দুইটা ফিঙে



তানভীর মোহাম্মদ
অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

অলঙ্করণ: কাব্য কারিম

  • Font increase
  • Font Decrease

আকাশে বড় লেজ দুইটা পিচ্চি পিচ্চি পাখি উড়তেছে। মনে হইতেছে ওরা দুইজন পরস্পর দুষ্টুমি করতে করতে—উড়ার নানান তাল ভাঙতে ভাঙতে, হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাইতেছে বাতাসে। ডানা ঝাঁপটায়ে একে অপরকে ঢাইকা ফেলতে চাইতেছে। তারপর ফুড়ুৎ করে একটু নিচে নাইমা গিয়া শাঁই কইরা উড়াল দিতেছে অনেক উপরে। ওদের এইটুকু মাথার ঠিক এইটুকুই প্রকাশ। আমি দেখতে পাই না তাদের ইঙ্গিত। যেন পৃথিবীর সব প্রেম সব কামনা ছোট্ট ছোট্ট দুইটা চোখে একাকার হইয়া মোলায়েম পালকগুলাতে ছড়ায়ে পড়তেছে।

আশপাশ দেখতে দেখতে হঠাৎই চোখ পড়ল দূরের আরেকটা ছাদে। একটা বড়সড় চিলও আমার সাথে দেখতেছে এই দৃশ্য। পরপর আরো দুইটা চিল আইসা বসল। আমি ওদের মনোযোগের কোথাও নাই। বড় বড় চিলগুলাকে দেইখা হিচককের দ্য বার্ডস-এর কথা মনে পড়ল আমার। ওইখানেও চিলেরা এমন নিঃস্পৃহ ভাব নিয়া এদিক ওদিক বইসা থাকে। প্রথমে একটা দুইটা, তারপর কয়েকটা, তারপর অগণিত। আর তার পরই বিপর্যয়। পাখিরা হঠাৎ মানুষের ওপর আক্রমণ শুরু করে। ভয়ানক সেই দুর্যোগ। সিনেমা দেখতে দেখতে আমাদের সাজানো গোছানো প্রিয় সবকিছুর কথা মনে পরে তখন। কাছের মানুষদের বুকের কাছে টের পাই। দুর্যোগে তাদের কষ্ট হবার ভয় জাপটায়ে ধরে। অন্যদের যেন কেউ নাই। কিচ্ছু নাই। বাঁচতে বাঁচতে কতকিছুর সাথেই তো রাইখা যাইতেছি কতরকম দুর্ব্যবহারের ছাপ। কে যে কখন আসতে পারবে তার অনেক অনেক পুরানো পাওনা বুইঝা নিতে, সেইটার সময় নিশ্চয়ই আমরা ঠিক করব না। নাকি করব তাও?

আমার সকাল সকাল এইরকম ছাদে আইসা নানান ভাবনার অভ্যাস কোনো কিছুর ওপরই নির্ভর করতেছে না আজকাল। আমি ঘুমাইলাম কি না ঘুমাইলাম ব্যপারই না যেন। এমন দুর্বার দুর্জয় কামনা আমি কী কইরা হেলাফেলা করি। সূর্য ওঠে-ওঠে-ওঠে আর আমার কপালে ঘুমের পর্দা নামতে থাকে। কতদিন স্বপ্নের মতন ভাবলাম ‘সারাটি রাত ঘুমিয়ে তবে’ ভোরে এইখানে আইসা দাঁড়াব। কফি খাব। তারপর হালকা নাশতা সাইড়া গভীরতর চিন্তাভাবনা করতে করতে লেইখা যাব আবার ঘুম না আসা পর্যন্ত। কিন্তু আমার রাত আমার বাতাস আমার সিনেমা আর গুটিকয় মশাকেন্দ্রিক ব্যস্ততা সারতে সারতে আবারও সেই সকাল। এমন সকাল।

