ব্রানসউইক শহরে নিহত কৃষ্ণাঙ্গ আহমুদ আরবারি



মঈনুস সুলতান
গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

গ্রাফিক: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

পিচঢালা সড়কের দিকে দিশা ধরে তাকিয়ে ড্রাইভ করতে করতে হলেণ আমার দিকে তুর্কি সুফি-সংগীতের একটি ক্যাসেট বাড়িয়ে দেয়। আমি তা রের্কডারে গুঁজে নভ টিপি। টয়োটা গাড়ির ভেতরকার বাতাবরণ ভরে ওঠে দরবেশী ঘরানার চ্যান্টিয়ের মতো নেশা ধরানো মূর্চ্ছনায়। দরদী এ সংগীতের রচয়িতা সপ্তদশ শতকের সুফিসন্ত হজরত নিয়াজ আল মিস্রি। এত বছরের পুরানো ক্যাসেটটি এখনো বাজছে দেখে আমি রীতিমতো তাজ্জব হই! কত বছর আগের কথা, আমরা টেপটি খরিদ করেছিলাম তুরস্কের কোনিয়া নগরীর জগতজোড়া মশহুর সুফিসন্ত হজরত জালাল উদ্দীন রুমির মাজার-সংলগ্ন মিউজিয়ামের গিফট শপ থেকে। তখন কি জানতাম, প্রায় তিন দশক পর আমরা একত্রে ড্রাইভ করে রওয়ানা হব, যুক্তরাষ্ট্রে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ব্রানসউইক শহরের দিকে। বয়সের প্রভাবে ক্যাসেটের জিগর হয়ে এসেছে দুর্বল, তারপরও শ্রবণে লিরিকটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে:
কান ইয়ানি বুলবুল ওলডু
হার আচিলদি গুল ওলডু
গজ কুলাক ওলডু হার ইয়ার
হার নে কি ভাব ও ওলডু..

গীতল এ চরণগুলোর টোটাফাঁটা ভাব-তর্জমা হতে পারে;

হৃদয়ের তুমুল মনস্তাপ
রূপান্তরিত হয় সংগীতপ্রবণ পাখিতে ফের
আগুনে পুড়ে তৈরি হয় অজস্র গোলাপ
সৌরভে মৌতাত হয় ঢের
যেদিকে তাকাই দেখি তোমার অসংখ্য চোখ
সংবেদনশীল সহস্র্র শ্রবণ হয়ে আছে উন্মূখ.. ..

অত্যন্ত নস্টালজিক এ গীতের ভাবসম্পদ নিয়ে নীরবে তর্পণ করতে করতে আমি জর্জিয়ার সাভানা শহরে—সম্প্রতি আমাদের সাময়িকভাবে থিতু হওয়ার বিষয়-আশয় নিয়ে ভাবি। আমাদের দিনযাপনে বোধকরি লং ডিসটেন্স ড্রাইভিংয়ের প্রয়োজন ফুরিয়েছে, তাই অত্র এলাকায় এসে আমরা হালফ্যাশনের গাড়ি-টাড়ি কেনার চেষ্টা করিনি। যে টয়োটা-করোলা গাড়িটি হলেণ ড্রাইভ করছে, তা আমরা সেকেন্ডহ্যান্ড খরিদ করেছিলাম সম্ভবত ২০০৬ সালে, সাউথ আফ্রিকার প্রিটোরিয়া নগরীতে বসবাসের সময়। সে থেকে ছাই রঙের বাহনখানা আমাদের সঙ্গে সফর করেছে, মেক্সিকো সিটি কিংবা সিয়েরা লেওনের ফ্রিটাউন প্রভৃতি শহর। প্রৌঢ়ত্ব পেরিয়ে প্রবীণ হয়েছি আমরা, ক্ষীণ হয়েছে দৃষ্টিশক্তি, গাড়িখানাও বয়োবৃদ্ধ হয়েছে, লজজড় হয়েছে তার দেহলতা, তবে সেবাদানে অক্ষমতা প্রকাশ করেনি, কৈমাছের প্রাণ নিয়ে আমাদের সঙ্গে উজিয়ে চলছে—যাপিত সময়ের ঢালে।

হলেণ স্টিকশিফ্ট টেনে গিয়ার বদলায়, বাহনখানা ঝাঁকি দিয়ে কেঁপে ওঠে, তাতে পেছনের সিটে ঝিমুনি ভেঙে ধড়মড় করে জেগে ওঠেন মিসেস মেরি মেলবো। তাঁর কণ্ঠস্বর মাস্ক ও ফেসশিল্ডের ঘেরাটেপ অতিক্রম করে ঝাঁঝিয়ে ওঠে, ‘আর উই দেয়ার?’ হলেণ ‘নট রিয়েলি’ বলে স্পিড বাড়ায়। আমরা আটলান্টিক মহাসাগরের পাড় ঘেঁষা যে সড়ক ধরে পথ চলছি, তা ওশ্যান হাইওয়ে নামে পরিচিত। রাজপথের একপাশে বৃক্ষময় নিবিড় বনানী, তার কিনার ঘেঁষে কসমস ফুলের ঘন বিন্যাস, তাতে ফুটে আছে বর্ণবিহ্বল নিযুত পুষ্পদল, যা দৃষ্টিতে ছড়ায় সতেজ সিগ্ধতা, কিন্তু মন থেকে মুছে যায় না উদ্বেগের ম্লানিমা। তামাম রাজ্য জুড়ে গেল সপ্তা দুয়েকে লকডাউন শিথিল হতে হতে উপে যেতে বসেছে। শুরু হয়েছে যানবাহন চলাচল ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। মিডিয়ায় ম্রিয়মান হয়ে এসেছে করোনা সংক্রমণজনিত তথ্যাদি। মানুষজন ভুগছে তাবৎ কিছু নরম্যাল হয়ে যাওয়ায় বিভ্রমে। আসলেই কি স্বাভাবিক হয়ে এসেছে সমস্থ-কিছু? স্থানীয় মিডিয়া থেকে করোনাভাইরাসের বিস্তার সংক্রান্ত তথ্যাদি মুছে গেছে। তবে, অন্তর্জালে মনোযোগ দিয়ে খুঁজলে পাওয়া যায় মৃত্যুর সপ্তাওয়ারি উপাত্ত। যে কাউন্টির অন্তর্গত আমাদের শহর, ওখানে সপ্তা দুয়েক আগে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল নয়, বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ২৯। ব্রানসউইক নামে যে মফস্বল শহরের দিকে আজ আমরা মেলা দিয়েছি, ওখানেও পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক বলে জোরেশোরে এলান দেওয়া হয়েছে, তবে মৃত মানুষের সংখ্যার দিকে তাকালে ধারণা ভিন্ন হয়, যাঁদের মৃত্যু হয়েছে তাঁদের অধিকাংশ কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকান। রিপাবলিকান প্রশাসনের কেউ কেউ বলছেন, এরা স্বাস্থ্য সুরক্ষার সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করছে না, তাই এড়াতে পারছে না মৃত্যুর করাল ছোবল।

ব্রানসউইক শহরটি আমাদের অচেনা, তা বলা যাবে না। আগেও ওখানে বার তিনেক এসে ঘুরপাক করে গেছি। ওখানকার মেরি রস ওয়াটারফ্রন্ট্র পার্কে ফিবৎসর অনুষ্ঠিত হয় ‘রিদম অন দি রিভার কনসার্ট’ শিরোনামে নদীভিত্তিক সংগীতের জলসা। বছর দেড়েক আগে পুরো এক সন্ধ্যা—মাঝরাত অব্দি আমরা কাটিয়েছি নৃত্য-ঝংকারের রীতিমতো হিপনোটিক পরিবেশে। আরেকবার আসা হয়েছিল, মেফ্লাওয়ার নামে একটি নৌযান-কেন্দ্রিক প্রদর্শনীতে। ইউরোপ থেকে অভিবাসী হিসাবে আগত শ্বেতাঙ্গ সেটলারস্—মূলত পুর্তগিজ নাবিকরা তাদের মাছ ধরার বহরকে খ্রিস্টীয় রীতিতে আশির্বাদ করার প্রক্রিয়া হিসাবে বন্দরনগরীতে আনেক বছর আগে এ সমুদ্রমেলাটি চালু করেছিলেন। মেফ্লাওয়ারের পর্বে পুষ্প-দীপাবলিতে সজ্জিত অনেকগুলো সুদর্শন বোটের ভেসে যাওয়া এখনো চোখে ভাসে।

