোকে নিজের অনুভূতির সঙ্গে ঝালিয়ে নিয়ে কখন যে উপস্থিত জনতা ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে পরিণত হয়ে গেছে তা বক্তা-শ্রোতা কেউ-ই খেয়াল করেননি।

বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘... তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইলো, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে।... মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ্ ।’

এই বক্তব্যের মাধ্যমে শেখ মুজিবুর রহমান একটি গেরিলাযুদ্ধের দিক-নির্দেশনা দিয়েছিলেন। ভাষণ শেষে স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগানমুখর হয়ে উঠেছিলো ঢাকার পথঘাট। কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চে-ই দিয়েছেন। এজন্য বেশ সতর্কতা অবলম্বন করেন জনতার নেতা শেখ মুজিব।

ষাটের দশকের শেষ দিকে পৃথিবীর অনেক দেশেই বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন চলছিল। নাইজেরিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতার জন্য বায়াফ্রা সশস্ত্র সংগ্রাম করছিল। রক্তপাত হচ্ছিল কিন্তু আন্তর্জাতিক সমর্থন পাচ্ছিল না বিদ্রোহীরা। আন্দোলন চলছিল ইন্দোনেশিয়াতেও। সেসব আন্দোলনের নেতিবাচক দিক ও দুর্বলতা সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর ধারণা ছিল।

তিনি উপলব্ধি করেন হঠকারিতার পরিণতি শুভ হয় না এবং হঠকারী নেতা কখনো বিশ্ববাসীর সমর্থন পান না। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধুর সংযত আচরণের জন্য আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন তাঁর দিকে এবং প্রতিপক্ষ পাকিস্তান সরকার ধিক্কৃত।

তিনি এতটা সুকৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেন যে এই কৌশলের কারণে ইয়াহিয়া খানের নির্দেশ এবং প্রস্ততি তাকা স্বত্বেও এই জনসভার ওপর হামলা করার সাহস করেনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে একজন কর্মকতা বলেন যে, শেখ মুজিব কৌশলে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে চলে গেল, কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারলাম না (ডয়েচে ভেলে, ৩১ অক্টোবর ২০১৭)।

বঙ্গবন্ধু সাধারণ মানুষের বোধগম্য ভাষা ও শব্দ ব্যবহারে সাবলীল বক্তৃতা করেছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে প্রতিদিন যে মানুষ মারা যাচ্ছিল তাও তুলে ধরেন তিনি। ৬ মার্চ এ ইয়াহিয়া যে, ২৫ মার্চে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের কথাও উঠে আসে তাঁর ভাষণে। তুলে ধরেন পাকিস্তানের ২৩ বছরের রাজনীতির পটভূমি।

বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘... ২৫ তারিখ অ্যাসেমব্লি ডেকেছেন। রক্তের দাগ শুকায় নাই। রক্তে পাড়া দিয়ে, শহীদের উপর পাড়া দিয়ে, অ্যাসেম্বলি খোলা চলবে না। ... আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। দেশের মানুষের অধিকার চাই।...আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায় রাখতে পারবা না।’

তাঁর ঘোরতর প্রতিপক্ষ ও শত্রুকেও সৌজন্য রক্ষা করে সম্বোধন করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেছেন, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, জনাব ভুট্টো সাহেব। রাজনৈতিক সমস্যা সমাধান এবং জাতীয় পরিষদে যোগদানের এমন চারটি শর্ত ঘোষণা করেন যা কারও পক্ষে অযৌক্তিক বলা সম্ভব ছিল না। সে জন্য পৃথিবীর মানুষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন দেয়।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নেতা। জনগণনন্দিত ও গণতান্ত্রিক এই নেতা শেষ পর্যন্ত চেয়েছিলেন, শান্তিপূর্ণ উপায়ে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকার অর্জনের পথ খোলা রাখতে। ৭ই মার্চের পরও তিনি ইয়াহিয়া, ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনায় বসেছেন।

তারা চেয়েছেন অস্ত্রের মাধ্যমে বাঙালিকে দাবিয়ে রাখতে। পাকিস্তানি সৈন্যদের বারণ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছেন, '... তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।'

কিন্তু নিরস্ত্র বাঙালিকে সশস্ত্র পশুশক্তি নিশ্চিহ্ন করতে করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাঙালি আর মেনে নেয়নি, তারা রুখে দেয়।

শোষিত ও নির্যাতিত বাঙালি জাতিতে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। একাত্তরের মার্চ মাসের ৭ তারিখে তাঁর ভাষণেই যেন মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের নতুন এক দিগন্তের সূচনা করে।

আমরা স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছি, উদযাপন করেছি জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী। এবছর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণেরও পঞ্চাশ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।

এমতাবস্থায় এই ভাষণটি আজও আমাদের জাতীয় জীবনের অনুপ্রেরণা। বঙ্গবন্ধু নেই, কিন্তু তার দিকনির্দেশনা আজও রয়ে গেছে। সেই নির্দেশনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামনের দিয়ে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, জয় বাংলা।