অন্যান্য সময় ভোর হইতে থাকলে চারদিকে নির্মাণ শ্রমিকদের জাইগা ওঠার শব্দ পাই। একজন একজন কইরা হাজিরা দিতে থাকে। আর বিভিন্ন রকম টুংটাং ঠাশটুশ চলতেই থাকে। ফলে সকাল মানে যে কেবলি সকাল তারও কোনো সুযোগ থাকে না। অদ্ভুত ব্যক্তিস্বাধীনতার কবলে পইড়া হাঁসফাঁস করতে থাকি ঘুম ঘুম চোখে। জমিদাররা সব একসাথে বাড়ি বানাইলেই মনে হয় পৃথিবীটা কত শান্তির হইতো। অনুগত মনুষ্যের এই সময়ে আমাদের কেন এত শব্দ পোহাইতে হয়?

ঘনবসতির শহরে বড় হইতে হইতে, শব্দের কী এক অদ্ভুত অভ্যস্ততায় আমাদের জীবন স্বাভাবিক হইতে বাধ্য হইল। চক্রাকারে লাখ লাখ মানুষের আবর্তিত হওয়ার শব্দ ঘুরপাক খায়। অগণিত প্রাণ চারপাশকে অত্যধিক জীবন্ত কইরা তুলতে তুলতে, একইসাথে মৃত্যুর দিকেও ঠেইলা দিতে থাকে যেন। যানবাহনের ধোঁয়া আর হর্নের প্রাচুর্যে আমাদের বোধ প্রতিনিয়ত মাটির সাথে মিশে যেতে থাকে। পিষে যেতে থাকে। এরই মধ্যে আমাদের শিল্প, আমাদের সাহিত্য, আমাদের প্রেম-দাম্পত্য সব অ্যাবসার্ড হইতে হইতে ঝাপসা হইয়া যায়। খুব দ্রুত চশমা লাগে। এমনই নিরুপায় বাঁইচা থাকায় যখন ঘুম ভাঙে, দেখি, বেলা উইঠা গিয়া আবার পড়তেও শুরু করছে। আর ওইদিকে আন্ডার কনস্ট্রাকশন থেকা শ্রমের কেমন যেন ক্লান্তি ভাইসা আসতেছে ম্রিয়মাণ শব্দে ভর কইরা।

সেই লেজ বড় পাখিরা গিয়া একটা আন্ডার কনস্ট্রাকশন বিল্ডিংয়ের প্রথম ছাদে বসছে দেখলাম। একটু দূর দূর ভাব। আমাদের দেইখা সোশ্যাল ডিসটেন্সিং খেলা খেলতেছে মনে হয়। অবশ্য বাইরে থেকা দেখা দূরত্বের এই সত্য ওদের সত্যের থেকে কতটা পৃথক তারও আঁচ পাইতেছি কিছুটা। এই যে জুটিটা দূরত্ব বজায়ে রাইখা বইসা আছে আর একটু একটু কইরা দুইজনই আগাইতেছে-সরতেছে, তাতেই বোঝা যায় দৃশ্যমান দূরত্ব এইখানে অনেক ফেলনা ব্যাপার। তার চেয়ে বরং অনেক বেশি কাছাকাছি ওরা নিজেদেরকে পাইতেছে। হয়তো হার্টবিটও শুনতে পাইতেছে পরস্পর। হঠাৎ হঠাৎ ডানা ঝাপটাইতেছে না উইড়াই, আবার ঠিকঠাক তা ছাঁচে না বসায় হালকা নাড়াচাড়া দিয়া ঠিক কইরা নিতেছে। একজন আগায়ে আসলে অপরজনও মৃদু লাফে সইরা যাইতেছে দূরে। যেহেতু তাদের যখন যেখানে খুশি উইড়া যাইতে কোনোই মানা নাই, সেজন্যই হয়তো এক দৃষ্টিতে নিবদ্ধ হবারও কিছু নাই। প্রচুর মাথা নাড়তেছে দুইজনই। মিথ্যা পলায়নরত পাখিটা টাশ কইরা দেখলাম দুইতলার ছাদে চইলা গেল। তারপর ক্ষণকাল। এবং পরেরটাও পিছু নিল মাথা নাড়তে নাড়তে।