পেছনের সিট থেকে মিসেস মেরি মেলবো খোনা গলায় বলেন, ‘সুফি-সঙ ইজ সুপার লাভলি, ইউ গাইজ ডিজারভ্ সাম ফুড।’ তিনি চকোলেটের প্রলেপ দেওয়া গ্রোনলা-বার ও আইসটির ক্যান বাড়িয়ে দেন। আমি অ্যালকোহল রাব দিয়ে ঘঁষামাজা করে গ্রোনলা-বারের মোড়ক খুলি। সাভানা থেকে ব্রানসউইকের দূরত্ব বেশি না, তবে যে রকম থেমে থেমে—ব্যাকরোড ধরে আস্তে-ধীরে চলছি, পৌঁছতে মনে হয় ঘণ্টা দুয়েক লেগে যাবে। আমরা রওয়ানা হয়েছি কাকভোরে, মিসেস মেলবো ঘণ্টাখানেক দূরের একটি এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে বসবাস করেন, তাঁকে পিকাপ করে আনা-নেওয়ার তুলতবিলে ব্যয় হয়েছে পুরো দুই ঘণ্টা, যুতমতো চা-পানি মুখে দেওয়ার ফুরসত হয়নি। মিসেস মেলবো ফের আওয়াজ দেন, ‘মিউজিক ইজ মেকিং মি ফিল লাইক ডু অ্যা দরবেশ ড্যান্স।’ অন্যের প্রতি সহমর্মিতা ছাড়া মিসেস মেলবোর চরিত্রের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সামান্য কিছুতে উদ্দীপ্ত হওয়া। মানুষটি গাত্রবর্ণে শ্বেতাঙ্গ, বয়স ৭৯, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ ও বাথে কব্জি কমজোর। ইনি আজকাল আর লং ডিসটেন্স ড্রাইভ করতে পারেন না, তবে পেশাগত কাজ থেকে অবসর নিতে পারেননি, এখনো জর্জিয়া স্টেট ইউনিভারসিটিতে ছোটখাট কী একটা চাকুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কাজ না করেও মিসেস মেলবোর উপায় নেই, বয়সের ভাটিতে পৌঁছে স্টুডেন্ট লোন নিয়ে তিনি কলম্বিয়া ইউনিভারসিটিতে পিএইচডি করেছিলেন, এখন সে ঋণ মাসওয়ারি পরিশোধ করে চলছেন। এক কামরার একখানা এপার্টমেন্টও কিনেছিলেন—সে দেনা তাঁকে শোধ করতে হচ্ছে কিস্তিতে। তাঁর ত্রিসংসারে বিত্তবান খেশকুটুম আছেন প্রচুর, সঙ্গত কারণে মেরি তাদের ঘৃণা করেন, এদের প্রসঙ্গ ওঠলে অশোভন জবানে খিস্তিখেউড় করতে ছাড়েন না।

বছর দশেক আগে মিসেস মেলবোর নিঃসঙ্গ দিনযাপনে জুটেছিল একজন জেন্টোলম্যান ফ্রেন্ড। হল্যান্ডের বয়স্ক এ নৃবিজ্ঞানি স্টেট ইউনিভারসিটিতে এসেছিলেন ভিজিটিং স্কলার হিসাবে। তাঁদের অন্তরঙ্গতার এক পর্যায়ে তিনি শ্বেতাঙ্গ মেরি মেলবোর দিকে নিবিড়ভাবে তাকিয়ে, ভুরু কুঁচকে মন্তব্য করেছিলেন, ‘ফর সাম রিজন আই বিলিভ ইউ হ্যাভ সাম আফ্রিকান ব্লাড ইন ইউ..।’ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, চেহারা-সুরতে মেরি মেলবো পুরোদস্তুর হোয়াইট ওয়োম্যান হলেও তাঁর দেহসৌষ্ঠবে আছে পশ্চিম আফ্রিকার নারীদের কাঠামোগত আদল। নৃবিজ্ঞানি স্বদেশে ফিরে যাওয়ার সময় তাঁকে এনকারেজ করে বলেছিলেন, ‘ইউ মাইট ওয়ানা ডু অ্যা ডিএনএ টেস্ট, আই অ্যাম শিওর ইউ উইল ফাইন্ড সামথিং ইন্টারেস্টিং আবাউট ইয়োরসেল্ফ..।’ ততদিনে যুক্তরাষ্ট্রের নানা জায়গায় হরেক কিসিমের মানুষজন—তাঁদের পুর্বপুরুষদের জিনিওলজি বা নৃতাত্ত্বিক শিকড় সম্পর্কে বিশদ জানতে অ্যানসেস্টার ডটকম নামক ওয়েবসাইটের শরণাপন্ন হচ্ছে। মিসেস মেরি মেলবো তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে নিজের ডিএনএ পরীক্ষার উদ্যোগ নেন। সপ্তা তিনেকের ভেতর রেজাল্ট আসে, ডিএনএ পরীক্ষা করনেওয়ালারা কনফার্ম করেন যে, তাঁর শরীরে সত্যিই প্রবাহিত হচ্ছে—পশ্চিম আফ্রিকান অজ্ঞাত কোনো কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের শোণিত।

খুব যে অবাক হয়েছিলেন মিসেস মেলবো, তা নয়। পারিবারিক গালগল্পে জানতেন, তাঁর পূর্বপুরুষদের মালিকানায় ছিল কটন ফার্ম। তারা তুলাচাষে ব্যবহার করতেন আফ্রিকার পঞ্চিমাঞ্চল থেকে অপহরণ করে নিয়ে আসা কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিতদাসদের মেহনত। এঁদের কন্যা-সন্তানরা বিবেচিত হতেন শ্বেতাঙ্গ ফার্ম-মালিকদের সম্পত্তি হিসাবে। এঁরা ধর্ষণের শিকার হতেন আকসার। এ প্রক্রিয়ার ফলশ্রুতিতে সন্তাদি জন্মানোরও সামাজিক প্রমাণ আছে প্রভূত পরিমাণে। মিসেস মেলবোর সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গ আত্মীয়স্বজনদের কেউ কেউ বিশ্বাস করে, হোয়াইট সুপ্রিমেসি বা শ্বেতাঙ্গ সম্প্রদায়ের একচ্ছত্র অধিপত্য প্রতিষ্ঠায়। পারিবারিক দলিলপত্র খুঁজে তিনি আরো অবগত হন যে, তাঁর এক পূর্বপুরুষ নাকি ক্রীতদাস প্রথা বিলোপের বিরুদ্ধে ওকালতি করে অনেক বছর আগে ছাপিয়েছিলেন একটি পুস্তিকা। তা বিতরণ করা হয়েছিল সাদার্ন ব্যাপটিস্ট চার্চের শ্বেতাঙ্গ উপাসনাকারীদের মধ্যে। তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন, প্রফেট আব্রাহাম নিজে ছিলেন ক্রীতদাস মালিক। খ্রিস্টের জীবদ্দশায় জেরুজালেমের রোমান প্রশাসকরা ব্যবহার করত ক্রীতদাসদের শ্রম, যীশু নাকি এ প্রক্রিয়ার কোনো প্রতিবাদ করেননি। তাই ক্রীতদাস প্রথা ধর্মীয় বিধানে অনুমোদিত।

দরবেশী মিউজিক বাজতে বাজতে ক্রমশ সুরলয় মিহি হয়ে আসে। তার সাথে মিশে যায় পেছনের সিট থেকে ভেসে আসা নাক-ডাকার শব্দ। হলেণ মৃদু হেসে স্টিয়ারিং হুইলে হাত রেখে আমার দিকে তাকায়। কাকভোরে জাগার আরেক সমস্যা, গাড়ির দ্রুত সঞ্চালনে মিসেস মেলবো ঘুমিয়ে পড়েছেন। মুখে মাস্ক ও ফেসশিল্ড থাকার ফলে কাচের বন্ধ শার্সিতে আটকে পড়া বোলতার মতো ফড়ফড়িয়ে আওয়াজ হচ্ছে। নাক-ডাকা করোনার আলামত নয়, এ নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হওয়া নিষ্প্রয়োজন। তবে পেছন দিকে দ্রুত গতিতে ছুটে যাওয়া সমুদ্রপাড়ের দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে আমার ভাবনায় ফের চলে আসে মিসেস মেলবোর পারিবারিক দ্বন্দ্বের প্রসঙ্গ।