লেখক-উপাচার্য, বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়; জামালপুর। ই-মেইল: [email protected], [email protected]

   

বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের প্রেরণা



তোফায়েল আহমেদ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি দুনিয়ার নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের শ্রেষ্ঠ বন্ধু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা এই আগস্ট মাসে হারিয়েছি। শোকাবহ আগস্টের সেই কালরাতে ঘাতকের নির্মম বুলেটে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিবসহ জাতির পিতার পরিবারের অন্য সদস্যরা-তাদের সবাইকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি। বঙ্গবন্ধুর কাছেই শুনেছি, তিনি বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর উপলব্ধি করেছি, এই পাকিস্তান বাঙালিদের জন্য হয় নাই। একদিন বাংলার ভাগ্যনিয়ন্তা বাঙালিদেরই হতে হবে।’ সেই লক্ষ্য সামনে রেখে জেল-জুলুম, অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করেছেন; কোনোদিন মাথা নত করেননি তিনি। বঙ্গবন্ধুর রাজনীতির মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীন বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করা। আজ তিনি টুঙ্গিপাড়ার কবরে শায়িত। আর কোনোদিন ফিরে আসবেন না, দরদি কণ্ঠে বক্তব্য রাখবেন না। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি আমাকে আন্দোলিত করে। বঙ্গবন্ধুর চেতনা আমাদের চলার পথের প্রেরণা। ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আমরা যখন বঙ্গবন্ধুকে কারামুক্ত করে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সংবর্ধনা দিয়ে কৃতজ্ঞ জাতির পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞচিত্তে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলাম, সেই থেকে শেষদিন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিলাম।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন দূরদর্শী নেতা। ’৭০-এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল সামরিক সরকার প্রণীত লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার তথা এলএফও’র অধীনে। অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে এলএফও’র অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে নিষেধ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছি এটা প্রমাণ করতে যে, কে বাংলার মানুষের নেতা।’ ’৭১-এর ৩ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের সামনে নবনির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ করান স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। সেদিনের শপথ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘৬ দফা আজ আমার না, আমার দলেরও না, এই নির্বাচনের মাধ্যমে ৬ দফা আজ জাতীয় সম্পত্তিতে রূপান্তরিত হয়েছে। যদি কেউ ৬ দফার সঙ্গে বেইমানি করে তবে বাংলার মানুষ তাকে জ্যান্ত কবর দেবে। এমনকি আমি যদি করি আমাকেও।’ এভাবেই বঙ্গবন্ধু ৬ দফাকে আপসহীন পর্যায়ে উন্নীত করেন। ’৭১-এ অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে বঙ্গভবনে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা হলে বলেছিলেন, ‘মিস্টার ভুট্টো, পাকিস্তান আর্মি ষড়যন্ত্র করছে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে। তুমি পাকিস্তান আর্মিকে বিশ্বাস কোরো না। ওরা প্রথমে আমাকে হত্যা করবে, পরে তোমাকে।’ ভাগ্যের নির্মম পরিহাস বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা হত্যা করতে পারেনি। কিন্তু বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কতিপয় বিপথগামী কর্মকর্তা আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যদ্বাণী সত্যে পরিণত হয়। এরপর ঠিকই পাকিস্তান আর্মির জেনারেল জিয়াউল হক ভুট্টোকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করেন। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেন, ‘এরপর কী হবে?’ বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেন, ‘এরপর ইয়াহিয়া খান আসবে। ইয়াহিয়া খানকে অনুসরণ করে একটা টিম আসবে। সেই টিম নিয়ে একদিন আমার সঙ্গে আলোচনা শুরু করে হঠাৎ বাঙালিদের ওপর আক্রমণ চালাবে। আর সেদিনই পাকিস্তানের সমাধি রচিত হবে।’ রাজনৈতিক পরিস্থিতির কী নিখুঁত বিশ্লেষণ! পরবর্তীকালে এসব ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব রূপ আমরা দেখেছি।

জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি ধাপেই বঙ্গবন্ধু বাঙালির মুক্তির জয়গান গেয়েছেন। দুবার মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব, আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা।’ বাংলা ও বাঙালির জন্য তার হৃদয়ের ভালোবাসা ছিল অপরিসীম। সমুদ্র বা মহাসমুদ্রের গভীরতা পরিমাপ করা সম্ভব; কিন্তু বাংলা ও বাঙালির জন্য বঙ্গবন্ধুর হৃদয়ের দরদ ও ভালোবাসার গভীরতা অপরিমেয়। দলীয় কর্মীদের দেখতেন পরিবারের সদস্যের মতো। সব সময় বলতেন, ‘নির্দিষ্ট আদর্শ ও সেই আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের ঐক্যেই আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। আওয়ামী লীগ নেতার দল নয়-এ প্রতিষ্ঠান কর্মীদের প্রতিষ্ঠান।’ এমনকি বিরোধী নেতাকর্মীদের প্রতিও তার গভীর সহমর্মিতা ছিল।