যেই ছাদে ওরা দুইজন লুকোচুরি খেলতেছে, সেইটা আটতলা দেহের বিশাল এক বিল্ডিং। সারি সারি পিলার ছাদগুলাকে মাথায় তুইলা রাখছে। এর প্রতিটা নির্মাণে আমার শ্রবণেন্দ্রীয় পুরাপুরি বাধ্য হইয়াই অংশ গ্রহণ কইরা আসছে শুরু থেকা। ফলে ইচ্ছার অভাবের কারণে হবু ভবনটা দেখলেই ঘুমভাঙা দাবির কথা মনে পড়ে। কিন্তু এক সন্ধ্যার ঘটনায় তা ক্ষীণ হইয়া আসাতে, আমি যেমন মারাত্মক মর্মাহত হইলাম। একইসাথে জমিদারদের ওপর থাকা হররেকরকম পুরানো ক্ষোভ রক্তকণিকায় আবারও বেশ পীড়া দিয়া গেল।

সেইদিন সন্ধ্যায়, বের হবার পর মনে হইল আজকের সন্ধ্যাটা একদমই অন্যান্য দিনের মতন লাগতেছে না। লক ডাউনের আতঙ্কে সবার দিশাহারা অবস্থা। বড় মসজিদটায় কিছু লোক মাগরিবের নামাজ পড়তেছে। আশপাশের সব বাড়িতে হইচই হইচই। দুই হাত ভইরা বিভিন্ন খাদ্যদ্রব্য তুলতেছে ফ্যামিলিরা। চাল, ডাল, তেল, আলু, পেঁয়াজ বাজারসুদ্ধ তুইলা আনতেছে একদম। বাজারে গিয়া তো দেখি হুলুস্থুল কাণ্ড। মানুষজনের প্রচণ্ড ভিড়। বস্তা ভইরা ভইরা জিনিসপত্র নিয়া ভ্যান রিকশায় তুলতেছে। কেউ কারো দিকে তাকাইতেই তেমন ইচ্ছুক না। সাহায্য করবার তো সুযোগই নাই। হঠাৎ পরিচিত কারো সাথে দেখা হইয়া গেলে সহানুভূতি জানায়ে রাখতেছে আগত দিনগুলার জন্য। অথবা অনিচ্ছায় পাওনাদারের মুখোমুখি হইয়া পড়লে, শুকনা একটা হাসি দিয়া বলতে চাইতেছে কয়টা দিন খায়া পইড়া বাঁচতে দেখলে রাগ কইরেন না প্লিজ।

লম্বা লম্বা সিরিয়াল প্রতিটা দোকানে। আলু পেঁয়াজ রসুন হুড়মুড় কইরা ঢুকতেছে বস্তার ভিতর। ভিড়ের মধ্যে দেখলাম এক মহিলা। ত্রিশ কেজির বিশাল এক বস্তা হেঁচড়াইতে হেঁচড়াইতে মাটিতে পইড়া গেল। আমি আগাইতে আগাইতে ভাবি, আমার নিত্যদিনের পরিচিত এই বাজার, আজকে কী হইলো তার? খুব দ্রুত আরো এক লোক আগায়ে আসলো সেই মহিলাকে তুলতে। সে এমনিই ঘোরাঘুরি করতেছিল বোধহয়। চেনা লোক। যদিও তার সাথে আমার পরিচয় খুবই অল্প। কুড়িগ্রাম বাড়ি। বাসার পাশের নির্মাণাধীন বিল্ডিংয়ের কাজ হওয়ার সময় দেখছিলাম সে অন্যান্য সহকর্মীদের সাথে আটতলার ছাদে রড উঠাইতেছে। আর সেই রড তোলার পদ্ধতিও কী যে বিপদজনক। কয়েকটা রড দড়ি দিয়া বাঁইধা লম্বালম্বি একজন একজন কইরা সবাই উপরের তলার ছাদে দাঁড়ানোজনকে তুইলা দিতেছিল। এইভাবে এইভাবে আটতলা। অমানবিক! পরে একদিন তার সাথে কথা বইলা সেই শ্রমের মূল্যমান জানার পর, আর কোনোদিনই সোলাইমানের সাথে হাইসা কথা বলতে সাহস পাই নাই। আমি ভাবতাম, আমার সৌখিন হাসাহাসি আর কুশল বিনিময় তার জন্য হয়তো অনেক গভীর অপমানের কারণ হবে।

