অনুগমন



মশিউল আলম
অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

অলঙ্করণ: আনিসুজ্জামান সোহেল

  • Font increase
  • Font Decrease

‘না রে ইদ্রিস, গাঁওত আর থাকমু না, শহরত চলে যামু। শহরত যায়া ইশকা চালামু আর খালি ছিনামা দেখমু।’ জয়নাল ভাত খেতে বসে বকবক করছে।

ইদ্রিস পাত্তা দিচ্ছে না। সে আপন মনে খাচ্ছে: ধবধবে সাদা ভাত, নতুন আলুর ভর্তা, বাঁধাকপি ভাজি, খেসারি কলাইয়ের ডাল, কাঁচা মরিচ, মিছরির মতো সাদা নুন।

ইদ্রিস যে জয়নালের কথায় ভ্রুক্ষেপ করছে না জয়নাল তা দেখতেই পাচ্ছে, কিন্তু তাতে জয়নালের কথা বলায় কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কথা বলার জন্য তার শ্রোতার দরকার হয় না। শহরে গিয়ে সিনেমা দেখার স্বপ্নের কথা বলতে বলতেই সে বলছে অন্যের গৃহস্থালিতে আর কামলা খাটবে না, জমি আধি-পত্তন নিয়ে বর্গাচাষী হয়ে নিজের গৃহস্থালি গড়বে। আবার সঙ্গে সঙ্গেই বলছে যে অন্যের জমি আধি নিয়ে চাষাবাদ করতে গেলে নিজের হাল থাকতে হয়, নিজের গরু থাকতে হয়, কিন্তু তার এসবের কিছুই নাই। পত্তন নিয়ে চাষ করতে হলে আগে জমির মালিকের হাতে পত্তনির টাকা তুলে দিতে হয়, তার পরেই শুধু তার জমিতে নামা যায়।

‘মুই তো কিষান! গিরস্তবাড়িত কাম করে খাঁও। মুই ট্যাকা পামু কোন্টে জি জুমি পত্তন লিমু? হাল কিনমু, গরু কিনমু?’ জয়নাল বলল।

কিন্তু ইদ্রিসের দিক থেকে কোনো সাড়া এলো না। ইদ্রিস গোগ্রাসে ভাত খাচ্ছে।

‘আলু-পোটলের ব্যবসা করমু রে! ব্যাপারি হমু।’ জয়নাল বলল।

ইদ্রিস কাঁচা মরিচে কামড় দিয়ে কচমচ করে চিবুতে লাগল।

‘কিন্তুক ব্যবসা করতেও তো পুঞ্জি লাগবে। মুই ট্যাকা পামু কোন্টে?’ জয়নাল বলল।

ইদ্রিস এক ঢোক পানি খেয়ে বিরাট এক গ্রাস ভাত মুখে পুরল।

‘না রে, এইগুলা কেছু হোবে না। এইবার শিবগঞ্জের মেলাত যাত্রাপাটি অ্যালে ওরগে সাতে যোগ দিমু। দ্যাশ-বিদ্যাশ ঘুরে বেড়ামু। কী মজা হোবে রে! জিন্দেগি মোর ফাইন হয়া যাবে!’ জয়নাল বলে চলল। ইদ্রিস আপন মনে ভাত খেয়েই চলল।

জয়নাল চাচির ঘরে মানুষ। চাচার জমি-জিরাত না থাকায় জয়নাল গেরস্থদের গরু-ছাগল চরিয়ে, ঘাস কেটে আর বড় কিষানদের জন্য মাঠে পান্তা বহন করে বড় হয়েছে। এখন সে হেসে খেলে গেরস্থদের বাড়ি বাড়ি কামলা খেটে বেড়ায়। কিন্তু কাজেকর্মে তার মন খুব-একটা নাই, দরকারি কাজটা করার চেয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াতেই তার আনন্দ বেশি। লোকে বলাবলি করে, ফুর্তিবাজ জয়নালটা কামকাজ করে কিসের ছাই, দিনমান খালি কুয়ারা-ফাজলামো লিয়ে আছে। খালি গপ্পগুজব করে আর গান গায় আর খালি গামলা গামলা ভাত খায়।

কিছুক্ষণ আগেও ধান কাটতে কাটতে গলা ছেড়ে গান গাইছিল, এখন ভাত খাচ্ছে। জমির আলের ওপর ল্যাটা মেরে বসে সঙ্গী ইদ্রিসের সঙ্গে ভাত খাচ্ছে আর গল্প করছে। গল্প হচ্ছে না, কারণ জয়নাল শুধু একাই বকবক করে চলেছে, ইদ্রিস তার কথায় কোনো সাড়া দিচ্ছে না, হুঁ-হাঁ কিছুই করছে না। কিন্তু জয়নাল বকতে বকতে যখন মুখে প্রায় ফেনা তুলে ফেলল, তখন আর সইতে না পেরে ইদ্রিস ঘেউ করে উঠল, ‘চুপ কর! ভাত খাবা দে।’

জয়নাল হে হে করে হাসতে হাসতে বলল, ‘মুখ বোন্দ করে খালি ভাত খায়াই যাবু? অ্যানা গপ্প-সপ্প করা লাগে না?’
‘ভাত খাওয়ার সমে কতা কওয়া হয় না। সুন্নতে মানা।’
‘তাই?’
‘হয়। খাওয়ার সমে কতা কলে গুনা হয়।’

জয়নাল চুপ করল। ইদ্রিসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ভাত খেতে লাগল। কিন্তু একটু পরেই সে বুঝতে পারল শুধু খাওয়ায় সুখ নাই। গল্প করা ভাত খাওয়ার মতোই জরুরি ব্যাপার। এবার সে ইদ্রিসের মনোযোগ আকর্ষণের মতলবে বলল, ‘ক্যা রে দোস্ত, বিয়া করবু না?’

ইদ্রিস হেসে বলল, ‘হঠাৎ বিয়ার কতা?’
‘হঠাৎ কী রে? হঠাৎ কী? বয়েস কতটি হলো সে খিয়াল আছে?’

২.
তার পর ধান কাটার মৌসুম শেষ হলে বিরান মাঠের একাকী শিমুল গাছটা যখন মাতাল সাঁওতালদের চোখের মতো শতসহস্র টকটকে লাল ফুল নিয়ে ঝকঝক করে উঠল তখন একদিন জয়নাল কোত্থেকে একটা বউ নিয়ে হাজির। গাঁয়ের সব মানুষকে ডেকে ডেকে সে বলতে লাগল, ‘দ্যাখো বারে, হামার বউ দেখে যাও। তামান দুনিয়া ঢুঁড়ে ইংকা বউ তোমরা আর অ্যাডাও পাবিন না!’

বউ দেখে গ্রামের লোকে বলে, ‘কথা মিথ্যা লয়। ইংকা সুন্দর বউ তুই কোন্টে পালু রে জয়লাল?’

জয়নাল গদগদ হয়ে বলে, ‘সে কথা কয়ো না বাপু, আল্লা এক্কিবারে লিজ হাতে তুলে দিছে। আল্লা দিলে ইংকাই হয়। তে শোনো কাহিনী...’

জয়নাল রঙ চড়িয়ে তার বিয়ের গল্প বলতে শুরু করল : ‘কী মনে করে গেনু শিবগঞ্জের হাটত। কোনো কাম নাই, সাথে ট্যাকা-পসাও কেচ্চু নাই। ইমনিই গেনু বাপু। হাটের মদ্যে ঘুরে বেড়ানু খানিক। তে, সন্ধ্যাসমে হাটত থ্যাকে ফিরে আসোছোঁ, দেখনু এক বুড়া ব্যাটা যায় ঠুকঠুক কোরে, আর তার পিছে পিছে এক বেটিছল। কী আর কমু বাপু, কলে কবিন মিছা কথা, সন্ধ্যার আন্ধার উজালা কোরে বুড়ার পিছে পিছে হাঁটে পরির লাকান এক বেটিছল। মুই মনে মনে কনু, এডা মানুষ লয়, আসলেই বুঝি আসমানের পরি। মুই জুয়ান মরদ বাপু, চোখোত্ তো অ্যানা র্ঘুকি লাগবেই। আর তোমরা তো জানিনই, মুই মানুষটা ক্যাংকা ফাজিল। তা হাউস হলো বুড়ার সাথে অ্যানা কুয়ারা করোঁ। কী আর হোবে, বুড়া তো আর মোক মারা পারবে না। আর যুদিল চিগড়াচিগড়ি আরম্ভ করেই দ্যায়, দিমু না হয় কষে এক দৌড়। তে, এই মনে করে বুড়াক কনু, বুড়া ব্যাটা কোন্টে যায়? বুড়া থামে না, মাটির দিকে চায়া ঠুকঠুক কোরে হাঁটতে হাঁটতে কয়, কোন্টে আবার, বাড়িত। মুই কনু, বাড়ি কোন গাঁও? বুড়া তাও মাথা তোলে না, কয় শিমুলিয়া। এইবার মুই সাহস কোরে কনু, বেটিছল কে হয়? বুড়া কয় লাতিন। আর অ্যানা সাহস কোরে কনু, লাতিন তো সেনা হোছে, বিয়া দিবিন না? বুড়া এবার থামল, চোখ দুডা তুলে মোর দিকে তাকাল। মুই মনে মনে কনু, লাঠিডা দিয়ে একখান বাড়িই হাঁকায় নাকি! না, বুড়া আর কেছু কলো না। আবার হাঁটা ধরল। মুই পিছে পিছে যাতে যাতে আবার কনু, লাতিনক বিয়া দিবিন না? বুড়া এবার কয়, বিয়া তো দেমো, কিন্তুক ঘড়ি সাইকেল ট্যান্ডিস্টার আর লগদ ট্যাকা পামো কোন্টে? মুই এবার ফুসলাবার ধরনু, বুঝিছিন? মুই বুড়াক কনু, কেচ্ছু যদি দেওয়া না লাগে? শুনে বুড়া এইবার খাঁড়া হলো, মোর মুখের দিকে চায়া কলো, ঘড়ি সাইকেল ট্যান্ডিস্টার আর লগদ ট্যাকা ছাড়া হামার লাতিনক্ বিয়া করবে কে? মুই কনু, ক্যা? হামি যদি করি? বুড়া মোক্ পুছ করে, কোন গাঁয়ের মানুষ তুমি? মুই কনু মধুপুর। বুড়া কয়, সত্যিই বিয়া করবিন, না ইয়ার্কি মারোছিন? মুই কনু ইয়ার্কি লয়, সত্যি। বাস! আল্লা কবুল কোরে লিলো, বুঝিছিন বারে? আল্লা লিজ হাতে মোক্ বেহেশতের পরি দান করল। বুড়া কলো, আজই বিয়া করবিন? মুই চরপটাত্ থাবা ম্যারে লাফ দিয়ে উঠে কনু, হয় আজই, অ্যাক্‌খোনি! বুড়া কয়, তালে আসো হামার সাথে। বাস, তোমাগেরে জয়নালের বিয়া হয়া গেল বারে, ওই রাতত্ই। দেনমোহর একশ এক ট্যাকা। আল্লা মেহেরবান!’

গ্রামের মানুষ বউ দেখে খুশি। কিন্তু জয়নালের চাচা-চাচির বড্ড আফসোস। গরীব হলে কী হয়, পুরুষ মানুষ বিয়ে করলে টাকা-পয়সা, দান-টান কিছু না কিছু তো পায়, কিন্তু জয়নাল খালি-হাতে শুধু বউটাকেই নিয়ে এসেছে, যে কিনা এখন বসে বসে সানকি সানকি ভাত গিলবে। চাচি কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘হারামজাদাক খায়া-না-খায়া মানুষ করনু, আর বিয়া কোরে লিয়ে অ্যালো একলাই। অ্যাডা কথা কলোও না।’ চাচা আহাজারি করতে লাগল: ‘আহারে মোর আর কেউ নাই, লিয়ে-দিয়ে এক ভাস্তা। সেই নিমকহারামডাই বিয়া কোরে লিয়ে অ্যালো একলাই, ডিমান-ডুমান কেচ্চু পালো না। আহ্হারে মোর কপাল।’

জয়নাল চাচা-চাচির হাতে-পায়ে ধরে মাফ চেয়ে বলল, ‘তোমরা ব্যাজার হয়ো না বাপু, মাপ কোরে দ্যাও। যা হওয়ার হয়া গেছে।’

যা হবার হয়ে গেল বটে, কিন্তু বউকে নিয়ে জয়নালের নাচানাচির শেষ নাই। বউকে সে মাথায় করে রাখবে না কাঁধে নিয়ে নিয়ে নাচবে তার দিশা পায় না। সড়কের কিনারে দাঁড়িয়ে থাকে, লোকজনকে ডেকে ডেকে বলে, ‘ও চাচা, ও ভাই, হামার বউ দেখে যাও। ইংকা বউ তোমরা তামান দুনিয়া ঢুঁড়ে আর অ্যাডাও পাবিন না!’

বউকে ঘরে রেখে মাঠে গিয়ে কাজ করতে ইচ্ছা করে না জয়নালের। কোনো কোনো দিন সে বউকে সঙ্গে নিয়েই মাঠে যায়। জমির আলের উপর তাকে বসিয়ে রেখে সে হাল বয় আর গলা ছেড়ে গান গায়। আর ঘুরে ফিরে বারবার বউয়ের কাছে এসে বসে গল্প জুড়ে দেয়। তার গল্পের শেষ নাই, মুখে তার সারাক্ষণ কথার খই ফোটে।

হঠাৎ হঠাৎ সে বলে ওঠে, ‘বউ, তুই কী চাস?’

বউ হেসে মাথা নেড়ে জানায় সে কিছু চায় না।

জয়নাল শিমুলের গাছ দেখিয়ে বউকে বলে, ‘ফুল চাস? ফুল লিবু?’

বউ হেসে মাথা দোলায়, আর জয়নাল নিতম্ব বের করে মালকোঁচা বেঁধে দৌড়ে চলে যায় শিমুল গাছের তলায়। গিয়ে দেখে, ওহ হো, শিমুল গাছে তো চড়া যায় না, কাঁটা! তখন সে পাগলের মতো গাছে ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে। ঢিল ছুঁড়তে ছুঁড়তে হাপসে যায় আর লজ্জা পেয়ে হাসে, পড়ে থাকা ফুলগুলো চুপি চুপি কুড়িয়ে কাছা ভর্তি করে।

আমগাছের মগডালে পাখির বাসা দেখে সে বউকে শুধায়, ‘পক্কির বাচ্চা লিবু, বউ?’
বউ হেসে মাথা নাড়ে, আর জয়নাল পাছা বের করে মালকোঁচা বেঁধে দুই নিতম্বে দুই চাপড় মেরে দুহাতের তালুতে থুথু নিয়ে দুই তালু ঘষে তরতর করে গাছে উঠে যায়। কিন্তু পাখির বাসায় গোখরোর উদ্যত ফণা দেখে পড়ি-মরি নেমে আসে ছড় ছড় করে, তার দুই ঊরু আর বুকের ছাল-চামড়া ছড়ে গিয়ে দর দর করে রক্ত ছোটে, কিন্তু সে দাঁত বের করে হাসে।

সন্ধ্যায় সে বউকে নিয়ে খালের পাড়ে বসে গল্প জুড়ে দেয়। খালের অন্য পাড়ে মহুয়া গাছ। সেখানে অজস্র বাঁদুড়ের আনাগোনা। একটু দূরেই বাঁশঝাড়, সেখানে ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে থোকায় থোকায় জোনাকি জ্বলে। জয়নাল সেদিকে চেয়ে বউকে বলে, ‘জানিস, জোনাক পোকা জ্বলে ক্যান?’

অবোধ কিশোরী বউ অবাক হয়ে শুধায়, ‘ক্যান জ্বলে?’