মহান মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে ১৮ ডিসেম্বর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসি। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন এবং ১৪ জানুয়ারি আমাকে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তার রাজনৈতিক সচিব করেন। বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর ছিল ’৭২-এর ৬ ফেব্রুয়ারি, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। সফরসঙ্গী হিসাবে দেখেছি কলকাতায় স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসভা। ২০ লক্ষাধিক মানুষের উদ্দেশে বক্তৃতার শেষে কৃতজ্ঞচিত্তে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘রিক্ত আমি নিঃস্ব আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই।’ এরপর রাজভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠকে আমার উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। বৈঠক শেষে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমার জন্মদিনে আপনাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু পুনরায় বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনার সফরের আগেই আমি চাই ভারতের সেনাবাহিনী আপনি ফিরিয়ে আনুন।’ ইন্দিরা গান্ধী বলেছিলেন, ‘আপনি যা চাইবেন আমি তাই করব।’ ’৭২-এর ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে আসেন এবং প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ১২ মার্চ বিদায়ি কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতের সেনাবাহিনী ফিরিয়ে নেন। একই বছরের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের আরেক মিত্রদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন সফরে গিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সোভিয়েত ইউনিয়ন আমাদের সার্বিক সমর্থন জুগিয়েছে। সেদিন সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সেই কোসিগিন বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন এবং ক্রেমলিনে শীর্ষ নেতৃবৃন্দ-কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল লিওনিদ ইলিচ ব্রেজনেভ, সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। এটি ছিল বিরল ঘটনা। ’৭৩-এর ৩ আগস্ট কানাডার রাজধানী অটোয়াতে ৩২টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছিল কমনওয়েলথ সম্মেলন। সব নেতার মাঝে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। ’৭৩-এর ৯ সেপ্টেম্বর আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোটনিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুসহ ৬ জন নেতার নামে তোরণ নির্মিত হয়েছিল। আলজেরিয়ার মঞ্চে দাঁড়িয়েই বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘বিশ্ব আজ দু’ভাগে বিভক্ত। শোষক আর শোষিত, আমি শোষিতের পক্ষে।’ ’৭৪-এর ২২ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরদিন তিনি ইসলামিক সম্মেলনে যান। সেদিন লাহোরে দেখেছি মানুষ রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে স্লোগান তুলেছে ‘জিয়ে মুজিব জিয়ে মুজিব’, অর্থাৎ মুজিব জিন্দাবাদ মুজিব জিন্দাবাদ। লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন বঙ্গবন্ধু। যতক্ষণ তিনি লাহোরে না পৌঁছেছেন, ততক্ষণ সম্মেলন শুরুই হয়নি। বঙ্গবন্ধুর জন্য সম্মেলন একদিন স্থগিত ছিল। ’৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্বর, জাতির পিতা জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মহত্ত্বের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু আত্মমর্যাদাবান নেতা, তার প্রতি বিশ্ব নেতাদের গভীর শ্রদ্ধা। আন্তর্জাতিক রাজনীতির হিমালয়সম উচ্চতায় আসীন ছিলেন তিনি। যেখানে গিয়েছেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছেন। স্বাধীনতার পর অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বিচক্ষণ ও দক্ষ কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বঙ্গবন্ধুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ অব নেশনস, ওআইসি, ন্যামসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সদস্যপদ লাভ করে।

বঙ্গবন্ধুর সমগ্র চিন্তাজুড়েই ছিল দেশ ও দেশের মানুষ। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য তিনি অর্থনৈতিক মুক্তির কাজ শুরু করেন। স্বাধীনতার পর দেশ ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত। গোলাঘরে চাল, ব্যাংকে টাকা ও বৈদেশিক মুদ্রা ছিল না। রাস্তা-ঘাট ধ্বংস করে দিয়েছিল হানাদার বাহিনী। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। রেললাইন উপড়ে ফেলা হয়েছে। প্লেন, রেল ছিল না। পুরো যোগাযোগ ব্যবস্থা তছনছ। মাত্র ৩ বছর ৭ মাস উদয়াস্ত পরিশ্রম করে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশটাকে আমরা স্বাভাবিক করি। ভৈরব ব্রিজ, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ যেদিন উদ্বোধন করা হয় সেদিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলাম। রাষ্ট্রের যত প্রতিষ্ঠান তার সবকটির ভিত্তি স্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু। এতসব কিছুর পর যখন দেশটাকে স্বাভাবিক করে দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন, ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। অথচ তখন গোলাঘরে চাল, ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রা এবং দেশে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছিল।