ক্রিসমাসের ফ্যামিলি রিইউনিওনে সাত-পাঁচ ভেবে তিনি সামিল হয়েছিলেন। তখন বয়সে তরুণ দুজন সম্পূর্ণ শ্বেতাঙ্গ কাজিনের সঙ্গে তাঁর তুমুল বসচা হয়। তারা ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্যের শার্লটভিলে অনুষ্ঠিত হোয়াইট সুপ্রিমিস্টদের মশাল মিছিলে যোগ দিয়েছিল। তারা মিসেস মেলবোর সুয়েটারে আটকানো বর্ণবাদবিরোধী স্লোগান ‘ব্ল্যাক লাইভস্ ম্যাটার’ আঁকা বোতামটি খুলে ফেলতে বলে, তিনি তাতে বিরক্ত হয়ে রিইউনিওন ত্যাগ করেন। নিজের নৃতাত্ত্বিক পরিচিতি সম্পর্কে সচেতন হওয়ার পর থেকে মিসেস মেলবো কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের পার্টি-পর্ব ও কনসার্ট-থিয়েটারে যাচ্ছিলেন। ওয়েস্ট আফ্রিকা থেকে শিকল পরিয়ে এদেশে নিয়ে আসা কৃষ্ণাঙ্গ মানুষজনদের ওপর লেখা বইপত্রও পড়ছিলেন সঙ্গোপনে। কিন্তু ক্রিসমাস রিইউনিওনের ঘটনার পর, তিনি বন্ধু-বান্ধবদের তাঁর শরীরে যে আফ্রিকান রক্তের মিশ্রণ আছে—তা ডিএনএ টেস্টের রেফারেন্স দিয়ে প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেন। বিষয়টি স্যোশাল মিডিয়া অব্দি গড়ালে, তাঁর পরিচিত আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষজন তাঁকে শ্রদ্ধার সাথে তাঁদের পালাপার্বণে দাওয়াত দিতে শুরু করেন।

আমাদের সঙ্গে মিসেস মেলবোর দেখা হয় সাভানা শহরের আফ্রিকান-আমেরিকান সম্প্রদায়ের পরব কোয়ানজো সেলিব্রেশনে। আমরা দুজনে সিয়েরা লেওনে ইবোলা সংকটের সময় আমাদের পেশাদারি কাজবাজ গুটিয়ে কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রে ফিরেছি, সাভানাতে বাস করছি সাময়িকভাবে। কোয়ানজোতে গিয়েছিলাম কৃষ্ণাঙ্গ গায়কদের লাইভ উপস্থাপনায় সৌল মিউজিক শুনতে। সাক্ষাতের শুরুতেই মিসেস মেলবোর সঙ্গে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দ্রুত আমাদের বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে । মিসেস মেলবো সেনেগালের কৃষ্ণাঙ্গ সুফিসন্ত শেখ আহমাদু বমাবা সম্পর্কে কৌতূহল দেখিয়ে আমাকে তাজ্জব করে দেন! তিনি অতঃপর নিজেকে শ্বেতকায় দেহে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের রক্ত বহনকরা নারী বলে পরিচয় দিয়ে জানান, ক্রীতদাস প্রথার সমর্থনকারী যে ব্যাপ্টিস্ট চার্চে তাঁর শ্বেতাঙ্গ পুর্বপুরুষরা উপাসনা করত, ওখানে যাওয়া তিনি বাদ দিয়েছেন। বিকল্প হিসাবে সংখ্যালঘু আফ্রিকান-আমেরিকানদের মধ্যে প্রচলিত ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। নামাজ-রোজা প্রভৃতি রীতি-রিচ্যুয়েলের কড়াকড়ি তাঁর পছন্দ হয়নি, তবে শেখ অহমাদু বামবা প্রবর্তিত তারিকা মৌরিদ সুফি ব্রাদারহুডের সংগীত-ভিত্তিক জপ-তপ তাঁর মনে ধরেছে।

এরপর মিসেস মেলবোর আমন্ত্রণে নগরীর আফ্রিকান-আমেরিকান নেইভারহুডে আয়োজিত মৌরিদ তরিকার বাদ্যযন্ত্র-ভিত্তিক জপ-তপের একাধিক জলসায় আমরা শরিক হই। তাঁর সঙ্গে ফের আমাদের নিবিড়ভাবে মিথস্ক্রিয়ার সুযোগ হয়, কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক জর্জ ফ্লয়েডের শ্বেতাঙ্গ পুলিশের পদপিষ্ট হয়ে বেপানহভাবে খুন হওয়ার পর প্রতিবাদ মিছিলে। দেখি মিসেস মেলবো আফ্রো কেতার মোটিফ আঁকা বাটিকের রঙচঙে লেবাস পরে, ‘ব্ল্যাক লাইভস্ ম্যাটার’ লেখা প্লেকার্ডটি উঁচিয়ে বর্ণবাদবিরোধী আওয়াজ দিচ্ছেন। পর পর বেশ কয়েকটি প্রতিবাদী জমায়েতে তাঁর সঙ্গে দেখা হয়। প্রতিটি মিছিলে তাঁকে দেখি উদ্যোগ নিয়ে তরুণদের বিনীতভাবে বলছেন, জটলা না করে সামনে এগিয়ে যেতে, যাতে নানাবিধ আন্ডারলায়িং কন্ডিশনস্-এ ভোগা আমাদের মতো বয়স্ক মানুষরা সামাজিক দূরত্ব মেনটেইন করে প্রতিবাদে সামিল হতে পারে।

প্রতিবাদ কর্মকাণ্ডে এসে মিসেস মেলবোর কাছ থেকে আমরা জানতে পারি, ব্রানসউইক শহরের যে স্থানে জগ করতে গিয়ে দুজন শ্বেতাঙ্গ পিতাপুত্রের যোগসাজশে গুলিবিদ্ধ হন কৃষ্ণাঙ্গ যুবক আহমুদ আরবারি, ওখানে বর্ণবাদবিরোধী নাগরিকরা আজ জড়ো হয়ে পুষ্পমণ্ডিত করবেন ক্রুশকাঠ। পঁচিশ বৎসর বয়সের টগবগে তরুণ আহমুদ নিহত হন ২৩শে ফ্রেব্রুয়ারি। ঘটনাটি সাথে সাথে মেইনস্ট্রিম মিডিয়ায় সংবাদ হয়নি। মাস খানেক পরে যখন স্যোশাল মিডিয়ায় তাঁর হত্যাকাণ্ডের ভিডিও চাউর হয়, লকডাউনের ক্লেশে আমরা ছিলাম বিশেষভাবে ব্যতিব্যস্ত, মনোযোগ দেওয়ার মতো মানসিক অবকাশ ছিল না। তারপর নিউইয়র্ক টাইমসে ভিডিওটি সার্কুলেট হলে, প্রতিবাদীদের চাপে জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের ব্যুরো অব ইনভেশটিগেশন তদন্তের উদ্যোগ নেয়। বলতে দ্বিধা নেই, মৃত্যুর চার মাস পরও খুনি পিতা-পুত্রকে গ্রেফতার না করার উল্লেখ করে টেলিফোনে মিসেস মেলবো আমাদের এ জুলুম সম্পর্কে সচেতন করেন।

আহমুদ আরবারি

বর্ণবাদবিরোধী লাগাতার আন্দোলনের আজ ঊনিশতম দিন, আমরা যে এ মুহূর্তে ব্রানসউইকের দিকে যাচ্ছি, তার পেছনেও আছে মিসেস মেলবোর উৎসাহ। তিনি স্যোশাল মিডিয়ার হিল্লা ধরে—কোথায় কী হবে, যাবতীয় তথ্যদি সংগ্রহ করেছেন। লকডাউন উঠে গেছে বটে, তবে আন্ডারলায়িং হেল্থ কন্ডিশনসের কারণে আমাদের গৃহে অন্তরিন থাকতে বলা হয়েছে। তাই, প্রথমে লংরেঞ্জ ডিসটেন্স আমাদের দ্বিধা ছিল, কিন্তু মিসেস মেলবো পাল্টা যুক্তি হাজির করেন, তাঁর বক্তব্য ছিল পরিষ্কার, এ পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রে ‘আই অ্যাম নট আ রেসিস্ট’ বলাই যথেষ্ট না, প্রয়োজন বর্ণবাদবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে শরিক হওয়া।’ তো আমরা আজ তাঁকে নিয়ে রওয়ানা হয়েছি ব্রানসউইকের দিকে। মফস্বলী শহর-ভিত্তিক আন্দোলনটি সম্পর্কে আরো কিছু খুঁটিনাটি জানার প্রয়োজন আছে, কিন্তু পেছনে সিটে মিসেস মেলবো ঘুমিয়ে কাদা।