জয়নাল বলে, ‘জোনাক পোকার গোয়াত এডিয়াম থাকে, এডিয়াম। এডিয়াম কী জিনিস? এডিয়াম হলো এক ধরনের জিনিস, আন্ধারের মদ্যে জ্বলে। তাই ঘড়ির মধ্যে এডিয়াম থাকে। আন্ধারের মধ্যে দেখা যায় কয়টা বাজল।’

আকাশের বেশুমার তারা দেখিয়ে সে বউকে বলে, ‘দেখিছু, কত তারা? তারাভরা আকাশের দিকে চায়া থাকতে তোর ক্যাংকা লাগে, বউ? মোর কলে খুবই ভালো লাগে। মনে হয় ওই তারার দ্যাশত্ উড়ে চলে যাঁও।’

বউ মিটি মিটি হাসে।

তার হাসি দেখে জয়নাল বলে, ‘তুই বুঝি মনে মনে কোস, মোর মাথার ঠিক নাই, লয়? মুই অ্যাডা পাগলা? হয় বউ, কওয়া পারিস তোক্ পায়া মুই পাগলাই হয়া গেছুঁ। আল্লা লিজ হাতে তোক মোক দান করিছে। মোর মাওডা বুঝি কোনো সওয়াব করিছেল।’

বউ বলে, ‘আম্মার কথা তোমার মনে আছে?’

জয়নাল মাথা নাড়ে: মায়ের কোনো স্মৃতি তার মনে পড়ে না। চাচিই তাকে মায়ের মতো বড় করে তুলেছে। চাচির এক মেয়ে মারা যাওয়ার পর আর কোনো সন্তান হয়নি। জয়নাল চাচির বুকের দুধ খেয়ে বড় হয়েছে।

তার পরে আকাশ জুড়ে বড় সড় একটা চাঁদ ওঠে। খালের স্থির পানিতে চাঁদের ছবি দেখে জয়নাল বউকে বলে, ‘ওই দ্যাখ, খালের বিছনাত চাঁন শুতে আছে। দেখিস, এই ঘণ্টাখানেকের মদ্যেই ওই চাঁন লাফ দিয়ে উঠে চলে যাবে বাঁশের আগাত। বাঁশের আগা ঝুঁকে পড়বে, দেখে মনে হোবে বড়শির মাথাত ধরে আছে একখানা সোনার মাছ।’

তার পর সে এই গল্প ফাঁদে : ‘কাল পাছাআত্রিরে কী স্বপন দেখনু, জানিস? দেখনু, খালের পারত তুই আর মুই বসে আছোঁ, এই এখনকার মতন। খালের পানিত চাঁন দেখে তুই বায়না ধরলু, চাঁন চাই, চাঁন অ্যানে দ্যাও। মুই কনু চাঁদ ত ধরা যায় না। কিন্তুক তুই কোনো কতাই শুনিস না, তোর ওই একই বায়না। কী আর করা, মুই ঝাঁপ দিনু খালের পানিত। নিয়াশ বোন্দ কোরে দিনু এক ডুব। কিন্তুক কোন্টে তোর চাঁন? চাঁন নাই। মুই চাঁন ঢুঁড়তে ঢুঁড়তে পাতালপুরিত নামবার লাগ্নু। ঢুঁড়ে ঢুঁড়ে মুই এক্কিবারে হয়রান, তাও চান্দের দ্যাখা নাই। শ্যাষম্যাষ খালি হাতে মন ব্যাজার কোরে ফিরে আনু। খালের পানিত ভুশ্ করে মাথা তুলে দেখবার পানু কী, খালের পারত বসে আছো তুই, আর তোর কোল জুড়ে ঝলমল করে হাসোছে আকাশের চাঁন। চারদিকে এক্কিবারে ধবধবা হয়া গেছে চান্দের আলোত।’

বানোয়াট গপ্প শুনে বউ মৃদু মৃদু হাসে, আবছায়ায় জয়নাল তা দেখতে পায় না। বাঁশঝাড়ে একটা বক ডেকে ওঠে। রাতচোরা পাখিরা তার জবাবে নানা রকম শব্দ করতে থাকে। অনেক দূরে শিয়ালের ঝাঁক এক সঙ্গে হুক্কাহুয়া রবে চিৎকার শুরু করে আর তার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের অলিগলির ভিতরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুরু হয়।
জয়নাল বলে চলে, ‘শোনেক বউ, ওই পরিবার পরিকল্পনার মেয়ামানুষগুলা কিন্তুক কয়দিন পরেই অ্যাসে ঘুরঘুর করবা লাগবে। তুই কিন্তুক ওরগেরে কথা কানোতই লিবু না। ওরা ফুসলায়া ফাসলায়া তোক কিন্তুক হাসপাতালত লিয়ে যাবে, কেছু অ্যাডা করবে, তার পরে আর হামাগেরে ছলপলই হোবে না। খবরদার শুনবু না ওরগেরে কথা। কিসের জন্মনিয়ন্ত্রণ? শোনেক, হামরা কলে ওগলানের মদ্যে নাই। দশ-বারোটা ব্যাটাবেটি হোবে হামাগেরে। গাঁও ভরে ফালামু তুই আর মুই, বুঝলু? ভোটের আগে শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়া আসলে কমু, আইদা, মদুপুরের জয়নাল কথা কয়। তার বাড়িত বিশজন ভোটার, হুঁশ কোরে কথা কবেন। হাটেবাজারে যেটে সেটে মানুষ হামাগেরে ব্যাটাগরক পুছ করবে, কার ব্যাটা তুই? খালি শুনবা পাবে, জয়নালের, জয়নালের ব্যাটা হামি। বারোটা ভাই হামরা, হুঁশ কোরে কথা কয়ো।’ হা হা করে হেসে ওঠে জয়নাল। বউ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে হাসে।

৩.
জয়নালের চাচা মূরলীপুরের ইউনুস ফকিরের সঙ্গে চিল্লা দিতে গেছে। চাচিবুড়ি তালকুদারদের বাড়িতে ঝিগিরি করে। ভোরবেলা উঠে সে তালুকদারবাড়ি চলে যায়, সেখানেই সকালের পান্তা খেয়ে কাজ শুরু করে। দুপুরে ভাত খায়, রাতেও ওই বাড়িতেই খেয়ে-দেয়ে নিজের বাড়ি ফিরে আসে। জয়নাল কাজ করে মন্ডলদের বাড়িতে, তারও সেখানেই খাওয়া-দাওয়া। জয়নালের বউ একা একা কী রাঁধে কী খায় তার কোনো ঠিক নাই। গেরস্থদের বাড়িতে তাকেও ঝিগিরি করতে হবে, এ ছাড়া কোনো উপায় নাই। কিন্তু জয়নাল বলেছে সে নতুন বউ, তাকে অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতে পাঠাতে সে পারবে না। কিন্তু বেচারি বউ কী খেয়ে সারাদিন কাটায় তার খোঁজ জয়নাল রাখে না। ইচ্ছা করে নয়, আসলে জয়নাল আলাভোলা লোক বলে এমনটা ঘটে। তা ছাড়া এমন নয় যে জয়নালের ঘরে চাল থাকে না। এই গ্রামে যার ঘরে এক বেলা ভাত রাঁধার চাল আছে তার আর কোনো অভাব আছে বলে মনে করা হয় না। জয়নালের বউটা বাড়ির পাশের জঙ্গল থেকে কচুঘেঁচু তুলে এনে দুপুরে রেঁধে খায়, রাতে জয়নাল মন্ডলদের বাড়ি থেকে ভাত নিয়ে আসে। দুজনে তাই ভাগ করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।

হতদরিদ্র জয়নাল এই অবস্থার মধ্যেও বউকে যখন-তখন বলে, ‘বউ তুই কী চাস?’ এক রাতে বউ লজ্জার মাথা খেয়ে বলে ফেলে, ‘মুরগির গোশত দিয়ে ভাত খাবা মন চায়।’

পরদিন সকালে জয়নাল মন্ডলবাড়িতে গিয়ে মন্ডলকে বলল, ‘চাচা মিয়া, একশডা ট্যাকা দ্যাও বারে, খুবি দরকার।’

মন্ডল নিমের দাঁতন দিয়ে দাঁত ঘষছিল, দাঁতনটা মুখ থেকে বের করে বলল, ‘লিত্যি লিত্যি ট্যাকা চাস কিসক্? উদিনকা না ঘর ছাওয়ার কথা কয়া পাঁচশ ট্যাকা লিলু, তার পর কাম র্কলু কয়দিন রে?’

জয়নাল ছ্যাবলার মতো হাসতে হাসতে বলে, ‘সারা বছর পড়ে আছে চাচা, কাম কোরে ব্যাবাক শোধ দিমু।’
‘তা ত দিবু। কিন্তু আষাঢ়-শাওন চলে গেল, বিষ্টিটিষ্টি বোধহয় আর হোবে না। পাঁথারত্ পানি নাই, এখন তোর কামডা কী? গান গায়া আর বউয়ের সাতে পিরিতের গপ্প করে দিন কাটাবু আর কয়দিন পরপর ট্যাকা চাবু, তালে ক্যাংকা কোরে হয়?’

জয়নাল মনে মনে স্বীকার করে, মাঠে পানি নাই, জমি চাষ করা যাচ্ছে না, ধান রোপাও সম্ভব নয়। এখন আসলে মন্ডলবাড়িতে তার কোনো কাজ নাই। এই অবস্থায় গ্রামের গৃহস্থরা তাদের বাঁধা কিষানদের ছেড়ে দেয়। মন্ডল যে এখনো তাকে বিদায় করে দেয়নি সেটা তার একান্তই ভালোমানুষী।

জয়নাল চুপ করে রইল।

মন্ডল বলল, ‘এখন তোর কামডা কী তুইই ক?’

জয়নাল উত্তর দিতে পারল না।

‘কাল থে তুই আর আসিস না বাপু। বিষ্টিটিষ্টি হোক, তার পর আসিস।’

জয়নাল এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, বুকের কাছে দুটি হাত জড়ো করে বলল, ‘একশডা ট্যাকা দিলে বড়ই উপকার হলো হিনি চাচা।’

মন্ডল এবার বিরক্ত হয়ে উঠল, ‘এই অবস্থায় তুই ট্যাকা চাস কোন মুখে?’

জয়নালের দমে যাওয়ার জন্য এটুকুই যথেষ্ট। কেউ তাকে নিজে ইচ্ছা করে কিছু না দিলে জীবনে কোনো দিন কারো কাছ থেকে সে কিছু আদায় করতে পারেনি। বরং নানা ছুঁতানাতায় অনেক ন্যায্য পাওনা থেকেই অনেকে তাকে বঞ্চিত করেছে।
কাল থেকে আর কাজে আসবে না। কিন্তু আজ সকালের পান্তাটা, দপুরের ও রাতের খোরাকিটুকু থেকে মন্ডল নিশ্চয়ই তাকে বঞ্চিত করবে না। জয়নাল এ রকম ভাবছে, আর পান্তার জন্যে মনে মনে অপেক্ষা করছে। কিন্তু মন্ডল তাকে ওভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আরো বিরক্ত হয়ে উঠল: ‘কাম না থাকলে খালি খালি মানুষ থোয় কোন গিরস্থ? খোঁজ লিয়ে দ্যাখ দিনি, এই গাঁওত্ এখন কোনো গিরস্থের বাড়িত্ তোর মতন জুয়ান কোনো মরদ বসে বসে তিন বেলা ভাত গিলোছে নাকি? কী রে? খাঁড়া হয়া থাকলু ক্যা?’

জয়নাল আর কোনো কথা না বলে মন্ডলবাড়ির চৌকাঠ ডিঙিয়ে গলিতে নেমে এল।

অভুক্ত অবস্থায় প্রায় বিতাড়িত হয়ে মন্ডলবাড়ি থেকে ফিরে আসার সময় জয়নালের মনটা একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিজের বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে বউয়ের মুখটা মনে পড়ায় তার বিষণ্নতা কেটে গিয়ে বরং একটা ফুর্তির ভাব জেগে উঠল। এখন সারাদিন বউয়ের সঙ্গে ইয়ার্কি-ফাজলামো আর গল্প-গুজব নিয়ে থাকা যাবে এই চিন্তা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। অভাব-অনটন জয়নালের জীবনে নতুন কিছু নয়, কিন্তু তার স্বভাবটা এমন যে এ নিয়ে তার খুব-একটা দুশ্চিন্তা হয় না।

কিন্তু বউ মুরগির মাংস দিয়ে ভাত খেতে চেয়েছে এই কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়ায় একটুখানি মুশকিল বোধ হলো। হাতে গোটা বিশেক টাকা আছে, কিন্তু তা দিয়ে তো একটা মুরগির বাচ্চাও কিনতে পাওয়া যাবে না। বউয়ের হাউসটা তাহলে সে মেটায় কী করে?

আচ্ছা ঠিক আছে, উপায় একটা বের হবেই—এ রকম ভাবতে ভাবতে জয়নাল বাড়ির পথে হেঁটে চলল।

বাড়ি পৌঁছ দেখতে পেল বউ নাই, ঘরে শিকল তোলা। জয়নাল মনে মনে বলল, এই সকাল বেলা নতুন বউটা তার কোথায় যেতে পারে? সে গলা খাঁকরে ডেকে উঠল, ‘ও বউ, কোন্টে গেলু তুই?’

কোনো সাড়া মিলল না।

জয়নাল এবার বলে উঠল, ‘ব্যাপার কী? অ্যাখোনি পাড়া বেড়াবা আরম্ভ কোরে দিলু নাকি?’

বউ কোথায় যেতে পারে তা ঠাহর করতে না পেরে সে ঘরের সামনে মাটির বারান্দায় বসে পড়ল। তার পেটে ক্ষুধা মোচড় দিয়ে উঠল। প্রতিদিন এই সময় তার পেট পান্তা হজমের কাজ করে অভ্যস্থ, এখন পান্তার অভাবে নাড়িভূড়িই যেন হজম করতে শুরু করে দিল। পেটের এই অন্যায় ব্যবহার জয়নালকে ক্রুদ্ধ করে তুলল। সে চিৎকার করে উঠল, ‘বউ, তুই গেলু কোন্টে?’

ঘরের পিছনে শুকনা লতাপাতায় শব্দ হলো, জয়নালের চোখ সেই দিকে ছুটে গেল। কাউকে দেখতে পেল না সে। তার মনে হলো কেউ যেন এইমাত্র ঘরের পিছনের ঝোপঝাড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে ঝট করে উঠে সেদিকে ধেয়ে গেল। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না।

জয়নালের স্বভাবে যা নাই, এবার তার মনের মধ্যে তাই জেগে উঠল। একটা ক্ষীণ সংশয় তার বুকের মধ্যে চিকন এক যন্ত্রণা এনে দিল : কেউ কি লুকিয়ে লুকিয়ে এ বাড়িকে লক্ষ করে? আরো সহজ করে প্রশ্নটা সে সাজাল : প্রতিদিন সকালে সে কাজে চলে যাওয়ার পর বউ যখন একা থাকে তখন কি কোনো পুরুষ চুপি চুপি এই বাড়িতে আসে? যে মেয়ে এমন সুন্দরী তার দিকে লোভী পুরুষদের কুনজর তো পড়তেই পারে। কিন্তু বউটা? সেও কি স্বামীকে ফাঁকি দিয়ে পরপুরুষের সঙ্গে ব্যাভিচারে লিপ্ত হয়? জয়নালের ক্ষুধার্ত পেটটা মোচড়াতে আরম্ভ করল, তার সহজ সরল মনটা বিষিয়ে উঠল সে পায়ের বুড়া আঙুল দিয়ে উঠানের মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে অপ্রীতিকর ও অশুভ চিন্তা করতে লাগল।

একটু পরে পায়ের শব্দে জয়নাল ঘাড় ঘুরিয়ে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেল বউ বাড়ি ঢুকছে, তার এক হাতে ডাঁটাশুদ্ধ তিনটা কচু গাছ, অন্য হাতে কিছু বুনো শাক। মুহূর্তেই জয়নালের মন থেকে সব অশুভ চিন্তা দূর হয়ে গেল, একটা করুণ মমতা তার মনকে সিক্ত করে ফেলল : আহারে! বউটা মোর গরু-ছাগলের মতন খাস খায়া থাকে!