সুদৃঢ় নীতি, আদর্শ ও সংকল্পবোধ নিয়ে তিনি যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গঠনে অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু জাতীয়-আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে খুনিচক্র তাকে দেশের অভ্যন্তরে সপরিবারে হত্যা করে। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করেই খুনিচক্র ক্ষান্ত হয়নি। একই বছরের ৩ নভেম্বর আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করার জন্য কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে-বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে যারা বারবার নেতৃত্ব দিয়েছেন-জাতীয় চার নেতাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় রাজনীতিতে নেতৃত্ব শূন্যতা তৈরি করা। কিন্তু ঘাতকচক্রের ষড়যন্ত্র আমরা সফল হতে দেইনি। আওয়ামী লীগের রক্তে ভেজা পতাকা দলীয় ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার হাতে তুলে দিয়ে সেদিন আমরা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলাম। আজ তা প্রমাণিত। জাতির পিতা অর্থনৈতিক উন্নয়নের যে ভিত্তিভূমি তৈরি করে দিয়ে গেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ধারণ করে, শোককে শক্তিতে পরিণত করেছেন। নিষ্ঠা, সততা ও সাহসের সঙ্গে সব প্রতিকূলতা অতিক্রম করে তিনি বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন এবং দেশকে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করতে জাতিকে সাফল্যের সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।

তোফায়েল আহমেদ : আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ-সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি

[email protected]

;

১৫ আগস্ট: আজ শোকের দিন



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৮তম শাহাদত বার্ষিকী আজ।

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি জাতি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে দিবসটি পালন করবে। দিবসটি উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সর্বশেষ খবর দ্য ডেইলি স্টার বাংলার গুগল নিউজ চ্যানেলে।
আওয়ামী লীগের কর্মসূচির মধ্যে আছে-সূর্য উদয় ক্ষণে বঙ্গবন্ধু ভবন এবং কেন্দ্রীয় কার্যালয়সহ সারাদেশে সংগঠনের সকল স্তরের কার্যালয়ে জাতীয় ও দলীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ ও কালো পতাকা উত্তোলন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক স্মৃতি-বিজড়িত ধানমন্ডির বঙ্গবন্ধু ভবন প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ।

বনানী কবরস্থানে ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন, মাজার জিয়ারত, ফাতেহা পাঠ, মোনাজাত ও মিলাদ মাহফিল এবং টুঙ্গীপাড়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে শ্রদ্ধার্ঘ নিবেদন, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং আলোচনা সভা।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে সেনাবাহিনীর কিছু বিপথগামী সদস্য ধানমন্ডির বাসভবনে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ হারিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিণী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।


পৃথিবীর এই জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর অনুজ শেখ নাসের, ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার ছেলে আরিফ ও সুকান্তবাবু, মেয়ে বেবি, বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শেখ ফজলুল হক মণি, তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি এবং আবদুল নাঈম খান রিন্টু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও ঘনিষ্ঠজন।

এ সময় বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।

মূলত, ৭৫ এর ১৫ আগস্ট থেকেই বাংলাদেশে এক বিপরীত ধারার যাত্রা শুরু হয়। বেসামরিক সরকারকে উৎখাত করে সামরিক শাসনের অনাচারী ইতিহাস রচিত হতে থাকে।

সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানির নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনো জঘন্য কাজ করতে পারে।

ভারতীয় বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক নীরদ সি চৌধুরী বাঙালিদের 'বিশ্বাসঘাতক' হিসেবে বর্ণনা করে বলেন, বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা শেখ মুজিবকে হত্যার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি বিশ্বের মানুষের কাছে নিজেদের আত্মঘাতী চরিত্রই তুলে ধরেছে।

দ্য টাইমস অব লন্ডন এর ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট সংখ্যায় উল্লেখ করা হয় 'সবকিছু সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুকে সবসময় স্মরণ করা হবে। কারণ, তাকে ছাড়া বাংলাদেশের বাস্তব কোনো অস্তিত্ব নেই।

একই দিন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় বলা হয়েছে, 'বাংলাদেশের লাখ লাখ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।'

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর স্বঘোষিত প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ বিচারের হাত থেকে খুনিদের রক্ষা করতে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স জারি করে।

পরবর্তীতে জিয়াউর রহমান ১৯৭৯ সালে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সকে আইন হিসেবে অনুমোদন করে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সুদীর্ঘ একুশ বছর পর ক্ষমতায় এলে ১৯৯৬ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার তিন প্রধান আসামী বরখাস্ত লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান ও সাবেক প্রতিমন্ত্রী তাহের উদ্দিন ঠাকুরকে গ্রেপ্তার করা হয়।

একই বছরের ২ অক্টোবর বঙ্গবন্ধুর একান্ত সহকারী (পিএ) এ এফ এম মোহিতুল ইসলাম পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় থানায় একটি এফআইআর করেন।

১৯৯৬ সালের ১৪ নভেম্বর খুনিদের বিচারের হাতে ন্যস্ত করতে পার্লামেন্টে ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি সিআইডি এই মামলায় ২০ জনকে অভিযুক্ত করে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে চার্জশিট দাখিল করে এবং একই বছরের ১২ মার্চ ৬ আসামির উপস্থিতিতে আদালতে বিচার শুরু হয়।