সোলাইমানকে দেইখা অসহায় হাসি দিলাম আমি। জিগেশ করল বাজার করতে আইছেন? অনেকদিনের বাজার কিন্যা ফালান। দেশ তো বন্ধ হয়া যাইব। খাবার দাবার পাইবেন না পরে। অবস্থাটা কী দেখেন। আগে দেখতাম টাকা নাই তাই খাওন নাই। কয়দিন পর তো দেখমু যাগো টাকা আছে তাগোও খাওন নাই। হরবর কইরা এইসব বলতে থাকা সোলাইমানকে থামায়ে দিয়া যখন আমি জিগেশ করলাম কেমন আছেন। সে চুপ হইয়া গেল। জাস্ট চুপ হইয়া গেল। আমারও তখন আর কী বলার থাকে।

আমি ফিঙে পাখি দুইটাকে লক্ষ্য করতে করতে দেখতেছি ওরা সোলাইমানের হাড় ভাইঙ্গা বসানো ছাদগুলাতে এখনো দুষ্টুমি করতেছে। যেইটা হালকা লজ্জা পাওয়ার মতো কইরা একফুট দুইফুট পলায়ে যাইতেছে ওইটাকে মেয়ে ধইরা নেওয়ার ব্যাপারে মনস্থির করলাম। মেয়ে ফিঙেটা হঠাৎই একটা ছাদ স্কিপ কইরা উইঠা গেল উপরের ছাদে। ছেলেটা ওর তাল অনুযায়ী প্রথমে এক ছাদই উঠল। কিন্তু সাথেই সাথেই দেখল, একি। পাজিটা তো উইঠা গেছে উপরেরটায়। সে হুশ কইরা উইড়া গিয়া একদম মেয়েটার সাথে ঘেঁইষা বসতে চেষ্টা করল। উহু উহু। মেয়েটা সইরা বসছে।

ওরা এখন পাঁচতলার ছাদে। কোনো তলারই দেয়াল পুরাপুরি উঠে নাই। নিচের দিকে একটু একটু উইঠা আছে। আর উপরের দিক তো শুধুই ছাদ আর পিলার। এইপাশে ওদিকের আকাশ দেখা যায়, ওইপাশেও নিশ্চয় এদিকের আকাশ আর আমাকে দেখা যাইতেছে। এর মধ্যে দিয়া বাতাসের অবারিত পথ। কোনো ঘর নাই, দেয়াল নাই। কত স্বচ্ছ। আমাদের আসলে কিছুদিন এমন বসতি বানায়েই থাকা উচিত। তখন বোঝা যাবে আমাদের পারস্পরিক কূটনীতি জটিলতার কোনো উপযুক্ত আবাসনের খোঁজ পাইছে কিনা। নাকি তার অন্ধকারের দিকে আগাইবার আরো অনেক পথ বাকি। আমার সাথে আমরা এবং অন্যদের সাথে আমি, আবার তাহাদের সাথে সে ও অন্যরা। এমন কইরা আরো কত। সম্পর্কের এইরকম নানান স্তরের লুকোচুরি কী একটা সভ্য দেয়াল তুইলা দিয়া আড়াল কইরা ফেলি নিমেষেই। অবিশ্বস্ততা, নোংরামি, রাগ, হিংসা, অভিমান, ক্ষুধা সব ঢাইকা দিয়া কোমল শান্তির ছড়াছড়ি আমাদের চোখে মুখে। ওইদিকে পাখিরা আরো একতলা উঠল। ওদের ভাবার দরকার নাই কিছুদিন পর এইখানে কত্তগুলা আড়াল গইড়া উঠবে। যেইগুলার ভিতরের রূপ রস গন্ধ কিছুই টের পাওয়া যাবে না এইদিক থেকা।