বউ অসময়ে স্বামীকে বারান্দায় অকর্মার মত বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘কী হলো? ফিরে আলিন ক্যা?’

জয়নাল ফের ছ্যাবলা হয়ে গেল, ইয়ার্কি মেরে বলল, ‘মোর চাকরিডা চলে গেছে বউ!’
‘চাকরি? কিসের চাকরি?’

গ্রামের সরল কিশোরী চাকরি বলতে বোঝে শহরের অফিস-আদালতে উচ্চ বেতনে কাজ করা। মন্ডলদের বাড়িতে খোরাকিসমেত মাসিক ছয়শ টাকা মজুরির কাজকেই যে তার স্বামী চাকরি বলছে এই রসিকতাটুকু বুঝতে তার সময় লাগবে। জয়নাল যখন বলতে আরম্ভ করল যে মাঠে পানি নাই, ক্ষেতে কাজ নাই, তাই মন্ডল আর অকাজে ভাত ধ্বংস করার লোক রাখতে চায় না বলে তাকে বিদায় করে দিল, তখন তার বউয়ের ছোট্ট সুন্দর মুখখানা চুপসে গিয়ে আরো ছোট ও মলিন হয়ে গেল। তা দেখে জয়নাল বলে উঠল, ‘তা এত চিন্তা করার কী আছে? মন্ডলের বাড়িত কাম নাই বলে কি দুনিয়াত আর কোনো কাম নাই?’

বউ কিছু না বলে রোদের মধ্যে চুলার পাড়ে বঁটি নিয়ে কচু কাটতে বসল। জয়নাল বউয়ের গা ঘেঁষে বসে বলল, ‘তুই দেখি কতা বোন্দ কোরে দিলু?’

বউ মাথা নিচু করে কচুর ডাঁটা কাটতে কাটতে বলল, ‘পন্তা খায়া আসিছিন?’
‘না না! চাকরি চলে গেল, পন্তা খামু কী? কাম না করলে কেউ খাবা দেয়?’
‘খিদা লাগেনি?’
‘লাগিছেল। কিন্তু এখন আর খিদা নাই।’

এটুকু বলেই জয়নাল উঠে দাঁড়াল। ‘তুই তরকারি কোট্, মুই অ্যানা ঘুরে আসোঁ’ বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো।

বউ বলল, ‘কোন্টে যাওছিন?’
‘তুই তরকারি কোটেক, আজ হামরা দুবরে সমে ভুল্কানি ভাত খামো। মুরগির গোশ্ত দিয়ে!’

বউকে পরের প্রশ্নটা করার সুযোগ না দিয়েই জয়নাল ছুটে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।

৪.
জয়নাল তিন মাইল দূরে উপজেলা সদরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। তার ধারণা সেখানে গেলে নতুন কোনো বুদ্ধি পাওয়া যেতে পারে। যারা জমিতে কাজকর্ম করে তারা অফসিজনে উপজেলা সদরে ভ্যানগাড়ি আর রিকশা চালায়। জয়নাল সাইকেল চালাতে জানে না বলে রিকশা বা ভ্যান চালাবার কথা কখনো ভাবেনি, যদিও এখন তার মনে হচ্ছে দুই চাকার সাইকেলের চেয়ে তিন চাকার রিকশা বা ভ্যানগাড়ি চালানো নিশ্চয়ই সহজ। ইদ্রিস রিকশা চালাতে ঢাকা চলে গেছে। পনের দিন রিকশা চালিয়ে নগদ এক হাজার টাকা সঙ্গে নিয়ে চলে আসে। দিন কয়েক বসে বসে খায়, তার পর আবার চলে যায়। জয়নাল তো সাইকেলই চালাতে শেখেনি; ঢাকা শহরে অত লোকের ভিড় আর বাস-ট্রাকের মধ্যে সে রিকশা চালাতে পারবে না বলে ইদ্রিসের প্রলুব্ধকর কথাবার্তা শুনেও যেতে রাজি হয়নি। ইদ্রিস বুঝে নিয়েছে জয়নালের সমস্যাটা ঢাকার ভিড় বা রিকশা চালাতে না-জানা নয়। আসল কথাটা হলো, নতুন বউকে ছেড়ে ঢাকায় গিয়ে একটানা পনের দিন থাকা জয়নালের পক্ষে সম্ভব হবে না।

উপজেলা সদরে ঢুকে মাইকের চিৎকারে জয়নালের কানে প্রায় তালা লেগে গেল। এক সঙ্গে যে কত মাইক বাজছে তার হিসাব নাই। মাইকে ভোট চাওয়া হচ্ছে। ধানের শিষ আর নৌকা মার্কার পক্ষে চিৎকার বেশি। লাঙ্গল মার্কায়ও ভোট চাওয়া হচ্ছে। মাইকগুলো পরস্পরকে চাপা দেওয়ার জন্যে চিৎকারের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। ভোটপ্রার্থী ক্যানভাসারদের গলা ভেঙে ফাটা বাঁশের মতো হয়ে গেছে, তবু তারা গলার রগ ফুলিয়ে অবিরাম চিৎকার করে চলেছে।

একটা বটগাছের তলায় কতকগুলি আদিবাসী নারীপুরুষ। ডালি-কোদাল নিয়ে কেউ বসে আছে, কেউ দাঁড়িয়ে আছে। জয়নালের বুঝতে অসুবিধা হলো না যে তারা মজুর, কোথাও মাটি কাটার কাজ করছে। কিন্তু এই বেলা এগারোটায় তারা কিসের অপেক্ষা করছে তা সে বুঝতে পারল না। ইতস্তত পায়ে জয়নাল তাদের দিকে এগিয়ে গেল। একজনের কাছে গিয়ে বলল, ‘তোমরা কোন্টে কাম করোছিন?’

লোকটা শ্লেষাত্মক হেসে বলল, ‘কাম বারাওছে এবার। দুই দলে এইছা মারামারি লাগিছে..।’
‘কোন্টে মারামারি লাগিছে, ভাই?’ জয়নাল জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু লোকটা আর কিছু বলল না।

জয়নাল ফিরে এলো। রাস্তা থেকে একটু দূরে একটা ঘরের সামনে প্রচুর ভিড় দেখতে পেল। ঘরটার ছাদে বড়সড় একটা নৌকা, আগাগোড়াই সেটি ছবিওয়ালা কাগজে মোড়ানো। শেখ সাহেবের ছবি, তার বেটির ছবি এবং এই এলাকার যিনি নৌকা মার্কার টিকেট পেয়েছেন তাঁর ছবি। জয়নাল এক পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে নৌকাটির দিকে নির্বোধের মতো চেয়ে রইল। সে ভোটার, কিন্তু কাকে ভোট দেবে এখনো জানে না। মন্ডল এখনো বলেনি কাকে ভোট দিতে হবে। কেউ জয়নালের কাছে ভোট চাইতেও যায়নি।

‘এই, কে রে তুই?’ এক যুবক ধমকের সুরে জিজ্ঞাসা করল জয়নালকে। জয়নাল কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না।

যুবক তাকে বলল, ‘বাড়ি কোন্টে?’

জয়নাল বলল, ‘মধুপুর, ভাই।’
‘কী দেখিস?’
‘কেছু লয় ভাই, ইমনি। নৌকাডা সুন্দর হোছে।’
‘কী করিস?’
‘মান্ষের বাড়িত কাজকাম করি। এখন কাম নাই, মাঠত পানি নাই তো!’
‘নৌকা মার্কার হয়া কাম কর, আয়।’
‘কী করা লাগবে, ভাই?’

যুবকটি জয়নালকে তাদের নির্বাচনী অফিস ঘরে ডেকে নিয়ে গেল। একশটা পোস্টারের একটা বান্ডিল তার হাতে দিয়ে একটা মাটির ভাঁড় দেখিয়ে বলল, ‘এডা লে। মুকুর হুটাল চিনিস? মুকুর হুটালত যায়া এক কেজি ময়দা লিবু, পানি দিয়ে ময়দা আঠা আঠা করে গুল্বু। তার পর এই পোস্টারগুলা দেয়ালে দেয়ালে লাগাবু। লাগান শ্যাষ হলে ফিরে আসবু। একশ ট্যাকা পাবু। যা।’

জয়নালের হাতে তো পয়সা নাই। ময়দা কিনবে কী দিয়ে? কিন্তু সে কথা সে যুবককে বলতে পারল না। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইল।

‘কী রে? বুঝিসনি?’

জয়নাল মাথা নেড়ে জানাল সে তার কর্তব্য বুঝেছে, কিন্তু তার পরও সে দাঁড়িয়েই রইল।

যুবক বলল, ‘সমস্যা কী? যা!’

জয়নাল এবার বলল, ‘মোর কাছে ট্যাকা নাই ভাই, ময়দা কিনমু কী দিয়ে?’

যুবক বলল, ‘আরে পাগলা, ময়দা কিনা লাগবে না। মুকুক্ যায়া কবু, তালেই দিয়ে দিবে। যা, তাড়াতাড়ি যা।’

৫.
একটা চিকন গলির মধ্যে দাঁড়িয়ে দেওয়ালে পোস্টার সাঁটছে জয়নাল। তিন তরুণ তার দুপাশে এসে দাঁড়াল। এক তরুণ তাকে বলল, ‘থাম থাম। এত কষ্ট করা লাগবে না। কয় ট্যাকা দিছে?’
জয়নাল ভয়ে ভয়ে বলল, ‘ট্যাকা অ্যাখোনো দ্যায়নি, ভাই। কাম শ্যাষ হলে দিবে।’
‘কয় ট্যাকা দিবে?’
‘একশ ট্যাকা, ভাই।’
‘পোস্টার কতগুলা?’
‘একশডা।’
‘পোস্টারগুলা এদিকে দে। আর তুই বাড়িত চলে যা। খবরদার, কাক্কো কবু না। সোজা বাড়িত চলে যাবু।’

মানি ব্যাগ থেকে দুটি একশ টাকার নোট বের করে তরুণ বলল, ‘এই লে, একশ লয়, দুই শ ট্যাকা।’

জয়নাল কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘না ভাই, অরা মোক্ মারবে।’
‘ভয় নাই। কেউ জানা পাবে না। ধর, ট্যাকা লে। লিয়ে সোজা বাড়িত চলে যা। এই তল্লাটে তোক যান আর না দেখি।’ তরুণটি তার সঙ্গীদের ইঙ্গিত করল, তাদের একজন পোস্টারের গোলাকার বান্ডিলটা তুলে নিয়ে বগলদাবা করল।

জয়নাল কাঁপা কাঁপা ডান হাতটা বাড়িয়ে নোট দুটো খামচে ধরে মুঠির মধ্যে নিয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে এমনভাবে দৌড়ে গলির ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো, যেন তাকে কোনো হিংস্র জন্তু তাড়া করছে।

দুপুরের একটু পরে লাল টকটকে ঝুঁটিওয়ালা একটা মোরগ নিয়ে জয়নাল বত্রিশটা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে বাড়িতে ঢুকল।

৬.
এই দরিদ্র অঞ্চলে গরীব ভূমিহীন স্বপ্নহীন ক্ষেতমজুদের বউরা খুব তাড়াতাড়ি পুরোনো ও কুশ্রী হয়ে যায়। তাদের স্বামীরা অচিরেই তাদেরকে গৃহস্থদের বাড়িতে ঝিগিরি করতে পাঠায়, কারণে-অকারণে প্রহার করতে শুরু করে। কিন্তু দুই মাস পেরিয়ে গেছে, জয়নাল তার বউয়ের গায়ে হাত তুলেছে এমন কথা কেউ একদিনও শুনতে পায়নি। আর পরের বাড়িতে কাজ করতে পাঠানো? জয়নাল মনে হয় সেটা জীবনেও করবে না। গ্রামের লোকেরা বলে জয়নাল বিয়ে করে আরো ফূর্তিবাজ হয়েছে। তারা বলে যে জয়নালের মতো বউপাগলা পুরুষ এ গাঁয়ে কখনো জন্মায়নি।

সত্যি। দারিদ্র্য আর উদয়াস্ত হাড়ভাঙা খাটুনির মধ্যেও জয়নালের চোখের সামনের পৃথিবীটা যেন এক ঘোরলাগা রঙিন জগৎ। চাঁদের আলোয় সে দেখতে পায় উঠানের ডালিম গাছে মুক্তা ঝুলে আছে। সকালে চোখ মেলে সে দেখে, এক অদ্ভুত রাঙা আলোয় ভরে আছে সমস্ত পৃথিবী। জীবনের ঘোর তার কিছুতেই কাটে না, তার চারপাশের রঙিন পর্দাটি কিছুতেই সরে না।

৭.
শুক্রবার দুপুরবেলা জুম্মাঘরের সামনের চত্বরে সরকারি টিউবঅয়েলটি ঘিরে এক দঙ্গল ছেলে বুড়া ইচ্চিপিচ্চির ভিড়। গোসল করার ধুম চলছে। দুই-একজন গোসল করছে আর অপেক্ষমাণ অন্যরা নিজেদের পালা না আসা পর্যন্ত বসে বসে গল্প করছে। তাদের কারো কাঁধে, কারো কোমরে গামছা, মাথায় পাগড়ির মতো গোল করে বাঁধা লুঙ্গি। কেউ এসেছে বালতি নিয়ে, কেউ বদনা।

এখন এক সঙ্গে গোসল করছে জয়নাল, আমজাদ আর সলিমুদ্দি। সলিমুদ্দির ছোট্ট ছেলেটা বাপের কোমর চেপে ধরে তার নাভির সঙ্গে গাল পেতে আছে, সলিমুদ্দি বালতিভর্তি পানি ঢালছে নিজের মাথায়—বাপ-বেটার গোসল হয়ে যাচ্ছে এক সঙ্গে। আমজাদ দুই বালতি পানি ইতিমধ্যে নিজের গায়ে ঢেলেছে, এখন বালতি ভরে নিয়ে একটু দুরে এসে গা কচলাচ্ছে। এই ফাঁকে তিন-চারটা শিশু হামলে পড়ল টিউবঅয়েলের হাতলের ওপর। তাদের একজন হাতল ধরে দোল খাচ্ছে আর অন্যগুলি টিউবঅয়েলের মুখের পানির ধারার নিচে বসার যুদ্ধে তুমুল ঠেলাঠেলি করছে। জয়নাল হাতলটা কেড়ে নিয়ে বলে উঠল, ‘এই চ্যাংরাপ্যাংরাগুলার অত্যাচারে আর শান্তিমতন ডুব পারা গেল না বারে। এই, যাও যাও, সরো।’

আমজাদ দুষ্ট শিশুর দলকে বলল, ‘এই পকর যাও, পকর যাও।’

জয়নাল আমজাদকে সমর্থন করে শিশুদের ভর্ৎসনা করতে লাগল, ‘এই উকরি-পুকরির দল, তোরাই কি ভদ্রলোক হছিন নাকি রে? পকর গেলে হয়?’

এক দুষ্ট ছেলে প্রতিবাদে চটাং করে লাফ দিয়ে উঠল : ‘ক্যা, পকর যামো ক্যা? কল থাকতে পকরত্ ডুব দিয়ে চুলকানি-পচারি ধরামো নাকি? তোমরাই পকর যাওয়া পারিন না?’