১৯৯৭ সালের ১৯ জুন পর্যন্ত বিচারক বিব্রত হওয়াসহ স্বাধীনতা-বিরোধী চক্রের নানা বাধার কারণে ৮বার বিচার কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়।

এভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়া শেষে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার রায়ে বিচারক কাজী গোলাম রসুল ১৫ জন সাবেক সেনা কর্মকর্তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন।

অন্যদিকে, ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৪ দিনের শুনানি শেষে বিভক্ত রায় দেন। বিচারক এম রুহুল আমিন অভিযুক্ত ১৫ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বজায় রাখেন।

কিন্তু অপর বিচারক এ বি এম খায়রুল হক অভিযুক্ত ১৫ জনকেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেন।

পরবর্তীতে ২০০১ সালের অক্টোবরের সংসদ নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ বন্ধ থাকে।

দীর্ঘ ৬ বছর পর ২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের মুখ্য আইনজীবী বর্তমান সরকারের আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সুপ্রিম কোর্টে সংক্ষিপ্ত বিবৃতি দেন এবং ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের ৩ সদস্যের একটি বেঞ্চ ২৭ দিনের শুনানি শেষে ৫ আসামিকে নিয়মিত আপিল করার অনুমতিদানের লিভ টু আপিল মঞ্জুর করেন।

২০০৯ সালের ১২ নভেম্বর ২৯ দিনের শুনানির পর চূড়ান্ত আপিল শুনানি শেষ হয় এবং আদালত ১৯ নভেম্বর রায়ের তারিখ নির্ধারণ করেন। ওইদিন (১৯ নভেম্বর) বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ৫ সদস্যের বেঞ্চে হাইকোর্টের দেয়া রায় বহাল রেখে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৫ আসামির দায়ের করা আপিল আবেদন খারিজ করা হয়।

২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি আপিলের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে ২৮ জানুয়ারি ৫ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর করে জাতিকে দায়মুক্ত করা হয়।

২০২০ সালের ১২ এপ্রিল ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরও একজন খুনি আবদুল মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

বঙ্গবন্ধুকে সপরিবার হত্যার ৪৫ বছর, নৃশংস ওই হত্যাকাণ্ডের মামলার ২৫ বছর এবং উচ্চ আদালতের রায়ে ৫ আসামির ফাঁসি কার্যকরের প্রায় ১০ বছর পর গ্রেপ্তার হয় খুনি মাজেদ।

;

পনের আগস্ট ও হত্যার রাজনীতি



ড. মাহফুজ পারভেজ
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

যখন নতুন রাষ্ট্র রূপে স্বাধীন বাংলাদেশ কেবল তার যাত্রা শুরু করেছে, তখন তার সামনে ছিল পাহাড়প্রমাণ সমস্যা। যার সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক সংঘাত ও অস্থিতিশীলতা। এমতাবস্থা সপরিবারে বঙ্গবন্ধু এক গভীর ষড়যন্ত্রেও অংশ। পরবর্তীতে জাতীয় চারনেতার হত্যাকা- হত্যার রাজনীতির নতুন ক্ষত সৃষ্টি করে এবং এসব নৃশংস হত্যাকা- সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে দেয়।

পিছনে ফিরে তাকালে দেখা যায়, ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হওয়ার পর ব্রিটেন ও ভারত হয়ে স্বপ্নের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। দীর্ঘ আন্দোলনের সফলতায় যে স্বপ্নের বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে, তা পুনর্গঠনের প্রত্যয়ে তিনি তখন দীপ্ত। যুদ্ধের ফলে বিধ্বস্ত সোনার বাংলা গড়ার প্রতীতে তিনি শুরু করেন জীবনের আরেক অধ্যায়।

অনেকে ভেবেছিলেন বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার ভার নেবেন না। কারণ, তিনি তখন আর দলীয় নেতা নন, সমগ্র বাংলাদেশের আপামর মানুষের অবিসংবাদিত নেতা। কিন্তু বাঙালির স্বার্থে ও বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নেওয়ার জন্য তিনি সরকারপ্রধান হন। ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর সরকার ঘোষণা করে ‘বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) অধ্যাদেশ ১৯৭২’। ১৯৭৩ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এই অধ্যাদেশ বলে অভিযুক্ত করা হয়েছিল ৩৭ হাজার ৪৭১ জনকে। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল ২ হাজার ৮৪৮ জনের। দ-প্রাপ্ত হয় মাত্র ৭৫২ জন দালাল তথা পাকিস্তানি দোসর। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।