হলেণ চুপচাপ ড্রাইভ করছে। পথের এক পাশে নোনাজল-প্রিয় বাদামী ঘাসে ছাওয়া বিস্তীর্ণ প্রান্তর। তার ভেতরে দিয়ে সর্পিল ভঙ্গিমায় সমুদ্রের দিকে চলে গেছে খাড়ি, তাতে উর্মি তুলে আগুয়ান হচ্ছে জোয়ারের জল। মেঘভাসা আসমানের তলায় দীর্ঘ ঘাসের প্রান্তরটি লো-কান্ট্রি নামে পরিচিত। জলাভূমির এখানে সেখানে ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে রুপালি জলের পাশ ঘেঁষে উঁকি দিচ্ছে গ্রীবা সর্বস্ব শুভ্র সারস। সেলফোনে বিং করে এলান হয় ভাইরাস আপডেটের এ্যালার্ট। আর্টিফিসিয়েল ইন্টলিজেন্সের কেরেসমাতিতে মনে হয়, সেলফোনও জেনে গেছে যে, আমরা আগুয়ান হচ্ছি লো-কান্ট্রি মাড়িয়ে। চোখকোণ দিয়ে দেখি, রিঅপেনিংয়ের প্রতিক্রিয়ায় অত্র এলাকায় নতুন করে ভাইরাস আউটব্রেকের সংবাদ। এসব জায়গায় ঔপনিবেশিক যুগের আউটপোস্টের মতো গ্রাম ও মফস্বলী শহর আছে বেশ কয়েকটি। কোনো কোনো জনপদে হাসপাতাল বলে কিছু নেই, শহরে অবশ্য হেলথ সেন্টার আছে, খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে একটি-দুটি আইসিইউ ইউনিট, তবে শ্বাসপ্রশ্বাসের কষ্ট নিরসনের হাতিয়ার ভেন্টিলেটার প্রায় সর্বত্রই অনুপস্থিত। ঠিক বুঝতে পারি না, প্রশাসন এবার কোন প্রক্রিয়ায় ভাইরাসের বিস্তার ঠেকাবে? নাকি এ যাত্রায়ও কিছু না করে মুমুর্ষ মানুষজনকে সুযোগ করে দেবে মৃত্যুর।

রাজসড়কটি বেঁকে চলে এসেছে সমুদ্রের কিনারে। সামান্য ফাঁক করা জানালা দিয়ে আসে নোনাজলের গন্ধ। হলেণ জানতে চায়, ‘ইউ রিমেমবার.. ভিজিটিং কোনিয়া ইন টার্কি উইথ মি?’ আমি উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি, ‘অহ্ ইয়েস, ইট ওয়াজ ইনডিড মিনিংফুল টু ভিজিট হজরত জালাল উদ্দীন রুমিজ্ শ্যারাইন উইথ ইউ।’ সে এক হাতে খুটখাট করে ক্যাসেটটি বদলায়। এ ক্যাসেটের ধ্বনি পুরানো দিনের মতো মূর্চ্ছনা ছড়াচ্ছে দেখে খুশি হই। সুফিসন্ত রুমির মাজার সংলগ্ন মিউজিয়ামের গিফট শপ থেকে আমরা এ ক্যাসেটটিও কিনেছিলাম। গাড়ির চলমান আবহ ঘূর্ণায়মান দরবেশদের নৃত্যছন্দময় স্যামা পালনের নেপথ্য সংগীতে ভরপুর হয়ে ওঠে। সৈকতের কাছে আধডোবা হয়ে উল্টে পড়ে আছে বিরাট আকারের একটি জাহাজ। লকডাউনের দু-তিন সপ্তা আগে শত শত মোটরকার নিয়ে সেইল করা জাহাজটি কী কারণে জানি আগুন লেগে উল্টে গিয়েছিল। ঠিক মনে পড়ে না—রফতানীর পথে ডুবে যাওয়া ব্র্যান্ড নিউ গাড়িগুলোকে উদ্ধার করা হয়েছিলো কি?

দরিয়ার জলে ভেসে আসে একটি বিরাট বাণিজ্য জাহাজ। তার উত্তাল তরঙ্গ সংঘাতে আকুল হয়ে দোলে খানিক তফাতে ভাসা পালতোলা কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন সেইলবোট। হংসমরালের বন্ধনী হয়ে বাঁকানো একটি ঝাঁক চক্রাকারে ঘুরে ঝুপ ঝুপ করে ঝরে পড়ছে বালুচর সংলগ্ন জলে। হলেণ ড্রাইভ করতে করতে চোখের কোণ দিয়ে তাকিয়ে আছে সিস্ক্যাপের দিকে, বুঝতে পারি—অনেক বছর আগে আমাদের কোনিয়া ট্রিপ নিয়ে এখনই সে কিছু বলতে চাচ্ছে না। ১৯৯২ সালের ঘটনা, আমি আঙ্গুলের আঁকে বৎসরের হিসাব কষি। হলেণ কানসালটেন্সির কাজ করছিল তুরষ্কে, তার সঙ্গে সপ্তা দুয়েক কাটানোর জন্য আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে চলে গিয়েছিলাম ইস্তাম্বুলে। ওখানে পৌঁছার আগে আমি বিগতভাবে সচেতন হয়ে উঠেছিলাম ওয়ার্কপ্লেসে বর্ণবাদী আচরণ সম্পর্কে। আমি পর পর তিনটি ওভারসিজ কন্সালটেন্সিতে ফাইনালিস্ট ছিলাম। আমার দু-একজন শ্বেতাঙ্গ সতীর্থরাও একই সাথে অ্যাপ্লাই করেছিল। তারা কোনো রকমের ফিল্ড এক্সপিরিয়েন্স বা পাবলিকেশনস্ ছাড়াই কাজ পেয়েছিল, প্রাসঙ্গিক কাজে ছয় বছরের মাঠ পর্যায়ের কাজ ও অ্যাকাডেমিক প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখার অভিজ্ঞতা ছিল আমার, কিন্তু আমি নির্বাচিত হইনি। টেলিফোনে বিষয়টা জেনে হলেণই বর্ণবাদী আচরণ সম্পর্কে আমাকে সচেতন করে তোলে।

ইস্তাম্বুলের গ্র্যান্ডবাজার ও বসফরাস সংলগ্ন ওয়াটারফ্রন্ট প্রভৃতি জায়গায় ঘুরেফিরে আমাদের দিন কয়েক ভালোই কাটে। তবে কথাবার্তায় বারবার ফিরে আসতে থাকে ওয়ার্কপ্লেসে আমার বর্ণবাদী অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ। আমি যেখানে বসবাস করছিলাম, ম্যাসাচুসটেসের মফস্বল শহর অ্যামহার্স্ট, তা ছেড়ে বিরাট আকার মেট্রোপলিটান লস এ্যাঞ্জেলসে রিলকেট করার সম্ভাবনা হলেণ আমাকে ভেবে দেখতে বলে। তার যুক্তি ছিল—কসমোপলিটান নগরীতে নানা গাত্রবর্ণের মানুষজন বাস করছে কাছাকাছি, ওয়ার্কপ্লেসেও গাত্রবর্ণের বৈচিত্র প্রচুর, ‘আই গেজ, ইউ উইল ফিট ইন অ্যা বিগ সিটি রাইট অ্যা ওয়ে, বড় শহরে ভিন্ন গাত্রবর্ণের মানুষদের কর্মপ্রাপ্তির সম্ভাবনা অঢেল।’ সে লসএঞ্জেলসে তার সঙ্গে একত্রে লিভ টুগেদার করতে উৎসাহ দেয়।

ইস্তাম্বুল থেকে পুরো আটঘণ্টা বাস জার্নি করে আনাতোলিয়ার কোনিয়া শহরে পৌঁছে আমরা এত ক্লান্ত ছিলাম যে সকালে আর গেস্টহাউস থেকে বেরোইনি। আধশোয়া হয়ে শর্টওয়েভ রেডিয়ো শুনছিলাম। খবরে লসএঞ্জেলস্ নগরীতে রডনি কিং রায়টের কথা বিস্তারিতভাবে শোনা যায়। কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষ রডনি কিংকে গ্রেফতার করে চারজন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ কর্মকর্তা তাঁকে সড়কের ওপর ইলেকট্রিক শক দিয়ে বেধড়কভাবে পেটায়। ঘটনাটি ক্যামকর্ডারে ভিডিও করেন একজন পথচারী। তা মিডিয়ায় প্রচারিত হলে প্রতিক্রিয়ায় আদালতে বিচার বসে। তাতে জুরি অনেক বিচার-বিবেচনা করে অতঃপর পুলিশ অফিসারদের বেকসুর খালাস ঘোষণা করেন। ফলশ্রুতিতে লসএঞ্জেলস্ জুড়ে চলছে অগ্নিকাণ্ড, মৃত্যু হয়েছে বেশ কিছু মানুষের, পুলিশ গ্রেফতারও করেছে অনেক নাগরিককে, যাদের বেশিরভাগই হচ্ছেন কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকান মানুষ।