এত ছোট ছেলের মুখে এমন প্রতিবাদ শুনে জয়নাল হতবাক। সে সলিমুদ্দির দিকে চেয়ে বলল: ‘শুনিছু সলিমদ্দি ভাই, খাতুর ব্যাটা কয় কী শুনিছু?’

খাতু নামক পিতার প্রতিবাদী পুত্রটি একটু দূরে দাঁড়িয়ে আবার জয়নালকে মুখঝামটা মারল: ‘ক্যা? কমো না ক্যা? কল কি তোর বাপের নাকি?’

জয়নাল রেগে গিয়ে চটে গিয়ে ধমক দিয়ে উঠল, ‘খাতুর ব্যাটা, লল্লিত টিপা দিয়ে এক্কিবারে ম্যারে ফালামু।’

খাতুর বেটা আর একটু সরে গিয়ে কোমরে দুহাত রেখে বাহাদুর মরদের মতো জয়নালকে যুদ্ধে আহ্বান করল, ‘আয় দিনি?’

জয়নাল বালতিটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে খাতুর বেটার দিকে ধেয়ে গেল। খাতুর ব্যাটা উল্টা দিকে ঘুরে পিছনের পথটা দেখে নিল, তার পর মুখ ফিরিয়ে জয়নালের দিকে চেয়ে বলল, ‘তোর বউয়ের গোয়া!’ বলেই লাগাল ভোঁ দৌড়। জয়নালের কানদুটোতে ঝাঁ করে আগুন ধরে গেল, তার উপর আমজাদ যখন দাঁত বের করে ‘এক্কিরে জয়নাল, তোর লতুন বউডার মান-ইজ্জত থুলো না’ ইত্যাদি বলতে বলতে উপস্থিত লোকজনদের মুখের দিকে তাকাতে লাগল, তখন ভেজা গায়ে ভেজা লুঙ্গিতে ফটাস ফটাস শব্দ তুলে জয়নাল খাতুর বাড়ির দিকে ছুটে গেল।

খাতুর বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মাটিতে গুঁড়ি মারতে মারতে জয়নাল চিৎকার ছাড়ল, ‘খাতু ভাই, খাতু ভাই, তোর ব্যাটাক্ যদি তুই শাসন না করিস মোর শাসন কিন্তুক সহ্য করা পারবে না।’

খাতু বেরিয়ে এসে জানতে চাইল কী হয়েছে, জয়নালের এমন উত্তেজনার কারণ কী।

কিন্তু জয়নালের মুখ থেকে আর কথা বেরোল না। সে রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘খুব ব্যাদ্দপ হয়া গেছে তোর ব্যাটা।’

খাতু বুঝতে পারল না কী এমন বেয়াদপি করেছে তার ছেলে যার জন্য জয়নালকে গোসল ছেড়ে এমন ভেজা কাপড়ে দৌড়ে তার বাড়ির দরজা পর্যন্ত আসতে হয়েছে। খাতু এবার স্পষ্ট করে জানতে চায়, ‘তা কী করিছে মোর ব্যাটা?’
‘খুব ব্যাদ্দপ হয়া গেছে!’
‘তা কী ব্যাদ্দপি করিছে সিডা কস না ক্যা?’

খাতুর বেটা যে কথা বলে জয়নালের বউয়ের ইজ্জত মেরে দিয়েছে সে কথা জয়নাল নিজমুখে কিভাবে উচ্চারণ করতে পারে? সে একটা দম ফেলে আবার দম নিয়ে রাগে মাটিতে গুঁড়ি মারতে মারতে বাড়ি ফিরে গেল।

৮.
জয়নাল বাড়ি ফিরে দেখতে পেল বউ বিছানায় পড়ে ছটফট করছে। বউয়ের ছটফটানি আর লালচে মুখ দেখে জয়নাল ভয় পেয়ে ছুটে গিয়ে তার কপালে হাত রেখে চিৎকার করে উঠল, ‘ক্যা চাচি, বউয়ের গাও জ্বরে পুড়ে যায়, আর তোর হুশজ্ঞান নাই?’

কিন্তু চাচা-চাচির কোনো সাড়াশব্দ এলো না। চাচা হয়তো জুম্মাঘরে নামাজ পড়তে গেছে, আর চাচি, যে এখন আর তালুকদার বাড়িতে কাজে যায় না, সে যে কোথায় গেছে কে জানে। বউ জ্বরে কাতরাচ্ছে, যন্ত্রণায় ছটফট করছে—এই দৃশ্য দেখে জয়নালের বুকের ভিতরটা যন্ত্রণায় মোচড় খেতে শুরু করল। সে বারবার ‘চাচি হারামজাদিটা গেল কোন্টে’ বলতে বলতে দাঁত কামড়ায়। বউয়ের কপালে হাত রেখে তার মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে ‘বউ, ও বউ, কী হলো তোর’ বলে ঝাঁকায়, সারা ঘর দাপিয়ে বেড়ায়, ঘর থেকে বেরিয়ে চিৎকার ছাড়ে, ‘চাচি, ওই চাচিবুড়ি, গেলু কোন্টে তুই?’

জয়নাল বউয়ের মাথায় পানি ঢালে, তার শিয়রের কাছে বসে থাকে সারারাত। এক চুলও নড়ে না। তার এই অবস্থা দেখে চাচা-চাচি বিরক্ত হয়। চাচি বলে, ‘আহ্লাদের আর শ্যাষ নাই।’ চাচা বলে, ‘জ্বরজারি কি মানষের হয় না?’

জয়নাল তাদের কোনো কথাই মানে না। সে সারাঘর শুধু পায়চারি করে আর ফিরে ফিরে এসে বউয়ের মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে বলে, ‘কী হলো! ও বউ, তোর কী হলো!’

শেষ রাতে বউ বলল, ‘তুমি নিন যাও। কাল সকালেই হামার জ্বর ভালো হয়া যাবে।’

জয়নাল অবুঝ বালকের মতো উদগ্রীব হয়ে বলল, ‘সত্যিই ভালো হয়া যাবে তো?’
‘হয়, তুমি নিন যাও।’

বউ এমন নিশ্চিত সুরে কথাটা বলল যে জয়নালের স্বস্তি বোধ হলো। সে বউয়ের পাশে আস্তে করে শুয়ে পড়ল, তার কপালে স্নেহভরা হাত রেখে বলল, ‘ভাল হয়া যাবু। কাল সকালেই আল্লা তোক ভাল করে দিবে, দেখিস।’

বউ লক্ষ্মী মেয়ের মতো বলল, ‘আচ্ছা।’

জয়নাল আবার কাল সন্ধ্যায় সুস্থ বউকে নিয়ে খালের পাড়ে বসে জোনাকি জ্বলা দেখবে, তার সঙ্গে মজার মজার সব গল্প করবে—এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ল।

কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙার পরে সে দেখতে পেল বউ আবার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। তার ফর্সা মুখটা পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে। কপালে হাত রেখে সে টের পেল, প্রচণ্ড জ্বরে গা সত্যিই পুড়ে যাচ্ছে। জয়নাল চৌকিতে মাথা ঠুকতে লাগল: ‘ও বউ, কী হলো তোর! ও আল্লা, কী পাপ করনু মুই, মাপ কোরে দে।’

চাচি বলল, ‘কপালত জলপট্টি দেওয়া লাগবে।’

জয়নাল চিৎকার করে উঠল, ‘দেওয়া লাগবে তে আগে কসনি ক্যা?’ তার পর সে গামলা ভরে পানি এনে গামছা ভিজিয়ে বউয়ের কপালে চেপে ধরে বিড়বিড় করে আল্লাহকে ডাকতে লাগল: ‘ও আল্লা, মাপ করে দে। মাপ কার দে মাবুদ। দরগাতলিত্ শিন্নি দিমু, মাপ কেরে দে। মোর বউক্ ভাল কোরে দে।’ তার পর সে তার বউকে ধরে ঝাঁকায় আর বলে, ‘ও বউ, আল্লা আল্লা কর, আল্লা আল্লা কর।

বউ কাতরায়, মাকে ডাকে, আল্লাকে ডাকে। জয়নাল বলে, ‘হয় হয়, বেশি করে আল্লা আল্লা কর। ভাল হয়া যাবু, আল্লামাবুদ তোক্ ভাল কোরে দিবে। আল্লা, রহম করিস মাবুদ!’

৯.
দুপুরের দিকে জ্বর একটু পড়ে এলো। বউ ইশারায় জয়নালকে ডাকল। জয়নাল কাছে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে বউয়ের মুখের দিকে চেয়ে বলল, ‘কী কস, বউ?’ বউ নিস্তেজ কণ্ঠে বলল, ‘ট্যাংরা মাছ দিয়ে চারটা ভাত খাবার মন চায়।’

জয়নাল লাফ দিয়ে উঠে তৌরা জালটা কাঁধে নিয়ে বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে গেল। যেতে যেতে মনে মনে বলল, দুনিয়ার ব্যাবাক ট্যাংরা মাছ আজ ধরে লিয়ে আসমু।
জয়নাল ঝপাৎ শব্দে খালের পানিতে জাল ছুড়ে দিল, দিয়ে হাঁপাতে থাকল, কোমর হেলিয়ে সামনে ঝুঁকে দুই হাঁটুতে দুহাতে ভর দিয়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বড় বড় চোখে খালের পানির দিকে চেয়ে রইল। খালের পানি কাঁপতে কাঁপতে স্থির হয়ে এলো। এবার সে জাল টানতে শুরু করল।

জালে মাছ উঠল না। শামুক ঝিনুক গুগলি ব্যাঙ কাঁকড়া রাজ্যের আবর্জনা উঠে এলো। জয়নাল জাল ঝেড়ে আবর্জনা পরিষ্কার করে আবার ছুড়ে দিল। আবার টেনে তুলল। মাছ উঠল না। আবার জাল ঝাড়ল, আবার ছুড়ে দিল, আবার টেনে তুলল। কিন্তু নিষ্ফল। এই নিষ্ফলতার চক্রে ঘুরপাক খেতে খেতে জয়নাল বিড়বিড় করে বলল, ‘মাছ গ্যালো কোন্টে? কোন্টে গ্যালো দুনিয়ার ব্যাবাক মাছ?’

ভেজা জালটা কাঁধে নিয়ে এবার সে খালের পাড় ধরে হাঁটতে শুরু করল। তার মনে হলো, খালটা বাড়ির এত কাছে বলেই কোনো মাছ নাই, লোকজন সব মাছ ধরে খেয়ে ফেলেছে। দূরে গেলে নিশ্চয়ই কিছু মাছ পাওয়া যাবে। দূরে গিয়ে সে জাল ফেলল। কিন্তু দূরেও মাছ নাই। সে বেকুব বনে গেল। জাল রেখে মালকোঁচা বেঁধে খালের পানিতে নেমে পড়ল। জালেই যেখানে মাছ আটকা পড়ছে না, সেখানে সে শুধু দুই হাত দিয়ে মাছ ধরতে চায়। সে খালের তলার কাদামাটি হাড়তে বেড়াল। হাতে শামুক ঠেকল, কাঁকড়ার সুচালো ঠ্যাং ফুটে গেল।

‘ঘটনা কী? কোন্টে গ্যালো দুনিয়ার ব্যাবাক মাছ?’

জয়নালের মনে হলো, সে এক অলীক জগতে ঢুকে পড়েছে, এখানে যা-কিছু ঘটছে তার কিছুই সত্য নয়। দুনিয়ার সব মাছ উধাও হয়ে গেছে এটা হতে পারে না, তার সারা জিন্দেগিতে কখনো এরকম হয়নি।

সে শূন্য হাতে খালের পাড়ে উঠে দাঁড়াল। মালকোঁচা খুলে লুঙ্গি চিপে পানি নিংড়াতে নিংড়াতে ভাবল, এখন খালি হাতে ক্যাংকা করে বাড়িত ফিরে যাই? আহারে, বউডা মোর ট্যাংরা মাছের ঝোল দিয়ে ভাত খাবা চায়। সে হঠাৎ চিৎকার উঠল: ‘ও ট্যাংরা মাছের গ্যাতিগুষ্টি, কোন্টে গেলিন তোমরা সকলে? ইংকা নিমকহারামি কোরো না হামার সাথে।’

খালপাড়ের সড়ক ধরে কাঁধে লাঠি জাল খালুই নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে খয়বর জেলে।

জয়নাল হাঁক ছেড়ে ডেকে উঠল, ‘খয়বর ভাই, কোন্টে যাস? মাছ মারবা?’

খয়বর সাড়া দিল না। মাথা নিচু করে আপন মনে দুলকি চালে হেঁটে চলল।

জয়নাল বলে উঠল, ‘মাছ ত নাই। উধাও হয়া গেছে শুয়োরের বাচ্চারা।’
‘মাছ ধরবা জানা লাগে।’ ফুটানি প্রকাশের সুরে বলল খয়বর জেলে। নিজের পথে নাচতে নাচতে হেঁটে চলল হাটের পথে।

জয়নাল দৌড়ে তার দিকে যেতে যেতে বলল, ‘থাম থাম! মিচ্চি অ্যানা থাম রে ভাই।’

খয়বর একটুও থামল না।

তার পিছু পিছু যেতে যেতে জয়নাল বলল, ‘তালে তোর খলইত্ মাছ আছে?’

খয়বর বলল, ‘মাছার খলইত মাছ থাকবে না তে কার কাছে থাকবে?’
‘এনা থাম রে, ভাই।’
‘ক্যা?’
‘মুই মাছ কিনমু।’
‘মৎস্য বেন্নাগেরে খাদ্য লয়।’ খয়বর একই তালে এগিয়ে চলল।

এবার জয়নাল চিৎকার করে উঠল, ‘থাম কনু, থামেক!’

খয়বর থমকে দাঁড়াল। সে অবাক।

জয়নাল বলল, ‘কয় ট্যাকার মাছ আছে তোর খলইত্?’
‘ক্যা? তোর আবার ট্যাকার গরম হলো কোন্টে থিনি?’
‘বেশি কতা কস না। খলই নামা।’
‘লে দ্যাখ। দেখেই হাউস মিটা। কিনার মুরাদ হোবে না।’

জয়নাল দেখল, তেলাপিয়া, সিলভার কার্প, কই, পুঁটি এবং বড় বড় ট্যাংরায় খয়বরের খলুইটি রীতিমতো ধনী।

‘ট্যাংরা কত্টি আছে?’ জয়নাল জানতে চাইল।
‘স্যারখানেক হোবে, ক্যা?’
‘দাম কত?’
‘ক্যা? কিনবু নাকি?’
‘দাম কত তাই ক।’
‘আশি ট্যাকা।’

জয়নাল তার জালটা দেখিয়ে বলল, ‘মোর এই জালের দাম কটিৎ হোবে?’
‘ক্যা?’
‘আগে ক কত হোবে? লতুন জাল।’
‘শত্খানেক হবার পারে।’
‘গুলতানি মারিস না। খালি সুতার দামই আছে দ্যাড়শ ট্যাকা! তার উপর আছে কাঁটির দাম, আছে বুনানির খরচ।’
‘এই হিসাব দিয়ে মুই কী করমু?’
‘মোর এই জালডা তুই লিয়ে লে। আর ট্যাংরা মাছ যতগুলা আছে ঢাল মোর খলইত্। পনচাশ ট্যাকা পরে ফেরত দেস।’
‘না, জাল মুই নিমু না। মোর জাল আছে।’
‘ঠিক আছে লে, ট্যাকা ফেরত দেওয়া লাগবে না। লে লে, তাড়াতাড়ি কর।’

খয়বর জেলে বেছে বেছে শুধু ট্যাংরা মাছগুলো নিজের খলুই থেকে জয়নালের খলুইতে পার করে দিল। তার পর জয়নালের জালটা নিজের লাঠির এক মাথায় বেঁধে নিয়ে নিজের খালুইটি অন্য মাথায় নিজের জালের পাশে ঝুলিয়ে লাঠিটা কাঁধে ফেলে নাচতে নাচতে চলে গেল হাটের পথে।

জয়নাল ট্যাংরা মাছসুদ্ধ ছোট্ট খালুইটা হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করল। ইতোমধ্যে বেলা পড়ে গেছে, জয়নালের মনটা ছট ফট করে উঠল : ‘আহারে, বউটার বুঝি কত খিদা লাগিছে!’