আমাদের তো এখন শহরই সবকিছু। যাদের কিছু কিছু গ্রামে রাইখা আসছে তারা সবাই বাড়িতে চইলা যাইতেছে। আমাদের কোথাও যাওয়ারই তেমন দরকার নাই। তাই বাসায় বইসা বইসা খাদ্য মজুদ করতেছি, আর যারা ক্ষুধা ও মৃত্যুর মাঝামাঝি পইড়া এদিক ওদিক ছোটাছুটি করতেছে, ওদের গালাগাল দিতেছি। এইসবে কিছুটা ক্ষোভ ঝইড়া গিয়া ক্ষুধার ব্যাপারে আমাদের জানার ঘাটতিও কিছুটা ঢাকা পড়তেছে বৈকি। সোলাইমান কথায় কথায় জানাইল বাড়ির মালিক যেই পাওনা পরিশোধ করছে ওতে কইরা বাড়ি যাবার মতন সাহস তার হইতেছে না। অযথাই অনেকগুলা ক্ষুধার্ত মুখ দেইখা দেইখা মরতে হবে। এদিকে কাজ বন্ধ হইল অনির্দিষ্টকালের জন্য। খাওয়ানোর আশ্বাসও তো দিতে পারবে না। এইখানে থাকলে আবার নিজের খাবারেরই যোগান আসবে কই থেকা সেইটা ভাবতে ভাবতে বাড়িতে ফিরতে পারার সময়গুলা শেষ হইয়া যাইতেছে। কী থাকতেছে আর। আজকালকের মধ্যে আবার গাড়িও বন্ধ হইয়া যাবে। আজকে দেখা হওয়ার পর কথাবার্তার শুরুর দিকে, একটু বেশিই হাসতেছিল মনে হইল। সেই অতিরিক্ত হাসি হাসি মুখ মনে পড়তে থাকল আমার। ফলে বিজ্ঞানসম্মত কর্তব্য ভুইলা গিয়া সোলাইমানকে বলতে হইল যে তার দ্রুতই বাড়িতে যাওয়া দরকার। বুঝায়ে বললাম দেখেন, আমাদের কিন্তু মাঝেমধ্যে কিছুই থাকে না। সেই সময় ওই মানুষগুলাই থাকে শুধু। যেমনেই থাকুক। আপনে বাড়িতে যানগা তাড়াতাড়ি। আল্লাহর ওপরে ভরসা রাখেন। খাইতে কিছু না কিছু তো পাইবেন অবশ্যই। ওইটা দিয়া চালাইয়া নেন। আমরা বাঁইচা থাকলে আবার মাছ-মাংশ খাবোনে।

প্রয়োজনের তুলনায় অতি অল্প কিছু টাকা দিয়া তার সাহস যোগাইতে চেষ্টা করলাম। তারপর বাজারে ঢুইকা কেনাকাটায় হারায়ে গেলাম। তখন স্বাভাবিকভাবেই আমার পক্ষে কল্পনা করা সম্ভব ছিল না যে সোলাইমান গাড়ি না পাইয়া ড্রামের মালামাল সাইজা অন্ধকার হাতড়াইতে হাতড়াইতে বাড়ি যাবে।