সেলজুক সুলতানদের হাতে গড়া কোনিয়া নগরীতে পর্যটনের মতো ঐতিহাসিক স্থাপনা বিস্তর। ভেবেছিলাম, একটু বিশ্রামের পর প্রথমে ‘আলেদিন টেপে’-তে যাব পুরানো দিনের কেল্লা সংলগ্ন নগর প্রাচীর দেখতে, যেখানে এক জামানায় শানশওকতে দাঁড়িয়ে ছিল আলেদিন কায়কোবাদের বিপুল এক প্রাসাদ। তারপর গেস্টহাউসে ফেরার পথে সুলতান সেলিমের নির্দেশে তৈরি মসজিদটির পাশের গলিতে কোনো ক্যাফেতে ঢুকে এক পেয়ালা টার্কিশ কফি পান করতে করতে স্রেফ তাকিয়ে থাকব মিনার-গুম্বুজে চিত্রার্পিত আকাশের দিকে। কিন্তু লসএঞ্জেলসে রায়টের সংবাদ আমাদের করে তুলে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন। রিল্যাক্স হালতে পর্যটন করার উৎসাহ আমরা হারিয়ে ফেলি। বেশ কিছুক্ষণ ঝিম ধরে বসে থাকার পর হলেণ প্রস্তাব করে মেভলানা মিউজিয়ামে যাওয়ার। মিউজিয়ামটি হজরত রুমির মাজারের কমপাউন্ডে তৈরি করা হয়েছে তুরষ্কে কামাল আতাতুর্কের সংস্কার-প্রবণ জামানায়। ট্যাক্সিতে বসে কথাবার্তায় জানতে পারি, সংকট দেখা দিলে, কিংবা উদ্বেগ বিপুল হয়ে উঠলে, ইস্তামবুলের দরবেশী তরিকার কোনো মাইফেলে গিয়ে কিছু সময় কাটিয়ে আসা হলেণের অভ্যেস হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মেভলানা স্কোয়ারে এসে ট্যাক্সির ভাড়া মেটানোর সময় দেখতে পাই পরিসর মহিমান্বিত করে দাঁড়িয়ে থাকা সেলিমিয়া মসজিদের গুম্ভুজ ও মিনার। হজরত রুমির দরগা, যা তুর্কি জবানে ‘তাকে’ নামে পরিচিত, তার কমপাউন্ডে ঢোকার মুখে পড়ে দারুণভাবে অলংকৃত ‘দারভিশান কাপিসি’ বা দরবেশদের তোরণ। কাছেই হজরত রুমির মাজার, মানসিক প্রস্তুতি না নিয়ে এসে পড়েছি, তাই দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জিয়ারত করে আমরা চলে আসি ‘সেমাহেইন’ বা ঘূর্ণায়মান দরবেশদের নৃত্যের পরিসরে। ওখানকার কার্নিশে বসে এক জোড়া ঘুঘু কেবলই ডেকে চলছে। সামান্য সময় জাদুঘরে কাটিয়ে আমরা চলে আসি গুলবাগে। ফোয়ারার ঝিরিঝিরি শব্দের সাথে গোলাপের সৌরভ মিশে ওখানে তৈরি হয়েছে আশ্চর্য এক পরিবেশ। তরুণ এক দরবেশ এসে আমাদের দিকে গোলাপপাশ বাড়িয়ে দিয়ে সন্ধ্যাবেলা ঘূর্ণায়মান দরবেশদের স্যামা মাহফিলে সামিল হওয়ার দাওয়াত দেন। হলেণ ধর্মে মুসলমান নয়, এ তথ্যটি সে জানালে, তিনি মৃদু হেসে তার কব্জি স্পর্শ করে ক্যালিওগ্রাফিতে হজরত রুমির ইংরেজিতে অনুবাদসহ মসনবী লেখা একটি লিফলেট বাড়িয়ে দেন। গুলবাগে কিছুক্ষণ কাটিয়ে আমরা ফিরে আসি গেস্টহাউসে। বিকালে ফের লিফলেটটি পড়ি, সাথে সাথে অনুধাবনের সুবিধার জন্য মার্জিন টুকে রাখি আমার ভাবতর্জমা। অনেক বছর পরও গাড়িতে ব্রানসউইকের দিকে যেতে যেতে রুমির কবিতার বিষয়বস্তু নিয়ে ফের ভাবি; ধর্ম, গোত্র ও বর্ণ-ভিত্তিক বিভেদের ঊর্ধ্বে উঠে, সবাইকে একই কাফেলায় দাওয়াত দেওয়ার নির্দশন আজও আমার স্মৃতিতে বেনজীর হয়ে আছে। ভাবি, কোনো এক সুযোগে নিচে উল্লেখিত হজরত রুমির কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ খুঁজে বের করে তা মিসেস মেলবোর সঙ্গে শেয়ার করতে হয়।

এসো তুমি—ডাকছি আবার
এসো—আমাদের কাফেলায় আজ
পৌত্তলিক! পরিচয়ে কিবা কাজ,
অগ্নি উপাসক,
না হয় হলেইবা তপস্বী বক!
নাহকে নিমজ্জিত হয়ে—
করেছো বুঝি হাজারো পাপ,
আর ওয়াদার বরখেলাফ।

কিছু যায় আসে না—এসো
এসো, দাওয়াত হেঁকে যাই
হরেক কিসিম মানুষের কাফেলায়
তোমারও হবে যে ঠাঁই।

বাকি অংশ পড়তে ক্লিক করুন

   

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন



রামকৃষ্ণ জানা
দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

দক্ষিণ এশিয়ার নদী-অববাহিকায় চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন

  • Font increase
  • Font Decrease

রামকৃষ্ণ জানা

[বিশ্ব নদী দিবস প্রতিবছর সেপ্টেম্বর মাসের চতুর্থ রোববার। বিশ্ব নদী দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ‘রাইটস অব রিভার'। বিশ্বেরা অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে দিবসটি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আয়োজন করা হয়েছে বিভিন্ন কর্মসূচি। ইতিহাসবিদ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপক ড.  রূপকুমার বর্মণ নদী ও ইতিহাসের চর্চায় উন্মোচন করেছেন মানুষ, সমাজ, সংস্কৃতি ও রাজনীতির বাহুমাত্রিক বিন্যাস।]

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলির মধ্য দিয়ে অসংখ্য নদী প্রবাহিত হওয়ার কারণে প্রতিনিয়ত নদী-অববাহিকাগুলোতে ঘটে চলেছে আভ্যন্তরীণ অভিবাসন যা বিশ্বব্যাপী অভিবাসনচর্চার অন্যতম বিষয় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বর্তমানে নদীকে বহুমুখী ব্যবহারের মাত্রাবৃদ্ধির ফলে উদ্ভূত নদীজনিত সমস্যার কারণে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের াা অঞ্চলের মানুষেরা নিজেদের জীবনকে রক্ষা করতে জোরপূর্বক অভিবাসনে বাধ্য হচ্ছে। এইরকম একটি প্রেক্ষাপটকে ড. রূপকুমার বর্মণ তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দিয়েছেন।   

মোট তিনটি অধ্যায় এবং পর্যাপ্ত সংখ্যক সারণীসহ এই বইটিতে একই সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় আলোচিত হয়েছে। গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে নদীমাতৃক বাংলার জেলেসম্প্রদায়ের মানুষের জীবনজীবিকার ওপরে নদীর অপরিসীম প্রভাব। ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে লিখিত বিভিন্ন সাহিত্যগুলি যে তৎকালীন সমাজের দর্পণ-লেখক তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটকে সাহিত্যের নিরিখে  বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন। অদ্বৈত মল্লবর্মণের লেখা ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ নামক উপন্যাসকে লেখক উক্ত অঞ্চলের মৎস্যজীবী সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে শুধু নদীর সম্পর্কের আলোচনায় সীমাবদ্ধ না রেখে একে কেন্দ্র করে নদী-উপকূলবর্তী মানুষের জীবনসংকট ও তারই প্রভাবে যে তাদের অভিবাসন ঘটেছিল সেই প্রেক্ষিতকে নদীর ইতিহাসচর্চার মাধ্যমে নতুনভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। কীভাবে তিতাস-অববাহিকায় মালোসম্প্রদায়-অধ্যুষিত চরটি একে একে জনশূন্য হয়ে উঠেছিল-তাও এতে পরিস্ফুটিত। বর্তমানে পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় আভ্যন্তরীণ অভিবাসনের একটি প্রামাণ্য দলিল রূপে বর্ণিত এই উপন্যাসকে কেন্দ্র করে মানুষের আভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি ও অভিবাসন সংকটের কথাকে স্মরণ করিয়ে ডঃ বর্মণ এই সাহিত্যকে ইতিহাসের এক অন্যতম আধারে পরিণত করেছেন। 