১০.
জয়নাল দূর থেকে দেখতে পেল তাদের বাড়ির সামনে লোকজনের ভিড়। সে একটু থেমে দাঁড়াল, তার পর আবার হাঁটতে থাকল। বাড়ির দরজার কাছে পৌঁছলে লোকজন সরে গিয়ে তাকে পথ করে দিল। কিন্তু কারো মুখে কোনো কথা নাই। ভিড়ের পেছনের দিকে দুয়েকজন চাপা স্বরে ফিস ফিস করে কিছু বলল।

জয়নাল বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখতে পেল, উঠানের মাঝখানে খা খা রোদে একটা চৌকি পাতা হয়েছে। চৌকির উপর একটা লাশ, মাথা থেকে পা পর্যন্ত ময়লা কাঁথায় ঢাকা। চৌকির এক কোণে থুতনি রেখে চুপ করে আছে চাচি। কাঁদছে না, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে।

জয়নাল হাতের খলুইটা মাটিতে রেখে আঙিনা থেকে সামান্য উঁচু মাটির বারান্দার কিনারে বসল। দুই হাঁটুতে কনুই ঠেস দিয়ে গলাটা লম্বা করে ছেড়ে দিল, তার মাথাটা ঝুলে পড়ল। লোকজন গোল হয়ে ঘিরে ধরল তাকে, কিন্তু কেউ কোনো কথা বলল না। তাদের কারো কারো মনে হলো, জয়নাল এক্ষুনি ডুকরে কেঁদে উঠবে, তার কান্নার শব্দে আসমানটা ফালা ফালা হয়ে যাবে।

কিন্তু জয়নাল কাঁদল না, চোখ বন্ধ করে বসে রইল। তার মাথাটা দুই বাহুর মাঝখানের ফাঁকে ঝুলে রইল।

চাচা কাছে এসে বলে, ‘কী জয়নাল, বসে থাকলু ক্যান, বাপ? দাফন-কাফনের জোগাড়পাতি করা লাগে ত!’

জয়নাল মাথা তুলল না। চুপচাপ ঝিম মেরে বসেই রইল।

চাচা তাড়া দিল, ‘ওঠ্ বাপ, মউতা বেশিক্ষণ থোওয়া ঠিক লয়, আজাব হয়।’

জয়নাল এবার মাথা তুলল। সবাই তার মুখের দিকে উৎসুক চোখে তাকাল। তারা দেখতে পেল: কিছু হয় নাই জয়নালের। মরদ শক্ত আছে!

বাঁশ কেটে খাটিয়া বানানো হলো, মউতাকে গোসল করানো হলো, গোলাপজল ছিটানো হলো, ধূপকাঠি জ্বালানো হলো, খুব তাড়াতাড়ি সব বন্দোবস্ত হয়ে গেল। মধুপুরের কোথাও কোনো বিকার দেখা গেল না। জয়নালের বউয়ের মরে যাওয়া কারো কান্নার উদ্রেক করল না: মেয়েটি এখনো এ গাঁয়ে নতুন। শুধু জয়নালের চাচির বুঝি মেয়েটির জন্যে মায়া পড়ে গিয়েছিল, শুধু সে বুড়িই মাঝেমাঝে নাকি স্বরে কেঁদে উঠছে। শুধু তখনই মনে হচ্ছে যে বাড়িটা একটা মরাবাড়ি।

খাটিয়া গোরস্থানের পথে রওয়ানা দেওয়ার আগমুহূর্তে দোস্ত ইদ্রিস জয়নালকে বলল, ‘জয়লাল, দোস্ত, বউয়ের মুখটা একবার দেখবু না?’

জয়নাল অবশেষে মুখ খুলল: ‘মুখ দেখে আর কী হোবে? এমন বেয়াক্কালা মেয়ামানুষ আর দুনিয়াত নাই। মরেই যদি যাবু, তালে কলু ক্যান যাও মাছ ধরে আনো! ক্যান কলু না কাছে থাকো!’

বউকে কবরে রেখে এসে জয়নাল আবার বারান্দার কিনারে বসে ঘাড় শিথিল করে মাথাটা ঝুলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করল। তার পর ঝপ করে রাত নেমে এলো। পাড়াপ্রতিবেশীরা একে একে চলে যেতে লাগল, যাওয়ার সময় নিজেদের মধ্যে বলাবলি করল :
‘হামাগেরে জয়নাল শক্ত মরদ আছে।’
‘আরে বাপু, বউ মরা কোনো ব্যাপার হলো? এক বউ মলে দশটা বউ পাওয়া যায়।’
‘হয় হয়, দ্যাশ জুড়ে কত মেয়া, আর হামাগেরে জয়নাল যে তাগড়া জুয়ান, আজই হয় করলে কালই কত মেয়ার বাপ ঘড়ি সাইকেল ট্যান্ডিস্টার লিয়ে দৌড়ে আসপে...!’

অনেকক্ষণ পর জয়নাল মাথা তুলে বিড় বিড় করে বলল, ‘মরেই যদি যাবু, তালে মোক্ মাছ ধরবা পাঠালু ক্যান? ক্যান কলু না কাছে থাকো?’

গলির মোড়ে কুকুর কেঁদে উঠল। দূরে শিয়ালের ঝাঁক হুক্কাহুয়া শুরু করল। বাঁশঝাড়ে একটা পেঁচা ডেকে উঠল।

চাচি জয়নালকে ভাত খেতে ডাকল। জয়নাল আবার মাথা ঝুলিয়ে অন্ধকার মাটির দিকে চেয়ে বলল, ‘খিদা নাই।’

অনেকক্ষণ সে নীরব অন্ধকারে একা একা বসে রইল। তার পর কোমরে হাত দিয়ে উঠে দাঁড়াল, আকাশের দিকে তাকাল। চাঁদ নাই, একটা তারা পর্যন্ত নাই। আকাশ ভাতরাঁধা মাটির পাতিলের তলার মতো কালো। কোথাও কোনো আলো নাই।

জয়নাল নিজের ঘরে গেল। দরজায় খিল না এঁটেই শুয়ে পড়ল।

জয়নাল ঘুমিয়ে পড়ল। আর জাগল না। সে আর কোনো দিন জেগে ওঠেনি।

   

গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ধ্রুব এষ



বার্তা২৪ ডেস্ক
শিল্পী ধ্রুব এষ

শিল্পী ধ্রুব এষ

  • Font increase
  • Font Decrease

নান্দনিক প্রচ্ছদ ও অলংকরণশিল্পী হিসেবে দেশে আলাদা অবস্থান তৈরি করেছেন ধ্রুব এষ। শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ নিয়ে ঢাকার পান্থপথের হেলথ এন্ড হোপ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এই শিল্পী।

হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে বলেন, “তার অবস্থা বর্তমানে স্থিতিশীল।”

জ্বর সঙ্গে তীব্র কাশি নিয়ে বুধবার এ হাসপাতালে আসেন ধ্রুব এষ। পরিস্থিতি দেখে তাকে এইচডিইউতে ভর্তি করে নেওয়া হয়।

লেলিন চৌধুরী বলেন, "শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণের কারণে উনার অক্সিজেন স্যাচুরেশন কমে গিয়েছিল। সে কারণে অবস্থা কিছুটা অবনতির দিকে গিয়েছিল। পরে অক্সিজেন সরবারাহ করা হয়, এখন তিনি স্টেবল আছেন। আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি।"

সুনামগঞ্জের সন্তান ধ্রুব এষের বয়স ৫৭ বছর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলার ছাত্র থাকার সময় বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা শুরু করেন। প্রয়াত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের অধিকাংশ বইয়ের প্রচ্ছদ ধ্রুব এষেরই আঁকা। তার আঁকা প্রচ্ছদে প্রকাশিত হয়েছে ২৫ হাজারের বেশি বই।

দেশে প্রচ্ছদশিল্পে আধুনিকতা আনার কৃতিত্ব কেউ কেউ ধ্রুব এষকে দেন। আঁকাআঁকির সঙ্গে তিনি লেখালেখিও করেন। শিশুসাহিত্যে অবদানের জন্য ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার পান ধ্রুব এষ।

;

তৃতীয় পক্ষ



ওমর শরিফ
অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

অলঙ্করণ: মামুনুর রশীদ

  • Font increase
  • Font Decrease

 

এ শহরে বাড়ি আর বাড়ি। ছায়া, শান্তি দেবে এমন গাছ কোথায়? গত বারের তুলনায় এবার গরমটা একটু বেশী পড়েছে। দুপুরবেলা তাই খাঁ খাঁ করছে রাস্তাঘাট। প্রায় জনমানব শূন্য চারিদিক। মাঝে মাঝে কিছু রিক্সা, ট্যাক্সি চলছে এদিক সেদিক। ভাগ্যিস দুই রাস্তার মাঝের ডিভাইডারে সারি সারি গাছ আছে। তবু একটু সবুজ দেখা যায়, তা-না হলে কিযে হতো? কথাগুলো ভাবলো মিতু। কলেজ পড়ুয়া তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী মিতু। কলেজে কোন ভাবেই মন বসছিলোনা মিতুর। একটা ঘটনা অস্থির করে রেখেছে তাকে কাল থেকে। তাই মাত্র তিনটা ক্লাস করে বেরিয়েছে ধানমন্ডি লেক যাবে বলে। ধানমন্ডি লেকে অনেক গাছ, অনেক শান্তি। সায়েলা, রবি দু’একবার জিজ্ঞেস করেছে কোথায় যাচ্ছে জানার জন্য। সায়েলা, রবি মিতুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মিতু ওদের মিথ্যে বলেছে।

-বলেছে ‘বড় চাচার বাড়ি যাচ্ছি, চাচা একটু অসুস্থ তাই দেখা করে ওখান থেকেই বাসা চলে যাবো’।     

‘ক্লাস শেষে বন্ধুদের আড্ডা জমে উঠেছিলো খুব তবু ছাড়তে হয়েছে। এই খাঁ খাঁ রোদে কার দায় পড়েছে তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসার? কল দিলে কল ধরো না, কেটে দাও আবার ব্যাকও করনা! এটা কি ধরনের কথা’? রিক্সার ভাড়া দিতে দিতে বলল মিতু। মিতুর রাগ দেখে সামনে দাঁড়ানো স্বপন মিটমিট হাসছে। ছয় ফিটের মতো লম্বা, ট্রিম করা দাড়ি, মাথার চুল এলোমেলো, একটা হাওয়াই শার্ট সঙ্গে জিন্স পড়া। পায়ে স্যান্ডেলের বদলে স্নিকার পড়েছে আজ। একটু আগোছাল যাকে বলে ‘স্বযত্নে অবহেলা’। স্বপনের এই ব্যাপারটাই দারুণ টানে মিতুকে। ওর মধ্যে কোথায় একটা ব্যাপার আছে। কি নেই, আবার আছে। ঠিক পূর্ণ নয় আবার খালিও নয়। স্বপন মোটামুটি স্বচ্ছল পরিবারের ছেলে। দেশের নামকরা একটা পত্রিকা অফিসে কাজ করে। কথা কম বলে। যা কথা বলে তা ওর গিটার বলে। খুব ভালো গিটার বাজায় স্বপন।      

রিক্সা থেকে নেমে তেড়ে এলো মিতু। ‘কি কানে শোন না। হাসছো আবার, লজ্জা নেই’? রাগে বলল মিতু।

‘আচ্ছা বাবা রাগ পরে হবে। আগে চলো লেকের ভেতরটায় যাই, এখানে অনেক রোদ’। বলল স্বপন। লেকের পার ধরে দুজনে হাঁটতে হাঁটতে লেকের পাশে থাকা রেস্টুরেন্ট ‘জলসিরি’তে গিয়ে বসলো। রেস্টুরেন্টে লোকজন কম। দাঁড়িয়ে থাকা ওয়েটারকে এসিটা অন করে দিতে বলল স্বপন। মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বলো কি হয়েছে, এতো জরুরি তলব কেন?’

মিতু প্রতিত্তরে বলল, ‘আগে বলো এতক্ষণ ধরে তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন’? কতোবার ট্রাই করার পর তোমাকে পেয়েছি, তোমার হিসাব আছে? এতো কথার পরও স্বপনকে শান্ত দেখে মিতু আরও খানিকটা রেগে গেলো। বলল, ‘তুমি কি অনুভূতিহীন, তোমার কি জানতে ইচ্ছে করেনা, আমি কেন এতবার ফোন দিয়েছি’?

স্বপন একটু সিরিয়াস হয়ে গলা খাকিয়ে বলল, ‘আসার পর থেকে আমাকে বলার সুযোগ দিয়েছ তুমি? শুধু নিজেই বলে যাচ্ছ’।

এতক্ষণে নিজেকে যেন খুঁজে পেলো মিতু, একটু লজ্জাও পেলো। কিছুটা নমনীয় হয়ে বলল, ‘আচ্ছা বলো কেন ফোন ধরতে এত সময় নিলে’?

স্বপনের সরল উত্তর, ‘খুব জরুরি মিটিং এ ছিলাম তাই তোমার ফোন আসার সঙ্গে সঙ্গে ফোন ধরতে পারেনি। মিটিং শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে ফোন করেছি। তারপর সব কাজ ফেলে এইতো তোমার সামনে আমি’।

মুখের এক্সপ্রেশন দেখে বোঝা গেলো উত্তরে মিতু সন্তুষ্ট হয়েছে। কিন্তু কিসের যেন উদ্বেগ স্পষ্ট। ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি স্বপনের।  সে বলল, ‘কি হয়েছে? কোন সমস্যা? আমাকে খুলে বলো’।

মিতু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘স্বপন আমার বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে বাসা থেকে। পাত্র পক্ষ জানিয়েছে আমাকে খুব পছন্দ হয়েছে তাদের। আগামীকাল আসবে ডেট ফাইনাল করতে। আমি এখন কি করবো স্বপন? আমাকে বলে দাও’।

স্বপন বলল, ‘বিয়ে করে ফেল। বাবা মা যা চাই তাই করো এতে সবার মঙ্গল’।

মিতু অবাক হয়ে স্বপনের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। বলল, ‘মানে কি? তাহলে এতদিন আমারা কি করলাম। তুমি একটা প্রতারক। তুমি একটা হিপোক্রেট। এখন দায়িত্ব নেয়ার সময় পালাচ্ছো। কাপুরুষ কোথাকার’। তখনও স্বপনের ঠোঁটে মৃদু হাসি দেখে অবাক হয়ে গেলো মিতু।

স্বপন মিতুর দুহাত টেনে কাছে নিয়ে বলল, ‘এতো দিনেও চিনতে পারলেনা আমাকে। তুমি যা ভাবো আমি তার থেকে অনেক অনেক বেশী ভালোবাসি তোমাকে’। বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বপন বলল,‘চলো’। মিতু বললো,

- ‘চলো’। মিতু বললো,
- ‘কোথায়’?
- চলোই না।
- আগে বলো কোথায়?
- কাজী অফিসে।
- মানে?!
- আমরা আজই এক্ষুনি বিয়ে করছি।
- কি বলো এসব?
- যা বলছি ঠিক বলছি। এছাড়া আমাদের হাতে আর কোন পথ নেই।
- তোমার বাসা?
- আমি ম্যানেজ করবো।
- আমার বাসা?
- ওটা পরে ম্যানেজ হয়ে যাবে।

 

দরজা খুলতেই নাসরিন স্বপনের সঙ্গে একটি মেয়েকে দেখতে পেলো। দুজনেই পা ছুঁয়ে সালাম করতেই নাসরিন অবাক হয়ে পা সরিয়ে নিলো। কিছুটা সংকোচেও। নাসরিন স্বপনের মা। নাসরিন কিছুটা হতভম্ব হয়ে দরজা ছেড়ে দাঁড়ালেন। সোফায় বসতে দিলেন। সোফাতে বসে মাকে উদ্দেশ্য করে স্বপন বলল, ‘মা আমরা বিয়ে করে ফেলেছি। তোমাকে  পরিচয় করিয়ে দিই। এ হচ্ছে মিতু। মিতু, ‘ইনি তোমার শাশুড়ি’।

নাসরিন ছেলের দিকে হাঁ করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। যেন কিছুই বুঝতে পারছেন না। একটু ধাতস্থ হয়ে বললেন, ‘এসব কি বলছিস স্বপন, কাউকে না জানিয়ে এতবড় কাজ তুই কিভাবে করলি? তোর বাবাকে আমি কি উত্তর দিবো। আর চিনি না জানি না একটা মেয়েকে এনে ঘরে তুললি?