অনিশ্চয়তার কবলে পড়া নিয়া আমার কখনোই বিশেষ ভয় কাজ করে নাই। শুধুই স্রষ্টার ওপরে বা ভাগ্যের ওপরে ভরসা কইরা বইসা থাকা না। আমার ধারণা এর পিছনে নিশ্চয়ই আব্বার গুণগত বৈশিষ্ট অনেক বেশি প্রভাব ফেলছে। আমার মন যখন অনেক নরম; অনেক ছোট, তখন থেকাই প্রভাবিত হওয়াটা ঘইটা থাকতে পারে। আমাদের কত ভালো সময় গেছে, কত খারাপ সময় গেছে। অতি ভালো আর অতি খারাপের সাথেও পরিচিতি ঘটছে বিভিন্ন পর্বে। কিন্তু যতবারই কোনো সংকটের মুখোমুখি দাঁড়াইতে উদ্যোগী হইছি আমার কেবলই মনে পড়ছে ক্ষুধার কথা। অথচ কোনো বেলা আমরা না খাইয়া সবাই একে অন্যের থেকা মুখ লুকাইতেছি এমন মনে পড়ে না। তবু কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই কেউ একজন খাবার পাইতেছে না এই অনুভূতির কারণেই হয়তো ক্ষুধার ভয় থেকা আমি কখনো মুক্তি লাভ করি নাই।

সোলাইমানের পিকআপ ভ্যানে ড্রামে কইরা বাড়িতে যাওয়ার কথা মনে পড়ায় খুব দমবন্ধ লাগতেছে আমার। ত্রিপল দিয়া ঢাকা অনেকগুলা ড্রামের দৃশ্য কল্পনা থেকা মুইছা ফেলতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাইতেছি। বড় বড় শ্বাস নিতেছি স্বাভাবিক হইতে। চারদিকের বিস্তৃত শূন্যতায় দৃষ্টি ছড়ায়ে দিয়া পুরা সময়টা ধারণ করতে চাইলাম। আমরা সবাই মিলা কেমন একা হইয়া গেছি। করোনা আমাদের কপালে আইসা উপস্থিত হওয়ার পর, পর্যায়ক্রমে দেখা বিভিন্ন ঘটনা চেতনে আইসা জ্বালাতন শুরু করে। ফলে কিছুই সহনীয় অবস্থায় থাকতেছে না। যতটুক জায়গা আমার অস্তিত্বের জন্য বরাদ্দ ওইটুকুও শূন্যতাকে দিয়া দিতে পারলে আর কোনো অনুভূতিই থাকত না আমার। কিন্তু ওইটা কি মুক্তি? তা তো হইতে পারে না। এতটা দিন থাকলাম কোনো দায়ই কি মাখল না গায়ে? প্যাকেটবন্দী হয়া বাজার কইরা আসার সময় যখন দেখি শুনশান রাস্তার দুইপাশে অনাহারী মানুষগুলা বইসা তাকায়ে আছে আকাশের দিকে—কেন দেখাইলাম তাদেরকে, যে আমি কিছু না কিছু খাইতে পাইতেছি?

অথরিটি তাদের সাথে কী সম্পর্ক রাখছে সেইটা তাদের অভিযোগের মোটামুটি চূড়ান্ত মাত্রা হইলেও আমার মতন মুখচেনা মানুষগুলার প্রতি ওদের চাহনির যৌক্তিকতা খুব ভালোভাবেই টের পাই তখন। সেইটা সহ্য করবার জন্য কত সবল চিত্তের হইতে হবে তার সম্পর্কেও যখন আমার কোনো ধারণা নাই, আমি কই গিয়া মুখ লুকাব।

লকডাউন শুরু হইল পরে ভিন্ন ভিন্ন পর্যায়ের নির্দেশনা আসার পর সবার যখন রোজগারের পথ বন্ধ হইল, বাসাবাড়ি থেকাও বাইর হওয়া মানা। তখন সঞ্চয়বিহীন ঋণের বোঝা টানতে টানতে ক্লান্ত এই মানুষগুলার তো বাইর হইতেই হয়। রাষ্ট্রের অধীনে থাইকা যেইভাবে এতদিন নিজেদের খাবারটুকু যোগাড় কইরা আসছে; এবং পদে পদে সরকারি কর্তৃত্বের জানা-অজানা নানান অধিকারকে অবধারিত কর্তব্য হিসাবে সন্তুষ্ট কইরা আসছে। তবে কেন এখন ওরা—যাদেরও আছে মৃত্যুর ভয়, ক্ষুধার মুখোমুখি দাঁড়ায়া আপনাকে বিশ্বাস করতে পারল না হে মহামতি ঠাকুর? চিরদিনই তো খালি পুলিশ খালি পুলিশ। ওরা আর আপনার মতো বুদ্ধিমান মানুষ হইতে পারল কই। তার ওপর মুখ ফসকায়ে বোকাবোকা কিছু বললেই আপনার জমাট মাখনের মতো দুগ্ধ অভিমান। যেন কত আপন; যেন বাবা মা!