ই. এইচ. কার(E. H. Carr)-এর ইতিহাসচর্চার মূল নির্যাস-‘ইতিহাসকে জানার আগে ঐতিহাসিক কে. জানো’-এ সম্পর্কে গ্রন্থকার পূর্ণমাত্রায় সচেতন। তিনি মালোজাতির ইতিহাসকে তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে বুকানন হ্যামিল্টন(Francis Buchanan-Hamilton), নৃতত্ত্ববিদ জেমস(Dr.James Wise) ও রিসলে(H.H. Risley) প্রদত্ত বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জেলেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করেছেন। পরবর্তীকালে ঔপনিবেশিক সরকারের হীনবিভাজন নীতি থেকে মুক্তি পেতে তারা যে ১৯১৩ সালে ‘ঝালো-মালো ক্ষত্রিয় সমিতি’ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সংস্কৃতায়ন ঘটিয়েছিল লেখক তা বর্ণনা করেছেন।   

অধ্যাপক বর্মণ গ্রন্থের দ্বিতীয় অধ্যায়ে আসাম ও বাংলার নদী-উপত্যকাগুলিতে বসবাসকারী মানুষদের সার্বিক জীবনের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের সাক্ষী হিসেবে ঐ অঞ্চলের নদীকেন্দ্রিক সাহিত্যগুলোকে তাঁর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে ব্যবহার করেছেন। দেবেশ রায় রচিত ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’-কে লেখক একজন ঐতিহাসিকের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখিয়েছেন যে একটি নদী  কীভাবে আঞ্চলিক স্তরের সংগ্রাম থেকে মানুষকে আন্তর্জাতিক স্তরের সংগ্রামে উত্তীর্ণ করতে পারে। তিস্তা নদী রাজবংশী সম্প্রদায়ের কাছে ছিল এক দেবীস্বরূপা আবার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশ থেকে আগত প্রভূত মানুষের কাছে এই নদী-উপকূল হয়ে উঠেছিল আশ্রয়দাত্রী জননীস্বরূপা। এই প্রসঙ্গে লেখক অত্যন্ত সুচারুভাবে এই অঞ্চলের আদিবাসিন্দা রাজবংশী সম্প্রদায় ও আগন্তুক উদ্বাস্তু বাঙ্গালীর দ্বন্দ্বকে তাঁর লেখনীর মাধ্যমে তুলে  ধরেছেন। যুক্তফ্রন্ট সরকার ও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গৃহীত বিভিন্ন ভূমিসংস্কারমূলক পদক্ষেপ (যেমন-‘অপারেশন বর্গা’) এই রাজবংশী সম্প্রদায়ের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার ঘটায় এবং ইউ. কে. ডি. (UKD) ও ইউ. টি. জে. এ. এস. (UTJAS)-নামক আঞ্চলিক দলগুলি অচিরেই তাদের পূর্বতন দাবী তথা কামতাপুর রাজ্যগঠনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তিনি দেখিয়েছেন ভারত ও বাংলাদেশ জলবণ্টনচুক্তি অনুযায়ী তিস্তা নদীতে বাঁধ নির্মাণের দ্বারা সরকার মানুষের উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট হলেও সেই উন্নয়নযজ্ঞই কীভাবে নদী-উপকূলবর্তী মানুষগুলোকে বঞ্চনার শিকারে পরিণত করেছিল। অবশেষে ডঃ বর্মণ প্রশ্ন তুলেছেন-বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর মানুষ কি তবে তিস্তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে নাকি এখনও  মানুষ তিস্তার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে?  

এরই সঙ্গে গ্রন্থকার সাহিত্যিক জিতেন্দ্র দাস লিখিত ‘কলহি নদীর একুল হিকুল’-গ্রন্থের ইতিহাসনির্ভর বিশ্লেষণের মাধ্যমে তৎকালীন আসামের বিশেষত দিপার বিলসংলগ্ন এলাকায় বসবাসকারী মানুষের জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতকে একটি বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে তুলে ধরেছেন। কালক্রমে এই নদীর চরে অশান্তির বার্তা বহন করে আনে বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন এবং এরই  ফলশ্রুতিতে এখানে শুরু হয় বহিরাগত ও স্থানীয় মানুষদের সমাজের সর্বক্ষেত্রে আধিপত্য স্থাপনের এক তীব্র অসম লড়াই। অসমের একটি নদীচরের মানুষের আভ্যন্তরীণ সংকট কীভাবে একটি বৃহত্তর আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়েছিল তা লেখক বর্ণনা করেছেন। 

এই গ্রন্থের তৃতীয় অধ্যায়ে ড.  রূপ কুমার বর্মণ তাঁর বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন যে, ভুটানের ওয়াং-চু (পশ্চিমবঙ্গে রায়ডাক ও বাংলাদেশে দুধকুমার নামে পরিচিত) নদী কীভাবে ভুটানের প্রাকৃতিক সম্পদ ও অর্থনৈতিক সম্পদকে নিয়ন্ত্রণ করে ক্রমশ সমগ্র ভুটানবাসীর জীবনের অবলম্বন হয়ে উঠেছে। অন্যদিকে ভুটানের বৌদ্ধধর্মকে কেন্দ্র করে কীভাবে এই নদী ভুটানবাসীর মনে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছিল তার ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন।  লেখকের বর্ণনায় প্রাধান্য পেয়েছে রায়ডাক-১ ও রায়ডাক-২ নদীর গতিপথে অসম ও বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় উদ্ভূত ঝাউকুঠি, বলাভুত ও রামরাই কুঠির মত অসংখ্য চরে বসবাসকারী মানুষের জীবনসংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। তিনি দেখিয়েছেন যে এই অঞ্চলে প্রাচীনকাল থেকে কোচ, মেচ, রাভা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর সাথে সাথে এখানকার অনেকটা অংশ জুড়ে রয়েছে রাজবংশী মানুষের বসতি। ঔপনিবেশিক আমলে ছোটনাগপুর অঞ্চল থেকে সাঁওতাল, কোল, ভিল, মুন্ডাদের শ্রমিক হিসেবে আগমনের ফলে এই নদী-অববাহিকার বসতিগুলি এক মিশ্র সংস্কৃতির পীঠস্থান হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব-পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ) থেকেও অনেক মানুষকে এই অঞ্চল সাদরে গ্রহণ  করে নিয়েছিল। ডঃ বর্মণের নৃ-তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে এইভাবেই এই নদী-অববাহিকা হয়ে উঠেছিল এক টুকরো ভারতবর্ষ।  

লেখক এই অধ্যায়ে আরও দেখিয়েছেন যে একই নদীর জল বহুধর্ম ও বহুসংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে চলেছে আবহমানকাল ধরে। কোচবিহারের রাজাদের অনুগ্রহে কামাক্ষ্যা মন্দিরের ভিত্তিস্থাপনের ইতিহাস লেখক তুলে ধরেছেন। পরবর্তীতে আবার এই রাজারা এই অঞ্চলেই একাধিক শিবমন্দির স্থাপন করে কোচবিহারের প্রধান দেবতা হিসেবে শিবকে স্থান দেন। অন্যদিকে এখানেই শঙ্করদেবের হাত ধরে একসময় যে বৈষ্ণবধর্মের উত্থান ঘটেছিল তা পরবর্তীতে কোচসাম্রাজ্যের রাজধর্মে পরিণত হয়। তিনি বর্ণনা দিয়েছেন কীভাবে বৈষ্ণবসত্রগুলি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন হয়ে পড়েছিল। একদা কোচপ্রশাসনের ওপর বৈষ্ণবধর্মের প্রভাব এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে তাঁরা নিজেদের নামের সাথে ‘নারায়ণ’ উপাধি সংযোগ করেছিলেন ও কোচমুদ্রার নাম ‘নারায়ণী মুদ্রা’ রেখেছিলেন। সেইসঙ্গে এই অঞ্চলে লৌকিক দেবদেবীরও পূজা-পাঠ প্রচলিত ছিল। তিনি ব্যাখ্যা করেছেন যে ঔপনিবেশিককালে খ্রিষ্টান মিশনারীরা ‘ইভানজেলিকালিজম্’ ধারণার বশবর্তী হয়ে রাভা ও মেচ উপজাতিদের কীভাবে খ্রিষ্টানধর্মে ধর্মান্তরিত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং এইসকল প্রান্তিক মানুষদের জীবনে পাশ্চাত্য ধর্ম ও শিক্ষা প্রবেশের সাথে সাথে তাদের নিজেদের চিরায়ত ঐতিহ্য, ধর্ম-সংস্কৃতির যে পরিবর্তনগুলি ঘটেছিল সে বিষয়েও তিনি আলোকপাত করেছেন।