স্বপন পাত্তা না দিয়ে উত্তর দিলো, ‘মিতু ভালো ঘরের মেয়ে। বাবা মা শিক্ষিত। সে নিজেও শিক্ষিত অনার্স করছে। দেখতে ভালো, স্বভাব চরিত্রেও ভালো। তোমার সামনেই আছে দেখে নাও’। বলে হাসতে লাগলো।

নাসরিন আর বেশী কথা না বাড়িয়ে মিতুর দিকে তাকালেন। প্রথমিক কিছু কথা বার্তা জিজ্ঞেস করলেন।

বললেন, ‘বিয়েটা কি কোন ভাবে থামানো যাচ্ছিল না বা বাবা মা কে বুঝিয়ে শুনিয়ে অনার্স শেষ করে তারপর বিয়েটা হলে বোধহয় ভালো ছিল’। মিতু মাথা নিচু করে শুধু শুনে যাচ্ছে।

শুধু বলল, ‘আন্টি আমি বাবাকে খুব ভয় পাই আর বাবা সরকারি চাকরি ছাড়া বিয়ে দিবেন না। বললে আরও ঝামেলা বাড়বে’। 

নাসরিন মিতুকে থামিয়ে দিয়ে ঘরে নিয়ে যেতে বললো।

স্বপন দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো, ‘অফিসে বিশেষ কাজ আছে, আমাকে একবার এক্ষুনি অফিস যেতে হবে। এর মধ্যে আশা করি তোমাদের চেনা জানা হয়ে যাবে’।

স্বপনের কথা শুনে মা ও মিতু দুজনেই বেশ অবাক হয়ে একে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকলো।

নিজের রুমে বসে বসে মিতু ল্যাপটপে হানিমুনের ছবি দেখছিল। কাশ্মীর যে কি সুন্দর ভাবাই যায় না। পাহেলগাম, সোনমার্গ, গুলমার্গ জায়গাগুলো ভোলার মতো না। সেবারই জীবনের প্রথম বরফ পড়া দেখেছিলো মিতু। কিছু ছবি দেখেতো মিতু রীতিমত না হেসে পারল না। সে সময় ওরা দুজনেই কেমন বাচ্চা বাচ্চা ছিল। ‘দেখতে দেখতে বিয়ের প্রায় চার বছর হতে চললো’ ভাবল মিতু। একটু কি দীর্ঘশ্বাসের মতো বয়ে গেলো বুকের ভিতরটায়? হানিমুনের ছবি দেখা শেষে পুরনো কিছু ছবিতে চোখ গেলো মিতুর। বাবা মা’র ছবি। বাবা মা পাশাপাশি বসা। বাবার কোলে মিতু। মিতুর বয়স তখন ছয় কি সাত হবে। কি দারুন একটা ছবি। মনের অগোচরেই চোখটা ভিজে এলো মিতুর। এখনও বাবার বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক হয়নি।

মিতুর বাবা মিতুর বিয়ের কথা শুনে বলেছিলেন, ‘মিতু নামে আমার মেয়ে ছিল আমি ভুলে গেছি। বাবার অপমান করতে যে মেয়ের বিন্দুমাত্র বাঁধে না; সে আমার মেয়ে হতে পারে না। মিতুর মুখ আমি দেখতে চায়না’।

মাস্টার্স পাস করে মিতু চাকরির কথা ভাবেনি, যদিও স্বপন ওকে বার বার বলেছে বাসায় একা একা বোর লাগবে, তবুও। মিতুর শাশুড়িও একই কথা বলেছে, কিন্তু মন থেকে সায় দেয়নি মিতু। বাচ্চা পালন করবে আর সংসার সামলাবে এটিই ছিল তার চিন্তা।

মিতুর বাচ্চার খুব শখ কিন্তু স্বপন এখন বাচ্চা নিতে নারাজ। বললেই বলে, ‘আরে বাচ্চার জন্য এতো তাড়া কিসের, অঢেল সময় পড়ে আছে, আগে নিজেদের মতো করে সময় পার করি’।

স্বপন সকাল সকাল বেরিয়ে যায় ফেরার কোন সময় নির্দিষ্ট নেই। কখনও আটটা কখনও দশটা পেরিয়ে যায়। আবার কখনও কাজের এতো চাপ থাকে যে কোন কোন রাতে বাসা ফেরা হয়না। কাজ নিয়ে খুব সিরিয়াস স্বপন। খুব তাড়াতাড়ি কয়েকটা প্রমশনও পেয়েছে সে। এই বছর প্রমোশন নিয়ে গাড়ি কিনেছে ওরা। মিতুর পছন্দতেই কেনা। লাল রঙের গাড়ি। লাল রঙের গাড়ি মিতুর খুব পছন্দ। স্বপনের উন্নতিতে মিতুর গর্বের শেষ ছিলনা। মিতুর কেবলই মনে হতো স্বপনের যত সাফল্য সবই তার নিজের। সে নিজে অনুভব করতো আর আনন্দ নিয়ে সেলেব্রেট করতো। মিতুর বন্ধু বান্ধবী পাড়া পরশি যার সঙ্গেই কথা হোক না কেন, ইনিয়ে বিনিয়ে স্বপনের সাফল্যের কথা বলবেই। সে কথায় কথায় স্বপন যে তার ক্যারিয়ারে খুব ভালো করছে, সে হাসবান্ড হিসেবে খুব কেয়ারিং, পরিবারের ব্যাপারে যত্নবান সেগুলো অন্যকে বলে আত্মতৃপ্তি পায়। সেদিন পাশের বাসার ভাবি বললেন, ‘মিতু ভাবি কি যে করি বলেন তো? আমার হাসবান্ড তো আমার হাতের রান্না একেবারেই খেতে পারেনা। আপনি কিভাবে যে ম্যানেজ করেন’?

মিতু হাসতে হাসতে বলন, ‘আপনার ভাইতো আমার হাতের রান্না ছাড়া খেতেই পারেনা। আসলে এ হচ্ছে ভালোবাসা, বুঝেছেন ভাবি ভালবাসা থাকলে বিষও মধু মনে হয়’।

মিতুর সেদিনের সেই আত্মতৃপ্তি ভোলার মতো না। কথা যখন বলছিলো তখন দু চোখ চকচক করে উঠছিল যেন। 

কিছুক্ষণ ধরে মোবাইলটা বেজে চলেছে। মিতু রান্না করছিলো তাই ধরতে দেরি হলো।

হাত মুছে ফোনটা ধরে বলল, ‘হ্যালো স্লামালেকুন। কে বলছেন’?  

মোবাইল ওপাশ থেকে ভেসে এলো, ‘ভাবি আমাকে চিনতে পারছেন আমি ফারুক বলছি। ঐযে নিউ মার্কেটে দেখা। আপানারা প্লাস্টিকের কিছু জিনিস কিনছিলেন। মনে আছে’?  

মনে পড়ে গেলো মিতুর। সে বলল, ‘ও হ্যাঁ ফারুক ভাই! কেমন আছেন? বাসায় সবায় কেমন আছে? বাচ্চারা কেমন আছে’? সরি ফারুক ভাই আপনার নম্বারটা আমার মোবাইল সেভ ছিল না’।  

ফারুক উত্তরে বলল, ব্যাপার না ভাবি, হতেই পারে। আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালো আছে। আলহামদুলিল্লাহ। ভাবি একটা কাজে একটু ফোন করেছিলাম’।

মিতু বলল, কি ব্যাপার বলুন তো?

স্বপন ভাইকে একটু দরকার ছিল। উনি কি বাসায় আছে না কোন কাজে বাইরে গেছেন?

কেন আপনি জানেন না? আপনার স্বপন ভাইতো আপনাদেরই অফিসের ট্যুরে চট্টগ্রাম গেছে।

ফারুক একটু অবাক হয়ে বলল, ‘কি বলেন ভাবি? আমার জানা মতে স্বপন ভাইতো অফিসের ট্যুরে কোথাও যাননি। বরং উনি তো বাসার কাজের কথা বলে দু’দিন ছুটি নিয়েছেন।!

মিতু আর কথা বাড়ায় না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে, অনুমানে সে তা বুঝেছে। সে কথাটা ঘুরিয়ে ফারুককে বলল, ‘হ্যাঁ স্বপন বলছিলো বাসার কাজের সঙ্গে অফিসের কাজও সেরে আসবে। তাইতো সেদিন আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলো। আমি হয়তো বুঝতে ভুল করেছি’।

ফারুক ওপাশ থেকে বলল, ‘ও আচ্ছা ঠিক আছে ভাবি, স্বপন ভাইয়ের অন্য কোন নম্বার থাকলে দিলে ভালো হয়। জরুরি আলাপ আছে’।

ফারুক ভাই স্বপনের তো একটাই নম্বার। ও তো আর অন্য কোন নম্বার ব্যবহার করেনা। ও কল দিলে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলবো’।

কথা বলার সময় যতদূর সম্ভব মাথাটাকে ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করলো মিতু। কথা শেষ করে বিছানায় ধপাস করে বসে পড়লো সে। সে কিছু একটা গড়বড় আছে অনুমান করছে। কিন্তু আবার এও চিন্তা করছে অনুমান নির্ভর কিছু ভেবে বসা ঠিক না। সে মনে মনে চিন্তা করলো, ‘স্বপন এলে কথা বলবে’।

স্বপন দুই দিন পর অফিসের কাজ করে বাসায় ফিরে এলো। এসেই মিতুকে জরিয়ে ধরে চুমু খেল। গভীর আদরে বুকের মধ্যে নিয়ে অস্ফুটে বলল, ‘আহা কি শান্তি। তোমাকে বুকে নিলে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। এই কি আছে তোমার মধ্যে? তোমাকে বুকে নিলেই আমার কেন এতো শান্তি শান্তি লাগে?

মিতু শুধু হুম হলে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বেশী কথা বাড়ালো না। স্বপন মিতুর এই ব্যবহারে কিছুটা অবাক হল। বলল, কি ব্যাপার শরীর খারাপ নাকি? কিছু হয়েছে? মন খারাপ?

মিতু উত্তরে বলল, ‘রান্না করতে করতে একটু টায়ার্ড হয়ে গেছি মনে হয়। ঠিক হয়ে যাবে। তুমি তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি’। বলে মিতু রান্না ঘরের দিকে চলে গেল। স্বপনও ফ্রেশ হতে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

মিতুর স্বপনের এরকম ব্যবহার দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করলো। মন থেকে কালো মেঘ যা এতক্ষণ খেলা করছিলো তা কেটে গেলো। নিজেকে খুব হাল্কা হাল্কা বোধ করছে এখন। দুজনে একসঙ্গে বসে খেল। ডাইনিং টেবিলে স্বপন অনেক গল্প করলো মিতুর সঙ্গে। মনে হল এই দুইদিনে অনেক গল্প জমা ছিল। মিতুকে পেয়ে সব বাধা সরে গিয়ে একসঙ্গে বেরিয়ে আসতে লাগলো সব।

এতো কিছুর পরও মিতু লক্ষ্য করলো, ‘আগে কথায় কথায় স্বপন মিতুর গায়ে হাত দিত। ট্যুর থেকে এলে বেডে অনেক আদর করতো। কিন্তু এবার টায়ার্ড বলে পাশ ফিরে শুয়ে গেলো। মিতুর শরীরটাকে কাছে টেনে পর্যন্ত নিলো না। স্বপনের ব্যবহার মিতুর কাছে কিছুটা আলাদা মনে হল। শুয়ে শুয়ে মিতুর কেবলই মনে হতে লাগলো অফিস থেকে দেরিতে ফেরা, হুটহাট ট্যুরের নামে বাইরে যাওয়া। মোবাইল চ্যাট করা আর মোবাইল বেজে উঠলে খুব সন্তর্পণে অন্য রুমে গিয়ে কথা বলা, কেমন যেন আলগা একটা অনুভূতির সৃষ্টি করলো মিতুর কাছে। মিতু ঠিক বুঝতে পারছে কিছু তো একটা আছে যা মোটেও স্বাভাবিক নয়। কোথায় যেন কি নেই। মিতু মনে মনে ছটপট করে উঠলো। এতদিন তাহলে কেন বুঝতে পারেনি সে? নাকি এ সবই তার ভুল, দুর্বল মনের বিকার মাত্র।

শুক্রবার ছুটির দিন। এই দিনটিতে স্বপন কিছুটা বেলা করে ঘুম থেকে ওঠে। মিতু সকালের রান্না করতে ব্যাস্ত সময় পার করছে। আজ পরোটা, ডিমভাজা আর আলুর দম রান্না হচ্ছে। স্বপনের ফেভারিট। নাস্তা প্রায় রেডি। স্বপনকে উঠাতে ঘরে ঢোকা মাত্র স্বপনের মোবাইল মেসাজের শব্দ কানে ভেসে এলো মিতুর। স্বপন তখনও ঘুমে অচেতন। ‘কোন জরুরি মেসেজ নাকি’? ভাবলো মিতু। মিতু কাছে গিয়ে মোবাইল তুলতেই আরেকটি মেসেজ ভেসে উঠলো। রিয়া নামে কেউ লিখেছে, ‘তোমাকে খুব মিস করছি’। মেসেজ দেখে মিতুর কেমন যেন বাজে অনুভূতি হল। সে সম্পূর্ণ মেসেজ পড়ার জন্য মোবাইল আনলক করতেই একগাদা হার্ট ইমজি ভেসে উঠলো। মিতুর চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠলো। সে ধীরে ধীরে স্ক্রল করতে শুরু করলো। সে যতই পড়ছে ততই অবাক হচ্ছে। স্বপন লিখেছে চট্টগ্রামের ট্যুরটা অতুলনীয় ছিল। রিয়ার উত্তর, ‘না মোটেও না। আমার মতে গুলশান হোটেলে আমাদের সময়টা ছিল বেস্ট। তবে কক্সবাজার ট্যুরটাও বেশ উপভোগ্য ছিল। বেডে যে তুমি কি পাগলের মতো করো না। তোমাকে সামলানোই যায় না। ইউ আর আ রিয়েল ওয়াইল্ড টাইগার। আই লাভ ইউ’।

উত্তরে স্বপন লিখেছে, ‘তোমার কোন তুলনা হয় না। তুমি বেস্ট। আই লাভ ইউ ঠু’।

সমস্ত শরীর থর থর করে কাঁপছে যেন। নিজেকে দিশেহারা মনে হচ্ছে। পাগল পাগল লাগছে সব। পড়ছে আর মিতুর দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ওদের দুজনের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি দেখা যাচ্ছে। এসব দেখে মিতুর কেবলই মনে হচ্ছে কেউ যেন ওর হৃৎপিণ্ডটাকে ছিঁড়ে কুটি কুটি করে দিচ্ছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড চাপ অনুভব করছে সে। কষ্টে কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না যেন। 

হঠাৎ করে ঘুম ভেঙ্গে মিতুকে তার মোবাইল হাতে কি যেন করছে দেখতে পেলো স্বপন। এমন সময় উঠে এসে পেছন থেকে মিতুর কাছ থকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘হাউ ডেয়াড় ইউ। তুমি আমার মোবাইলে হাত দিয়েছো কেন? মেসাজ কেন পড়ছো? মানুষের প্রাইভেসি বলে একটা কথা আছে। আনশিভিলাইসড কোথাকার’।

মিতু কিছুই বললোনা শুধু ফ্যালফ্যাল করে স্বপনের দিকে চেয়ে থাকলো। স্বপনের উদ্ধতপূর্ণ কথাবার্তা  নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলো না সে। এ ধরনের অন্যায় করার পর কোন মানুষ যে এতো নির্বিকার হতে পারে মিতুর চিন্তার বাইরে ছিল। শান্ত থাকতে থাকতে হঠাৎ মিতু চিৎকার করে উঠলো। বলল, চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার? অফিসের ট্যুরের নাম করে বান্ধবী কে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। ছি ছি তোমার লজ্জা করেনা?