একই সময়ে বঙ্গবন্ধু মনোযোগ দেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের অর্থনীতি ও গণতান্ত্রিক শাসনকাঠামো বিনির্মাণের কাজে। শিল্পকারখানা জাতীয়করণ করে তিনি শিল্প-উৎপাদনের ৮৫ ভাগ সরকারি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। এদিকে, ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের উত্তর ও পূর্বাঞ্চলে আশানুরূপ বৃষ্টিপাত না হওয়ায় খরা ও মন্দা দেখা দেয়, যা ছিল যুদ্ধে প্রায়-ধ্বংস দেশের জন্য মারাত্মক বিপর্যয় স্বরূপ। খরাজনিত দুর্ভিক্ষের কারণে সৃষ্টি হয় নানামুখী সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা, যা মোকাবেলা করার কঠিন চ্যালেঞ্জ সরকারকে নিতে হয়। প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা ও রাষ্ট্রীয় অর্থের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সরকার দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সর্বাত্মক চেষ্টা চালায়। যদিও তখন যুদ্ধ-পরবর্তী পরিস্থিতির জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার অভাবে কিছু অসন্তোষ ধূমায়িত হয়, যার নেতৃত্ব দেয় অতি-ডান ও অতি-বাম উগ্রবাদী দলগুলো।

সিভিল ও মিলিটারি প্রশাসনে একই সময়ে পুঞ্জিভূত হতে থাকে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও ¯œায়ুগত লড়াই, যার একদিকে ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ আর বিপক্ষে পাকিস্তান প্রত্যাগতরা। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে তৎকালে কর্মরত বাঙালি সৈনিকের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ৫০ হাজার। যাদের মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার আটক ছিল পাকিস্তানে। বাংলাদেশে যে ১৪-১৫ হাজার সৈন্য ছিল, তাদের অনেকেই যুদ্ধে আহত-নিহত হন আর বাদবাকী অধিকাংশই ছিল যুদ্ধাহত, পঙ্গু ও রণক্লান্ত। তাদের পক্ষে এসব ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর প্রাধান্য ঠেকানো ও অপতৎপরতা সামাল দেওয়া সম্ভব হয় নি। ফলে প্রশাসনের সর্বস্তরে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের দাপট বাড়তে থাকে, যারা সরকারকে নানাভাবে বিব্রত ও স্যাবোটাজ করতে থাকে।

এমতাবস্থায় ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ নতুন দেশের নতুন সরকারের অধীনে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ধারা দৃঢ় ও অব্যাহত রাখার জন্য নির্বাচন ছিল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাসের বহিঃপ্রকাশ। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে নির্বাচন শতভাগ বিতর্কহীন হতে পারে নি। বিরোধী দলগুলোও হটকারিতা ও নানা সমালোচনায় মুখর হয় নির্বাচন প্রসঙ্গে। যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ যে বিপুল বিজয় পাবে, তা ছিল খুবই স্বাভাবিক। অন্যদিকে, বিরোধীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নির্বাচন না করায় আশানুরূপ ফল লাভে ব্যর্থ হয়। নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো তখন চরমভাবে সমালোচনা ও আন্দোলনমুখর হয় এবং অতিউগ্র কিছু দল নাশকতামূলক কার্যক্রম শুরু করে। ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী’ নামে একটি নতুন সশস্ত্র সংস্থা গঠন করে, যার কার্যকলাপ নিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিসরে বির্তক সৃষ্টি হয়। তদুপরি, অপরাপর বাহিনীগুলোর সঙ্গে এই নতুন বাহিনীর দূরত্ব ও মতপার্থক্যও দেখা দেয়।

এতকিছুর পরেও দেশকে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতায় পরিচালনার জন্য সরকার সচেষ্ট হয়। সংবিধান প্রণয়ন ও নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে যুদ্ধের ক্ষত নিয়েই সংসদীয় ব্যবস্থার গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা অব্যাহত রাখে। এমন কৃতিত্ব যুদ্ধ-পরবর্তী দেশগুলোর জন্য দৃষ্টান্ত স্বরূপ। যদিও দেশে তখন বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান ভঙ্গুর, প্রশাসন, সিভিল সোসাইটি ও রাজনীতিতে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং আইন-শৃঙ্খলা নাজুক। নানা রকমের অন্তর্দ্বন্দ্ব পেরিয়ে সরকার শাসনের ধারা অব্যাহত রাখতে সচেষ্ট হয়। যদিও সরকার দলের ছাত্র সংগঠনের ভাঙনের ফলে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর গঠিত হয় নতুন দল জাসদ, যারা তীব্রভাবে বিরোধিতার রাজনীতি শুরু করে। সরকার এসব সামাল দিয়েও দেশের জন্য নানা রকমের নীতি ও কর্মসূচি নিয়ে চলতে থাকে। যার মধ্যে শিক্ষা ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ড. কুদরাত-ই-খুদার শিক্ষা কমিশন অন্যতম। সরকার ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি করে, বিরোধীরা যার তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়। সরকার-বিরোধী আন্দোলন ক্রমশ বেগবান হয়ে দুনীতি, স্বজনপ্রীতি সম্পর্কে সরব হয় এবং দেশব্যাপী আন্দোলনের সূচনা ঘটায়। ফলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষিত হয়। এর ফলে মৌলিক অধিকারসমূহ স্থগিত হয়। এর ২৭ দিন পর ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়। ৭ জুন দেশে একক জাতীয় দল হিসাবে ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ বা ‘বাকশাল’ গঠন করা হয়, যাতে রাজনীতিবিদ, শিক্ষক, সৈনিক, আমলা ইত্যাদি বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের নেওয়া হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’।