সামনের বিল্ডিং গাছপালা সব কুয়াশায় আচ্ছন্ন হইয়া আছে। যেইখানটাতে গাছও নাই বিল্ডিংও নাই, সেইখানটায়ও নিশ্চয়ই এমন। হালকা কুয়াশা। একটু একটু শীতল বাতাস বইতেছে। আমি আবার মনোযোগ দিলাম ফিঙে দুষ্টুগুলার দিকে। মন খারাপে কাজ নাই। দেখি ওরা কী করতেছে। মেয়ে ফিঙেটা এখন সাততলায় বইসা নিচে উঁকিঝুঁকি মারতেছে একটু একটু। আগ্রহ বেশি প্রকাশ পাইতে নিলে আবার এলোপাথাড়ি মাথা নাড়তেছে এদিক ওদিক। হাহা, কোনো উদ্দেশ্যই নাই তার এই পলায়নের। কাউকেই কিন্তু তার দরকার নাই। নিজেই নিজের কাজ সাইরা নিতে পারবে, হুম। ছেলেটা ছয়তলায় বইসা বইসা একদমই উপরে কেন তাকাইতেছে না সেইটাও একটু ভাইবা নিতেছে হয়তো। ওইটা তো না তাকানোর চেষ্টায় একদম বুকের সাথে মুখ মিশায়ে রাখছে। ওর যে যাইতেই হবে উপরে! বুকটা আকুপাকু করতেছে। ফুড়ুৎ কইরা হয়তো উইড়া গিয়া একদম গায়ে পইড়া যাবে, ছেলেদের মতন।

চারদিকে কোনো সাড়াশব্দ নাই। গুমোট কান্নার মতন লাগতেছে। সবাই ঘুম। জানালা বন্ধ। অথচ এইসময় সব বাসার রান্নাঘর সচকিত হয়া ওঠার কথা। যারা রান্না করবার, পুনর্ঘুমের একটা ফ্রেশনেসের কামনা যাদের কপালকে জর্জরিত কইরা রাখছে, তারা সজাগ হইতে হইতে এইটা ওইটা বসাবে চুলায়। তারপর একে একে সবাই উঠবে। খাবে দাবে এবং বাইর হবে। কিন্তু আজকে তো কারো বাইর হওয়ার কথা নাই। কোনদিন থেকা বাইর হবে তাও ধারণার অতীত। কিংবা আর কখনো বাইর হওয়া হবে কিনা! এভিনিউ দুইয়ের বড় মসজিদ থেকা কয়েকজনকে নামাজ পইড়া পৃথিবীতে বাইর হইতে দেখা গেল। মাস্ক পরতেছে।

গতকাল দেখছিলাম মসজিদ পুরাটা বাঁশ দিয়া ঘেরাও দিয়া রাখা। সবাইকে বাসায় নামাজ পড়ার জন্য মাইকে আহ্বান জানানো হইতেছে সকাল বিকাল। তারপরও নামাজি ব্যক্তিরা পুলিশের গাড়ি চেক দিয়া দিয়া হাজির হয় আল্লাহর কাছে। বাঁশের বাউন্ডারির ফাঁক দিয়া এক পা ঢুকায়ে মাথা নত কইরা চুপেচাপে ঢুইকা যাইতেছে। তারপর সদর দরজা আটকায়ে নামাজ পড়তেছে মাইক ছাড়াই। জনমনে ঠাকুরের মধ্যস্ততাকারীদের এই গাড়িগুলা এতটাই অবিশ্বস্ততার প্রতীক হইয়া ভুমভুম করতে থাকে যে বিশ্বব্যাপী চলমান দুর্যোগ মানে তাদের কাছে শুধু ওই লোকগুলাই। ওদের কোনোভাবে ফাঁকি দিয়া নিজের কাজগুলা সাইরা নিতে পারলেই তো হইল।