তবে আলোচ্য গ্রন্থে এই অঞ্চলের অন্যান্য অনেক নদীর কথা লেখকের আলোচনায় স্থান পায় নি। তিনি এই অঞ্চলের নিম্নবর্গের মানুষের ইতিহাসকে তুলে ধরলেও তাঁর লেখায় একটি বিশেষ জনজাতির কথা প্রাধান্য পেয়েছে। নদীর অভিশাপ তাহলে কি শুধুমাত্র জেলেসম্প্রদায়ের ওপর পড়েছিল কিংবা ঝালো-মালো সম্প্রদায়ের বর্তমান সামাজিক অবস্থান কেমন-এসকল প্রশ্নের উত্তরসন্ধানে লেখক নীরব থেকেছেন। তিনি অভিবাসনের ফলে সৃষ্ট এই অঞ্চলের আদি-অধিবাসীদের ক্ষোভের কথা উল্লেখ করলেও বাঙ্গালী উদবাস্তুর যন্ত্রণার কথা তাঁর লেখায় উহ্য থেকেছে। নদীকেন্দ্রিক উন্নয়নযজ্ঞ এই অঞ্চলের জনজাতিবিন্যাসকে কতখানি প্রভাবিত করেছিল তা আরও স্পষ্টভাবে পরিস্ফুটিত হলে তা পাঠকের মনে অধিক আগ্রহের সঞ্চার করত। কামতাপুর রাজ্যের দাবী উত্থানের পশ্চাতে অন্যান্য ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের ভূমিকা এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলনের ফলে দেশের অভ্যন্তরে বাঙ্গালীদের অভিবাসনের ঘটনা লেখক ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরেছেন।

ডঃ বর্মণ তাঁর লেখা এই বইটিতে দেখিয়েছেন যে কোন অঞ্চলের ইতিহাস জানার ক্ষেত্রে সেই অঞ্চলকেন্দ্রিক রচিত সাহিত্যগুলি কীভাবে ইতিহাস রচনার প্রামান্য দলিল হয়ে উঠতে পারে। সাহিত্যে প্রতিভাত দলিত মানুষের জীবনসংগ্রামকে নদীকেন্দ্রিক ইতিহাসচর্চায় স্থান দিয়ে লেখক তাঁর অনন্য রচনাশৈলীর পরিচয় পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। নদী কীভাবে জনমানসের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দীপিত করতে পারে এবং সেইসঙ্গে মানুষের জীবনধারণের অর্থনৈতিক কাণ্ডারী হয়ে উঠতে পারে তা লেখক তাঁর সুদক্ষ লেখনীর মাধ্যমে প্রমাণ করেছেন। তাঁর লেখায় নদী হয়ে উঠেছে নদী-অববাহিকা অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর গোষ্ঠীগত এবং জাতীয়তাবাদী ভাবধারার প্রতীক। আবহমানকাল ধরে নদী মানুষের অভিবাসনের ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সাক্ষী থেকেছে এবং দ্বন্দ্বপ্রসূত অভিবাসনের ফলশ্রুতিতে সৃষ্ট আদি-অধিবাসী ও আগন্তুক সম্প্রদায়ের লোকেদের মধ্যে গড়ে ওঠা সম্পর্কের দলিল এই উপন্যাসকেন্দ্রিক ইতিহাস-বিশ্লেষণ। উত্তরবঙ্গের কামতাপুরি আন্দোলন(১৯৬৯) এবং অসমের বঙ্গাল খেদাও আন্দোলন(১৯৭৯-১৯৮৫) উদ্ভবের ক্ষেত্রে নদী কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক হয়ে ওঠে তা লেখকের ইতিহাসচর্চায় এক বিশেষ স্থান দখল করে রয়েছে। সেইসঙ্গে নদী কীভাবে ধর্ম-সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করতে পারে তার এক নির্ভরযোগ্য ইতিহাস-বিশ্লেষণ লেখকের লেখনীতে পরিস্ফুটিত হয়েছে। উত্তরবঙ্গ ও অসমের পরিবেশ-ইতিহাসচর্চায় এই বই যে কতখানি মূল্যবান তা পাঠক  বইখানি পাঠের পর সহজেই উপলব্ধি করতে পারেন।     

......

গ্রন্থ সমালোচনা

Rup Kumar Barman, River, Society and Culture: Environmental Perspectives on The Rivers of Assam and Bengal. Delhi: Primus Books, 2023, xix+95pp, ISBN: 978-93-5687-835-8(Paperback)

.........

রামকৃষ্ণ জানা ,গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়।

;

গড়তে চান বই পড়ার অভ্যাস?



মোঃ শরীফুল ইসলাম, নিউজরুম এডিটর, বার্তা২৪.কম
বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশের জন্য বই পড়ুন

  • Font increase
  • Font Decrease

লাইব্রেরিগুলো আজকাল ফাঁকা পড়ে থাকে। ক্যাম্পাসের আড্ডায় বই, সে বড়ই হাস্যকর! বই পড়ার মতো সময় হয়ে ওঠে না কারোরই! আমাদের বর্তমান সময়টা কেড়ে নিয়েছে মোবাইল আর ইন্টারনেট। অথচ বই পড়ার গুরুত্ব কমবেশ সকলেরই জানা।

মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার জন্য বই কতটা জরুরি সেটা আমাদের অজানা নয়। কিন্তু একটি বই পড়ার জন্য যে সময় প্রয়োজন, প্রয়োজন উপযুক্ত স্থান। সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, সঠিক বই নির্বাচন।

বই পড়া শুরুর ক্ষেত্রে নতুন পাঠকরা নানান সমস্যার সম্মুখীন হন। এই সমস্যা কাটিয়ে উঠতে না পেরে অনেকের আর বই পড়াই হয় না। আজকের আলোচনায় আমরা জানব কীভাবে একটি বই পাঠ করা যায়, গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস।

সময়: বই পড়ার কথা বললেই সবাই এক বাক্যে বলবে, ‘সময় নেই!’ সময় নিয়ে আমাদের অভিযোগের বড় কারণ হলো, নিজের কাজগুলো গুছিয়ে না করা। প্রতিদিন মাত্র ২০-৩০ মিনিট সময় দিয়েই কিন্তু গড়ে তোলা যায় বই পড়ার অভ্যাস। সময় না পাওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ইন্টারনেট আর সোশ্যাল মিডিয়া। তাই, সকাল কিংবা সন্ধ্যা হাতের ফোনটা দূরে সরিয়ে কিছুক্ষণের জন্য বসে যান বই নিয়ে।

পরিবেশ: উপযুক্ত পরিবেশ বই পড়ার মনোযোগ বাড়িয়ে দেয়। জানালার পাশে, বেলকনিতে কিংবা বাসার ছাদে বই পড়ার স্থানটি যেন হয় নির্জন এবং শান্ত। আজকাল বিভিন্ন পার্কে ‘নীরব বই পাঠ কর্মসূচি’ দেখা যায়। চাইলে যোগ দিতে পারেন তাঁদের দলেও। বই পড়ার পাশাপাশি পরিচয় হবে বইপ্রেমী মানুষদের সাথে।

বই নির্বাচন: বই পড়ার ক্ষেত্রে ইচ্ছে যেমন জরুরি তেমনি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সঠিক বই নির্বাচন। এক্ষেত্রে নিজের ভালো লাগাকে প্রাধান্য দিন। যেসব গল্প আপনাকে আকর্ষণ করে শুরুতে সেই বইগুলোকেই আপনার পাঠ্য তালিকায় রাখুন। 

পাঠাগার: পাঠাগারে গেলেই যে বই পড়তেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। বইয়ের সাথে সময় কাটালে এক সময় সেটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছে হবে। আর ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে কখন যে দু’য়েক পাতা পড়ে ফেলবেন, নিজেই টের পাবেন না! তাই বই পড়ার অভ্যাস গড়তে চলে যান পাঠাগারে। বই না পড়ুন, অন্তত সুন্দর সুন্দর ছবি তোলা তো হবে!