স্বপন মিতুকে থামাতে এগিয়ে আসতেই মিতু একরকম পাগলের মতো চড়, থাপ্পড় দিতে শুরু করে দিলো। আক্রোশে স্বপনের রাতে পড়া জামাটা একটানে ছিঁড়ে ফেললো মিতু। মুখে বলল কুত্তার বাচ্চা তুই আমার বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে আমার জীবন নিয়ে খেলেছিস। বাস্টার্ড।

স্বপন মিতুকে থামাতে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। মুখে বলল, ‘আর একটা কথা বললে তোকে এখানেই মেরে ফেলবো। কি প্রমাণ আছে তোর কাছে যে আমি লম্পট। ... উল্টাপাল্টা কথা বললে তোকে আমি খুন করে ফেলবো’।

মিতু তখনও স্বপনের জামার কলার ধরে আছে। বলল, ‘ফারুক ভাই কল করেছিলো উনি বলেছেন তুমি অফিসের ট্যুরে যাওনি। তুমি তোমার লাভারের সঙ্গে হানিমুনে গিয়েছ চট্টগ্রামে। তারও আগে কক্সবাজারে আর গুলশানে একসঙ্গে রাত কাটিয়েছ। সবই পড়েছই আমি। তোমাদের একসঙ্গে ইন্টিমেট সব ছবিও দেখেছি। ছি তোমার ঘেন্না করেনা। চরিত্রহীন, লম্পট কোথাকার?

সব শুনে স্বপন একটা ধাক্কা খেল যেন। একটু বোকা বোকা লাগছে নিজেকে। সে আস্তে আস্তে বিছানায় গিয়ে বসলো। কোন উপায় না পেয়ে মিতুর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার ভুল হয়েছে মিতু, আমাকে তুমি ক্ষমা করো। এবারের মতো মাফ করে দাও, প্লিজ’।

অপরাধবোধ আর অনুশোচনায় নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছিলো স্বপনের। ক্ষণিকের আনন্দের জন্য এ কোন ভুল করে বসলো স্বপন। সে চাইলেও নিজেকে আর ক্ষমা করতে পারবেনা।  

এতক্ষণে মিতুও কিছুটা ধাতস্ত হয়ে এসেছে। স্বপনের দিকে তাকিয়ে শুধু জিজ্ঞেস করলো, ‘স্বপন আমার কি দোষ ছিল? আমিতো তোমাকে নিজেকে উজাড় করে চেয়েছি। এতো বড় কষ্ট তুমি আমাকে দিতে পারলে? তুমি আমার পৃথিবী ধ্বংস করে দিয়েছ। আমাকে শেষ করে দিয়েছ। কিভাবে পারলে? এসব জানার আগে আমার মৃত্যু হলনা কেন? স্বপন আমি যে তোমাকে খুব খুব ভালোবেসে ছিলাম। এত বড় প্রতারণা তুমি কেন করলে? আমাকে বললে আমিই তোমার জীবন থেকে চলে যেতাম। তাই বলে এতবড় আঘাত তুমি আমাকে দিতে পারলে’?

 

সময় যেন থেমে গেলো। মিতু আর আগের মতো উচ্ছ্বসিত হয়না। স্বপন বিরাট ভুল করেছে এবং তা সে বারবার স্বীকার করেছে। মিতু স্বপনকে মন থেকে ক্ষমাও করেছে। কিন্তু দিন শেষে যখন মুখোমুখি হয় তখন নিজের মূল্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয় মিতুর। বড্ড সস্তা লাগে নিজেকে। পরিপূর্ণভাবে কিছু দিতে না পারার বেদনা নিজেকে কুড়ে কুড়ে খায়। মিতু বুঝতে চেষ্টা করে তাদের মাঝে কি ছিলনা যে স্বপনকে অন্য মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট করেছে। সম্মানবোধ? মিতুর মতে, ‘স্বপন মিতুকে ভালোবাসতো ঠিক কিন্তু তার মধ্যে গভীরতা ছিলনা, সম্মান ছিলনা। যা ছিল তা প্রাত্যহিক জীবনের অভ্যেস। মাপ করে চুমু দেয়া, বাহির থেকে এসে জড়িয়ে ধরা, সাংসারিক কথা বলা, রুটিন করে মিলিত হওয়া। এর মধ্যে নতুনত্ব কি আছে? যা আছে তা সবই অভ্যেস। মিতু স্বপনকে রিয়ার কাছে কেন যাচ্ছে না জানতে চাইলে বলে, ‘রিয়াকে আমি সেভাবে কখনই দেখিনি। এটা একটা মোহ’।

মিতু বুঝতে পারে রিয়া স্বপনের পাঞ্চ লাইন। অনেকটা সারাদিনের ক্লান্তির পর এক পেগ মদ যেমন তেমন। স্বপনের কাছে ঘরটা থাকলো ঠিকই, মাঝে মাঝে একটু বাম্পার রাইডিং ও থাকলো, যা জীবনে স্পাইস যুক্ত করবে। এই সমীকরণ যা বোঝায় তা হচ্ছে। স্বপনের লয়াল থাকা প্রায় অসম্ভব, মিতুও সেটি বোঝে।

আগে দুজনার অনেক কথা হতো এখন সত্তুর শতাংশ কথা কমে গেছে দুজনার মধ্যে। প্রয়োজন ছাড়া কথা হয় না। একে ওপরের দিকে ঠিক ভাবে তাকাতে পর্যন্ত পারে না। অনুশোচনায় আর অপমানে দুজনেই শুধু হারিয়ে থাকে। দুজনেই অনুভব করে, কোন কিছুই আর আগের মতো নেই। ঘটনা প্রবাহে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে গেছে। স্বপন মিতুকে স্বাভাবিক হওয়ার জন্য যথেষ্ট সাহায্য চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মিতু নিজের সামনে নিজেই দাঁড়াতে পারছেনা। দুপুরে বিছানায় শুয়ে শুয়ে মিতু ভাবছে সে আর কি করলে এমন ঘটনা ঘটতো না? কি করলে স্বপনকে আগলে রাখতে পারতো? বার বার একই উত্তর পেলো। অভ্যেস! টানটা আর আগের মতো নেই।

পরের দিন খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মিতু বারান্দায় দাঁড়িয়ে সকালের আকাশ দেখছে। আনমনে কি যেন ভাবছে। স্বপন মিতুকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, ‘অফিসে যাচ্ছি’ বলে বের হয়ে গেলো। মিতু একবার সকালের নাস্তার কথা জিজ্ঞেস পর্যন্ত করলো না। বারান্দায় বসে দুই হাতের তালুতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে  কাঁদতে শুরু করলো।

রাতে স্বপন অফিস থেকে ফিরে এসে কলিং বেল দিলো। কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না দেখে একটু ভয় পেয়ে গেলো সে। ব্যাগে রাখা এক্সট্রা চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল স্বপন। রাতে লাইট জ্বালায়নি মিতু। পুরো বাসা চুপচাপ। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো স্বপনের। হঠাৎ ভয় পেয়ে মিতু মিতু বলে ডাকতে শুরু করে দিলো স্বপন। বেডরুমে ঢুকে দেখল মিতু সেখানে নেই। লাইটের সুইচ অন করলো স্বপন। বাথরুম, পাশের রুম, বেলকণি ঘুরে ঘুরে দেখল, কয়েকবার ডাকলো মিতু নাম ধরে কিন্তু কোন সাড়া নেই। বেড রুমে ফিরে এসে বিছানায় বসে পড়লো স্বপন। দুই হাতের তালুতে মুখ লুকাল সে। ভয়ে টেনশনে ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। হাত থেকে মুখ তুলতেই লক্ষ্য করলো এস্ট্রের নিচে চিঠির মতো কি যেন চাপা দেয়া আছে টেবিলের উপর। স্বপন উঠে এসে দেখল হ্যাঁ মিতুর লেখা চিঠি একটা।

চিঠিতে লেখা,

স্বপন, আমরা পছন্দ করে পরিবারের মতের বাইরে গিয়ে সংসার পেতে ছিলাম। সুখে দুখে আমরা সব সময় এক ছিলাম। পাশাপাশি ছিলাম। ভেবেছিলাম জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোমার সঙ্গে পাড়ি দিবো। তা আর হলনা। এই ৮ বছরের সম্পর্কে কোনদিন বুঝিনি তুমি আমার কেউ নও। আজকের পর থেকে শুধুই মনে হচ্ছে তুমি আমার কেউ নও, তুমি আর পাঁচটা মানুষের মতো। তুমি নিশ্চয় জানো একটা সম্পর্ক টিকে থাকে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস আর সম্মান বোধ থেকে। একটা সম্পর্কের আয়ু বেড়ে যায় একে অপরকে বোঝা পড়ার মাধ্যমে। জানিনা কি পাপ করেছিলাম যে আল্লাহ আমাকে এতো বড় শাস্তি দিলেন। হ্যাঁ, শাস্তিই বটে। সম্পর্কে প্রতারণার কোন জায়গা থাকতে পারে না। আমি জানি আমাকে তুমি ঠিক ভালোবাসতে পারোনি। যা তুমি ভালবাসা বলছো তা আমার প্রতি নিছক ইনফাচুয়েসন। পুরনো অভ্যেস। কেন? সেটির উত্তর তুমিই ভালো দিতে পারবে। তুমি আজ আমাকে যে অসম্মান করেছ তার কোন তুলনা হয় না। আয়নার সামনে কোনদিন দাঁড়াতে পারবো এ বিশ্বাস আমার মরে গেছে। তোমার প্রতি রাগ বা ঘৃণা কোনটিই নেই আমার। তুমি আমার কাছে এখন যে কোন পুরুষ। তবু আমি তোমার ভালো চাইবো। তুমি ভালো থেকো। অনেক ভালো থেকো। নিজের যত্ন নিয়ো। শুধু জেন মিতু নামের একটি মেয়ে তোমাকে সত্যি সত্যি ভালোবেসেছিল। তোমাকে খুব খুব চেয়েছিলো। তার দাম সে পায়নি বলে চলে যাচ্ছে। আমাকে খুঁজনা।-মিতু

চিঠিটা পড়ে কাঁদতে কাঁদতে বুকের মাঝে ধরে, ‘মিতু আমাকে মাফ করে দাও, আমাকে ক্ষমা করে দাও’ বলে বিলাপ করতে লাগলো স্বপন। কেমন পাগলের মতো মিতু মিতু বলে ডাকতে লাগলো সে। কিছুক্ষণ পর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে জীবনটাকে অসম্ভব ভারি বলে মনে হতে লাগলো স্বপনের। বিস্তীর্ণ আকাশে জীবনের অসীম অনিশ্চয়তার দিকে তাকিয়ে থাকলো শুধু।      

;

নৃত্য-গীতে জীবন্ত হল রবীন্দ্রনাথ ও ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর কালজয়ী আখ্যান



স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

  • Font increase
  • Font Decrease

বিশ্ব পরিভ্রমণের সময় বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে আর্জেন্টিনায় ল্যাটিন আমেরিকার কালজয়ী সাহিত্যিক, সাহিত্য সমালোচক ও নারীবাদী লেখক ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর ঐতিহাসিক সাক্ষাতের শতবর্ষ এ বছর।

১৯২৪ সালে এই দুই কালজয়ী লেখকের সাক্ষাত অক্ষয় হয়ে আছে দু’জনের জীবনস্মৃতিতে, ব্যক্তিগত চিঠিপত্র আদান-প্রদানে আর ভিক্টোরিয়াকে রবীন্দ্রনাথের ‘পূরবী’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করার মতো বহু ঘটনাবহুল আখ্যানকে ঘিরে। দু’জনের এই মধুর এ আখ্যানকে ঢাকার সাহিত্য ও সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে তুলে ধরলো ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি)।

সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ছায়ানট মিলনায়তনে ‘TAGORE AND VICTORIA OCAMPO-VIJAYA the victorious: 100 years on’ শীর্ষক নৃত্য-গীতে সেই অবিস্মরণীয় আখ্যানকেই ফুটিয়ে তুললেন যুক্তরাজ্য থেকে আগত বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ ও শিল্পী ডা. অনন্ত গুপ্ত এবং তাঁর সহশিল্পীরা।

বক্তব্য রাখছেন ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসা

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার (আইজিসিসি) এর পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী আয়োজনের পরিপ্রেক্ষিত তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানে অতিথি ঢাকায় নিযুক্ত আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত মারসেলো সি. চেসার লাতিন আমেরিকার জনগণের হৃদয়ে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতির কথা তুলে ধরে তাকে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সেতুবন্ধন রচনকারী মহান লেখক হিসেবে বর্ণনা করেন। অনুষ্ঠানে আর্জেন্টিনায় অবস্থানকালে রবীন্দ্রনাথ রচিত বিভিন্ন কালজয়ী গান নৃত্যসহযোগে পরিবেশন করেন শিল্পীরা। একইসঙ্গে সেইসব গানের প্রেক্ষিত তুলে ধরা হয়।

উল্লেখ্য, ১৯২৪ সালে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে দেশটির স্বাধীনতা সংগ্রামের শতবর্ষ উদযাপনে যোগ দিতে গিয়ে তেষট্টি বছর বয়সী রবীন্দ্রনাথ সমুদ্রপথে অসুস্থ হয়ে পড়েন। এসময় তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস আইরেসে থামেন এবং ওঠেন সান ইসিদ্রো শহরের এক হোটেলে। সেখানে কবির ভীষণ অনুরাগী আর্জেন্টিনার বিখ্যাত সাহিত্যিক ও নারীবাদী লেখিকা ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো (যিনি কবির গীতাঞ্জলির ফরাসি অনুবাদ পড়ে তাঁর কবিতার সঙ্গে কবিরও অনুরাগী হয়ে উঠেন)। রবীন্দ্রনাথের আগমনের খবরে ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো ছুটে যান কবির কাছে। তিনি কবিকে সুস্থ করার জন্য হোটেল থেকে নদী তীরে বাগানবাড়িতে নিয়ে আসেন।

অনুষ্ঠান মঞ্চে অতিথিদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন আইজিসিসি পরিচালক ড. মৃন্ময় চক্রবর্তী