চায়ের দোকানদার মিলিটারি ফাঁকি দিয়া শাটার ফালায়ে বইসা থাকে, কেউ টোকা দিলে ভিতর থেকা বলে দুধ চা না রঙ চা? কী অদ্ভুত কাণ্ডকারখানা। তারপর শাটার অল্প উঁচা কইরা ক্রেতাকে আপন বানায়া নেয়। মাসখানেক আগে ওই দোকানদার হাসতে হাসতে বলতেছিল দেখছেননি ইহুদিগুলান মরতাছে ক্যামনে ভাইরাসে। হালাল হারাম মানে না তো। যা তা খায় একবারে। সেদিনও ওর দোকানে মসজিদকেন্দ্রিক স্থানীয় প্রশাসনের লোকজন আড্ডা মারতেছিল যথারীতি। ওদের সেই খারাপমানুষির মুখোমুখি হইতে গিয়া প্রচণ্ড অস্বস্তি পোহাইছিলাম সেদিন। যুক্তির বিরুদ্ধে ধর্মের ভাবসর্বস্ব যেই লড়াইয়ের ইতিহাস, ইসলাম তাতে একটু ভিন্ন রঙই তো নিয়া আসছিল। মহামারিতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ব্যপারে নবীজির স্পষ্ট বক্তব্য থাকা সত্ত্বেও ইসলামিক নেতারা এমন দুর্বল ভূমিকায় নিজেদের হাজির করাটা খুব বেশিই অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। অনুসারীদের দায় তারা কিভাবে এড়াইতে পারেন।

হঠাৎ কোনো একটা দৃশ্য আমার এইসমস্ত ভাবনাচিন্তাকে পুরাপুরিভাবে অপ্রয়োজনীয় কইরা ফেলল। আমার মনোযোগ সত্যিকার অর্থে কোনদিকে আমি সেদিকে লক্ষ্য করতে চেষ্টা করলাম। পাখি দুইটা আবারও আমার মনোযোগ কাইড়া নিল লাফালাফি করতে করতে। ওরা এখন সর্বোচ্চ ছাদে। যেই ছাদটা এখনো কমপ্লিট হয় নাই। সারি সারি বাঁশের ওপর কাঠ দেওয়া। ফলে ওইখানে কলাবাগানের মতো একটা আড়াল ভাব তৈরি হইছে। ওরা দুইটা তার মধ্যে দিয়া লুকোচুরি খেলতেছে। হাসাহাসি লুকালুকির এক পর্যায়ে মেয়েটা ক্লান্ত হইয়া একখানে বইসা পড়ল। ছেলেটা খুশিতে ওর চারপাশে উড়তে উড়তে চক্কর দিয়া একদম জড়ায়া বসল। এইবার মেয়েটা আর সরতেছে না। আমি আমার মাঝেও কিঞ্চিৎ দুষ্টু দুষ্টু ভাবের আভাস পাইলাম। হার্টবিট বাড়তেছে। এইবার, হ্যাঁ, ওরা দুইজন ফাইনালি মিলিত হইল। আমি তো মানুষ, ওদের কিছুই দেখতে বাঁধা নাই। আমার কনস্ট্রাকশনে আইসা পাখিরা কী কইরা গেল তাতেও মন খারাপ নাই। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ওদের প্রশান্ত উইড়া যাওয়া দেখতে দেখতে একটু মন খারাপ হইল। সবই তো আছে। আমরাও থাকি না!

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;