সোশ্যাল মিডিয়া: আমরা সবকিছুতেই সোশ্যাল মিডিয়াকে দায়ী করি। অথচ সোশ্যাল মিডিয়ার সুষ্ঠু ব্যবহার আপনার অভ্যাস গড়ার বড় সহায়ক। ফেসবুকে সাহিত্য তথা বই বিষয়ক বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। যেখানে বিভিন্ন বই নিয়ে আলোচনা হয়, হয় বই বিষয়ক আড্ডাও। এসব গ্রুপে যুক্ত হয়ে বাড়াতে পারেন বইয়ের সাথে নিজের সম্পৃক্ততা।

ধারাবাহিকতা: বলা হয়ে থাকে টানা ২১ দিন কোনো কাজ করলে সেটা অভ্যাসে পরিণত হয়। বই পড়ার ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম নয়। অভ্যাস গড়তে হলে ধরে রাখতে হবে ধারাবাহিকতা। সামান্য হলেও প্রতিদিন পড়ুন। এই ধারাবাহিকতায় আপনার বই পড়াকে অভ্যাসে পরিণত করবে। 

বই পড়ার অভ্যাস রাতারাতি তৈরি হবে না। এজন্য প্রয়োজন ধৈর্য্য এবং অধ্যাবসায়। নতুন পাঠকদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, কিছুদূর পড়ার পর বইটি আর ভালো লাগে না। এক্ষেত্রে ধৈর্য্যহারা হওয়া যাবে। জোর করে সে বই পড়ার প্রয়োজন নেই।

বই মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়তে পারলে জীবনে উন্নতি সাধন অবধারিত। একাডেমিক পড়ার বাইরেও বইয়ের বিশাল একটি জগত রয়েছে। সেই জগতে মানুষ জানার জন্য পড়ে, পড়ে জ্ঞান অর্জনের জন্য। বই পড়লে মানসিক চাপ হ্রাস পায়, হয় মস্তিস্কের ব্যায়াম, বাড়ে শব্দ ভান্ডার ও স্মৃতি শক্তি। বই পাঠকের চিন্তার জগতকে বিস্তৃত করে, বৃদ্ধি করে বিশ্লেষণ ক্ষমতা। বই পড়ার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তি ও মননশীলতার বিকাশ হয়। তাই বই হোক প্রত্যেক মানুষের উত্তম বন্ধু এবং বইয়ের সঙ্গে হোক আমাদের মিতালি।

;

মায়ের সমাধির খোঁজে



মহীবুল আজিজ
মায়ের সমাধির খোঁজে

মায়ের সমাধির খোঁজে

  • Font increase
  • Font Decrease

কন্ডাক্টরকে বললাম, এখানে নামিয়ে দিন,
এখানে এই মিয়াপাড়ায় আমি নামবো—
মিয়াপাড়া কবরস্থানে শুয়ে আছে আমার মা।
মায়ের কবর দেখতে এলাম আটান্ন বছর পরে,
জ্যাঠা বলেছিলেন, গেট দিয়ে ঢুকে ডানদিকে একটু গেলে
একটা গোলাপ গাছ ঘেঁষে কবরটা,
কবরের আগে আমাকে গোলাপ গাছ খুঁজতে হয়—
জ্যাঠা চলে গেছেন তা-ও বত্রিশ বছর।
ডানদিকে ঘুরতেই জড়িয়ে ধরে তাজা গোলাপের ঘ্রাণ,
পাশাপাশি চারটা কবর, চারটাতেই গোলাপের পাহারা;
এত কবর এত কবর, কবরে ভর্তি কবরস্থান—
কোথায় শেষ শয্যা নিয়েছিলেন আমার মা!
হাওয়ায় পাতা দোলে গোলাপের, চারটাই একসঙ্গে,
চারটা গাছ থেকেই মুখবাড়ানো গোলাপ ডাক দেয়—
এইখানে এইখানে এইখানে—কোন্খানে!
উবু হবো কবরের মাটি নিতে
কিন্তু চারটাই ডানদিকে, চারটাই গোলাপের পাশে,
প্রতিটি কবর থেকে একটি একটি মুঠো নিয়ে
পলিথিনের চারটে ব্যাগে রাখি।
একবার মনে হয় প্রথমটাতে,
তারপর মনে হয় দ্বিতীয়টাতে,
আবার মনে হয় তৃতীয়টাতে
এবং মনে হয় চতুর্থটাতে সন্ধান রয়েছে মায়ের।
মা সুপ্ত থেকে যান অনির্দিষ্ট মাটিতে ,
তবে কোন্ মানবের মাটি ধরে রাখি বুকের কাছে!
ঠিক তখন বিস্ময়ের মতন একটি ফুটন্ত গোলাপ
গাছ থেকে ঝরে পড়ে দ্বিতীয় কবরে,
সংশয়ী মন বলে, তবে কী গোলাপই বার্তাবহ মায়ের!
অদৃষ্টে অবিশ্বাসী মন দোলে সংশয়ে,
তখন আরেকটি গোলাপ ঝরে পড়ে চতুর্থ কবরে।
অর্থাৎ দুই যোগ দুইয়ে এসে আমার আর হিসেব মেলে না,
জ্যাঠা বলেছিলেন, কবরটা গেটের ডানদিকে ঘুরতেই
এবং গোলাপের পাশে।
বত্রিশ বছরে চতুর্গুণ হয়েছে গোলাপ
কিন্তু এক ও অবিভাজ্য আমার মা’কে
এই গোলাপের কারণেই খুঁজে পাই না আমি—
ফিরে আসি শুধু গোলাপের ঘ্রাণ নিয়ে।

১১-০৯-২০২৩

;

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল



শরীফুল আলম
অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

অর্ধেক রিয়েল, অর্ধেক ভুল

  • Font increase
  • Font Decrease

 

আমি সীজার হতে চাইনি
তবুও তুমি ক্লিওপেট্রাই থেকে গেলে
অহেতুক লড়াইয়ে তুমি জয়ী হতে চেয়েছিলে
সম্ভবত একেই পরিযায়ী প্রেম বলে
আলো আঁধারীর খেলা বলে
স্বপ্ন আর জেগে থাকা বলে ,
সমাপ্তি কিম্বা বিবিধ, তা সে যাই হউক
এই সহজ কথাটি
আমরা কেউ কাউকে সহজ ভাবে বলতে পারিনি
অথচ তুমি ফ্রিজিডেয়ারটি বন্ধ করে রাখলে
আর বললে, "নোটেড ",

নিউইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।
হ্যাঁ, এটাই সত্যি
তুমি লৌহশৃংখলে অনুজ্জ্বল এক ডিমলাইট
সুচারু মোহের অভাবে তুমি প্রমত্তা নদী
বাবুই পাখীর বাসার ন্যায় তুমি ঝুলে থাক আমার স্বপ্নে
যা হতে পারতো নির্মল এক সবুজের প্রান্তর ।

তুমি ওঁত পেতে থাকা বাঁশপাতার ফাঁকে পূর্ণিমা
আমি তোলপাড় করে ছুটে চলা এক্সপ্রেস ট্রেন
দলছুট শালিক,
আজ কোন বৈভব নেই
ভালোবাসাবাসি নেই ,
কবিতাও ইদানিং প্রিয় লাগেনা
তবু স্নায়ুরা জেগে থাকে
মনে হয় হলুদ পাতায় যেন ক্লোরোফিল
আমিও প্রবণতায় ফিরে যাই সাইবেরিয়া ।

আনচান মনে কত আকুলতা
কালবৈশাখীর তান্ডব
যেন বাতাসে কাঁপন ধরে,
এসো সখা,
এই শ্রাবণে আবার রিডিজাইন করি,
স্যাটেলাইটে প্যারালাল বার্তা পাঠাই
ভুলে যাই অর্ধেক রিয়েল আর অর্ধেক ভুল
প্লাবনে অবাধ্য ঢেউয়ের উছ্বল ।

________________________________________

 ৯ সেপ্টেম্বর । ২০২৩।
নিউইয়র্ক । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ।

 

;