এরপর এই দুই লেখকের সম্পর্ক গভীর আত্মিক সম্পর্কে পর্যবসিত হয়। কবি তাঁকে বিজয়া বলে সম্বোধন করতেন। কবির বিভিন্ন গানেও ভিক্টোরিয়ার উপস্থিতি রয়েছে। তাকে উৎসর্গ করেন কাব্যগ্রন্থ ‘পূরবী’। রবীন্দ্রনাথকে চিত্রকর্মে প্রাণিত করেন ওকাম্পো। ব্যবস্থা করেন প্রদর্শনীরও। দুই কালজয়ী সাহিত্যিকের মাঝে যেসব পত্র বিনিময় হয় তা সাহিত্যের চিরকালীন সম্পদে পরিণত হয়েছে।

;

বর্ষবিদায় - বর্ষবরণ

  ‘এসো হে বৈশাখ’



প্রদীপ কুমার দত্ত
মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

মঙ্গল শোভাযাত্রা/ ছবি: নূর এ আলম

  • Font increase
  • Font Decrease

আবারও বছর ঘুরে এসেছে বৈশাখের পয়লা দিন। আমাদের জাতীয় উৎসব নববর্ষ। গত বেশ কয়েক বছর ধরে দেখতে পাই এই উৎসব নিকটবর্তী হলেই মঙ্গল,আনন্দ,আশার প্রতীক দিনটিকে বিতর্কিত করে একে বানচাল করার এক অশুভ প্রচেষ্টা দানা বাঁধানোর উদ্দেশ্যে একশ্রেণির লোক মাঠে নামে। পহেলা বৈশাখ উৎযাপন উপলক্ষে যে উৎসবমুখরতা, তা আমাদের সমাজে গ্রহণযোগ্য নয়,আমাদের কৃষ্টি সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়, এই জাতীয় নানা বিষয়ের অবতারণা করে দিনটিকে বিতর্কিত করার চেষ্টা পরিলক্ষিত হয়।

বিতার্কিকদের মধ্যে কেউ কেউ আবার এর মধ্যে ধর্মাচরণকেও টেনে আনেন। গত বছর তো আইনগত ব্যবস্থা নেয়াও শুরু হয়েছিল। সেই প্রচেষ্টা অবশ্য হালে পানি পায় নি। এবারেও দন্ত-নখর বের করা শুরু করেছিল আমাদের বাংলার আদি সংস্কৃতির বিরোধীরা। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষীয় সরকার ক্ষমতায় থাকায় অংকুরেই সেই চেষ্টা বাধাগ্রস্ত হয়ে থেমে গেছে। অবশ্য সরকার উভয়পক্ষকে খুশি রাখার চেষ্টা করে উৎসব পালনের সময়সীমা সংক্ষিপ্ত করে নির্দেশনা জারি করেছেন। এই রকম আপোষ করে সেই কুৎসিত শক্তিকে প্রশ্রয় দিয়ে মাথায় তোলা হচ্ছে কিনা তা খতিয়ে দেখা সরকারের উপযুক্ত মহলের উচিৎ।

উৎসব পালনের কোনও নির্দিষ্ট ফর্মুলা নেই। সময়ের সাথে সাথে এবং অঞ্চলভেদে বিভিন্ন অনুষঙ্গ ও ধরন পাল্টায়। সংস্কৃতি ও কৃষ্টি গতিশীল। সমাজে গ্রহণযোগ্য এবং শালীনতার মাত্রা অতিক্রম না করা আনন্দে মেতে ওঠার বিভিন্ন কার্যক্রমের সমষ্টিই উৎসব। আদিকাল থেকেই বৈশাখী মেলা, হালখাতা, চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, নীলপূজা, চড়ক, বিভিন্ন প্রকৃতির লোকজ সংস্কৃতির ও খেলাধুলার আয়োজন,সাধ্যমত নতুন পোষাক ও ভালো খাবারের আয়োজন,অতিথি আপ্যায়ন, ইত্যাদি নিয়ে বাঙ্গালীরা পুরাতন বর্ষ বিদায় ও নববর্ষের আগমনকে একটি উৎসবের রূপ দিয়ে আসছে।

কালক্রমে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকে বাংলা সংস্কৃতির উপর পাক সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন কতৃপক্ষের আক্রমণ প্রতিহত করার অংশ হিসাবে ছায়ানট রমনা বটমূলের বর্ষবরণ উৎসব আয়োজন শুরু করে। সেই আয়োজন আজ ডালপালা বিস্তার করে সারা দেশে এমনকি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। ইতিহাস স্বাক্ষী, মৌলবাদের কালো থাবা সেই আয়োজন থামিয়ে দিতে রমনা বটমূলের অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে নিরীহ সংস্কৃতি প্রেমীদের হত্যা করেও সফল হয়নি।২০০১ সালের সেই হামলার পর নিরীহ বাঙ্গালী গর্জে উঠে ২০০২ সালে আরও অধিক সংখ্যায় রমনায় হাজির হয়েছে। দেশের শহর ও গ্রামের দিকে দিকে বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণ অনুষ্ঠান আরও ব্যপ্তি লাভ করেছে।

ঢাকার চারুকলা ইনস্টিটিউট বিগত শতাব্দীর আশির দশকে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই আনন্দ উৎসব পরবর্তীতে মঙ্গল শোভাযাত্রার রূপ ধারণ করে। এই সফল আয়োজন ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর স্বীকৃতি লাভ করেছে। আনন্দ প্রকাশের এই বহিঃপ্রকাশ নিয়ে এক শ্রেণির লোকের প্রচন্ড গাত্রদাহ রয়েছে।ধর্মবিরোধী আখ্যা দিয়ে তারা এই শোভাযাত্রা বন্ধ করতে চায়।দেশের প্রাগ্রসর প্রগতিশীল নাগরিকরা এই জাতীয় অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে চায় না। মঙ্গল শোভাযাত্রা, রমনা বটমূলের অনুষ্ঠান সহ বর্ষবিদায় ও বর্ষবরণের সকল আয়োজন দিন দিন আরও সবল,সতেজ ও পরিশীলিতভাবে অগ্রসর হবেই।

বৈশাখী উৎসবের বিরোধিতাকারী কূপমণ্ডূকদের অনেকের জানাই নেই যে এই উৎসব একই সময়ে দুই একদিন আগে বা পরে বহু জায়গায় বিভিন্ন নামে পালিত হয়। আমাদের নববর্ষ, আসামে বিহু,পাণ্জাবে বৈসাখ,থাইল্যান্ডে সাংক্রান,বার্মায় থিংইয়ান,নেপাল ও সংলগ্ন উত্তর ভারতে বিক্রম সম্ভত,কম্বোডিয়ায় চউল চ্নাম থিমে, সিংহলে আলুথ অনুরুদ্ধা, লাওসে বা পি মেই, কেরালায় ভিষু, তামিলনাড়ুতে পুথান্ডু, এই সব উৎসবই দক্ষিণ /দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার প্রাচীণ কাল থেকে চলে আসা বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ। অনেক এলাকায়,এমনকি আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রামেও ওয়াটার ফেস্টিভ্যাল বা একে অপরের শরীরে পানি ছিটানো এই উৎসবের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ। জল শুচি,পবিত্রতা ও শুভ্রতার প্রতীক। পুরনো বছরের ভুল, অসাফল্য, গ্লাণি সব ধুয়ে নতুন বছর আরও উন্নততর জীবনযাত্রায় এগিয়ে যাওয়ার প্রতীক এই জল ক্রীড়া।

যে সকল অন্ধকারের শক্তি এই বর্ষবিদায়/বর্ষবরণ উৎসবকে হিন্দুয়ানীর সাথে সম্পর্কিত অনুষ্ঠান বলে প্রচার করেন তাদের জ্ঞাতার্থে জানাই যে সনাতনী ধর্মাচার ও সামাজিক আচার কিছু এই সময়ে অবশ্যই থাকে। সেগুলো সবই তাঁরা পালন করেন পণ্জিকা অনুযায়ী। সেই পঞ্জিকার সনাতনী ধর্মের পূজা বা উৎসব সমূহ নির্ধারিত হয় বিক্রম সম্ভত বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী। সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী চন্দ্র/সূর্য/নক্ষত্র এর অবস্থান সমন্বয় করে বিভিন্ন মাস ২৯,৩০,৩১ এমনকি ৩২ দিনেও হয়।

সেই বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পহেলা বৈশাখ বেশির ভাগ বছর ১৫ এপ্রিল তারিখে হয়ে থাকে।লিপ ইয়ার সেই বর্ষপণ্জিতে না থাকার কারনে মোটামুটি চার বছরে একবার এটি ১৪ এপ্রিলে হয়। বাংলাদেশ সরকার বাংলাদেশের জন্য বহু বছর গবেষণার পর বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে নিজস্ব বর্ষপঞ্জি চালু করেছে। সেই বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করে প্রায় বছরই বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায় নববর্ষের দিন (১৪ এপ্রিল) তাঁদের সামাজিক/ধর্মীয় চৈত্র সংক্রান্তির পালনীয় ক্রিয়াকর্ম নিজেদের ঘরে পালন করেন।কিন্তু পহেলা বৈশাখের নববর্ষের সকল উৎসব ও কর্মকাণ্ডে আপামর দেশবাসীর সাথে সানন্দে অংশগ্রহণ করে থাকেন। একই কথা তাঁদের অন্য সকল পূজা পার্বণের বেলায়ও খাটে।


আমাদের পার্বত্য এলাকায় এই নববর্ষ পালন হয় জমকালো আয়োজনের মাধ্যমে। এই অঞ্চলে বহু বাঙ্গালী তো আছেনই। কিন্তু বৃহৎ সংখ্যায় থাকেন ১৪টি বিভিন্ন জাতিসত্ত্বার মানুষ। নৃতাত্ত্বিক,সাংস্কৃতিক,ভাষাগত এবং বিভিন্ন ভাবে তাঁরা সমতলের বাঙ্গালীদের চাইতে তো বটেই, এমনকি একে অপরের চাইতেও আলাদা। এই বিভিন্নতা আমাদের জাতীয় সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এই সৌন্দর্যের নামই বহুল প্রচলিত শব্দবন্ধ ইউনিটি ইন ডাইভার্সিটি বা বৈপরীত্যের মধ্যে ঐক্য।

এখানকার বম,খিয়াং,লুসাই,পাঙ্খোয়া ও খুমিরা বৃহত্তর সংখ্যায় খৃষ্ট ধর্মাবলম্বী। তাঁদের বড় উৎসব বড়দিন(ক্রিসমাস)।বকি সকলের জন্য তিন দিন ব্যাপী বর্ষবিদায় /বর্ষবরণ উৎসবই বছরের সেরা পার্বণ। এই সময় সব পাহাড় মাতোয়ারা হয়ে ওঠে উৎযাপনে।যোগ দেন তাঁদের খৃষ্টান ধর্মাবলম্বী অন্যান্য জাতিসত্ত্বার প্রতিবেশীরা এবং পাহাড়ে থাকা বাঙ্গালীরা। আমোদে অংশ নিতে দেখা যায় সমতল থেকে এই উপলক্ষে ছুটে আসা পর্যটকদেরও।

তাঁদের উৎসব আনন্দ উৎযাপনের মধ্যে অনেক উপাদান। মঙ্গল শোভাযাত্রার আলোকে র‍্যালী হয় সবাইকে নিয়ে।আয়োজনে থাকে প্রশাসন ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। হয় বিচিত্রানুষ্ঠান। খাওয়া দাওয়ার আয়োজন সকলে করেন সাধ্যানুযায়ী উঁচুমানের। তার মধ্যে বিশেষ একটি আয়োজন হল বিভিন্ন তরিতরকারির মিশ্রণে পাঁজন বা লাবড়া। কে কত পদের তরকারি/শাক/ওষধি দিয়ে পাঁজন রেঁধেছেন তার চলে অঘোষিত প্রতিযোগিতা। ক্ষেত্র বিশেষে এই সংখ্যা পণ্চাশ ছাড়িয়ে যায় বলে শুনেছি।


উৎসবমালা শুরু হয় দেবতা ও প্রয়াতঃ পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতে পাহাড়ি ঝরণা বা নদীতে ফুল ও প্রদীপ ভাসিয়ে। নতুন কাপড় পরিধান নতুন বছরের আগমনকে স্বাগত জানানোর প্রতীক।মন্দিরে চলে মহামতি বুদ্ধদেবের আরাধনা আগত বছরে সকলের মঙ্গল কামনায়। অনেক বড় মন্দিরে বহু লোক সমাগম হয় প্রথম দিন রাতে।সারা রাত উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা তৈরিতে সবাই হাত লাগায়। প্রত্যুষে সেই পিঠা দেবতাকে নিবেদন করা হয়। প্রথম দিন বহু মন্দিরের বুদ্ধ মূর্তি বাদ্য সহযোগে আনন্দ মিছিল করে নিয়ে যাওয়া হয় নিকটবর্তী নদীর পানিতে স্নান করানোর জন্য।

পাহাড়ে নববর্ষের সবচাইতে বড় আকর্ষণ সাংগ্রাইং জলক্রীড়ার কথা আগে উল্লিখিত হয়েছে। এছাড়াও থাকে পিঠা তৈরির প্রতিযোগিতা, কুস্তি,তৈলাক্ত বাঁশ বেয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা, ইত্যাদি। সৌহার্দ্য বাড়াতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া,দলবদ্ধ ভাবে পান ভোজনের ব্যবস্থা করাও এই তিন দিনের কার্যক্রমের বিশেষ একটি দিক। চাকমারা বিজু, ত্রিপুরা জনগোষ্ঠী বৈসুক,মারমারা সাংগ্রাইং, ম্রো জনগণ চাক্রান নামে এই উৎসবকে অভিহিত করেন। তণ্চঙ্গাদের কাছে বিষু,অসমীয়া সম্প্রদায়ের কাছে বিহু নামে পরিচিতি এই উৎসবের।

নামে কি বা আসে যায়। যে যেই নামেই জানুক এই উৎসব আমাদের লোকজ সংস্কৃতির একটি প্রাণের উৎসব। বাঙ্গালী ক্ষুদ্রতর নৃগোষ্ঠী নির্বিশেষে সবাই যার যার পছন্দ ও সাধ্য অনুযায়ী উৎসব পালন করবেন এটাই স্বাভাবিক। কারো যদি পছন্দ না হয় তিনি উৎসব পালনে বিরত থাকতেই পারেন। সেটা তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতা। কিন্তু অন্যের উৎযাপনে বাধা সৃষ্টি করার অধিকার কারও নেই।

প্রাচীন কাল থেকে চলে আসা এই নববর্ষের সাথে সাথে হিজরি সাল;চন্দ্র,সূর্য, নক্ষত্র মন্ডলীর অবস্থান;ফসল তোলা;খাজনা পরিশোধ; ইত্যাদি বিষয়ের সমণ্বয় করে জ্যোতির্বিদ ফতেহউল্লাহ্ সিরাজী ও রাজা টোডরমলের কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাদশাহ আকবর চালু করেন আমাদের বর্তমানে চলিত বাংলা বর্ষপঞ্জি। সেই বর্ষপঞ্জির ১৪৩১ সাল সমাগত।

আসুন আমরা ১৪৩০ কে বিদায় জানিয়ে আবাহন করে নেই ১৪৩১কে। দেশবাসী ও বিশ্ববাসী সকলকে জানাই নববর্ষের শুভেচ্ছা ও শুভকামনা। উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ কামনা করি সকলের। কামনা করি ক্ষুধা মুক্ত,বণ্চনা মুক্ত, প্রতারণা মুক্ত, ব্যথা মুক্ত ও যুদ্ধ মুক্ত পৃথিবী। কল্যাণ হোক সকলের।সুখী ও সমৃদ্ধ হোন সবাই।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও পরিব্রাজক

;