গবেষকরা মনে করেন, প্রতিকূল অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামাল দিতে বঙ্গবন্ধু ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর সূচনা করেছিলেন। এতে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। দ্রব্যমূল্য ও অর্থনীতিতে কিছুটা স্থিতিশীলতা দেখা দেয়। এদিকে ১ সেপ্টেম্বর ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ তথা ‘বাকশাল ব্যবস্থায়’ নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই ১৫ আগস্ট সপরিবারে নিহত হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধু হত্যার এই নির্মম ঘটনার চার মাস পর ৩ নভেম্বর নিরস্ত্র অবস্থায় জেলে নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের প্রধান চার জাতীয় নেতা: সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। স্বাধীনতার সংগ্রামের সঙ্গে তাঁদের প্রত্যেকের নাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিল। দীর্ঘ ২৫ বছর বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগ্রত করার সাধনায় নিয়োজিত থাকার পর তাঁরা স্বাধীনতার নয় মাস জাতির মুক্তির লক্ষ্যে জীবনকে উৎসর্গ করেছিলেন। পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে নেতৃত্ব প্রদানকারীদের হত্যার মাধ্যমে এটা “বোঝা গেল যে, হত্যাকারীদের ক্রোধ কেবল বঙ্গবন্ধু-পরিবারের মধ্যে সীমিত ছিল না। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক আদর্শ ও সে আদর্শের সঙ্গে যুক্ত মানুষগুলোও ছিল তাদের আক্রোশের লক্ষ্য” বলে মনে করেন বদরুল আলম খান তার সংঘাতময় বাংলাদেশ: অতীত থেকে বর্তমান, (ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১৫, পৃ. ২১৯) গ্রন্থে।

ড. মাহফুজ পারভেজ, প্রফেসর, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম; নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।

;

বঙ্গবন্ধুকে ‘মহান মানবতাবাদী’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন বিশ্বনেতাগণ



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

সরকার প্রধানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপোষহীন ও মানবতাবাদী নেতৃত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মহান স্বপ্নদ্রষ্টা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মতি যাদুঘর পরিদর্শনকালে বিশ্বনেতারা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

তারা ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে রক্ষিত পরিদর্শক মন্তব্য বইয়ে এই মূল্যায়ন তুলে ধরেন।

"বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল এবং সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের মত ঘটনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে খুবই বিরল। মহান একজন মানবতাবাদী হিসেবে তিনি সকল মানুষের জন্য সমতা, সুযোগ ও মর্যাদার মহান প্রবক্তা।"

নগরীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন শেষে মন্তব্য লেখার জন্য রক্ষিত বইয়ে এ মন্তব্য করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

এতে তিনি আরো বলেন, "বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। ভারতের জনগণের পক্ষে আমি একজন মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্কের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।"

মোদি ২০১৫ সালের ৬ জুন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শ্রী রামনাথ কোবিন্দ বলেন, "আমি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের মহান আত্মত্যাগ দেখে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত এবং তিনি তাঁর দেশের মানুষের সেবা করেছেন। আমি বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সকল সদস্য যারা অকালে নিহত হয়েছেন, তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।"

কোবিন্দ বলেন, বঙ্গবন্ধুর দেখানো আদর্শ ও মূল্যবোধ বাংলাদেশসহ সারাবিশ্বের পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখাবে। বাংলাদেশের প্রিয় জাতির পিতার জীবন ও কর্মের সাক্ষ্য দেওয়া ভবন পরিদর্শন করে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা।

ভারতের সাবেক এই রাষ্ট্রপতি ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালী ইয়োলড্রিম ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় মন্তব্য বইয়ে তিনি লেখেন, বাংলাদেশের মহান স্থপতি এবং বাঙ্গালী রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিধন্য বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন আমার জন্য খুবই সম্মানের বিষয়। বঙ্গবন্ধু কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী সামরিক অফিসারদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ৪০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান এখনও ২০ শতকের একজন অন্যতম নেতা হিসেবে স্মরণীয় ও বরণীয়।

তিনি বলেন, "তুরস্কের জনগণ এবং মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পক্ষ থেকে আমি একজন মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বাংলাদেশ সফরকালে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করে আমি ব্যক্তিগতভাবে যা প্রত্যক্ষ করেছি, তা আমার হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আমি বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাই যে আমরা বাংলাদেশের স্থপতি প্রয়াত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একই উষ্ণ ভাবাবেগে ডুবে আছি এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।"

মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহীম মোহামেদ সলিহ বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের সংগ্রাম বাংলাদেশকে তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পথকে তৈরি করেছে। তিনি গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকার লাভের ক্ষেত্রে আইকন হিসেবে সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এবং তাঁর আদর্শ বাংলাদেশ ও বিশ্বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে। তিনি ২০২১ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালী জাতির অধিকার ও মর্যাদা আদায়ে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গভীর তাৎপর্যপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁকে দেওয়া বঙ্গবন্ধু খেতাবে দেশের মানুষের প্রতি এই দেশপ্রেমিক নেতার গভীর ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়।

এতে তিনি আরো বলেন, 'আমাদের দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্রতী এই মহান স্বপ্নদ্রষ্টা ও বিশ্ব রাষ্ট্রনায়ককে আমি অভিবাদন জানাই।'

তিনি ২০১৩ সালের ৪ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

জার্মানীর প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিয়ান উলফ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, এই স্মৃতি জাদুঘর আমাদের একজন মহান রাষ্ট্রনায়ককে স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি তার জনগণের অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়াই করেছেন এবং অতিদ্রুত স্বাধীনতা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমি বাঙ্গালী জাতির স্থপতি এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানাই।'

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সম্মোহনী এবং অসীম সাহসী নেতৃত্বে মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর জনগণকে নেতৃত্ব দান করেছিলেন।

তিনি বলেন, 'আমি একজন মহান দূরদর্শী এবং রাষ্ট্রনায়কের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি যিনি স্বাধীন, উন্নত এবং গর্বিত বাংলাদেশের দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।'

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী বলেন, 'দূরদৃষ্টি সম্পন্ন একজন নেতা এবং রাষ্ট্র নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। তিনি স্বাধীনতার জন্য প্রতিকূলতা ও বিরূপ পরিস্থিতি উপেক্ষা করে অটল সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছেন।'

সোনিয়া বলেন, 'বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক এবং সমতার ভিত্তিতে মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে তার জনগণকে ক্ষমতাবান করতে চেয়েছিলেন। স্বাধানীতার পরপরই বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ড বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। তাঁর আত্মত্যাগ সব সময় সম্মানিত হবে, পরবর্তী প্রজম্ম এ আত্মত্যাগকে সম্মান করবে এবং এ সম্মান অব্যাহত থাকবে। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।'

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মূখ্যমন্ত্রী মমতা বন্ধ্যোপাধ্যায় বলেন, এই উপমহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু এক জলন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি এবং পিতা।

মমতা বলেন, বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মঞ্চে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বে মর্যাদা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই বিরল নেতা, যার প্রতি ধর্মমত নির্বিশেষে সকল মানুষ প্রণাম জানিয়ে ধন্য হয়। তার স্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।

শান্তিতে নোবেল জয়ী কৈলাশ সত্যার্থি বলেন, আমার আবেগ ও অনুভূতি জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। এই স্থানটি সত্যিকারভাবেই একটি তীর্থভূমি, প্রার্থনার একটি পবিত্র স্থান, যারা মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার ও কল্যাণে বিশ্বাস করে।

২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন শান্তিতে এই নোবেল বিজয়ী।

কৈলাশ সত্যার্থি বলেন, এই স্থানটি ভৌগলিক সীমা ও সময় অতিক্রম করেছে, কারণ বঙ্গবন্ধু নিজের সত্ত্বাকে সার্বজনীন ও অমর করে রেখে গেছেন।

তিনি বলেন, আমি প্রার্থনা করি, এখানে যে ধরণের সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা হয়েছে, তার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং কোথাও যেন এ ধরণের ঘটনা না ঘটে। পৃথিবী যেন মানবিক ও সভ্য হয়, যেখানে একটি বন্দুকের গুলিও যেন তৈরি না হয় ও তার ব্যবহার যাতে না হয়।

কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জ্যাং স্যাং মিন ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি পরিদর্শক বইয়ে মন্তব্য করেন, বঙ্গবন্ধু তাঁর মাতৃভূমি বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য সারাজীবন যে লড়াই সংগ্রাম করেছেন তার প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি শান্তির পায়রার মতো তাঁর দেশের মানুষের স্বাধীনতাকে ভালবাসতেন, যার মূল্য সার্বজনীন। তাঁর (বঙ্গবন্ধু) স্বাধীনতার সংগ্রাম ভবিষ্যতের জন্যও অব্যাহত থাকবে।

কোলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে প্রণাম। ভারতের মাটিতে থেকেও আমরা 'জয় বাংলা' ধ্বনিতে উদ্বেলিত হয়েছি। ৭ মার্চের আপনার কবিতা বাঙালী হিসেবে আমাকে, আমাদের আজও দোলা দেয়। বাঙালী জাতিকে যেন কেউ দাবায়ে রাখতে না পারে-এই আর্শিবাদ প্রার্থনা করি।

তিনি ২০২৩ সালের ১০ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর সামরিক সরকার বাড়িটিতে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার ছোট বোন শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় বেঁচে যান)।

১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরেও তাঁকে বাড়িটিতে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। পরে একই বছরের ১০ জুন তিনি বাড়িতে প্রবেশ করার অনুমতি পান।

১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট এ বাড়িটিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেন।

;